শয়নে স্বপনে জাগরণে
গৃহী কি সন্ন্যাসীর মতো সংসারে থাকতে পারে! গৃহী অথচ সন্ন্যাসী! নিশ্চয় পারে। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ তো সেই কারণেই এসেছিলেন। এসেছিলেন গৃহীকে পথ দেখাতে। মানুষ, বিশেষত কলকাতার মানুষ সম্পর্কে তাঁর অদ্ভুত এক করুণা ছিল। শ্রীশ্রীমা সারদাদেবীকে যাওয়ার আগে, আমাদের ছেড়ে মহাপ্রয়াণে যাওয়ার আগে একটি অনুরোধ করেছিলেন : “দেখ, কলকাতার লোকগুলো যেন অন্ধকারে পোকার মতো কিলবিল করছে। তুমি তাদের দেখো।
সংসারের কাম-ক্রোধাদি অন্ধকারে লোক না পোক! মতুয়ার বুদ্ধি নিয়ে মশগুল হয়ে আছে। সকলেই ভাবছে, আমার ঘড়ি ঠিক চলছে। মুলো খেয়ে মুলোর ঢেঁকুর তুলছে। ভাবছে, বেশ আছি। এই তো বেশ। সংসারার্ণবঘোরে লাট খাচ্ছে, শত শত জীব। হাসছে, কাঁদছে। দুঃখ, শোক, জরা, ব্যাধি। আত্মার অবমাননা। অষ্টপাশে বদ্ধ অহঙ্কারের পুঁটুলি। নিত্য ভুলে অনিত্য নিয়ে মাতামাতি। যখন বোঝা গেল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ডাক এসে গেছে। বাঁশ পেকে গেছে। কাঁচা বাঁশই নোয়ানো যায়। পাকা বাঁশ ভেঙে যায় পটাস করে। মাটির হাঁড়ি পুড়ে পাকা হয়ে গেলে নতুন আর কোন আদল দেওয়া যায় না।
ঠাকুরের দৃষ্টি ছিল সবদিকে। সংসারী মানুষকে তিনি কড়া নজরে রেখেছিলেন, ছোট অহঙ্কারের কত রকমের প্রকাশ। মায়া জীবকে নিয়ে কেমন বাঁদরনাচ নাচাচ্ছেন। সেই দর্শনের পরেই অভিযোগ—স্ত্রী-পুত্রের জন্যে লোকে ‘একঘটি কাঁদে”। অথচ দারা-পুত্র-পরিবার, কেউ নয়, কে তোমার! প্রেয়সী! কে তোমার প্রেয়সী বাপু! মরে দেখ। ভূতের যদি জ্ঞানচক্ষু থাকে, তাহলে সে দেখতে পাবে, “সেই প্রেয়সী দেবে ছড়া, অমঙ্গল হবে বলে।” বড় ছেলে গয়ায় গিয়ে পিণ্ডি দিয়ে আসবে, বাবার ভূত ঘাড় না মটকায়। সেই স্ত্রী-পুত্রের জন্যে ঘটি ঘটি অশ্রুবিসর্জন। দ্বিতীয় কান্নার বস্তু হলো টাকা। টাকার জন্যে লোকে “কেঁদে ভাসিয়ে দেয়”। যেন টাকাই জীবন। টাকায় মরণ-বাঁচন। পৃথিবীতে এলে কেন? না, টাকা কামাতে। ঠাকুরের প্রশ্নঃ “টাকায় কি হয় বাপু?” নিজেই উত্তর দিচ্ছেন, জ্ঞানচক্ষু খুলে দিচ্ছেন : “টাকায় কি হয়? ভাত হয়, ডাল হয়, কাপড় হয়, থাকবার জায়গা হয়—এই পর্যন্ত। ভগবানলাভ হয় না। তাই টাকা জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না-এর নাম বিচার, বুঝেছ?”
বিষ্ঠাকে ঘৃণা করে মানুষ বললে : “তুই নীচ, অস্পৃশ্য, ঘৃণ্য, দুর্গন্ধী আবর্জনা!”
বিষ্ঠা বললে : “প্রভু! তুমি যে আমার চেয়েও নীচ, নীচতম। তোমার সংস্পর্শেই আমার এই অবস্থা। আমি তো দুর্মূল্য, স্বাদু খাদ্যবস্তু ছিলুম। তোমার সংসর্গেই আমার এই হাল!” টাকায় আর বিষ্ঠায় তফাত কোথায়? যে-টাকা ঈশ্বরসেবায় ব্যয়িত হয় না, নিজের ভোগেই লাগে, সে অর্থ বর্জ্য-পদার্থের মতোই ঘৃণ্য। সঙ্গদোষে ব্রাত্য।
ঠাকুর বলছেন : “বিচার করা খুব দরকার। কামিনী-কাঞ্চন অনিত্য ঈশ্বরই একমাত্র বস্তু। বস্তুবিচার! এই দেখ, টাকাতেই বা কি আছে, আর সুন্দর দেহেই বা কি আছে! বিচার কর, সুন্দরীর দেহেতেও কেবল হাড়, মাংস, চর্বি, মল, মূত্র—এইসব আছে। এইসব বস্তুতে মানুষ ঈশ্বরকে ছেড়ে কেন মন দেয়? কেন ঈশ্বরকে ভুলে যায়?”
তুলসীদাস আরো কড়া ভাষায় সাবধান করছেন :
“দিনকা মোহিনী, রাতকা বাঘিনী,
পলক পলক লহু চোষে।
দুনিয়া সব বাউরা হোকে,
ঘর ঘর বাঘিনী পোষে।।”
—দিনে যে মোহিনী, রাতে সেই বাঘিনী। মুহুর্মুহু রক্ত শোষণ করে। আর জগতের লোক কি করছে, উন্মত্ত হয়ে গৃহে গৃহে সেই বাঘিনীকে প্ৰতিপালন করছে।
মহিলারা হয়তো দুঃখ পাবেন। ভাববেন তাঁদের বুঝি ছোট করা হলো। তা নয়, এ হলো সাধনের কথা।[১] সাধন-জগতের কথা। নারীরাও জানেন তাঁদের কি সাঙ্ঘাতিক মোহিনীশক্তি। সংসারে যাঁরা মজে থাকতে চান, তাঁরা থাকুন না। কে বারণ করছে। ঠাকুরের সান্নিধ্যে এমন মানুষও এসেছিলেন, যিনি বন্ধুকে বলছেন, তুমি তাহলে এই ব্যাড়োর-ব্যাড়োর শোন, আমার একটু কাজ আছে, ইম্পর্টান্ট বিজনেস, আমি যাই। এমন মানুষ দেখলেই ঠাকুর চিনতে পারতেন, আর বলতেন : “যাও যাও, রাসমণির বিল্ডিং-টিল্ডিং দেখ, বাগান দেখ।” আর যাকে দেখে মনে হতো অন্বেষণ জেগেছে, তাকে কাছে ডেকে নিতেন। ঠাকুর তুলসীদাসের মতোই জানতেন—
“ওছে নরকি পেটমে, রহে ন কোটি বাৎ।
আধ সের পাত্র মে, কৈসে সের সমাৎ।।“
—যে-ভাঁড়ে আধসের মাত্র ধরে, সে-ভাঁড়ে কদাচিৎ একসের ঢালা উচিত নয়, সেইরকম সামান্য অর্থাৎ বিষয়ী মানুষের উদরে ভাবভারপূর্ণ বাক্য কখনোই স্থান পায় না।
[১. রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভাব-অনুসারে ‘কামিনী’ অর্থে ‘কাম’কে বুঝতে হবে, ‘নারী’কে নয়।–সম্পাদক]
অপাত্রে দান পণ্ডশ্রম। সব মহাপুরুষেরই এক বাণী; কারণ, সত্য এক, ঈশ্বর এক। জেন বৌদ্ধধর্মের মহাপুরুষদেরও একই শিক্ষা—আরেকটু বিস্তারিত। গল্পাকারে। যেমন—
এক অহঙ্কারী জেনারেল এসেছেন মঠাধ্যক্ষের কাছে। কোমর থেকে খাপসুদ্ধ তরোয়াল খুলে তাঁর টেবিলের ওপর ঠকাস করে রেখে চালিয়াতের মতো বললেন : “শুনলুম মানুষকে খুব জ্ঞান-ট্যান দিচ্ছেন। সেই জ্ঞানে সব জীবনধারা বদলে যাচ্ছে, মানুষ শান্তি পাচ্ছে। তা দেখি, সেটা জ্ঞান না অজ্ঞান। আমাকে একটু ছাড়ুন তো।”
বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এই চ্যাটাং চ্যাটাং কথায় সামান্যতম উষ্ণ হলেন না।
তিনি বললেন : “আপনি আমার অতিথি, দূর থেকে আসছেন, আগে এক কাপ চা খান”–এই বলে তিনি এক কাপ ভর্তি চা আনলেন। হাতে একটি কেটলি। ভর্তি কাপ জেনারেলের সামনে রেখে, সেই কাপেই কেটলি থেকে হুড় হুড় করে চা ঢালতে লাগলেন। কাপ উপচে চা পড়ল প্লেটে, প্লেট উপচে টেবিলে, টেবিল থেকে গড়িয়ে মেঝেতে!
জেনারেল তাঁর কাণ্ড দেখে বললেন : “করছেন কি? আপনি পাগল? ভর্তি কাপে চা ধরে?” সন্ন্যাসী হেসে বললেন : “আমি ঐ কথাই বলতে চাইছি তো! কাম এম্পটি। খালি কাপ হয়ে আসুন, তবেই তো আমি জ্ঞানের চা ঢালতে পারব। ইউ আর ফুল। অহঙ্কারে টইটম্বুর!”
তুলসীদাসজী বলছেন :
“জঁহা রাম তহাঁ কাম নহী, জঁহা কাম তহাঁ নহী রাম।
দুহু মিলত নহী রব রজনী নহী মিলত একঠাম।।”
—যেখানে কাম সেখানে রাম নেই, যেখানে রাম সেখানে কাম নেই। রাম আর কাম এক জায়গায় থাকতে পারে না, যেমন দিন আর রাত। আলো থাকলে অন্ধকার থাকে না, অন্ধকার থাকলে আলো।
এত কথা এল এই কারণে, সংসার-মায়ায় যাঁরা মজে থাকতে চান থাকুন। তুলসীদাস এক কথায় ঠাণ্ডা করে দিয়েছেন :
“শাকট সুকুট কুকুরা, তিনকে মত এক।
কোটি ভাঁতি সমঝাও, তৌ ন ছোড়ে টেক্।।”
–-পাষণ্ড, শূকর, কুক্কুট—এই তিনের মত এক। কোটি কোটি সদুপদেশ নম্র প্রিয়বাক্য যতই বর্ষণ কর, কিছুতেই নিজের জেদ ছাড়বে না?
কিন্তু যাঁরা তাঁকে চান, ঠাকুরকে চান, তাঁদের প্রথম প্রয়োজন চিত্তশুদ্ধির। ঠাকুর স্পষ্ট করে বললেন : “চিত্তশুদ্ধি না হলে হয় না। কামিনী-কাঞ্চনে মন মলিন হয়ে আছে, মনে ময়লা পড়ে আছে। ছুঁচ কাদা দিয়ে ঢাকা থাকলে আর চুম্বক টানে না। মাটি কাদা ধুয়ে ফেললে তখন চুম্বক টানে। মনের ময়লা তেমনি চোখের জলে ধুয়ে ফেলা যায়।”
দেহশুদ্ধি আর চিত্তশুদ্ধি, দুটি বড় কথা। দেহশুদ্ধির জন্য প্রয়োজন ব্রহ্মচর্যের, আর চিত্তশুদ্ধির জন্যে প্রয়োজন নির্মল চিন্তার। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে হয়, “ঠাকুর, কৃপা করে জ্ঞানের আলো তোমার নিজের ওপর একবার ধর, আমি তোমায় দর্শন করি।”
কি সন্ন্যাসী, কি গৃহী—পথ তো সেই এক ‘রয়্যাল রোড’। দেহ আর মনে বিশুদ্ধ হও। আর কি? মনে, বনে, কোণে। কারোকে দেখাবার প্রয়োজন নেই, হাঁক-ডাক করার প্রয়োজন নেই, তুমি আছ, “তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম। ‘ আর কি? আবার তুলসীদাসজীকে স্মরণ করি
“এক ঘড়ি আধি ঘড়ি, আধি হুমে আধ
তুলসী সঙ্গত সন্তকি, হরে কোটি অপরাধ।।”
–-এক ঘণ্টা, আধ ঘণ্টা, এমনকি আধেরও আধ ঘণ্টা যদি সাধুসঙ্গ করা যায়, তাহলে সেই সাধুসঙ্গ কোটি অপরাধ হরণ করে।
ঠাকুর বলছেন : “দেখ! ঈশ্বরকে দেখা যায়। ‘অবাঙ্মনসগোচরম্’ বেদে বলেছে। এর মানে বিষয়াসক্ত মনের অগোচর। বৈষ্ণবচরণ বলত, তিনি শুদ্ধ মন, শুদ্ধ বুদ্ধির গোচর। তাই সাধুসঙ্গ, প্রার্থনা, গুরুর উপদেশ—এইসব প্রয়োজন। তবে চিত্তশুদ্ধি হয়। তবে তাঁর দর্শন হয়। ঘোলা জলে নির্মলি ফেললে পরিষ্কার হয়, তখন মুখ দেখা যায়। ময়লা আর্শিতেও মুখ দেখা যায় না।“
স্বামীজী বলছেন : “তীর্থে বা মন্দিরে গেলে, তিলক ধারণ করিলে অথবা বস্ত্রবিশেষ পরিলে ধর্ম হয় না। তুমি গায়ে চিত্রবিচিত্র করিয়া চিতাবাঘটি সাজিয়া বসিয়া থাকিতে পার, কিন্তু যতদিন পর্যন্ত না তোমার হৃদয় খুলিতেছে, যতদিন পর্যন্ত না ভগবানকে উপলব্ধি করিতেছ, ততদিন সব বৃথা। হৃদয় যদি রাঙিয়া যায়, তবে আর বাহিরের রঙের আবশ্যক নাই। ধর্ম অনুভব করিলে তবেই কাজ হইবে।” স্বামীজী বলছেন : “যদি দেহমন শুদ্ধ না হয় তবে মন্দিরে গিয়া শিবপূজা করা বৃথা।”
তুলসীদাস বলছেন :
“তুলসী পিঁদনে হরি মেলেতো,
মেয় পেঁদে কুঁদা আউর ঝাড়।
পাখর পূজনে হর মেলেতো
ময় পূজে পাহাড়।।”
—তুলসীর মালা গলায় ধারণ করলেই সাক্ষাৎ হরিদর্শন! তাহলে আমি তুলসীগাছের একটা মোটা গুঁড়ি গলায় ঝুলিয়ে বসে থাকি। আর পাথর কেন, গোটা একটা পাহাড় পূজা করি—শিলার বদলে পর্বত।
ঠাকুর বলছেন, ওহে! ঘাবড়াও মাত! গৃহীও পাবে, অবশ্যই পাবে। যদি ইচ্ছা থাকে। প্রবল ইচ্ছা। ‘তিন টান’ এক করতে হবে। মনই সব জানবে। জ্ঞানই বল আর অজ্ঞানই বল, সবই মনের অবস্থা। মানুষ মনেই বদ্ধ ও মনেই মুক্ত, মনেই সাধু এবং মনেই অসাধু। মনেই পাপী ও মনেই পুণ্যবান। সংসারী জীব মনেতে সর্বদা ভগবানকে স্মরণ-মনন করতে পারলে তাদের আর অন্য কোন সাধনের দরকার হয় না।
মনই সব। ঠাকুর বলছেন, মন আর মুখ এক কর। তিনি মন দেখেন। তুলসীদাসের কি সুন্দর দর্শন! একেবারে ঠাকুর!
তুলসীদাসজী বলছেন :
“রাম ঝরোখে বয়েঠ কর, সবকো মুজরা লে
জ্যায়সা যাকে চাকরি, অ্যায়সা উকো দে।।”
—ভগবান শ্রীরাম জগদরূপ গৃহের উচ্চ বাতায়নে বসে আছেন। দেখছেন জগতের লোক কে কি করছে! অহর্নিশ দেখছেন। আর কি করছেন? যার যেমন কাজ তাকে সেইরকম পুরস্কার দিচ্ছেন।
ঠাকুর বলছেন, সংসারে আছ। থাক। প্রারব্ধ তোমার ক্ষয় কর। মনে রেখো, “নিষ্কাম কর্ম করতে পারলে ঈশ্বরে ভালবাসা হয়; ক্রমে তাঁর কৃপায় তাঁকে পাওয়া যায়। ঈশ্বরকে দেখা যায়, তাঁর সঙ্গে কথা কওয়া যায়, যেমন আমি তোমার সঙ্গে কথা কচ্ছি!”