শয়তানি-জুয়া
ক
বিলাতে গ্লেমিস ক্যাসেল নামে এক প্রসিদ্ধ সেকেলে দুর্গ-প্রাসাদ আছে। স্ট্রার্থমোরের আর্লরা এই প্রাসাদে বাস করেন। তোমরা সকলেই জানো বোধ হয়, এদেশে রাজা-মহারাজার মতন ‘আর্ল’ হচ্ছে একরকম বিলাতি উপাধি! স্ট্রার্থমোরের আর্লদের বংশ হচ্ছে খুব প্রাচীন বংশ। সে বংশের অর্থ, সম্মান ও যশ কিছুরই অভাব নেই। গ্লেমিস ক্যাসেলেরও নাম-ডাক খুব, বিলাতি ইতিহাসেও তার কথা পাওয়া যায়।
গ্লেমিস ক্যাসেলের গুপ্তগৃহের কথা কোনো বাইরের লোক জানে না। কিন্তু প্রত্যেক আর্লই সাবালক হলে সেই গুপ্তকথা জানতে বাধ্য। লোকে বলে, সেই গুপ্তকথা এমন ভয়ানক যে, তা একবার শুনলে পর এ জীবনে কেউ আর ভুলতে পারে না। কী যে সেই ভূতুড়ে গুপ্তকথা তা আবিষ্কার করবার জন্যে অনেকেই অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে।
গুপ্তকথার রহস্য না-হয় নাইই জানা গেল। কিন্তু সাহেবরা বলে, ‘গ্লেমিস হচ্ছে ভূত-প্রেতদের মস্ত আড্ডা এবং সে-সম্বন্ধে এক-আধটা নয়, শত শত গল্প আছে। সব গল্প বলবার জায়গা এখানে নেই। তবে একটা গল্প বলতে পারি। তোমরা কান পেতে শোনো।
দুই
দ্বিতীয় জেমস তখন ইংল্যান্ডের রাজা। ১৬৮৫ থেকে ১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ইংল্যান্ডকে শাসন করেছিলেন।
গ্লেমিসে তখন আর্ল অফ ক্রুফোর্ডের প্রভুত্ব। লোকে তাঁকে ‘দেড়ে-রাজা’ ও ‘বাঘা-রাজা’ বলে ডাকত! শেষ নামটা শুনেই বুঝতে পারছ বোধ হয় যে, লোকটির স্বভাব ছিল কীরকম।
বাঘা-রাজার একটা বিশ্রী বদ-অভ্যাস ছিল, জুয়াখেলা। তিনি তাসের জুয়াখেলা না খেলে থাকতে পারতেন না। অন্য কোনো খেলুড়ে না জুটলে চাকরবাকরদের ডেকে আনিয়ে জুয়া খেলতেও তিনি লজ্জা পেতেন না!
নভেম্বর মাসের এক অন্ধকার রবিবার রাত্রে বাঘা-রাজার মাথায় হঠাৎ খেয়াল চাপল, আজ জুয়া খেলতেই হবে! কিন্তু রবিবার যে বিশ্রামের দিন, ধার্মিক খ্রিশ্চানদের পক্ষে সেদিন যে জুয়াখেলা মহাপাপ, সেটা তিনি একবারও ভেবেও দেখলেন না। আর ভাববেনই বা কেন, বাঘা-রাজা তো ধার্মিক ছিলেন না!
কিন্তু খেলুড়ে কই? বাঘা-রাজা চাকরদের ডাক দিলেন। কিন্তু তাঁর হুকুম শুনে তারা চোখ কপালে তুলে বললে, ‘ওরে বাপরে, রবিবারে জুয়াখেলা! প্রাণ গেলেও আমরা ও মহাপাপ করতে পারব না!’
রেগে তিনটে হয়ে বাঘা-রাজা বললেন, ‘মহাপাপ? বহুৎ আচ্ছা! আজ যদি শয়তানও এসে হাজির হয়, তবে তার সঙ্গেও আমি জুয়া খেলব!’—এই বলে তিনি তাঁর ঘরে ঢুকে গুম হয়ে বসে রইলেন।
শয়তানের কান বড়ো তীক্ষ্ণ। বাঘা-রাজার কথা সে শুনতে পেলে। অন্ধকার ঘুটঘুটে রাত। সারা দুনিয়া ভয়ে চুপ মেরে আছে। নিজের ঘরে জেগে বসে আছেন খালি বাঘা-রাজা। বাহির থেকে দরজায় কে ধাক্কা মারলে।
বাঘা-রাজা গর্জে উঠলেন, ‘কে?’
সাড়া এল, ‘আমি খেলুড়ে। আপনি কি আমাদের সঙ্গে জুয়া খেলতে চান?’
বাঘা-রাজা বললেন, ‘তুমি যে-হও, সে-হও! চলে এসো ভেতরে! তোমার সঙ্গে আমি জুয়া খেলব!’
ঘরের ভিতরে অমনি এক অদ্ভুত মূর্তির আবির্ভাব! খুব লম্বা ছিপছিপে চেহারা, তীক্ষ্ণ জ্বলন্ত চোখ, ছুঁচালো দাড়ি, গায়ে মিশকালো পোশাক। তার মুখের দিকে তাকালে বুক ঢিপ ঢিপ করে ওঠে!
বাঘা-রাজা শুধোলেন, ‘কে তুমি?’
সেলাম ঠুকে মূর্তি বললে, ‘খেলুড়ে।’
‘কেয়াবাত, কেয়াবাত! এসো, তবে খেলা শুরু করি!’
খেলা চলল, পৃথিবীতে জনপ্রাণীর সাড়া নেই—নিঝুম রাত ঝিম-ঝিম করে কাঁদছে!
তিন
খেলা বেশ জমে উঠল।
কিন্তু বাঘা-রাজা প্রতিবারই হেরে যাচ্ছেন। তিনি বুঝলেন, এই আকাশ থেকে খসে-পড়া খেলুড়েটি বড়ো যে-সে খেলোয়াড় নয়। যত হারছেন, তাঁর রোখ ততই বেড়ে উঠছে।
খেলুড়ের চোখ দুটো মাঝে মাঝে জ্বল-জ্বল করে ওঠে, আর মাঝে মাঝে তার ঠোঁটে একটুখানি হাসির বিদ্যুৎ খেলে যায়!…সাপের হাসি কেউ দেখিনি, কিন্তু সাপ যদি হাসত, তাহলে সে বোধ হয় এমনি হাসিই হাসত!
কিন্তু বাঘা-রাজার ভয়-ডর কিছু নেই, এত হেরেও তিনি একটুও দমলেন না। দেখতে দেখতে হেরে হেরে তাঁর হাতের টাকা ফুরিয়ে গেল।
বাঘা-রাজা মনে মনে মানলেন, হুঁ লোকটা ওস্তাদ খেলোয়াড় বটে! হারি আর জিতি, এর সঙ্গে খেলেও সুখ!
খেলুড়ে গম্ভীর আওয়াজে বললে, ‘কী রাজা, এখনও কি খেলার শখ আছে?’
‘আলবাত!’
‘কিন্তু টাকা কই?’
একখানা দাসখত লিখে বাঘা-রাজা বললেন, ‘এবারে এই দাসখত বাজি ধরলুম!’
‘কী দাসখত?’
‘আমি যদি হারি, চিরকাল তোমার গোলাম হয়ে থাকব!’
‘মৃত্যুর পরেও?’
‘মৃত্যুর পরেও।’
খেলুড়ে হাসতে লাগল হা-হা-হা-হা-হা-হা-হা! তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে টেবিলের ওপরে ঝুঁকে পড়ে গম্ভীরভাবে বললে, ‘এসো, তবে খেলা যাক!’
স্তব্ধ কালো রাতের বুকের ভিতর গিয়ে সেই ভীষণ হা-হা-হা-হা হাস্য একটা অমানুষী হাহাকারের মতন বেজে উঠল।
কিন্তু বাঘা-রাজার খেয়াল নেই—খেলার নেশায় তিনি তখন পাগল, তাঁকে যেন দানোয় পেয়েছে!
চার
দুর্গের সমস্ত লোক জেগে উঠেছে! ঘুম যেন সেখান থেকে ভয় পেয়ে চম্পট দিয়েছে। ওপরে ও কে হাসছে? ও কি মানুষের হাসি? সকলে কান পেতে শুনতে লাগল।
একজন বললে, ‘বাঘা-রাজা জুয়া খেলচেন!’
আর একজন সভয়ে বললে, ‘আজ রবিবার! বিশ্রামের দিন এ কী অমঙ্গুলে ব্যাপার!’
আর একজন বললে, ‘কিন্তু খেলুড়ে এল কোথা থেকে?’
আর সবাই বললে, ‘তাই তো, কী আশ্চয্যি ব্যাপার! আমরা কেউ গেলুম না, দুর্গের সমস্ত দ্বার বন্ধ, বাইরে এক ভূতের মতন কালো রাত খাই-খাই করচে, তবে খেলুড়ে এল কখন, কেমন করে?’
ওপরের ঘরে থেকে আকাশ ফাটানো চিৎকার জেগে উঠল! খেলা বুঝি পুরোদমে চলছে! আবার হা-হা-হা-হা অট্টহাসি আর সঙ্গে-সঙ্গে বাঘা-রাজার গর্জন! একজন সাহসী লোক উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘যাই, উঁকি মেরে ব্যাপারটা কী দেখে আসি!’
আর সবাই বললে, ‘যেও না, যেও না, অমন কাজও কোরো না! বাঘা-রাজা আজ শয়তানকে ডেকেছিল।’
কিন্তু সে কারুর মানা মানলে না। পা টিপে-টিপে ওপরে গিয়ে উঠল। অট্টহাস্যে ও ভীষণ গর্জনে তখনও চারিদিক কেঁপে-কেঁপে উঠছে। ঘরের দরজার ছোট্ট এক ফাঁকে চোখ রেখে সে দেখতে লাগল।
ঘরের ভিতরে খেলুড়ে হঠাৎ একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে, হাতের তাস ছুড়ে ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে বললে, ‘চুলোয় যাক ও চোখটা!’
একটা তীব্র বিদ্যুৎ শিখা চমকে উঠে দরজার ফাঁকের দিকে ছিটকে পড়ল এবং সঙ্গে-সঙ্গে লুকিয়ে যে উঁকি মারছিল, চোখে হাত-চাপা দিয়ে মাটির ওপরে লুটোপুটি খেতে খেতে যন্ত্রণায় সে আর্তনাদ করে উঠল, ‘চোখ গেল, আমার চোখ গেল!’
বাঘা-রাজা তাড়াতাড়ি বাইরে ছুটে এসে বললেন, ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল!’
কিন্তু ঘরের ভিতরে ফিরে গিয়ে তিনি আর খেলুড়েকে খুঁজে পেলেন না। শেষ-বাজি জিতে সে অদৃশ্য হয়েছে—কিন্তু কোথায়?
বাঘা-রাজা সভয়ে দেখলেন, যাওয়ার সময়ে সে দাসখতখানাও নিয়ে গিয়েছে।
পাঁচ
এই ঘটনার পাঁচ বছর পরে বাঘা-রাজার মৃত্যু হল। কিন্তু তারপর থেকে প্রতি রবিবার রাত্রে বাঘা-রাজার ঘরে যে কাণ্ডটা হতে লাগল, তা আর বলবার নয়! হা-হা-হা-হা অট্টহাস্য, ভয়ানক গর্জন, দুপদাপ শব্দ—ঘরের ভিতরে যেন পুরোদমে সেই সাংঘাতিক জুয়াখেলা চলেছে।… দুর্গে মানুষের আর তিষ্ঠানো দায়।…শেষটা পাঁচিল তুলে বাঘা-রাজার সমস্ত দরজা-জানলা বন্ধ করে দেওয়া হল।
লোকে বলে বন্ধ ঘরের অন্ধকারে বসে এখনও প্রতি রাত্রে বাঘা-রাজা ও তাঁর সেই অমানুষ খেলুড়ে জুয়াখেলা খেলে—সৃষ্টির শেষ দিন না এলে খেলা আর বন্ধ হবে না।
—