আটাত্তর
দু’শ’ চল্লিশ সেকেণ্ড!
দু’শ’ বিশ!
দু’শ’!
এক শ’ আশি!
উড়ে চলেছে যেন সময়, যখন প্রতিটি সেকেণ্ডই সোনার চেয়েও দামি।
রক্তাক্ত, আধো-অচেতন কোহেনের গুরুভার নিয়ে ছুটছে রানা। ওর কাঁধের উপর নেতিয়ে পড়ে রয়েছে ফিল কোহেন।
ওদের পিছনে, হার্ডির বাহু নিজের ঘাড়ে নিয়েছে ফুলজেন্স। সহযোদ্ধার শরীরের অর্ধেক ভার ওর উপর। খানিকটা বয়ে, খানিকটা টেনে-হিঁচড়ে — আপ্রাণ প্রচেষ্টায় এগোচ্ছে ও প্যাসেজওয়ে ধরে।
উপরে ওঠার সিঁড়িতে দুপদাপ পা ফেলে, হোঁচট খেতে খেতে হ্যাচওয়ে ধরে ছুটল ওরা নির্ধারিত সময়ের আগেই আপার ডেকে পৌঁছুনোর জন্য।
পসাইডনের ছুটন্ত, আতঙ্কিত কর্মচারীদের পদশব্দের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। নিজেদের অস্ত্রে নিজেরাই দুনিয়া ছাড়তে চলেছে, দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছে খবরটা। যে যেভাবে পারে, জাহাজ ত্যাগের জন্য মরিয়া।
গভীর একটা কাঁপুনি উঠে এল যেন বিশাল জলযানের অন্তস্তল মন্থন করে। মিটমিট করতে করতে নিভু নিভু হয়ে এল বাতিগুলো। পৃথিবীতে এসে নামছে যেন কোনও এলিয়েন-শিপ।
ছোটা বন্ধ করল না রানা। দৃঢ় সঙ্কল্পে দাঁত পিষছে দাঁতে।
এক শ’ সেকেণ্ড!
‘কাম অন, ফ্রেণ্ডস!’ চেঁচাল ও পিছনের উদ্দেশে। ‘থেমো না, বন্ধুরা!’
শেষ হ্যাচওয়ে থেকে দিনের আলোতে বেরিয়ে আসতেই ধোঁয়ার গন্ধ মেশানো বাতাস আর উজ্জ্বল রোদ চুম্বন করল চারজনের শরীরে।
সুবোধ বালকের মত শান্ত হয়ে রয়েছে সাগর। সুনীল আকাশে কলঙ্ক বলতে শুধু ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা ডেক থেকে ওঠা ধোঁয়ার ফালি।
সামনে, কার্গো কনটেইনার-সারির ফাঁকগুলোতে দিশেহারা মানুষজনের ছুটোছুটি। প্রাণের ভয় সবারই রয়েছে। লাইফবোট নামানোর চেষ্টা করছে কেউ কেউ। অন্যরা হাচড়ে-পাছড়ে রেইলে উঠে আগপিছ না ভেবেই ঝাঁপ দিচ্ছে সাগরে। অত উপর থেকে পতনটা যে মারাত্মক হতে পারে, প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় সেটা।
পিটপিট করে ঘাম ঝরাল রানা চোখের পাতা থেকে। নিচে নোঙর করা ইনফ্লেটেবল বোটে নেমে যাওয়া ল্যাডারটার কথা ভাবল।
আশি সেকেণ্ড!
নাহ, পৌঁছুতে পারবে না নৌকায়!
ষাট!
‘হেলিকপ্টার!’ বাঘের মত গর্জন ছাড়ল ও।
ডেকের উপর দিয়ে স্বল্প দৌড়ের দূরত্বে হেলিপ্যাড। রানা ভাবছে, যথাসময়ে কি ওড়াতে পারবে চপারটাকে?
জানা নেই কারও। কিন্তু এটাই ওদের বাঁচার একমাত্র সম্ভাব্য উপায়।
দৌড়াতে শুরু করল রানা। ভারি ওজনের জন্য প্রচণ্ড চাপ পড়ছে দুই পায়ের কোয়াড্রিসেপের উপর। হার্ডি আর ফুলজেন্সেরও যে ছেড়ে-দে-মা-কেঁদে-বাঁচি অবস্থা, বুঝতে পারছে ওদের নাকমুখের ঘোঁত ঘোঁত শব্দ শুনে।
পঞ্চান্ন সেকেণ্ড!
হেলিপ্যাডে পৌঁছে জোরসে টান মেরে খুলল রানা এয়ারক্রাফটের সাইড হ্যাচ। পাঁজাকোলা করে কোহেনকে পিছনে তুলতে গিয়ে গোঙানি বেরিয়ে এল নিজের মুখ দিয়েই। ঘুরে দাঁড়িয়ে, পাইলটের আসনের দিকে দৌড়ে এসে ঝটিতি উঠে বসল কন্ট্রোলের পিছনে।
এরই মধ্যে চপারে উঠেছে বাকি দু’জনও।
পঁয়তাল্লিশ সেকেণ্ড!
‘ওড়াও, ওস্তাদ! ওড়াও ফড়িংটাকে!’ আহত ফরাসির কড়কড়ে কণ্ঠস্বর কানে এল রানার। ‘ওঠ, শালা হেলিকপ্টারের বাচ্চা!’
চোখ বোলাচ্ছে রানা আধা-পরিচিত ককপিট লে- আউটে।
‘পারবি, রানা!’ বলল ও নিজেকে, ‘পারবি তুই এটাকে ওড়াতে!’
চল্লিশ সেকেণ্ড!
টারবাইন সচল করল ও সুইচ চেপে।
প্রাণের সঞ্চার হয়েছে রোটরে। বিরক্তিকর ধীর গতিতে ঘুরতে শুরু করল প্রথমে, তার পর স্পিড বেড়ে চলল ক্রমশ। যতক্ষণ না ককপিটের উপর অর্ধস্বচ্ছ চক্র তৈরি করল রোটরব্লেডগুলো, বেড়েই চলল ঘূর্ণনের গতি। ইঞ্জিনের আওয়াজ বাড়তে বাড়তে রূপ নিয়েছে রীতিমত গর্জনে।
ওঠো! ওঠো! অনবরত চিৎকার চলছে রানার মগজে।
এগারো সেকেণ্ড!
দশ!
এয়ারক্রাফটটা ভাসতে শুরু করতেই ভারবদল করতে লাগল স্কিড দুটো।
নয় সেকেণ্ড!
আট!
‘উড়াল দে, ‘কপ্টারের ছাও!’ আরও একবার খিস্তি ঝাড়ল ফুলজেন্স।
ভিডিয়ো-গেমারদের মত টানাটানি শুরু করল রানা কন্ট্রোলে।
এমনভাবে শূন্যে উঁচু হলো চপার, মায়া কাটাতে পারছে না যেন অনেক দিনের বান্ধবী এই জাহাজটার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠল আরও কয়েক ফুট।
ছয় সেকেণ্ড!
পাঁচ!
হেলিপ্যাডের সমস্ত আকর্ষণ ছিন্ন করে উঠে যাচ্ছে এখন হেলিকপ্টার। যেন বিপদটা টের পেয়েছে এতক্ষণে! পাশেই পসাইডনের সুপারস্ট্রাকচারকে মনে হচ্ছে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিঙের মত। উঠছে… উঠছে… পারল ওরা অবশেষে!
তক্ষুণি শব্দহীন বিস্ফোরণে তোলপাড় শুরু হলো যেন জলযানটায়। অকল্পনীয় উন্মত্ততায় আচমকা আঘাত হানল যেন অদৃশ্য কোনও টাইফুন।
এমনভাবে দুমড়ে-মুচড়ে গেল গোটা জাহাজ, ঠিক যেন
প্লাসটিকের খেলনা। চুরমার হলো প্রতিটা অক্ষত জানালা। চোখের নিমেষে ভেঙে, ছিঁড়ে, ডিগবাজি খেয়ে শূন্যে পাখা মেলল রেইলিং, কেইবল, ওয়াকওয়ে, মাস্তুল, কনটেইনার। তারপর দুই টুকরো হয়ে গেল এত বড় জাহাজটা। পিছনদিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতেই আকাশে নাক তুলল পসাইডনের সামনের অংশ। হাজার হাজার টনী কার্গোগুলো ধপাধপ্ আছড়ে পড়তে লাগল ডেকের উপর
উন্মাতাল হয়ে উঠেছে জাহাজের চারপাশের সমুদ্র। বহু দূর পর্যন্ত ছিটকে উঠছে ফেনা আর ফোয়ারা। উড়ন্ত জঞ্জালের দূষণ আকাশ-বাতাস জুড়ে।
ইস্পাতের একটা কেইবল যে কখন রোটরব্লেডে জড়িয়ে গেল, টেরও পেল না রানা। যথেষ্ট উঁচুতে ওঠার পর সরে পড়তে যাচ্ছে ডেকের উপর থেকে, ঠিক সেই সময়ই ঘটল এই সর্বনাশটা।
তীক্ষ্ণ মড়মড় শ্রুতিকটু আওয়াজের সঙ্গে গতিপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে চক্রাকারে ঘুরতে লাগল হেলিকপ্টার।
সামাল দেয়ার সাধ্য হলো না রানার। গোঁত্তা খেতে খেতে সোজা গিয়ে আছড়ে পড়ল ওরা পর্বতপ্রমাণ তরঙ্গের বুকে।
সাগরনীল দানোর ভয়াল হাঁ-টা ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না রানা জ্ঞান হারানোর আগে।