আটষট্টি
বোঝাই যাচ্ছিল, দীর্ঘ একটা রাত পার করতে হবে ওদের। শেষ পর্যন্ত যখন ক্লান্তিতে চোখ বুজল কোহেন, তার পরও প্রতিটা মিনিট জেগে থাকার কষ্ট সহ্য করতে হলো রানাকে।
প্রথমে গেল সেলেনার কী অবস্থা, দেখার জন্য। কিন্তু চিকিৎসকের কঠোর আপত্তির কারণে ফিরে আসতে হলো ওকে।
পরের বার গিয়ে শুনল এক বয়স্ক আর্দালির কাছে, সরিয়ে নেয়া হয়েছে ওকে। কোথায় রেখেছে, তার সদুত্তর দিতে পারল না লোকটা। বলল, ডাক্তার আবদুল্লাহ্ হয়তো বলতে পারবেন। প্রবলেম হলো—কেউই জানে না, কোথায় পাওয়া যাবে ডাক্তারকে।
অগত্যা চলে আসতে হলো রানাকে। পায়চারি শুরু করল ও দুশ্চিন্তায় পাগল হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে
ঘুম হারাম একা শুধু ওরই হয়নি। জনতার স্রোত কমেছে বটে গত কয়েক ঘণ্টায়, তবে বন্ধ হয়নি একেবারে। মেডিকেল স্টাফরাও বিশ্রামের সুযোগ পাচ্ছে না সেজন্য।
ভোর সাড়ে তিনটার কিছু পরে ওকে সাহায্য করা সিস্টারটিকে এক কোনায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখল রানা। কাজের ধকলে শেষ হয়ে গেছে মহিলা।
পানি আনতে গেল রানা বেচারির জন্য।
কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সেটুকু পান করে চোখ মুছল সেবিকা।
বিনয়ী ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল রানা, সেলেনার ব্যাপারে জানা আছে কি না কিছু।
খোঁজ নিয়ে দেখছে, বলে কাজে ফিরে গেল মহিলা।
চারটার আগে আর দেখা পাওয়া গেল না তার। শান্ত, বিষণ্ণ, আবেগহীন স্বরে বলল, ‘আসুন আমার সঙ্গে।
করিডোর ধরে নিয়ে চলল সে রানাকে।
শেষ কয়েক ঘণ্টায় আরও বিশৃঙ্খল আর ভয়াবহ হয়েছে হাসপাতালের অবস্থা। অনুসরণ করতে করতে কু-চিন্তাগুলো মন থেকে সরাতে পারল না রানা।
কোথায় চলেছে মহিলা?
কোনও ধরনের অফিস-কামরাতে, যেখানে ওকে বুঝিয়ে দেয়া হবে সেলেনার ঘড়ি, জুতো, ছেঁড়া কাপড়চোপড়, ইত্যাদি ব্যবহার্য জিনিসপত্র- যার মানে দাঁড়ায়, বাঁচাতে পারেনি ওরা মেয়েটাকে?
অবশেষে এক দরজা খুলে, ক্লান্ত হেসে ভিতরে যেতে ইশারা করল নার্স।
রানার শরীরে স্বস্তির বিচ্ছুরণ ঘটাল যেন হাসিটা। ইচ্ছা হলো, জড়িয়ে ধরে ইন্দোনেশিয়ান চিকিৎসাকর্মীটিকে।
‘থ্যাঙ্ক ইউ! থ্যাঙ্ক ইউ!’ আবেগ ঝরাল ও নার্সের হাত চেপে ধরে। ‘অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে!’
অর্ধালোকিত কামরাটায় প্রবেশ করল ওরা।
এক সারির শেষ মাথায় পর্দাঘেরা একটা বিছানার দিকে ইঙ্গিত করল মহিলা।
‘খুবই দুর্বল উনি,’ সতর্ক করল ফিসফিসিয়ে। ‘প্রচুর বিশ্রামের দরকার। খেয়াল রাখবেন, ঘুম যাতে না ভাঙে।’
‘এক্স-রে?’
‘ঠিক আছে সব কিছু। যাই আমি। আবারও বলছি, বিরক্ত করবেন না ওঁকে, ঠিক আছে?’
ওয়ার্ড ছেড়ে বেরিয়ে গেল সেবিকা।
সতর্ক পায়ে এগোতে লাগল রানা বেডগুলোর পাশ দিয়ে। পুরুষ পেশেন্টই বেশি। কেউ ঘুমাচ্ছে, কেউ আলো- আঁধারি থেকে দৃষ্টি দিয়ে অনুসরণ করছে ওকে।
থামল রানা নির্দিষ্ট বিছানাটার সামনে এসে। পর্দার একটা পাশ টেনে দিয়ে আকুল নয়নে তাকাল।
ঘুমে বিভোর সেলেনা। পুরু করে ড্রেসিং করা হয়েছে কপালে। মুখের আঘাতগুলো পাণ্ডুর হলেও কিছুটা রং ফিরেছে চেহারায়।
শ্বাস নিতেও ভয় হচ্ছে রানার, পাছে জেগে যায় সেলেনা। স্বস্তির সঙ্গে লক্ষ করল, নিয়মিত ছন্দে বুক ওঠানামা করছে মেয়েটার।
আরও কাছে এসে দাঁড়াল ও। পর্দাটা পিছনে টেনে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল বিছানার পাশে।
‘সরি, সেলেনা… রিয়েলি সরি!’ বাতাসকে শোনাচ্ছে যেন রানা। ‘এসব কিছুই প্রাপ্য ছিল না তোমার।’
ইচ্ছা করছে, ছুঁয়ে দেখে মেয়েটাকে। চুমু এঁকে দেয় কপালে। এত অস্থির লাগছিল এতক্ষণ! আশ্চর্য শান্তির সুবাতাস বইছে এখন মনে। জোসেফ নিকলসন, প্রজেক্ট ডুড়ে—মনে হচ্ছে এখন বহু, ব-হু দূরের ঘটনা।
‘নিরাপদ এখন তুমি,’ নিচু গলায় আবারও বলল রানা। ‘পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠো। ব্যস, আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই আমার!’
কোনও জবাব এল না বাতাসের কাছ থেকে।
‘এমন কোথাও নিয়ে যাব তোমাকে, যেখানে একটা চুলও কেউ স্পর্শ করতে পারবে না তোমার!’ উথলে ওঠা স্নেহে কপালে পড়ে থাকা লাল একটা চুলের গোছা সরিয়ে দিল রানা আলতো করে।
ক্ষীণ ফাঁক হলো সেলেনার চোখ দুটো। ধীরে ধীরে খুলে গেল পুরোপুরি।
‘রানা…’ ডেকে উঠল ফ্যাসফেঁসে কণ্ঠে। মরীচিকার মত কেঁপে কেঁপে উঠছে যেন পাশে বসে থাকা প্রিয় মানুষটির অবয়ব। ‘রানা… এটা কি তুমি?’
‘হ্যাঁ, আমিই তো!’ হাসার চেষ্টা করল রানা। কিন্তু কেন জানি পানি এসে গেল চোখে।
ওর হাত স্পর্শ করল সেলেনা। উষ্ণ, কিন্তু জোর নেই হাতে।
‘বলো, রানা… কক্ষনও ছেড়ে যাবে না আমাকে!’ আকুতি ঝরল ওর কণ্ঠ থেকে।
‘না, কক্ষনও না!’ শক্ত করে ধরল রানা হাতটা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত এক চুলও নড়ছি না এখান থেকে!
‘কথা দিচ্ছ?’
‘আসুক না, দেখি, কে সরাতে পারে আমাকে তোমার ‘কাছ থেকে!’