পঁয়ষট্টি
দূরদিগন্ত জুড়ে, যতখানি দেখতে পাচ্ছে ও, জেগে উঠছে মহাসমুদ্র। নব্বই কিংবা এক শ’ ফুট উঁচু নীলচে-সবুজ দেয়াল উঠেছে ঢেউয়ের। মাথায় বিক্ষুব্ধ সাদা ফেনা।
না, ব্যাপারটা ওর কল্পনা নয়; যদিও মনেপ্রাণে চাইছে, সত্যি না হোক ওটা।
এত প্রকাণ্ড ঢেউ জীবনে দেখেনি, কিংবা কল্পনাও করেনি রানা। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় উঁচু হচ্ছে আরও, ছুটে আসছে ডাঙা লক্ষ্য করে। দূরের মেনটাওয়াই প্রণালী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা দ্বীপগুলোকে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দিয়ে সুমাত্রা কোস্টলাইন গ্রাস করার জন্য ধেয়ে আসছে এখন ভয়াল সুনামি।
আগ্রাসী ঢেউয়ের শিকার হতে দেখল রানা নানা দেশের নানান রঙের বিশাল আকৃতির জাহাজগুলোকে। খুদে দেখাচ্ছে এত দূর থেকে। শক্তিশালী জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে মুহূর্তে সাগরসমাধি ঘটছে ওগুলোর তালগোল পাকিয়ে। বাঁচার রাস্তা নেই!
সেলেনার ডাকে চমক ভাঙল ওর। দড়িতে ঝাঁকি দিচ্ছে ও। ‘এই, রানা! কী হলো তোমার?’
কথা জোগাল না রানার মুখে। চোখ সরাতে পারছে না ও এগিয়ে আসতে থাকা ঢেউয়ের উপর থেকে।
এ মুহূর্তে কত দূরে ওটা?
দশ মাইল?
সময় আছে কতক্ষণ?
না, খুব বেশি নয়।
আর ওদেরকে আঘাত করবে না ওটা, পাশ কাটিয়ে যাবে, সেরকম কোনও সম্ভাবনাই নেই।
কোনও কিছুই রেহাই পাবে না সর্বগ্রাসী সুনামির হাত থেকে। ধ্বংস হয়ে যাবে ছোট্ট উপদ্বীপটার সব কিছু।
আছড়ে পড়বে ঢেউ দক্ষিণ-পশ্চিমের অরক্ষিত দেয়ালের উপর। দালান ধ্বংসের পর সুনামির শিকার হবে গোটা উপকূলরেখার সৈকত, বন্দর, গ্রাম আর শহরগুলো।
দূর থেকে মহাপ্লাবনের স্বরূপ দেখতে পেয়ে এরই মধ্যে দিগ্ভ্রান্তের মত ছুটোছুটি শুরু করেছে হাজারো মানুষ। বুঝে গেছে, কিছুতেই বাঁচতে পারবে না ওরা মহাপ্রলয়ের করাল থাবা থেকে।
অসহায়ভাবে তাকিয়ে দেখল রানা, মাত্র কয়েক সেকেণ্ডেই উপকূলের দিকে মাইল কে মাইল পেরিয়ে এল পানির প্রাচীর। বড়সড় একটা সেইলিং ইয়টের মাস্তুলের চেয়েও উঁচু হয়ে গেল অকল্পনীয় দ্রুতগতিতে। মরিয়ার মত ঢেউয়ের সামনে থেকে সরে যেতে চাইছে জলযানটা।
ছোঁ দিয়ে ঢেউয়ের শিখরে তুলে নিল ওটাকে জলদানব, খেলনার মত ছুঁড়ে ফেলল নিচে। পরমুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল ওটা তার অতল জঠরে।
তার পর তুমুল বেগে আগে বাড়ল সর্বভুক তরঙ্গ। দ্রুতই ডাঙার সঙ্গে দূরত্ব কমে আসছে ওটার। অল্প কয়েক মিনিটেই পৌঁছে যাবে এখানে।
অবিশ্বাস্য দৃশ্যটা থেকে অতি কষ্টে দৃষ্টি সরিয়ে নিচে তাকাল রানা।
ভূমিকম্প শেষের স্বস্তিতে এখনও মগ্ন কোহেন ও সেলেনা। জানেও না—ওরা যেটা অনুভব করল একটু আগে, সামান্যই আভাস ছিল সেটা কয়েক মাইল দূরের সাগরবক্ষে ঘটা বহু গুণ শক্তিশালী আরেক কম্পনের। সুচিন্তিতভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে ওটাকে, পাঠানো হয়েছে নির্ভুল নিশানায়। সাফল্য-ব্যর্থতা পরের প্রশ্ন, খেলা আসলে শেষই হয়নি নিকলসনের। সবে শুরু হয়েছে মাত্র।
রশি টানতে আরম্ভ করল রানা। পাগলা আতঙ্কে এমনই বুজে এসেছে কণ্ঠ, ওগরাতেই পারল না দুটো শব্দের বেশি।
‘ঢেউ! ঢেউ! ঢেউ আসছে!’
একটা মুহূর্ত স্থবির হয়ে রইল সেলেনা। উপলব্ধির ধাক্কায় পরক্ষণেই ঝুলে পড়ল চোয়াল। নিজেও ওঠার চেষ্টা করছে রশি বেয়ে।
হিসাব-নিকাশ চলছে রানার মাথায়। ওই মরণঢেউ সৈকতে এসে আছড়ে পড়ার আগেই কি ওদের তুলে আনতে পারবে আপাত নিরাপদ এই আশ্রয়ে? পানির সরাসরি ধাক্কা এড়াতে কি যথেষ্ট উঁচুতে থাকবে ওরা?
এমন নয় যে, অতখানি উঁচু হয়েই সাগরসৈকতে ঝাঁপিয়ে পড়বে ঢেউ। কিন্তু যদি পড়ে? পাড়ের ঢালের কারণে যদি আরও উঁচু হয়?
ঢেউয়ের আঘাত যদি প্রতিরোধ করতে না পারে বিল্ডিংটা?
আঘাতের প্রচণ্ডতা কেমন হতে পারে, কল্পনা করার চেষ্টা করল ও। কল্পনাতীত শক্তিতে পুরানো এই কারখানাটাকে খেলনাবাড়ির মত গুঁড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে পানি। ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে ইট-কাঠ-পাথরের ধ্বংসাবশেষ আর টন কে টন লোহালক্কড়।
জানপ্রাণ দিয়ে রশি বাইছে সেলেনা। বেদম নাচানাচি করছে ওটা বিক্ষিপ্ত আন্দোলনে। রানার পক্ষেও কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে রশি ধরে রাখা। গার্ডার থেকে পড়ে যাতে না যায়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হচ্ছে।
জোরালো থেকে জোরালোতর হচ্ছে আসন্ন প্লাবনের বজ্ৰধ্বনি।
এক ঝলক চাইল রানা জানালা দিয়ে।
অনেক দেরি হয়ে গেছে। একেবারে বুকের কাছে চলে এসেছে ঢেউয়ের প্রাচীর।
ঘণ্টায় পাঁচ শ’ মাইল বেগে ছুটে আসছে ওটা উপকূলের দিকে। সেলেনাকে তুলে আনার আগেই পৌঁছে যাবে সৈকতে।
কয়েক মাইল দীর্ঘ সমুদ্রসৈকতে এক যোগে আঘাত হানল সুনামি। কেঁপে উঠল গোটা উপকূল, গাছপালা, ঘরবাড়ি।
উপকূল প্লাবিত করে ছোট্ট পেনিনসুলার সবুজ অরণ্য উজাড় করতে শুরু করল লক্ষ লক্ষ টন পানির অদম্য চাপ। হাজার হাজার উপড়ে পড়া মহীরুহকে ভাসিয়ে নিয়ে চলল পাহাড়প্রমাণ ঢেউ ও প্রবল জলস্রোত।
স্বয়ংক্রিয়ভাবে রশি টানছে রানা। পৌঁছে গেছে সেলেনা… পৌঁছে গেছে প্রায় …
হৃৎপিণ্ডের বার কয়েক পাগলা ধুকপুকুনির মাঝেই দালানে চলে এল জলের পাহাড়। কিছুক্ষণ আগেই যে-আলোড়নটা কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে ওদের, তার চেয়ে অন্তত পাঁচ গুণ শক্তিশালী ঝাঁকুনিতে গার্ডার থেকে খসে পড়ার উপক্রম হলো রানার। ফুরসতও পেল না সেলেনাকে ঝুলে থাকতে বলার।
সাগরমুখী দেয়ালের ফাটলগুলো চওড়া হতে হতে গোটা দেয়ালটাই ভিতরদিকে ভেঙে পড়ল, মুহূর্তে অদৃশ্য হলো পাথর আর ফেনায়িত পানির নিচে। ডুবে গেল গোটা মেঝে।
মরিয়ার মত রশি ধরে রেখেছে রানা। উত্তাল ফেনার নিচে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখল ফিল কোহেনকে।
ফের দেখা গেল লোকটাকে এক মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণেই হারিয়ে গেল আবার অতিকায় এক গাছের গুঁড়ির নিচে চাপা পড়ে। ভাঙা দেয়াল দিয়ে ভেসে এসেছে ওটা।
বিপজ্জনক ভঙ্গিতে দুলছে সেলেনা রশি আঁকড়ে ধরে। মুখ-চোখ বিস্ফারিত। মাত্র কয়েক ফুট দূরে ও লোহার গার্ডার থেকে। কিন্তু রানার ধারণার চাইতেও অনেক দ্রুত উঠে আসছে বিক্ষুব্ধ পানির তোড়।
ঢেউয়ের গর্জন ছাপিয়ে শোনাই গেল না সেলেনার ত্রাহি আর্তনাদ। ঘূর্ণিস্রোত ডুবিয়ে দিয়েছে ওর পা দুটো, চোখের পলকেই পানি উঠে এল কাঁকাল অব্দি।
‘সাঁতার জানি না আমি, রানা!’ গলার শিরা-ছেঁড়া চিৎকারে কথাটা মনে করিয়ে দিল সেলেনা। ‘মরতে দিয়ো না আম্—’
শেষ করতে পারল না কথাটা। তার আগেই কাঁধ-মাথা চলে গেল জলের তলে। বাড়ন্ত পানি আর টান টান হয়ে থাকা রশিটা ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছে না রানা।
এবার অত্যধিক ওজন অনুভব করল হাত দুটোতে। পানির তোড় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে সেলেনাকে।
শুরু হলো ওর প্রাণান্ত সংগ্রাম। আচমকা রশিটা সরসর করে পিছলে যাওয়ায় চিৎকার করে উঠল রানা আতঙ্ক আর যন্ত্রণার প্রতিক্রিয়ায়। তালুর চামড়া ছিলে গেছে ওর। জানে না, কী করে লটকে রয়েছে গার্ডারে। এটুকুই জানে শুধু, হাল ছাড়ছে না ও—ছাড়বে না কিছুতেই।
দাঁতে দাঁত চেপে টেনে চলল রশি।
শোঁ শোঁ করে কুড়ি ফুটের মত উঠে স্থিতিশীল হলো পানির লেভেল। বাড়ছে এখনও, তবে দৃশ্যমানভাবে নয়।
অসংখ্য মৃত গাছ নিয়ে গোটা সাগরটাই যেন ঢুকে পড়েছে বিল্ডিঙের মধ্যে। বাকি দেয়ালগুলোও ভেঙে পড়ার উপক্রম।
টগবগিয়ে ফুটতে থাকা ফেনা ভেদ করে বেরিয়ে এল মেয়েটার মাথা আর কাঁধ। লাল চুলগুলো লেপটে রয়েছে মুখে। কাশছে সেলেনা, পানি ছিটাচ্ছে মুখ দিয়ে, লৌহমুষ্টিতে আঁকড়ে রেখেছে রশি।
চট্ করে দেখে নিল রানা, ঠিকভাবে আটকে রয়েছে কি না দড়ির অন্য প্রান্ত। তার পর দুই পায়ে গার্ডার পেঁচিয়ে ধরে নিচের দিকে ঝুলিয়ে দিল শরীরটা। হাত ধরতে চাইছে ভাসমান মেয়েটার।
‘হয়ে গেছে! আর কোনও চিন্তা নেই!’ কবজি দুটোর নাগাল পেতেই ভরসা ফিরল রানার মনে।
সজোরে টান দিয়ে ঘূর্ণিতরঙ্গ থেকে মুক্ত করল সেলেনাকে।
হাচড়ে-পাচড়ে গার্ডারে উঠে যেতে সক্ষম হলো মেয়েটা।
ফোঁটায় ফোঁটায় জল ঝরছে গা থেকে। ঠকঠক করে কাঁপছে ও ঠাণ্ডায়। প্রচণ্ড শকের কারণে হারিয়েছে বাকশক্তি। নিজেও গার্ডারে সোজা হয়ে বসে এক হাতে জড়িয়ে ধরল ওকে রানা। কয়েক ফুট নিচেই জঞ্জালে বোঝাই সর্বনাশা বন্যা।
ছেড়েই দিয়েছিল কোহেনকে আবার জীবিত দেখতে পাওয়ার আশা। আচমকা লোকটিকে পানির উপর ভেসে উঠতে দেখে এক ঝলক রক্ত ছলাৎ করে উঠল বুকের মাঝে।
থু-থু করে লবণাক্ত পানি ফেলছে কোহেন মুখ থেকে। বিশাল এক গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে আছে প্রাণপণে। নিশ্চিত ছিল রানা, ওটার তলায় পড়েই ভর্তা হয়েছে ও।
স্রোতের তাড়নায় নিজ অক্ষের উপর পাক খাচ্ছে গুঁড়িটা। ওই অবস্থাতেই শক্তিশালী ঘূর্ণাবর্ত টেনে নিচ্ছে ওটাকে ছাতের সাপোর্ট সেকশনের মাঝ বরাবর, যেটায় আশ্রয় নিয়েছে ও আর সেলেনা।
কড়িবরগা ধরে রাখা সেন্ট্রাল পিলারে ধাক্কা মারতে চলেছে গুঁড়িটা, উপলব্ধি করল রানা আতঙ্কের সঙ্গে। দ্রুত ছুটে আসছে ওটা… অত্যন্ত ক্ষিপ্র গতিতে।
প্রচণ্ড সংঘর্ষে ভেঙে গেল পিলার। চতুর্দিকে ছিটকে উঠল পানি। অবলম্বন হারিয়ে কাত হয়ে গেল রানাদের আশ্রয়স্থল। ধাতুতে ধাতুতে ঘর্ষণের কর্কশ, তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে হেলে গেল পানির দিকে।
এক মুহূর্তের জন্য শিয়োর ছিল রানা, পড়ে যাচ্ছে পানিতে। বাঁচিয়ে দিল স্রোতের তোড় থেকে রেহাই পাওয়া সমুদ্রমুখী দেয়ালের একমাত্র অংশটা। গার্ডারের এক প্রান্ত আটকে রইল ওটার সঙ্গে। না পড়লেও, ধাবমান পানির উপর ঝুলে রইল ওরা বিপজ্জনকভাবে।
‘মিস্টার কোহেন!’ ডাক ছাড়ল রানা চিৎকার করে।
অন্ধের মত স্রোতের মাঝে আছাড়ি-পিছাড়ি করছে সিআইএ এজেন্ট। বেরোনোর চেষ্টা করছে ডালপালার জট থেকে। যে-কোনও মুহূর্তে গড়ান দিয়ে তলায় নিয়ে যেতে পারে ওকে গুঁড়িটা।
‘কাম অন, কোহেন!’ হাত বাড়াল রানা। ‘পারবেন আপনি!’ ধরে ফেলল লোকটার বাহু।
ক্ষতবিক্ষত এজেন্ট ডালের জট ছাড়িয়ে বেরিয়ে এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিল। এতটাই বিমূঢ় হয়ে পড়েছে যে, উচ্চারণ করতে পারল না একটা শব্দও। ক্ষতগুলো ছাড়া সাদা হয়ে রয়েছে লোকটার চেহারা। মৃগী রোগীর মত থরথরিয়ে কাঁপছে হাত দুটো।
জানালার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে জলস্রোত। জানা কথা—বাকি দেয়ালগুলোও পড়ে গেলে পানির নিচে তলিয়ে যাবে দালান, সেই সঙ্গে ওরাও।
‘ছাতে উঠতে হবে আমাদের!’ জানালার দিকে ইঙ্গিত করল রানা। ‘বেরিয়ে যেতে হবে জানালা দিয়ে!’
কিন্তু শেষ শব্দটা মুখ দিয়ে বেরোনো মাত্রই, সবচেয়ে বেশি যে-আশঙ্কাটা করছিল ও, ঘটতে শুরু করল সেটাই।