ঊনষাট
কড়া রোদে বেরিয়ে এল ওরা দালান ছেড়ে।
সেই একই অ্যারোস্পেশাল পিউমা ওদের জন্য অপেক্ষা করছে হেলিপ্যাডে। রাইফেলের খোঁচায় রানা আর সেলেনাকে ওঠানো হলো চপারের পিছনে। আধ ডজন আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে নাঙ্গা ধাতব মেঝেতে বসতে বাধ্য হলো ওরা।
নিরুদ্বিগ্ন ভিকান্দার এনসিও-র সঙ্গে সমাসীন হলো সামনের সিটে। ক্বচিৎ তাকাচ্ছে রানাদের দিকে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, বিন্দু মাত্র উত্তেজনা নেই লোকটার মধ্যে।
কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও বেইমানটার উপর থেকে চোখ সরাতে পারছে না রানা।
মাটি ছাড়ল হেলিকপ্টার। দেখতে দেখতে উঠে গেল কমাণ্ড বেইসের অনেক উপরে।
গহীন জঙ্গল, নদী আর মগজ গুলিয়ে দেয়া ক্যানিয়ন পিছিয়ে যেতে লাগল নিচ দিয়ে। রানার হিসাব অনুযায়ী, দক্ষিণ-পশ্চিমে চলেছে পিউমাটা।
ওর আঙুলের ফাঁকে নিজের আঙুলগুলো ভরে নিয়ে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরল সেলেনা, মাথা রাখল কাঁধে। টারবাইনের উঁচু গ্রামে গর্জন আর খোলা হ্যাচ দিয়ে আসা গরম বাতাসের ঝাপটার কারণে আলাপচারিতা অসম্ভব।
এক চুল নড়ছে না রানা। অনুত্তেজিত শ্বাসপ্রশ্বাস চললেও রুদ্র ঝড় বয়ে যাচ্ছে ওর ভিতরে।
আধঘণ্টা পেরিয়ে গেল। সর্পিল, জনসঙ্কুল ট্রান্স-সুমাত্রা হাইওয়ে আর গোটা কয়েক শহরাঞ্চল পার হওয়ার পর কাঙ্ক্ষিত দ্বীপটার পশ্চিম উপকূলরেখা দেখা গেল দিগন্তে।
অত্যুৎসাহে নিচে তাকাল গুস্তাফ।
শিগগিরই নামতে শুরু করল যন্ত্রফড়িং।
লোকটার বর্ণনার কড়া পাহারাঅলা, অশুভ কাজকারবারের আড্ডাখানার সঙ্গে বিস্তর ব্যবধান রহস্যময় আস্তানাটার; যেটা দেখানোর জন্য অর্ধেক পৃথিবী ঘুরিয়ে এনেছে মিথ্যুকটা। নিকটস্থ উপকূলীয় শহর থেকে সিকি মাইলমত দূরে হবে ওটা। সমুদ্র সমতল থেকে উঁচু নয় বেশি, এমনই এক অরণ্যসঙ্কুল উপদ্বীপের কিনারে অবস্থিত শহরটা।
পরিত্যক্ত কোনও ফ্যাক্টোরি কিংবা প্রকাণ্ড কোনও বাঙ্কারের মত মনে হচ্ছে ধূসর দালানটাকে। শান্ত, বিস্তৃত সবজে-নীল মহাসাগর ওটার পিছনে। মেনটাওয়াই আর্কিপেলাগোর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু ভূখণ্ড আবছাভাবে চোখে পড়ে দিগন্তসীমায়। মেইনল্যাণ্ড আর ছোট ছোট দ্বীপগুলোর মধ্যবর্তী প্রণালীটার জায়গায় জায়গার সাদা সব ফুটকি। বহু দূরে থাকা প্রমোদতরী ও জাহাজ ওগুলো। অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে।
অনাদর-অবহেলার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেল বিল্ডিঙের পাশে চপারটা নেমে এলে। পেরিমিটার ঘিরে তৈরি করা সিকিউরিটি ফেন্স মেরামত করা হয় না বহু দিন। যত্রতত্র গায়েব হয়ে গেছে তারের বেড়া। যেই কোথাও দিঘল হলুদ ঘাসের বুকে মুখ থুবড়ে পড়েছে খুঁটি, স্থানীয় লোকজন চুরি . করে নিয়ে গেছে বেড়া। দালানের চারপাশে কংক্রিটের ফাটল থেকে নির্বিবাদে বেড়ে উঠেছে আগাছা।
সশস্ত্র প্রহরীদলের জিপ নিয়ে টহল দেয়া দূরের কথা, কোনও ধরনেরই জীবন্ত কিংবা চাকাঅলা জড়বস্তু দেখা যাচ্ছে না চোখের সীমানায়!
সেলেনার উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতেও একই প্রশ্ন রানার মত: কেন ওদের আনা হলো এখানে? স্রেফ নিজের কথার সত্যতা প্রমাণই নিশ্চয়ই একমাত্র উদ্দেশ্য নয় গুস্তাফ ভিকান্দারের?
ভাঙাচোরা একটা এন্ট্রান্সের সামনে কংক্রিটের জমিন স্পর্শ করেছে ‘কপ্টারটা। দালানের প্রবেশপথ মনে হচ্ছে এই একটাই।
অফিসারের হুকুমে হ্যাচ থেকে নামানো হলো রানা– সেলেনাকে। আগাছা ছাওয়া কংক্রিটের উপর দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল ওদের সৈন্যরা।
আগে আগে চলেছে আত্মবিশ্বাসী ভিকান্দার। মৃদু হাসি ঠোঁটে ধরে রেখে কদম ফেলছে লম্বা লম্বা। সম্ভ্রমের সঙ্গে পিছে পিছে আসছে এনসিও।
রাগ আর ঘৃণার জ্বলন্ত দৃষ্টিতে নকল সুইডিশটার দিকে চেয়ে রয়েছে সেলেনা।
এক সৈন্যকে ওর সবুজ ব্যাগটা নিয়ে আসতে দেখে অবাক হলো রানা। ভাবেনি যে, জীবনে আর দর্শন মিলবে ওটার। মাথায় ধরল না, কী প্রয়োজন এখানে জিনিসটার।
মরচে পড়া রিভেটঅলা ইস্পাতের উঁচু ডাবল ডোরওয়ের কাছে পৌঁছে গেছে গুস্তাক। ভারি তালা আর শেকল দিয়ে আটকানো এন্ট্রান্সটা। একটা চাবি বের করে তালাটা খুলতেই, আলগা হয়ে গেল শেকল।
তিন-তিনজন সৈন্যকে হাত লাগাতে হলো স্টিলের দরজাটা টেনে খুলতে। প্রলম্বিত গোঙানি ছাড়ল কবজা।
ভিতরের ছায়ায় প্রবেশ করলে, গুস্তাফকে অনুসরণ করল বাকিরা।
পলেস্তারাবিহীন ইটের কলাম উঠে গেছে চল্লিশ ফুট উঁচুতে ছাতের গার্ডারের দিকে। বাইরে থেকে দেখলে যেমনটা . মনে হয়, ভিতরটাকেও দেখাচ্ছে তেমনই পুরানো কোনও কারখানার মত। পার্থক্য কেবল, ঝেড়েমুছে সরিয়ে ফেলা হয়েছে এক কালের ইণ্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারিগুলো।
ফোকরের মত, দেয়ালের উঁচুতে থাকা একমাত্র জানালাগুলো মহাসাগরের দিকে। শত প্রজন্ম ধরে মাকড়সারা জাল বুনে বুনে ঘোলা করে দিয়েছে ফাটা কাঁচের শার্সি।
ফাঁকা দালানের দেয়ালে বাধা পেয়ে সৈনিকদের ভারি বুটের আওয়াজ ফিরে আসছে প্রতিধ্বনি হয়ে। ছাতে নীড় বাঁধা পাখির বেহিসাবি বিষ্ঠা, ধুলোময়লা আর সৈকত থেকে উড়ে আসা বালি মেঝেতে জমেছে পুরু হয়ে।
‘ব্যাটা দেখছি ডাহা মিথ্যেবাদী!’ বলল সেলেনা ঝাঁজাল কণ্ঠে। ‘বহু বছর ধরে ব্যবহার করা হয়নি জায়গাটা।’
থেমে দাঁড়িয়ে, অনুচ্চ কণ্ঠে কয়েকটা কথা বলল গুস্তাফ অফিসারের সঙ্গে।
নিজের লোকেদের দিকে ঘুরে আদেশ করল এনসিও। রানার ব্যাগ বহনকারী সৈন্যটি এগিয়ে এসে তুলে দিল ওটা গুস্তাফের হাতে। তার পর আবার জোর কদমে যোগ দিল দেশি ভাইদের সঙ্গে।
ওদেরকে নিয়ে এন্ট্রান্সের কাছে ফিরে গেল অফিসার। রানা, সেলেনা আর গুস্তাফ ভিকান্দারকে দালানে রেখে উঠে পড়ল ওরা অপেক্ষমাণ হেলিকপ্টারে।