চুয়ান্ন
আবার যখন উড়ল প্লেনটা, গাছপালার মাথায় উঠে আসা সূর্যটা এরই মধ্যে গনগনে তপ্ত হয়ে উঠেছে।
যতটুকু সম্ভব, ফিউল নিয়েছে ওরা ছোট্ট এয়ারফিল্ড থেকে। মনে মনে সন্তুষ্ট রানা। যথেষ্ট নেয়া হয়েছে তেল … যথেষ্টর চাইতেও বেশি।
মাঝসকালের মধ্যে পিছনে ফেলল ওরা ভারতের দক্ষিণ উপকূল। বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে যাত্রা শুরু হলো সবুজ-নীল ঝিলমিলে মহাসাগরের উপর দিয়ে। শ্রী লঙ্কার দুরন্ত কিশোরেরা জেলেনৌকা থেকে হাসিমুখে হাত নাড়তে লাগল গর্জনশীল এয়ারক্রাফটটার উদ্দেশে। কয়েক ঘণ্টা পর সুমাত্রার পশ্চিম উপকূলে ঢোকার আগপর্যন্ত শ্রী লঙ্কাই শেষ ভূখণ্ড।
সফরের অন্তিম অধ্যায় চলছে এখন।
টুইন ইঞ্জিনের একটানা গর্জনে কেমন জানি তন্দ্রা লেগে আসে। কোর্স, স্পিড আর আলটিচ্যুডের অবিরাম মনিটরিং; পান্নারঙা গম্বুজের মত নির্মেঘ আকাশ আর পাশে সেলেনার উপস্থিতিতে কোথায়, কী উদ্দেশ্যে চলেছে, মাঝে মাঝে ভুলেই যাচ্ছে রানা। অদ্ভুত ব্যাপার! মনে হচ্ছে, চিরটা কাল কাটিয়ে দেয় এভাবে! স্বচ্ছ, উষ্ণ মহাসাগরের উপর দিয়ে স্রেফ উদ্দেশ্যহীন উড়ে চলা। এই পথ যদি না শেষ হয় …
অবশ্য দুপুরের পর পরই মিলিয়ে গেল এই উড়ু উড়ু ভাবনা। ফিরে এল রানা বাস্তবে। সুমাত্রার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ল্যাণ্ডস্কেপের আভাস দেখা যাচ্ছে দিগন্তে।
একেবারে গায়ের উপর এসে পড়ার আগপর্যন্ত টেরই পেল না ওরা ফাইটার প্লেনের উপস্থিতি। রণসজ্জায় সজ্জিত, ইন্দোনেশীয় এয়ার ফোর্সের মার্কা মারা এক জোড়া এফসিক্সটিন দু’পাশ দিয়ে উড়তে লাগল এসটি-ওয়ানের সমান্তরালে। থ্রটল অফ করে ঘেরাও করল ওদের। গণ্ডি ছোট করে আনছে ছোট্ট, সাদা টার্বোপ্রপের। চড়ুই পাখিকে কবজা করেছে যেন দুই বাজ।
স্টারবোর্ডে বসা পাইলটের ভাইযার পরা চেহারা আর জেট থেকে বেরোনো তপ্ত, ঘন ধোঁয়া স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রানা ককপিটের জানালা থেকে।
আশঙ্কায় ফ্যাকাসে হয়ে ঘুরে তাকাল সেলেনা। ‘রানা!’
কোনও প্রত্যুত্তর করল না ও। এরই মধ্যে যোগাযোগ করেছে রেডিয়োতে।
ক’মুহূর্ত পর হেডসেটের কঠোর, কর্তৃত্বপূর্ণ ভাষাটা রূপান্তরিত হলো ইংরেজিতে। ততক্ষণে অবশ্য বক্তব্যের সারমর্ম বোঝা হয়ে গেছে রানার
‘ক্-কী চাইছে ওরা?’ চক্ষু চড়কগাছ মেয়েটার।
‘ওদের আকাশসীমায় প্রবেশের অনুমতির প্রমাণ দেখতে চাইছে। এক্ষুণি দেখাতে না পারলে বাধ্য হবে ল্যাণ্ড করাতে।’
‘ল্যাণ্ড করাবে?, কোথায়?’ ঠোঁট কামড়াল সেলেনা অগ্রসরমান দ্বীপটার কোস্টলাইনের দিকে তাকিয়ে। সৈকতের কিনারায় বিশাল এক গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অরণ্যের ঠাসবুনট। ‘এটা কি করতে পারে ওরা?’
‘কে বলেছে, পারে না?’ পাল্টা বলল রানা। ‘আকাশ থেকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে হুমকি মনে করলে।’
ক্ষিপ্ত কণ্ঠটা খ্যানখ্যান করে উঠল রানার কানে: ‘আমাদের নির্দেশ যদি না মানেন, বাধ্য হব প্রাণঘাতী হামলা চালাতে। আবারও বলছি, বাধ্য হব প্রাণঘাতী হামলা চালাতে।’
কথাটা বিশ্বাস করল রানা। রোটারি মেশিন ক্যাননের ট্রিগার আলতো স্পর্শ করলেই মুহূর্তের মধ্যে হাজার টুকরো হবে এসটি-ওয়ান। সলিল-সমাধি ঘটবে সবার।
‘কী করবে, রানা?’ শ্বাস আটকে জিজ্ঞেস করল সেলেনা।
‘এমন নয় যে, ছুটে পালাতে পারব ওদের খপ্পর থেকে।’ কণ্ঠস্বর শান্ত রয়েছে রানার। ‘সেকেণ্ডে ছ’শ’ ছিয়াশি মিটারের বেশি স্পিডে চলতে পারে ওগুলো। বলতে পারো, সবচেয়ে দ্রুতগামী আকাশযানের সমকক্ষ প্রায়। আর ওদের চাইতে ভালো অস্ত্রপাতি রয়েছে আমাদের কাছে, সেটাও তো নয়।’ ঠোঁটে ঠোঁট চাপল ও। লম্বা শ্বাস ফেলে রেডিয়োর টক বাটনে চাপ দিয়ে বলল, ‘কপি। দিস ইজ সিয়েরা ইনডিগো ফোর-টু- নাইন-ওহ। আনন্দের সঙ্গে নির্দেশ পালন করছি। কোর্স চেঞ্জ করার জন্যে রিরুটেড ডেস্টিনেশন জানান দয়া করে। ওভার।’
‘এসকোর্টটাকে অনুসরণ করে চলুন পেকানবারুর এয়ার ফোর্স কমাণ্ড বেইসে, আদেশ করা হলো রেডিয়োতে। ‘এসকোর্টের সঙ্গেই থাকতে হবে আপনাদের। একটুও সরবেন না কোর্স থেকে। আবার বলছি, একটুও সরবেন না কোর্স থেকে। নয় তো বাধ্য হব গুলি করতে।’
‘বোঝা গেছে, দুলাভাইয়েরা।’ টক বাটন চাপল রানা। ‘কপি দ্যাট। আগে বাড়ুন।
ঝলমল করছে সুমাত্রা উপকূল। প্রতি মুহূর্তেই এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। বন্দরের দিকে কয়েক ডিগ্রি কোর্স বদলে নিল ফাইটার বিমান দুটো। নিতান্ত অনিচ্ছায় সেই কোর্স ফলো করতে হলো রানাকে। আর কোনও বিকল্প নেই এ ছাড়া। উঁহুঁ… একদমই না!
‘বেইসে পৌঁছনোর পর কী ঘটতে পারে, রানা?’ সেলেনার কোঁচকানো ভ্রু যেন স্বাভাবিক হবে না কোনও দিন।
‘নির্ভর করছে নতুন এই দোস্তোদের সহনশীলতার ওপর,’ জবাব দিল রানা। ‘পশ্চাদ্দেশ অক্ষত রেখেই ছেড়ে দিতে পারে। নয় তো পারে হাতে লোহার চুড়ি পরাতে।’
‘অস্ত্রগুলো!’ পাংশু হয়ে গেছে সেলেনা।
মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘হ্যাঁ। হালকাভাবে নেবে না ওটাকে। কোনও মেঘের মধ্যে যদি ঢুকে পড়া যেত, ওদের চোখের আড়ালে ফেলে দিতে পারতাম ওগুলো। সেটাই ভালো হবে বোধ হয়।’ দিগন্তে চোখ বুলাল ও। যত দূর দেখা যায়, মেঘের চিহ্নও নেই।
ধ্যাত্তেরি! আক্ষেপ করল মনে মনে। একেবারে মাঠে মারা গেল পরিকল্পনাটা।
‘কোনও রাস্তাই কি খোলা নেই ওদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার?’ আকুল হয়ে জানতে চাইল সেলেনা।
‘প্লেন থেকে লাফ দিতে পারি।’
আরও মুখ শুকিয়ে গেল মেয়েটার। ‘ভালো বুদ্ধি নয় এটা, তা-ই না?’
‘ঠিক,’ স্বীকার করল রানা। ‘আদর্শ বুদ্ধি বলা যায় না এটাকে।’
গুস্তাফকে দেখা গেল কেবিনের দরজায়। ঝুলে পড়েছে চোয়াল। চেহারায় নানা রঙের খেলা।
‘দুটো মিলিটারি ফাইটার উড়ছে বাইরে!’ এমনভাবে বলল লোকটা, যেন ব্যাপারটা এখনও জানে না ওরা।
‘আমরাও ভাবছিলাম, খেয়াল করেছেন কি না…’ জবাব দিলেও, গুস্তাফের দিকে মনোযোগ নেই রানার। আরও অনেক কিছু খেলা করছে ওর মগজে। তাজা ফুল সারা দিন রোদে ফেলে রাখলে যেরকম শুকিয়ে আসে, ঠিক তেমনি মুখ শুকিয়ে এল ইন্সট্রুমেন্টের দিকে তাকিয়ে।
‘সেলেনা!’ ডাকল ও, ‘কমপিউটারে দেখবে একটু পেকানবারু এয়ার বেইসটা?’
কিবোর্ডের দিকে ফিরে ট্যাপ করা শুরু করল সেলেনা। ‘বানানটা কী? লাগবে না… পেয়েছি!’
‘এবার কো-অর্ডিনেট দাও মেইন সিস্টেমে, যাতে নতুন কোর্স সেট করতে পারি।’
কয়েক মুহূর্ত পর, সামনের প্যানেলে ফুটে উঠল ডেটা। ‘সম্ভবত সমস্যায় পড়তে চলেছি আমরা,’ বলে উঠল রানা।
‘আহ…’ ঢোক গিলল সেলেনা। ‘আমি তো জানতাম, এরই মধ্যে সমস্যায় রয়েছি আমরা।’
‘ওটা তো পুরানো সমস্যা, শুরু হবে এয়ার বেইসে পৌঁছুনোর পর। আর এটা শুরু হচ্ছে ওখানে পৌঁছুনোর আগেই।’
‘আগে মানে?’ ঠিক বুঝতে পারল না সেলেনা।
‘মেডান পৌঁছুনোর মত পর্যাপ্ত ফিউল নিয়ে ভারত ছেড়েছি আমরা, ব্যাখ্যা করল রানা। ‘কিন্তু সমুদ্র থেকে দু’শ’ মাইল দূরে এই পেকানবারু। অত দূর পর্যন্ত যেতে পারবে না প্লেনটা।’
‘কী হবে তা হলে?’ চোখ পিটপিট করল সেলেনা। সমস্যার স্বরূপটা এবার হৃদয়ঙ্গম হলেও মনে আসতে দিল না ভয়ঙ্কর ভাবনাটা।
‘ফিউল ছাড়া প্লেন উড়বে না…’ তাকাল রানা মেয়েটার চোখে।
‘তার মানে… তার মানে… ক্র্যাশ করতে চলেছে এসটি- ওয়ান?’
চোয়াল কঠিন হলো রানার। ‘যদি না তার আগেই গুলি করে ফেলে দেয় আমাদের!’