তেপ্পান্ন
স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ছ’টা পঁয়তিরিশে, জার্মানি ছাড়ার প্রায় বারো ঘণ্টা পর মাসকাট বন্দরনগরীর ছোট এক কমার্শিয়াল এয়ারবেইসের মাটি ছুঁল রানা। সাগর থেকে মাইল কয়েক ভিতরে ওটা।
এয়ার-কণ্ডিশনড প্লেন থেকে নামতেই ড্রাগনের নিঃশ্বাসের হলকা লাগল যেন ওদের শরীরে। কয়েক মিনিটেই টের পেল রানা, ঘামে ভিজে গায়ের সঙ্গে সেঁটে গেছে শার্টটা।
ভ্রমণক্লান্ত পাইলট আর কো-পাইলটের হাল হয়েছে যেন যান্ত্রিক বিহঙ্গটারও। ধুলোবালির প্রলেপ পড়েছে মসৃণ সাদা ফিউযেলাজে।
একমাত্র যে-লোকটিকে তাজা ও প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে, সে হচ্ছে গুস্তাফ।
‘ঘুম হলো?’ কৌতুকের সুরে জিজ্ঞেস করল রানা। ‘আশা করি, টায়ার্ড হয়ে পড়েননি?’
‘আর বেশি স্যাণ্ডউইচ নেই প্লেনে!’ এমনভাবে বলল লোকটা, যেন স্যাণ্ডউইচের অভাবে মরতে চলেছে ওরা।
‘চিন্তায় ফেলে দিলেন,’ বলল রানা রগড় করে, যদিও মুখখানা গম্ভীর।
মহা ব্যস্ততা এয়ারবেইস জুড়ে। ছোটখাটো প্রপেলার প্লেন থেকে শুরু করে লিয়ার জেট পর্যন্ত হরেক জাতের এয়ারক্রাফট কেবল আসছে আর যাচ্ছে। রিফিউলিং ডকের কাছে, নিচু এক ছায়াঢাকা দালানে বসার ব্যবস্থা। কড়া রোদ থেকে গা বাঁচিয়ে পাইলট, ক্রু আর প্যাসেঞ্জাররা শরীর জুড়াতে পারে বরফ মেশানো কফিতে চুমুক দিয়ে। রানাদেরও দু’হাত তুলে ডাকছে যেন সুদৃশ্য লাউঞ্জ।
তেল ভরা দেখতে দেখতে রানার মনে হতে লাগল, রৌদ্রতপ্ত অ্যাসফল্ট গর্ত খুঁড়ছে জুতোর তলায়। বিশ্রামের জন্য মনে মনে তড়পাচ্ছে ও। ঘণ্টা কয়েক চোখ না বুজলে চলছে না আর!
কিন্তু আভগ্যাসের শেষ কয় গ্যালন যখন পাম্প করা হচ্ছে, দূরের এক গেট দিয়ে দ্রুত বেগে ঢুকতে দেখল রয়্যাল ওমান পুলিসের একটা জিপ গাড়িকে।
সামনের সিটে উদ্ধত ভঙ্গিতে বসা অফিসারের চোখে কালো চশমা। মাথায় চূড়াঅলা ক্যাপ। খুব সম্ভব ক্যাপটেন লোকটা। ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পিছে বসেছে খাকি ‘উর্দি পরা জনা পাঁচেক গুণ্ডা টাইপের লোক। দেখে মনে হয়, ভালোই বোঝে ওরা নিজেদের কাজকর্ম।
তীক্ষ্ণ, কর্কশ আওয়াজ তুলে থামল গাড়িটা শ’খানেক গজ তফাতে। প্রাইভেট এক সেসনা পাইলটের টুটি চেপে ধরার জন্য নেমে এল সবাই জিপ থেকে। মিনিট পনেরো আগে ল্যাণ্ড করেছে প্লেনটা।
সেসনার কাগজপত্র পরীক্ষা করছে ওরা, সেই সঙ্গে চলছে অসহ্য হম্বিতম্বি। রাইফেল বাগিয়ে ধরে বিমানে উঠে পড়ল তিন গুণ্ডা। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, হাতেনাতে ধরতে চলেছে এক ঝাঁক টেররিস্টকে।
এর পর যেটা হতে পারে—প্রবল উৎসাহে এক দল স্টাট্রুপার তালাশ শুরু করবে এসটি-ওয়ানের ভিতর। সঙ্গে আনা অস্ত্রগুলোর ব্যাপারে জেরায় জেরবার করবে ওকে। একটা প্রশ্নেরও সন্তোষজনক জবাব দিতে পারবে না রানা।
‘আমার মনে হয়, দরকারের চাইতেও বেশি সময় পার করে ফেলেছি এখানে,’ বলল ও সেলেনাকে।
আবার উঠে বসল রানা পাইলট সিটে। এক ঘণ্টাও হয়নি, বেইসে এসেছে ওরা।
এবার দক্ষিণ-পুবে ঘুরিয়েছে ও বিমানের মুখ। আরব সাগরের উপর দিয়ে ভারতের দিকে যাত্রা এবার। বারো শত পঞ্চাশ নটিকাল মাইলের জার্নি।
ওমান কোস্টলাইন ছোট হয়ে এল পিছনে। যাত্রাপথে ওটাই শেষ ভূখণ্ড। আরও কিছুক্ষণ দেখা গেল উপকূলরেখা, তার পর আবছা হয়ে মিলিয়ে গেল।
পানির উপর দিয়ে গর্জন ছেড়ে উড়ে চলেছে ছোট্ট এয়ারক্রাফট। বিশাল এক আগুনের গোলার রূপ নিয়ে সূর্য ডুবছে পশ্চিম দিগন্তে। ঝিলিমিলি লাল আর সোনালি রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে কালচে হয়ে আসা সাগরের একাংশ।
এক সময় নেমে এল অন্ধকার।
চাঁদের আলোর সঙ্গে ঝিকমিক করা ন্যাভিগেশন লাইট আর ইন্সট্রুমেন্টের আভায় আবছাভাবে আলোকিত হয়ে আছে ককপিট
বয়ে চলেছে সময়। মাঝে মধ্যে উড়ে যাচ্ছে ওরা জাহাজের উপর দিয়ে। এতটাই ক্লান্ত যে, কথা বলছে না তেমন একটা।
হঠাৎ কাঁধের উপর সেলেনার হাতের স্পর্শে চমকে উঠল রানা। উপলব্ধি করল, বুকের সঙ্গে লেগে আসছিল থুতনি।
চোয়াল শক্ত হলো রানার। প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি খাটিয়ে জাগ্রত রাখল নিজেকে।
পেরিয়ে গেল দু’টি ঘণ্টা। সামনে ছড়ানো অনন্ত, কালি মাখা মহাসাগর ছাড়া আর কিছুর যেন অস্তিত্ব নেই পৃথিবীতে। সমস্ত ভূখণ্ড তলিয়ে গেছে মৃত্যুর মত অন্ধকার সমুদ্রের অতলে, আর ওরা উড়ে উড়ে ডাঙা খুঁজে বেড়াচ্ছে, খুঁজছে আশ্রয়—এমনই এক বিমূর্ত অনুভূতির খেলা চলছে রানার মনের মধ্যে।
‘দুঃখিত, সঙ্গী হিসেবে খুব একটা সুবিধার নই আমি, ‘ বিড়বিড় করে বলে, ঘাড় ঘোরাল সেলেনা। ‘নিজেও কোনও মতে খুলে রেখেছি চোখ দুটো।’
ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলের সবজে আভায় মেয়েটার হাসিমুখ দেখতে পেল রানা।
‘পিছনে গিয়ে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নাও গে,’ বলল রানা মমতা ভরা কণ্ঠে।
‘না।’ জোরের সঙ্গে মাথা নাড়ল মেয়েটা। ‘এখানেই থাকছি আমি। যদি কোনও প্রয়োজন হয় তোমার।’
‘হুম… প্রয়োজন…’ ফাঁকা গলায় আওড়াল রানা।
শুরুতে সরল রেখার মত কালো দিগন্তের উপর আলোর আভা চোখে পড়ল ওদের। ধীরে ধীরে সাগরের বুক থেকে মাথা জাগাতে শুরু করল যেন মুম্বাই শহরের বিস্তীর্ণ আলোকমালা।
কোর্স ঠিক রেখে উড়ে চলল ওরা শহরের দক্ষিণ প্রান্ত ধরে। রাত একটার কিছু আগে ন্যাভিগেশন যন্ত্রপাতিগুলো জানিয়ে দিল রানাকে, বিমান এগোচ্ছে বেঙ্গালুরুর রামা- নগরমের এয়ারস্ট্রিপের দিকে।
স্ট্রিপের চারদিকের উঁচু উঁচু গাছগুলোর জন্য প্রায় গোত্তা দিয়ে নামতে হলো কায়দা করে। এমন হাঁপিয়ে উঠেছিল রানা, খেয়ালই করল না রানওয়ে লাইটের দিকে। তবে দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় নিরাপদেই নামাতে পারল প্লেনটা। ওটা যখন নেমে আসছে, রানার বাহু আঁকড়ে ধরে থাকল সেলেনা।
অবশেষে কন্ট্রোল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারল রানা। এতক্ষণে বিশ্রাম পেল শ্রান্ত-ক্লান্ত স্নায়ু আর পেশিগুলো।
এডেকা মার্কেট থেকে কেনা শেষ স্যাণ্ডউইচটা গিলতে গিলতে রীতিমত উপেক্ষা করল ও গুস্তাফকে। খাওয়া শেষে নেতিয়ে পড়ল আরামদায়ক প্যাসেঞ্জার সিটে। পুরোপুরি নিঃশেষিত ও। অনুভব করছে, ধীরে ধীরে মন থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে টেনশন। চোখ দুটো বোজার সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে গেল স্বপ্নহীন শূন্যতার কোলে।
ঘুম ভাঙার পর, চোখ দুটো মেলেই পাশের সিটে সেলেনাকে দেখতে পেল রানা। ভোরের প্রথম আলো চুইয়ে ঢুকছে ডিম্বাকৃতি পোর্টহোল জানালা দিয়ে।
‘খুব সুন্দর জায়গা।’ হাসল মেয়েটা। ‘গায়ে হাওয়া লাগাতে যাচ্ছি আমি। বেরোতে চাও নাকি হাতপা খেলানোর জন্যে?’
উদীয়মান সূর্যের সোনালি আভার ঔজ্জ্বল্যে মলিন হয়ে আসছে তারাগুলো। গাছগাছালির মাঝ দিয়ে প্রাতঃভ্রমণ করতে করতে ফুসফুস ভরে নিল ওরা চনমনে, তাজা বাতাসে।