লোহার থাবা – চিত্রা দেব
বন্ধু অমিতাভ চৌধুরীর সনির্বন্ধ অনুরোধ এড়াতে না পেরে সঞ্জয় সোম দিনসাতেকের ছুটি নিয়ে এখানে এসেছেন। অমিতাভ স্টেশনে গিয়েছিলেন। বন্ধুকে নিয়ে বাইরে এলেন। ঘন শালের অরণ্য দেখে মুগ্ধ হলেন সঞ্জয়। বললেন, ‘স্বর্গরাজ্য একেবারে!’
‘প্রথম-প্রথম আমারও মনে হত। তা তোর কুকুরটাকে আনিসনি?
‘সিল্কি! কাল-পরশুর মধ্যেই এসে পড়বে—আজ ওকে ”বুক” করতে পারিনি, আমার চাকর পাঠিয়ে দেবে।’
‘যাক, নিশ্চিন্ত হলাম।’ বলে জিপে স্টার্ট দিলেন অমিতাভ।
পরের দিন সকাল হওয়ার আগেই অমিতাভ ঘুম ভাঙিয়ে দিলেন সঞ্জয়ের : ‘ওঠ, ওঠ, সকালে ঘুমোতে হবে না।’
‘কী ব্যাপার?’
‘মারাত্মক! খুন হয়েছে একটা, যাবি তো চল।’
উঠে পড়লেন সঞ্জয় সোম। বললেন, ‘কোথায় খুন হয়েছে?’
অমিতাভ বললেন, ‘খুন হয়েছে কি না এখনও বলতে পারছি না। এখানকার একজন ধনী ব্যক্তি সনাতন মল্লিক, বাড়ি থেকে নিখোঁজ। ভদ্রলোক চলা-ফেরা করতে পারেন না—কোমর থেকে অবশ হয়ে গেছিল। খুব বদমেজাজি বলে প্রায় কেউই সুচক্ষে দেখে না। বিরাট বাড়িতে একমাত্র ছেলে আর চাকর-বাকরদের নিয়ে থাকতেন। তোর কুকুরটা থাকলে ভালো হত।’
‘আজই হয়তো আসবে।’ বন্ধুকে সান্ত্বনা দেন সঞ্জয় সোম।
ঘটনাস্থল বাড়িটার সামনে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। তার কুড়ি গজ দূরেই রেললাইন—বাড়িটার অদূরেই লেভেল ক্রসিং। ড্রইংরুমে সনাতন মল্লিকের ছেলে সীতেশ বসেছিল। তাঁদের দেখেই বলল, ‘আসুন দারোগাবাবু, নমস্কার।’
অমিতাভ নীরবে তার নমস্কার ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘কী ব্যাপার?
‘বাবাকে কাল রাত থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘কত রাতে জানলেন যে, সনাতনবাবু ঘরে নেই?’
‘রাতে নয়—আজ ভোরবেলা চা নিয়ে রঘু বাবার ঘরে গিয়ে দেখল, তিনি নেই।’
‘সারা বাড়ি খুঁজেছেন?’
‘খুঁজেছি। বাবা উঠতেই পারেন না—দোতলা থেকে নামলেন কী করে?’
‘দরজা কি খোলাই ছিল? আপনারা কি দরজা খুলে ঘুমোন?’
‘হ্যাঁ। দরজা ভেজানো ছিল—চারপাশে গ্রিলের দরজা বন্ধ থাকে বলে ভয়ের কিছু থাকে না।’
রাত্রে শয্যায় সনাতন মল্লিক শুয়েছিলেন—সেই একটি প্রমাণ ছাড়া কোনও জিনিস অবিন্যস্ত হয়নি। বিছানার কাছে একটা সুদৃশ্য দড়ি ওপরের ভেন্টিলেটারের পাশ দিয়ে ঝুলছিল। সেটা দেখে সঞ্জয় বললেন, ‘দড়িটা কীসের?’
‘ও-দড়িটা টেনে বাবা রঘুকে ডাকতেন, ওর সঙ্গে ঘণ্টা বাঁধা আছে—একতলায় রঘুর ঘর।’
অমিতাভ এগিয়ে গিয়ে দড়িটা টানলেন, কিন্তু কোনও ঘণ্টা বাজল না, উলটে দড়িটা ওপর থেকে পড়ে গেল। অমিতাভ বললেন, ‘এ কী!’
সঞ্জয় পরীক্ষা করে দেখে বললেন, ‘দড়িটা কাটা রয়েছে। তার মানে বুঝতে পারছ, সনাতনবাবু যাতে ঘণ্টা বাজিয়ে রঘুকে না ডাকতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
এদিক-ওদিক দেখে নীচে নেমে এলেন তাঁরা। সীতেশ বলল, ‘এই অঞ্চলের বিপ্লবীরা বাবাকে ভয় দেখাচ্ছিল। হয়তো তারাই কিছু করেছে।’
‘কী করে ভয় দেখাত?’
‘চিঠি দিয়ে।’
‘চিঠিগুলো দেখাতে পারেন?’
সঞ্জয়ের প্রশ্নে যেন বিব্রত বোধ করল সীতেশ। বলল, ‘না। বাবা কোথায় চিঠি রাখতেন, না ফেলে দিতেন, জানি না।’
‘কিছু মনে করবেন না, সীতেশবাবু, আপনার বাবার সঙ্গে আপনার সদ্ভাব ছিল কি?’
‘ছিল না। কাল সন্ধেবেলাই বাবার সঙ্গে খুব কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে। বুড়ো হয়েছেন, তবু টাকা-পয়সা কিছুই আমাকে দিতে চান না।’
‘আপনি কিছু করেন না?’
‘না।’
‘বাড়িতে ক’জন চাকর আছে?’
‘চারজন। মালি একজন।’
‘ওদের ডাকুন।’
‘একজন চাকরকে পাবেন না—সে রাত্রে থাকে না, অন্যদের ডাকছি।’
প্রথমেই রঘু এল। মাঝারি বয়েসের একটি লোক।
‘তোমারই নাম রঘু? সনাতনবাবুর কাজ করতে?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, বাবু।’
‘তোমার বাবুকে শেষবার দেখেছ কখন?’
‘আজ্ঞে, রাত দশটার সময় বাবুকে খাইয়ে, যখন শুতে গেছি।’
হঠাৎ সঞ্জয় বলেন, ‘তোমার বাবু কি রাত্রে মোমবাতি জ্বালেন?’
‘না তো, বাবু!’
‘কেন?’ খর চোখে প্রশ্ন করে সীতেশ মল্লিক।
‘এমনিই।’ পাশ কাটিয়ে যান সঞ্জয়। বলেন, ‘রঘু, তুমি বাবুর ঘরে শোও না কেন? ঘণ্টা বাজালে সবসময় শুনতে পাও?’
‘আমার কান খুব সজাগ। আগে তিনতলাতেই শুতাম। ছোটবাবু—।’
তার আগেই সীতেশ বলল, ‘আমিই আপত্তি করেছি। পুরোনো চাকর হলেই যে বিশ্বাস করতে হবে, তার কী মানে আছে?’
‘সকালে তুমিই চা নিয়ে গেছিলে?’
‘হ্যাঁ। পাঁচটার সময় চা খান আমার বাবু—নিয়ে গিয়ে দেখি তিনি বিছানায় নেই।’
আরও একঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে সনাতন মল্লিকের ঘরে তালা দিয়ে নেমে এসে সঞ্জয় রঘুকে বলেন, ‘রঘু, যে-চাকরটি এখানে থাকে না, সে কখন আসে?’
‘কে, কালী? সে তো খুব ভোরে আসে। ছোটবাবুর চাকর…তবে কাল অনেক রাতেও আমি যেন কালীর গলা শুনেছি, বাবু।’
‘অনেক রাত মানে?’
‘রাত দশটা হবে আজ্ঞে। আমি তখন বাবুকে খাবার দিচ্ছিলাম।’
এই কথাগুলো সীতেশ মল্লিক শুনতে পায়নি। সে অমিতাভর সঙ্গে দোতলায় গেছিল।
সঞ্জয় বলেন, ‘এ-কথা এখন কাউকে বোলো না, রঘু।’
বাগানটা একবার ঘুরে নিয়ে বেরোনোর সময় সঞ্জয় দেখলেন গেটের কাছে জুতোর ছাপ, পায়ের দাগ, চাকার রেখা আর ইতস্তত থাবার আঁচড়।
‘কুকুর আছে নাকি আপনাদের?’
‘না তো।’ নমস্কার করে গেট বন্ধ করল সীতেশ।
বাড়ি ফিরে এলেন দুজনে। সঞ্জয় চায়ের টেবিলে বসে বললেন, ‘তুই কালীর খোঁজ কর! সে হয়তো অনেক কিছু জানে।’
‘তুই রঘুকে মোমবাতির কথা জিগ্যেস করছিলি কেন?’
‘লক্ষ করিসনি, সনাতনবাবুর ঘরের মেঝেতে কয়েক ফোঁটা মোম পড়েছিল। সে-মোম কী করে এল?’
বিকেলের দিকে অমিতাভর কাজ থাকায় সঞ্জয় একাই বেড়াতে বেরোলেন। ‘সিল্কি’ এসে গেছে। স্টেশন থেকে তাকে নিয়ে তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। মনে-মনে সনাতনবাবুর কথা ভাবতে-ভাবতে লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে চলে এলেন একসময়ে। রেললাইন পার হয়ে পায়ে হাঁটা বাঁকা রাস্তাটা চোখে পড়ল তাঁর। সুন্দর শুঁড়ি-পথটার সৌন্দর্যে যেন মুগ্ধ হয়ে গেলেন সঞ্জয়। হঠাৎ দেখলেন, সিল্কি অভিনিবেশ সহকারে মাটি শুঁকে-শুঁকে চলেছে। সামান্য ভিজে মাটিতে অনেকগুলো ইতস্তত থাবার দাগ রয়েছে। ভালো করে লক্ষ করলেন তিনি : দুটো শেয়ালের বা কুকুরের আটটা পায়ের ছাপ রয়েছে পাশাপাশি—একটা অন্যটাকে অতিক্রম করেনি, এক-একটা থাবার দূরত্ব এক বিঘতের মতন, একটা থাবার তিনটে নখ যেন মাটিতে বিঁধে গেছে। সঞ্জয় ভাবতে চেষ্টা করলেন, কোথায় তিনি এই থাবার ছাপ দেখেছেন। বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ল, আজই সকালে সনাতনবাবুর বাড়ির সামনে এইরকম থাবার দাগ দেখেছেন তিনি, বেশ গভীর থাবার ছাপ।
হাতে সময় ছিল বলে তিনি স্থির করলেন, থাবাগুলো অনুসরণ করবেন। সনাতনবাবুর বাড়ির বাগানের মাটিতে যে-থাবার ছাপ আছে, সেই ছাপ শুঁড়ি-পথ ধরে কোথায় গেছে? সিল্কিকে নিয়ে অগ্রসর হলেন সঞ্জয়। শিক্ষিত অ্যালসেশিয়ান মাটি শুঁকতে-শুঁকতে অগ্রসর হল। প্রায় এক মাইল চলার পর সঞ্জয়ের নাকে উৎকট গন্ধ এল। আরও খানিকটা যেতেই পচা গন্ধের উৎস দেখতে পেলেন তিনি। বেশ নিচু একটা জায়গা। বোধহয় শহরের বেওয়ারিশ মড়াগুলোকে এখানেই ফেলা হয়। অনেকগুলো কাক, দু-তিনটে শকুন ঘোরাঘুরি করছে। পুতিগন্ধময় দু-চারটে শবও চোখে পড়ল। ভালো করে দেখলেন, ভদ্র পোশাক পরা একজন বর্ষীয়ান লোকের শবও পড়ে আছে সেখানে। অবশ্য শিয়াল-কুকুরে খানিক-খানিক খেয়েও গেছে। সনাতন মল্লিককে আগে না দেখলেও সঞ্জয় অনুমান করলেন, এই লোকটিই বোধহয় সনাতন মল্লিক। অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ করে তাঁর মনে হল, মৃত লোকটিকে গলা টিপে মারা হয়েছে। পড়ন্ত আলোয় চোখে পড়ল তার মীনা করা আংটির ওপর লেখা রয়েছে এস. এম.। নিশ্চিন্ত হলেন সঞ্জয়। বন্ধু অমিতাভকে খবর দিতে হবে। দুটো শিয়ালের থাবার অনুসরণে লাশ আবিষ্কারের কৃতিত্ব কি কম?
আবার রাস্তায় উঠলেন সঞ্জয়। তাঁর আগে-আগে চলল সিল্কি কাঁচা মাটিতে থাবার ছাপ এঁকে। অবাক হলেন সঞ্জয়। দেখলেন সিল্কির মতো অতিকায় অ্যালসেশিয়ানের থাবার ছাপও শিয়ালের থাবার মতো গভীর নয়। তা ছাড়া শিয়ালগুলো এখান থেকে ফিরে যায়নি। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলেন, পাশের রেললাইনের দিকে গেছে কি না বুঝতে পারলেন না। কারণ, সেখানে সবুজ ঘাস রয়েছে। তবু তন্নতন্ন করে খুঁজেও শিয়ালের কোনও চিহ্ন দেখতে পেলেন না সঞ্জয়। সন্ধে হয়ে আসছে বলে ফিরে আসার পথ ধরলেন।
অমিতাভ বাড়িতে ফিরে বন্ধুর জন্য বসেছিলেন। সঞ্জয় ও সিল্কিকে প্রবেশ করতে দেখে বললেন, ‘যাক, তোর সারমেয় এসে গেছে।’
‘শুধু আসেনি, সনাতনবাবুর লাশও খুঁজে বের করেছে।’
‘কোথায়—কোথায়?’ লাফিয়ে উঠলেন অমিতাভ।
সঞ্জয় বিকেলের অভিযানের আনুপূর্বিক সব ঘটনা বললেন। থাবার দাগগুলো যে রহস্যময় মনে হয়েছে, সে-কথাও বললেন।
অমিতাভ সনাতনবাবুর লাশ তুলে আনার ব্যবস্থা করে এসে বসলেন।
সঞ্জয় বললেন, ‘কী ব্যবস্থা করলি?’
‘লাশ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করলাম। সীতেশকেও জানাতে হবে।’
‘এখুনি জানাবার দরকার নেই। তাতে সাবধান হয়ে যাবে।’
‘তুই কি স্থির নিশ্চিত যে, সে-ই খুন করেছে?’
‘প্রমাণ না পেয়ে কিছু বলা যায় না। তবে সনাতনবাবুর মৃত্যুতে আর কেউ লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা নেই যখন—।’
‘সীতেশ যদি বা খুন করে, তাহলে সে কী করে সনাতনবাবুর লাশ ফেলে এল? ভদ্রলোক খুব হালকা ছিলেন না!’
সঞ্জয় আপনমনে বললেন, ‘শিয়ালের থাবা, দুটো শিয়াল পাশাপাশি গেছে—তারা আর ফেরেনি…আচ্ছা, একটা শিয়ালের ওজন কত বলতে পারিস?’
‘না। কোনওদিন কোলে তুলে দেখিনি।’ রাগত স্বরে বলেন অমিতাভ।
‘আমিও না—কিন্তু সিল্কি নিশ্চয় শিয়ালের চেয়ে ভারী।’
‘তা তো হবেই, অত বড় অ্যালসেশিয়ান যখন।’
‘অথচ শিয়ালের থাবাগুলোর দাগ আরও গভীর।’
‘তবে কি বলতে চাস, ওগুলো শিয়ালের থাবা নয়?’
‘দেখে এসেছি ওগুলো থাবারই দাগ…তবে…অমিতাভ, এখানে কামার আছে?’
‘আছে। কেন?’ বিস্মিত হলেন অমিতাভ।
‘কাল ভোরে তাদের ডেকে পাঠাস।’
‘একজনই কামার এ-অঞ্চলে আছে, যে জিনিসপত্র তৈরি করে।’
‘তাকেই ডেকে আনতে হবে।’
‘তোর কথার মাথামুন্ডু বুঝতে পারছি না।’
‘কাল পারবি।’ বলে আলোচনায় ইতি টানলেন সঞ্জয়।
পরের দিন সকালে অমিতাভর কাছে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এল, গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে সনাতন মল্লিককে।
‘জানতাম। অমিতাভ তুই কালীর খোঁজ করেছিস?’
‘কাল সে কাজে এসেছিল অনেক বেলায়—আমি আর ওদিকে যাইনি।’
‘আজ ওদিকে যাব। তার আগে কামারকে চাই।’
হাসতে-হাসতে অমিতাভ বললেন, ‘ডেকে পাঠিয়েছি। এখানে এসেও তুই কাজ করবি?’
‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। বুদ্ধির খেলায় বিপক্ষকে মেরে এনেছি, তবে প্রমাণ করতে পারব কি না কে জানে!’
ছোট শহরের কামার সাতসকালেই পুলিশের ডাক পেয়ে ছুটে এসেছে। সঞ্জয় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নাম কী?’
‘আজ্ঞে, মাধব।’
‘আচ্ছা মাধব, সীতেশবাবুর দু-জোড়া জুতো তাহলে তুমিই করেছ?’
‘হ্যাঁ, বাবু।’ বলে ফেলেই যেন পাংশু হয়ে গেল মাধব।
অমিতাভ বুঝতে পারছিলেন না কামার আবার কী জুতো তৈরি করেছে। তবু চুপ করে রইলেন। বন্ধুর ওপর অসীম আস্থা ছিল তাঁর।
‘আচ্ছা মাধব,’ সঞ্জয় বললেন, ‘সীতেশবাবু জুতোগুলোর কথা কাউকে বলতে বারণ করেছিলেন, তাই না?’
‘হ্যাঁ, বাবু।’
‘আচ্ছা, তুমি যেতে পারো।’
মাধব চলে গেলে সঞ্জয় বললেন, ‘এবার চল।’
‘কোথায়?’
‘সীতেশবাবুর বাড়ি—জুতো খুঁজতে।’
‘জুতো! কোন জুতো? আমরা জুতো খুঁজব কেন?’
‘সেই জুতো—যা সীতেশ মল্লিক অর্ডার দিয়ে তৈরি করেছে। যার পায়ের কাছে হিলের বদলে ঘোড়ার নালের মতো লাগানো আছে লোহার থাবা।’
‘লোহার থাবা!’ বিস্ময়ে কথা সরে না অমিতাভর।
সুসজ্জিত পুলিশ ফোর্স নিয়েই রওনা হলেন অমিতাভ। সঙ্গে চললেন সঞ্জয় ও সিল্কি। আকস্মিকভাবে অমিতাভদের আসতে দেখে চমকে উঠল সীতেশ। সে-ভাব গোপন রেখেই অভ্যর্থনা জানাল : ‘আসুন, কিনারা হল কিছু?’
‘হয়েছে, আপনার বাবার লাশ পাওয়া গেছে এক মাইল দূরে মড়া ফেলার আস্তানায়। তাঁকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে।’
‘সেকি?’ সীতেশের গলা খুব অস্পষ্ট শোনাল।
‘আমরা বাড়ি সার্চ করব।’
সীতেশ কোনও উত্তর দিল না। অমিতাভ ও সঞ্জয় উঠে পড়লেন। সিল্কিকে নিয়ে সঞ্জয় উপস্থিত হলেন সনাতন মল্লিকের ঘরে। অমিতাভকে বললেন কালী ও রঘুকে ডেকে আনতে। তারা আসতেই তিনি কালীকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘কালী, তুমি দড়িটা কেটেছ কেন?’
‘দড়ি! না বাবু, আমি কাটিনি।’
‘মিথ্যে কথা বোলো না।’ ধমক লাগালেন অমিতাভ।
‘কালী, তুমি সনাতনবাবুর লাশ ফেলে এসেছ বেওয়ারিশ মড়া ফেলার জায়গায়—আমরা খোঁজ পেয়েছি, তুমি তাঁকে খুন করেছ—।’
হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল কালী : ‘হুজুর মা-বাপ আমার…আমি খুন করিনি…।’
‘তবে কী করেছিস?’ আবার ধমকে উঠলেন অমিতাভ।
‘বিকেলে ছোটবাবুর কথায় দড়িটা কেটে দিয়েছিলাম শুধু। ছোটবাবু সেদিন বাগানে পাহারা দিতে বলেছিলেন বলে অনেকক্ষণ ছিলাম।’
‘মালি কোথায় গেছিল?’
‘ছোটবাবুর সঙ্গে বেরিয়েছিল, হুজুর।’
‘আপনি কোথায় গিয়েছিলেন, সীতেশবাবু?’
‘মাইলতিনেক দূরে একটা গাছ দেখতে—একরকমের লতা—রাজ্যের ফুল ফোটে। মালিকে নিয়ে গেছিলাম, কোনও চারা পেলে তুলে আনব বলে। সুন্দর ফুল!’
আচম্বিতে প্রশ্ন করেন সঞ্জয়, ‘যাওয়ার আগে মোমবাতি হাতে সনাতনবাবুর ঘরে এসেছিলেন কেন, স্নানের তোয়ালে নিয়ে?’
‘আমি আসিনি।’
‘তাহলে আলনায় পড়ে থাকা ওই তোয়ালেটা আপনার নয়?’
সিল্কিকে তোয়ালেটা শোঁকাতেই সে সীতেশের দিকে তেড়ে এল। সীতেশ বিবর্ণ হয়ে বসে পড়ে।
সঞ্জয় মৃদু হেসে বললেন, ‘অমিতাভ, বাড়ি সার্চ না করে বাগানের মাটি খুঁড়ে খুঁজে দেখো তো, লোহার থাবাওয়ালা দু-জোড়া জুতো পাও কিনা।’
সঙ্গে-সঙ্গে সীতেশ লাফিয়ে উঠল। তা দেখে সঞ্জয় বললেন, ‘আর অস্বীকার করে কোনও লাভ নেই, সীতেশবাবু। মাধব কামার স্বীকার করেছে। অমিতাভ, তুমি সীতেশবাবু আর মালিকে গ্রেপ্তার করতে পারো।’
অমিতাভ ইঙ্গিত করতেই সীতেশ এবং মালিকে অ্যারেস্ট করা হল। কিছুক্ষণ পরে বাগানের ঘন ‘বোগেনভিলিয়া’ গাছের নীচে, মাটির তলা থেকে, জুতো নিয়ে এল অন্যতম সার্জেন্ট। সবাই দেখল, সাধারণ জুতোর মতোই, শুধু জুতোর তলায় মুখের দিকে এবং গোড়ালির দিকে দুটো করে লোহার থাবা বসানো রয়েছে ঘোড়ার নালের মত।
অমিতাভ বললেন, ‘চমৎকার!’
সঞ্জয় বললেন, ‘এই জুতো পরেই সীতেশ মল্লিক এবং তার সহকারী মালি সনাতনবাবুর মৃতদেহ ফেলে এসেছে। তার আগে রাত দশটার পরে সীতেশ মোমবাতি নিয়ে সনাতনবাবুর ঘরে ঢোকে। তোয়ালে দিয়ে তাঁর মুখ চাপা দিয়ে গলা টিপে হত্যা করে। তারপরই সীতেশ বুদ্ধির খেলা দেখিয়েছে। শেয়ালের থাবা লাগানো জুতো পরে লাশ ফেলে এসেছে এক মাইল দূরে। ফেরবার সময় জুতো খুলে রেললাইন ধরে হেঁটে বাড়ি ফিরেছে। তাই শেয়ালের ফেরার চিহ্ন আমরা দেখিনি। নরম মাটিতে মানুষের ওজন এবং সনাতনবাবুর ভার বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে দাগগুলো গভীর হয়েছে। মোমবাতি নিয়েছিল—সহজে নিবিয়ে অন্ধকার করা চলে বলে। দড়ি কাটা হয়েছিল রঘু যাতে কিছু না শুনতে পায়। তাড়াতাড়িতে তোয়ালেটা নিয়ে যেতে পারেনি সীতেশ। এর পরিকল্পনা ছিল দীর্ঘদিনের—সেদিনের সন্ধ্যার ঝগড়া কিছু নয়। তাই না, সীতেশবাবু?’
সীতেশ মল্লিকের মাথাটা মাটির দিকে ঝুঁকে আসে।
মাসিক রোমাঞ্চ
মার্চ, ১৯৭১