লোটন ষষ্ঠীর কথা
এক ব্রাহ্মণীর এক ছেলে, একটি বউ, আর একটি মেয়ে। মেয়ের তিনটি ছেলে আর বউয়ের সাত ছেলে। পাড়ার লোকেরা বলে, ‘আহা! ব্রাহ্মণীর কী বরাত, মা ষষ্ঠী যেন ডাল ভেঙে পড়েছেন! ব্রাহ্মণীর সময়ও ভালো, ছেলে দশ টাকা রোজগার করে, মাকে ভক্তি করে।’ শ্রাবণ মাস, শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীর দিন গিন্নি ষষ্ঠী পুজোর আয়োজন করছেন, তাঁর সোনার ছয়টি লোটন ছিল, তাই দিয়ে বছর বছর ষষ্ঠী পুজো করেন। গিন্নি কৌটো খুলে দেখেন যে তাঁর তিনটি লোটন আছে আর তিনটি নেই। তখন গিন্নি বউকে ডেকে বললেন, ‘বউমা! আমার এ সর্বনাশ কে করলে? লোটন কে চুরি করেছে? মা ষষ্ঠীর জিনিস কার নিতে ভরসা হল?’ এই কথা শুনে বউ কেঁদে-কেটে ছেলের মাথায় হাত দিয়ে দিব্বি করলে, ‘আমি যদি লোটন নিয়ে থাকি, তাহলে আমার সাত বেটার মাথা খাই।’ মেয়েকে জিজ্ঞাসা করতে মেয়ে বললে, ‘আমি জানি না মা, তোমাদের বাড়ি আমি ক-দিনই বা আছি? এই আজ বাদে কাল শ্বশুরবাড়ি চলে যাব।’ গিন্নি কোনো কথা না বলে ক্ষীরের লোটন গড়ে ষষ্ঠীকে দিলেন। বউ মনের দুঃখে সে দিন আর কিছুই খেলে না। সমস্ত দিন কেঁদে কেঁদে রাত্রে আশে-পাশে সাতটি ছেলে নিয়ে শুয়ে রইল। স্বামী এসে সমস্ত শুনলে, শুনে রেগে বউকে কিছু না বলে, মার কাছে শুয়ে, মায়ে বেটায় কত কথা কইতে কইতে ঘুমোল।
তার পর দিন সকলে ঘুম থেকে উঠে দেখে যে, বউয়ের সাতটি ছেলে মরে রয়েছে। বউ কেঁদে পাড়া মাথায় করলে। তখন মেয়ে বলতে লাগল—‘দেখলে মা, দেখলে দাদা, ও লোটন বউ ঠিক নিয়েছে, তা না হলে আর এ সর্বনাশ হয়! কীরকম রাক্ষুসী দেখলে, ঠাকুরের জিনিস চুরি করে আবার ছেলের মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি? মর মর, দূর করে দাও, ওর মুখ দেখতে নেই।’ বউ কাঁদতে কাঁদতে ঘরের দরজা বন্ধ করে মরা ছেলেগুলি বুকে করে নিয়ে পড়ে রইল। সমস্ত দিন গেল। ছেলেদের পোড়াবার জন্যে স্বামী এসে দরজা খুলতে বললে, বউ কিছুতেই দরজা খুললে না। মা ষষ্ঠীর দয়া হল। তিনি রাত্রে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণীর বেশ ধরে বউ-এর ঘরের ভিতর এলেন। বউ বললে, ‘কে মা তুমি! এখানে কেমন করে এলে?’ মা ষষ্ঠী বললেন, ‘আমি কেউ নই বাছা! বলি, তুই আবাগী ছেলের মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি করলি, আবার কাঁদছিস!’ বউ বললে, ‘আমি তো লোটন নিইনি মা! তাই দিব্যি করেছি।’ ষষ্ঠী ঠাকরুণ বললেন, ‘ছি মা, তুমি সাত ছেলের মা হলে, তোমার কি এই কাজ! সত্যি হোক, মিথ্যে হোক, কখন ছেলের মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি কোরো না।’ এই বলে তিনি বাঁশপাতা ঝেড়ে ছেলেদের গায়ে জলের ছিটে দিতেই, সাতটি ছেলে বেঁচে উঠল। ছেলেগুলো বলতে লাগল, ‘মা গো মা! এত ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, আমাদের ডাকনি? বড়ো ক্ষিদে পেয়েছে, কিছু খেতে দাও মা।’ এদিকে মা ষষ্ঠী অন্তর্দ্ধান হয়েছেন। বউ চেয়ে দেখে দেখে যে মা নেই, খালি ছেলেরা চেঁচাচ্ছে। খানিক পরে সকাল হল। বউ ছেলেপুলে নিয়ে দরজা খুলে দেখে যে ননদের তিনটি ছেলে মরে গেছে! গিন্নী এই সব দেখে অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, এ কী ব্যাপার! স্বামী বউয়ের মুখে রাত্রের ঘটনা শুনে অবাক হলেন। মেয়ের ঘুম ভাঙতে চেয়ে দেখে যে তার তিনটি ছেলেই মরে গেছে। সে কেঁদে-কেটে বাড়ি মাথায় করলে। মায়ে ঝিয়ে মা ষষ্ঠীর কাছে মাথা খুঁড়তে লাগলেন।
এমন সময় দৈববাণী হল—‘জানিস না মাগি! তোর মেয়ে আমার লোটন চুরি করে আবার পরের মেয়ের নামে দোষ দিয়ে সতী হয়েছে! এখন কাঁদতে লজ্জা করে না? যদি ভালো চাস তো তোর মেয়েকে বউ-এর পায়ে ধরতে বলগে যা।’ তখন আর কারও কিছু জানতে বাকি রইল না। ননদ ভাজের পায়ে ধরে কাঁদতে লাগল। বউ বললে, ‘ভয় কী ঠাকুরঝি! মা যখন দয়া করেছেন, তখন আর ভাবনা নেই। তুমি লোটন বার করে দাও, তোমার ছেলেরা বাঁচবে। মার কোপে তোমার এমন হয়েছে, এখনি মার দয়া হবে, তুমি লোটন বার করে দাও।’ তখন ননদ তাড়াতাড়ি বাক্স খুলে লোটন বার করে দিলে।
বউ তখন সেই মা ষষ্ঠীর দেওয়া বাঁশপাতার জল ছেলেদের গায়ে ছিটিয়ে দিতেই তিনটি ছেলে উঠে বসল! বউ-এর এই অদ্ভুত ক্ষমতা দেখে সকলে তাকে দেবতার মতো ভক্তি করতে লাগল। বোনকে ভাই ছি-ছি করতে লাগল। বললে ‘তোর পাপেই আমার ছেলে মরেছিল, তোর ছেলেও মরেছিল। ভাগ্যিস অমন বউ পেয়েছিলুম, তাই তার পুণ্যে আজ সব হারানো ধন পেলুম।’ ননদ ভাজের কাছে গিয়ে পায়ে ধরে মাপ চাইলে, দাদার পায়ে ধরে মাপ চাইলে। গিন্নি মেয়েকে বকতে লাগলেন। মেয়ের লোটন চুরির কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। বউকে সকলে ভালোবাসতে লাগল। বউ-এর সুখ্যাতি, আর মা ষষ্ঠীর দয়া দেশ-বিদেশে প্রচার হল। সেই থেকে সকলে শ্রাবণ মাসে এই লোটন ষষ্ঠীর পূজা করে। লোটন চুরি করার জন্যে সকলে এতে লোটন ষষ্ঠী বা লুন্ঠন ষষ্ঠী বলে। এই ষষ্ঠী করলে ছেলেপুলে কখনও অকালে মরে না।
লোটন ষষ্ঠীর কথা সমাপ্ত