2 of 2

লাল ভেটকি – বুদ্ধদেব গুহ

লাল ভেটকি – বুদ্ধদেব গুহ

সুন্দর জায়গা না? বল? হাতে ঢেউ তুলে সুগত আমায় বলল। বালিয়াড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে চোখ চাইতেই দেখলাম, সুগতর হাতের ঢেউ লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ঢেউ হয়ে ঘন নীল সমুদ্রের ওপর নাচছে। শীতের দুপুরের সুপুরুষ রোদ, সুন্দরী সমুদ্রের সুগন্ধি গ্রীবায় আলতো ভাবে চুমু খেয়ে ভিন্‌দেশি হাওয়ার সঙ্গে ছুটে পালাচ্ছে। সমস্ত সৈকত-রেখায় কোনও লোক নেই, কোনও নুলিয়া নেই, অসংবৃত-বস্ত্র, সলজ্জা কোনও স্থূলাঙ্গী মহিলা পর্যন্ত নেই—আদিগন্ত সৈকত-রেখায় কোনও প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই—কেবল ছোট ছোট বাদামি কাঁকড়াগুলো গর্ত থেকে বেরিয়ে নোনা ফেনায় হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে। একটু আগে একটি একলা কৃষ্ণসার হরিণ ভিজে বালির ওপর দিয়ে হেঁটে গেছে, কেবল তার পায়ের দাগ।

পিছন ফিরে চাইলাম—সেদিকে চেয়েও চোখ ফেরানো যায় না। খয়েরি ও পাটকিলে বালিয়াড়িতে সুতনুকা ছিমছাম ঝাউবনের সারি। তা পেরিয়ে চিলকা হ্রদ এক ফালি অতিকায় বেলজিয়ান আয়নার মতো পড়ে রয়েছে। এক খণ্ড সারস-সাদা মেঘের এবং উড়ে চলা ফ্লেমিংগোর ঝাঁকের শ্বেত এবং কমলা রঙা ছায়া পড়েছে। ঝাউবনের চুলে সামুদ্রিক হাওয়া এসে শিস দিয়ে চিরুনি বুলোচ্ছে। বাঁদিকে এক ঝাঁক কৃষ্ণসার হরিণ খুরে খুরে বালি ছিটিয়ে এক্কা-দোক্কা খেলছে।

বসে পড়লাম। সুগত বলল, কী রে পছন্দ তো?

আমি মুখ ঘুরিয়ে বললাম, ভীষণ।

তুই আগে এসেছিস এখানে? শিকারেই?

ধ্যাৎ, শিকার-টিকার করতে আমার ভাল লাগে না। এমনি এসেছি—।

রাইফেলের নলে হাওয়ার সঙ্গে বালি ঢুকেছিল। পকেট থেকে রুমাল বের করে নলের মুখ বেঁধে দিলাম। সুগত বলল, ‘নেঃ, একটা সিগারেট খা। তারপর সিগারেটটা ধরিয়ে বলল, তোর কাছে তো লুকোবার নেই কিছু—এ জায়গাটায় আমার হার হয়েছিল।

আমি শুধোলাম, হার হয়েছিল মানে?

ও বলল, সে কথা শুনে কি হবে? ‘গেছে যে দিন একেবারেই গেছে।’

জোয়ার আসছে। ঢেউগুলোর মধ্যে সবে-গোঁফ-ওঠা-ছেলেদের মতো একটা অস্থিরতা জেগেছে।

এবারেও আমরা নৌকো করেই এসেছি। উদ্দেশ্য, চিলকায় পৃথিবীর নানান কোণ থেকে উড়ে আসা মৌসুমি পাখি এবং ছরপড়িয়ার কৃষ্ণসার হরিণ শিকার। কাবাব খাবার জন্যে রাতের বেলা ঝাউবনে খরগোশেরও অভাব নেই। বন্দুক নিয়ে বেরুলেই হল। পুরী থেকে চোরা শিকারিরা পায়ে হেঁটে চলে আসে রাতারাতি হরিণ খরগোশ মেরে পালায়। সুগত থাকে ভুবনেশ্বরে—সেখানকার এক সাহেব কোম্পানির ও ম্যানেজার। বন্ধুমহলে গুজব শুনেছিলাম, এক পেত্নির প্রেমে পড়ে ওর নাকি মাথা প্রায় খারাপ হবার উপক্রম হয়েছিল। ওর মতো ছেলে সম্বন্ধে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য শুনে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি—বিশ্বাস করিওনি। সুগতই অনেক দিন থেকে লিখছে একবার এদিকে আসতে। চিলকায় অনেকবার এলেও চিলকার সঙ্গে সমুদ্রের যেখানে সম্পর্ক, সেই ছরপাড়িয়ায় এর আগে কখনও আসিনি। তাই এবার চলেই এলাম। এসে দেখছি, ভালই করেছি।

পিঠের হ্যাভারস্যাক থেকে খুলে থার্মোফ্লাস্কটা বের করে বালির ডানলোপিলোয় পা ছড়িয়ে বসল ও, তারপর আমাকে একটা কফি ঢেলে দিল, তারপর শুধোল, এত তাড়াতাড়ি নৌকোয় ফিরে কি হবে? এখানে সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখেই ফেরা যাবে। আমি বললাম, খুব ভাল কথা। সুগত সাহিত্যের ছাত্র ছিল, য়ুনিভার্সিটিতে থাকাকালীন গেরুয়া পাঞ্জাবি পরত ও কবিতা লিখত। সুতরাং বুঝলাম, এই পরিবেশে ওর ভাবের উদয় হয়েছে। এই অবস্থায় শিকারের কথা বললে আমাকে একটা আকাট জংলি ঠাওরাবে।

কফি শেষ করে আরও একটা সিগারেট শেষ করল সুগত। তারপর জ্বলন্ত টুকরোটা দু আঙুলে নাড়াচাড়া করতে করতে কি ভাবতে ভাবতে জলের দিকে ছুড়ে ফেলল। তারপর হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলল, তোকে বলেই ফেলি বুঝলি—অনেকদিন ধরে ভেবেছি কাউকে বললে বোধহয় বোঝাটা হালকা হবে। আমি মাথাটা হাতে রেখে বালির ওপর কাত হয়ে শুয়ে বললাম, ‘বল।’

সুগত সমুদ্রের দিকে ঘুরে বসল—যেন সমুদ্রকেই বলবে, যা বলার, কিংবা সমুদ্রকেই কনফেশনাল কবে। ঢেউগুলো ফুলে ফুলে উঠছে। সুগত শুরু করল—।

গত বছর বড়দিনের ছুটিতে এখানে এসেছিলাম। নৌকোয় তোফা খাই দাই—সকালে পদচারণা করি—। দুপুরে সাঁতারের পোশাক আর ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে এইখানে চলে আসতাম—সারা দুপুর খেয়াল-খুশিমত জলরঙের ছবি আঁকতাম, তারপর দুপুর একটু নিস্তেজ হলে, থার্মোফ্লাস্ক থেকে ঢেলে এক পেয়ালা কফি খেয়ে সাঁতারের পোশাক পরে সাঁতার কাটতে নামতাম। যতক্ষণ না সূর্য অস্ত যেত ততক্ষণ সাঁতার কাটতাম।

আমি শুধোলাম—এখানে এই জনমানবশূন্য সৈকতে তো শুনেছি অনেক হাঙর আছে। তোর ভয় করত না?

সুগত বিবক্ত হয়ে বলল, হাঙর তো ডালহাউসি স্কোয়ারেও আছে, তা বলে কি তুই ভয় করিস?

বুঝলাম, ওর জবানবন্দিতে বাধা হয়ে পড়ে, এমন কিছু ও পছন্দ করছে না। চুপ করে গেলাম।

ও বলল, একদিন এমনি দুপুর বেলা এখানে আসছি। বালি তেতে আগুন। পাতলা চটি পায়ে দিয়ে আসছি, এইখানে এসে এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল। একটি বিরাট বহুবর্ণ-ছাতা বালিতে পোঁতা রয়েছে এবং হালকা-বেগুনিরঙা সাঁতারের পোশাকে একটি মেয়ে ডানলোপিলো ম্যাট্রেসের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে ইংরেজি পেপারব্যাক পড়ছে। চোখে সান-গ্লাস। এক ঝলক দেখে যেমন বুকটা ধ্বক করে উঠল তেমনি মনটা বিরক্তও হল। এতদিন এই বেলাভূমি ছিল আমার একার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মালিকানায় একে আমি ভোগ করেছি। কোথা থেকে এরা এল? আমার পায়ের শব্দ মেয়েটি শুনেছিল, এবং একবার মুখ ঘুরিয়ে দেখেছিল। চমৎকারভাবে খোঁপা বেঁধেছিল, সানগ্লাসে চোখ ঢাকা ছিল; কিন্তু মুখের গড়ন যে ভারী মিষ্টি, তা প্রথম দর্শনেই বুঝেছিলাম। শরীরের গড়ন যে ভাল সে বিষয়েও সন্দেহ ছিল না, কিন্তু খুঁচিয়ে কোনও রমণীর শরীর চোখ দিয়ে চাটবার মতো অশালীনতা আমার নেই, এবং তখনও ছিল না। আমাকে দেখে মেয়েটি বলল, হ্যালো।’ ব্যাস, ওই পর্যন্ত। পাশ কাটিয়ে আমি বাঁদিকে যত দূরে পারি গিয়ে আস্তানা নিলাম এবং মনে মনে মেয়েটির মুণ্ডপাত করতে লাগলাম।

সেদিন স্নান করে যখন ফিরছি তখনও বেলা ছিল। ওকে দেখা গেল না। ছাতাটিকেও না। বোধহয় অনুচর এসে নিয়ে গেছে। কিন্তু বালির ওপর জলের পাশে বেগনেরঙা কি একটা জিনিস চোখে পড়ল, কাছে গিয়ে দেখি মেয়েদের চান করবার রাবারের টুপি। টুপিটি কুড়োতে গিয়েই চোখে পড়ল ভিজে বালির ওপর কে যেন গভীরভাবে দাগ কেটে লিখেছে, “নির্জনতার ভাগ দেওয়ার জন্যে অশেষ ধন্যবাদ’। লিখেছে ইংরেজিতেই।

নৌকোয় ফিরেই শুনলাম, ছরপড়িয়ার অপর পারে একটি নীল মোটরবোট এসে লেগেছে। তার যাত্রী এক সাহেব, মেমসাহেব ও তাদের কন্যা। বাঙালি সাহেব কি মাড়োয়ারি সাহেব কি ইংরেজ সাহেব—মাঝি অত বলতে পারল না। তবে সাহেবেরা যে বিলক্ষণ এসেছেন বুঝতে পারলাম—যখন রাতের বেলা চিলকার জলের ওপর কাঁপতে কাঁপতে দূরাগত ইংরেজি গানের শব্দ ভেসে এল। ‘মাই ফেয়ার লেডি’র গান বাজছে রেকর্ড প্লেয়ারে ‘Isn’t it loverly, loverly, loverly?’

পরদিন যথাসময়ে যখন গেলাম, দেখলাম মেয়েটা একা নয়, সঙ্গে একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক ও প্রৌড়া ভদ্রমহিলা। ভদ্রলোকের মাথাভরা টাক—বুকভরা চুল—এবং চোখভরা বুদ্ধি। নদনদে ভুঁড়ির ওপরে লাল রঙা সুইমিং ট্রাঙ্ক। ভদ্রমহিলা বিপুলা। এই যদি মা হন, তাহলে এমন মেয়েরও এই বয়সে এই অবস্থা হবে। ভাবা যায় না। পাশে একজন ছোকরা চাকর বীয়ারের বোতল আগলাচ্ছে এবং মালিকের খিদমদ্‌গারী করছে।

টুপিটি ফেরত দেওয়াতে অনেক ধন্যবাদ প্রাপ্তি হল। জানা গেল, ভদ্রলোক মুখ্যত শিকারেই এসেছেন—তবে সেই ফাঁকে সমুদ্র আবিষ্কার করার, একটু চান-টানও করে নিচ্ছেন।

সেদিন ছবি আঁকা শেষ করে তাড়াতাড়ি স্নান সারলাম এবং স্নান সেরে মাথায় কি যে দুষ্ট গ্রহ ভর করল, আমার তোয়ালেটি বালিতে ফেলে রেখে তার পাশে তুলির উলটো দিক দিয়ে গভীরভাবে লিখলাম, ‘নির্জনতা, শুধুই নির্জনতা, মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে।’ ইংরেজিতেই লিখলাম। যদিও, আজ ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করে বুঝলাম তাঁরা ভারতীয়। পাঞ্জাবিও হতে পাবেন, সিন্ধীও হতে পারেন, ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না।

তার পর দিন আমার তোয়ালে ফেরত পেলাম। ভদ্রমহিলা আমার আঁকা ছবি চাইলেন এবং ওদের নৌকোয় সে রাতে খেতে বললেন। মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন, নাম বললেন, মিতা, কলকাতার কলেজে পড়ে—খুব নাকি ভাল সাঁতার কাটে—সাঁতার কাটতে নাকি অষ্ট্রেলিয়া না নিউজিল্যান্ড কোথায় গিয়েছিল। মেয়েটিকে সেদিন ভাল করে দেখলাম। এত চমৎকার গড়ন যে ভারতীয় মেয়েদের হয় আমার জানা ছিল না। আজ একটা বাদামি রঙা সাঁতারের পোশাক পরেছে। মনে হল, এই বাদামি বালি, এই বাদামি রোদ, এই বাদামি পোশাক সবকিছু মিলে মেয়েটির শরীর থেকে কোনও জ্বালা বিকীরিত হচ্ছে। যে জ্বালা দেখা যায় না কিন্তু চোয়ালের দিকে চাইলে, সানগ্লাসে চোখ ঢাকা থাকা সত্ত্বেও সে জ্বালা বোঝা যায়। প্রচণ্ড উষ্ণ গ্রীষ্ম মধ্যাহ্নে খয়েরি মাটিতে ছটফট-করা কোনও বাদামি তিতির বলে মনে হল আমার মেয়েটিকে।

সেদিন আমি যখন ছবি আঁকছিলাম তখন মেয়েটি চান করতে লাগল। সমুদ্রে কাউকে চান করতে দেখলে যে অত ভাল লাগে আমি জানতাম না। বিরাট বিরাট ফণা-তোলা নীলাভ-স্বচ্ছ ঢেউয়ের বুক ফুঁড়ে ফুঁড়ে মিতা একটি বাদামি তপসে মাছের মতো সাঁতার কাটতে লাগল। কী সুন্দর বক্র রেখায় শরীরটিকে মাছের মতো বেঁকিয়ে হাত দুটিকে সামনে প্রসারিত করে সে সমুদ্রকে উপহাস করে করে তাকে যেন ক্ষেপিয়ে তুলল। তরঙ্গগুলি বুদবুদ তুলে বিড় বিড় করতে করতে বালিতে এসে গড়িয়ে পড়তে লাগল—আমার মনে হল ওরা মিতাকে দেখে স্তুতি করে তালে তালে গাইছে ‘Isn’t it lover- ly, loverly, loverly?’

রাতে ওদের বোটে গেলাম। খুবই ছোট বোট, কিন্তু নেই এমন জিনিস নেই। কেরোসিনের ফ্রিজ খুলে হুইস্কি সাধলেন ভদ্রলোক। প্রত্যাখ্যান করতেই মেয়েটি বলল, ‘হাউ ইজ ইট? ইভিন নাউ এ টিটোটালার?’ খেতে খেতে মিতার সঙ্গে অনেক গল্প হল। ও বলল, আমি পরের জন্মে মাছ হয়ে জন্মাব। আমার কাছ থেকে ছবি চাইল। আমি বললাম যাবার আগের দিন দেব।

সেদিন অনেক রাত অবধি আমার ঘুম হল না। মিতা কি একটা উগ্র সুরভি মেখেছিল। আমার বালিশে তার গন্ধ পাচ্ছিলাম। শেষ রাতে স্বপ্ন দেখলাম একটা বদমাইস উদবেড়াল সুন্দরী একটি রূপসী মাছকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে—সমুদ্রে—নাকে নোনা জলের গন্ধ পাচ্ছি—জলের তোড় খুব বেশি বোধহয়; ভরা জোয়ার—আতঙ্কে ঘুম ভেঙে গেল—দেখলাম উদটির মুখটি অবিকল আমার মতো।

এই অবধি বলে সুগত থামল। দেখলাম ওর কষ্ট হচ্ছে। ও একটা সিগারেট ধরাল। সূর্যের তেজ কমে এসেছে। একটি সী-গাল কোথা থেকে উড়ে এসে আমাদের সামনে বসল। হঠাৎ সুগতকে শেষ সূর্যের সোনালি আলোয় খুব সুন্দর বলে মনে হল আমার। কালো চেহারায় এমন একটা করুণ আভিজাত্য আছে কি বলব। মাথা ভরা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, টিকোলো নাক—। সব মিলিয়ে ভারী সুন্দর দেখাতে লাগল।

সিগারেটটাতে বড় একটা টান লাগিয়ে সুগত আবার শুরু করল—

পরদিন হাঁটতে গেলাম না সকালে—নৌকোয় বসে বসে একটি ছবি আঁকলাম। সমুদ্রের ঢেউয়ে একটি সুন্দরী রূপোলি মাছ নাচছে এবং বালির ওপর একটি মৃত রক্তাক্ত উদ পড়ে রয়েছে। ছবিটা এঁকে খুব আনন্দ হল। কেন জানি না, মনে হল মিতার মতো মাছের জন্যে অনেক উদ অনেকবার মরতে পারে।

সেদিন বিকেলে মিতাকে দেখলাম একা রঙিন ছাতার তলায় বই পড়ছে। আমাকে ওখানেই বসতে অনুরোধ করল। আমি সকালে আঁকা ছবিটা ওকে দিলাম। ও শুধলো, এ ছবির কি কোনও মানে আছে? আমি বললাম, ‘মানে নেই।’ মিতা বলল, চলুন আজ আমরা একসঙ্গে সাঁতার কাটি। আমি বললাম, আপনি আগেই নামুন। আপনি ভীষণ ভাল সাঁতার কাটেন। মিতা ঠেটি উল্টে বলল, ‘ভাল সাঁতার কেটে কি লাভ? যদি সারাজীবন একা-একাই সাঁতার কাটতে হয়।’ কেন জানি না, আমার মনে হল ওর কথার পেছনে কোনও ইঙ্গিত আছে—অনামা যন্ত্রণার নিরসনের পথ জানে না ও—যে আগুনে জ্বলছে তার নাম জানে না। তারপর ও উঠে পড়ে বলল, আপনি ভীষণ লাজুক—ছেলেরা এত লাজুক হলে ভাল লাগে না। আমি উত্তর দিলাম না। চুপ করে বসে ছবি আঁকতে লাগলাম। মিতা জলে নেমে গেল। হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ফিরে বলল, বর্তমানটাই কিন্তু সত্যি। ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই—আপনি বিশ্বাস করেন না?’আমি জোরে চেঁচিয়ে বললাম, ‘ভবিষ্যতে আমি বিশ্বাস করি’—হাওয়া আর ঢেউয়ের শব্দ আমার কথা ডুবিয়ে দিল।

মুখ নিচু করে ছবি আঁকছিলাম এমন সময় ‘বাঁচান বাঁচান’ চিৎকার শোনা গেল। চমকে তাকিয়ে দেখি মিতা অনেক দূরে চলে গেছে—ঢেউগুলো কেঁপে উঠেছে—জলের ওপরে খুব নিচু হয়ে এক ঝাঁক সীগাল উড়ছে। কী হল? হাঙর না আন্ডারকারেন্ট? যত তাড়াতাড়ি গিয়ে জলে পড়লাম এবং যত জোর আমার বুকে ছিল সব জোর দিয়ে দু হাতে জল কেটে এগোতে লাগলাম।

আজ মিতা একটা কমলা রঙা পোশাক পরেছে। এই ওকে দেখতে পাচ্ছি। এরই মধ্যে ঢেউ এসে ওকে আড়াল করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে ডুবে যাচ্ছে হাত দুটো উপরে তুলছে, ঢেউয়ের তোড়ে একবার পিছিয়ে আসছে আবার পরক্ষণেই এগিয়ে যাচ্ছে। কোনওক্রমে ওর কাছে গিয়ে পৌঁছতেই প্রাণভয়ে ও আমাকে জড়িয়ে ধরল—আমার মনে হল আমিও ডুবে যাব। ওর গায়ে আমি গুলিবিদ্ধ ফ্লেমিংগো পাখির ডানার গন্ধ পেলাম। তেমনি আঁশটে গন্ধ; নোনা গন্ধ। পরক্ষণেই ঢেউ-ভাঙার শব্দের সঙ্গে গলা মিলিয়ে জলের মধ্যেই মিতা গেয়ে উঠল ‘Isn’t it loverly, loverly, loverly?’ এবং আমাকে চমকে দিয়ে আমাকে ছেড়ে কুলের দিকে সাঁতরে গেল। কিছুই হয়নি? মিছিমিছি আমাকে এত বড় ভয় পাওয়াল? আমি ওকে তাড়া করে গেলাম। ও একটি লাল সামুদ্রিক ভেটকির মতো নীল জলে মোড় নিয়ে আমাকে চেঁচিয়ে বলল, ‘বর্তমানটাই সত্যি। আমি ঢেউয়ের মধ্যে বুড়বুড়ি তুলে বললাম, ‘সত্যিই যে সত্যি’, তা দেখাচ্ছি।

তারপর, জলে আর মরা ফ্লেমিংগোর আঁশটে গন্ধ থাকল না। সেই স্বপ্নে-পাওয়া সুগন্ধিতে সমস্ত সমুদ্র সুরভিত হয়ে উঠল—আমার রুপোলি মাছের সঙ্গে সাঁতার কাটতে লাগলাম। সূর্যের তেজ পড়ে আসতে লাগল। মিতা বালিতে উঠে বিস্তীর্ণ সৈকতে দুটি হাত কাঁধসমান তুলে, তুড়ি দিয়ে দিয়ে নেচে নেচে গাইতে লাগল, ‘Isn’t it loverly. loverly, loverly?’ বোধ হয় আমিও ওর সঙ্গে নেচেছিলাম। তারপর সূর্য-না-ডোবা পর্যন্ত আমার কোলে মাথা রেখে বালিতে শরীর এলিয়ে মিতা শুয়েছিল। আমি হাত দিয়ে ওর ভেজা চুল কপাল থেকে সরিয়ে দিয়েছিলাম—ওর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়েছিলাম। আমার ঠোঁটে সেই গন্ধ এখনও লেগে আছে।

সারা রাত মিতার কথা ভাবলাম। পরদিন যেন আর তর সইছিল না। কখন সমুদ্রে যাব। সমস্ত রাত কানের মধ্যে বেজেছে মিতার বেসুরো গলার দুষ্টুমিভরা মিষ্টি গান ‘Isn’t it loverly, loverty, loverly?’ বেজেছে, ঢেউয়ের শব্দ; হাওয়ার শিস। নৌকো ছেড়ে বেরোতে যাব, এমন সময় মাঝি আমায় কথায় কথায় বলল যে, সেই সাহেবদের নীল বোটটি একটু আগে চলে গেছে। আমার বিশ্বাস হল না। বালি ভেঙে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়লাম। সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে দেখি সেখানে কেউ নেই—কাঁকড়াগুলো দৌড়োদৌড়ি করছে, হাওয়াটা দাপাদাপি করছে শুধু। হঠাৎ নীচে বালিতে রঙিন কি একটা চোখে পড়ল। দৌড়ে নেমে গিয়ে দেখি, বালিচাপা আমার সেই ছবিটি—রূপোলি মাছ সাঁতার কাটছে এবং রক্তাক্ত উদ মরে পড়ে আছে। পাশে, ভিজে বালিতে গভীরভাবে কে লিখেছে—‘বর্তমানটাই সত্যি। ভবিষ্যৎ বলে সত্যিই কিছু নেই।’ আমার মনে হল এই নীল ঢেউয়ের আড়ালে একটি লাল সামুদ্রিক ভেটকি জলে বুদবুদ তুলে খেলে বেড়াচ্ছে, যাকে আমি কোনওদিন ধরতে পাব না।

২১ আগস্ট ১৯৬৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *