লালিমা পাল স্মরণে
গল্পের পটভূমিকা কলকাতার বিখ্যাত রেসকোর্স। শীত শেষের এক উজ্জ্বল অপরাহ্নে রেসকোর্স এবং আশপাশ ভাগ্যান্বেষীদের দ্বারা কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উছলিয়ে উঠেছে। রঙিন, ঝলমলে বিচিত্র সব সাজ-পোশাকে এসেছেন বিচিত্রতর পুরুষ-মহিলারা। নীল আকাশ এবং সবুজ মাঠের মধ্যে বিকেলের রোদে তাঁদের উত্তেজনা, তাঁদের উচ্ছলতা সমস্ত গ্যালারিগুলিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে।
এইমাত্র একটা দৌড় শেষ হয়েছে। এই মুহূর্তে এক বাজির সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, গ্যালারিতে উত্তেজনা একটু কম। আরেক বাজি না আসা পর্যন্ত সবাই এখন একটু খোলামেলা আলোচনা করছে। দুই বন্ধু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। আজ পর পর তিন বাজি করে তারা দু’জনেই হেরেছে। এখন নিজেদের মধ্যে উলটোপালটা বাজি ধরছে; যেমন, আমার পকেটের রুমালটা কী রঙের অথবা সামনের মাঠের ঘাসে ওই যে কাকটা উড়ে যাচ্ছে ওটা বসবে কিনা অথবা আরও মারাত্মক, দূরের ওই ভদ্রলোকের মাথায় ওটা উইগ না সত্যিকারের নিজের চুল।
হঠাৎই এদের মধ্যে একজন একটা কঠিন প্রশ্ন করে বসল, ‘ওই যে গ্যালারির তৃতীয় ধাপে একেবারে বাঁদিকে, চোখে গোগো চশমা, একঘাড় শ্যাম্পু করা লম্বা চুল, গলায় চেন, লাল ঢিলে পাঞ্জাবি আর জিন্স পরা ওই যে হাত নাড়ছে, বলো তো ছেলে না মেয়ে?’ প্রশ্ন শুনে দ্বিতীয় বন্ধুটি ভাল করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে তাকানোর আগেই পাশের থেকে একজন ফ্যাসফ্যাসে কর্কশ গলায় বলে উঠলেন, ‘এসব কী বাজে প্রশ্ন? মেয়ে হতে যাবে কেন, ও আমার ছেলে।’
প্রশ্নকারী হকচকিয়ে গিয়ে পাশের দিকে তাকালেন। উত্তম-ছাঁট চুল, ঠোঁটে সিগারেট, প্রিন্টেড হাওয়াই শার্ট পরা ব্যক্তিটির কাছে তখনই ক্ষমা চাইলেন ওই প্রশ্নকারী, ‘দাদা, কিছু মনে করবেন
না, আপনি যে ওর বাবা, পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন সেটা বুঝতে পারিনি।’ এই ক্ষমা প্রার্থনায় ব্যক্তিটি আরও উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, ‘দাদা? দাদা কী বলছেন। বাবা-টাবা নই, আমি ওর মা।’
হিন্দু ধর্মে অর্ধনারীশ্বরের কথা আছে। কোথাও কোথাও তার মূর্তি বা ছবিও দেখেছি। এক সঙ্গে, এক দেহে, বাম অংশ পার্বতী, ডান অংশ মহাদেব হরপার্বতীর বারোয়ারি পুজোও চাক্ষুষ করেছি। অর্ধনারীশ্বর কোনও নতুন, অশিক্ষিত বা অর্বাচীন চিন্তা নয়। উমা-মহেশ্বরের এই সংযুক্ত মূর্তির বর্ণনা আছে যে মণির মতো ঝকঝকে, ত্রিনয়ন, চতুর্ভুজ এবং এই চার হাতে রয়েছে পাশ, লাল পদ্ম, নরকরোটি এবং শূল। কোনও ভক্ত পাঠকের বা ভক্তিমতী পাঠিকার ভাল লাগতেও পারে এই আশায় তন্ত্রসারে অর্ধনারীশ্বরের যে রূপধ্যান আছে সেটি লিখে দিচ্ছি—
নীলপ্রবাল রুচিরং বিল সভ্রিনেভ্রং
পাশারুনোৎপল-কপালক-শূলহস্তম্।
অর্ধাম্বিকেশমণিশং প্রবিভক্তভূষং
বালেন্দু-বদ্ধ-মুকুটং প্রণমামি রূপম্।।
ব্রাহ্মণ সন্তান, কবে নমনীয় কৈশোরকালে উপনয়নে যজ্ঞোপবীত বারণ করেছিলাম, কবে সে সব ফেলে দিয়েছি কিন্তু সংস্কারের গভীরে কোথায় কী আছে। সমাজ ইয়ার্কি, সমস্ত আধুনিকতা সত্ত্বেও শাস্ত্রের কথা, ধর্মের কথা, তন্ত্রসার কেন? সপ্তাহান্তিক এই রসিকতার কলমে নির্বোধ কিংবা ধর্মান্ধ ছাড়া কে উমা-মহেশ্বরের রূপধ্যান লিখবে।
সুতরাং পুনরাগমন। আবার ফিরে আসি নিজের নির্দিষ্ট এলাকায়। যেমন মস্তানদের, যেমন কুকুরদের আছে নির্দিষ্ট পাড়া বা এলাকা, তেমনই কলমকারের রয়েছে নির্দিষ্ট গণ্ডি।
আজ পনেরো বিশ বছর হল মাঝে মধ্যেই খবরের কাগজে সংবাদ বেরয় শল্যবিদ্যার অসাধারণ কেরামতি, নিউজিল্যান্ডের অমুক মহিলা তিন ছেলের মা একটি অস্ত্রোপচার করে পুরুষ হয়ে গেছেন। অথবা কানাডা বা অস্ট্রেলিয়া থেকে খবর আসে এ বি সি কোম্পানির শক্তসমর্থ, চোয়াড়ে, গোঁয়ার জেনারেল ম্যানেজার মিস্টার আলেকজান্ডার আর নেই। একটি অস্ত্রোপচার করে তিনি পেলব, রূপসী, তরুণীতে রূপান্তরিত হয়েছেন, এখন থেকে তাঁর নাম হয়েছে মিস এলি। মিস এলির বিগত পুরুষজন্মের দুটি সন্তান, তারা তাকে বাবা বলবে না মা বলবে, আর তাদের আসল মাকেই বা তারা কী বলে ডাকবে, এই সব বিশাল সমস্যা নিয়ে জটিল গবেষণা চলছে বলেও খবর আসে।
চিন্তার কথা আজ কিছুদিন হল কাছাকাছি নানা জায়গা থেকে এ জাতীয় খবর আসছে। এই সেদিনই পড়লাম মধ্যপ্রদেশ না হরিয়ানা কোথায় এক সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ব্যায়ামের শিক্ষয়িত্রী তাঁর নারীসুলভ ব্রীড়া ও বেশবাস পরিত্যাগ করে পৌরুষ গ্রহণ করেছেন।
এইসব ঘটনা যতটা চাঞ্চল্যকর এবং লোমহর্ষক ততটাই ভীতিপ্রদ। শুধু শাস্ত্রীয় অর্ধনারীশ্বরই নয়, সেই আয়ান ঘোষ, বৃহন্নলা, শিখণ্ডীর যুগ হতেই এরকম ঘটনাবলি শেষ পর্যন্ত খুবই গোলমেলে।
তবে আমি ডাক্তারি শাস্ত্র জানি না, মনোবিদ্যায় আমার জ্ঞান জিরো, তবু বলছি যদি কোথাও কোনও প্রকৃত পুরুষ মানুষ মহিলায় বা প্রকৃত মহিলা পুরুষে রূপান্তরিত হয়ে থাকেন, তার সঠিক প্রমাণ মিললে আমি আমার তিন মাসের মাইনের সম পরিমাণ টাকা বাজিতে হারতে রাজি আছি।
সর্বনাশ! কলম যে আবার ভারী হয়ে গেল। একেবারে স্টার্লিং সিলভার পার্কার কলমের চেয়েও ভারী। তার চেয়ে গুরুর গুরু রসসাগর পরশুরামকে স্মরণ করি।
পুরুষমানুষের মেয়েলিপনা নিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মজার গল্পটি পরশুরামের কচি সংসদ। সেই যে পেলব রায়, ‘সে গোঁফ কামাইল, চুল বাড়াইল এবং লেডি টাইপিস্টের খোঁপার মতন মাথার দু’পাশ ফাঁপাইয়া দিল। তারপর মুগার পাঞ্জাবি, গরদের চাদর, সবুজ নাগরা ও লাল ফাউন্টেনপেন পরিয়া মধুপুরে গিয়া আশু মুখুজ্যেকে ধরিল—ইউনিভার্সিটির খাতাপত্রে পেলারাম রায় কাটিয়া যেন পেলব রায় করা হয়। সার আশুতোষ এক ভলুম এনসাইক্লোপিডিয়া লইয়া তাড়া করিলেন।’ অথবা, ‘লালিমা পাল মেয়ে নয়। নাম শুনিয়া অনেকে ভুল করে, সেজন্য সে নামের পর পুং লিখিয়া থাকে।’
থাক, আর মানুষের মহিলা, পুরুষ বিচার করে লাভ নেই। সে বেশ কঠিন কাজ। মানুষ থেকে সরাসরি মাছিতে নেমে আসছি।
আমার এক প্রবাসী বন্ধু কয়েকদিনের জন্যে কলকাতায় এসে শেয়ালদা পাড়ার একটা মাঝারি হোটেলে উঠেছেন। এক রবিবারের সকাল তার সঙ্গে দেখা করতে গেছি। হোটেলের সিঙ্গল বেড ঘর, সামনের ড্রেসিং টেবিলের উপরে কাল রাতের আধখোলা সিগারেট, শূন্যপ্রায় মদের বোতল। এখনও ঘরে ঝাঁট পড়েনি। ঘরের মধ্যে ইতস্তত মাছি। দু’-একটি কুশল প্রশ্নের পর বন্ধুটি হঠাৎ বললেন, ‘তোমাদের কলকাতায় পুরুষ মাছির চেয়ে মহিলা মাছির সংখ্যা অনেক বেশি?’ আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘মাছির আবার পুরুষ মহিলা আছে নাকি?’
বন্ধুটি মৃদু হেসে বললেন, ‘ওই দ্যাখো ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় বসে যারা নিজেদের মুখ দেখছে, তারা সব মহিলা মাছি, তাদের সংখ্যা এগারো। আর ওই টেবিলের উপরে মদ, সিগারেটের উপর ঘুরছে পুরুষ মাছিরা। ওদের সংখ্যা আট।’