1 of 2

লাভ-বার্ডস

লাভ-বার্ডস

তুমি যেন কী করছিলে। কী করছিলে প্রথমে বুঝতে পারিনি। মনে আছে, মোমবাতির কাঁপা-কাঁপা আলোয় ঘর ভরেছিল, বারান্দার কাছে দাঁড়িয়ে তুমি তোমার পাখিগুলোকে খাবার দিচ্ছিলে।

তুমি আমার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়েছিলে। কাঁধ-অবধি তোমার কালো রেশমি চুলে আলোর আঙুলগুলি পিছলে যাচ্ছিল।

ঘরের দরজা খোলা ছিল, ব্ল্যাক-আউটের সময় এমন করে দরজা খোলা রাখতে নেই, তবু তুমি দরজা খুলে রেখেছিলে।

আমার পায়ের শব্দ শুনে তুমি চমকে উঠেছিলে, চমকে উঠে পেছন ফিরে চেয়েছিলে, হেসে বলেছিলে, বোসো আমি আসছি।

আমি বসে তোমাকে দেখছিলাম, তোমার পাখিগুলো দেখছিলাম। অনেকগুলো পাখি। ছোটো ছোটো হলুদ, নীল পাখি। বোকা বোকা গোল গোল মুখ, ভাষাহীন চোখ, কিন্তু ভীষণ নরম, সুখী, আদুরে পাখিগুলো। তুমি একদিন বলেছিলে, ওগুলোর নাম লাভ-বার্ডস।

পাখিগুলো প্রতিমুহূর্তে স্বাধীনতা চায়—যতক্ষণ ক্লান্তিতে না ঘুমিয়ে পড়ে ততক্ষণ খাঁচার এ-দেওয়ালে ও-দেওয়ালে আছড়ে মরে। দিনের বেলায় তোমার বারান্দা থেকে আকাশ দেখা যায়, একটা পুরোনো অশ্বত্থ গাছ দেখা যায়। অশ্বত্থ গাছে টাগরা-বের করা কাকেরা ভিড় করে। ওরা দেখতে ভালো নয়, তাই ওদের কেউ বন্দি করেনি। স্বাধীনতার আকাশভরা উষ্ণ রোদ্দুরে ওরা শীতের দুপুরে উড়ে উড়ে বেড়ায়। আর তোমার পাখিগুলো নরম সুন্দর ভালোবাসার পাখিগুলো শুধু সুন্দর বলেই খাঁচায় বন্দি থাকে আর ডানা আছড়ায়।

তুমি ফিরে এলে, আসার আগে পর্দাগুলো ভালো করে টেনে দিয়ে এলে যাতে বাইরে আলো না যায়, তার পর আমার সামনে, সাদা টাইলের মেঝেতে আসন-পিঁড়ি হয়ে বসলে, বসে বললে, কী খবর বলো?

ফলসা-রঙা তাঁতের শাড়িতে তোমাকে মোমের আলোর মতো নরম দেখাচ্ছিল।

আমি বললাম, কোনো খবর নেই। মাঝে মাঝে বাইরের এই অন্ধকার সাঁতরে তোমার কাছে এসে বড়ো শান্তি লাগে। মনে হয়, আমি যেন একটা গুলি-খাওয়া হরিণ, তোমার এই নরম নির্জন ঘরে একবার এসে পৌঁছোতে পারলে আর কোনো ব্যাধ বুঝি আমাকে খুঁজে পাবে না।

তুমি কানের পাশের চুল সরিয়ে হাসলে। তোমার দাঁতগুলো ভারি সুন্দর। হাসলে তোমাকে দারুণ লাগে। তুমি বললে, তুমি একটা বোকা।

কেন? বোকা কেন। আমার যা মনে হয় তা কি ঠিক নয়?

তুমি চুল ঝাঁকালে, বললে, ঠিক নয়।

ঠিক নয় কেন?

ঠিক নয় এইজন্যে যে, শান্তি তোমার বুকের মধ্যেই থাকে সবসময়ে, অশান্তির পাশাপাশি—তবে তুমি হয়তো তা খুঁজে পাও না, বিশল্যকরণীর মতো তা হয়তো তোমার বুকের মধ্যে জমাঢ-বাঁধা পাথরের আড়ালে আড়ালে লুকিয়ে থাকে। বুঝলে?

তার পর একটু থেমে বললে, আমার কাছেও শান্তি নেই। তা ছাড়া তুমি যেমন জানো, তোমার মতো অত বড়ো বড়ো ভাবনা, বড়ো বড়ো কথাও আমার জানা নেই। আমি আমার জীবনকে ভীষণ ভালোবাসি, এ জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমি ভালোবাসি, জীবন সম্বন্ধে আমার দারুণ উচ্ছ্বাস। এটা করব, সেটা করব, যা করতে ভালোবাসি তাই-ই করব, কারো বারণ শুনব না, মানা মানব না, তোমার মতো অতশত ভাবনা ভাবার সময় কোথায় আমার? যাকগে, এসব কথা যাক। তুমি কী খাবে বলো।

কী রান্না করেছ?

আজ? ঝাল ঝাল ভেটকি মাছের ঝোল, তপসে মাছ ভাজা আর ভাত।

আমি আসব, তুমি জানতে বুঝি?

জানতাম। আমার মন বলছিল।

রজত এখনও ফেরেনি?

তিনি আজ দেরিতে ফিরবেন।

অফিসের কাজ?

তুমি বড়ো কৌতূহলী। রোজই তো সময়মতোই আসে, মাঝে মাঝে দেরি করে এলে ভালো লাগে। আমি নিজেকে নিয়ে একটু একা সময় পাই, একটু ভাবি, জীবনে কী চেয়েছিলাম, কী পেলাম এবং এই পাওনাটুকুর বদলে কতখানি মূল্য দিলাম এসব কথা ভাবি। ভালো লাগে, বিশ্বাস করো; একা থাকতে খুব ভালো লাগে। আমি যে একটা আলাদা মানুষ, আলাদা ব্যক্তি, আমার মনের মধ্যে যে একটা আলাদা জগৎ আছে আমার, যা একেবারেই আমার, আমার নিজস্ব, তা ভেবে ভারি ভালো লাগে।

এত কথা একনিশ্বাসে বলে ফেলে তুমি বললে, কী? তুমি চুপ করে আছ যে? কথা বলবে না?

তুমিই বলো। শুনতে ভালো লাগছে।

যাই বলো, তোমরা পুরুষমানুষরা কিন্তু কোনো সময়েই আমাদের শরীর পেরিয়ে আমাদের দেখতে শিখলে না। আমরা প্রত্যেকটি মেয়েও যে মানুষ, তোমাদের মতোই এক একজন ইন্টারেস্টিং বিচিত্র মনের মানুষ, এ খবর তোমরা কখনো রাখলে না। মাঝে মাঝে ভগবানের ওপর রাগ হয়, এই মেয়েদের শরীর নিয়ে জন্মেছি বলে।

তুমি কি আমাকেও বলছ?

ঠিক তোমাকে বলিনি, সকলকেই বলছি। তুমি অন্যরকম, জানি, নইলে তোমার বই পড়ে তোমার সঙ্গে এমন করে আলাপ করতে দৌড়ে যাব কেন? তুমি জানো না, কতদিন আমি ফোন ডায়াল করে রিসিভার নামিয়ে রেখেছি, কতদিন। কতদিন কত চিঠি লিখেছি তোমাকে, লিখে ছিঁড়ে ফেলেছি, পোস্ট করা হয়নি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেবেছি, আমার চেহারাটা যে সুন্দর, (বলো? সুন্দর না?) তাই তোমার চোখ বুঝি-বা আমার শরীরটাতেই এসে দাঁড়িয়ে পড়ে, শরীরের আড়ালে, শরীর ছাপিয়ে যে মন, যে মনের জন্যেই আমরা মানুষ সেই মনটা ; বুঝি তোমার চোখ এড়িয়ে যায়। সত্যি বলছি, বড়ো ভয় ছিল। বড়ো ভয়।

এখনও আছে?

তুমি মুখ নীচু করে কথা বলছিলে এতক্ষণ। হঠাৎ মুখ তুললে, হাসলে, বললে, তোমার কী মনে হয়?

জানি না।

তুমি আবার হাসলে, বললে, তাহলে নাই বা জানলে। তার পরই বললে, তুমি কী ভাবো বলো তো সবসময়ে? কী ভাবো এত?

আমি কথা বললাম না।

আবার তুমি বললে, আমি জানি তোমার খুব দুঃখ আছে কোনো, সে দুঃখ তোমাকে কেবলই অন্যমনস্ক করে দেয়।

কীসের দুঃখ?

তোমার সেদিনের লেখাটা পড়লাম, আচ্ছা, তোমার নায়িকারা সব অমন নিষ্ঠুর কেন? বলতে পারো? তোমার নায়করাও অন্য দশটা পুরুষের মতো নয়।

কীরকম?

মানে, তারা কেউ কিছু কেড়ে নিতে শেখেনি। পুরুষমানুষরা বড়ো অধৈর্য হয়—তারা তোমার নায়কদের মতো ধৈর্যবান নয়—যা তাদের চাইবার তা তারা তখনই চায়, না পেলে কেড়ে নেয়।

জানি না কেন? বোধ হয় আমার নায়কেরা বিশ্বাস করে যে, কেড়ে-নেওয়া কোনো কিছুই চিরদিন থাকে না। যা আপনি আসে, শুধুমাত্র তাই থাকে। চিরদিন।

বুঝলাম না। তোমার কথাবার্তাও তোমার গল্পের নায়কদের মতো। হেঁয়ালি হেঁয়ালি। মেয়েরা তো পুরুষদের হাতের পুতুল। তোমরা আবার চিরদিনের পাওয়াতে বিশ্বাস করো নাকি? আজ যা চাও, কালই তা ধুলোয় ফেলে, আবার নতুন কিছু খুঁজে বেড়াও। তোমাদের মুখে ওসব কথা ভালো শোনায় না। মনে হয়, বানানো কথা।

এই অবধি বলে তুমি আবার বললে, কী? কথা বলছ না কেন?

আমি বললাম, এসব কথা থাক। আমার গল্পের নায়িকাদের তুমি বুঝবে না—তারা একজন দাম্ভিক মেয়ের ছায়া, যে মেয়ে তার দম্ভের জন্য সব কিছু করতে পারে।

মানুষ খুনও করতে পারে? দম্ভ বোলো না, বলো, স্বার্থপরতা। অমন মেয়ে আমি অনেক দেখেছি—যারা জীবনে শুধু নিতেই শিখেছে, বদলে দিতে শেখেনি এককণা। হয় তাই, নইলে বলব তুমি ইনিয়ে বিনিয়ে মিথ্যা গল্প লেখো। তুমি, মানে তোমার মতো ছেলে এমন করে ভালোবাসে অথচ তোমার সে ভালোবাসা ফেরত দেয় না এমন মেয়ে থাকতে পারে না।

ইশ, কথাটা শুনতে ভারি ভালো লাগল। একটা কাগজে লিখে দিয়ো। বাঁধিয়ে রাখব। বলো তো, গলায় ঝুলিয়েও রাখতে পারি। তবে কথা কী জানো, তাকে দোষ দিই না আসলে সেই বাজপাখিটার দোষ! তুমি তো কতদিন বলেছ যে তোমার পাখিগুলোকে তুমি মুক্ত করে দেবে, কই তাদের দিলে কোথায় মুক্তি? তারা যে দিনরাত খাঁচার চার দেওয়ালে আছড়ে মরছে—তা বুঝি তুমি দেখেও দেখো না। তা ছাড়া ওদের মধ্যে কেউ তোমার উচ্ছ্বাস নিয়ে, পৃথিবীর সব ভালোলাগা নিয়ে, জীবনকে দারুণ ভালোবেসে যদি খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েও, তো দেখতে পাবে সেই পুরোনো অশ্বত্থের পুরোনো বাজটা ছোঁ মেরে তার নরম গলাটা ক্ষতবিক্ষত করে দিল। কেন? তুমি নিজে কি কখনো তার আঁচড় খাওনি, জানোনি কেমন লাগে? তবে তোমার সাহস ছিল, সাহস আছে, যা হয়তো অন্য অনেকের নেই। তাই তোমাকে আমি সম্মান করি।

সম্মান করো? আমাকে তবে তুমি সম্মান করো, জ্যাঠামশায়ের মতো? আর কিছু করো না?

আর কিছু করব কী করে বলো। তেমন করে দিতে পারি এমন যা কিছু আমার ছিল সবই যে একজন নিয়ে গেছে। দেওয়ার মতো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই আমার। যা দিতে পারি, তা শুধুই সখ্যতা; বন্ধুত্ব। এ ছাড়া দেবার মতো কিছু তো আমার বাকি নেই।

তোমার কি অতটুকুই ছিল? এত সামান্যই? কখনো কি ভালো করে বুকের মধ্যে খোঁজ করেছ, বাকি কিছু আছে কি নেই?

জানি না, কখনো খোঁজ করার প্রয়োজন হয়নি আগে।

এর পর তুমি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলে, তার পর বললে, তোমার নায়িকাকে আমার একবার দেখতে ইচ্ছে করে, জানতে ইচ্ছে করে কী তার আছে যা আমার নেই। তার কাছে তুমি কী পেতে পারতে যা তোমাকে পৃথিবীর অন্য কোনো মেয়ে দিতে পারে না? সে কি আমার চেয়েও সুন্দরী? বলেই তুমি আয়নার দিকে সরে গিয়ে বসলে। তোমার ছায়া পড়ল আয়নায়। একটা গলা-বন্ধ বাদামি ব্লাউজ, ফিঙের গায়ের মতো উজ্জ্বল ও কালো কাঁধ-সমানচুল দু-কাঁধে নেমে এসেছে। তোমার নিখুঁত শরীর ঘিরে ফলসা-রঙা শাড়ি। আমি বিস্ময়ে তোমার ছায়ার দিকে চেয়ে রইলাম।

তুমি আবার বললে, বলো না, সে কি আমার চেয়েও সুন্দর?

আমি হাসলাম, জবাব দিলাম না কোনো।

তার পর তুমি আবার বললে, শরীরের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, সে কি আমার মতো করে ভালোবাসতে পারে? আমি একজন বিবাহিত ভদ্রলোককে ভালোবেসে যে ত্যাগ স্বীকার করেছি, তোমার সেই বাজপাখির হাতে প্রতিদিন যে লাঞ্ছনা সহ্য করেছি সে কি তা করতে পারত তোমার জন্যে?

না। সে তা পারত না।

তাহলে?

তাহলে কী? সব মেয়েরা তোমার মতো নয়। তুমি ব্যতিক্রম। তোমার মতো মেয়ে বেশি নেই। মেয়েরা বড়ো স্বার্থপর। তারা নিজেদের সুখ, নিজেদের ক্ষুদ্রতা, নিজেদের চাওয়া নিয়ে সবসময়ে এতই ব্যস্ত যে, কখনো তারা অন্যের কথা ভাবে না। তারা জন্মদিনে ফুল পাঠায়, টেলিফোনে তোতাপাখির মতো ‘মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস’ বলে, নিউ মার্কেট থেকে সোয়েটার কিনে নিজের হাতে-বোনা বলে প্রেজেন্ট করে, উঁচু কলারওয়ালা জামা কিনে দেয় বয়-ফ্রেণ্ডদের। কিন্তু ভালোবাসা যে একটা মেকানিক্যাল উইশ করা নয়, জামা নয়, উপহার নয়; ভালোবাসা যে তার চেয়ে অনেক অনেক গভীরতাসম্পন্ন বোধ তা বোঝার মতো মেয়ে বেশি নেই। নেই যে তা নয়; কিন্তু বেশি নেই।

তোমার নায়িকা তোমাকে বোঝে না, তোমার মতো লোকের মনটুকু পর্যন্ত বুঝতে পারে না, তবুও তুমি তাকে ভালোবাসো কেন? তুমি তাকে ভুলে যাও না কেন? তোমার জীবনে একটা সামান্য মেয়েকে ভোলার মতো কোনো উপকরণ নেই? নেই বন্ধু-বান্ধবী? নেই আড্ডা-সিনেমা ক্লাব-পার্টি? নেই তোমার লেখা? তুমি এমন করে নিজেকে নষ্ট করছ কেন? তোমাকে দেখলে আমার কষ্ট লাগে।

আমি হাসলাম, বললাম, তোমার লাগে। হয়তো আমার নিজেরও লাগে, যখনই আয়নার সামনে দাঁড়াই, কিন্তু তার লাগে না। তার আমার জন্যে কিছুই করার নেই।

তবে? কেন তুমি এখনও তাকে ভুলতে পারো না?

পারি না, সে কী করব বলো? তার সঙ্গে তো আমি অভিনয় করিনি কোনোদিন; সে যেমন আমার সঙ্গে করেছিল। কোনোদিনও আমি তাকে আমার প্রয়োজনের যন্ত্র হিসেবে, আমার মুশকিল আসান বলে দেখিনি, তাকে যে আমার যা ছিল সব কিছু দিয়ে আমি ভালোবেসেছিলাম। ভোলা কি অতই সোজা? তার প্রতি আমার যে প্রীতি বা অনুভূতি তা চিরদিন একই থাকবে। কাজের মধ্যে, ছুটির মধ্যে, দিনের মধ্যে, রাতের মধ্যে তাকে বার বার মনে পড়বে, অনুক্ষণ; কিন্তু তাকে তা আর জানতে দেব না। অনেক ভেবে দেখলাম, আমার পক্ষে নিজেকে ঠকানো অন্যকে ঠকানোর চেয়ে অনেক সোজা।

তুমি অনেকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইলে। পাখিগুলো খাঁচায় ঝাঁপাঝাঁপি করতে লাগল। বাইরে ওয়ার্ডেনের বাঁশি শোনা গেল, কারো বাড়ি থেকে বোধ হয় আলো বাইরে যাচ্ছিল।

তুমি হঠাৎ বললে, আমার আজ সকাল থেকে খুব মন খারাপ। তুমি এলে বলে খুব ভালো লাগছে।

মন খারাপ কেন?

দেখো না, এই যুদ্ধ লেগেছে, আমরা হয়তো জিতব, কিন্তু কত তাজা তাজা সুন্দর ছেলেরা মরে যাচ্ছে—প্রতিমুহূর্তে মরছে। যুদ্ধ থেমে যাবে, একদিন পর্দা সরিয়ে ফেলব আমরা সকলে জানালা থেকে—আবার আলো ঝলমল করবে শহরে, কিন্তু সেই ছেলেগুলোআর ফিরে আসবে না। তাদের মায়েরা, তাদের বান্ধবীরা সেদিনও পর্দা টেনে রাখবে ঘরের। একথা কেবলই আমার মনে হচ্ছে, আর মনে হয়ে মনটা যে কী পাগল পাগল করছে তোমাকে কী বলব।

তোমার মন নরম, তাই দুঃখ হচ্ছে, কিন্তু পৃথিবীতে কত লোকের কত দুঃখ, সকলের দুঃখ দূর করার ক্ষমতা তো আমার-তোমার নেই। আমরা শুধু যাদের জানি, যাদের কাছাকাছি থাকি, তাদের দুঃখ দূর করার চেষ্টা করতে পারি—তাও পারি কই—তবু চেষ্টা করতে হয়তো পারি। চেষ্টাটুকু নিয়েই আমাদের খুশি থাকা উচিত। তাই নয়?

তুমি ঠিক আমার বাবার মতো কথা বলো। বাবার কথা মনে হয়—বাবা আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন অথচ আমি রজতকে বিয়ে করায় বাবা আর কোনোদিন আমার মুখ দেখতে চান না, আমাদের বাড়িতে আমার ঢোকা বারণ, কারণ আমি বাবাকে সকলের কাছে ছোটো করেছি—আমার জন্যে অনেক লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে বাবাকে। কিন্তু আমি জানি, বাবা আমাকে আজও ভালোবাসেন তেমনি করে। মাকে ফোন করি। মা বলেন, বাবা কেমন হয়ে গেছেন, কারো সঙ্গে কথা বলেন না, চুপ করে থাকেন সবসময়ে, মাঝে মাঝে আমার ঘরে গিয়ে একা বসে থাকেন, আমার আলমারি খুলে আমার ফেলে আসা শাড়িগুলো দেখেন, আমার ড্রয়ার খুলে ছোটোবেলায় কুড়িয়ে আনা কাশফুল আর কুঁচফল, কাচের চুড়ি আর পুঁতির মালা নাড়াচাড়া করেন। বাবার জন্যে ভীষণ কষ্ট হয়।

একদিন চলে যাও না কেন? চলে গিয়ে ছোটোবেলার মতো গলা খুলে বাবা বলে একবার ডেকে ওঠো না কেন? দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরো না কেন? একবার গিয়েই দেখো বাবা ক্ষমা করেন কি না?

ক্ষমার কথা বলছ কেন? আমি তো কোনো দোষ করিনি। কাউকে ভালোবাসা কি দোষ? আমার ইচ্ছেমতো কাউকে আমি জীবনে বেছে নিয়েছি—এটা কি আমার এত বড়ো হীন অপরাধ?

তা যদি জানোই তবে আর দুঃখ পাও কেন? এসব কথা ভেবো না তাহলে।

না ভেবেও যে পারি না।

তাহলে দুঃখ পেয়ে মরো।

তাই তো মরছি।

তার পরেই তুমি বললে, মরব কোন দুঃখে? আমি বাঁচতে চাই, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমি দারুণভাবে বাঁচতে চাই। জানো তো, আমি বিশ্বাস করি যে নবজন্ম নেই। ওসব বোগাস। যা চাইবার যা পাবার সবই এ জন্মে, এক্ষুনি। পরজন্মের ভরসায় এ জন্ম নষ্ট করতে রাজি নই।

তার পর তুমি হঠাৎ বললে, শোনো, আমার কাছে এসে মাটিতে বোসো, আমাকে একটু আদর করো না। আমার বাবার মতো করে—বাবা খালি আমার চোখে চুমু খেতেন আর বলতেন আমার মেয়েটাকে আমি বড়ো ভালবাসি। খাও না গো, আমার চোখে আমার বাবার মতো করে একটু চুমু খাও না?

আমি মাটিতে নেমে এসে তোমার চোখে চুমু খেলাম, তুমি ভালো লাগায় দু-চোখ বন্ধ করে ফেললে। তার পর বললে, আমাকে একটু কোলে নেবে? আমার বাবার মতো করে আমাকে একটু কোলে নেবে?

আমি হাসলাম। বললাম বুড়োমেয়েকে কোলে নেওয়া যায় নাকি? তার পর তোমাকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে দাঁড়িয়ে উঠলাম, উঠে তোমার আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আয়নায় তাকিয়ে তুমি খিলখিল করে হেসে উঠলে, বললে অ্যাই, তুমি আমার কে গো?

আমি বললাম, আমি তোমার বন্ধু।

শুধুই বন্ধু?

শুধুই বন্ধু নই, আমি তোমার দুঃখের ও সুখের বন্ধু।

বন্ধুত্ব ছাড়া তুমি আমাকে আর কিছু দিতে চাও না, নিতে চাও না আমার কাছ থেকে? সত্যি করে বলো? তোমার বুকে হাত ছুঁইয়ে বলো।

আমি ওকে কোল থেকে নামিয়ে বললাম, বিশ্বাস করো, চাই না। বন্ধুকে বন্ধুত্ব ছাড়া আর কিছু দিতে নেই, তার কাছ থেকে আর কিছু চাইতেও নেই। তাহলে বন্ধুত্ব থাকে না। সখ্যতা থাকে না। এই নির্বান্ধব জগতে তোমার সখ্যতা ছাড়া আমার আর কিছু চাইবার নেই। তার পর বললাম, তুমি বুঝি আমাকে পরীক্ষা করছিলে?

তুমি হাসলে, বললে, পরীক্ষা কীসের?

আমি বললাম, বিশ্বাস করো কি না জানি না, জীবনের সব পরীক্ষাতেই আমি হেরে গেছি—এই প্রথম তোমার পরীক্ষায় জিতলাম। আমার সেই একজন, তোমার তুলনায় কিছুই সুন্দরী নয়, কিন্তু তাকে তো তার সৌন্দর্যের জন্যে আমি ভালোবাসিনি, আমি তাকে তার সমস্ত-কিছুর জন্যে ভালোবেসেছিলাম। তার চোখ-চাওয়া, তার হাসি, তার ব্যবহার, তার আত্মসম্মানজ্ঞান এবং তার হৃদয়হীনতা এই আমার destiny। ভাগ্যকে খন্ডাব, এমন কোনো জোর তো আমার নেই।

বিশ্বাস করো, আজ আমিও এই প্রথম হেরে গেলাম। জীবনে এই প্রথমবার। আমি কোনো পুরুষমানুষ দেখিনি আজ পর্যন্ত যে আগুন নিয়ে এমন নির্ভয়ে খেলতে পারে। তোমাকে কিন্তু আমি একটু ভালো-লাগা দিতে চেয়েছিলাম, তোমার এই মন খারাপ, তোমার এই নিজেকে নষ্ট করা, একটি বাজে মেয়ের জন্য তোমার জীবন নষ্ট করা এ আমার সহ্য হয় না। দেখলাম, জোর করে কাউকে, বিশেষ করে তোমাকে, সুখী করা যায় না।

আমি হাসলাম, বললাম তাকে বাজে বোলো না, আমার কষ্ট হয়। সে বাজে হলে যে আমার সমস্ত জীবনটাই বাজে, আমার এই চাওয়া, আমার এই কষ্ট, সবই একটা বাজে মূল্যহীন কারণের জন্যে। তা আমি কী করে মানি বলো? আমার কাছে সে ভীষণ দামি; সে অদ্বিতীয়া।

আচ্ছা, একটা কথা বলবে? সে যে তোমার মানসী, তোমার সমস্ত লেখার অনুপ্রেরণা—একথা সে জানে?

জানার তো কথা। সে তো বোকা নয়; মূর্খও নয়।

তাহলে, সব জেনেও সে গর্বিত হয় না, আমি তো ভাবতে পারি না। একজন মেয়ের জীবনে একজন লেখকের অনুপ্রেরণা হবার মতো সৌভাগ্য আর কী থাকতে পারে? এর চেয়ে বড়ো সম্মান আর কী হতে পারে? সব মেয়েই তো ঘর করে, সংসার করে, ছেলে-মেয়ে মানুষ করে, স্বামীর সঙ্গে একঘরে একখাটে বছরের পর বছর শোয়—এইসব দৈনন্দিনতার মাঝে এত বড়ো একটা গায়ে কাঁটা-দেওয়া আনন্দ, এত বড়ো একটা প্রাপ্তির কোনো দাম নেই তার কাছে; এ আমার বিশ্বাস হয় না।

আমি হেসে বললাম, তার আমার লেখা পড়ার সময়ই নেই। আমার কোনো লেখা সে পড়ার মতো উৎসাহ পায় না। সে হয়তো ধরেই নিয়েছে ছোটোবেলা থেকে যে, তাকে নিয়ে তো আমি লিখবই, লিখিই, এতে বিশেষ কিছু আর কী আছে? তাকে নিয়ে আমি লিখি, এতে আমিই ধন্য হয়ে গেছি, এর চেয়ে বেশি আর কী আছে এতে?

তুমি বড়ো মিথ্যা কথা বলো। এমন কখনো হতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি না এমন কখনো হতে পারে বলে।

পৃথিবীতে যত কিছু ঘটে সবই কি আমাদের বিশ্বাসযোগ্য? এও মনে করো এক আশ্চর্য। সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য।

তাহলে তুমি…

আমি বাধা দিয়ে বললাম, এসব কথা থাক। এসব কথা আলোচনা করে লাভ নেই। তোমার সঙ্গে তার আলাপ থাকলে তুমি হয়তো ওর কথা জানতে পারতে। হয়তো বুঝতে পারতে ওর কথা, যে কথা আমি কখনো বুঝিনি, ও হয়তো বলত যা কিছু পাইনি আমি, তার সমস্ত দোষ আমারই, আমার স্বভাবের, আমার কপালের। ওকে দোষ দিই না আমি। ও কী বলে জানো? বলে ও আমাকে এমন দুঃখ না দিলে আমি নাকি কখনো লিখতে পারতাম না। ও বলে যাকে চাইতে হয়, তাকে কখনো জীবনে পেতে নেই, জীবনে তা পেলেই তা সস্তা, বাজে, দৈনন্দিনতার লেবেল-মারা হয়ে যায়। হয়তো তাই-ই, হয়তো ও ঠিকই বলে। আমি শুধু ভাবি ও যদি কোনোদিনও আমার কষ্টটুকু বুঝতে পেত সেদিন ওর সমস্ত মহত্ত্ব সতীত্বর সব মুখোশ খুলে ফেলে হয়তো দৌড়ে এসে বলত, আমাকে ক্ষমা করো; আমাকে ক্ষমা করো।

তোমার কি মনে হয় ও কখনো তা বলবে?

আমি আবার হাসলাম, বললাম না। কোনোদিনও না। এটা আমার একটা প্রিয় স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন এ জীবনে কোনোদিনও সত্যি হবে না। আর তুমি যেমন বলো, আমাদের একটাই জীবন, পাঁচটা নয় দশটা নয় ; মাত্র এক ও একমাত্র জীবন। এ জীবনে স্বপ্নগুলোনেড়েচেড়ে দিন যাবে। এমন করেই দিন যাবে। এমন করে দিন কাটাতে হয়। কাটায় লক্ষ লক্ষ মানুষ। কেউ বড়োলোক হবার স্বপ্ন দেখে, কেউ কাউকে পাবার স্বপ্ন দেখে, স্বপ্নের মধ্যে, ঘোরের মধ্যে থাকি বলেই তো আমরা এত দুঃখ-কষ্ট ভরা পৃথিবীতে এখনও বেঁচে আছি। এই স্বপ্ন হচ্ছে পেথিড্রিন ইনজেকশান। আমরা সকলেই কম-বেশি এ ওষুধে অভ্যস্ত। কম-বেশি আমরা সকলেই এই স্বপ্নের ওষুধের বশ; ড্রাগ-অ্যাডিক্ট।

কথায় কথায় রাত বাড়ছে, তোমার বাড়ি যেতে হবে না? চলো একটু কিছু খাবে। তুমি বললে।

আজ খাব না। তার চেয়ে আমি তোমার কাছে অন্য কিছু চাই আজ।

কী তা?

বারান্দায় এসো।

কী করবে? তুমি কি বারান্দা থেকে অন্ধকারে ঝাঁপ দেবে নাকি? তোমার কিছুই অসাধ্য নেই।

চলোই না, বলে তোমার হাত ধরে আমি তোমার বারান্দায় এলাম।

তোমার হলুদ লাভ-বার্ডসগুলো খাঁচার জালে তখনও ঝাঁপাঝাঁপি করছিল—ওদের ঘুম নেই, ওদের শ্রান্তি নেই, বাইরে বিরাট উদার আকাশ, রাতের নিস্তব্ধ তারাভরা আকাশ, ওরা সেদিকে চেয়ে ওদের ছোটো ছোটো সুন্দর চোখে দিনরাত স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখে এই গন্ডিমাপা, বদ্ধ, হিসেবি জীবন থেকে ওরা বুঝি একদিন মুক্তি পাবে, একদিন ওরা যা করতে চায় তাই-ই করতে পারবে। সমাজ, সমাজের বাজপাখির পাহারা পেরিয়ে দূ—রে উড়ে গিয়ে ওরা একে অন্যকে যেমন করে চায়, তেমন করে পেতে পারবে। কোনো বাধা থাকবে না, কোনো শাসন থাকবে না, ভুল বোঝাবুঝি, মন-কষাকষি, ভাবনা কিছুই থাকবে না। সে জগতে এই হলুদ পাখিগুলো তাদের নরম সঙ্গিনীদের সহজে পাবে, আমি পাব আমার পাখিকে; তুমি পাবে তোমার পাখিকে।

তুমি বললে, ও কী করছ? রজত ভীষণ রাগ করবে।

তোমার বাবাও ভীষণ রাগ করেছিলেন, তুমি তো শোনোনি; তুমি তো তোমাদের সুখের খাঁচা ছেড়ে দুঃখের আকাশে উড়ে গেছিলে। ওরা কেন যাবে না?

তুমি কিছু বললে না, ব্ল্যাক-আউটের রাতের বারান্দায় আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলে।

তার পর, অনেকক্ষণ পর, তুমি আর আমি এই অন্ধকার নির্বান্ধব জগতে আমরা একসঙ্গে আমাদের নরম ভালোবাসার হাতে লাভ-বার্ডসদের খাঁচার দুটি দরজা মেলে ধরলাম।

অন্ধকারে কতগুলি ছটফট ফরফর আওয়াজ হল। তার পর অন্ধকারতর আকাশে কতগুলি হলদে-সাদা বিন্দু মুক্তির আনন্দে স্পন্দিত হতে হতে উড়ে চলল। যেখানে সমাজ নেই, ডিজেলের ধোঁয়া নেই, যেখানে বাধা নেই পদে পদে। দেখতে দেখতে সেই বিন্দুগুলি অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

আমি আর তুমি শুধু দাঁড়িয়ে রইলাম, আর নিরুচ্চারে শুধোলাম, জানি না কাকে, এই ইট-কাঠ-পাথরের খাঁচা থেকে আমাকে, তোমাকে, আমাদের মতো লক্ষ লক্ষ ভালোবাসার নরম পাখিদের কে মুক্ত করবে? কেউ কি মুক্ত করবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *