ললনা ছলনাময়ী – সুদীপ সাহা
সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠে এককাপ চা নিয়ে বসেছে বৃকোদর—হাতে তার ধূমায়িত চারমিনার, সামনে খোলা স্টেটসম্যানের পার্সোন্যাল কলম, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। খুবই বিরক্ত হল বৃকোদর। এই সাতসকালে আবার কে ডাকে!
ফোনটা নামিয়ে রেখে আবার স্টেটসম্যানের পার্সোন্যাল কলমে চোখ রাখল বৃকোদর, আর বিড়বিড় করতে লাগল। কী এমন কথা যে, ফোনে বলা যায় না—এখন ছোটো সেই লালবাজার! হ্যাঁ, হোমিসাইডের বড়কর্তা বর্মনখুড়ো ফোন করেছিলেন। কী এক বিশেষ প্রয়োজন, ফোনে খুলে বলা সম্ভব নয়—আজ সকালেই যেতে হবে বৃকোদরকে। তা সে ঘণ্টাদুয়েক সময় চেয়েছে। পার্সোন্যাল কলমটাই খুঁটিয়ে পড়তে মিনিট চল্লিশ লাগবে, তারপর তৈরি হওয়া—সেটা অবশ্য মিনিট দুইয়ের ব্যাপার—বাসের জন্য লাইন দেওয়া, ইত্যাদি।
‘এই যে বৃকোদর, এসে গেছ!’ বর্মনখুড়ো চেয়ার ঠেলে উঠে পড়লেন ‘আরে, বসতে হবে না—চলো, চলো।’
‘কোথায় আবার যাব?’ বৃকোদর বিরক্তভাবে জিগ্যেস করল, ‘একে তো সাতসকালে টেনে আনলেন, তা-ও আবার চা খাওয়ানো নেই, কিছু নেই—আসতে-না আসতেই চলো!’
‘আরে, হ্যাঁ—চা খাওয়াব বলেই তো নিয়ে যাচ্ছি—তুমি ওঠো তো!’
অগত্যা বৃকোদর উঠল। বর্মনখুড়ো বাইরে এসে পুলিশ জিপের বদলে ট্যাক্সিতে উঠলেন। তারপর একটা বড় সাইজের চুরুট ধরিয়ে মুখে পুরে বসে রইলেন।
ধর্মতলা চলে গেল, কোনও কথা নেই—লিন্ডসে চলে গেল, কোনও কথা নেই। অবশেষে অধৈর্য হয়ে বৃকোদর বলে ফেলল, ‘খুড়ো, চা-টা কি আমরা দক্ষিণ কলকাতায় পৌঁছে খাব?’
‘অ্যাঁ…ও! তাই তো, তোমাকে তো আবার চা খাওয়াতে হবে—এই, এই ট্যাক্সি, ওয়াপস চলো।’
দক্ষিণ কলকাতায় নয়, মধ্য কলকাতারই একটা নামকরা দোকানে চায়ের অর্ডার দিয়ে বসেছিলেন বর্মনখুড়ো—সদাশিব বর্মন, ক্যালকাটা পুলিশের হোমিসাইড বিভাগের বড়কর্তা। সামনে বসে পা দোলাচ্ছিল বৃকোদর সামন্ত, প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর—বর্মনখুড়োর স্নেহধন্য। এবার মুখটা ছুঁচলো করে বলল, ‘নোট জালের ব্যাপার তো আপনার আওতায় নয়—আপনি হঠাৎ নোট জাল নিয়ে চিন্তিত হলেন কেন?’
‘কী করে বুঝলে, বৃকোদর?’ কথা ফুটল বর্মনখুড়োর মুখে।
‘সেই যে ট্যাক্সিভাড়া দিয়ে চেঞ্জ ফেরত নিয়েছেন, আর টাকাগুলো পকেটে পোরেননি—কয়েক মুহূর্ত পরপরই উলটে-পালটে ওগুলো দেখে যাচ্ছেন—ব্যাপারটা কী?’
‘সেইজন্যেই তো তোমাকে এখানে নিয়ে আসা। ব্যাপার এমনই যে, ফোনে বলা যায় না, লালবাজারে বসে বলা যায় না। আমার ভাইপো তরুণকে কাল অ্যারেস্ট করেছে ক্যালকাটা পুলিশ, নোট জাল করার অপরাধে—।’
‘তাতে কী, পুলিশের লোকের ভাইপো বলে কি সে নোট জাল করতে পারে না?’
‘আঃ, বৃকোদর!’ বর্মনখুড়ো কাতরভাবে বললেন, ‘আমি চাই, তুমি ব্যাপারটা তলিয়ে দ্যাখো। আর তরুণের ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট আমি দিচ্ছি, তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।’
‘হেঁ, হেঁ, বর্মনখুড়ো,’ বৃকোদর একগাল হেসে বলল, ‘অ্যাডভান্সটা আপনি দেবেন, না জেলে গিয়ে তরুণবাবুর সঙ্গে কথা বলব?’
কটমট করে তাকিয়ে বৃকোদরের অর্ধেক ফি আগাম করলেন বর্মনখুড়ো।
বেয়ারা চা দিয়ে গেছিল। বৃকোদর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই উঠে সোজা চলে গেল কাউন্টারে এবং ফোনটা তুলে নিল।
‘হ্যালো, দৈনিক বার্তাবহ?…আমি বৃকোদর সামন্ত বলছি…একটা নোট জাল করার কেসে আপনাদের পত্রিকাকে আমি কভার করছি, ঠিক আছে তো?…হ্যাঁ, তাহলে কাগজপত্র তৈরি করুন, আধঘণ্টা পর আসছি…আচ্ছা, ঠিক আছে—ধন্যবাদ।’
‘কী ব্যাপার, চা যে ঠান্ডা হয়ে গেল।’ বৃকোদর ফিরতে বর্মনখুড়ো বললেন, ‘কাকে ফোন করতে গেছলে?’
‘কাজ শুরু করে এলাম, খুড়ো। টাকা তো আগাম পেয়ে গেছি!’ বৃকোদর বলল।
বর্মনখুড়ো লালবাজারে ফিরে গেলেন।
মিনিট পঁয়তাল্লিশ পর বৃকোদর আবার লালবাজার পৌঁছল ‘দৈনিক বার্তাবহ’-র রিপোর্টার হিসেবে—অবশ্য এবার আর বর্মনখুড়োর কাছে নয়। তরুণ বর্মনের জবানবন্দি ইত্যাদি দেখে বৃকোদর বাড়ি ফিরল—আর তারপরই বেরোল সেই বিখ্যাত লাল খেরোর খাতা। পাতা ওলটাতে-ওলটাতে বেরোল জাল নোটের কেস। গত ২১ জুন বেরিয়েছে স্টেটসম্যানে—তারই সারমর্মটুকু লিখে রেখেছে বৃকোদর :
(১) বম্বের বিজয় কাজোলকার—বয়স ছত্রিশ, পেশা ব্যবসা (অর্ডার সাপ্লায়ার), ২০ জুন সকালে মেসার্স রামচন্দ্র আগরওয়ালের থেকে কিছু যন্ত্রপাতি কিনে পাঁচ হাজার টাকা পেমেন্ট করে—সবই জাল নোটে। বিজয় বলেছে, ওই টাকা সে পেয়েছে দিল্লির এক পার্টির কাছ থেকে। কিন্তু সেই পার্টি পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের সময় যে-নোটের নম্বর দিয়েছে (প্রমাণসহ), তার সঙ্গে বিজয়ের দেওয়া নোটের নম্বর মেলেনি।
(২) পাটনার শঙ্কর তেওয়ারি টিভি সেট কিনে জাল নোটে পেমেন্ট করেছে এবং পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সে কোনও সঠিক উত্তর দিতে পারেনি।
এরপর বৃকোদর কলম খুলল, লিখল :
(৩) কলকাতার তরুণ বর্মন সদ্য দিল্লি থেকে ফিরে ব্যাঙ্কে টাকা জমা দিতে গেছিল—আটশো টাকা—সবই জাল নোটে। তরুণের বক্তব্য, বেশ কিছু টাকা নিয়ে সে সস্ত্রীক দিল্লি বেড়াতে গেছিল—যা টাকা ফিরেছিল, সেটা ব্যাঙ্কে জমা দিতে গিয়েই এই বিপত্তি। দিল্লিতে সে ছিল ‘হোটেল মিডল্যান্ড’-এ।
লাল খেরোর খাতা বন্ধ হল। পকেট থেকে বেরোল নাসিরুদ্দিন বিড়ি। বাড়িতে সে মাঝে-মধ্যে বিড়িই খায়। বিড়ি ধরিয়ে সে গেল স্টাডিরুমে। টেনে নিল র্যাক থেকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেমস ওয়েরিং-এর লেখা ‘ফ্রডস’। পাতা ওলটাতে-ওলটাতে হঠাৎ এক জায়গায় চোখ আটকে গেল বৃকোদরের। ওয়েরিং সাহেব লিখেছেন, জাল নোটের কারবারিরা কখনওই এমন জায়গায় নোট চালাবে না, যেখানে তাদের বারবার ফিরতে হবে।
‘হুম—,’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বৃকোদর। বিড়বিড় করে বলল, ‘অন্তত বিজয় কাজোলকার তাহলে মিথ্যে বলেনি। কারণ, মাল কিনতে রামচন্দ্র আগরওয়ালের কাছে তাকে বারবার যেতেই হবে। সে যদি জাল নোটের কারবারি হত, এ-ভুল তাহলে করত না। তাহলে মিথ্যে কথা কে বলল? দিল্লির পার্টি? কিন্তু সে তো আবার কী যেন প্রমাণ দিয়েছে! দু-নম্বর কেসে শঙ্কর ভগবান তো কিছুই বলেননি। ব্যাপার বোঝা মুশকিল। আর তরুণ বর্মন পেশায় এঞ্জিনিয়ার—কিছু বুদ্ধি নিশ্চয়ই ধরে। কাজেই জাল নোটের কারবারি সে হলে অন্তত ব্যাঙ্কে চালান করতে যেত না সেই নোট। তাহলে গোলমালটা কোথায়—বলি গোলমালটা কোথায়! ধুত্তেরি, এত অভিমানী প্রেয়সী আর দেখিনি—চুমু দিতে একটু দেরি হলেই ঘুমিয়ে পড়বে!’ বিড়ি নিভে গেছিল—শেষ কথাটা তারই উদ্দেশে।
‘সেন্সর করো, সেন্সর করো।’ বলতে-বলতে ঢুকলেন বর্মনখুড়ো, ‘কতদূর এগোলে? বড় অধৈর্য হয়ে পড়েছি হে, বৃকোদর। কাজে মন বসাতে পারছি না, তাই চলে এলাম।’
‘এক কাজ করুন, খুড়ো,’ বৃকোদর বলল, ‘কয়েকদিন ছুটি নিয়ে ফেলুন—আমার এখানে এসে থাকবেন। তাহলে ধৈর্যচ্যুতি হবে না মনে হচ্ছে।’
‘সত্যি বলছ, বৃকোদর?’ বর্মনখুড়োকে খুব উৎসাহিত দেখাল : ‘তাহলে কাল সকাল থেকেই চলে আসছি, ঠিক আছে তো?’
‘আসুন, তবে তার আগে একটা কাজ করে আসুন। বম্বে পুলিশের কাছে খোঁজ নিন, গত ২০ জুন যে-বিজয় কাজোলকর জাল নোটের ব্যাপারে ধরা পড়েছে, দিল্লিতে তার গতিবিধি সম্বন্ধে কোনও খোঁজ পাওয়া গেছে কি না। আর পাটনায় ওই একই কেসে যে-শঙ্কর তেওয়ারি ধরা পড়েছে—তার ব্যাপারে খোঁজ নিন, সেও দিল্লি গেছিল কি না।’
‘ওরে বাবা—অনেকদূর এগিয়েছ মনে হচ্ছে! একেবারে পাটনা হয়ে বম্বে? কী-কী নাম বললে যেন—বিজয় তেওয়ারি আর শঙ্কর কাজু না কী যেন!’
‘হ্যাঁ, বিজয় শঙ্কর জগাখিচুড়ি। লিখে নিন, লিখে নিন।’
‘তাই দাও, বাবা—আর নাম পেলে না!’
বর্মনখুড়ো চলে গেলেন। পরমুহূর্তেই বৃকোদর বেরিয়ে গিয়ে পোস্টঅফিস থেকে দুটো টেলিগ্রাম করে এল।
সন্ধেবেলা বাড়ির কলিংবেলের লাইনে লাগানো সুইচটা অফ করে দিল বৃকোদর। এই ব্যবস্থাটা সে রেখেছে, যাতে তাকে কেউ বিরক্ত করতে না পারে সেই জন্য। তারপর স্টাডিতে এসে শুরু হল অবিরাম পায়চারি, তৎসহ তাম্রকূটসেবন।
পরদিন সকাল ন’টায় বর্মনখুড়ো সত্যি-সত্যি এসে হাজির হলেন বৃকোদরের বাড়ি এবং চমকে গেলেন। কারণ চায়ের পেয়ালা হাতে যে বসেছিল, সে আর-একজন সদাশিব বর্মন—এমনকী বাঁ-গালের আঁচিলটা পর্যন্ত বাদ পড়েনি। বর্মনখুড়ো অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘হঠাৎ আমার ছদ্মবেশ কেন, বৃকোদর? অবশ্য বাড়িতে তুমি আর মৈনুল ছাড়া আর কেউ নেই বলেই তোমাকে বৃকোদর বলে ডাকলাম—না হলে মনে হচ্ছে, আমি আয়নায় মুখ দেখছি। হ্যাঁ—মৈনুল—এককাপ চা।’
‘কেন এই ছদ্মবেশ, সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য।’ বৃকোদর উইগটা খুলতে-খুলতে বলল, ‘মৈনুল ঢাকাই পরোটা করছে, খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন, খুড়ো। প্রথম অ্যাভেলেবল ফ্লাইটে দিল্লির দুটো টিকিট কেটে আনুন—আমরা দিল্লি যাচ্ছি।’
‘হঠাৎ দিল্লি কেন? কতদূর কী হল কিছুই বুঝছি না—একেবারে দিল্লি নিয়ে যাচ্ছ?’
‘মনে হচ্ছে, ঘটনার চাবিকাঠি সেখানেই। আর হ্যাঁ, টিকিট দুটো অবশ্যই অন্য নামে কাটবেন।’
পালাম থেকে ট্যাক্সিতে হোটেল মিডল্যান্ডের পথে যাওয়ার সময় বৃকোদর তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা বলছিল, বর্মনখুড়ো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন ‘খুড়ো, আপনি বিজয় কাজোলকর ও শঙ্কর তেওয়ারির দিল্লিতে গতিবিধি সম্পর্কে খোঁজ আনার আগেই আমার সন্দেহ হয়েছিল যে, এরা সকলেই হোটেল মিডল্যান্ডে উঠেছিল। তরুণের মতোই এরাও যে নিরপরাধ, সেটা মনে করার কিছু কারণ অবশ্যই আমার আছে। কাজেই আমার সন্দেহ হল, হোটেল মিডল্যান্ডই ঘটনার উৎস। সেটা যাচাই করার জন্যে আপনি হোটেল মিডল্যান্ডে চেক ইন করছেন এখনই—আর আমি চলে যাচ্ছি আমার বন্ধু সুরথের বাড়ি—ওকে টেলিগ্রাম করাই আছে। ওর ঠিকানাটা দিয়ে দিচ্ছি, আপনি একঘণ্টার ভেতর ওখানে চলে আসুন। ওখানেই খাওয়া-দাওয়া সারবেন এবং ওখানেই থেকে যাবেন। আপনার বদলে আমি ফিরব হোটেল মিডল্যান্ডে। কাল সকাল দশটায় দেখা হবে আবার সুরথের বাড়িতে। এই যে এসে গেছে মনে হচ্ছে! যান, নেমে পড়ুন।’
সফদারজঙ্গ এনক্লেভে সুরথের বাড়িতে হুল্লোড় বয়ে গেল। প্রায় সাত বছর পর দুই বন্ধুতে দেখা। প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের পর পারস্পরিক খবর আদান-প্রদান চলছিল, বর্মনখুড়ো এসে গেলেন। বৃকোদর হাঁ-হাঁ করে উঠল, ‘এ কী খুড়ো, আপনাকে বললাম ঘণ্টাখানেক পর আসতে, আর পঁয়ত্রিশ মিনিট মাত্র হল, আপনি চলে এলেন!’
‘আর বোলো না হে, বৃকোদর! তোমার কথামতো তো পেশা লিখেছি ব্যবসা। একটা নতুন কলম দেখলাম, দিল্লিতে আসার উদ্দেশ্য—সেখানে লিখেছি, দিল্লিতে ব্যবসায়িক সম্ভাবনা সম্বন্ধে পর্যালোচনা করা। ব্যস, রিসেপশনিস্ট মেয়েটি মুহুর্মুহু ফোন করছে, ড্রিঙ্কস লাগবে আপনার? …এনি আদার টাইপ অফ এন্টারটেইনমেন্ট?—শেষে বিরক্ত হয়ে কেটে পড়লুম।’
‘খুড়ো, টোপ গিলেছে মনে হয়—আপনার ওই উদ্দেশ্যটা খুব জাঁকালো হয়েছে।…কই রে সুরথ, খাওয়ার বন্দোবস্ত কর, আবার ফিরতে হবে।’
বর্মনখুড়োর ছদ্মবেশে বৃকোদর ফিরল হোটেলে। এখন তার নাম সুরজিৎ হালদার—এই নামেই সদাশিব বর্মন চেক ইন করেছেন। রিসেপশনিস্ট ভদ্রমহিলা শুধু সুবেশা সুরূপাই নন, তাঁর গলাটিও সুরেলা। রিনরিনে গলায় সুর তুলে তিনি বললেন, ‘হাই মিস্টার হালদার, হোয়ার হ্যাড য়ু বিন সো লং—আফটার অল ইটস আ ন্যু সিটি টু য়ু!’
‘থ্যাঙ্ক য়ু মিস…।’
‘লোলিটা কাপুর—য়ু ক্যান কল মি লোলা।’
‘থ্যাঙ্ক য়ু লোলা—ডেহলি ইজ নট দ্যাট ন্যু টু মি।’
‘ইজ ইট! মিস্টার হালদার—উই আর অলওয়েজ অ্যাট য়োর সার্ভিস—হোয়েনেভার য়ু নিড সামথিং, জাস্ট লেট আস নো।’
‘আই উইল—আই উইল লেট য়ু নো।’
হোটেলের ঘরে ঢুকল বৃকোদর। একজনের পক্ষে বেশ বড় ঘর। এককোণে সোফাসেট ও সেন্টার টেবিল। কিছু দূরে রাখা টিভি সেট। ঘরের আর-একপাশে একটা সিঙ্গল খাট। খাটের পাশে ছোট টেবিলে রাখা ফোন। মাথার কাছে রাখা মোরাদাবাদী কুঁজোয় জল। ঘরের প্রবেশ-দরজা পুব দেওয়ালে, তার কোলে করিডোর, এবং করিডোরের অপর পাশে অন্য কোনও ঘর নেই। দক্ষিণদিকে বিশাল জানলায় ভারী নীল রঙের পরদা লাগানো। পরদা তুললে ফুট ত্রিশেক নীচে দিল্লির সুসজ্জিত পথঘাটে আলোর মালা দেখা যায়। প্রবেশ-দরজার ঠিক মুখোমুখি ঘরের পশ্চিম দেওয়ালে একটা ওয়ার্ডরোব। তার পাশে দেওয়ালে ঢোকানো একটা অ্যাকোয়ারিয়ামে লাল-নীল মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ওয়ার্ডরোবটা খুলল বৃকোদর—বর্মনখুড়ো মালপত্র রাখার অন্য জায়গা না পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই ওয়ার্ডরোবে রেখেছেন তাঁর সুটকেস। ওয়ার্ডরোবটা ভালো করে নজর করল বৃকোদর—তারপর কপাল বাজাতে শুরু করল। তারপর তার চোখ গেল প্রবেশ-দরজায়—ভারী নীল পরদা সেখানে অনুপস্থিত। দরজার ওপরের দিকে একটা ছ’ফুট বাই পাঁচ ফুট কাটা জায়গায় কাচ বসানো, সম্ভবত ভেতর থেকে বাইরের অতিথিকে দেখার জন্য। দরজাটা খুলল বৃকোদর। দরজার ঠিক সামনেই করিডোরের উলটো দেওয়ালে ভেতরে ঢোকানো একটা শো-কেসে রাখা ঐতিহাসিক স্ফিঙ্কসের মডেল। প্রতিটি দরজার সামনেই একটি করে শো-কেস এবং সব ক’টিতেই নানারকম প্রাচীন ভাস্কর্যের মডেল। ঘরে ঢোকার সময় বৃকোদরের মনে হল, স্ফিঙ্কসের চোখ যেন একটু বেশি জ্বলছে।
বিছানায় শুয়ে সবে একটা চারমিনার ধরিয়েছে বৃকোদর, এমন সময় ফোন বাজল।
‘লোলা হিয়ার, মিস্টার হালদার—ফিলিং লোনলি?’
‘সি লোলা, আই লাইক টু হ্যাভ সামথিং টুনাইট অ্যান্ড দ্যাট ইজ আনইন্টারাপ্টেড স্লিপ।’
‘সরি মিস্টার হালদার, হ্যাভ সুইট ড্রিমস। নাইট….।’
সত্যিই ঘুমোল না কিন্তু বৃকোদর। রাত্রি প্রায় দুটো পর্যন্ত অবিরাম মস্তিষ্কচালনা করে অবেশেষে তার মুখে হাসি ফুটল। তারপর বেরোল সেই লাল খেরোর লম্বাটে খাতা। লম্বাটে, কারণ গোটা একপাতাতে কেস সম্বন্ধে যাবতীয় না লিখতে পারলে, বৃকোদরের মন খুঁতখুঁত করে। হিজিবিজি জঘন্য হাতের লেখায় কী যেন সে লিখতে লাগল।
বৃকোদর উঠল সকাল ছ’টা নাগাদ। হোটেলের চারপাশে খুব যত্নে সাজানো বাগান। সেই বাগানে ঘুরতে-ঘুরতে বৃকোদর লক্ষ করল, তার ঘরটা হোটেলের যে-উইং-এ, সেটা দেখা যাচ্ছে। আচ্ছা, বাইরে থেকে দক্ষিণ দেওয়ালটা এত চওড়া দেখাচ্ছে কেন? ঘরের ভেতর যা চওড়া, তার চেয়ে অন্তত ফুট-ছয়েক বেশি। পিছনে তো কোনও ঘর নেই! তাহলে?
বৃকোদর এবার হোটেলের পিছনদিকে বিরাট সুইমিং পুলে পৌঁছল। পুলের একদিকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডাইভিং বোর্ড রয়েছে। তার ঠিক পাশ দিয়ে একটা দরজা এবং ছোট্ট একটি ঘর। বৃকোদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, এমন সময় সেটা খুলে গেল। অবাক হয়ে বৃকোদর দেখল, লোলা দাঁড়িয়ে আছে, আর দরজা থেকে ধাপে-ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে মাটির তলায়।
বৃকোদর উৎফুল্ল সুরে বলল, ‘হাই লোলা, হাউ নাইস টু সি আ বিউটি ইন দ্য মর্ন—হোয়াট আর য়ু ডুইং হিয়ার?’
‘ও! মিস্টার হালদার!’ দরজাটা বন্ধ করতে-করতে লোলা বলল, ‘আই স্টে হিয়ার—দিস ইজ আওয়ার স্টাফ কোয়ার্টার।’
কালবিলম্ব না করে লোলা চলে গেল। বৃকোদর কপাল বাজিয়ে ভাবতে লাগল, মাটির নীচে স্টাফ কোয়ার্টার!
ঠিক দশটার সময় সুরথের বাড়ি হাজির হল বৃকোদর।
বর্মনখুড়ো চুরুট ধরিয়ে বসেছিলেন, বৃকোদরকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কী হে, সন্দেহ তোমার সত্যি না কি?’
‘খুড়ো, অনুসন্ধান-পর্ব শেষ হয়ে গেছে, এখন বাকি শুধু অপারেশান-পর্ব। তারও লে-আউট হয়ে গেছে, যথাসময়ে জানিয়ে দেব। আপনার সুটকেস থেকে অ্যাটাচিটা নিয়ে এসেছি। সুরথ-সুরথ! ব্যাঙ্ক থেকে হাজার-পাঁচেক টাকা তুলে আন…সব দশ টাকার নোটে—যাতে অ্যাটাচিটা বেশ ভরতি দেখায়, বুঝেছিস?’
‘যে-সুদটা লোকসান যাবে, সেটা তুই দিয়ে দিস তাহলে!’ হাসতে-হাসতে সুরথ বলল।
তারপর খুব নিচু স্বরে বৃকোদর তার আবিষ্কার এবং পরিকল্পনা সম্বন্ধে বলতে শুরু করল।
বিকেলের দিকে বৃকোদর কনট প্লেসের সেই বিখ্যাত কফি হাউসের ভেতরের কেবিনে এককোণে বসেছিল। একটা খবরের কাগজ সামনে খোলা ছিল। বৃকোদর তাতে বড়-বড় করে বি. এস. কথাটা লিখল। কিছু পরে একজন ওয়েটার অর্ডার নিতে এসে বৃকোদরের কোলে একটা মোটা খাম ফেলে দিয়ে গেল।
বৃকোদর বেরিয়ে পড়ল পকেটে পয়সা ঘোরাতে-ঘোরাতে। ‘ন্যাশনাল ডিটেকটিভ এজেন্সি’ কাজটা করে দিয়েছে বলে তার এখন খুব ভালো লাগছে। কলকাতা থেকে বৃকোদর দ্বিতীয় টেলিগ্রামটা এদেরই করেছিল, হোটেল মিডল্যান্ডের মালিক সম্পর্কে খোঁজখবর জোগাড় করতে বলে। অপারেশান-পর্বের আগে আর একটা কাজই বাকি রইল বর্মনখুড়োকে নিয়ে দিল্লি পুলিশকে ব্যাপারটা ইনফর্ম করা এবং অপারেশান শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই পুলিশের অকুস্থলে উপস্থিতির ব্যবস্থাটা করে রাখা। সুরথের বাড়ি থেকে বর্মনখুড়োকে তুলে নিয়ে সে-কাজটুকুও সেরে ফেলল বৃকোদর। এরপর অপারেশান-পর্ব।
হোটেল মিডল্যান্ডের রিসেপশনে খুব মৃদু স্বরে পাশ্চাত্য বাজনা বাজছিল। নরম আলোর ঢেউ তুলে ছড়িয়ে যাচ্ছিল সেই বাজনা। কাউন্টারের পিছনে বসে লোলা ঘড়ির টিকটিক শুনতে-শুনতে ভাবছিল, মিস্টার হালদার সেই সকালে বেরিয়েছেন, এখনও ফিরলেন না কেন? কোনও বড় অ্যাসাইনমেন্ট হল নাকি! ভদ্রলোককে এখনও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, টোপ গিলবে কি না। ঠিক আটটা বাজল—বাইরে যেন একটা ট্যাক্সি থামার আওয়াজ হল! ওই তো মিস্টার হালদার আসছেন!
‘হাই মিস্টার হালদার, ডু য়ু এনজয় আওয়ার অ্যাঙ্কসাইটি? আফটার অল য়ু আর আওয়ার গেস্ট। ডিড য়ু ফেস এনি ডিফিকালটি? হোয়ার হ্যাড য়ু বিন সো লং, ম্যান?’
‘ইয়া, আই ফেসড সাম টাবল টুডে, বাট আই ক্যান ফেস আ লট অফ টাবল ফর সাচ অ্যাচিভমেন্টস।’
বলতে-বলতে অ্যাটাচিটা খুলে ধরলেন মিস্টার হালদার ওরফে বর্মনখুড়ো। মনে-মনে ভাবছিলেন, মেয়েটা নিজেই থরে-থরে সাজানো টাকাগুলো দেখানোর সুযোগ করে দিল। যেভাবেই হোক, এগুলো দেখাতেই হত।
লোলা উৎফুল্ল স্বরে বলল, ‘য়ু ডিড আ গ্রেট জব, ম্যান—নাউ হ্যাভ সাম রেস্ট—বাই-ই।’
মিস্টার হালদার ঘরে গেলেন, অ্যাটাচিটা রাখলেন ওয়ার্ডরোবের ভেতরে। একটা চুরুট ধরিয়ে সবে টিভিটা খুলেছেন, এমন সময় চতুর্দিক হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল। সম্ভবত লোডশেডিং। রিসেপশনে আচমকা অন্ধকারের সুযোগে সাঁত করে ভেতরে ঢুকে পড়ল আর-এক মিস্টার হালদার ওরফে বৃকোদর সামন্ত। নিজের ঘরের সামনে এসে স্ফিঙ্কসের চোখের সামনে কাচে সে আটকে দিল একটা স্টিকার। ক্যাঁচ করে শব্দ তুলে ঘরে ঢুকেই সে সটান ওয়ার্ডরোবের সামনে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘খুড়ো, আমি ওয়ার্ডরোবের ভেতর ঢুকছি। আপনি প্ল্যানমাফিক পুলিশ নিয়ে সুইমিং পুলে ডাইভিং বোর্ডের সিঁড়ির পাশের দরজাটায় পৌঁছে যান। তাড়াতাড়ি…কারেন্ট এল বলে—পাঁচ মিনিট শেষ হতে চলল।’
আলো জ্বলে গেছিল। মিস্টার হালদার ওরফে বর্মনখুড়ো চুরুট মুখে রিসেপশন দিয়ে বের হওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘লোলা, আই শ্যাল বি লেট টু নাইট—সি য়ু টুমরো মর্নিং।’
ওয়ার্ডরোবের ভেতরে বসে দরদর করে ঘামছিল বৃকোদর। তার মাথায় তখন খালি চিন্তা, মালিককে অ্যারেস্ট করা গেছে কি না।
কতক্ষণ এভাবে বসেছিল বৃকোদর, তার হিসেব নেই। হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে ওয়ার্ডরোবটা
নীচে নামতে শুরু করল। বৃকোদরের মুখে হাসি ফুটল। বেশ কিছুক্ষণ নামার পর আবার ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল ওয়ার্ডরোব। আবছা আলোয় বৃকোদর দেখল, একটা ব্যাগ হাতে কে যেন এগিয়ে আসছে। পকেটে হিমশীতল নলের স্পর্শ অনুভব করতে-করতে হেসে ফেলল বৃকোদর—।
‘হাই, লোলা!’
লোলা হকচকিয়ে গেল, পরমুহূর্তেই ব্যাগটা ফেলে দৌড় লাগাল।
হাসতে-হাসতে বৃকোদর ব্যাগটা খুলতে লাগল। কারণ, সে জানে, লোলার জন্য দরজায় অপেক্ষা করছেন বর্মনখুড়ো, দিল্লি পুলিশের সঙ্গে। লোলা নীচে নামার পর ওঁরা গোপন জায়গা থেকে বেরিয়ে দরজায় পৌঁছেছেন।
সুরথের বাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে বৃকোদর বলছিল, ‘স্ফিঙ্কসের চোখে বসানো ছিল ভিউয়ার, যার সাহায্যে দরজায় কাচ বসানো জায়গা দিয়ে সোজা দেখা যেত ওয়ার্ডরোব—বন্ধ ও খোলা দু-অবস্থাতেই। ঘরে আর-কোনও নিরাপদ জায়গা না থাকায় লোকে ওয়ার্ডরোবেই টাকা-পয়সা রাখত, আর সেটুকু ওরা নজর করত ভিউয়ার দিয়ে। প্রতি ঘরের সামনেই একটা করে ভিউয়ার লাগানো ছিল। টাকা-পয়সা রেখে বাইরে বেরোলেই ওরা ওয়ার্ডরোব কাম লিফটকে নামিয়ে নিত আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রান্সফার রুমে। ট্রান্সফার রুম—কারণ, ওখানেই আসল টাকা বের করে নকল টাকা ভরে দেওয়া হত। আর ঘরের মালিকরা নিজেদের অজান্তে বাজারে ছড়িয়ে দিত জাল নোট। এভাবেই এদের শিকার হয়েছে বিজয় কাজোলকার, শঙ্কর তেওয়ারি এবং আপনার ভাইপো শ্রীতরুণ। আনন্দের কথা যে, হোটেলের মালিক ধরা পড়েছে…জাল নোট তৈরির যন্ত্রপাতি উদ্ধারের কাজ এখন দিল্লি পুলিশের। ক্যালকাটা পুলিশের হোমিসাইডের বড়কর্তার একটা কাজ অবশ্য বাকি আছে এখনও : পাওনাদারের বাকি টাকাটা মেটানো—অধমের দিনকাল বড় টানাটানিতে যাচ্ছে, স্যার।’
একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে একগাল হাসলেন বর্মনখুড়ো।
মাসিক রোমাঞ্চ
অক্টোবর, ১৯৭৭