লক্ষ্মীর প্রত্যাবর্তন
০১. তোতলামি
ইংরেজিতে এলিজিবল ব্যাচেলর বলে একটি কথা আছে, যার সরাসরি মানে হল যোগ্য কুমার অর্থাৎ যোগ্য পাত্র।
বিয়ের বাজারে সুপাত্রের এইভাবে পরিচয় দেওয়া হয়। তবে এর পরেও আছে মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলর যার মানে হল সবচেয়ে যোগ্য পাত্র।
একদা কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে, নব যৌবনে বিক্রমাদিত্য মিত্রকে অনায়াসে মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলর বলা যেত। কুলীন কায়স্থ, উচ্চ বংশ। লম্বা, ফরসা, ঠিক উত্তমকুমারের মতো দেখতে না হলেও বেশ সুদর্শন। শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ার, ভাল রেজাল্ট। একটা বিলিতি কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে পাশ করতে না করতে ভাল চাকরি। বয়স মাত্র ছাব্বিশ।
সুতরাং সবদিক থেকে সর্বার্থে তখন সুযোগ্য পাত্র ছিলেন বিক্রমাদিত্য। বলা উচিত, ব্যাকরণ ভুল হলেও, সুযোগ্যতম পাত্র, যাকে ওই ইংরেজিতে বলে মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলর।
কিন্তু এর পরেও একটা বিষয় উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে। এতাদৃশ গুণাবলি থাকা সত্ত্বেও বিক্রমাদিত্যের একটা ত্রুটি ছিল। তিনি ছিলেন আংশিক তোতলা।
তোতলা কিংবা আংশিক তোতলা এসব কথা হয়তো আজকের পাঠক বুঝবেন না। আজকাল তো তোতলা দেখাই যায় না। নতুন যুগের কী সব চিকিৎসা বেরিয়েছে, মানসিক চিকিৎসা। আত্মবিশ্বাসের অভাবেই নাকি তোতলামি দেখা দেয়, যে মানুষ বড়বাবুর সামনে তোতলা, সেই আবার ছোটবাবুকে স্বতঃস্ফুর্ত গালাগাল দেয়, অনর্গল। কার সঙ্গে কথা বলছি, কী কথা বলছি, কেন কথা বলছি–এসব চিন্তা মাথায় ঢুকলে অতিশয় সাব্যস্ত ব্যক্তিও কথায় কথায় তোতলা হয়ে পড়ে। হাত কচলায়, আজ্ঞে-আজ্ঞে করে।
আমরা শৈশবে এবং কৈশোরে অনেকরকম তোতলা দেখেছি। আগে বাংলা সিনেমায় তোতলার চরিত্র ছিল বাঁধা, যাত্রা-থিয়েটারেও প্রায় তাই। আমাদের কলেজ-জীবনে বাৎসরিক সোশ্যাল ফাংশনে একবার শীতল চট্টোপাধ্যায় নাকি সন্দীপ স্যানাল (এঁদের কি এখন আর কেউ মনে রেখেছে?) একটা কমিক করেছিলেন।
শিয়ালদা স্টেশনে নৈহাটি লোকালের কামরায় জানলার ধারে এক ব্যক্তি বসে রয়েছেন, এমন সময় জনৈক তোতলা ভদ্রলোক তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, খুব কষ্ট করেই জিজ্ঞাসা করলেন, ভা-ভা-ভা-ভা-…ই, ন-ন-ন-ন-… ওই হাটি? জানলার ভদ্রলোক কোনও কথা না বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন, এদিকে ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। এই ব্যাপার দেখে পাশের এক ভদ্রলোক দয়া পরবশ হয়ে গলা চড়িয়ে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ নৈহাটি। উঠে পড়ুন, তারপর সেই নীরব জানলাধারীকে বললেন, আপনি তো আশ্চর্য লোক মশাই, ট্রেনটা যে নৈহাটি যাচ্ছে এ কথা বলতে কী খুব কষ্ট হচ্ছিল?
ভদ্রলোক বললেন, খু-উ-উ-উব কষ্ট। আ-আ-আ-মি তোতলা। পরে বোঝা গেল এই বুদ্ধিমান। তোতলা অন্য তোতলার সঙ্গে কথা বলেন না। পাছে সে ভাবে যে সে তাকে ভ্যাঙাচ্ছে। এটা তার অভিজ্ঞতা, ইতিপূর্বে অপরিচিত তোতলার সঙ্গে বাক্যালাপ করতে গিয়ে তিনি একাধিকবার নির্যাতিত হয়েছেন।
তোতলা বৃত্তান্ত একটু দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ গল্পে তার প্রয়োজন আছে।
তবু গল্পেই ফিরে যাচ্ছি। তার আগে সামান্য একটু বাঁয়ে। বাঁয়ে মানে কম্যুনিস্ট নেতা নাম্বুদ্রিপাদ, এই তীক্ষ্ণধী দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ সুবক্তা ছিলেন এবং তোতলা ছিলেন। বক্তৃতার মধ্যে কদাচিৎ তোতলামি করেছেন, তবে করতে হলে দ্বিধা করতেন না।
একদা এক দুঃসাহসী অর্বাচীন সাংবাদিক এই নেতাকে প্রশ্ন করেছিলেন, স্যার আপনি বোধহয় একটু তোতলান?
সুরসিক নাম্বুদ্রিপাদ মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিলেন, সবসময় নয়। শুধু যখন কথা বলি তখন।
০২. ফুলশয্যা
ওই ছাব্বিশ বছর বয়েসেই বিয়ে হয়েছিল তখনকার সুযোগ্যতম পাত্র বিক্রমাদিত্য মিত্রের। রীতিমতো পালটি ঘরে, সম্বন্ধ করে, কনে দেখে শুভদিনে, শুভ লগ্নে, শুভ বিবাহ। কন্যার নাম রাজলক্ষ্মী। কন্যা রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী। শ্রীরামপুরের বনেদি বংশের মেয়ে শৈশবে মাতৃহীনা হয়ে দিল্লিতে মাতুলালয়ে মানুষ হয়েছে। বিয়ের বেশ কিছুদিন আগে শ্রীরামপুরে চলে আসে। সেখান থেকেই বিয়ে হয়।
এর আগেই আবাল্য দিল্লিতে মাতামহীর উদার প্রশ্রয়ে রাজলক্ষ্মীর একটু অদ্ভুত ধরনের মেজাজ তৈরি হয়। আদুরে বড়লোকের মেয়েরা এরকম হয়। যা ভাবা তাই করা, সঙ্গে সঙ্গে করা, রাজলক্ষ্মীর আদুরে চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
শ্রীরামপুরের বাড়িতে এসে রাজলক্ষ্মী একটি হিংস্র চেহারার হুলো বেড়ালকে আদর যত্ন করে পোষ মানায়। বেড়ালটি সাদা কালো রঙের এবং নিশ্চয়ই খুব ঝগড়াটে এবং মারামারি পরায়ণ, যার প্রমাণ হল তার একটি কান কাটা এবং লেজের কিয়দংশ ঘেঁড়া। এই বেড়ালের নাম হুলোঝুলো। এই হুলোঝুলোই কিন্তু কাল হল।
বিয়ের পর নববধূ যে শুধু শাড়ি-গয়না, বাসন-কোসন, বিছানাপত্র নিয়েই এল তা নয়, তার সঙ্গে কোলে চড়ে এই হুলোঝুলোও বিক্রমাদিত্যের বাড়িতে এল।
প্রবীণারা বধূমাতাকে বরণ করতে গিয়ে দেখলেন নববধূর সঙ্গে একটি হুলো বেড়ালকেও বরণ করে নিতে হচ্ছে। রাজলক্ষ্মীর আঁচলের নীচেই হুলোঝুলো ছিল। বিক্রমাদিত্যের বৃদ্ধা পিসিমা যখন আদরণীয়া বউমাকে ধান-দুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে চিবুকে একটি আলতো চুমু খেতে গেলেন, তখন হুলোঝুলো ফাঁস করে উঠে বৃদ্ধার গলদেশ আঁচড়ে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন।
হই-হই কাণ্ড। কেউ ডাক্তার ডাকতে গেল। কেউ টিটেনাস ইঞ্জেকশন কিনতে গেল। বিক্রমাদিত্যের অতি সাবধানী পিতৃদেব কয়েক হাজার নগদ টাকা দিয়ে বিক্রমাদিত্যের এক মামাকে, অর্থাৎ তাঁর এক শালাকে পাঠালেন যে কটা পারা যায়, অ্যান্টি র্যাবিজ ইঞ্জেকশন কিনতে। জলাতঙ্ক রোগের এই ওষুধ সবসময় পাওয়া যায় না।
ঘটনার আকস্মিকতায় বিয়ের জোড়ের দক্ষিণ প্রান্তে বিক্রমাদিত্য হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে, রাজলক্ষ্মী নির্বিকার। আর এর মধ্যে হুলোঝুলো আরেক কাণ্ড করেছে। পিসিমাকে আঁচড়ে দিয়েই রাজলক্ষ্মীর কোল থেকে এক লাফে নেমে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। সেখানে একটি নতুন কাঁসার থালায়, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা মাঙ্গলিক জোড়া ইলিশ নববধূকে অভ্যর্থনা করার জন্য সাজানো ছিল।
শুঁকে শুঁকে সেই থালার কাছে গিয়ে একটি ইলিশকে লেজ ধরে টানতে টানতে হুলোঝুলো তখন রাস্তার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।
এই দেখে বাড়ির পুরনো চাকর নীলমণি একটা লাঠি দিয়ে হুলোঝুলোর পিঠে মারল এক ঘা। লাঠি হুলোঝুলোর পিঠে পড়তে দুটি কাণ্ড ঘটল। হুলোঝুলো লেজ উঁচু করে এক দৌড়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে দোতলায় উঠে গেল এবং প্রাণপ্রতিম হুলোর এই নির্যাতন দেখে নববধূ রাজলক্ষ্মী আমার হুলো, আমার হুলোঝুলো বলতে বলতে চোখ উলটিয়ে ভূমিতলে শায়িতা পিসিশাশুড়ির কোলের উপর গিয়ে পড়ল।
সেইসঙ্গে জোড়ে বাঁধা বিক্রমাদিত্য হুমড়ি খেয়ে পড়ল দুজনেরই উপরে। কেলেংকারি কাণ্ড, শুধু বাড়ির লোকজন নয়, আশেপাশের পাড়া প্রতিবেশী, রাস্তার লোকজন সবাই ছুটে এসে কী হয়েছে। কিছু বুঝতে না পেরে শোরগোল আরও বাড়িয়ে দিল।
ব্যাপারটা কোথায় গড়াত তা বলা কঠিন। তবে বিক্রমাদিত্যের জ্যাঠামশাই প্রেমাদিত্যবাবু স্থিতধী মানুষ, কলেজে অঙ্কের অধ্যাপক। তিনি বললেন, যা হবার তা হয়েছে। আগে নতুন বউকে ঘরে ভোলো। বউমা আমাদের একাধারে মা লক্ষ্মী ও ষষ্ঠী। একেবারে বেড়াল বাহন নিয়ে এসেছেন।
দোতলায় উঠে দেখা গেল, হুলোঝুলো দোতলার একটা ঘরের সামনে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। তাকে দেখে রাজলক্ষ্মীর কান্না থামল, সে হুলোঝুলোকে কোলে নিয়ে চোখের জল মুছতে লাগল।
হুলোঝুলো কিন্তু নির্বিকার, এর পরের ঘটনাবলি আরও বিচিত্র এবং রোমাঞ্চকর। এ কাহিনিতে তার প্রয়োজন নেই। আবার পরের দিন ফুলশয্যার রাতে যাচ্ছি।
.
ফুলশয্যার দিন খাওয়া-দাওয়া মিটিয়ে অতিথি-অভ্যাগতদের বিদায় করে বিক্রমাদিত্য যখন শোওয়ার ঘরে প্রবেশ করল, তখন সে যা দেখল তা দেখে তার মাথায় রক্ত চড়ে গেল।
এমন একটি সুন্দর স্বপ্নের রাত। সুন্দরী নববধূ বালিশে মাথা দিয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছে, আর তারই ডানপাশে বালিশে শুয়ে রয়েছে হুলোঝুলো। যে বালিশটায় আসলে বিক্রমাদিত্যের শোয়ার কথা। স্বভাবতই বিক্রমাদিত্য হুলোঝুলোকে টুটি ধরে বিছানা থেকে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। হুলোঝুলো ফোঁস করে উঠে মাথা ঘুরিয়ে বিক্রমাদিত্যের কবজিতে কামড়ে দিল। বিক্রমাদিত্যের তা সহ্য হল না। সে সামনের জানলা গলিয়ে হুলোঝুলোকে সদর রাস্তার দিকে ছুঁড়ে দিল।
ইতিমধ্যে রাজলক্ষ্মীর ঘুম ভেঙেছে। সে এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে ডুকরে কেঁদে উঠল। বিক্রমাদিত্য কিছু না বলে কবজির ক্ষতে একটু ডেটল লাগিয়ে বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ল।
রাজলক্ষ্মী অঝোরে কাঁদতে লাগল। শুধু হুলোঝুলো নয়, সে ইতিমধ্যে জেনে গেছে তার বর তোতলা। বাসরঘর থেকে শুরু করে আজ এই ফুলশয্যার রাত পর্যন্ত তোতলামি এবং স্বাভাবিক উত্তেজনাবশত বিক্রমাদিত্য রাজলক্ষ্মীকে একটিও সম্পূর্ণ বাক্য বলতে পারেনি। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে কিন্তু আ-আ-আমি তো-তো-তো… এই পর্যন্ত এসে থেমে গেছে। আজ সন্ধ্যাতেই সুসজ্জিতা নববধূকে দেখে তুমি কী সুন্দর জাতীয় কিছু কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু পরপর সাত আটটা তু-তু-তুতু করা ছাড়া এগোতে পারেনি, রাজলক্ষ্মী হেসে ফেলেছিল। বলেছিল, তু-তু-তু-তু আবার কী? আমি কী কুকুর না বেড়াল যে আমাকে তু-তু করে ডাকতে হবে।
তখন হেসেছিল, কিন্তু এখন আর রাজলক্ষ্মী হাসছে না, হুলোক্সলোর শোকে এবং সেইসঙ্গে তোতলা স্বামীর কথা ভেবে সে নীরবে কাঁদতে লাগল।
রাতে বিক্রমাদিত্যের ভাল করে ঘুম হল না, ঘুম হওয়ার কথাও নয়। ভোরবেলার দিকে আধো তন্দ্রায় মনে হল রাজলক্ষ্মী ঘর খুলে কোথায় যেন যাচ্ছে।
যেখানে খুশি যাক, বিক্রমাদিত্য কোনও কথা
বলল না, এরপরে যখন অনেক বেলাতে ঘুম ভাঙল, তখন সে দেখল তার মাথার কাছে একটা কাগজের টুকরো, তাতে লেখা,
আমি হুলোঝুলোকে
খুঁজতে চললাম। তাকে না পাওয়া
পর্যন্ত ফিরছি না।
না, রাজলক্ষ্মী আর ফেরেনি। বিক্রমাদিত্যের বিয়ের শিক্ষা তো হয়েই গিয়েছিল, এমনকী কয়েকমাসের মধ্যে সে একটি বিলিতি কোম্পানিতে চাকরি জোগাড় করে ইংল্যান্ডে চলে গেল।
০৩. পুনর্মিলন
বিশ বছর পরে বিক্রমাদিত্য আবার দেশে ফিরে এসেছে। দীর্ঘকাল দেশের সঙ্গে প্রায় কোনও যোগাযোগ ছিল না। অবশ্য এর মধ্যে মা-বাবা, প্রবীণ আত্মীয়েরা সবাই বিগত হয়েছেন। তাই দেশে ফেরার খুব একটা টানও তার ছিল না। পুনরায় বিয়ের কথাও ভাবেনি। বিলেতে প্রেম, লিভ টুগেদার, এরকম খুচরো ব্যাপার অবশ্যই ঘটেছে, তবে তা গণ্যের মধ্যে নয়।
বিশ বছর নিঃসঙ্গ প্রবাসে বিক্রমাদিত্য বিলিতি পাউন্ডে যে টাকা জমিয়েছে, ভারতীয় অঙ্কে সে অন্তত দু-চার কোটি হবে। বিলেতে গিয়ে বিক্রমাদিত্যের সবচেয়ে বড় উপকার হল যেটা কোনওরকম ডাক্তার, ওষুধ, চিকিৎসা ছাড়াই তার তোতলামি সেরে গেল।
অবশ্য একদিন তার দেশে ফেরার বাসনা হল, ওখান থেকেই দালালের মারফতে সাদার্ন অ্যাভিনিউতে বিলাসবহুল বহুতল বাড়ির একটি দক্ষিণ খোলা ফ্ল্যাট কিনল।
এতকাল বিদেশে থাকার পর এখানকার শব্দদূষণ, বায়ুদূষণে বিক্রমাদিত্যের অবশ্য কিছু অসুবিধে হচ্ছিল, তবে সে রাস্তায় বেরোলে। এই বারোতলার ফ্ল্যাটে দূষণ ঢের কম।
কাজের লোক কাউকে রাখেনি। বিলেতে থেকে রান্না করা, কাপড় কাঁচা, বাসন মাজা সব অভ্যেস হয়ে গেছে। কাজের লোক মানেই বাড়তি ঝামেলা, সকালের দিকে একবার রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-এর একটা পুরনো মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে পাঁচশো গ্রাম দই কেনে। লেকমার্কেট থেকে কিছু শাকসবজি ও ফল। আর কাটাপোনা বা ওই জাতীয় কয়েক টুকরো মাছ।
টক দই বিক্রমাদিত্যের অতি প্রিয়। বিলেতে থাকতে রাশিয়ার যোগার্ট খাওয়া তার অভ্যেস হয়ে। গিয়েছিল। এখানকার টক দই অবশ্য খুব ভাল। সকালবেলা অল্প নুন চিনি আর লেবুর রস মিশিয়ে বড় এক গেলাস টক দইয়ের ঘোল খেয়ে নেয়। আর কিছু পরিমাণ দই মিশিয়ে শসা কুচি, টমাটো কুচি, আম-আপেলকলা যখন যে ফল পাওয়া যায় তা দিয়ে একটা রায়তা বানায়। বিক্রমাদিত্যের সারা দিনে এই দুটিই প্রধান খাদ্য। সঙ্গে কখনও এক চামচ ভাত, দু-টুকরো পাঁউরুটি কিংবা ভাজা মাছ। বেশ ভালই চলছিল তার।
আজ কয়েকদিন হল হয়েছে কী, সকালে দই এনে খাবার টেবিলের উপর রেখে বিক্রমাদিত্য যখন স্নানে যায়, তখন কী করে যেন ভাঁড়ের দই নিঃশেষ হয়ে যায়। রীতিমতো ভৌতিক ব্যাপার। রহস্যটা কিছুতেই উন্মোচন করতে পারে না বিক্রমাদিত্য। এসব দিনে তাকে প্রায় অভুক্তই থাকতে হয় আর বেরিয়ে গিয়ে দুই কিনে আনতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু একদিন ব্যাপারটা ধরা পড়ল। বাথরুমে স্নান করতে সবে ঢুকেছে বিক্রমাদিত্য, এমন সময় টেলিফোন বাজতে সে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে একটা সাদা-কালো, কানকাটা, লেজ ছেঁড়া হুলো বেড়াল দইটা চোখ বুজে পরম তৃপ্তিতে খাচ্ছে। তাকে দেখেই বিড়ালটা দৌড়ে গিয়ে জানলা দিয়ে মহাশূন্যে একটা লাফ দিল। বিক্রমাদিত্য ভাবল নির্ঘাৎ মারা পড়বে। কিন্তু তা হবার নয়। বারো ফুট দূরে সামনের ফ্ল্যাটের খোলা জানলায় সে অবতীর্ণ হল এবং মুহূর্তের মধ্যে ফ্ল্যাটের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ওই ফ্ল্যাটটা এই তলাতেই। ফ্ল্যাটের দরজায় নেমপ্লেট লাগানো আছে। ইংরেজিতে লেখা লখমি দেবী। ভদ্রমহিলাকে দু-চারবার যাতায়াতের পথে এবং লিফটে বিক্রমাদিত্য দেখেছে। সুডৌল, মধ্যবয়সি, সুন্দরী মহিলা। হাসি বিনিময় হয়েছে, তবে আলাপ হয়নি।
আজ বিক্রমাদিত্য ভাবল, বেল দিয়ে ভদ্রমহিলাকে ডেকে বলে আসে যে আপনার বেড়াল সামলান। সে দৈনিক আমার দই খেয়ে যায়। তারপর ভাবল, কী দরকার কাল থেকে দই ফ্রিজে রেখে দেব। বেড়াল তো আর সেখান থেকে খেতে পারবে না।
কিন্তু এরপরেও মাঝেমধ্যে গোলমাল হতে লাগল। বেড়ালের সাহস বেড়ে গেছে। মাঝেমধ্যে জানলা দিয়ে ঢোকে, ভুল করে দুই টেবিলে রাখলেই নিঃশব্দে মুহূর্তের মধ্যে এসে খেয়ে যায়। একদিন কী ভেবে রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-র যে দোকান থেকে সে নিয়মিত দই কেনে, সেই প্রবীণ দোকানিকে বিক্রমাদিত্য তার সমস্যা বলল। বিচক্ষণ মিষ্টান্ন বিক্রেতা সব শুনে খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, এটা কোনও সমস্যাই নয়।
বিক্রমাদিত্য বলল, কোনও সমস্যা নয়! ভদ্রলোক বললেন, ওই যে সামনে পানের দোকান দেখেছেন, ওই দোকান থেকে পানে খাওয়ার চুন কিনে নিয়ে যান। তারপর একটা প্লেটের মধ্যিখানে চুনটা রেখে চারপাশে দই দিয়ে দিন। এবার দই খেতে গিয়ে মজা বুঝবে বেড়াল।
সত্যিই মজা বুঝেছিল সেই বেড়াল। দই খেতে খেতে চুনে মুখ পড়তেই সে বিদাৎ বেগে জানলার দিকে ছুটে গেল, যথারীতি প্রতিদিনের মতো মহাশূন্যে লাফ দিল নিজের বাড়ির জানলার দিকে কিন্তু আজ চুনে মুখ পুড়ে যাওয়ায় তার অঙ্কে সামান্য ভুল হয়েছিল। সে জানলার নীচে গুঁতো খেয়ে সরাসরি নীচে পড়ে গেল।
বাথরুমের দরজার আড়াল থেকে দৃশ্যটা উপভোগ করছিল বিক্রমাদিত্য। হঠাৎ বেড়ালটার ক্রুদ্ধ, বিকৃত মুখ, কাটা কান, ছেঁড়া লেজ, সাদাকালো লোম–সব দেখে বিক্রমাদিত্য হৃদয়ঙ্গম করল, সর্বনাশ। এই তো সেই হুলোঝুলো। যে তার জীবন ব্যর্থ করেছে।
মুহূর্তের মধ্যে এটাও অনুমান করতে পারলে, পাশের ফ্ল্যাটে লক্ষ্মী দেবীই হল রাজলক্ষ্মী। সামান্য চেনা হলেও সাত পাকে বাঁধা সম্পর্ক, সেকি ভোলা যায়? আর এক মুহূর্তও দেরি করল না। বিক্রমাদিত্য। সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বাথরুমের তোয়ালে জড়ানো অবস্থাতেই একইসঙ্গে পাশের ফ্ল্যাটের দরজার বেল বাজাতে ও কড়া নাড়তে লাগল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। লক্ষ্মীদেবী দরজায় এসে দাঁড়ালেন। বিক্রমাদিত্য সরাসরি তাকে জিজ্ঞাসা করতে গেল, কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে পারল না। বহুদিন পরে আবার তার তোতলামি ফিরে এসেছে, একবার আপনি লক্ষ্মী বলতে গিয়ে আ-আ-আ… করে ঠেকে যায়। আরেকবার তুমি রাজলক্ষ্মী প্রশ্ন করতে গিয়ে তু-তু-তু.. করতে থাকে।
সেই কতদিন আগের তু-তু-তু-তু.. ভদ্রমহিলা মৃদু হেসে বললেন, ঠিক আছে আর তু-তু করতে হবে না। আমি রাজলক্ষ্মী, রাজ কেটে দিয়ে লক্ষ্মী হয়েছি।আর একটাই প্রশ্ন ছিল হুলোঝুলো বিড়াল এতকাল বাঁচল কী করে? প্রশ্নটা মুখে করার সাহস পেল না। ঘরের ভিতরে ড্রেসিং টেবিল, সেখানে এগিয়ে গিয়ে একটা লিপস্টিক তুলে নিয়ে আয়নায় লিখে প্রশ্ন করল। রাজলক্ষ্মী বলল, একটা হুলোঝুলো তো নয়, একটা হুলোঝুলো গেছে, আবার একইরকম দেখতে আরেকটা কুড়িয়ে এনেছি। আমার জীবনে তো আর কিছু নেই। বিক্রমাদিত্য আয়নার নীচের দিকে ছোট ছোট করে লিখল, এ হুলোৰুলোও তো গেছে। একটু আগেই বারোতলার জানলা থেকে নীচে পড়ে গেল। রাজলক্ষ্মী বলল, তা যাক, এই শেষ, এখন তো তোমাকে পেয়ে গেছি। রাজলক্ষ্মী বিক্রমাদিত্যকে বাহুপাশে আবদ্ধ করল।
গল্প এখানেই শেষ। কিন্তু বারোতলা, চোদ্দতলা থেকে পড়ে গেলে বিড়াল মরে না। কথায় বলে বিড়ালের নয়টা জীবন।
হুলোঝুলোও তখন নীচের লনে ঘাসের উপরে পড়ে কোনওরকমে সম্বিত ফিরে পেয়ে, ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে এখন বারোতলার ফ্ল্যাটের দিকে উঠছে। এবার রাজলক্ষ্মী যেভাবে পারে সামলাক।