রোমান্স
অবসরের জীবনে ধীরে-সুস্থে রয়ে বসে উপভোগ করার মতো জিনিসের অভাব আর যারই থাক, অতীশ ভট্টাচায্যির অন্তত নেই। শীতের ঘুম, তৃতীয় কাপ চা, হরেক রকমের বই, পত্র-পত্রিকা, মর্নিং ওয়াক… ইচ্ছে হলে থিয়েটার-সিনেমা, ইচ্ছে হলে বাড়ি বসে যৌবনকালের বাংলা গান কিংবা শুধু টিভির স্ক্রিনে আলগা করে চোখ ফেলে বসে থাকা, কিংবা পুরনো বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা জমানো।
পুরো যৌবনটা কেটেছে ছোটাছুটি করে। একটু বেশি করে বিছানায় গড়ানো সেটাও যেন একটা আলাদা উপভোগের স্বাদ বয়ে আনে। ধরো মাঘ মাসের ভোর ছ-টা। কথায় বলে মাঘের শীত বাঘের গায়ে। তা তেমন শীত হতভাগা কলকাতাতে আর পড়ে না। তবু ভোরের দিকটা ওরই মধ্যে একটু জমজমাট। জলযোগের পয়োধি মার্কা হয়ে থাকে। তা এতদিন তো সে পয়োধি চাখবার সুযোগ পাওয়া যায়নি। অফিসের আগের আবশ্যিক প্রাতঃকৃত্যগুলো তো ধর তক্তা মার পেরেক জাতীয় ছিল। এখন অতীশ ঘাপটি মেরে থাকেন। মাথার অর্ধেকটা অবধি বালাপোশ চাপা দিয়ে জয়া উঠে পড়েছে টের পান। কেমন একটা অবৈধ প্রেমের রোমাঞ্চ নিয়ে বালাপোশের মধ্যে আরও ঘন হয়ে যেতে থাকেন তিনি।
জয়ার উঠে-পড়ার মধ্যে আগেকার সেই তড়াক ভাবটা আর নেই। একবার দুবার এপাশ ওপাশ করল, হাউমাউ করে গোটা পাঁচেক হাই তুলল, পটপট করে কটা আঙুল মটকাল, তারপর এক পা লেপের ভেতরে, এক পা লেপের বাইরে, ভেতরে… বাইরে, ভেতরে… বাইরে, তুমি কি কুমির-ডাঙা খেলছ? পিটপিট করে চোখ খুলে সোঁদা সোঁদা গলায় অতীশ প্রশ্নটা ছোড়েন।
আমার দুঃখু তুমি আর কী বুঝবে? ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলেন জয়া, অবসর তোমারই হয়েছে, আমার তো আর হয়নি। সমাজ-সংসার, আত্মীয়স্বজন, লোকজন। নিজের ছেলেমেয়ে পর্যন্ত স্বার্থপর। চোখ যতদিন না উলটোচ্ছি, কারও চোখ ফুটবে না। এক্ষুনি গিয়ে রামধনকে তুলতে হবে দুধ আনার জন্যে। কত করে বললুম বাড়িতে দিয়ে যাবে ব্যবস্থা করো। তা কটা পয়সার জন্যে… এখন ওই বুড়ো মানুষটা! কদিনই বা আছে? ওকে তুলে পাঠাও, মেয়ে তো নামেই আধুনিকা। আমি মা হয়ে অনুমতি দিচ্ছি তুই দুধ আনতে যা, মুদির দোকানে যা, কিছু হবে না। না তাঁর মান যায়! মুদির সঙ্গে সুখদুঃখের গল্প করতে করতে সময় জ্ঞান থাকে না। কী না জনসংযোগ করছি, তৃণমূল স্তরে, এ দিকে আড়াইশো চিনি। নিয়ে আয় তো রে বললেই শ্রেণিচৈতন্য বেরিয়ে পড়ে।–আচ্ছা, মা, তুমি একটা যুবতী মেয়েকে মুদির দোকানে পাঠাচ্ছ?—বলতে বলতেই জয়া ঘর পেরিয়ে, দালান পেরিয়ে ওদিকে। কলঘরের দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ।
অতীশ আবার বালিশে মুখ গুঁজে জয়ার ফেলে-যাওয়া ভাষণের টুকরোটাকরা শব্দ চাখতে থাকেন। জয়ার আগে এত কথার বাঁধুনি ছিল না, এ বাঁধুনি ছিল জয়ার মায়ের কথাবার্তায়, তিনি চলে গেছেন, ভাষণগুলি মেয়ের কাছে ফেলে গেছেন। চোখ না উলটোলে চোখ ফুটবে না, ক-টা পয়সার জন্যে, মুদির সঙ্গে সুখদুঃখের গল্প, কেমন লাগসই ছবির মতো শব্দগুলো! দু-তিন বছর আগে হলে এমন ভোর পার-হওয়া দৌড়ন্ত সকালে বিছানা মুড়ি দিয়ে শব্দের ছবিটা উপভোগ করা যেত?
তবে অতীশের সবচেয়ে পছন্দের জিনিস হল পুরোনো বন্ধুদের আসা-যাওয়া এবং তাদের সঙ্গে অতীতচারণ।
শীতের বেলাটা ধরো মরে মরে আসছে।
আশপাশের বাড়ির আলসেতে, ন্যাড়াবোঁচা গাছগুলোর গায়ে মরাটে আলো। একেবারে বাসি মড়ার রং। এই সময়টা যতই চায়ের সঙ্গে মচমচে মুড়ি-কড়াইশুটি রেখে যাক জয়া, মনটা কেমন খারাপ-খারাপ করে। মরা আলোর সঙ্গে কেমন একটা তাদাত্ম এসে যায়। আয়না দেখতে ইচ্ছে যায়, মাথার ফাঁকা অংশটাতে আঙুল চলে যায়। নিজের হাত পা ধড় মুণ্ডু সব যেন বোপর বাড়ি যাওয়ার যোগ্য ময়লা পুরনো কাপড়ের মতো লাগতে থাকে। এই সময়ে, যেমন আজ, বেলটা যদি মধুর সুরে বাজে এবং দরজা খুলে বাসনমাজুনি ঝোল্লার মায়ের বদলে শোভন শোভনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় এক মুখ হাসি নিয়ে, তবে তার চেয়ে খুশির জিনিস আর কী হতে পারে?
বুকটা চিতিয়ে অতীশ বলে ওঠেন, যাক রে শোভন এবারের মতো বাঁচিয়ে দিলি, আরেকটু হলেই আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলুম।
তা, সেইরকম চেহারাই করেছেন বটে। মুখ যেন খ্যাংরা ঝাঁটা। খোক্কসের মতো নখ, ও জয়া তোর কর্তার বোধ হয় নেল পালিশ পরবার শখ হয়েছে রে! -শোভনা চ্যাঁচাল।
জয়া সিঁড়ির মোড় থেকে রেলিং বুকে চেপে ঝুঁকে পড়েন, আরে আসুন আসুন…।
ঠিক বলছ তো? আসব? না চা দের ভয়ে লুকিয়ে পড়বে?
শোভন ঘন্টায় ঘন্টায় চা খান। কবে জয়া থিয়েটারের টিকিট কাটা থাকায় পাড়ার বান্ধবীর সঙ্গে চলে গিয়েছিল বহুবার ক্ষমা চেয়ে, এবং দারুণ নাটকটা বাদ দিতে না পারার জন্য লজ্জিত হয়ে, শোভন আজও সে কথা তুলে খোঁটা দিতে ছাড়েন না।
জয়া বললেন—দেখুন অর্ধেকটা প্রকাশিত হয়ে রয়েছি। পুরোটা হলে না হয় আপনার বস্তাপচা ঝগড়াটা শুরু করবেন। গ্যাসে অলরেডি জল বসিয়ে এসেছি।
সর্বনাশ! সেবার গৃহত্যাগ করেছিলে, এবার কি গৃহদাহ?
এরই মধ্যে নীচের কোনো একখানা ঘর থেকে বেরিয়ে ঝিলিক হাত নেড়ে বলল, ওঃ বাবা মা কাকু, তোমাদের ভম একটু কমাও, নইলে ওপরে যাও, আমরা একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছি।
ভম তো বেশ কমিয়েছি রে, শোভন বললেন। সাড়ে পাঁচ কেজি কমেছে, ডাক্তার বলছে…।
আহা বুঝতে পারছ না যেন। দেহের নয়, গলার। নবটা একটু ঘোরাও… বলে ঝিলিক পরদা সরিয়ে আধো-অন্ধকার ঘরটার মধ্যে সেঁদিয়ে গেল।
দুই দম্পতি মেয়ের কাছ থেকে বকুনি খেয়ে কাঁচুমাচু মুখে ওপরে উঠে গেলেন। জয়া বললেন, চলুন আমরা বারান্দায় গিয়ে বসি। আপনারা বসুন গিয়ে, আমি চা-টা নিয়ে আসছি।
বারান্দায় ভালো করে গুছিয়ে বসে শোভন বললেন, ঝিলিকটা কী এমন রাজকার্য করছে রে? কোচিং ক্লাস খুলেছে নাকি? ঘরের আধা-অন্ধকারের মধ্যে জোড়া জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করছে বলে মনে হল, যেন বনের মধ্যে বনবেড়ালদের সভা বসেছে।
যা বলেছিস।—অতীশ সায় দিলেন, ওয়াইল্ড একেবারে।
বলেন কী? চেয়ার-টেবিল ভাঙে নাকি?—শোভনা ঘাবড়ে গেছেন।
ভাঙেনি এখনও, তবে ভাঙলেই হল, যা জোরে চাপড়ায়।
জয়া একটা জাম্বো সাইজের ফ্লাসক নিয়ে ঢুকলেন। শোভনা গলা নামিয়ে বললেন, হ্যাঁ রে জয়া, ড্রাগ-ফ্রাগ খায় না তো! বিশ্রি একটা গন্ধ পেলুম যেন!
জয়া বললেন, অতটা বোধ হয় না। ড্রাগ-নিবারণী সমিতি না কী একটা করেছে যে!
কী জানি! শোভনা বলে উঠলেন, পুলিশেরও তো চুরি-ডাকাতি করার কথা, মানছে কি? আসলে গাঁজার গন্ধটা একজনের দৌলতে আমার চেনা কিনা!
বিয়ে থা দে, বিয়ে-থা দে,—শোভন দরাজ গলায় বলে উঠলেন। শোভনার গাঁজা প্রসঙ্গটা চাপা দেয়ার জন্যেই কি না কে জানে!
বিয়ে কি আজকালকার ছেলেপুলেদের কেউ দেয় রে। বিয়ে আজকাল করে। অতীশের নিঃশ্বাস পড়ল।
শোভনা বললেন, হ্যাঁ, আপনার মতো আগেকার ছেলেপুলেদের বিয়েই যেন কেউ ঘাড়ে ধরে দিয়েছিল। হেদুয়ার মোড়ে হা-পিত্যেশ, বসন্তকেবিনে আধখানা কবিরাজি কি কফি হাউজে সাড়ে তিন কাপ কফি নিয়ে টানা তিন চার ঘন্টা, এলিটে ফেয়ারওয়েল টু আর্মস, রূপবাণীতে জংলী… এ সব যেন আর আমরা জানি না।
জানো তো দেখছি অনেক কিছুই, কিন্তু ম্যাডাম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়া কি এত ডিটেল জানা যায়?
অতীশের কথায় জয়া হাততালি দিয়ে হেসে উঠল, খাপ খুলব না কি? শোভনা!… সামান্য একটু লজ্জা রুমাল দিয়ে মুছে নিয়ে শোভনা বললেন, সত্যি, দিনগুলো সব কোথায় গেল বলো তো! কী দিনই ছিল!
ইট ওয়াজ দা বেস্ট অব টাইমস, ইট ওয়াজ দ্য ওয়ার্ল্ড অব টাইমস, সবার জীবনেই এই প্যারাডক্সিক্যাল দিনগুলো আসে, তারে কয় জৈবন।
অতীশ বললেন, আমাদের এসেছিল, আমাদের পিতাদের এসেছিল, আমাদের পিতামহদের এসেছিল, এখন আমাগো পোলাপানদের আইস্যাছে।
তা সে যাই বল অতীশ, আমাদের যৌবনকাল যেন একটা বিশেষ রকম ছিল। ঠিক ওই স্বাদটা, শোভনের গলায় রোমন্থনের আমেজ।
জিভ বার কর, জিভ বার কর—এমন করে অতীশ বললেন যে ঘাবড়ে গিয়ে শোভন সঙ্গে সঙ্গে হাঁ করে এক হাত জিভ বার করে ফেলেছেন।
বলি জিভটা কার?
এ আবার কী প্রশ্ন? এ জিভ আমার, আবার কার?
তবে? নিজের জিভে অন্যের জৈবনের স্বাদ পাবি কী করে?
কথাটা খানিকটা ঠিক অতীশ, কিন্তু তবু বলব দিনকাল পালটে গেছে ভাই। আমাদের সময়ের সেই সর্বাত্মক রোম্যান্স আর নেই। চিন্তা করে দ্যাখ, মণিকা আড়ি আর শান্তনু চক্রবর্তী–কী জুটি রে? মণিকা চার ফুট দশ ইঞ্চি, শান্তনু ঝাড়া ছয় কী আরও বেশি। একটা চুমু খেতে গেলে পর্যন্ত হয় মণিকাকে মই লাগাতে হযে, নয় শান্তনুকে হাঁটু গেড়ে বসতে হবে। প্রেমে কোনো বাধা হয়েছিল? দুজনে কলেজস্ট্রিট দিয়ে গন্ডোলার মতো ভেসে চলেছে, শান্তনুর টাকা পয়সা মণিকার জিম্মায়, মণিকার নোট-পত্তর শান্তনুর ঝোলায়।
তোমরা আর কী জানো? কতটুকুই বা জানো?—শোভনা জয়ার দিকে চেয়ে হেসে বললেন, জয়শ্রী লাহিড়িকে মনে আছে তো? দারুণ মিষ্টি দেখতে! তোমরা
সবাই তো তার জন্যে পাগল ছিলে।
কোনকালে? কোনকালে?—অতীশ চ্যাঁচামেচি করে উঠলেন। শোভন বললেন, আরে বাবা বেথুন-বিউটি বলে কথা! একটু আধটু দোলা তো দেবেই। তার ওপর সাজ কী? সব সময়ে ফিলিম-স্টারের মতো সেজে আছে। গালে রুজ, ঠোঁটে লিপস্টিক।
জয়া বললেন, মোটেই না। ওর চেহারাটাই ওই রকম। গালের চামড়া এত পাতলা আর মসৃণ যে লাল ব্লাড ভেসলগুলো দেখা যেত, তাতেই মনে হত কিছু মেখেছে।
শোভনা বললেন, জয়া ঠিকই বলেছে। জয়শ্রীর চোখের পাতাই এত ঘন আর কালো ছিল যে মনে হত কাজল পরেছে, ঠোঁট এমনি এমনিই লাল। কীর্তি জানেনা ওর? হস্টেলে থাকত তো! একদিন গিয়ে দেখি কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে। আমার দেখে বললে, ওহ ডগ-টায়ার্ড। ক্যান্ডিডেট ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে। একই ফিলম উনিশবার দেখা হল। উনিশজনের সঙ্গে।
কোথায় এখন জয়শ্রী?
এক বোকা ব্যারিস্টারকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করছে। আচ্ছা… তোদের অরিজিৎদার কথা মনে আছে? অরিজিৎ গোস্বামী!
শোভন বললেন, সেই রামস্বামী না কি মেয়েটা লেঙ্গি মারল বলে তো সুইসাইড করতে গিয়েছিল।
রাইট। লাস্ট মোমেন্টে পেট ওয়শ করে বেঁচে যায়।
শুধু কি প্রেম? বাঁধনহারা, ছন্নছাড়া, ওয়াইল্ড, স্যাক্রিফাইসিং… আরও কত কী ছিল। জলসা ছিল, গড়পাড়ের, বাদুড়বাগানের, শ্রীকৃষ্ণ লেনের, বউবাজারের। বিসর্জনের বাজনা বাজতে না বাজতেই শুরু হয়ে যেত। অতীশ বললেন, জলসাগুলো ছিল রোমান্সের আবহসংগীত। মেজাজ তৈরি করে দিত। আহা! ঠিক রাতদুপুর, আসর সরগরম, কানাতের ফাঁক দিয়ে শীতের হাওয়া ঢুকছে! সতীনাথ সেই হাওয়ায় বিরহ ঢেলে দিয়ে গেলেন।
শুধু বিরহ? অভিমান, আর্তি, আকুতি। তারপর শেষরাতে সেই বিরহের ঘুড়ি কেটে দিলেন দ্বিজেন মুখার্জি তাঁর ব্যারিটোন গলায়—শ্যামলবরণী তুমি কন্যা, ঝিরঝির বাতাসে ওড়াও ওড়না… আহা হা ভাবতে গেলে আর জ্ঞান থাকে না রে ভাই, জ্ঞান থাকে না।
এই সময়ে ঝিলিক হাতে একটা বড়ো প্যাকেট নিয়ে এসে বলল, কাকু, কাকিমা, তোমরা মোমো খাবে? গরম গরম আছে।
হঠাৎ? কোত্থেকে এল? অতীশ জিজ্ঞেস করলেন।
মুখ টিপে মুচকি মতো হেসে ঝিলিক বলল, বনবেড়ালরা এনেছে। এই নাও চায়ের সঙ্গে স্মৃতির সস মাখিয়ে খেয়ে ফ্যালো। ওড়না দুলিয়ে চলে গেল ঝিলিক। চোখদুটো ভ্যালভেলে করে শোভন বললেন, আমাদের বাল্যকালে ছিল কড়াইয়ের চপ, পকৌড়ি, দ্বারিকের শিঙাড়া। দেখতে দেখতে চপ হয়ে গেল… অতীশ তাড়াতাড়ি বললেন, ফ্লপ।
শোভনা বললেন, পকৌড়ি আর বলে না, বলে পাকোড়া।
জয়া বললেন, শিঙাড়াও বলে না, বলে সামোসা। এসে গেছে রোল, মোমো…
মোমোয় কামড় দিয়ে শোভন বললেন, স্মৃতির সস মাখিয়ে খাওয়াই বটে। ঝিলিকটা বলেছে ভাল। আচ্ছা অতীশ, তখন বনবেড়াল বললুম ও শুনতে পেল কী করে বল তো?
জয়া বললেন, ওর মাথার পিছনে দুটো চোখ আছে। রোটেটিং কান। কিছু চোখ কান এড়ায় না।
তা ঘরের মধ্যে ওগুলো বনবেড়াল, না মন বেড়াল?
অতীশ হো হো করে হেসে উঠলেন, বলেছিস ভালো। আমাদের যুগের জয়শ্রী লাহিড়ি যদি উনিশটাকে খেলাতে পারে তো এ যুগের ঝিলিক ভট্টাচার্যই বা কম যাবে কেন?
না না ঠাট্টা নয়। আচ্ছা জয়া–ঝিলিকের বয়স কত হল? কিছু মনে না করলে বল তো শুনি!
মনে করার কী আছে? ঝিলিক তো আপনার রিন্টুর পরের বছরই হল। আটাশ পার হয়ে গেছে। এম এ হয়ে গেছে এক যুগ হতে চলল।
করছে কী?
কী করছে না তাই জিজ্ঞেস করুন। প্রথমে তো দিব্যি টুক করে কলেজে চাকরি পেয়ে গেল। করল বছর দুয়েক। তার পর একদিন খোঁজ পেলুম কলেজের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে।
খোঁজ পেলি মানে? শোভনা অবাক হয়ে বললেন। তোদের সঙ্গে কী তোদের একমাত্র মেয়ের কোনো মানসিক যোগাযোগ নেই?
আছে বললে আছে ভাই, নেই বললে নেই—জয়া বললেন।
বুঝলুম না—শোভনা হতাশ।
না বোঝার কী আছে?—অতীশ চেয়ার এগিয়ে বসেন, সকালবেলা চা করে দিচ্ছে, বিছানা গুছোচ্ছে, বালিশ রোদে দিচ্ছে, দেয়ালে ঝুল দেখলেই ঝাড়ছে, মাকড়সা দেখলেই মুচ্ছো যাচ্ছে, ওর মায়ের আর ওর শতখানেক প্রসাধনের সামগ্রী নিয়ম করে কিনে আনছে।
জয়া হাঁ হাঁ করে উঠলেন—শতখানেক প্রসাধনের আইটেম মানে? ইয়ার্কি পেয়েছ?
আরে বাবা ক্রিমই তো খান পঞ্চাশেক। ঠোঁটের ক্রিম, চুলের ক্রিম, নাকের ক্রিম, কপালের ক্রিম, গালের ক্রিম…..
শোভনা বন্ধুর সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন, আহা, ঠোঁটের আর গালেরটা ঠিক আছে অতীশদা। বাকিগুলো আপনার উর্বর মস্তিষ্কের প্রোডাক্ট। কথা বলবার সুবিধের জন্যে মানে আলাপটা বেশ রঙ্গিলা করে তোলবার জন্যে ব্যবহার করছিলেন।
তোমরা সাইড-ট্র্যাকে যাচ্ছ—শোভন বিরক্ত হয়ে বললেন, আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল মা-বাবার সঙ্গে কন্যার মানসিক যোগাযোগ, সেটা…
হ্যাঁ হ্যাঁ, অতীশ বললেন, ওই যা বলছিলুম, সবই করছে, বেরোনোর সময়ে বলেও যাচ্ছে, ইচ্ছে হলে ডেস্টিনেশন এবং ফেরবার সম্ভাব্য টাইমও। কিন্তু কোথায় কখন বললে কী হবে, কেন, কেমন এসব বিষয়ে চুপ। ওগুলো নাকি ব্যক্তিগত ব্যাপার।
এই এক ব্যাক্তিগত উঠেছে আজকাল, শোভনা ফোঁস করে উঠলেন, রিন্টুটাকে নিয়ে আমাদের কত জল্পনা-কল্পনা। ছেলে আমাদের বন্ধু হবে। বাপের বন্ধু, মায়ের বন্ধু। ছেলে তো বাপের ফাজলামি শুনতে শুনতে বড়ো হল। কিন্তু বন্ধু কই? এখন দেখছি সে গুড়ে বালি। ব্যক্তিগত-তে এসে সব ঠেকে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত-টা আবার ঠিক কোনখান থেকে আরম্ভ হচ্ছে বোঝা দায়।
এই সময়ে ঝিলিক আবার এসে ঢুকল। ঝিলিক একটি অতি তন্বী পাঁচফুটি তরুণী। বয়সে যুবতি হলেও তাকে দেখলে আঠারো পার হয়েছে বলে মনে হয় না। রং মাজা। দেখতে সে ঠিক কেমন, সুন্দরী না বান্দরী সেটা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। কারণ অল্পবয়সের মহিমা তার সর্ব অবয়ব থেকে ঠিকরোচ্ছে। সে একটা ঝোল্লা কুর্তা পরেছে, যার ওপর কতকগুলো কার্টুন ফিগারের অ্যাপ্লিক সাঁটা। সালোয়ারটাও ঝোল্লা। ফলে ঝিলিককে আরও বেঁটে দেখাচ্ছে। কিন্তু তার চোখমুখ, হাঁটাচলা ইত্যাদি দেখলেই বোঝা যায় সে এসব গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না। ঝিলিকের মুখ তেলতেলে। প্রচুর চুলেও বেশ তেল। মাঝখানে সিঁথি কেটে দু-দিক পেতে আঁচড়ানো। ঝকঝকে দাঁতে ঝিলিক হেসে বলল, বসতে পারি?
শোভন-শোভনা হাঁ-হাঁ করে উঠলেন, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই বসবি বইকি! এ তো আমাদের সৌভাগ্য।
কেন? সৌভাগ্য কেন? বলতে বলতে ঝিলিক বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে নীচের দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে বলল, সদর দরজাটা ভালো করে টেনে দিয়ে যাস। এই পটাশ, পরের দিন রেকর্ডগুলো, মনে আছে তো?
নীচ থেকে কতকগুলো উচ্চ আওয়াজ এল। চার পাঁচটি ছোটো বড়ো চুল ছেলে, চার পাঁচটা এলোমেলো চুল মেয়ে রাস্তা কাঁপিয়ে তর্কাতর্কি করতে করতে চলে গেল।
ঝিলিক এবার মুখ ফিরিয়ে বলল, কেন? সৌভাগ্য কেন?
সৌভাগ্য মানে সৌভাগ্য কেন হবে? সৌভাগ্য বই কি! শোভন-শোভনা আমতা আমতা করতে থাকেন।
ঝিলিক হেসে বলল, আসলে আমার কথা আলোচনা হচ্ছিল, খুব ঘাবড়ে গেছ আমি এসে বসতে। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। ঠিক? না, না, মিথ্যে কথা একদম বলবে না, মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। আচ্ছা কাকু, তোমরা এত পি এন পি সি করো কেন বল তো?
জয়া রাগ করে বললেন, তুই তাহলে আমাদের পর? তোকে নিয়ে আলোচনা করলে পি এন পি সি?
দেখ মা, তা যদি বল প্রত্যেকটা মানুষই প্রত্যেকটা মানুষের পর। আমার পেট কামড়ালে তুমি বড়ো জোর ওষুধ দিতে পার। ডাক্তার ডাকতে পার, কিন্তু আমার ব্যথাটা তুমি ভোগ করতে পার কি?
অতীশ জোর গলায় বেশ ঘোষণা করার মতো করে বললেন, ঝিলিক, আমরা কিন্তু মোটেই তোমাকে নিয়ে সারাক্ষণ আলোচনা করিনি, একদম শেষ দিকটায় তোমার সম্বন্ধে, মানে তোমার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সামান্য কিছু আধা সিরিয়াস আলোচনা হয়েছে। তাকে নিন্দা বা চর্চা কোনোটাই বলা চলে না।
তা হলে কী আলোচনা হচ্ছিল এতক্ষণ?
রোমান্স নেই, শোভন ঘোষণা করলেন, প্রেমও নেই, আমাদের সময়ে ছিল, এখন নেই। এই।
ঝিলিক হাসতে হাসতে বলল, খাবারদাবারগুলো এখন কেমন যেন লাগে, না কাকু? সে সবজিও নেই, সে মাছও নেই, সব ভ্যাসকা। সে রাঁধুনিও নেই। কাকিমা রাঁধে, ঢোঁক গিলে ভালো, কিন্তু কাকু তোমার মায়ের মতো শুক্তো করতে কি পারে? বড়ির টক? শাকের ঘন্ট? বলো? জনান্তিকেই বলো না হয়, কিন্তু বলো। আচ্ছা বাবা, তুমি তো দিবারাত্র হা-হুতাশ করছ—নাই নাই সে-সব গান নাই বলে, তা তোমার বাবা মানে আমার দাদু গান বিষয়ে তোমাকে কিছু বলেননি? দাদু বা দিদা? বলেননি আহা জ্ঞান গোঁসাই, কৃষ্ণচন্দ্র দে… সব কী গানই গাইতেন, তোমাদের আধুনিক গান সতীনাথ মুখার্জি, শ্যামল মিত্র তার কাছে দাঁড়াতে পারে না, একেবারে ছ-ছ্যা। বলেননি?
কী বলতে চাস তুই? অতীশ রে-রে করে উঠলেন, আমরাই বুড়ো হয়ে গেছি? আমাদের স্বাদ পাবার ক্ষমতা চলে গেছে আর পৃথিবীর সবকিছুই ঠিক আগের মতো আছে, এই তো?
তুমিই বলছ বাবা কথাটা, আমি কিন্তু বলিনি—ঝিলিক মিটিমিটি হাসতে লাগল।
গা জ্বালানো চিড়িক চিড়িক হাসিসনি আর—জয়া এবার তাঁর কথার বাঁধুনি বার করে ফেলেন, আর সব ছেড়ে রোমান্সের কথাই ধর না। রোমান্স আর নেই, সেই সুদূর, সেই বিধুর,… ঝিলিক যোগ করল, হ্যাঁ হ্যাঁ সেই তিয়াস সেই হতাশা, সেই বিষাদ সেই বিরাগ, সেই অনুরাগ সেই অভিমান, সেই সর্বস্বত্যাগ সেই আত্মঘাত…
হ্যাঁ হ্যাঁ সেই শরীরপাত সেই কুপোকাত—এভাবে বললে কমিক শোনাবেই কন্যে। কিন্তু কথাটা সত্যি। তোমাদের যুগে প্রেম নেই, সবই ক্যালকুলেশন। তোমাদের হচ্ছে ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল, পোষালো তো পোষালো, নইলে কাটো। চুটিয়ে ডেটিং করো, দায়িত্ব নেবার কথা বোলো না, কিছু বলতে হলে শেয়ারবাজারের কথা বলো ব্যাঙ্ক থেকে কত লোন পাওয়া যাবে, কত ইন্টারেস্ট, কতটা ফেরত দিলে কতটা মেরে দিলে চলবে, বাড়ি মর্গেজ, গাড়ি মর্গেজ, ইনস্টলমেন্টের ফার্নিচার, ভাগের মা ভাগের বাবা, ভাগের ছেলেপুলে… আঙুল নেড়ে নেড়ে বলতে বলতে থেমে গেলেন শোভন।
কী হল! গাড়ি স্কিড করে গেল কেন কাকু? আগে বাড়ো, ভালোই বলছ।
অতীশ এইবার সুযোগটা নিয়ে নিলেন, বললেন, কথাটা ভালো করে বলার ব্যাপার নয় ঝিলিক। কথাটা হচ্ছে, তুই এখন কী করছিস, ভবিষ্যতেই বা কী করবি? কলেজের চাকরিটা ছাড়লি কেন? বিয়ে-থাই বা করবি কবে? এ সব তো আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে ড্রয়ারে চাবি দিয়ে রেখেছিস। আজ শোভনকাকুরা আসতে যদি তুমি চাবি খুললে তো কথাগুলো হয়েই যাক না! আপত্তি আছে?
না, আপত্তি নেই—ঝিলিক এবার গম্ভীর হয়ে বলল, আমার এক নম্বর কৈফিয়ত শুনে নাও বাবা-মা, কলেজের চাকরিতে আজকাল বড্ড বায়না ক্কা, কষ্ট করে এম, এ. পাস করলুম আটান্ন পার্সেন্ট মার্কস নিয়ে, তো বললে স্লেট পরীক্ষা দাও, যদি পাস করলুম তো বললে ভাইভা দাও, তা যদি দিলুম তো বললে এম ফিল করতে হবে, পি এইচডি করতে হবে, না হলে কদিন পরে আর ইনক্রিমেন্ট হবে না। এখন স্টাডি লিভ পাবার জন্যে কলেজের টি আর-দের সঙ্গে কনস্ট্যান্ট যোগাযোগ রেখে যেতে হবে, তার ওপর দলাদলি, কে সিপিএম, কে ফরওয়ার্ড ব্লক, কে কংগ্রেস, কংগ্রেসের সঙ্গে আবার সিপিএম-এর গোপন আঁতাত। এ সব বুঝতেই তো আমার বছরখানেক ঘুরে গেল। একে আমার অত ঘাড় হেঁট করে পড়তে ভালোই লাগে না, তার ওপর অত তেল খরচা, অত ক্লিকবাজি, আমার পোষালো না, আমি বিদ্রোহ করলুম। ধরি মাছ না ছুঁই পানি করে চালাতে পারতুম অনায়াসেই। কিন্তু সেটা ক্ষমতার অপচয় মনে হল, স্রেফ ছেড়ে দিয়ে চলে এলুম।
তা হলে তো তুই হার স্বীকার করে নিলি–শোভন বললেন।
আমার জীবনটা তো এখনও শেষ হয়ে যায়নি কাকু। আমি, সবাই যা করে সেই হেঁ-হেঁ-টা করলুম না, সিস্টেমটাও আমার পছন্দ হল না, এটা বিদ্রোহ। বিদ্রোহ ব্যাপারটা কিন্তু রোমান্টিক। টাকা-আনা-পাইয়ের হিসেব যারা করে তাদের দ্বারা হয় না।
সকলে একটু চুপচাপ। ঝিলিক বলল, আচ্ছা কাকু, কাকিমা, আমি একাই কি প্রবেলম চাইল্ড? রিন্টু? রিন্টুকে নিয়ে তোমাদের কোনো সমস্যা নেই?
তুমি প্রবলেম চাইল্ড কে বলেছে?—শোভনা জয়া একসঙ্গে বললেন।
শোভনা বললেন, কে বলে রিন্টুকে নিয়ে সমস্যা নেই!
শোভন-শোভনা পরস্পরের দিকে তাকালেন।
রিন্টু কি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে? ঝিলিক জিজ্ঞেস করল।
বলিস কী? এই বাজারে ওই চাকরি ছাড়া? তুই মেয়ে বলে পেরেছিস।
কিন্তু ও তো ভীষণ আনহ্যাপি ওখানে, বুঝতে পার না?
সেটাই তো প্রবলেম, মুখটা ম্লান করে থাকে, খেতে শুতে দীর্ঘশ্বাস, রোগা হয়ে যাচ্ছে।
তোমরা ঠিক জানো, চাকরিটাই ওর একমাত্র প্রবলেম?
কেন? আর কোনো প্রবলেমের কথা তো আমরা জানি না।
ঠিকই বুঝেছিলুম, তোমরা ওর কোনো খবরই রাখে না।
কী করে রাখব! তোমাদের চাবি-দেওয়া ব্যক্তিগত ড্রয়ার আছে না?–শোভনা ঝংকার দিয়ে উঠলেন।
তা আর কী প্রবলেম ওর?—শোভন জিজ্ঞেস করলেন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলা, ক্ষুধামান্দ্য—এ সব কীসের লক্ষণ কাকিমা, তোমাদের এক্সপিরিয়েন্স কী বলে?
সে কী রে? ও কি প্রেমে পড়েছে? হুর রে, কী মজা!–শোভনা প্রায় হাততালি দিয়ে ওঠেন আর কি,–তা ভাগ্যবতীটি কে?
তাকেই ভাগ্যবতী হতে হবে কেন? কাকিমা, রিন্টুও তো ভাগ্যবান হতে পারে!
রিন্টু ভাগ্যবান হলে আমাদের চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবে না। মেয়েটি কে? যে রিন্টুকে ভাগ্যবান করেছে। আমরা চিনি?
-চেনো।
তুই না কি রে?–শোভনা রই রই করে উঠলেন।
ঝিলিক আবার সেই চিড়িক মারা হাসি হেসে বলল, আমি কি পাত্রী হিসেবে খুব ভালো কাকু? একে তো খেয়ালি, তার ওপর ভীষণ গোঁয়ার। রিন্টুর ছ-ফুটের পাশে আমার পাঁচ ফুটই কি খুব মানানসই হবে?
শোভনা বললেন, তুই কি সেই জন্যে মত দিচ্ছিস না? দূর পাগলি। তুই আমাদের চেনাজানা, তোর বাবা-মা আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ড। এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে? আমাদের সময়েও ওরকম লম্বু গুড়গুড়ে জুটি ছিল। ওতে কিছু এসে যায় না।
অতীশ এই সময়ে বললেন, শুধু একটা মই…
জয়া চোখ পাকিয়ে তাকাতে তিনি চুপ করে গেলেন।
শোভন-শোভনা বললেন, রাজি হয়ে যা ঝিলিক। আমরা খুব খুশি হব।
ঝিলিক বলল, ধৈর্য ধরো। ধৈর্য ধরো, মেয়েটা আমি নয়।
তুই নয়?–হতাশ গলা শোভনার।
তবে তাকেও তোমরা দেখেছ।
দেখেছি? কে? কে?–শোভনা-জয়া একসঙ্গে হইহই করে উঠলেন।
পটাশ।
পটাশ? জয়া যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
শোভন বললেন, পটাশ না খটাশ? এ রকম আবার কারও নাম হয়? অ, তুই তখন ওপর থেকে বলছিলি বটে পটাশ রেকর্ড আনিস, না কী একটা!
শোভনা বললেন, ওই থ্রি কোয়াটার সুতো ঝোলা প্যান্ট আর ফতুয়া পরা মেয়েটা? চোখে বোধহয় সতেরো পাওয়ারের চশমা, দাঁত উচু-ওকে আমি প্রথমটায় মেয়ে বলে বুঝতেই পারিনি। আমার রিন্টুর পাশে ওই পটাশ?
প্রথমত কাকিমা, পটাশ নামটায় আপত্তি হলে ওর একটা পোশাকি নামও আছে। অনন্তযামিনী কৃষ্ণকামিনী সাবিত্রী কৌশল্যা আয়েঙ্গার। এখন উচ্চারণ করতে অসুবিধে বলে আমরা পটাশ বলেই ডাকি। দ্বিতীয়ত কাকিমা, কে কার পাশে থাকবে সেটা তো আর আয়না ঠিক করে দেবে না। কনভেনশন্যাল, রক্ষণশীল বিয়ে রোম্যান্টিক মানুষেরা কখনোই করে না। মন যাকে চায় তাকেই…
শোভন গম্ভীরভাবে বললেন, তা রিন্টুর মন যাকে চেয়েছে ওই পটাশ না পটাশিয়াম সায়নাইডটি কে? কী?
ও হল গিয়ে গ্লোব-ঐটার। পর্যটক। ওকে নিয়েই তো এখন ডকুমেন্টারি করছি আমরা। সেই জন্যেই ওর রেকর্ডস আনতে বলছিলুম। সাইকেলে ভারত ভ্রমণ দিয়ে আরম্ভ করেছিল। এখন তো আলাস্কা অবধি চলে গেছে।
ভালো। খুব ভালো। পছন্দ-অপছন্দ তোমাদের খুব ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা কিছু বলতে চাই না। তা রিন্টুর মন খারাপ করার কারণ কী? আমরা ওর পথের কাঁটা হয়ে থাকতে চাই না। অনুমতি দিয়ে দিচ্ছি, যা খুশি তাই করুক।
তোমরা অনুমতি দিলে কী হবে? পাত্রী স্বয়ং যে টালবাহানা করছে।
মানে? পটাশের রিন্টুকে পছন্দ হচ্ছে না? জয়া আকাশ থেকে পড়লেন।
কেন?
অবভিয়াসলি পটাশ আরও রোম্যান্টিক বলে। ওর দাবি রিন্টু ওই সরকারি চাকরিটা ছেড়ে দিক। ওরা দুজনে সারা পৃথিবী পর্যটন করে বেড়াবে। ট্রেনে, সাইকেলে, ট্রাকের মাথায়, হিচ হাইক আর কি, যখন যেমন জোটে।
অন্নবস্ত্র?–শোভনা হাঁ করে রয়েছেন। শোভন কোনোমতে জিজ্ঞেস করলেন। এ সব ব্যাপারে আজকাল কিছু স্পনসর-টর পাওয়া যাচ্ছে কাকু। তবে পটাশ পরোয়া করে না। ওর থিওরি হল দুটো শিক্ষিত বুদ্ধিমান ছেলেমেয়ে যাদের গোটা হাত-পা আছে তাদের গ্রাসাচ্ছাদনের অভাব হওয়ার কথা নয়। দরকার হলে মাল বইবে, দরকার হলে হোটেলে এঁটো বাসন ধোবে। মোট কথা…
অতীশ-শোভন প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলেন, রিন্টু একটা ইকনমিকসের এম.এস.সি. আই এ. এস. অফিসার… সে মাল বইবে? এঁটো বাসন ধোবে?
জয়া বললেন, পটাশের ইচ্ছে হয় সে বাসন ধুগে যাক। তাকে মানাবে এখন।
মজা পাওয়া গলায় ঝিলিক বলল, পটাশ কিন্তু বায়োকেমিস্ট্রির ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট মা, আর পটাশরা তিন পুরুষ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে আছে। ওর বাবা ডক্টর শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার এখন এডুকেশনের ডিরেক্টর।
চমৎকার, তা তাঁর মেয়ের এমন মতিগতি কেন? বাসনই যদি মাজবে তো বায়োকেমিস্ট্রি পড়ার দরকার কী ছিল?
পটাশ বলে, জীবনটাকে ঠিকমতো দেখতে শুনতে হলে, বুঝতে হলে, ল্যাবরেটরির বাইরে আসতে হবে। সমস্ত কাজ, সমস্ত পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে।
ভালো, তা ঘর-টর বাঁধা, ছেলেমেয়ে মানুষ করা এ সব করবে কবে? বুড়ো হয়ে গেলে?–শোভনার গলায় ঝাঁঝ।
কাকিমা সে-গুড়ে বালি, পটাশ বলে, পৃথিবীতে যথেষ্ট শিশু আসছে, তাদের আদর হচ্ছে না, তারা ধবংস হয়ে যাচ্ছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে ওদের দুজনের আর শিশু আনবার প্রশ্নই উঠছে না। আর ঘর বাঁধা? পটাশ পথকেই ঘর বলে মনে করে। বুড়ো বয়সের নাকি প্রশ্নই নেই। ওর ধারণা এইভাবে পৃথিবী দেখতে-দেখতে ওরা যৌবনেই গত হবে, বৃদ্ধ আর হতে হবে না।
—বাঃ, হতভম্ব চার মা-বাবার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল।
অতীশ বললেন, তা এই চিরপথিক চিরনবীন পটাশকেই আমাদের রিন্টু বিয়ে করবে ঠিক করেছে?–অতীশের গলায় কি শ্লেষ?
ঝিলিক একটু চুপ করে রইল, তারপর মুখ তুলে আলতো করে বলল, সেখানেই তো আসল প্রবলেম।
চারজনেই হাঁ করে আছেন।
ঝিলিক বলল, কাকু, পটাশ বিয়ে করতেও চাইছে না।
মানে?
বলছে বিয়ে-টিয়ে ও সব পুরনো সমাজের পুরোনো অভ্যেস। যতদিন পরস্পরের পরস্পরকে ভালো লাগে ততদিন একত্রে থাকলেই হল।
অর্থাৎ?
রিন্টুর ভালো না লাগলে রিন্টুর ফিরে আসার স্বাধীনতা আছে। পটাশের ভালো না লাগলে পটাশেরও। এই নিয়েই ওদের টানাটানি চলছে এখন। রিন্টু ডিসিশন নিতে পারছে না। বেচারির অবস্থা খুব খারাপ কাকু। পটাশকে ছাড়া ওর জীবন অন্ধকার, পটাশেরও তাই… এ দিকে…
এই সময়ে ফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। অতীশ ধরবার জন্যে উঠছিলেন, ঝিলিক তড়াক করে লাফিয়ে উঠল, বলল, আমার একটা এস টি ডি আসার কথা আছে বাবা, আমি ধরছি।
ওঁরা চারজন বারান্দার বসেছিলেন পরস্পরের দিকে মুখ করে, বারান্দার কোলে ঘর, ঘরটা ছায়া-ছায়া দেখাচ্ছে, ঝিলিকের বিস্কুট রঙের পোশাক ঘরের রঙের সঙ্গে প্রায় মিশে গেছে। ওর খোলা চুলের ঢাল দেখা যাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে নাকের উগা। সবাই প্রায় একসঙ্গে ঘরের দিকে মুখ ফেরালেন, কেননা—মাউথপিসের মধ্যে ঝিলিক বলছে-আরেকটু চেঁচিয়ে বল রিন্টু, ভালো করে শুনতে পাচ্ছি না, কেমন একটা ভোঁ ভোঁ আওয়াজ হচ্ছে… হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছে… ডিসিশন নিয়েছিস। বাঃ, চমৎকার, হ্যাঁ ডিসিশনটাই আসল, তোর চোদ্দো আনা বুদ্ধিবৃত্তি-ম্যাচুরিটি জীবনবোধ ওই ডিসিশনের মধ্যে দিয়েই প্রকাশ পাবে। কী বললি? গুড। ভেরি গুড, আই কনগ্রাচুলেট ইউ, ঘটনাচক্রে কাকু-কাকিমা আজ এখানে। তুই ওদের বল, নিজেই বল… হ্যাঁ ন্যাচার্যালি খুশি হবেন।
মাউথপিসে হাত চাপা দিয়ে ঝিলিক এদিকে চেয়ে বলল, কে আসবে? কাকু না কাকিমা, রিন্টু মালদা থেকে ফোন করছে, ডিসিশন নিয়েছে…
জড়বৎ বসে থাকেন শোভন-শোভনা। কী ডিসিশন রিন্টুর, যাতে ঝিলিক তাকে কনগ্রাচুলেট করে? কী সেই ডিসিশন যা শুনলে তাঁরা নাকি ন্যাচার্যালি খুশি হবেন? বুদ্ধিবৃত্তি-ম্যাচুরিটি-জীবনবোধ? কী জীবনবোধের বার্তা শোনাবে রিন্টু, তাঁদের নয়নের মণি, একমাত্র আদরের সন্তান?