রেফ্রিজারেটর
আগে গালভরা পোশাকি নাম ছিল রেফ্রিজারেটর। অনেকদিন হল বস্তুটি আটপৌরে হয়ে গেছে, শহরে নগরে প্রায় ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে, এখন তাকে ছোট করে ফ্রিজ বলা হয়। যেমন কিছুদিন হল টেলিভিশন হয়েছে টি ভি।
টেলিভিশন নিয়ে এ যাত্রা কিছু লিখতে চাই না। বিদ্যাবুদ্ধির পক্ষে সে বড় গুরুপাক হবে। সে বিষয়ে যথা সময় যথাস্থানে লেখা যাবে।
ফ্রিজের কথার আরম্ভে একটা পুরনো প্রচলিত গল্পের উল্লেখ করে নিচ্ছি। সেই যে কোন বাড়ির বাচ্চা কাজের ছেলেটি বা মেয়েটি গরমের দিনে ঠান্ডার লোভে একটা ফ্রিজের মধ্যে ঢুকে শুতে যায় এবং তারপরে তার মধ্যে দমবন্ধ হয়ে মারা পড়ে, সে গল্পটার কিন্তু কোনও ভিত্তি নেই। যতদূর জানা গেছে এ রকম গল্প সম্পূর্ণ মনগড়া। তা ছাড়া একটি আটদশ বছরের শিশু দরজা খুলে শুতে পারে ফ্রিজের মধ্যে এমন জায়গাই বা কোথায় ? আসলে রেফ্রিজারেটর যুগ শুরু হওয়ার মুখে এই নতুন যন্ত্রটি সম্পর্কে অনীহা, উদ্বেগ ও কৌতূহল, সেই সঙ্গে গৃহস্থের নাগালের বাইরে এর উচ্চমূল্য সব মিলিয়ে এই ভয়াবহ গল্পটির জন্ম দিয়েছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, অনেকসময় অনেক কড়া ডিসিপ্লিনের ইস্কুল সম্পর্কেও গুজব রটে। অমুক স্কুলে একজন ছেলে বা মেয়েকে স্কুল ছুটির আগের দিন ঘরে আটকিয়ে শাস্তি দেওয়া হয়। তারপর দিদিমণি বা মাস্টারমশায় ব্যাপারটা স্রেফ ভুলে গিয়ে বাড়ি চলে যান। পরে কয়েকদিন বাদে স্কুল খুললে দেখা যায় সেই ছাত্র বা ছাত্রীটি ক্লাসঘরে মরে পড়ে আছে।
এ রকম গল্প বহু ক্ষেত্রেই গুজব মাত্র। ভাল করে খোঁজ নিলে শোনা যায়, এ ইস্কুল নয় সে ইস্কুল, বড়দিনের ছুটির আগে নয়, পুজোর ছুটির আগের ঘটনা।
ফ্রিজের গল্প বহুদিন বন্ধ হয়েছে কিন্তু স্কুলের গল্প আজও মাঝেমধ্যে শোনা যায়।
সে যা হোক আমরা ফ্রিজের আদি যুগের আসল ব্যাপারে যাচ্ছি।
আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে যখন আমি বঙ্গপ্রদেশের বৃহত্তম জেলার একটি মফস্বলি স্কুলের নিচু ক্লাসের ছাত্র সেই সময় সৌভাগ্যক্রমে আমি জীবনে প্রথম ফ্রিজ দেখতে পাই। আমাদের সেই আটকোটি লোকের বিশাল জেলায় তখন সবসুদ্ধ পাঁচ-দশটি ফ্রিজ ছিল কিনা সন্দেহ এবং তার অধিকাংশই গ্রামাঞ্চলে, রাজা-জমিদারের বাড়িতে। গ্রামে এমনকী শহরেও বিদ্যুৎ সহজলভ্য ছিল না। এগুলো ছিল কেরোসিনের ফ্রিজ।
আমি প্রথম ফ্রিজ দেখি টাঙ্গাইল শহরের উপান্তে এক জমিদারের কাছারি বাড়িতে। আজ যখন দেখি একটি সামান্য শিশু পর্যন্ত এক মুহূর্তের মধ্যে সুইচ অন করে একটা রেফ্রিজারেটর চালিয়ে দিচ্ছে তখন আমার মনে পড়ে শান্তিকুঞ্জের সেই অতিকায় ফ্রিজটির কথা। সেই ফ্রিজটি কেরোসিনে চলত। তখনকার মফস্বলে তরিতরকারি মাছ মাংস ফ্রিজে রাখার কোনও প্রশ্ন ছিল না, টাটকা এবং প্রচুর পাওয়া যেত এসব জিনিস, অবশ্য টাকা থাকলে।
ওই ফ্রিজটি ব্যবহার করা হত কালেভদ্রে। গ্রীষ্মকালে কোনও কোনও দিন নিমন্ত্রণ বা অভ্যর্থনা বা পার্টি থাকলে বরফ এবং ঠান্ডা জলের জন্য এবং ঠান্ডা দই, পুডিং বা কোনও শীতল পানীয়ের জন্য ফ্রিজটি চালু করা হত ওই নির্দিষ্ট দিনটিতে।
ফ্রিজটি আয়তনে ছিল বিশাল। প্রায় ছোটখাটো একটা সিঁড়িকোঠা ঘরের মতো। বিরাট দরজা, খুলে নিয়ে যে কোনও বাড়ির গেটে লাগিয়ে দেওয়া যায়, সিংহদরোজা বানানোর মতো দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ।
সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার ছিল ফ্রিজটা চালু করা। অনেক কাল আগের কথা স্পষ্ট মনে নেই তবে এখনও আবছা আবছা ভাবে আমি স্মরণ করতে পারি যন্ত্রটিকে কার্যকরী করার একটা দৃশ্য। আমার আট-দশ বছর বয়স হবে, টাঙ্গাইলের সেই জমিদার বাড়ির একটা দেওয়াল ঘেঁষা বড় বকুল গাছ থেকে প্রায় শিউলি ফুলের মতো বড় বড় বকুল ঝরে পড়ত বাইরের রাস্তায়; গ্রীষ্মের কোনও কোনও ঘুমভাঙা ভোরবেলায় সেই ফুল কুড়োতে যেতাম।
একদিন সেই প্রায়ান্ধকার প্রভাতে দেখি জমিদার বাড়ির মধ্যে ভীষণ হাঁকডাক হইচই চলছে। কৌতুহলবশত পাঁচিলের উপর উঠে বসে দেখলাম সামনের একটা বড় ঘরে বিশাল কালো একটা দৈত্যের সিন্দুকের মতো জিনিসের সামনে জটলা। দুটি কেরোসিনের টিন হাতে নিয়ে চারজন লোক এসে একটা বড় পাইপের মধ্যে চোঙা দিয়ে সেই তেল ঢালছে, আর সমবেত নির্দেশ আসছে, ‘আরও আরও, আর না, আর না, আরেকটু, আরেকটু।’ কিছুক্ষণ পরে তৈলবাহী পাইপ উপচিয়ে তেল পড়ে ঘর ভেসে গেল।
বাড়ির মধ্য থেকে ডেকে আনা হল জনা কয়েক দাসীকে। তারা বড় বড় ন্যাতা দিয়ে মুছতে লাগল পাথরের মেজে থেকে সেই উপছে পড়া কেরোসিন তেল।
সেদিন সন্ধ্যাতেই কীসের যেন ভোজ। এই পরিচারিকারা বাড়ির মধ্যে মাছ, তরকারি কুটছিল। তারা খুব গজগজ করতে লাগল তাদের স্বাভাবিক কাজে বাধা পড়ায় এবং পুরুষদের অকমর্ণ্যতায়। জনৈকার কথাবার্তার মধ্যে বিষাক্তভাব সম্ভবত বেশি ছিল, হঠাৎ দেখলাম যে দু’জন কেরোসিন ঢেলেছিল তাদের একজন শূন্য কেরোসিনের টিন তুলে সেই প্রগলভা পরিচারিকাকে মারতে উঠল। হয়তো ভয় দেখাতে চেয়েছিল।
কিন্তু এর পরেই ঘটল অঘটন। পিচ্ছিল কেরোসিনসিক্ত পাথরের মেজেতে দাঁড়িয়ে অতিরিক্ত অঙ্গভঙ্গি করতে গিয়ে ক্রুদ্ধ ভৃত্যটি তার ভারসাম্য রক্ষা করতে পারল না। সে সহসা পা পিছলে চিত হয়ে পড়ে গেল অন্য এক পরিচারিকার ঘাড়ে এবং সেই সঙ্গে তার হাত থেকে কেরোসিনের ফাঁকা টিনটা ছিটকে গেল। একটু দূরে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রেফ্রিজারেটার চালানোর নির্দেশ দিচ্ছিলেন প্রৌঢ় ম্যানেজার মহোদয়। তিনি উড়ন্ত কেরোসিনের টিনের আঘাতে ধরাশায়ী হলেন। বোধহয় টিনের কাটা অংশ তাঁর কপালে লেগে গিয়েছিল, সেখানে কেটে গিয়ে দরদর করে রক্ত পড়তে লাগল।
সে এক প্রমাণ সাইজের লঙ্কাকাণ্ড। হইচই হুলস্থূল, তারপরে রাগারাগি কাঁদাকাটি—বাড়ির মধ্য থেকে বৃদ্ধ ভূম্যধিকারী দৌড়ে ছুটে এলেন, প্রথমে তিনি কিছুতেই কী হয়েছে বুঝতে পারেন না। অবশেষে কিছুটা বুঝে, কিছুটা অনুমান করে তিনি সবাইকে থামালেন, মুখে বলতে লাগলেন, ‘ছিঃ ছিঃ, তোমরা কেউ কোনও কর্মের নও। ভোজের বাড়ি, আজ সন্ধ্যাবেলা দুশো-আড়াইশো গণ্যমান্য লোক খাবে। এখনও পর্যন্ত মেশিনটা চালাতে পারলে না। তার উপরে দেখছি নিজেদের মধ্যে গোলমাল বাধিয়েছ।’
কথা বলতে বলতে তিনি ফ্রিজের ঘরের দরজার কাছে এগোতেই একজন পরিচারিকা, যে পড়ে যায়নি, সে তাঁকে দেখে খুব তাড়াতাড়ি ঘোমটা টেনে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই গড়িয়ে পড়ল মেজেতে।
অবস্থার গতিক দেখে বৃদ্ধ ভদ্রলোক দূরে সরে গেলেন। একটু পরে ঘর-টর মোছা শেষ হল। এবার কাজের লোকেরা বড় বড় দইয়ের হাঁড়ি, আরও নানারকম পাত্র নিয়ে এল। তার মধ্যে কয়েকটা চিনেমাটির বয়াম, কাচের কুঁজো এমনকী পিতলের কলসি পর্যন্ত ছিল। সম্ভবত এগুলোর মধ্যে জল ভরা ছিল, বোতলে জলভরার কোনও ব্যাপারই নেই। সমস্তই এলাহি ব্যাপার।
এরপর এল আসল মুহূর্ত। মেশিনটি চালু করার পালা। এ কাজ ম্যানেজার বা কর্মচারীদের দিয়ে হবে না, ডাক পড়ল বিলেত ফেরত ছোট সাহেবের। তিনিই পরবর্তী জমিদার। তিনি এসে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিতে লাগলেন, ‘দরজা আরেকটু চেপে বন্ধ করো, একটুও যেন ফাঁক না থাকে তা হলে সঙ্গে সঙ্গে ফেটে যাবে, সব মারা পড়বে।’ ফাটা এবং মারা পড়ার ভয়ে সবাই যতদূর সম্ভব পিছিয়ে গেল, কেউ আর যন্ত্রের সুইচ চালু করতে সাহস পায় না।
শেষে ছোট সাহেব স্বয়ং দূর থেকে একটা কাঠের লাঠি দিয়ে সুইচটা নামিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘর ফাঁকা, যে যার মতো প্রাণভয়ে দৌড় দিল।
আমিও পাঁচিলের উপর থেকে এক লাফে নেমে বাড়ির দিকে ছুটলাম। নামার মুহূর্তে দেখতে পেয়েছিলাম ফ্রিজের ঘর থেকে ঘন ধোঁয়া বেরুচ্ছে এবং একটা গোরুর হাম্বা হাম্বা ডাকের মতো শব্দ বেরচ্ছে ফ্রিজের থেকে।
ওইদিন সন্ধ্যায় আমার বাবারও নিমন্ত্রণ ছিল, ওই ভোজসভায়। ‘কিছু খাওয়া গেল না। জল, শরবত, দই, এমনকী মাছ, তরকারির মধ্যে পর্যন্ত কেরোসিনের গন্ধ। চারটি মুড়ি দাও চিবিয়ে জল খেয়ে শুয়ে পড়ি’, বাবা শুকনো মুখে অনেক রাতে ফিরে এসে মাকে বললেন।