রেডিওটা খুলুন
এইবার প্রচারিত হচ্ছে এক সাক্ষাৎকারভিত্তিক কথিকা। আজ আমাদের স্টুডিওতে এসেছেন ডক্টর তুলসী রায়। তিনি আন্তর্জাতিক নারীজাগরণের এক প্রবাদ পুরুষ, মাপ করবেন, প্রবাদ মহিলা। আজ ভারতে তো কাল কুয়ালালামপুরে। আজ ফিনল্যান্ডে তো কাল ফ্রান্সে।
প্রশ্ন : আচ্ছা ডাক্তার রায়, আপনার অনুমানে, পৃথিবীর সব নারী কবে নাগাদ পুরোপুরি পুরুষ হয়ে যাবে!
উত্তর : আ মোলো, প্রশ্নের ছিরি দেখ! নারীরা কোন দু:খে পুরুষ হবে। পুরুষ হলে তো হয়েই গেল। আন্দোলনই তো থেমে যাবে। বরং পুরুষেরা সব নারীর মতো হয়ে যাবে। বড় বড় চুল, মিনমিনে স্বভাব, ন্যাকা ন্যাকা কথা, দুলদুলে চলন। আমরা ঘরে-ঘরে এমন করে দেব, যেন সব গৃহভৃত্য। কেঁচো করে দোব সব, কেঁচো। বুঝেছেন?
প্রশ্ন : তার মানে আন্দোলনের ধারাটাকে পালটে নিলেন। এতকাল তাহলে ভুল পথে চলছিল?
উত্তর : তোমার মাথা। গাধা কোথাকার। আমাদের একটা এক্সপেরিমেন্ট চলছিল। দেখা গেল সেটা হবে না। শয়তান ভগবানের সঙ্গে তো লড়াই চলে না। আমরা মেয়েদের জিনস পরালুম, জাঙ্গিয়া পরালুম, চুল কামিয়ে মাথা নেড়া করালুম।
প্রশ্ন : তারপর, আমেরিকায় ডাম্বেল, বারবেল ভাঁজিয়ে স্ফীতকে আরও স্ফীত করে এক একটা ভীমভবানী করে দিলেন।
উত্তর : অসভ্য! ইতর! কী তুলে কথা বলছ! ছোকরা!
প্রশ্ন : না, না, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। চোরের মন বোঁচকার দিকে। আমি বারবেল তুলেছি ম্যাডাম।
উত্তর : ন্যাকা। আমি যেন কিছু বুঝি না। তোমার নজর খারাপ ভাই। তোমাদের জন্যেই নারীরা জাগতে পারছে না। নারী কম্যান্ডো দিয়ে তোমাদের ঝাড় দেওয়া উচিত। আমরা মুয়াম্মার গাদ্দাফির সঙ্গে আলোচনা করেছি, তিনি আমাদের কম্যান্ডো ধার দেবেন বলেছেন।
প্রশ্ন : কেন? আপনাদের ট্র্যাডিশানাল ঝ্যাঁটা!
উত্তর : ওরে আমার ঝ্যাঁটাখেঘোর জাত! সেই খ্যাংরা কি আর আছে! ঘরে ঘরে এখন ফুলঝাড়ু। সেদিন আমাদের এক সদস্যা তার অপদার্থটিকে ফুলঝাড়ু ট্রিটমেন্ট দিচ্ছিল, হতভাগা আরামে ঘুমিয়ে পড়ল। মাঝখান থেকে ঝাড়ুটা গেল। চোদ্দ টাকা দাম।
প্রশ্ন : ভ্যাকুয়াম ক্লিনার কি নারী প্রগতির পক্ষে ক্ষতিকর হবে?
উত্তর : কেন ওটার সঙ্গে এটার কী সম্পর্ক! হচ্ছে নারীজাগরণের কথা, ইনি ভ্যাকুম ভ্যাকুম করছেন।
প্রশ্ন : না, মানে ঝ্যাঁটা তো একটা শাসনের প্রতীক বা সিম্বল ছিল, সেটাও যদি না থাকে, তাহলে সংসারের বাঁধন একটু আলগা হয়ে যাবে না! যেমন ধরুন পুলিশের হাতের ব্যাটন, ফায়ার ব্রিগেডের হাতের হোসপাইপ, চাকুরের হাতে ব্রিফকেস, দরজির গলায় ফিতে, ডাক্তারের বুকে স্টেথো, বড়মানুষের মুখে পাইপ, ইনটেলেকট্যুয়ালের ঝোলাব্যাগ, এই সবই হল সিম্বল। সিম্বল গেলে লড়াইটা হবে কী করে!
উত্তর : আমরা যে রাস্তায় চলেছি, সে পথে সংসার বলে আর কিছু থাকবে না। আপনি ন্যাতা-ঝ্যাঁটার কথা কী ভাবছেন! বেড়াল দেখলে যে-রকম দ্যাখমার করা হয়, পুরুষ দেখলে মেয়েরাও সেই রকম দ্যাখমার করবে। নতুন প্রজন্মের নারীরা কি চিজ তৈরি হবে, কোনও ধারণা নেই আপনাদের। অ্যাই শুনছো, বলে সুর তুলে বউরা আর স্বামীকে ডাকবে না। ডাকবে, অ্যায় গদা, এদিকে আয়। যা বাজার করে আন। পাই-পয়সার হিসেব দিবি।
প্রশ্ন : আর যখন টাকার দরকার হবে, তখন কী বলবে? গদাই, আমার গদু, মাইনের টাকাটা ছাড়ো মানিক!
উত্তর : হ্যাঁ তা বলতে পারে! বোকা হলে তো চলবে না! শঠে শাঠ্যং। আধুনিক যুগে ব্যাবসা আর বিজ্ঞাপন ছাড়া কিছু থাকবে না। এই যে এত বড় একটা ওয়ার্লড কাপ হয়ে গেল, তখন কী হল। আক্রমের আক্রমণে ল্যাম্ব কাত। লিউইস পরের বলে শূন্য করে হাঁসের সঙ্গে কাঁদতে-কাঁদতে বাড়ি ফিরছে। হ্যাটট্রিক হল বলে। দর্শকরা দড়ির মতো টান-টান। হঠাৎ বাঁ পাশ থেকে ছটা ঘোড়া বেরিয়ে এল টগরম-বগরম করে। লে হালুয়া। ফ্রিজের বিজ্ঞাপন। সেটা শেষ হতেই মোটরের বল ড্যানস। সেটা শেষ হতেই একটা ছেলে আর একটা মেয়ের কোল্ড ড্রিংকসের বোতল নিয়ে কাড়াকাড়ি। শেষে মেয়েটা মোটর সাইকেলের চাবিটা কেড়ে নিয়ে ছেলেটার নাকের সামনে দোলাতে লাগল, শেষে পেছনের সিটে উঠে বসে জাম্বুবানের মতো ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে ফটফটিয়ে চলে গেল। ওদিকে মাঠে কী হচ্ছে জানার উপায় নেই। গড়িয়ে এল একটা টায়ার। কিছু করার নেই, জগৎটা হল ব্যাবসার। টাকাই সব। মানি, মানি, মানি, সুইটার দ্যান হানি।
প্রশ্ন : আপনারা কি তাহলে মেয়েদের রাজনীতির নেতাদের মতো করতে চাইছেন?
উত্তর : অফকোর্স, তাঁরাই তো আমাদের আদর্শ! ভোটের সময় মরণপণ। ভোট শেষ হবার পর মেরে দোস্ত বলে দেখবেন না! মারবে বুলি, অপেক্ষা করো পাঁচ বছর, তারপর আবার শুনবে বন্ধুগণ। মেয়েদের আমরা সেটাই শেখাব, পয়লা, দোসরা, দশ তারিখ পর্যন্ত গদাই, গদু, মাল কব্জা হয়ে গেলেই অ্যায় ব্যাটা গদা, যা গ্যাসের লাইন দে, ছেলেকে ইস্কুলে দিয়ে আয়। গত পাঁচ হাজার বছর ধরে মেয়েরা পুরুষের অনেক নির্যাতন সহ্য করেছে। বন্ধুগণ!
প্রশ্ন : বান্ধবীগণ!
উত্তর : কেন, বান্ধবী কেন?
প্রশ্ন : আপনি কাদের সম্বোধন করছেন ম্যাডাম! নিশ্চয় মেয়েদের!
উত্তর : ও ইয়েস! বান্ধবীগণ! না, বান্ধবী বললে তেমন ফোর্স আসছে না। ফ্রেন্ডস বলি। ওই শব্দটা উভলিঙ্গ! ফ্রেন্ডস! আপনারা ঘরে-ঘরে টাগডুম-বাগডুম লাগিয়ে দিন, পুরুষরা আদুরে বেড়ালের মতো ঘড়ঘড় করলেও পাত্তা দেবেন না। ওরা সব বকরাক্ষস, খক্কোশের দল। যেমন সব দেখতে, গোদা-গোদা পা, পায়ের পাতায় ছ্যাতলা, কুচুরমুচুর লোম, থলথলে ভুঁড়ি, গুলিগুলি চোখ, গোঁফদাড়ি, মাঝবয়েসে মাথাজোড়া টাক, শুলেই নাক ডাকে, অলস, পরীক্ষায় বসে টোকে, হ্যা হ্যা করে বকরাক্ষসের মতো হাসে, হেঁড়ে গলা, হাঁচলে মনে হয় বোম ফাটছে, টেঁকুর তুললে মনে হয় বাছুর, গপগপ করে খায়, খেলার খ জানে না, ক্রিকেট , ফুটবল, টেনিস যা হয় একটা কিছু পেলেই হল, সব ছেড়ে টিভির সামনে কেতরে পড়ল। মেয়েদের দিকে এমন চোখে তাকায় যেন—আবার খাব সন্দেশ! ঘুম থেকে সকালে টেনে তুলতে বাপের নাম ভুলিয়ে দেয়। হাই তুললে মনে হয় হিপোপটেমাস হাঁ করছে রসগোল্লা খাবার জন্যে। আড্ডায় বসলে পৃথিবী ভুলে যায়। আর রোজগার একটু ভালো হলেই মদ খায়। মাঝরাতে মালকে ডেলিভারি নিতে হয় রিকশাঅলার কাছ থেকে। তখন কেউ ডুকরে কাঁদে, কেউ তড়পায়, কিন্তু খাড়া হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা থাকে না। কেউ এই সময় পায়ে ধরে, কেউ আবার লাথি মারতে গিয়ে উল্টে বালতির ওপর পড়ে। তারপর অম্বল, হাঁপানি, সুগার, ব্রংকাইটিস, হাত কাঁপছে, পা কাঁপছে। ওগো শুনছ, কোথায় তুমি গেলে গো! আমার নিধন কাল উপস্থিত। সকালে অফিস যাওয়ার জন্যে পাউডার মেখে যখন এক একটা স্যাম্পল বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে তখন মনে হচ্ছে, ময়দার বস্তা থেকে এক একটা আরশোলা বেরিয়ে আসছে। বুড়ো শ্বশুরগুলো আরও অসহ্য। বউমা, বলে খুঁত ধরলেই হল। নড়বার-চড়বার ক্ষমতা নেই, সারাদিন বসে-বসে হুকুম। মেয়েরা পারবে না, এই সব পুরুষদের জন্যে কিছু করতে পারবে না। তারা অনেক করেছে। এইবার—আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো।
প্রশ্ন : ম্যাডাম, সৃষ্টির কী হবে! ক্রিয়েশান!
উত্তর : আর দরকার নেই। পৃথিবী পপ্যুলেশানে গিজগিজ করছে। তেমন প্রয়োজন হলে টেস্টটিউব বেবি হবে। এটা বিজ্ঞানের যুগ।
প্রশ্ন : ম্যাডাম! মেয়েরা যে ভীষণ প্রেমে পড়ে।
উত্তর : সে তো ছেলেদেরও সর্দি হয়, ডেঙ্গু হয়, টাইফয়েড হয়। প্রেমও সেইরকম। ভ্যাকসিন দিতে হবে, পোলিও, ট্রিপল অ্যান্টিজেনের মতো। ছেলেরাই হবে সেই ভ্যাকসিন। যা সব ছিরি হচ্ছে! যেমন তাদের পোশাক, তেমনি চালচলন। সব যেন, এই ছেলেটা ভেলভেলেটা। পাড়ায়-পাড়ায় মাইক বাজাচ্ছে আর ইলু-ইলু করে নাচছে। আর এক একবার চেন, রড, পেটো-পটকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে। ফিরে আসছে মাথা ফাটাফাটি করে। ছেলে কোথায়! সবই তো নেতাদের পোষা লেঠেল। এ তো নতুন যদুবংশ। নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। সব তো মার্ডারার, রেপিস্ট। যুবক কোথায়! সবই তো বক। রক, বক আর বকবক। এদের দেখলেই দড়িছেঁড়া বাছুরের মতো প্রেম ল্যাজ তুলে দৌড় মারবে। প্রেমের কাল শেষ। এখন ঘৃণার কাল।
প্রশ্ন : ম্যাডাম, আপনি তো একসময়, যখন কলেজে পড়তেন তখন প্রেম করেছেন।
উত্তর : কে বলেছে? এ সব মিথ্যে কথা। রটনা। আমার মুভমেন্টটাকে বানচাল করার জন্যে এক ধরনের অপপ্রচার। আমাকে দেখলে মনে হয়, আমি প্রেম করতে পারি? কোন প্রমাণে এই সব কথা বলছেন?
প্রশ্ন : ধরুন, কিছু প্রেমপত্র! আপনারই লেখা। দীর্ঘশ্বাসে ভরা। পৃথিবীর যাবতীয় ভাবে ভরা। সবুজ ঘাস, নীল সরোবর, এক আকাশ তারা, দখিনা বাতাস, ঝরা ফুল, চাঁদের আলো, গাছের ছায়া, ধন নয়, যশ নয়, খ্যাতি, ক্ষমতা নয়, টলটলে অশ্রুজলে চাওয়া সেই চির প্রেম। একটি ছেলে আর একটি মেয়ের প্রাচীন বটের মতো, প্রাচীন আকাঙ্ক্ষা। সেখানে লেখা ছিল :
আমি প্রণয়িনী, তুমি হে অবীর, আমার প্রণয়ী।
আমার সকল প্রেম উঠেছে চোখের জলে ভেসে!
প্রতিধ্বনির মতো হে ধ্বনি, তোমার কথা কহি
কেঁপে উঠে—হৃদয়ের সে যে কত আবেগে আবেশে!
সব ছেড়ে দিয়ে আমি তোমারে একাকী ভালোবেসে
তোমার ছায়ার মতো ফিরিয়াছি তোমার পিছনে!
তবুও হারায়ে গেছে,—হঠাৎ কখন কাছে এসে
প্রেমিকের মতো তুমি মিশেছ আমার মনে-মনে
বিদ্যুৎ জ্বালায়ে গেছ,—আগুন নিভায়ে গেছ হঠাৎ গোপনে!
মনে পড়ছে ম্যাডাম! চুয়ান্ন সাল। স্কটিশচার্চ কলেজ।
উত্তর : কোথায় সেই চিঠি! কার কাছে!
প্রশ্ন : আমার দিকে তাকান। আমার টাক ঢেকে দিন চুলে, কল্পনার চোখে। গাল দুটো ভরিয়ে দিন, চামড়া করে দিন মসৃণ। মরা চোখে যৌবনের দীপ্তি।
উত্তর : বদমাইশ! আপনিই সেই তুমি। স্কাউন্ড্রেল, ঠগ, জোচ্চর। ল্যাং মেরে পালিয়েছিল, বাঁদর।
প্রশ্ন : ল্যাংটা কে মেরেছিল বাঁদরী?
উত্তর : তুমি!
প্রশ্ন : তুমি
উত্তর : তুমি
প্রশ্ন : তুমি
উত্তর : একদিন দিয়েছিলে যেই ভালোবাসা,
ভুলে গেছ আজ তার ভাষা!
জানি আমি,—তাই
আমিও ভুলিয়া যেতে চাই
একদিন পেয়েছি যে -ভালোবাসা
তার স্মৃতি—আর তার ভাষা।
প্রশ্ন : কে কালপ্রিট! কোন শয়তানের জন্যে সব ভেস্তে গেল!
উত্তর : কে বলো তো, কে কে?
একসঙ্গে : নিখিলেশ! ভিলেন! ইটার্নাল ভিলেন!
উত্তর : তুমি বিয়ে করেছ?
প্রশ্ন : কী করে করব! কলেজে যার নাম হয়েছিল, তুলসীদাস। সে আর কার দাস হবে! তাই আমি নারীবিদ্বেষী তুলসীদাস। পাঁচশো বছর আগের আর তুলসীদাসের দোঁহাটাই আওড়াই,
দিনকা মোহিনী, রাতকা বাঘিনী, পলক পলক লহ চোখে
দুনিয়া সব বাউরা হোকে, ঘরঘর বাঘিনী পোষে।
উত্তর : আরে, এ তো সেই গ্রেপস আর শাওয়ার। শৃগালের গল্প, আচ্ছা, এখন আর কিছু করা যায় না?
প্রশ্ন : হে শৃগালী! সময়ের বাঘ যে দিনের ছাগল একটা-একটা করে খেয়ে গেছে!
উত্তর : কেন! সেই যে বলে,
দইয়ের আগা, ঘোলের শেষ
কচি পাঁঠা, বৃদ্ধ মেষ!
প্রশ্ন : দাঁড়াও, প্রাোডিউসার কী বলছেন শুনি, কাচের ঘরে বসে। কী হল মশাই!
প্রাোডিউসার বলছেন, সাক্ষাৎকারভিত্তিক কথিকা হল না,
শ্রুতিনাটক হয়ে গেছে!
তা হোক না মশাই, পাবলিক ভালো খাবে!
ঠোকাঠুকি ঘটিতে বাটিতে
মনের সঙ্গে মন
মানুষে মানুষে হাতাহাতি
মতের লড়াই
দেশ এক জ্যান্ত মড়া
সবাই মিলে খাটে তোল
বলো হরি, হরি বোল।।