1 of 2

রুপো ঠাকরুনের ভিটা – সুবোধ ঘোষ

রুপো ঠাকরুনের ভিটা – সুবোধ ঘোষ

খিদিরপুরের সঙ্গে এই ছোট জগৎপুরের কোনও মিল নেই। জায়গাটাকে সত্যি সত্যি ছোটখাট একটা ভিন্ন জগৎ বলেই মনে হয়েছে শুক্তির। পাঁচ ক্রোশ দূরে রেললাইন আর তিন ক্রোশ দূরে টেলিগ্রামের লাইন। তবুও ভাল।

এই তো মাত্র তিনটি দিন পার হয়েছে। মস্ত বড় একটা পালকি রেলস্টেশন থেকে খিদিরপুরের মেয়ে শুক্তিকে তুলে নিয়ে চলে এসেছে এখানে। আট জোড়া বেয়ারার পা তিন ক্রোশ কাঁচা সড়কের ধুলো আর দু ক্রোশ ডাঙা ও জাঙ্গালের ধুলো মাখতে মাখতে ছোট জগৎপুরের ভেতরে ঢুকতে চাষিদের ঘরের আঙিনা থেকে চিৎকার করে ছুটে এল এক পাল ছোট ছোট ছেলেমেয়ে—বউরানি, বউরানি। চলন্ত পালকির দরজার কাছেই এগিয়ে এসে উঁকিঝুঁকি দিয়ে ছোট জগৎপুরের বউরানিকে দেখতে থাকে ছেলেমেয়ের দল। তারপরেই ব্যস্তভাবে পথের এক পাশে সরে গিয়ে দাঁড়ায়। কারণ পালকির ঠিক পেছনেই ঘোড়ায় চড়ে আসছেন রাজাবাবু। ঘোড়ার গলার ঘুঙুর বাজে ঝুমঝুম করে।

বিয়ে হয়ে গেছে রাজাবাবুর, বউরানিকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা থেকে ফিরছেন।

এরই মধ্যে একদিন বউ-কথা-কও-এর ডাক শুনেছে শুক্তি। অনেক চেষ্টা করেছে পাখিটাকে দেখবার জন্য, কিন্তু দেখতে পায়নি, ঠিক বুঝতে পারা যায় না, কোন গাছের আড়ালে কোথায় বসে পাখিটা ডাকছে। মনে হয়, শুধু একটা ডাক এই বাতাসের মধ্যেই গা-ঢাকা দিয়ে আকাশের এদিক ওদিক উড়ে বেড়াচ্ছে। তিন দিনের মধ্যেই শুক্তির বড় বেশি ভাল লেগে গেছে ছোট জগৎপুরের পাখির ডাক।

তিনদিন ধরে নহবতের স্বর অশ্রান্তভাবে বেজে বেজে আজ থেমেছে। কুটুম্বআত্মীয় যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরাও সবাই বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। প্রজাবাড়ির যত ছেলেমেয়ে এসেছিল মেঠাই নেবার জন্য, তাদেরও হুল্লোড় থেমেছে। চলে গেছে সবাই। বিকাল হবার আগে একদল চাষি মেয়েও এসেছিল বউরানির মুখ দেখবার জন্য। মুখ দেখে খুশি হয়েছে তারা, তারপর আধ সের করে চিঁড়ে পেয়ে আরও খুশি হয়ে সবাই চলে গেছে।

তিন দিন ধরে মুখ দেখাতে দেখাতে একটু ক্লান্তই হয়ে পড়েছিল শুক্তি। অমুক পণ্ডিত মশাই, অমুক গুরুঠাকুর, আর অমুক বড়ঠাকুর, দূরের এই গ্রাম আর সেই গ্রাম থেকে নানাধরনের মানুষ এসেছে আশীর্বাদ করতে। শুধু মুখ দেখাতে দেখাতে নয়, প্রণাম করতে করতেও ঘাড়ে যেন ব্যথা ধরে গেছে। তবুও ভাল একটুও খারাপ লাগে না শুক্তির।

একটু হাঁফ ছাড়বার জন্যেই, অথবা ছোট জগৎপুরের আকাশটাকে একটু ভাল করে দেখবার জন্যেই বাড়ির ছাদের ওপর এসে দাঁড়ায় শুক্তি। যতদূর দেখা যায়, কাছের ও নিকটের সব দৃশ্যগুলিকেই দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখতে থাকে।

হঠাৎ চমকে ওঠে শুক্তি। দূরের ওই নদীর পাশে গাছের ভিড়ের ভেতর থেকে একটা মন্দির মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখা যায়। চুড়োর ওপর আবার সেইরকমই একটা ত্রিশূলও যে রয়েছে। অন্য দিকে চোখ ঘুরিয়ে আর মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে থাকে শুক্তি।

একটু অশান্ত হয়েই ওঠে শুক্তির মন। অস্বস্তিটা কাঁটার মতো মনের ভেতর বিঁধতে থাকে। ওই দুঃসহ দৃশ্যটা যে চার বছর আগের দুর্লজ্জ একটা ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। শুক্তির এই নতুন জীবনের শান্তি ও আনন্দকে বিদ্রূপ করার জন্য দৃশ্যটা যেন একটা হিংসুক চোরাদৃষ্টির মতো দূর খিদিরপুরের গাছপালার ভেতর থেকে বের হয়ে, আর আড়ালে আড়ালে পা টিপে টিপে এগিয়ে এসে এখানে ঠাঁই নিয়েছে। খিদিরপুরে আর ছোট জগৎপুরে কোথাও কোনও মিলই নেই। সেকেলে দুর্গের মতো গড়ন এই বাড়িটার সঙ্গে খিদিরপুরের একেলে বাড়িগুলির কোনও মিল নেই। তবে এক জায়গায় এই মিল আর এত কুৎসিত মিল কেন ?

চার বছর আগের একটি সায়াহ্নের একটা ঘটনা মাত্র, বুদ্ধিহীন কয়েকটা মুহূর্তের ভুল মাত্র। খিদিরপুরের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে যে দৃশ্যটার দিকে মুগ্ধভাবে তাকিয়ে, আর পাশের একটা পরিচিত মুখের কাছ থেকে গল্প শুনতে শুনতে হঠাৎ চমকে উঠেছিল শুক্তি, হাতধরা একটা লুব্ধ ও উন্মাদ অনুরোধের কাছ থেকে সরে যেতে পারেনি শুক্তি, সেই দৃশ্যটাকেই যে এখানেও তৈরি করে রেখেছে ওই নদীর তীর, গাছের ভিড়, মন্দিরের চুড়ো আর ত্রিশূল। যে দৃশ্য চোখে পড়তে কতবার মুখ কালো করেছে, আর সন্ধের অন্ধকারে বসে কেঁদেও ফেলেছে শুক্তি, যে দৃশ্য দেখে আজ চার বছর ধরে নিজেকে ঘেন্না করেছে, অশুচি বোধ করেছে, ভয়ংকর অনুবোধআর হঠাৎ আতঙ্কে সুস্বপ্নও ভেঙে গেছে শুক্তির, সেই দৃশ্যটা এখানে আবার কেন ?

আনমনাভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল শুক্তি, তা সে জানে না। হঠাৎ চোখে পড়ে, পূব দিকের আকাশটা সত্যিই মেঘলা হয়ে উঠেছে। সেইরকমই একটা মেঘ ভেসে আসছে ওই মন্দিরের দিকে। সূর্য প্রায় ডুবে এসেছে। পশ্চিমের আকাশ সেই রকমের লাল আর পুবের আকাশটা সেইরকমের কালো। ওই মেঘটা মন্দিরের ত্রিশূলকে তো এইবার ছুঁয়েই ফেলবে। সঙ্গে সঙ্গে হয়তো ঝিলিক দিয়ে উঠবে সে দিনের মতো ও সেইরকমের একটা বিদ্যুৎ। সেই মুহূর্তে কানের কাছে বেজে উঠবে একটা ভয়ংকর অনুরোধ। তারপর…সে ঘটনার কথা মনে পড়লে এখনও শিউরে ওঠে শুক্তি, তার কিছুক্ষণ পরেই একটা সর্বনেশে পায়ের শব্দ আস্তে আস্তে সিঁড়ি ধরে নীচে নেমে চলে গেল। মাগো !

চোখের ওপর আঁচল চেপে ছটপট করে ওঠে, ঠিক চার বছর আগে খিদিরপুরের বাড়ির ছাদে যেভাবে চোখে আঁচল দিয়ে ভুলের জ্বালা চাপা দেবার চেষ্টা করেছিল শুক্তি।

আস্তে আস্তে একটা শান্ত পায়ের শব্দ সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠতে থাকে, তারপরেই ব্যস্তভাবে যেন ছুটে এসে শুক্তির কাছে দাঁড়ায়।

শুভেন্দু বিস্মিত ও ব্যথিত হয়েই বলে—এ কি, তুমি কাঁদছ শুক্তি ?

চোখের ওপর থেকে আঁচল তুলে নিয়েই হেসে ওঠে শুক্তি—কে বললে কাঁদছি ? চোখে জল দেখছ ?

শুভেন্দু হাসে,—না। তবে চোখে আঁচল চেপে কি করছিলে ?

শুক্তি—তোমার পায়ের শব্দ শুনছিলাম।

শুভেন্দু—কি করে বুঝলে যে আমার পায়ের শব্দ। অন্য কারও তো হতে পারত ?

শুক্তির মুখের হাসি হঠাৎ নিষ্প্রভ হয়ে যায়। চোখের দৃষ্টিটাও কেমন করুণ হয়ে ওঠে। কিন্তু পরমুহূর্তেই হেসে অস্থির হয়ে মুখের ওপর আঁচল চাপে শুক্তি—ধেৎ।

শুভেন্দু—কী হল ?

শুক্তি—যা খুশি তাই বলা হচ্ছে, মুখে একটুও বাধছে না !

হাসিয়ে দেবার আর ভুলিয়ে দেবার ক্ষমতা আছে শুক্তির। শুভেন্দু সত্যই প্রসন্নভাবে হাসতে থাকে। সে হাসির ছোঁয়া লেগে শুক্তির এতক্ষণের যন্ত্রণাটাও যেন নিঃশেষে মুছে যেতে থাকে। ও ছাই একটা দৃশ্য দেখে এত বিচলিত হবার কোনওই দরকার ছিল না। কবেকার কোনও এক অন্ধকারের দাগ। পৃথিবীর কারও চোখে কখনও ধরা পড়েনি, কোনওদিন ধরা পড়বেও না। তবে বৃথা আর মনটাকে এত ভাবিয়ে তুলে লাভ কি ? শুক্তি মুখের হাসি দেখে যে ছোট জগৎপুরের মন এরই মধ্যে ভুলে গেছে, সেই ছোট জগৎপুরকে চিরকাল এমনি করেই হাসিয়ে ও ভুলিয়ে রাখলেই তো হল। শুক্তি জানে, সে ক্ষমতা তার আছে।

শুভেন্দুরও ভাবতে একটু আশ্চর্য লাগে, এই যে এত সুন্দর দেখতে একটি মানুষ, যার সঙ্গে জীবনে কোনও দিন পরিচয় ছিল না, সে কি করে মাত্র সাতটা দিনের মধ্যে এত আপন হয়ে যেতে, আর এত আপন করে নিতে পারল ? অন্য মেয়ে হলে কি করত বলা যায় না, কিন্তু শুক্তি আশ্চর্য করেছে এই ক’দিনের মধ্যে এই গেঁয়ো ছোট জগৎপুরকেই ভালবেসে। ঝিঁ ঝিঁ ডাকা সন্ধ্যা আর ফেউ-ডাকা রাত্রিকে পর্যন্ত অবাক হয়ে জানালার ধারে বসে বসে দেখেছে শুক্তি। এতটা আশা করেনি শুভেন্দু। বরং একটি আশঙ্কাই ছিল, শহরের শিক্ষিতা মেয়ে ছোট জগৎপুরের মতো এমন একটা জগৎছাড়া গ্রামকে ভাল লাগিয়ে নিতে পারবে কি না। কিন্তু সে আশঙ্কা মিথ্যে করে দিয়েছে শুক্তি। আজই সকালে একটা বাচাল বউ-কথা-কওকে দেখবার জন্যে ঘর থেকে বের হয়ে একেবারে দেউড়ির বাইরে গিয়ে গাছের মাথার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ। ভুলেই গিয়েছিল শুক্তি, সে হল এ বাড়ির বউ, নতুন বউ, আর জৎপুরের বউরানি। তা ছাড়া বাড়িতে এতগুলি কুটুম মানুষ যখন রয়েছে।

আরও সুখের কথা, শুক্তিকে দেখে, তার চেয়ে বেশি শুক্তির ব্যবহার দেখে কুটুমেরা একটু মুগ্ধ হয়েই গেছে। এই তো চাই। এরই মধ্যে যে মেয়ে এত আপন করে নিয়েছে শ্বশুরবাড়ির জীবনকে, সে সুখী হবেই হবে।

সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন শুভেন্দুর মা। তাঁর ইচ্ছা, নতুন বউ যেন এক মুহূর্তের জন্য মনে না করতে পারে যে সে পরের বাড়িতে আছে। এরই মধ্যে শুভেন্দুকে সাবধান করে দিয়েছেন মা। বউ আমার হাসবে, খেলবে আর ঘুরে বেড়াবে। বাড়ির মেয়ের মতো থাকবে। যা, কালই সকালে দু’জনে গিয়ে জগৎক্ষ্মীর মন্দিরে পুজো দিয়ে আয়।

শুভেন্দু বলে—কাল তোমার একটা পরীক্ষা আছে।

শুক্তি—পরীক্ষা ? কীসের ?

শুভেন্দু হাসে—তুমি কত বড় লক্ষ্মী সেটা প্রমাণ হয়ে যাবে।

চুপ করে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবে শুক্তি। শুভেন্দু ঠাট্টা করে, কি, ভয় পেয়ে গেলে নাকি ?

শুক্তি—ভয় ? ভয় পাবার কি আছে ?

শুভেন্দু—না পেলেই হল।

শক্তি—আমি ভয় করবার মানুষ নই। নইলে এখানে আসতাম না। চল কোথায় যাবে ? কোথায় তোমার পরীক্ষা ? শুভেন্দুর হাত ধরেই টান দেয় শুক্তি।

শুভেন্দু হাসে—আজ না, কাল সকালে।

এখন তো কোনও ভয়ই নেই শুক্তির মনে, এখানে আসবার আগেও খুব বেশি কিছু ছিল না। বরং ভয় দেখার চেষ্টা করেছিলেন বাড়ির আর সবাই।—স্টেশন থেকে দশ মাইল ধুলো কাদা আর চোরকাঁটা ডিঙিয়ে তবে পৌঁছতে পারা যায় ছোট জগৎপুর। চিঠি পৌঁছয় তিন দিনে। এ তো প্রায় জগৎ ছাড়া একটা জায়গা !

মনের মধ্যে একটু কিন্তু কিন্তু ভাব নিয়েই ছোট জগৎপুরের পাত্র সম্বন্ধে চিন্তা করেছিলেন বাড়ির সকলেই। পাত্র ভালই। ছোট জগৎপুরের ষোল-আনার মালিক। বয়স আর চেহারার দিক দিয়ে পাত্র ভালই। ওই জেলারই সদরের কলেজে পড়ত, বি-এ পাশ করেছে আজ চার বছর হল। তবে এটা বোঝা যায়, শহরের জীবন আর চালচলন থেকে ছেলেটি যেন একটু দূরে সরেই থাকতে চায়। কলকাতায় একটা ভাল চাকরি পেয়েও নেয়নি। দুটো ট্র্যাক্টর কিনেছে এবং মাইনে দিয়ে একজন পাশ-করা কৃষি ওভারশিয়ারকেও রেখেছে। ছেলেটির মতি গতি দেখে এটাই মনে হয়, নিজের রাজ্যে রাজাবাবু হয়ে আর ছোট জগৎপুরের মাটি ঘেঁটেই সে তার জীবন কাটিয়ে দিতে চায়। ভালই তো।

কিন্তু ভয় ছিল, শুক্তি পছন্দ করবে কি না এই বিয়ের প্রস্তাব। যে-রকম মুখচোরা মেয়ে, মনে আপত্তি থাকলেও মুখে কিছু বলবে না। আজ চার বছর ধরে কত প্রস্তাবই তো এল আর গেল, কিন্তু শুক্তির মুখ থেকে পছন্দ-অপছন্দের একটা সামান্য হাঁ বা না, মুখের ভাবে আগ্রহ বা অনিচ্ছার সামান্য একটু ইঙ্গিতও কোনওদিন দেখা গেল না। এই সম্বন্ধটা আবার একটু অন্য রকমের। একেবারে গাঁ-দেশের সঙ্গে সম্বন্ধ, যে গাঁ-দেশের চেহারা সম্বন্ধে কোনও ধারণাই নেই শুক্তির। সুতরাং শুক্তির মনে আপত্তি থাকলে, এই বিয়ের অর্থ হবে মেয়েটাকে জোর করে বনবাসে পাঠানো।

কিন্তু মুখচোরা মেয়েই সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে মুখ খুলল। এখানেই ভাল। হোক না গাঁ-দেশ; শহরের চেয়ে আর কত বেশি খারাপ হবে ?

এমনিতে দেখে মনে হয়, যেন কীসের একটা ঘেন্নায় গাড়ি-ঘোড়ার শব্দে অশান্ত ও জনতাপীড়িত এই শহুরে জীবনের স্পর্শ থেকে বনবাসে চলে যাবার জন্যই একটা জেদ মনের মধ্যে পুষে নিয়ে চারটা বছর অপেক্ষা করছিল শুক্তি। যেই সুযোগ এল অমনি চলে গেল।

ছোট জগৎপুরকে এত ভাল লেগে যাবে, এটাও কল্পনা করতে পারেনি শুক্তি। ভাবতে গিয়ে আরও আশ্চর্য হয়; ছোট জগৎপুরকে চোখে দেখবার আগেই যেন জায়গাটাকে ভাল লেগেছিল। কবে, কোন দিন থেকে, তাও মনে করতে পারে শুক্তি। এই তো মাত্র পাঁচ দিন আগে, ছোট জগৎপুরের মানুষটির সঙ্গে পাঁচ মিনিটের আলাপের পরেই।

—আমি তো ভেবেছিলাম, গাঁয়ের মানুষকে দেখেই ভয় পেয়ে তুমি মুখ ঘুরিয়ে নেবে।

—আমিও তো ভেবেছিলাম, শহরের মেয়েকে দেখেই কে-জানে কি-মনে করে তুমি চমকে উঠবে।

—আমি চমকে উঠেছি ঠিকই, আমার এত সুন্দর ভাগ্য দেখে।

ছোট জগৎপুরের একটা কৃতার্থ ও প্রসন্ন প্রাণ সেই যে শুক্তির হাত ধরল, কোথায় রইল শুক্তির ভয় ! না-দেখা গাঁ-দেশ ছোট জগৎপুরকেও যেন সেই মুহূর্তে ভালবেসে ফেলেছিল শুক্তি।

ছোট জগৎপুরই একটা ছোট জগৎ এবং বাড়ি বলতে এই একটি মাত্র বাড়ি যার নাম রাজবাড়ি। আর সবই কুঁড়েঘর। পথে বের হয়ে শুক্তি অবাক হয়ে যায় গাঁয়ের চেহারা দেখে। এখানে-সেখানে ডোবা, এদিকে-ওদিকে কাঁটার ঝোপ। এক জায়গায় ঘন সবুজ পাতায় ঠাসা কতকগুলি বুনো লতা, যেন লক্ষ লক্ষ সাপের মতো দেহ জড়াজড়ি করে ছোট একটা ঘাট বাঁধানো পুকুরকে একেবারে ঢেকে ফেলেছে। বুঝতে পারা যায় না, সাপগুলিই লতার মতো হয়ে গেছে, না লতাগুলি সাপের মতো হয়ে গেছে।

—ওটা কী ? দূরে উঁচু ইটের ঢিপির মতো একটা জায়গা, তার সারা গায়ে জংলা গাছের সাজ। শুক্তির প্রশ্ন শুনে উত্তর দেয় শুভেন্দু—ওটা একটা রাসমঞ্চ।

রাসমঞ্চের রূপ দেখে চক্ষু স্থির হয়ে যায় শুক্তির। হঠাৎ কতগুলো শালিক কর্কশস্বরে ডেকে ডেকে উড়তে থাকে, আর রাসমঞ্চের জংলা ঝোপের মধ্যে নড়াচড়া করে সাদা-কালো একটা জীব।

শুক্তি—ওটা আবার কি ?

শুভেন্দু—বাঘডাঁস।

শুক্তি—অ্যাঁ ?

শুভেন্দু হাসে—বাঘ নয়।

হেসে হেসেই পথ চলতে থাকে শুক্তি। হঠাৎ চমকে উঠলেও এরকমের ভয়কে একটুও ভয়াল বলে মনে হয় না, বরং ভালই তো লাগে।

ছোট জগৎপুরের রূপ আর প্রাণের পরিচয় বর্ণনা করতে থাকে শুভেন্দু। যেন এক আশ্চর্য দেশের মেয়েকে আরও আশ্চর্য এক দেশের পরিচয় শোনাচ্ছে। শুনতে শুনতে কখনও চক্ষুস্থির হয়, কখনও বা হেসে ফেলে শুক্তি।

শুভেন্দু বলে—ওই মৌজাটার অর্ধেকটাই হল চাকরান, আর তার বাঁয়ে যে-সব ক্ষেত দেখছ, ওর বেশির ভাগ হল মহাত্ৰাণ। এদিকের সবই অবশ্য ব্রহ্মোত্তর আর মৌরসি মোকররি। সব চেয়ে ভাল আয় হয়, ওই যে ওই মেটে সড়কের দুপাশে…

হাত তুলে যেন পৃথিবীর চারদিকে ছড়ানো মাটি, জল ও বাতাসের ওপর কতগুলি অদ্ভুত ও বিচিত্র স্বত্বের আর স্বামিত্বের গর্ব বর্ণনা করে শোনাতে থাকে শুভেন্দু। শুনতে মন্দ লাগে না, যদিও একবিন্দু অর্থ বোঝা যায় না, নীরবে শুধু হাসতে থাকে শুক্তি। শুভেন্দু নিজের মনের উৎসাহেই বলতে থাকে— সবচেয়ে ভাল উসুল আর আদায় হয় ওই দুটো বাজেয়াপ্তী আর খারিজা মহাল থেকে।

শুক্তি তার ধুলোমাখা পায়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে বলে—ধুলোও লাল রঙের হয় নাকি ?

শুভেন্দু—হয় বইকী। বাঘা-এঁটেলের রঙই হল লালচে, কোনওমতেই রবি ফলানো যায় না। তবে নদীর দিকে দু’ হাজার বিঘের ওপর বেলে আর দো-আঁশ আছে। ধান ফলে চমৎকার। এ ছাড়া ভাল মাটি বলতে ছোট জগৎপুরে আর বিশেষ কিছু নেই। উত্তরের ওগুলো সবই হল সাবেক পতিত, যত সব ঘাসি, কাঁকরে আর…।

হাসি থামাতে গিয়ে থেমেই যায় শুক্তি। শাড়ির আঁচলটা শুভেন্দুর চোখের সামনে তুলে ধরেই শিউরে উঠতে থাকে—ইস, কি বিশ্রী কতগুলো পোকা কাপড়টাকে কি-ভয়ানক কামড়ে ধরেছে দেখ।

শুভেন্দু বলে—পোকা নয়, চিড়-চিড়ে ফল।

শুক্তি অপ্রস্তুত হয়ে হাসতে থাকে—বেশ সুন্দর ফল তো, নামটা আরও সুন্দর।

এই ঝোপঝাপ গাছপালার, আর লতাপাতার নামগুলিই বা কি অদ্ভুত ! চলতে চলতে শুভেন্দু আরও নাম শোনাতে থাকে। এগুলি হল হাড়জোড়া লতা, ভাঙা হাড় জুড়ে দেয়। এটা হল একটা নাকড়া গাব। ওই দেখ, কাঁঠালের গাছটাকে কি ভয়ানক বাঁদরায় ছেয়ে ফেলেছে। আর ওই যে একটা কাকডুমুরের জঙ্গল দেখছ, তার ওপাশেই হল দীঘি। এগুলোকে বলে হাতিশুঁড়ো, ওগুলো শেয়াল-কাঁটা। একটা কুকসীমের ঝাড় আর দুটো কেওঠেঙ্গার ঝোপের পাশ দিয়ে আঁচল বাঁচিয়ে সাবধানে হাঁটতে হাঁটতে হেসে ফেলে শুক্তি—থাক, এত সুন্দর সুন্দর নামগুলি আর শুনিও না, মনে রাখতে পারব না।

শুভেন্দু বলে—এই যে জগৎলক্ষ্মীর মন্দির।

ভাঙা-চোরা আর বট-অশত্থের শেকড়ে জড়ানো একটা জীর্ণকায় পঞ্চরত্ন মন্দির। চারদিকের বনবাদাড়ে এখনও যেন অন্ধকার লুকিয়ে রয়েছে। মশার এক একটা ঝাঁক উড়ে যায় শব্দ করে। কি অদ্ভুত শব্দ। দিনের আলোতে চামচিকে ওড়ে অন্ধের মতো, দিগ্বিদিক বোধ হারিয়ে। শুক্তি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে, এই কি জগৎলক্ষ্মী মন্দিরের চেহারা ?

মন্দিরের দরজা খুলে দিল পৈতে গলায় যে লোকটা, তার দিকেও হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে শুক্তি। লোকটা যেন এই কাঁটালতার ঝোপে পালিত, একটা পাখির মতোই দেখতে। রোগা এইটুকু জীর্ণশীর্ণ দেহ নিয়ে জগৎলক্ষ্মীর পূজারী দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে, বুকের পাঁজরগুলো হাঁপায়।

মন্দিরের ভেতরে কোনও মূর্তি নেই। শুধু পাথরের ওপর একটি ধুনুচি রয়েছে, তার মধ্যে ধুনো পুড়ছে অল্প অল্প ধোঁয়া ছড়িয়ে। পুজোর ডালা থেকে ফুল আর সিঁদুর কৌটা তুলে ধুনুচির সামনে রাখে শুক্তি। পূজারী লোকটা ধুনুচির গায়ে সিঁদূর কৌটাটা একবার ছুঁইয়ে আবার ডালার ভেতর রেখে দেয়। তার পরেই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। একটা টাকা বের করে শক্তির হাতে তুলে দেয় শুভেন্দু। টাকাটা ধুনুচির কাছে রেখে একটা প্রণাম করে শুক্তি। পূজারী অস্ফুটস্বরে আর হাত তুলে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে কি যেন বলতে থাকে।

জগৎলক্ষ্মীর কাছ থেকে সরে এসে বাইরে দাঁড়িয়েই হাঁপ ছাড়ে শুক্তি।—এ কি রকমের জগৎলক্ষ্মী, বুঝলাম না কিছু।

শুভেন্দু বলে—ওই দীঘিটার ওপারে আরও মাইল দুয়েক উত্তরে যে গ্রামটা রয়েছে, তার নাম হল বড় জগৎপুর। সে গ্রামের কিছু আর এখন নেই। পুষ্করা লেগে সব শেষ হয়ে গেছে।

শুক্তির স্থিরচক্ষুর কৌতূহল লক্ষ্য করে শুভেন্দু কাহিনীটিকে আরও তাড়াতাড়ি সারতে থাকে।— এ সব অনেকদিন আগের কথা। ছোট জগৎপুরেও পুষ্করা লাগতে চলেছিল। মড়ক আর মরণ আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছিল বড় জগৎপুরের দিক থেকে এই দিকে। এই মন্দিরে কোনও বিগ্রহ ছিল না, তবু এখানেই এসে ছোট জগৎপুরের সব মানুষ দিনরাত পুজো দিত আর প্রার্থনা করত, পুষ্করার কোপ থেকে বাঁচবার জন্য।

পাশেই ঝোপের ভেতর কীরকম একটা ঝনঝনে শব্দ বেজে ওঠে৷ শুক্তি চমকে ওঠে— কীসের শব্দ ?

শুভেন্দু বলে—বোধ হয় শজারু !…একদিন মাঝরাতে, সেদিন পূর্ণিমা, দেখা গেল লালপেড়ে শাড়ি পরা এক মেয়ে হাতে একটা ধুনুচি নিয়ে ছোট জগৎপুরের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ধুনুচি থেকে ধোঁয়া উড়ছে। ধুনোর গন্ধে ভরে উঠল গ্রাম। তার পরের দিনই দেখা গেল, এই মন্দিরের ভেতরে একটি ধুনুচি রয়েছে এবং তার মধ্যে ধুনো পুড়ছে।

শুক্তি—তার মানে কি হল ?

শুভেন্দু—তার মানে এই যে, স্বয়ং লক্ষ্মী নিজে এসে ধুনোর ধোঁয়া ছড়িয়ে ছোট জগৎপুরকে পুষ্করার কোপ থেকে বাঁচিয়ে দিলেন।

শুক্তি—এ তুমি বিশ্বাস কর ?

শুভেন্দু হাসে—বিশ্বাস করতে তো ভালই লাগে।

শুক্তি—সত্যি হলে তো ভালই ছিল।

শুভেন্দু—তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না ?

শুক্তি—না।

শুভেন্দু—যাক, কিন্তু মনে রেখ, তোমার একটা পরীক্ষা আরম্ভ হল।

শুক্তি—কী ?

শুভেন্দু—এইবার ছোট জগৎপুরের সমস্ত মানুষ জানতে পারবে, নতুন বউরানি কত বড় লক্ষ্মী ?

শুক্তি—তার মানে ?

শুভেন্দু—কদিনের মধ্যেই এমন কোনও ঘটনা ঘটা চাই, যাতে বোঝা যাবে যে তুমি একটা খাঁটি লক্ষ্মী।

চমকে ওঠে শুক্তি।—আমি কি করে ঘটনা ঘটাব ?

শুভেন্দু—তোমার পুজোর ফলেই ঘটনা ঘটবে। যদি ছোট জগৎপুরের মানুষ আর রাজবাড়ির জীবনে কোনও নতুন সৌভাগ্য দেখা দেয়, তবে বুঝতে হবে তুমি সত্যিই লক্ষ্মী।

শুক্তির কণ্ঠস্বরে হঠাৎ বিরক্তির ভাব ফুটে ওঠে—এ রকম কোনও শর্ত আমি করেছিলাম না কি ?

শুভেন্দু হাসে—তুমি শর্ত করবে কেন ? এ হল এই ছোট জগৎপুরের শর্ত। চিরকাল এখানে এই শর্তেই রাজবাড়ির নতুন বউরানিরা পরীক্ষা দিয়েছে।

শুক্তি—সবাই পাশও করেছে নিশ্চয় ?

শুভেন্দু—হ্যাঁ, সে ইতিহাস মার কাছেই তে পাবে।

কোনও উত্তর দেয় না শুক্তি। ছোট জগৎপুরের এই সব কাঁটা ভরা ঝোপ, সাপের মতো হিংস্র লতা, পোকার মতো ফল, জন্তুর মতো গাছপালা, বিদঘুটে শব্দ আর নানারকমের অন্ধকারের মধ্যে কোনওই ভয় ছিল না। হঠাৎ কোথা থেকে এই অদ্ভুত গা-ছমছম করা কাহিনীটা এসেই যেন এই প্রথম ভয় পাইয়ে দিল শুক্তিকে।

গম্ভীর মুখে চলতে চলতে হঠাৎ থেমে দাঁড়ায় শুক্তি। এক মুহূর্ত কি যেন ভাবে। তারপরেই হেসে ওঠে—আমার একটু দরকার আছে। আর একবার মন্দিরে চল।

একটু বিস্মিত না হয়ে পারে না শুভেন্দু।—এখনই।

শুক্তি—হ্যাঁ।

চামচিকার দল আবার চিক চিক শব্দ করে উড়তে থাকে। ধুনোর গন্ধে ভরা মন্দিরের ভেতরে ঢুকে ধুনুচির কাছে মাথা উপুড় করে অনেকক্ষণ পড়ে থাকে শুক্তি। শুক্তির কাণ্ড দেখে হতভম্বের মতোই দাঁড়িয়ে থাকে শুভেন্দু। যেন এক অজ-পাড়াগাঁয়েরই অসহায় ও দুর্বল একটা মেয়ের বিপন্ন আত্মার কাতর আবেদনের মতো পড়ে রয়েছে শুক্তি। কে জানে, কি প্রার্থনা করছে শুক্তি, দু ঠোঁটের কাঁপুনিতে অতি ক্ষীণ স্বরে ফিস-ফিস করছে যে ভাষা, তার একটা কথাও শুনতে পায় না শুভেন্দু।

উঠে এসে শুভেন্দুর কাছে দাঁড়ায় শুক্তি—চল এবার।

আরও বিস্মিত হয়ে বেদনার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে শুভেন্দু। ভেজা ভেজা মনে হচ্ছে শুক্তির চোখ !

শুভেন্দু বলে—গল্পটা বলে তোমাকে কষ্ট দিলাম মনে হচ্ছে।

শুক্তি হাসে—একটুও না।

একটা সাড়াই পড়ে গেল ছোট জগৎপুরে। বউরানি লক্ষ্মী। বউরানি লক্ষ্মী।

দু পশলা জোর বৃষ্টি হয়ে গেছে। জগৎপুরের শক্ত এঁটেল মাটির ক্ষেত ভিজে নরম হয়ে গেছে। এবার লাঙ্গল আর রোপাই আরম্ভ করে দিলেই হল, আর কোনও অসুবিধে নেই।

সদর থেকে খবর নিয়ে এসেছে উকিলের মহুরি, তিন বছর ধরে ঝুলছিল যে মামলাটা, তার রায় বের হয়েছে এত দিনে। ষাট হাজার টাকার ডিক্রি পেয়েছে শুভেন্দু।

শাশুড়ি ডাক দিয়ে বলেন—বউমা আজ হল চতুর্দশী। আজই একবার গিয়ে হর্ষমতীর জল ছুঁয়ে এস।…ও শুভেন্দু, শুনছিস ?

শুভেন্দু বলে—হ্যাঁ শুনেছি, আজই যাব।

শুক্তি হাসি বন্ধ করে। হঠাৎ আবার গম্ভীর হয়—হর্ষমতীর জল মানে ?

শুভেন্দু—ওই সেই দীঘিটা। ওর নাম হল—হর্ষমতীর সায়র।

শুক্তি—ওর জল ছুঁলে কি হয় ?

হাসতে থাকে শুভেন্দু। শুক্তি তেমনি গম্ভীরভাবে বলে—আর একটা গল্প আছে বোধ হয়।

—হ্যাঁ।

—আর একটা পরীক্ষা দিতে হবে নিশ্চয় ?

—নিশ্চয়।

—আর পারি না। অপ্রস্তুতভাবেই আক্ষেপ করে অন্যদিকে মুখ লুকিয়ে বসে থাকে শুক্তি। এইভাবেই কি অনন্তকাল এখানে শুধু পরীক্ষা দিতে হবে ? ছোট জগৎপুর নামে এই রাজ্যিছাড়া রাজ্যিটা তো দেখতে বড় নিরীহ। আসা মাত্র একেবারে বউরানি বলে আদর করে আর মাথায় তুলে রাখতে চায়। কিন্তু এত অভ্যর্থনার ভেতরে ভেতরে আবার এই ষড়যন্ত্র কেন ?

শুভেন্দু সান্ত্বনার সুরে বলে—কি হয়েছে, কতটুকুই বা হাঁটতে হবে ? বরং একবার বেড়িয়ে এলে ভালই লাগবে তোমার।

শুক্তি—হাঁটতে ভয় পাই না। বেড়াননাও অভ্যেস আছে।

শুভেন্দু—তবে কীসের ভয়।

শুক্তি ভ্রূকুঞ্চিত করে—ভয় ? ভয় কেন করব ? কি পাপ করেছি যে একটা দীঘির জল ছুঁতে ভয় করব।

খুশি হয়ে শুক্তির হাত ধরে শুভেন্দু বলে—চল, পথে অনেক নতুন জিনিস দেখাব তোমাকে।

দ্বিধা করে বা দেরি করে কোনও লাভ নেই। পরীক্ষাটার সম্মুখীন হবার জন্যই প্রস্তুত হয়ে শুক্তি বলে—চলো।

মস্ত বড় একটা ডাঙ্গার ওপর দিয়ে চলতে চলতে শুক্তির মনের ভার আস্তে আস্তে মিটে যেতেই থাকে। ডাঙ্গার মাটি শক্ত, কিন্তু নরম ঘাসে ঢাকা। কাঁটার ঝোপ ঝাপ সরিয়ে ছোট জগৎপুরের মনটা যেন এখানে বেশ খোলামেলা হয়ে উঠেছে। মস্ত বড় একটা গাছের মৃতদেহ পাথরের মতো শক্ত ও মসৃণ হয়ে পড়ে রয়েছে ডাঙ্গার এক জায়গায়। শ্রান্ত হয়ে গাছের ওপর বসে শুভেন্দু ও শুক্তি।

গল্প করে শুভেন্দু।—এটা কি বলতে পার ?

—গাছ বলেই তো মনে হচ্ছে।

—গাছ কি এবকম পাথরের মতো হয় ?

—তবে কী এটা ?

—এটা হল বকরাক্ষসের লাঠি। সেই যে ভীমের হাতে মার খেয়ে মরে গেল বক সেই দিন থেকে তার লাঠিটা পড়ে আছে এখানে।

হেসে ওঠে শুক্তি। শুনতে ভালই লাগে। এ রকম গল্প হাজার হাজার মনের ভেতর পুষে রাখুক না ছোট জগৎপুর কিন্তু…। কিন্তু হর্ষমতীর গল্পটাও কি এই রকমের ?

হর্ষমতীর সায়রের কাছে পৌঁছবার পর গল্পটা শুরু করে শুভেন্দু। দাম আর টোপা পানায় ভরা প্রকাণ্ড সায়র। ভাঙা ভাঙা এক একটা ঘাটের শ্যাওলা মাখা ইট ছড়িয়ে আছে এলোমেলোভাবে। তালগাছের ওপর এই ভরা দুপুরেই অলস হাড়গিলা নিঃস্পন্দ হয়ে ঘুমোয়। যেমন নির্জন জায়গাটা, তেমনি একটা নিস্তব্ধতা যেন থমকে রয়েছে।

শুভেন্দু বলে।—সে অনেক দিন আগের কথা। এই যে কলাইয়ের ক্ষেত দেখছ, এখানেই ছিল এক রাজার বাড়ি। রাজার বড় দুঃখ, কারণ রানি হৰ্ষমতী ছিলেন বন্ধ্যা।

শুক্তি—থাক, আর শুনতে চাই না। এ গল্প না শুনলেও চলবে।

শুভেন্দু—কিন্তু সায়রের জল ছুঁয়ে এই চতুর্দশীতে একবার মাথায় হাত না দিলে তো চলবে না। শুক্তি—কেন ?

শুভেন্দু—এখানকার নিয়ম।

শুক্তি হাসে—অদ্ভুত নিয়ম, বেহায়া নিয়ম।…তুমি ওদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াও।

ঘাটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল শুক্তি। শুভেন্দু বলে—গল্পটা আগে শুনে নাও।…একদিন স্বপ্ন দেখলেন হর্ষমতী…।

থেমে, মুখ ফিরিয়ে প্রশ্ন করে শুক্তি—কি স্বপ্ন ?

—চোখ বুজে শুধু স্বামীর মুখ মনে করতে করতে এক চতুর্দশীর দুপুরে এই সায়রের জলে বার বার তিনবার ডুব দিয়ে পদ্মের শেকড় স্পর্শ করবি। তা হলেই তোর কোল আলো করা…।

শুক্তি মুখ কালো করে তাকায়—এটাও দেখছি একটা পরীক্ষা। বার বার তিনবার স্বামীর মুখ স্মরণ করে জল ছুঁতে হবে। এই তো ?

শুভেন্দু—হ্যাঁ।

শুক্তি—যেন অন্য কোনও মুখ ভুলেও মনে না আসে, এই তো ?

শুভেন্দু হাসে—হ্যাঁ।

শুক্তি মুখ ভার করে বলে—চল বাড়ি যাই।

শুভেন্দু বিষন্নভাবে বলে—সামান্য একটা গল্পের ওপর এত রাগ করছ কেন তুমি ?

চুপ করে ভাঙা ঘাটের হিংস্র দাঁতের মতো শ্যাওলা মাখা ইটগুলির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মুক্তি।

শুভেন্দুও একেবারে আনমনাভাবে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে। চুপ করে যেন শুক্তির এই আপত্তির আঘাতটাকে সহ্য করবার চেষ্টা করছে শুভেন্দু। কীসের জন্য, কেন, এ রকম করছে শুক্তি ? কি বলতে চায় শুক্তি ?

শুক্তি ডাকে—শুনছ।

শুভেন্দু—কি ?

—আমার কেমন ভয় ভয় করছে।

—কেন, কীসের এত ভয় ?

এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হঠাৎ শুভেন্দুর হাত ধরে সাগ্রহে অনুনয়ের সুরে শুক্তি বলে—কিছু মনে কোরো না। তুমি এসে আমার মাথা ছুঁয়ে দাঁড়াও, তবে আমি তিনবার জল স্পর্শ করতে পারব।

শুভেন্দুর মুখের বিষণ্ণতা কেটে যায়। —তাই বলো, এ তো রানি হর্ষমতীর চেয়েও এক ডিগ্রি বেশি হয়ে গেল। চলো।

লক্ষ্য করে শুভেন্দু, সায়রের জল তিনবার মাথায় ছোঁয়ানো হয়ে যাবার পরেও আর একবার জল তুলে নিয়ে চোখ দুটোকেও ধুয়ে ফেলে শুক্তি।

ফেরবার পথে শুভেন্দু আর একবার জিজ্ঞাসা করে—এ সব গেঁয়ো নিয়ম-টিয়ম পালন করতে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে শুক্তি ?

—না। তুমি যতক্ষণ সঙ্গে আছ, কোনও কষ্টই হবে না।

ছোট জগৎপুরকে ভাল লাগে, ভাল লাগে ছোট জগৎপুরের এই মানুষটিকে, কিন্তু ভয় করে ছোট জগৎপুরের এই কাহিনীগুলিকে। কি ভয়ানক এক একটা কাহিনী, যেন বুক চিরে পরীক্ষা করে দেখতে চায়, ভেতরে কিছু লুকনো আছে কি না।

কিন্তু শুক্তির ক্ষুব্ধ মনের যত অভিযোগ আর আশঙ্কা শান্ত করে দিয়ে, আর শুক্তির জীবনে একটা নতুন ঘটনার সূচনা সরবে ঘোষণা করে দিয়ে শাশুড়ির কণ্ঠস্বরের হর্ষ একদিন ধ্বনিত হয়, কারণ কৃপা করেছে হর্ষমতীর সায়র।—বউমা, এবার একদিন নাগেশ্বর তলায় বেড়িয়ে এস। ওরে শুভেন্দু শুনছিস।

ছোট জগৎপুরের গোচর মাঠের পশ্চিমে মস্ত বড় একটা বৃদ্ধ অশত্থ, তার গোড়ার দিকে একটা ফোকর। ফোকরের ভেতর আছেন এক অতি বৃদ্ধ নাগ। সে নাগকে কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ চোখে দেখেনি, তবুও তিনি আছেন, দ্বিতীয় এক অনন্ত নক্ষত্রর মতো চিরকাল এখানে আছেন। ছোট জগৎপুরের একশো বছর আগের বউরানিও প্রথম সন্তানের সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে এই নাগেশ্বর তলায় এসে ভয়নাশন পুজো দিয়েছেন। এ অবস্থায় মনে কোনও ভয় রাখতে নেই। ভয় থাকলে সন্তান ভীরু হয়।

শুক্তি একটু উৎসাহিতভাবেই প্রশ্ন করে—ভয়নাশন পুজো ?

শুভেন্দু—হ্যাঁ। যে ভয়কে সবচেয়ে বেশি ভয় হয়, সেই ভয়ের কথা জানিয়ে দিতে হবে নাগেশ্বরকে। তা হলে জীবনে আর সে ভয় থাকবে না।

শুক্তি বলে—চলো।

চলতে দেরি হয়নি, পৌঁছতেও দেরি হয়নি। নাগেশ্বর তলায় এসে বৃদ্ধ অশত্থের গোড়ায় মাটির ভাঁড়ে দুধ রেখে দিয়ে প্রণাম করে শুক্তি।

অশত্থতলার ধুলো লাগে কপালে। শুক্তি যেন কৃতার্থভাবে উঠে দাঁড়ায়। জিজ্ঞাসা করে—নাগেশ্বর কৃপা করলেন কি না, কি করে বুঝব ?

—সূর্য ডুববার পরেই ফিরে এসে যদি দেখ যে, ভাঁড়ের দুধ খেয়ে চলে গেছে নাগেশ্বর, তবেই বুঝবে…।

—সূর্য তো ডুবে এল।

—তবে চলো, আর একটু পরে ফিরে এসে দেখবে।

ঘুরে-ফিরে অপরাহ্নটা পার করে দিয়ে প্রথম সন্ধ্যার ছায়ান্ধকাবে বৃদ্ধ অশত্থের কাছে ফিরে আসে দুজন। শুভেন্দু বলে—ওই দেখ। আনন্দে শুভেন্দুর হাত ধরে হাসতে থাকে শুক্তি। প্রার্থনা গ্রহণ করেছেন নাগেশ্বর। ভাঁড়ে এক ফোঁটা দুধ নেই, কখন এসে নিঃশেষে পান করে অশত্থের গহ্বরে আবার অদৃশ্য হয়ে গিয়েছেন।

ফেররার পথে শুভেন্দু জিজ্ঞাসা করে—কোন ভয়ের কথা নাগেশ্বরকে জানালে ?

—তা বলব কেন ?

শুভেন্দু—আমিও একদিন নাগেশ্বরের কাছে এসে ভয়নাশন করে গিয়েছি।

শুক্তি হেসে লুটিয়ে পড়তে চায—তোমার ভয় ? তোমারও কি…।

শুভেন্দু—হ্যাঁ, পুরুষেরাও এসে এখানে ভয়নাশন করে। ছোট জগৎপুরের নিয়ম আছে, বিয়ে করতে যাবার আগে নাগেশ্বরের কাছে মনের কথা বলে ভয় দূর করে নিতে হয়।

শুক্তি—কি কথা বলেছ ?

শুভেন্দু—তা বলব কেন ? মনের একটা ভয়ের কথাই বলেছি।

শুক্তি—বলো না, আমি শুনলে দোষ কি ?

শুভেন্দু—গোঁয়ে মানুষের মনের একটা বাজে ভয়ের কথা, সে কথা শুনে তোমারই বা লাভ কি ?

সন্ধ্যার ছায়ান্ধকারেই শুক্তি দেখতে পায়, শুভেন্দুর চোখ দুটো কেমন অদ্ভুত একটা দৃষ্টি নিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

শুক্তি বলে—নাগেশ্বর তোমার প্রার্থনা গ্রহণ করেছিলেন তো ?

—ভাঁড়ের দুধ তো চেটেপুটে খেয়ে চলে গিয়েছিলেন।

—তবে আর ভাবনা কীসের ?

—তবুও ভাবনা হয়। সন্দেহ হয় নাগেশ্বর আমাকে ঠকালেন না তো ?

শুভেন্দুর চোখে সেই অদ্ভুত ভঙ্গি, আর দৃষ্টিটাও তেমনি। শুক্তি বলে—তোমার সন্দেহের কোনও অর্থই হয় না। নাগেশ্বর কাউকে ঠকাতে পারেন না।

শুক্তির সান্ত্বনার ভাষা ও ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলে শুভেন্দু।—তুমি যখন বলছ, তখন বিশ্বাস করছি, নাগেশ্বর আমাকে ঠকাননি।

পথ চলার ছন্দ যেন দুজনকেই আবার ফিরে পায়। আকাশে সন্ধ্যাতারা, একটু দূরে চাষিদের আঙ্গিনায় ঘরে-ফেরা গোরুর ডাক বাতাসে সাড়া জাগিয়ে তোলে। একটা দীপ জ্বলছে একেবারে নিকটেই। টিপির মতো একটা জায়গা, জংলা লতাপাতায় ঢাকা।

শুক্তি প্রশ্ন করে—এখানে প্রদীপ জ্বলে কেন ?

শুভেন্দু—এই মাসটা প্রতি সন্ধ্যাতেই এখানে প্রদীপ জ্বলবে।

শুক্তি—কেন ?

শুভেন্দু—এটা হল রুপো ঠাকরুনের ভিটে।

শুক্তি—এটাও একটা গল্প বোধ হয় ?

শুভেন্দু—হ্যাঁ। রুপো ঠাকরুন ছিলেন একজন সতীসাধ্বী…।

পায়ে যেন হঠাৎ কি একটা ফুটেছে। বেদনার্তের মতো মুখ করে অন্য দিকে তাকায় শুক্তি।—চলো, রাত হয়ে আসছে।

চলতে থাকে শুভেন্দু, কিন্তু রুপো ঠাকরুনের গল্পটা না বলে থাকতে পারে না।—রুপো ঠাকরুন ছিলেন এক গরিব বামুনের বউ। দেখতে পরমা সুন্দরী। এত গরিব যে দু’কড়ি খরচ করে সধবার সাধ একটু আলতা কেনবারও উপায় ছিল না রুপো ঠাকরুনের। একদিন কোথা থেকে অচেনা-অজানা একটি মেয়ে এসে বলল—দুঃখ করো না রুপো ঠাকরুন, তুমি জল দিয়েই আলতা পরো। যদি সতী হয়ে থাক, তবে তোমার পায়ে লেগে জলই আলতা হয়ে যাবে।

শুক্তি—তাই হল নিশ্চয়।

শুভেন্দু—হ্যাঁ, যতদিন বেঁচে ছিলেন রুপো ঠাকরুন ততদিন জলের আলতাই পরতেন। জলের দাগ আলতার চেয়েও বেশি রাঙা হয়ে ফুটে উঠত রুপো ঠাকরুনের পায়ে।

শুক্তি বলে—বাঃ , চমৎকার গল্প।

শাশুড়ি ডাক দিলেন—ও বউমা, প্রজাবাড়ির মেয়েরা এসেছে তোমার কাছে। শোন কি বলছে ওরা ?

আশ্বিন মাস, ছোট জগৎপুর এই মাসে একটা ব্রত করে, তার নাম সতীসোহাগ। এ বছর নতুন বউরানির পায়ে আলতা পরিয়ে সতীসোহাগ করবে প্রজাবাড়ির মেয়েরা, সেই কথা জানাতে এসেছে টগর, কালী, খাঁদি, পটলি, সীতা, ফুলকুঁড়ি, ধবধবি, বুড়ি আর চন্দনা। ছেঁড়া ময়লা কাপড়-পরা, হাড়-সার কতগুলো রোগা-রোগা মেয়ে। আজ ওরা সিধে নিয়ে যাবে, কাল এসে আলতা পরিয়ে সতী-সোহাগ করে যাবে।

প্রজাবাড়ির মেয়েদের প্রস্তাবটা চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনল শুক্তি। আড়ালে দাঁড়িয়ে মুখ টিপে হাসল শুভেন্দু। আধ সের করে চিড়ে সিধে নিয়ে চলে গেল প্রজাবাড়ির মেয়ের দল।

সন্ধে হতেই শুভেন্দুর সঙ্গে একটা ঝগড়ার মতোই ব্যাপার করে ফেলল শুক্তি। —তোমাদের এই রাজ্যিছাড়া গ্রামটা কি শুধু কতগুলি গল্প দিয়ে তৈরি ?

শুভেন্দু বলে—তাই তো দেখছি।

শুক্তি—পৃথিবীর কোথাও এমন সৃষ্টিছাড়া ব্রত আছে বলে তো শুনিনি।

শুভেন্দু—তাও সত্যি।

শুক্তি—সতী-সোহাগ ব্ৰতটার অর্থ কি ?

শুভেন্দু—ওই রুপো ঠাকরুনের ভিটের মাটি আলতার সঙ্গে গুলে পায়ে পরিয়ে দেবে।

শুক্তি—তাতে কি হয় ?

শুভেন্দু—অনেক কিছু হয়। আবার উল্টোটাও হয়। সে গল্প যদি শুনতে চাও তো বলি।

জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়ে অনেক দূরের দিকে তাকায় শুভেন্দু—ওই যে বড় জগৎপুরের ডাঙ্গাটা যেখানে আরম্ভ হয়েছে, তারই পুবে আছে চোখটেরির খাল। এক চোখটেরি একবার গাঁয়ের একশো মেয়েকে মেঠাই মণ্ডা খাইয়ে খুব ঘটা করে সতীসোহাগ করিয়েছিল। পায়ে টুকটুকে লাল আলতা পরানো মাত্রই আলতা জল হয়ে গেল। লোকে বললে, এ কি ব্যাপার ? একটু পরেই খবর এল, চোখটেরির স্বামী সাপের কামড়ে মরে গেছে। ধরা পড়ে গেল চোখটেরির জীবনের লুকনো দোষ। আর লজ্জা সহ্য করতে না পেরে শেষে ওই খালের জলে ডুবে মরে গেল।

শুক্তি—গল্পটা মোটেই ভাল নয়। চোখটেরির পাপে চোখটেরি মরল, ভালই হল। কিন্তু চোখটরির স্বামী বেচারা মরবে কেন ?

শুভেন্দু হাসে—মরে তো গেল। কি আর করা যাবে ?

কিছুক্ষণ পরে রাতটাও যেন কেমন-কেমন হয়ে গেল। কিছুতেই ঘুম আসে না শুক্তির। শুভেন্দুকেও ঘুমোতে দেয় না। ছোট জগৎপুরে আজকের রাত্রিটাকে বড় ভয় করছে শুক্তির। এই রাতটা তো ফুরিয়েই যাবে, তার পরেই সতী-সোহাগের আলতা নিয়ে দেখা দেবে কি ভয়ানক একটা সকালবেলা ! শুক্তির সমস্ত আত্মাটাই যেন কীসের একটা ভয়ে ধুক ধুক করছে।

শুভেন্দু বলে—আর কত গল্প শুনবে ? এবার ঘুমিয়ে পড়ো।

—কি করে ঘুম হবে ? একটা গল্পেরও কি মাথামুণ্ডু কিছু আছে। যত সব ভয় দেখানো বিদ্‌ঘুটে গল্প।

বাস্তবিক, ছোট জগৎপুরের প্রত্যেকটা ছায়া আর শব্দেরও যেন ইতিহাস আছে। যত সব অনুতাপের, প্রায়শ্চিত্তের, শাস্তির আর প্রতিশোধের ইতিহাস।

হুম হুম শব্দ করে একটা পেঁচা ডাকছিল এতক্ষণ। কিন্তু ওটা ঠিক পেঁচার ডাক নয়। শুভেন্দু বলে— অনেকদিন আগে এক ঘুমন্ত গেরস্থকে হত্যা করেছিল এক ডাকাত, তার নাম বেন্দা। গেরস্থের বউয়ের অভিশাপে চিরকালের মতো পেঁচা হয়ে গেছে বেন্দা ডাকাত। ঘুম নেই তার চোখে। আশ্বিনের ঠিক দিনটিতেই একবার ছোট জগৎপুরের অন্ধকারে উড়ে উড়ে চোখের জ্বালায় ডাকতে থাকে—ঘুমো, ঘুমো ! চাষি ছেলেরা জেগে উঠে একটা আমগাছের গায়ে জল ছিটিয়ে দেয়, তার পরেই আর পেঁচার ডাক শোনা যায় না।

এখানে বসেই দেখা যায়, শ্মশানের মাঠের দিকে একটা আলেয়া এগিয়ে চলেছে। কিন্তু ওটা তো ঠিক আলেয়া নয়। ওটা হল চিন্তেমণির জ্বালা। রোগী স্বামীর ওপর রাগ করে চিন্তেমণি একদিন বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল। যেদিন ফিরল, সেদিন স্বামীর চিতা জ্বলছে শ্মশানে। সেই যে চিন্তেমণি ঘর ছেড়ে চলে গেল, আর তাকে কোথাও দেখা গেল না। শুধু মাঝে মাঝে অনেক রাতে দেখা যায়, আলেয়া হয়ে শ্মশানের মাঠে স্বামীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে চিন্তেমণি।

অন্ধকার ছাপিয়ে কান্না-মেশানো দীর্ঘশ্বাসের মতো একটা ঝড়ের শব্দ অনেক দূর থেকে ভেসে এসে আবার মিলিয়ে যায়, কিন্তু ঝড় নয় ওটা। শুভেন্দু বলে, ওটা হল ভোলা বেদের দীর্ঘশ্বাস। যখ হয়ে মাটির নীচে গুপ্তধন আঁকড়ে পড়ে আছে ভোলা। এক দেবমন্দির থেকে বিগ্রহের হীরে-সোনা চুরি করে ভোলা বেদে কুঁয়োর নীচে নেমেছিল লুকিয়ে রাখার জন্য, হঠাৎ কুঁয়ো ধ্বসে সেই যে মাটি চাপা পড়ল তো পড়লই।

শুক্তি বলে—রক্ষে করো। আর গল্প শুনতে চাই না।

শুক্তির মুখের দিকে তাকিয়ে বিচলিত হয়ে ওঠে শুভেন্দু—এ কি, তুমি এতক্ষণ ধরে মুখ আড়াল করে শুধু কাঁদছ ?

শুক্তি—বড় ভয় করছে আজ।

শুক্তির মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে শুভেন্দু সমবেদনার সুরে বলতে থাকে—ছিঃ, এত ভয় করতে হয় ?

শান্ত হয় শুক্তি।

—কই গো বউরানি ! বউরানি কই ?

আঙ্গিনার ওপর এক পাল মেয়ের উল্লাস সকাল বেলাটাকে চমকে দিয়ে বেজে উঠল। রুপো ঠাকরুনের ভিটার মাটি নিয়ে সতী-সোহাগ করতে এসেছে চন্দনা, খাঁদি, সীতা, কালী, পটলি, ধবধবি, ফুলকুঁড়ি, টগর আর বুড়ি।

ও-ঘর থেকে সন্ত্রস্তের মতো ছুটে এ-ঘরে শুভেন্দুর কাছে এসে দাঁড়ায় শুক্তি।—ওদের চলে যেতে বললা লক্ষ্মীটি, পায়ে পড়ি তোমার।

শুভেন্দু—ছিঃ, সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে এরকম করছ কেন ? মা শুনলে বড় রাগ করবেন।

অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে শুক্তি। চোখের দৃষ্টি একটা আতঙ্কে অস্থির হয়ে কাঁপছে। যেন কোনও কথাই শুনতে পাচ্ছে না।

চুপ করে অনেকক্ষণ শুক্তির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে শুভেন্দু। তার পর শুক্তির একটা হাত ধরে আস্তে আস্তে শুক্তিকে কাছে টেনে নিয়ে একেবারে চোখের উপর চোখ তুলে জিজ্ঞাসা করে—কেন এত ভয় ?

শুক্তির সব চঞ্চলতা যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। ধীর, স্থির ও শান্ত। গলার স্বর একটুও বিচলিত না করে শুক্তি আস্তে আস্তে বলে—তুমি তো সবই বুঝতে পার।

—ঠিক বুঝতে পারি না। কিন্তু…।

—কিন্তু নয়, সত্যি।

—কবে ?

—চার বছর আগে।

শুক্তির হাত ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ায় শুভেন্দু। ঘরের ভেতর পাইচারি করে বেড়ায়। হঠাৎ হেসে ফেলে শুভেন্দু—নাগেশ্বরের কাছে আমি এই ভয়ের কথাই বলেছিলাম শুক্তি।

এক একটা মুহূর্ত যেন ভয়ংকর নিস্তব্ধতার মধ্যে মরে চলেছে। শুক্তি দাঁড়িয়ে থাকে, তেমনি ধীর, স্থির ও শান্ত। এই রাজ্যছাড়া ছোট জগৎপুরের সব কাহিনীর ভ্রূকুটি-ভার চোখগুলিকে আজ বুক চিরে দেখিয়ে দিতে পেরেছে শুক্তি। আর অস্থির হয়ে ওঠবার, মুখ লুকোবার, চোখ ফিরিয়ে নেবার তো দরকার নেই।

শুভেন্দু বলে—যাও, ওরা ডাকছে, দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ।

চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে শুক্তি। শুভেন্দু আবার অনুরোধ করে—মাত্র একটা অভিনয় তো। যাও, সেরে দিয়েই চলে এস, দেরি করে লাভ কি ?

ভাঙা ভাঙা নিশ্বাসের শব্দের মতো গলার স্বর, শুক্তি বলে—পারব না।

—কেন ?

—রুপো ঠাকরুনের ভিটার মাটি আমি সহ্য করতে পারব না।

—হর্ষমতীর জল সহ্য করতে পারলে, জগৎলক্ষ্মীর সিঁদুর সহ্য করতে পারলে, এটা আর সহ্য করতে পারবে না কেন ?

—না আর পারব না।

দু হাতে চোখ ঢাকা দিয়ে ঘরের মেজের ওপরেই বসে পড়ে শুক্তি।

শুভেন্দু এগিয়ে এসে কাছে দাঁড়ায়। জিজ্ঞাসা করে—কেন পারবে না ?

চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে শুভেন্দুর মুখের দিকে তাকিয়েই চোখ বন্ধ করে ফেলে শুক্তি।— তোমার অমঙ্গল হবে।

চমকে ওঠে শুভেন্দু, ঠিক যেমন হঠাৎ আলোর ঝলক লাগলে চমকে ওঠে মানুষের চোখ।

শুভেন্দু—এই তোমার ভয় ?

শুক্তি—ওই একটি ভয়।

ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ পাইচারি করে বেড়ায় শুভেন্দু। শুক্তির চোখ-বোঁজা মুখের দিকে বার বার তাকিয়ে দেখতে থাকে। ছোট জগৎপুরের অমঙ্গলের জন্য যার এত ভয়, আর একমাত্র ভয় সেই বেচারারই চোখের ঘুম কেড়ে নিয়ে শাস্তি দিচ্ছে ছোট জগৎপুরের কতগুলি নির্মম গল্প।

আর একবার তাকায় শুভেন্দু। শুক্তির কাছে এসে দাঁড়ায়। দেখতে অদ্ভুত লাগছে শুক্তির মুখটা। যেন শান্ত হয়ে, আর মন ভরে ছোট জগৎপুরের জন্য মঙ্গলের স্বপ্ন দেখছে দুটি ঘুমন্ত চক্ষু। না, কথাটা ঠিকই। নাগেশ্বর কখনও কাউকে ঠকাতে পারেন না।

হঠাৎ শুভেন্দুর সারা মুখে যেন একটা কৃতার্থ পুলকের হাসি ঝক করে ফুটে ওঠে। পা টিপে টিপে জানালার কাছে এগিয়ে যেয়ে আঙিনার ওপর প্রজাবাড়ির মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় কি যেন একটা কৌতুকের নির্দেশ জানায়। আস্তে আস্তে ফিরে এসে মেজের ওপর শুক্তির নীরব নিঃস্পন্দ ও চোখ-বোঁজা শান্ত মূর্তির পেছনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে।

হুড়মুড় করে ছড়া গাইতে গাইতে ঘরের ভেতরে এসে ঢুকে পড়ে মেয়ের পাল। টগর, চন্দনা, খাঁদি, পটলি, ধবধবি, বুড়ি, সীতা, ফুলকুঁড়ি আর কালী।

—রক্ষে কর। তুমি কোথায় ? ভয়ার্ত স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে শুক্তি।

শুক্তির মাথার ওপর হাত রেখে শুভেন্দু হাসতে হাসতে বলে—এই তো। পালিয়ে যাইনি।

ততক্ষণে দশ-বারোটা হাত একসঙ্গে লুটোপুটি করে রুপো ঠাকরুনের ভিটার মাটি আলতার সঙ্গে মিশিয়ে শুক্তির দু পায়ে মাখাতে আরম্ভ করে দিয়েছে।

চোখে আঁচল দিয়ে, আর শরীরটাকে যেন প্রাণপণে কঠিন করে নিয়ে নিঃশব্দে বসে থাকে শুক্তি। সতী-সোহাগের ছড়া আরও জোর গলায় বেজে উঠতে থাকে।

—রুপো ঠাকরুনের পা গো। কি আশ্চর্যি মাগো। জল হল আলতে। পা হল লালতে। কড়ি, তুলসী, কচি দুববো ধন্যি। পতি-সোহাগী সোনাপুতী ধন্যি।

অন্য ঘর থেকে ডাক শোনা যায়—থামলি এবার; ওরে ও মেয়ের দল ! বউমাকে আর বিরক্ত করিসনি, সিধে নিয়ে ঘরে যা এখন।

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৫২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *