রুপোলি রক্ত – অনীশ দেব
ডক্টর পালিত বললেন, এই নিন, আপনি আয়না চেয়েছিলেন—।
আমি বিছানায় উঠে বসলাম। খুব খুশি হয়ে আয়নাটা হাতে নিলাম। এখানে আসার পর এই প্রথম নিজের মুখ দেখতে পাব। ডক্টর পালিতের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞভাবে হাসলাম। উনিও হাসলেন হয়তো। কারণ, গোধূলির আবছা আলোয় সাদা দাঁত ঝিকিয়ে উঠল। আমি আয়নায় নজর দিলাম।
কার ছবি এটা? এই কি আমি? এরকমই কি দেখতে ছিলাম? সাদামাটা মাঝারি রঙের স্বাস্থ্যবান এক যুবকের মুখ। কী জানি! এই যুবককে কখনও আমি দেখিনি। নিজের যে-চেহারা আমার মনে আছে, তার সঙ্গে এতটুকু মিল নেই!
অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে, আর আয়নার মুখটাও ঢেকে যাচ্ছে আঁধারে। আয়নায় ঘরের একমাত্র জানলাটা চোখে পড়ছে, কিন্তু ডক্টর পালিত কই! চমকে চোখ ফিরিয়ে দেখি উনি আমার মাথার কাছে জানলা আড়াল করে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। মুখটা ছায়ায় ঢাকা, চোখ দুটো অন্ধকার কোটর। খসখস শব্দে হেসে বললেন, কী, নিজেকে চিনতে পারছেন না তো! এখানে যারা আসে তারা কেউই পারে না। আর যখন পারে তখন এখান থেকে তাদের ছুটি হয়ে যায়।
আমার মাথায় কিছুই ঢুকল না। ধাঁধার মতো সব জট পাকিয়ে গেল। এখানে কতদিন রয়েছি আমি? কতদিনই বা থাকতে হবে? বহুবার এ-কথা জিগ্যেস করেছি ডক্টর পালিতকে। উত্তরে পেয়েছি নিঃশব্দ হাসি।
দিন, আয়নাটা এবার দিন।—ডক্টর হাত বাড়িয়ে আয়নাটা নিতে চাইলেন।
আমি এটা কাছে রাখতে চাই, ডক্টর।—অনুনয়ের সুর বেরিয়ে এল আমার ঠোঁট চিরে।
আবার সেই হাসি। তারপর বললেন, নিয়ম নেই যে। যদি আয়না ভেঙে অসাবধানে আপনার হাত-পা কেটে যায়! আমরা চাই না, আমাদের রুগিদের অযথা রক্তপাত হোক। জানেন তো, রক্তের এক-একটা ফোঁটার কত দাম!
আয়নাটা হাত থেকে নিয়ে নিলেন। আমাকে বিশ্রাম নিতে বললেন। তারপর বেরিয়ে যাওয়ার আগে সুইচ টিপে ঘরের নীল আলোটা জ্বেলে দিয়ে গেলেন।
ঘরে আবার আমি একা। সন্ধে ঘন হয়ে গেছে। শরীর দুর্বল লাগছে। কেমন যেন ঘুম-ঘুম পাচ্ছে।
ডক্টর পালিতের এই হাসপাতালটাই ভারী অদ্ভুত। বিশাল এলাকা জুড়ে বাড়ি, অথচ জনা-চারেকের বেশি রুগি আমার চোখে পড়েনি। আর ডাক্তারও ওই একজন—ডক্টর প্রিয়লাল পালিত। এ ছাড়া একজন নার্স আছেন—মিস তৃষ্ণা পান। মোট ছ’টি প্রাণী। অথচ প্রায় তিন বিঘে জমি জুড়ে বাগান, পুকুর, বাড়ি, আর পিছন দিকটায় ঘন জঙ্গল। জায়গাটা শহর থেকে কত দূরে কে জানে! শহরে কি মানসিক রোগের কোনও হাসপাতাল নেই যে, আমাদের মতো চারজন হতভাগ্যকে এখানে পাঠিয়েছে!
খাঁ-খাঁ হাসপাতালে মাঝে-মাঝে আমি ঘুরে বেড়াই। একতলা, দোতলা, তিনতলা, চারতলা চষে বেড়াই। কাউকে চোখে পড়ে না, কেউ বাধা দেয় না। কিন্তু আমি জানি, এদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাড়ির বাইরে বেরোবার উপায় নেই।
এমনি করে হাঁটতে-হাঁটতেই অনেক দিন ডক্টর পালিতের দোতলার ল্যাবরেটরিতে পৌঁছে গেছি। শিশি, বোতল, নানান কেমিক্যাল ও যন্ত্রপাতিতে ভরা প্রকাণ্ড ঘর। ওই ঘরে ঢুকলেই আমার মন চনমন করে ওঠে। তাকে সার-সার সাজানো বিষের শিশিগুলো দেখে নিশপিশ করে হাতের আঙুলগুলো। মড়ার খুলি আর কাটাচিহ্নের মতো আঁকা একজোড়া হাড়ের ছবি আমাকে চোখ ঠাউরে হাতছানি দিয়ে ডাকে : আয় রে আয়! আমার চোখে নেশা ধরে যায়, মাথা ঝিমঝিম করে। ওঃ, কতদিন! কতদিন যে ওসব জিনিসে হাত দিইনি! কিন্তু হাজার ইচ্ছে হলেও আমি ফাঁকা ঘরে ঢুকে তাকের দিকে হাত বাড়াইনি। কারণ, আমি জানি, ডক্টর পালিত অথবা মিস পান ঠিক আমার ওপরে নজর রাখছেন। একদিন আমাকে ওঁরা হাতেনাতে ধরে ফেলেছিলেন। তবে কিছু বলেননি। ডক্টর পালিত আর মিস পান শুধু একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসেছিলেন। অপমানে আমার গায়ে জ্বালা ধরে গিয়েছিল সেদিন।
নীল আলো কেমন যেন স্বপ্ন ডেকে আনে। ঘুম-ঘুম পায়। এখানে সবকিছুর রং সাদা। ঘরের দেওয়াল, জানলা, দরজা, বাগানের ফুল, এমনকী রুগিদের মুখগুলো পর্যন্ত ফ্যাকাসে সাদা। শুধু ডক্টর পালিত আর তৃষ্ণা পানের ঠোঁটজোড়া টুকটুকে লাল। ঘোর লাল। ঠিক লিপস্টিকের মতো।
এমনসময়ে মিস পান ঘরে খাবার নিয়ে ঢুকলেন। বিছানার পাশে টেবিলের ওপরে খাবার নামিয়ে রেখে বললেন, কেমন আছেন?
নরম গলায় বললাম, ভালো—।
আপনি ক’দিন ধরে ঠিকমতো খাচ্ছেন না। ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করুন। নইলে সেরে উঠবেন কেমন করে?
আমি শুয়ে-শুয়েই আবছা আলোয় তৃষ্ণা পানকে দেখতে লাগলাম। শরীরে যৌবন মাথাচাড়া দিতে চায়। কিন্তু অন্ধকার চোখের দিকে চোখ পড়লেই শীত-শীত করে, লোমগুলো খাড়া হয়ে ওঠে।
আপনাদের স্বাস্থ্য সবসময় তরতাজা থাকা দরকার—। তৃষ্ণা পান কথা বলতে-বলতে ঠোঁটের ওপরে জিভের ডগাটা বুলিয়ে নিলেন : অবশ্য এখন আপনার চেহারা খারাপ নেই।
হঠাৎই কোমল হাতটা বাড়িয়ে আমার বাহু স্পর্শ করলেন। আদরের চিমটি কাটলেন : সব রুগিদের মধ্যে আপনি সবচেয়ে ভালো। আমাদের কথামতো চলেন, স্বাস্থ্যের যত্ন নেন।
আমি কী বলব ঠিক করে ওঠার আগেই মিস পান জুতো খটখটিয়ে চলে গেলেন। অতএব বিছানায় উঠে বসে টেবিলটা কাছে টেনে নিলাম। খুব খিদে পাচ্ছে। লক্ষ করে দেখেছি, ট্রিটমেন্ট রুম থেকে ফেরার পর থেকেই প্রচণ্ড খিদে পায়, অথচ খেতে ইচ্ছে করে না।
তিনদিন আগে ডক্টর প্রিয়লাল আমাকে ট্রিটমেন্ট রুমে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঘরটা কাচের। সেখানে যে আমার কী ট্রিটমেন্ট হয়েছিল মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে, যখন ফিরে এসেছি তখন শরীরে অসহ্য ক্লান্তি, অবসাদ আর জড়তা। তারপর থেকেই আমার খাওয়া-দাওয়ার মাপ বাড়িয়ে দিয়েছেন ডক্টর পালিত। ট্রিটমেন্ট রুম থেকে ফেরার পরে-পরেই বরাবর এই ব্যবস্থা করেন। ভালো করে খেয়ে-দেয়ে আমাকে আবার সুস্থ-সবল হতে হবে। ডাক্তারের আদেশ। অতএব খাওয়া শুরু করলাম।
হঠাৎই দরজায় একটা ছায়া নজরে পড়ল। চমকে মুখ তুলে তাকালাম। ছায়াটা ঘরে ঢুকে এল। চাপদাড়িওয়ালা অল্পবয়েসি ছেলে একটা। হাসপাতালে নতুন এসেছে। রোগাসোগা চেহারা। ছটফটে চোখ। মুখে কেমন একটা তেজ আছে। ও আর আমি ছাড়া যে-দুজন রুগি হাসপাতালে আছে, তারা বুড়ো। শুকিয়ে প্যাঁকাটির মতো হয়ে গেছে। ঘর ছেড়ে বেরোনোর ক্ষমতা নেই। স্রেফ বিছানায় শুয়ে-বসে থাকে। মিস পানকে ওদের কথা জিগ্যেস করলেই বলেন, ওঁদের আর কোনও রোগ নেই, ভালো হয়ে গেছেন।
তাহলে ওঁরা ছুটি নিয়ে চলে যাচ্ছেন না কেন?
কোথায় যাবেন? ওঁদের যে তিনকুলে আর কেউ নেই।—মিস পান সরু-সরু দাঁত দেখিয়ে হাসলেন : যাদের কেউ থাকে না, তারাই তো এখানে আসে। আমরাই তাদের সব।
আমি অধৈর্য হয়ে জানতে চেয়েছি, আমার অসুখ কবে সারবে?
সারবে। এত অধৈর্য হচ্ছেন কেন? আর দু-চারজন মোটাসোটা রুগি আসুক, আপনাদের দুজনের অসুখ তখন তাড়াতাড়ি সারবে।
আমি জবাব শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলাম। শুধু একবার মনে হয়েছিল, বুড়োদুটো বেঁচে আছে তো? ঘরের দরজা দিয়ে উঁকি মেরে যখনই ওদের দেখেছি, মনে হয়েছে সাদা চাদরে ঢাকা রক্তহীন সাদা দুটো মানুষ।
পেটপুরে খাচ্ছেন দেখছি!—ঠাট্টার সুরে বলল দাড়িওয়ালা ছেলেটি। বিনা আমন্ত্রণেই বিছানার একধারে এসে বসল।
দেখা হলেই ছেলেটা আমার সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ারকি করে। বলে, আপনি হলেন ওদের পোষা পাখি—জবাইয়ের মুরগির মতো। যত খেয়েদেয়ে মোটা হবেন, ততই ওদের ভালো।
আমি জবাব না দিয়ে একটা তরকারির বাটি ছেলেটার দিকে এগিয়ে দিলাম। বললাম, নিন, আমার এত খেতে ইচ্ছে করছে না।
ও যেন আঁতকে উঠল। তড়াক করে উঠে পড়ল বিছানা ছেড়ে। তারপর বলল, মরে গেলেও আপনার হাত থেকে কোনও জিনিস খাচ্ছি না। এত জলদি আমার মরার সাধ নেই।
আমি অবাক হয়ে আর কিছু বলার আগেই সে ঘর ছেড়ে চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম। বেশ আরাম লাগছে এখন।
পরদিন ডক্টর পালিত ও মিস পানের হাসির মানে খুঁজে পেলাম।
আমাকে ফাঁকা ল্যাবরেটরিতে বিষের শিশি ঘেরা জায়গায় দেখে কেন ওঁরা সেদিন অমন করে হেসেছিলেন, এখন বুঝতে পারছি। অপমানে তখন গায়ে জ্বালা ধরে গিয়েছিল। এখন সে-জ্বালা শতগুণ হয়ে আমার শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ভয় হচ্ছে, আমার এই ছটফটানি দেখে ওঁরা আমাকে আজই আবার ট্রিটমেন্ট রুমে না নিয়ে যান।
সকালবেলার দিকে হাসপাতালের ভেতরে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। একসময় হাজির হয়ে গেলাম ল্যাবরেটরিতে। যথারীতি সেখানে কেউ নেই। মনে কেমন একটা জেদ চেপে গেল। ঝট করে একটা বোতল টেনে নিলাম তাক থেকে। মারকিউরিক ক্লোরাইডের সলিউশন। বোতলের গায়ে মড়ার খুলি ও কাটাকুটি হাড়ের ছবি। বোতলটা গায়ের সাদা অ্যাপ্রনের আড়ালে লুকিয়ে ফিরে এলাম নিজের ঘরে।
তারপর ডক্টর পালিত ও মিস পান যেখান থেকে জল খান, সেই ওয়াটার ফিলটারের জলের মধ্যে বোতলের অর্ধেকটা ঢেলে দিয়েছি। বোতলটা লুকিয়ে ফেলেছি নিজের ঘরে। ব্যস, কাজ শেষ!
কিন্তু একটু পরেই মিস পান এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। বললেন, একটু আসুন, একটা জিনিস দেখাব।
কী?—আমি হকচকিয়ে গেলাম। একটু ভয়ও পেলাম।
চলুন না, একটা মজা হবে।—নকল আহ্লাদে ওঁর গায়ের নরম ছোঁয়া ঘষে দিলেন আমার গায়ে।
সুতরাং ওঁর সঙ্গে গেলাম।
প্রিয়লাল পালিত ওয়াটার ফিলটারের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। আমাকে দেখে হাসলেন : আসুন, আসুন, আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি।
তারপর ফিলটারের কল খুলে এক গেলাস জল ভরতি করলেন। এবং এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।
আমি ভয়ে পিছিয়ে গেলাম। কোনওরকমে বললাম, আমার জলতেষ্টা পায়নি।
মিস পান আমাকে অসম্ভব শক্তিতে পিছমোড়া করে চেপে ধরলেন। ওঃ, কী করে এত শক্তি এল এই তুলতুলে মেয়েটার শরীরে!
আর ডক্টর পালিত জলভরতি গেলাসটা আমার নাকের কাছে নিয়ে এলেন। বললেন, দেখুন তো শুঁকে, মারকিউরিক ক্লোরাইডের গন্ধ পাওয়া যায় কি না!
বাধ্য হয়ে ঘ্রাণ নিলাম। হ্যাঁ, টের পাওয়া যাচ্ছে সহজেই। কোনওরকমে ঘাড় নেড়ে সে-কথা জানালাম। তখন মিস পান আমাকে ছেড়ে দিলেন। ভয়ে আমার শরীর কাঁপছিল, ধরা পড়ে গেছি আমি। এখন ওঁরা কী করবেন আমাকে নিয়ে?
ডক্টর পালিত এক চুমুকে গেলাসের সবটুকু জল খেয়ে নিলেন।
বিষ! তীব্র বিষ! অথচ—।
আবার ফিলটারের কল খুলে গেলাস ভরতি করলেন। এবারে দিলেন মিস পানকে। উনিও গেলাস শেষ করলেন এক নিমেষে। দুজনেই হাসলেন আমাকে ব্যঙ্গ করে। তারপর আবার গেলাস ভরতি হল। আবার নিমেষে গেলাস শেষ। তারপর আবার। আবার!
এইভাবে আমাকে দেখিয়ে ওঁরা পালা করে ফিলটারের বিষাক্ত জল শেষ করার উৎসবে মেতে উঠলেন। সে কী হাসি ওঁদের! পেটে হাত চেপে, শরীর দুলিয়ে, আমার দিকে তাচ্ছিল্যের আঙুল তুলে সে কী হাসি! যেন নেশার ফোয়ারা ছুটছে।
দেখতে-দেখতে ফিলটারে জল শেষ! আশ্চর্য! যে-বিষে অন্তত পনেরোটা ধেড়ে মানুষের অক্কা পাওয়ার কথা, সেই বিষ হাসতে-হাসতে ওঁরা ছক্কা মেরে শেষ করলেন। অথচ এখনও ওঁরা অট্টহাসি হাসছেন। চোখের তারা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
আমি তাড়া-খাওয়া নেড়ি কুকুরের মতো দু-পায়ের ফাঁকে লেজ ঢুকিয়ে ছুটে চলে এলাম নিজের ঘরে। বিছানায়। তারপর অসহ্য জ্বালায় শুধু ছটফট-ছটফট। এইজন্যেই ওঁদের ল্যাবরেটরিতে কোনও পাহারা নেই, কোনও ভয় নেই ওঁদের। এমনকী আমার কাছ থেকেও না।
সমস্ত ব্যাপারটা একটা জটিল ধাঁধার মতো ঠেকছিল, এমনসময় দাড়িওয়ালা ছেলেটা আমার ঘরে এল। ওকে এক গেলাস জল এগিয়ে দিলাম। ছেলেটা তীব্র ভাষায় আমার ওপরে মুখিয়ে উঠল। এক ধাক্কায় জলের গেলাস ছিটকে ফেলে দিল। আমার ভেতরটা টগবগ করে ফুটছিল। হাত বারবার মুঠো হয়ে যাচ্ছিল আপনা থেকেই।
ছেলেটা বলল, কিছুই বোঝেন না, না? ন্যাকা! আপনি এখানে কী করে এসেছেন, তা জানেন? নাকি সবসময় ভুলে যাওয়ার ভান করেন! আপনার সব ফাইলপত্তর আমি দেখেছি। আপনি ইন্ডিয়া ড্রাগ কোম্পানির কেমিস্ট ছিলেন। তিন-তিনটে মানুষকে বিষ খাইয়ে খুন করেছেন আপনি! তারপর ধরা পড়েন। বহুদিন আপনাকে নানান মেন্টাল হসপিটালে রেখে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু আপনার ওই এক রোগ! বিষ দেখলেই হাত নিশপিশ করে, যাকে হাতের কাছে পান, তাকেই একঢোক বিষ গিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে, তাই না!
আমি বিছানায় পাথর হয়ে বসে রইলাম। ও যা বলছে সব সত্যি? নিশ্চয়ই সত্যি! নইলে সব কথাগুলোই আমার এত চেনা-জানা ঠেকছে কেন? শুধু আমার নিজের মুখটাই আমার কাছে অচেনা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, কেউ আমার মাথার ঢাকনা খুলে ভেতরের জিনিসগুলো আচ্ছা করে নেড়েঘেঁটে দিয়ে আবার ঢাকনা বন্ধ করে দিয়েছে।
দাড়িওয়ালা ছেলেটা চলে গেল। আমার মাথার ভেতরে ওর কথাগুলোই বারবার বাজতে লাগল : তিন-তিনটে মানুষকে বিষ খাইয়ে খুন করেছেন আপনি! তিন-তিনটে মানুষকে…।
সন্ধেবেলা প্রিয়লাল পালিত আর মিস পান আমাকে দেখতে এলেন। ওঁদের মুখ-চোখ-ব্যবহার একেবারে স্বাভাবিক। সকালের ওই সাংঘাতিক ঘটনা যেন একেবারে ভুলে গেছেন। কিন্তু আমার অসহ্য জ্বালা যেন আবার শুরু হল।
বিভিন্ন প্রশ্ন করে ডক্টর পালিত আমার মানসিক প্রতিক্রিয়া দেখলেন। তারপর চোখ, জিভ পরীক্ষা করলেন, রক্তচাপ মাপলেন, পালস দেখলেন, গা-হাত-পাও দেখলেন টিপে-টিপে। তৃষ্ণা পান ঠায় দাঁড়িয়ে লোভী চোখে ডক্টরের কাণ্ডকারখানা দেখছিলেন। পরীক্ষা-টরিক্ষা শেষ হয়ে গেলে আগ্রহ নিয়ে বললেন, কেমন দেখলেন, ডক্টর? কাল পেশেন্টকে ট্রিটমেন্ট রুমে নেওয়া যাবে?
যাবে।—গম্ভীরভাবে জবাব দিলেন পালিত। তারপর দুজনেই চলে গেলেন।
আমার ভীষণ ভয় করছিল। আবার ওই ট্রিটমেন্ট রুম! ওখানে কী হয় জানি না। কেমন যেন এক আশ্চর্য ঘোরের মধ্যে সেই সময়টুকু কেটে যায়। তারপর ঘরে বিছানায় যখন জ্ঞান ফেরে, তখন শুধু অবসাদ আর ক্লান্তি।
ডক্টর ও নার্স চলে যেতেই মারকিউরিক ক্লোরাইডের লুকোনো বোতলটা বের করলাম। কী করব এখন এই বিষ দিয়ে? দাড়িওয়ালা ছেলেটা খুব চালাক। আমার হাত থেকে কক্ষনও কিছু খায় না। আর বাকি ওই বুড়ো রুগি দুটো—ওদের বিষ দিলেই বা কী, আর না দিলেই বা কী! কী যে করি এই বোতলটা নিয়ে!
সাত-পাঁচ ভেবে শেষপর্যন্ত খোলা জানলার কাছে গেলাম। ছায়া-ছায়া অন্ধকার নেমে এসেছে বাইরের বাগানে, পেছনের ঘন জঙ্গলে। কোনও প্রাণীর একটানা গর্জন কানে এল। নেকড়ের চিৎকার। প্রায় রোজ রাতেই শোনা যায়। চোখ তুলে দেখি আকাশে আধখানা চাঁদ। চাঁদের আলো মাঝে-মাঝেই ঢেকে দিচ্ছে উড়ন্ত বাদুড় আর প্যাঁচার ডানা। লক্ষ করেছি, এই অঞ্চলে নিশাচর পাখিই বেশি চোখে পড়ে। কেন কে জানে!
আর অপেক্ষা না করে হাতের বোতলটা ছুড়ে দিলাম বাইরের অন্ধকার বাগানে। অনেকক্ষণ পরে শব্দটা ভেসে এল। কাচের বোতলটা ভেঙে চৌচির। যাক, আপদ গেছে! ওটা রেখেও তো কোনও লাভ ছিল না। যদি অবশ্য নিজেকেই না…।
আমার মাথার মধ্যে সবকিছু যেন কেমন গোলমাল হয়ে যায়। দুচোখ বুজলেই সার-সার শিশি-বোতলের স্বপ্ন দেখি। সব ক’টার ওপরেই মড়ার মাথার খুলি আঁকা। খুলির কালো চোখের কোটর দুটো ধকধক করে জ্বলছে। আমার হাতের আঙুলগুলো লাউডগা সাপের মতো হিলহিল করে আকুলিবিকুলি করে। বুকের ভেতরে দুপদাপ শব্দ হয়। সেই তিনজনের কথা মনে পড়ে—যাদের আমি বিষে নীল করে দিয়েছি। কিন্তু তিনের পর? চার নম্বরকে খুঁজে পেলাম কই! আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে আমাকে? ওই দাড়িওয়ালা ছেলেটাকে যদি…।
কী ভেবে ঘর ছেড়ে বেরোলাম। দাড়িওয়ালা ছেলেটির ঘরে গিয়ে একবার দেখলে হয় কী করছে। অবশ্য এই সময়টাতে ও রোজ তাস খেলে। একা-একা। বলে, এখানে যতক্ষণ পারবেন জেগে থাকবেন। চোখের পাতা এক করলেই বিপদ। ওই ডাক্তার আর নার্সকে বিশ্বাস নেই—।
কিন্তু ওর ঘরে গিয়ে ভারি অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। ছেলেটা নিজীবভাবে বিছানায় শুয়ে আছে। দুচোখ মেলে ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে। এরকম ক্লান্ত অসহায় ওকে কখনও দেখিনি। আমি বিছানার খুব কাছে চলে গিয়েছিলাম। ছেলেটি মুখ ফিরিয়ে আমাকে দেখল। প্রথমে ভয় পাওয়া চোখে আমার হাতের দিকে তাকাল। তারপর হাত খালি দেখে আশ্বস্ত হল। গলায় হাত বুলিয়ে বারকয়েক ঢোক গিলল।
আমি জিগ্যেস করলাম, এরকম অসময়ে শুয়ে আছেন যে?
ছেলেটা চাপা গলায় ফিসফিস করে বলল, আমাকে আজ ট্রিটমেন্ট রুমে নিয়ে গিয়েছিল।
এমনসময় বাইরের অন্ধকার থেকে ভেসে এল প্যাঁচার কান্না, শেয়ালের একটানা চিৎকার, নেকড়ের পালের ক্রুদ্ধ গর্জন।
তারপর?—আমি রুদ্ধশ্বাসে জানতে চাইলাম।
ওই ডাক্তার আর নার্সটা মানুষ নয়! ওরা ভ্যাম্পায়ার। এই দেখুন—।
শুয়ে থাকা অবস্থাতেই থুতনিটা সামান্য উঁচু করল ছেলেটি। হাত দিয়ে দাড়ি সরাল। ঘরে অল্প পাওয়ারের নীল আলো জ্বলছিল। ওর গলার খুব কাছে চোখ নিয়ে দেখলাম এক ইঞ্চি তফাতে দুটো ছোট ক্ষতচিহ্ন—মাপে মসুর ডালের দানার মতো। জায়গাটা দু-আঙুলে টিপে ধরে রগড়াল ছেলেটা। সঙ্গে-সঙ্গে কালচে ঘন তরলের ফোঁটা দেখা গেল ক্ষতমুখে। ছেলেটা আঙুলের ডগায় সেই তরল মুছে নিল, আমাকে দেখাল।
দেখুন—রক্ত!
তারপর ফ্যাকাসে মুখে ক্লিষ্ট হেসে জানতে চাইল, আমার তো গলায়, আপনার কোথা থেকে রক্ত নিয়েছে?
অজান্তেই আমার হাত চলে গেল ঘাড়ে। জায়গাটা খুঁজে পেলাম। এখনও ব্যথা। আমি জানি ইঞ্জেকশান সিরিঞ্জ অথবা দাঁতের দাগজোড়া ওখানেই আছে। সত্যিই কি প্রিয়লাল পালিত আর তৃষ্ণা পান ভ্যাম্পায়ার? ছেলেটা কি ঠিক বলছে? অবশ্য হতেও পারে। এই জায়গাটা নির্জন। শুধুমাত্র সংসার থেকে জবাব-দেওয়া রুগিরাই এখানকার বাসিন্দা। খোঁজখবর করার কেউ নেই, সন্দেহ করার কেউ নেই। তার ওপর ডক্টর আর নার্সের অন্ধকার চোখ, ঝকঝকে দাঁত, ওই বিষাক্ত জলপানের ঘটনা…নাঃ, আমার সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ছেলেটিকে সকালের ঘটনা জানালাম। বললাম, বিষে ওঁদের কিচ্ছু হবে না।
ছেলেটি অস্পষ্ট হেসে বলল, হলে তো আপনিই শায়েস্তা করতে পারতেন।
একটু থেমে আবার বলল, ভ্যাম্পায়ার নিয়ে আমি অনেক বইপত্র ঘেঁটেছি। এরা দুজন যে-টাইপের, তাতে রুপোর বুলেট দিয়ে গুলি না করলে এরা শেষ হবে না। কিন্তু এখানে রুপোর বুলেট কোথায় পাবেন?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ছেলেটি। আবার চোখ ফেরাল সিলিংয়ের দিকে।
বুলেট, রিভলবার, কান-ফাটানো শব্দ, রক্তপাত—নাঃ! আমার শরীর অস্থির-অস্থির করতে লাগল। এগুলো আমার একদম ধাতে সয় না। আমার পছন্দ শিশি-বোতল, মড়ার খুলি, কাটাকুটি হাড়। কিন্তু সেভাবে কি শেষ করা যাবে ডক্টর আর নার্সকে? ছেলেটার কথামতো সত্যিই যদি ওঁরা ভ্যাম্পায়ার হন?
ছেলেটা হঠাৎই বিড়বিড় করে বলল, পোষা মুরগির মতো তিলে-তিলে এখানে মরতে হবে। বাঁচার কোনও পথ নেই….।
বাইরে থেকে আবার ভেসে এল নিশাচর প্রাণীগুলোর চিৎকার।
আমি পায়ে-পায়ে বাইরের করিডরে চলে এলাম। মনে-মনে দুশ্চিন্তার জট ছাড়াতে চেষ্টা করছি। খুঁজে বেড়াচ্ছি প্রশ্নের উত্তর।
খাঁ-খাঁ করিডরে আমার পায়ের শব্দ অপার্থিব প্রতিধ্বনি তুলতে লাগল।
দু-দিন পর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। শিশি-বোতল-মড়ার-খুলি-কাটাকুটি-হাড়। কিন্তু আমি ডক্টর পালিতের ল্যাবরেটরি থেকে বোতল সরাতে পারব না। ওঁরা ঠিক টের পাবেন এবং ওইরকম গা-জ্বালা-করা হাসি হেসে আমাকে অপদস্থ করবেন। আমার অসহ্য লাগে। সুতরাং দাড়িওয়ালা ছেলেটিকেই বলব বোতল সরানোর জন্যে।
দুপুরের দিকে ওর ঘরে গেলাম। সব খুলে বললাম। শুনে ও বিশ্বাস করতে চাইল না। আমি ওকে ভরসা দিলাম। বললাম, আপনার সাহায্য না পেলে এ-কাজ আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়।
ছেলেটা রাজি হল। দুটো দিন ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে ও অনেকটা চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। ওকে বললাম, ঠিক সময় হলেই জানিয়ে দেব কখন কীভাবে কোন বোতলটা সরাতে হবে।
পরপর তিনদিন আমি গোগ্রাসে খাওয়া শুরু করলাম। যে করে হোক ওজন বাড়াতে হবে। দেখলাম, ওজন বাড়ছেও। নিয়মিত রাউন্ডে এসে ডক্টর পালিত ও তৃষ্ণা পান আমার গা টিপে-টিপে দেখেন। ওঁদের চোখ ধকধক করে। আমি শিউরে উঠি। বুঝি, সময় হয়ে এসেছে। আমাকে ট্রিটমেন্ট রুমে ওঁরা নিয়ে গেলেন বলে।
চতুর্থ দিন বিকেলে আমি খুব উত্তেজিত হওয়ার অভিনয় করলাম, অস্থির হয়ে হাত-পা ছুড়তে লাগলাম। ডক্টর পালিত সেটা লক্ষ করে মিস পানের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন, সময় হয়ে গেছে। কালই ওঁকে একবার ট্রিটমেন্ট রুমে নিয়ে যেতে হবে, কেমন?
মিস পান আমার ঘাড়ে কোমল হাত রাখলেন। ওঁর টুকটুকে জিভের ডগা দেখা গেল। তারপর বললেন, হ্যাঁ, আর দেরি নয়, কালকেই—।
ওঁরা চলে যেতেই আমি দাড়িওয়ালা ছেলেটার ঘরে গেলাম। ও উত্তেজিত অবস্থায় আমারই জন্যে অপেক্ষা করছিল। ওকে বললাম, চুপিসাড়ে ডক্টর পালিতের দোতলার ল্যাবরেটরিতে যেতে। তারপর কতকগুলো দরকারি জিনিস নিয়ে আসতে।
ঘন্টাখানেক পরেই ছেলেটি ফিরে এল। সাদা অ্যাপ্রনের আড়াল থেকে বের করে দিল দরকারি জিনিসগুলো। আমার মুখে হাসি ফুটল। ওকে শাবাশ জানিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। তারপর সমস্ত নির্দেশ দিয়ে বললাম ঝটপট কাজ সারতে।
ছেলেটি আমার কথামতো কাজ শুরু করল।
আমার বুক শুকিয়ে আসছে, শরীরে আগুন জ্বলছে, চোখের সামনে লাল-নীল তারা নাচছে। শেষপর্যন্ত আমি সইতে পারব তো!
…কাজ শেষ করে ও আমার কাছে সরে এল। উদ্বেগের সুরে জানতে চাইল, আপনার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?
আমি দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিলাম, আমি ঠিক আছি। আপনি ঘরে চলে যান। কালকেই সব জানতে পারবেন।
ও চলে গেল। আমি বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলাম। একরকম জেদ ধরেই রাতের খাওয়া পেট ভরে খেলাম। তারপর যন্ত্রণা সহ্য করে শুধু অপেক্ষা। অপেক্ষা। দু-চোখে আমার ঘুম নেই। ঘুম…।
অসহ্য চিনচিনে যন্ত্রণার মধ্যে জ্ঞান ফিরল।
চোখ খুলেই এক অপরূপ দৃশ্য দেখতে পেলাম।
ট্রিটমেন্ট রুমের ধবধবে বিছানায় আমি শুয়ে রয়েছি। একটু দূরেই টলমল অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে চেষ্টা করছেন ডক্টর প্রিয়লাল পালিত ও মিস পান। দুজনেরই কালো অন্ধকার চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে। মুখ-ঠোঁট লিপস্টিকে মাখামাখি। নাকি রক্ত? দু-হাতে বুক খামচে ধরে হাঁ করে ওঁরা বাতাস নিতে চাইছেন। টুকটুকে জিভ বেরিয়ে এসেছে অস্বাভাবিক রকম। ঝকঝকে দাঁত দেখা যাচ্ছে। দাঁতে কি লিপস্টিকের ছোপ?
টলতে-টলতে প্রথমে মুখ থুবড়ে পড়লেন ডক্টর পালিত। মিস পান ট্রিটমেন্ট রুম থেকে বেরোতে যাচ্ছিলেন, দরজার কাছেই হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। সামান্য মাথা তুলে আমি মিস পানের শক্ত হয়ে যাওয়া পা দুটো দেখতে পাচ্ছি, আর দেখতে পাচ্ছি ডক্টর পালিতের কুঁকড়ে যাওয়া বীভৎস দেহ। আমার ঘাড়ের কাছটা চটচট করছে, বালিশের অবস্থাও তাই। শরীরে অবসাদ, অথচ ভেতরে যেন মরুভূমির আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। এ জ্বালা কি আর নিভবে না?
যাক, তবু নিশ্চিন্ত! ভ্যাম্পায়ার দুটো শেষ!
গতকালের কথা মনে পড়ছে। দাড়িওয়ালা ছেলেটিকে যখন কাজের দায়িত্ব দিয়ে ডক্টর পালিতের ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়েছিলাম, তখন ও কীরকম যেন হতভম্ব হয়ে পড়েছিল।
ওকে বলেছিলাম, খুব মনোযোগ দিয়ে শুনুন। একটা স্যালাইনের বোতল আর নিডল নিয়ে আসবেন। এ ছাড়া ঘরের ডানদিকের প্রথম তাকে দেখবেন একটা ছোট বোতল আছে। তার গায়ে লেখা AgNO3 সলিউশন—সেই বোতলটা নিয়ে আসবেন। ব্যস, কাজ শেষ।
ছেলেটি হেসে বলেছিল, বোতলের গায়ে মড়ার খুলি আঁকা আছে তো?
আমি ব্যস্ত হয়ে বলে উঠেছি, না, না, ওটা বিষ নয়, বিষ নয়!
ছেলেটা কেমন যেন হতবাক হয়ে গেল। ভ্যাবাচ্যাকা মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কী যেন জিগ্যেস করতে চায় এমন ভাব।
আমি হেসে বললাম, কোনও চিন্তা নেই। ভুলে যাবেন না, আমি কেমিস্ট ছিলাম।
ছেলেটি চুপ করে রইল। তখন আমি ঘরে ফিরে এসে ওর জন্যে অপেক্ষা করেছি।
ও জিনিসগুলো হাতিয়ে ফিরে আসার পর, আমরা কাজ শুরু করি। ওকে বলেছি, স্যালাইনের বোতলটা বাথরুমে গিয়ে খালি করে নিয়ে আসুন।
কোনওরকম প্রশ্ন না করেই ছেলেটি আমার নির্দেশ পালন করেছে।
তারপর ছোট বোতলের তরলটা ঢেলে নিয়েছি স্যালাইনের খালি বোতলে। পাইপ আর নিডল ফিট করেছি। ছেলেটিকে বলেছি, স্যালাইনের বোতলটাকে উলটোভাবে উঁচু করে ধরে রাখতে। আর আমি নিডল গুঁজে দিয়েছি আমার বাঁ-হাতের কনুইয়ের খাঁজে। বোতলের তরল পাইপ বেয়ে নেমে এসে ঢুকে যেতে লাগল আমার শরীরে, মিশে যেতে লাগল আমার রক্তে। ছেলেটি বোকা-বোকা ভয়ার্ত চোখে আমাকে দেখছিল…।
…একসময় বোতল শেষ হল। নিডল বের করে তুলো দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে হাত ভাঁজ করে রইলাম। ছেলেটিকে বললাম, খালি বোতল, পাইপ, নিডল, সব জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিতে। শুধু আমার রক্তে ছাড়া আর কোথাও যেন আমাদের গোপন কাজের কোনও চিহ্ন না থাকে।
ওঃ, কী যন্ত্রণা যে সহ্য করেছি সারাটা রাত! ভ্যাম্পায়ার দুটোকে নিকেশ করতে পেরে মনে হচ্ছে যন্ত্রণা সহ্য করা আমার সার্থক হয়েছে।
রুপোর বুলেট আমি পাইনি। তবে ল্যাবরেটরি থেকে পেয়েছি AgNO3—আর্জেন্টাম নাইট্রেটের দ্রবণ। আর্জেন্টাম! ল্যাটিন ভাষায় ওটাই রুপোর নাম! সেই সিলভার নাইট্রেট, অর্থাৎ রুপোর পরমাণু ছুঁচ বিঁধিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছি আমার রক্তে। রক্তে মিশে গেছে রুপো। রুপোর বুলেটের চেয়েও ভয়ঙ্কর এবং অমোঘ। সেই রুপোলি রক্ত চুষে খেয়ে ডক্টর প্রিয়লাল পালিত আর মিস পান…।
আমার শরীর ভীষণ দুর্বল লাগছে। ট্রিটমেন্ট রুম থেকে কি আর বেরোতে পারব কখনও? দাড়িওয়ালা ছেলেটাই বা কোথায়? আস্তে-আস্তে বাইরে অন্ধকার নামবে। শুরু হবে নিশাচর প্রাণীর আর্ত কান্না, হিংস্র গর্জন। এই নির্জন মৃত্যুপুরী থেকে নিরাপদে বাইরে বেরোতে পারব তো? বাইরে তিনজনকে শেষ করেছিলাম। তার কতদিন পরে এখানে দুজনকে বাগে পেলাম। মোট পাঁচজন! এখনও কত বাকি! অন্তত তেরোজনকে শেষ করতেই হবে! তেরো, আনলাকি থার্টিন! নইলে নরকে যে আমার ঠাঁই হবে না!
রাত বোধহয় বেড়েছে। কারণ, বাইরে শুরু হয়েছে নেকড়ের গর্জন। আর শরীরের ভেতরে প্রতিটি শিরায় ও ধমনিতে রুপোলি রক্তের পাগল করা ছুটোছুটি ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠছে। বাইরের গর্জনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোটি-কোটি লোহিত কণিকা কেমন মাতালের মতো নাচছে …নাচছে…নাচছে…আর চোখের সামনে লাল-নীল-হলুদ তারার মেলা…।
মাসিক রোমাঞ্চ
পুজো সংখ্যা, ১৯৮৪