উপন্যাস
বড়গল্প
ছোটগল্প
1 of 2

রুপোর মাছ

রুপোর মাছ

অনেকেই বলে মামার বাড়িতে মানুষ হওয়া ভালো নয়। নিজের বাড়ি ছেড়ে মামার বাড়ি কেন? অনেক সময় ছেলেদের বাবা মারা গেলে বা বাবার অবস্থা খারাপ হলে মায়েরা ছেলেকে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। আমার ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। আমার বড়মামা বিরাট ডাক্তার। মেজোমামা নাম করা অধ্যাপক। আমার মাসিমাও খুব শিক্ষিতা। এক সময় একটা ভালো স্কুলে শিক্ষকতাও করেছিলেন কিছুকাল। আমার দুই মামা এবং মাসিমা ঠিকই করেছেন বিয়েটিয়ে করবে না। সাবেক আমলের বিশাল বাড়ি। বিরাট জমিদারি। আমার মাকে এসে অনুরোধ করেছিলেন, দিদি, ভাগ্নেটাকে আমাদের দিয়ে দে। তৈরি করে আবার তোর কাছে ফেরত দিয়ে যাব। ওখানে অতবড় জায়গা, খোলামেলা, কাছাকাছি ভালো ইস্কুল। দেখবি ও খুব আনন্দে থাকবে। প্রথমে আমার মনে হয়েছিল কী জানি বাবা, বাবা মাকে ছেড়ে থাকতে পারবো তো! এখন মনে হয় মামাদের আর মাসিকে ছেড়ে আমি কোথাও থাকতে পারব না। লোকে বলে আনন্দ নিকেতন। আমার মামার বাড়িটা সত্যিই তাই। সব সময় একটা হুল্লোড়। যখন একা থাকি তখন ভাবি স্বর্গ তো দেখিনি, দেখতেও চাই না। আমার মামার বাড়িটাই তো স্বর্গ! আমার বড়মামা যেন মহাদেব। মেজোমামাকে দেখলে মনে হয় অর্জুন। আর আমার মাসিমা যেন দ্রৌপদী! ঠিক দ্রৌপদীর মতো দেখতে। দ্রৌপদী কেমন দেখতে ছিলেন জানি না। তবে কল্পনায় দ্রৌপদীর যে ছবি আছে তার সঙ্গে আমার মাসিমার খুব মিল। নামটাও ভারি সুন্দর—কুসি! কুসি বোধ হয় একটা নদীর নাম। আবার কচি কচি আমকেও বলে কুসি। সত্যি কথা বলতে কী, আমি আমার মাসিমাকে মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসি।

সকাল বেলা। মাসিমা আমাদের একতলার বসার ঘরে একটা দোল খাওয়া চেয়ারে বসে অল্প অল্প দুলছেন আর গান গাইছেন, দিবা নিশি করিয়া যতন হৃদয়েতে রচেছি আসন। কর্তা যিনি ক্ষ্যাপা তিনি ক্ষ্যাপার মূলাধার। চাকলা ছাড়া চ্যালা দুটো সঙ্গে অনিবার। আহা গুণের কথা কইবো কার। মাসিমা গান গাইছেন আর গান্ধারীদি একটা হাতল লাগানো ডাস্টার দিয়ে ছবির ধুলো ঝাড়ছে। মাসিমার বসে থাকার কারণ এই ধুলো ঝাড়ার কাজটা গান্ধারীদি একটু ফাঁকি দিয়ে সারে। তাই মাসিমা বলেছেন, আমি বসে থাকবো, আমার সামনে তুই পরিষ্কার করে সব ঝাড়বি। একটাও ছবি যেন না ভাঙে।

গান্ধারীদি একটা ছবি একটু নাড়াতেই ছবির পেছন থেকে একটা খাম মেঝের ওপর পড়ল। গান্ধারীদি থেবড়ে বসে খামটা দেখছে। মাসিমা গান থামিয়ে বললেন, ‘কি ওটা?’

‘এই ছবিটার পেছন থেকে খুটুস করে পড়ে গেল।’

‘পড় না, পেছনে কার নাম লেখা অছে?’

‘কিছু লেখা নেই গো। সাদা খাম। মোটা মতন। যেন পার্শে মাছের ডিম ধরেছে।’

‘টিপে দেখনা।’

‘না বাবা, ভয় করছে! কিনা কি আছে ভেতরে। মাগ্গো!’

আমি ওপাশের টেবিলে বসে বসে অঙ্ক কষছিলুম। আর একটু পরেই মাস্টার মশাই আসবেন। মাসিমা আমাকে বললেন, ‘বিলে দেখ তো, আমার আলসে লেগে গেছে। উঠতে ইচ্ছে করছে না চেয়ার ছেড়ে।’

আমি উঠে এসে খামটা হাতে নিয়ে খুলতেই ভেতর থেকে কিছু শুকনো বেলপাতা আর ফুল মেঝেতে পড়ে গেল। গান্ধারীদি বললে, ‘ইঃ বাব্বা, ফুল বেলপাতা! কেউ তুকতাক করেছে গো!’

মাসিমা বললেন, ‘তোর মাথা করেছে!’

গান্ধারীদি বললে, ‘এই দেখ না সিঁদুর মাখানো বেলপাতা। চন্দন মাখানো জবা ফুল। একটা লাল কাপড়ের টুকরা। মেঝেতে যখন পড়ল না বাড়িটা একেবারে কেঁপে উঠল।’

মাসিমা বললেন, ‘কেঁপে উঠল! আমরা কেউ টের পেলুম না!’

তুমি তো বসে বসে দুলছিলে আর ক্ষ্যাপা ক্ষ্যাপা করে গান গাইছিলে। তুমি কি করে টের পাবে! হ্যাঁ, বিলু পেয়েছে। বাড়িটা কেমন কেঁপে উঠল নারে!’

আমি বললুম, ‘অঙ্ক কষতে বসলে আমার কাছে তখন সারা পৃথিবীটাই কাঁপে। আমি অত বুঝতে পারিনি। তা বলছে যখন কেঁপেছে তাহলে কেঁপেছে!’

মাসিমা এক ধমক দিলেন আমাকে, ‘চুপ কর!’

গান্ধারীদি বললে, ‘এই দেখ বিশ্বাস কর না, ওই তো সে বার চৈত্র মাসে আমার মেসোমশাই যার পল্টন বাজারে অত বড় দোকান, এ বেলা ও বেলা হাজার টাকা রোজগার। আর কী খাওয়া! যখন খেতে বসতো তখন গোটা একটা ছাগল মাথা বাদ দিয়ে খেয়ে উঠত। খেয়ে উঠে যখন ঢেঁকুর তুলতো তখন মনে হত রাজবাড়িতে তোপ পড়ল! পাড়ার লোকে ঘড়ি মিলিয়ে নিত—ঠিক আড়াইটে!

মাসিমা বললেন, ‘তার সঙ্গে ফুল বেলপাতার কী সম্পর্ক?’

গান্ধারীদি বললে, ‘আমার মা বলত, গেঁদো যখন বলবি তখন সব গোড়া থেকে বলবি। জেনে রাখো আগে গাছের গোড়া তারপর ডালপালা।’

মাসিমা ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ‘তাহলে তুই মাসিমার জন্ম মেসোমশাইয়ের জন্ম থেকেই বল, সে যবে শেষ হয় হবে।’

গান্ধারীদি খুব মিষ্টি গলায় শান্ত স্বরে বললে, ‘শোন দিদি, তোমার গুণের কোনও তুলনা নেই। কিন্তু তোমার একটাই দোষ। কথায় কথায় বড় রেগে যাও। আমি কি অতটা গোড়া থেকে বলবো বলেছি? আমার কি বুদ্ধিশুদ্ধি নেই! তাহলে তো মার সঙ্গে বাবার বিয়ে দিয়ে শুরু করতে হয়! তুমিই বল যেটা আগে সেটা আগের। যেটা পরে সেটা পরের। আমার বাবা বলত, গাঁদু আগে অ বলবি, তারপর আ বলবি তারপরে হ্রস্বই।’

মাসিমা বললেন, ‘তারপরে দীর্ঘ-ই বলবি, তারপরে হ্রস্ব-উ বলবি, তারপরে দীর্ঘ-উ বলবি তারপর…’ মাসিমা ক্ষেপে গিয়ে বলতে লাগলেন, ‘ঋ, ৯, ও, ঔ তারপরে ক, খ, গ, ঘ। তারপরে দ্বিতীয় ভাগ তার পরে নব ধারাপাত!’

গান্ধারীদি বললেন, ‘ওই দেখ, আমি একটা উপমা দিলুম, তুমি কিনা রেগে গিয়ে বর্ণপরিচয় পড়তে লাগলে! আমার মা কি বলত জানো? মানুষ রাগে অন্ধ হয়ে যায়, অন্ধ! আমার বাবার ডান পা-টা কি করে ভেঙে ছিল জানো? রেগে গিয়ে।’

আমি মেঝের একপাশে বসে পড়েছি। থাক অঙ্ক মাসিমার সঙ্গে গান্ধারীদির লাগলে সে যে কোথায় গিয়ে শেষ হবে!

মাসিমা বললেন, ‘রেগে গিয়ে নিজের পা-টা দুমড়ে মটাস করে ভেঙে ফেললে!’

গান্ধারীদি বললে, ‘আরে না গো সে এক কাণ্ড। শোন না! আমার বাবা যে কী রকম রাগী ছিল সে তুমি না বললে বুঝতে পারবে না। মা বলেই বিয়ে করেছিল আমি হলে করতুম মা।’

মাসিমা বললেন, ‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ! বাবাকে কেউ বিয়ে করে!’

গান্ধারীদি বললে, ‘দিদি তুমি সবই বোঝ কিন্তু বড় লেটে। দাঁড়াও তোমাকে বোঝাই। ধর আমি আমার মা। এবার আমার সম্বন্ধ হল আমার বাবার সঙ্গে। না এটা তুমি বুঝবে না। আর একটু খোলসা করি। ধর আমার সম্বন্ধ হল আমার মায়ের স্বামীর সঙ্গে। কি ক্লিয়ার! খালি তুমি চরিত্রটা পাল্টে নাও। ধর গান্ধারী মা তাহলে কী হত? আমি পরিষ্কার বলে দিতুম, এ লোককে আমি বিয়ে করবো না।’

মাসিমা বললেন, ‘তার মানে তুই তোর বাবাকে ভালোবাসিস না, ঘৃণা করিস।’

গান্ধারীদি ফুঁসে উঠে বলল, ‘সে যদি বল তো তাই বল। আমার অবস্থা দেখে তুমি বুঝতে পার না—আমার বাবা কেমন ছিল?’

মাসিমা ভুরু কুঁচকে বলেন, ‘তার মানে তুই বলতে চাইছিস এই বাড়িতে তোর অবস্থা খুব খারাপ! তাকিয়ে দেখ আমার সঙ্গে তোর তফাৎ কোথায়! আমি গোটা কতক পাস করেছি, তুই করিস নি। যা তুই আমার সঙ্গে আর কথা বলবি না। তুমি তোমার মতো থাকো, আমি আমার মতো থাকি। তোর হাঁড়িতে তোর চাল ফুটবে আমার হাঁড়িতে আমার চাল।’

গান্ধারীদি কেঁদে ফেলেছে, ‘এই নাও, কি বুঝতে কি বুঝলে! তোমরা ছাড়া আমার আর কে আছে গো! আমি কি তোমাদের পর? জেনে রাখো পর করলেও পর হচ্ছি না। তুমি সেই চেষ্টাই করছ। আমি কি জানি না।’

মাসিমা বললেন, ‘আমি চেষ্টা করছি!’

গান্ধারীদি এইবার হাপুস কেঁদে বলতে লাগল, ‘তা নাহলে তুমি এমন কথা বললে কি করে তোর হাঁড়িতে তোর চাল, আমার হাঁড়িতে আমার চাল!’

মাসিমা গান্ধারীদির চোখ মোছাতে মোছাতে বললেন, ‘আমার হয়েছে পাগল আর পাগলি নিয়ে কারবার। ভাই দুটো বদ্ধ পাগল আর এই একটা পাগলি! তা বল তোর বাবার ঠ্যাং ভাঙল কি করে? না না ঠ্যাং বলাটা ঠিক হল না। তোর বাবার পা ভাঙল কি করে?’

গান্ধারীদি একটু সামলে নিয়ে শুরু করল, ‘রোজ রাত্তিরে এক রাউন্ড পেটাপেটি তো হবেই। সেদিন মা বললে তুমি আমার গায়ে হাত তুলে দেখ তোমার বাপের নাম ভুলিয়ে দেব। তার আগের দিন মা একটা হিন্দি ছবি দেখে এসেছিল। একটা বোতল ভেঙে খোঁচা মতো করে বাবাকে একবার শুধু ভয় দেখালে—আজ তোমার ভুঁড়ি ফাঁসাবো। বাবা অমনি ওরে বাবারে বলে এমন দৌড় লাগাল, দাওয়া থেকে উঠোনে। পড়বি তো পড় গর্তে! সেই মাকেই যেতে হল সদরে। পায়ে প্লাস্টার করে পড়ে রইল ন’মাস! ব্যবসা লাটে উঠল। দোকান বিক্রি হয়ে গেল। বাবা হয়ে গেল একটা জবুথবু জন্তুর মতো। তারপরে মা বিধবা হল। এই সব দেখে মা আমাকে একটা কথা বলেছিল। সেই কথাটা তোমাকেও বলে রাখি দিদি, মা বলেছিল, বুঝলি গান্ধারী হিন্দি ছবির কোমর দোলানো মেয়ে হতে যেও না। স্বামী যেমনই হোক দেবতা।’

মাসিমা বললেন, ‘তাই তুই হিন্দি ছবি দেখিস না এতদিনে বুঝতে পারলুম।’

গান্ধারীদি বললে, ‘ভালো লাগে না গো, কী সব বাজে বাজে গান। বাজে বাজে নাচ। ওরা কি আমাদের দেশের মেয়ে গো! পুরুষগুলোও ভারি বদ। খালি মদ খায় আর মারামারি করে।’

মাসিমা বললেন, ‘তুই একেবারে খাঁটি কথা বলেছিস। সব পয়সার লোভে! বল গান্ধারী টাকা ছাড়া কি পৃথিবীতে কিছু নেই!’

গান্ধারীদি বললে, ‘অ্যায় তুমি সার কথা বললে। মা আমাকে বলত, গেঁদো, উপোস করে মরবি সেও ভালো তবু চরিত্র নষ্ট করবি না।’

মাসিমা বললেন, ‘বাঃ বাঃ! এই তো এ দেশের মেয়ে! স্বামীজির ভারতবর্ষের মেয়ে! হ্যাঁরে গান্ধারী তোর মা মারা যাবার পর কি হল?’

গানধারীদি বললে, ‘আমার জন্মজন্মের যে বাবা সে তোমার ওই বড় দাদা আমাকে রেল স্টেশন থেকে তুলে নিয়ে এল গো! ছোট ছোট প্যাকেটে বাদাম বিক্রি করতুম। চুলে তেল নেই। পেটে ভাত নেই। ছেঁড়া ফ্রক। তারপর তুমি সবই তো জানো দিদি!’

মাসিমা বললেন, ‘তুই ঠিক তোর মায়ের মতো হয়েছিস। তোকে কি তোর মায়ের মতো দেখতে রে!’

গান্ধারীদি বললে, ‘ঠিকই বলেছ! একেবারে মায়ের মতো দেখতে। আমাদের যখন অবস্থা ভালো ছিল এখন আমি যেমন দেখতে আমার মাকেও ঠিক ওই রকম দেখতে। কপালে এতখানি একটা লাল টিপ। সুন্দর একটা শাড়ি। মা মন্দিরে যাচ্ছে মনে হচ্ছে যেন রাজরানি!

মাসিমা বললেন, ‘জানিস তো গান্ধারী মাঝে মাঝে আমার মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ে।’

গান্ধারীদি বললে, ‘মনের কথা মনেই রাখ দিদি মন খুলো না। সব মানুষ এখন আনমনা।’

মাসিমা বললেন, ‘বাঃ চমৎকার একটা শব্দ বললি তো—আনমনা। আনমাইন্ডফুলের বাংলা! তোর যদি বয়েসটা একটু কম হত আমি তো ডক্টরেট করাতুম।’

গান্ধারীদি বললে, ‘না বাবা আমি ডাক্তার হতে চাই না। বড়দাকে দেখে আমার শিক্ষা হয়েছে।’

মাসিমা বললেন, ‘কোথায় ডক্টরেট কোথায় ডাক্তার! এখন বল তোর মেসোমশাইয়ের কি হল?’

গান্ধারীদি বললে, ‘মেসোমশায়ের বিছানার তলায় শালপাতায় মোড়া লাল জবা, বেলপাতা, মেয়েদের মাথার বড় বড় চুল। একটা লাল কাপড়ের টুকরো। কে না কে ঢুকিয়ে রেখেছিল। মেসোমশাই উদুরি হয়ে মারা গেল।’

মাসিমা বললেন, ‘তা বেলপাতার সঙ্গে উদুরির কি সম্পর্ক!’

গান্ধারীদি বললে, ‘তুমি শহরে থাক তো তাই এসব বুঝবে না। একে বলে তুকতাক। জানো তো সম্পত্তি হল কালসাপ। না থাকা সে অনেক ভালো। যদি থাকে অশান্তির একশেষ। জানো তো আমার মেসোমশাইয়ের বড় ভাইয়ের বউ এই কাণ্ডটা করেছিল। মা বলত, ‘গেঁদো অনেক খেয়ে দুঃখে থাকার চেয়ে অল্প খেয়ে সুখে থাকা ভালো।’

মাসিমা বললেন, ‘একেবার সার কথা। আমি তো এদের বলি, ‘পূর্বপুরুষরা করে গেছেন, দেখো, তোমরা যেন ভাইয়ে ভাইয়ে অশান্তি করে পুড়িয়ে ফেল না!’

গান্ধারীদি বললে, ‘তুমি যখন চুল এলো করে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকো তখন মনে হয় তুমি এই বাড়ির জগদ্ধাত্রী।’

মাসিমা বললেন, ‘বাড়াস নি তো! এমনিই মানুষের অহঙ্কার যায় না, সেই আগুনে আর ফুঁ দিস না। এখন বল এগুলোর কি হবে!’

আমি এতক্ষণ শুনছিলুম চুপ কর। এই জগদ্ধাত্রী বলায় আমার মনে হল গান্ধারীদি ঠিকই বলেছে। মাসিমার মধ্যে কি একটা ব্যাপার আছে।

এইবার হল কি বড়মামা আমাদের নগেন কাকাকে নিয়ে হইহই করে ঘরে ঢুকে পড়ল। নগেন কাকার হাতে একটা খ্যাপলা জাল। সেই জালে অন্তত শ-খানেক নানা মাপের রুপোলি মাছ খলবল করছে! সারা ঘরে ছিরছির করে জল পড়ছে। পুকুরের কিছু শ্যাওলা আর ঝাঁজিও রয়েছে। মাসিমা এক লাফে দোলনা চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন, ‘একি একি!’

বড়মামা মুখে উদ্ভাসিত হাসি, ‘দেখ দেখ কুসি কী অসাধারণ! কী সুন্দর! তোকে দেখাবার জন্যে দৌড়ে এসেছি। পুব দিকের পুকুরে জাল ফেলা হয়েছিল তো, দুচোখ ভরে একবার দেখে নে!’

মাসিমা বললেন, ‘সত্যি বড়দা তোমার তুলনা তুমিই!’

নগেন কাকু হাসতে হাসতে বললেন, ‘জলের মাছ তাহলে জলেই ছেড়ে দিয়ে আসি দিদি।’

গান্ধারীদি বললে, ‘আমি একবার কোলে নিয়ে বসব!’

মাসিমা বললেন, ‘না নানা, সারা ঘর জলে জল তোর কাজ বাড়ল!’

গান্ধারীদি বলল, ‘তা বাড়ুক, বসার ঘরে জ্যান্ত মাছ দেখেছ কখনও?’

বড়মামা হঠাৎ মেঝের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘একি ছবির পেছন থেকে এগুলোকে কে টেনে বার করলে? কী সর্বনাশ!’

মাসিমা বললেন, ‘কেন, কে রেখেছে?’

বড়মামা বললেন, ‘আমি আমি!’

মাসিমা বললেন, ‘ওখানে রাখার কারণ?’

বড়মামা বললেন, ‘মানুষ আঙুলে আংটি পরে কেন! মঙ্গলের জন্যে। তা বাড়িটা কি দোষ করেছে! বাড়ির তো আর আঙুল নেই থাকার মধ্যে আছে দেওয়াল। সেই দেয়ালে টাচ করিয়ে সিদ্ধেশ্বরী কালিবাড়ির ফুল বেলপাতা আর মায়ের শাড়ির আঁচল রেখে দিয়েছি। কেউ মাড়ায়নি তো! যা যা ঠিক যেমন ছিল, রেখে দে, দেওয়াল টাচ করিয়ে। তোকে কে এসব নাড়াচাড়া করতে বলেছে?’

গান্ধারীদি বললে, ‘লে হালুয়া, কাল রাত্তিরেই তো তুমি বললে, তোদের প্রত্যেককে সায়েব বাড়ি ঘুরিয়ে আনা উচিত। বাড়ি কী করে এন্টারটেন করতে হয়!’

বড়মামা বললেন, ‘উঃ আবার সেই ভুল ইংরেজি! এন্টারটেন নয় এন্টারটেন নয়, মেনটেন মেনটেন।’ বলতে বলতে বড়মামা বেরিয়ে গেলেন। পেছন পেছন নগেন কাকু।

ঘরের মেঝেতে থৈ থৈ জল। সেই জলে একটা রুপোলি মাছ জাল গলে পড়ে গেছে। সেটা তিরতির করে লাফাচ্ছে। সেই দিকে তাকিয়ে গান্ধারীদি একটা অসাধারণ কথা বললে, ‘দেখ দিদি, এই বাড়ির সুখ এই বাড়ির আনন্দের মতো কী রকম মেঝেতে পড়ে আছে। পুকুরে দিয়ে আসি বলো! সুখটা আরও বড় হোক।’

শাড়ির আঁচলে মাছটা পুরে গান্ধারীদি বেরতে বেরতে বললে, ‘বিলু বিলু, আয় আয়। ও অঙ্কটঙ্ক পরে হবে। এমন সুন্দর রোদ, নীল আকাশ শরতের মেঘ। চল চল মাছ দেখি। ফড়িং দেখি। ফুল দেখি। পাখি দেখি…।’

আমার আগে আগে গান্ধারীদি ছুটছে। পেছন পেছন আমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *