1 of 2

রামস্বামীর উপল মণি

রামস্বামীর উপল মণি

[এটি একটি আশ্চর্য সত্য ঘটনা। কাহিনি যিনি বলছেন তাঁর নাম টি ডবলিউ ড্রেসার— তিনি সওদাগরি জাহাজের বেতার বিভাগের পদস্থ কর্মচারী।]

সে আজ পঁচিশ বৎসর আগের কথা।

নানা জাহাজে চাকরি নিয়ে নানা বার নানা দেশে বার বার আসা-যাওয়া করতে হয়েছে। তখন আমার বেপরোয়া উদ্দাম যৌবন, দুনিয়ার অলৌকিক কোনো কিছু শুনলে একেবারেই বিশ্বাস করতুম না। কিন্তু রামস্বামী আমার সেই বিশ্বাসের মূল আলগা করে দিয়েছে।

রামস্বামীর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল বোম্বাই শহরে গিয়ে। বারংবার দেখাসাক্ষাতে আমাদের আলাপ বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছিল। তখন তাকে দেখলে খুশি হতুম। কিন্তু এখন তার দেখা পাওয়া তো দূরের কথা, তাকে মনে পড়লেও আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হয়।

সেবার আমি এল্লারম্যান-উইলসন কোম্পানির ওথেলো জাহাজে চেপে বোম্বাই শহরে গিয়ে পৌঁছেছিলুম। রামস্বামীও জাহাজে এসে উঠল। বন্দরে যেকোনো জাহাজ এলেই সে তার উপরে উঠতে ছাড়ত না। সে জহুরি— তার ব্যবসাই ছিল রত্ন বিকিকিনি। জাহাজে জাহাজে সে খরিদ্দার সন্ধান করত।

পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছোট্টখাট্টো মানুষটি। মাথা ভরা ঘনকৃষ্ণ চুল। ফিটফাট সাদা ধবধবে পোশাক। তার কাছে সর্বদাই থাকত মোড়কে মোড়কে মোড়া বহুমূল্যের বা স্বল্পমূল্যের বিবিধ রত্ন বা প্রস্তর। এমন নাবিক ছিল না যে বোম্বাই শহরে গিয়েছে অথচ রামস্বামীর সঙ্গে চেনাশোনা হয়নি।

সেদিন সকাল সাড়ে দশটা। সূর্যের নিষ্ঠুর কিরণে চারিদিক উত্তপ্ত। নিজের কামরায় শুয়ে একখানা ডিটেকটিভ গল্পের বই পড়ছি এমন সময় দরজার ওপরে করাঘাত।

বেরিয়ে দেখি, রামস্বামী। একমুখ হেসে বললে, ‘কিছু কিনবেন?’ বলেই পকেট থেকে বার করে ফেললেন গোটাকয়েক মোড়ক।

বললুম, ‘যা কেনবার আগেই কিনেছি, আজ আর কিছু নয়।’

‘বেশ, তাই সই। তবে একটা অনুরোধ। একখানা কাগজ দিতে পারেন?’

প্যাড থেকে একখানা কাগজ টেনে নিয়ে তাকে দিলুম।

আমার সামনে তিনটে মোড়ক রেখে দিয়ে, একটা ময়লা ও কিছু কিছু ছেঁড়া মোড়ক নিয়ে রামস্বামী আমার দেওয়া কাগজখানার ওপরে উপুড় করে ধরলে, ঝর ঝর করে ঝরে পড়ল একরাশ টুকরো টুকরো হিরা— গুনতিতে শ-খানেকের কম নয়!

আমার দিকে পিছন ফিরে সে হিরেগুলো বেছে বেছে গুছিয়ে রাখতে লাগল।

আমি একটা মোড়ক কৌতূহলী হয়ে খুলে ফেললুম। ভিতরে রয়েছে তিনখানা চমৎকার উপল মণি (opal)। তার মধ্যে বিশেষ করে একখানা হচ্ছে যারপরনাই অপূর্ব! উপলের তেমন বর্ণবৈচিত্র আর কখনো দেখিনি।

মনে এমন দুর্মতি জাগল যে কিছুতেই লোভ সামলাতে পারলুম না, উপলখানা সরিয়ে ফেললুম— জীবনে সেই-ই আমার প্রথম এবং শেষ চুরি।

কিছুই আন্দাজ করতে না পেরে রামস্বামী তার মালপত্তর নিয়ে বিদায় গ্রহণ করলে— আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম।

পরদিনই আমাদের জাহাজ বোম্বাই ছাড়ল।

পর পর সাত সপ্তাহ কেটে গেল সমুদ্রের ওপরেই। প্রতিদিনই মুগ্ধ চোখে উপলখানা দেখি আর নাড়াচাড়া করি। তারপর বিলাতে ফিরে উপলখানা মাকে উপহার দিলুম। মা সেখানা পদকের মতো কণ্ঠদেশে ধারণ করলেন।

কিছুদিন পরেই রামস্বামীর কাছ থেকে একখানা টেলিগ্রাম পেলুম। সে লিখেছে ‘সাহেব, দয়া করে উপলখানা ডাকে ফেরত পাঠাও। নইলে তোমার অনিষ্ট হবে।’

মনে মনে ভীত হয়েও আমি দোষ মানলুম না। জবাবে জানালুম, ‘উপল আমি পাইনি। এটা তোমার মনের ভুল।’

উত্তরে আর কোনো তার এল না দেখে আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম।

কিছুদিন পরে আমাদের জাহাজ আবার আলেকজান্দ্রিয়া, সুয়েজ ও এডেন হয়ে বোম্বাই বন্দরে গিয়ে নোঙর ফেললে। তার পরদিনই যা ভয় করছিলুম, তাই!

বেলা তখন দশটা। আমার কামরায় করাঘাত!

কম্পিত স্বরে বললুম, ‘ভেতরে এসো।’

রামস্বামী ঘরে ঢুকল। তার চেহারা দেখে আমার চমক লাগল।

তার মাথার চুল উশকোখুশকো, তার পোশাক ময়লা, তার তামাটে ত্বকের ভিতর থেকে ফুটে উঠেছে কেমন একটা ভয়াবহ পাণ্ডুবর্ণ এবং তার চোখ দুটো বসে গিয়েছে ভেতর দিকে!

সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘রামস্বামী, কী হয়েছে তোমার?’

আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সে বললে, ‘সাহেব, দয়া করে উপলখানা ফিরিয়ে দিন। ওটা বিক্রির জন্যে নয়, ওটা আমার নিজস্ব জিনিস, ওটা না পেলে আমার মহা অমঙ্গল হবে, আর ওটা কাছে রাখলে তোমারও মঙ্গল হবে না।’

মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিয়ে প্রকাশ্যে বললুম, ‘রামস্বামী, উপলখানা আমার কাছে থাকলে আমি নিশ্চয়ই তোমাকে ফিরিয়ে দিতুম।’ এ যেন নিজের মুখেই নিজের অপরাধ স্বীকার করা হল!

পর মুহূর্তেই রামস্বামী যেন পাগল হয়ে গেল। থরহরি কম্পমান দেহে, দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে সে নিজের ভাষায় চিৎকার করে কীসব বলতে লাগল।

আমি আর সইতে পারলুম না, তাড়াতাড়ি নিজের কামরা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লুম —কিন্তু রামস্বামী তবু আমার সঙ্গ ছাড়ল না, পিছু পিছু আসতে লগল— কখনো বকতে বকতে, কখনো চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে এবং কখনো মিনতি করতে করতে। তারপর অন্য একটা ঘরে ঢুকে আমি ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলুম। অনেকক্ষণ ভেবে-চিন্তে শেষটা স্থির করলুম, এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব— রামস্বামীর জিনিস তাকেই আবার ফিরিয়ে দেব!

সেই দিনই তার বাড়ির দিকে যাত্রা করলুম, কিন্তু সেখানে গিয়ে শুনলুম বাড়ির ভিতরে কারা উচ্চস্বরে কাঁদছে। পাশেই এক দরজির দোকান। জিজ্ঞাসা করলুম, ‘এখানে এত কান্নাকাটি কীসের?’

দরজি বললে, ‘রামস্বামী মারা পড়েছে।’

আমি বললুম, ‘অসম্ভব। রামস্বামী আজ চার ঘণ্টা আগে আমার সঙ্গে দেখা করেছিল।’

দরজি বললে, ‘কী যে বল সাহেব! রামস্বামী মারা গিয়েছে কাল, চব্বিশ ঘণ্টা আগে!’

আমার মনে উঠল ঝড়— বিস্ময়ের, আতঙ্কে, অনুতাপের ঝড়!

যথাসময়ে দেশের বাড়িতে ফিরে দেখি, মায়ের গলায় উপল মণির পদকখানা নেই।

জিজ্ঞাসা করে জানলুম, মা পদকখানা খুলে গহনার বাক্সে রেখে দিয়েছিলেন, কিন্তু কিছুদিন থেকে সেখানে পাওয়া যাচ্ছে না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *