1 of 2

রামমোহনের বাড়ী নীলামে

রামমোহনের বাড়ী নিলামে 

১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে রাজা রামমোহন রায় বিলাত যাত্রা করেন। তাঁর বিলাত যাত্রার ঠিক এগারো মাস পূর্বে, তাঁর মানিকতলার বসতবাটি ও বাগান নিলাম দ্বারা বিক্রয়ের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। বিজ্ঞাপনটা বেরিয়েছিল ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দের ৯ জানুয়ারী তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায়। বিজ্ঞাপনটায় কি লেখা ছিল, তা পাঠকদের অবগতির জন্য আমি বিজ্ঞাপনটার হুবহু অনুলিপি নিচে দিচ্ছি। 

ইশতেহার 

স্থাবর ধন পাবলিক সেলে অর্থাৎ নীলামে বিক্রয় হইবেক। 

সন ১৮৩০ সালে আগামী ২১ জানুয়ারী বৃহস্পতিবার টালা কোম্পানির সাহেবরা তাহাদের নীলাম ঘরে নিচের লিখিত স্থাবর ধন পাবলিক অক্সেন অর্থাৎ নীলাম করিবেন বিশেষতঃ আপার সার্কুলার রোড শিমলার মানিকতলাস্থিত বাটী ও বাগান যাহাতে এক্ষণে বাবু রামমোহন রায় বাস করেন। ঐ বাটির উপরে তিন বড় হাল অর্থাৎ দালান, ছয় কামরা, দুই বারান্দা ও নীচের তলায় অনেক কুটরী আছে এবং ঐ বাটীর অন্তপাতি গুদাম ও বাবুর্চিখানা ও আস্তাবল প্রভৃতি আছে। 

এবং ১৫ বিঘা জমির এক বাগানে অতি উত্তম সমভূমি ও পাকা রাস্তা ও তাহাতে নানাবিধ ফলের গাছ ও তিনটা বৃহৎ পুষ্করিণী আছে। ঐ বাগানে কলিকাতার সীমার মধ্যস্থ গবর্নমেণ্ট হৌস হইতে গাড়ীতে বিশ মিনিটে পহুঁছান যায়। 

ঐ বাটি ও ভূমির চতুঃসীমা এই, বিশেষত উত্তরদিকে গদাধর মিত্রের বাগান, দক্ষিণ, দিকে সুকেশের ষ্ট্রীট নামে রাস্তা, পূর্বদিকে সার্কুলার রোড নামে সড়ক এবং পশ্চিমে ও উত্তর পশ্চিমে রূপনারায়ণ মল্লিকের বাগান। 

ঐ বাটি ও বাগান যিনি দেখিতে চাহেন তাঁহার দেখিবার কিছু বাধা নাই 

এই বিজ্ঞাপনটায় প্রযুক্ত ভাষা সম্বন্ধে কিছু টীকার প্রয়োজন আছে। সেজন্য টীকাগুলি আমি এখানে সন্নিবিষ্ট করছি। বিজ্ঞাপনে উল্লিখিত টালা কোম্পানি’ হচ্ছে সেকালের কলকাতার সবচেয়ে বড় নিলামদার সংস্থা টুলো অ্যাণ্ড কোম্পানি’, ‘হাল’ হচ্ছে ‘হলঘর ও সুকেশের ষ্ট্রীট’ হচ্ছে ‘সুকিয়া ষ্ট্রীট’ (সুকিয়া ষ্ট্রীট বর্তমান শতাব্দীর বিশের দর্শকের শেষ পর্যন্ত কর্ণওয়ালিশ ষ্ট্রীট হতে সারকুলার রোড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল)। বিজ্ঞাপনের শেষাংশ বিশেষ লক্ষণীয়, কেননা এই অংশ ইঙ্গিত করে যে রামমোহনের ইচ্ছানুসারেই এই বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। 

উদ্ধৃত বিজ্ঞাপন থেকে যে তথ্যগুলি আমরা সংগ্রহ করতে পারি তা হচ্ছে—

(১) রামমোহনের বাটি ও বাগান শিমলা মানিকতলায় আপার সারকুলার রোডে অবস্থিত ছিল। 

(২) বিজ্ঞাপন প্রকাশের সময় রামমোহন ওই বাড়িতেই বাস করতেন। 

(৩) বাড়িটি দ্বিতল ছিল, এবং এর ওপর তলায় তিনটি বড় হল, ছয়টি কামরা ও দুটি বারান্দা ছিল। বাটির নীচের তলায় অনেকগুলি ‘কুটুরি’ ছিল, কিন্তু কোনো হল ছিল এরূপ কোনো উল্লেখ নেই। 

(৪) ওই বাটির অন্তঃপাতী আরও ছিল গুদাম, বাবুর্চিখানা ও আস্তাবল প্রভৃতি। 

(৫) উক্ত বাটি ছাড়া, আরও ছিল ১৫ বিঘা জমির ওপর একটি বাগান যার মধ্যে অতি উত্তম সমভূমি ও একটি পাকা রাস্তা, নানাবিধ ফলের গাছ ও তিনটা বৃহৎ পুষ্করিণী। এখানে ‘এবং’ ও ‘ও’ শব্দের ব্যবহার কি এই ইঙ্গিত করে না যে, বাড়িখানা হতে বাগানটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল? ‘পাকা রাস্তার’ উল্লেখ দেখে মনে হয় যে যখন বাড়ি ও বাগান একত্র ছিল, তখন ওই পাকা রাস্তা দিয়েই তাঁর বাড়িতে পৌঁছাতে হত। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে রামমোহন তাঁর বসতবাটি ও বাগান নিলামে তুলেছিলেন কেন? সমসাময়িক সংবাদপত্র বা অন্য কোনো সূত্র থেকে আমরা এর কোনো হদিশ পাই না। অনুরূপভাবে সমসাময়িক সংবাদপত্রসমূহ ওই নিলামের ফলাফল সম্বন্ধে কোনো আলোকপাত করে না। রামমোহন তৎকালীন কলকাতার একজন অতি সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। কলকাতায় তাঁর একাধিক বাড়ি ছিল। একখানা বাড়ি চৌরঙ্গীতেও ছিল। সুতরাং আর্থিক কৃচ্ছতার জন্য তিনি তাঁর মানিকতলার বাড়ি ও বাগান নিলামে তোলেন নি। 

তবে কারণটা কি? 

মনে হয় সদ্য আমহার্ষ্ট ষ্ট্রীট নির্মাণের ফলে তাঁর বসতবাটি হতে, বাগানটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় তিনি মর্মাহত হয়েই বাড়িখানা নিলামে তুলতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। 

নীলামের কারণ ও ফলাফল জানা না থাকলেও উদ্ধৃত বিজ্ঞাপনটার একটা অন্য মূল্য আছে। সকলেরই জানা আছে যে, রামমোহনের বসতবাড়ি সম্বন্ধে একটা বিতর্ক আছে। আমার মনে হয় এই বিজ্ঞাপনে প্রদত্ত রামমোহনের বাড়ির বিশদ বিবরণ, সেই বিতর্কের নিষ্পত্তিতে সাহায্য করবে। ওই বর্ণনার সঙ্গে যে বাড়ির মিল আছে, সেটাই যে রামমোহনের প্রকৃত বসতবাটি, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। 

ওই বাড়ি সম্বন্ধে রামকৃষ্ণ কথামৃত’-এর তৃতীয় ভাগ প্রথম খণ্ডের প্রথম পরিচ্ছেদ বিশেষ আলোকপাত করে। ‘ ম’ লিখেছেন—‘৫ই আগস্ট ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে। গাড়ী দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়ী হইতে ছাড়িয়াছে। পোল পার হইয়া শ্যামবাজার হইয়া ক্রমে আমহার্ষ্ট ষ্ট্রীটে আসিয়াছে। ভক্তেরা বলিতেছেন, এইবার বাদুড়বাগানের কাছে আসিয়াছে। ঠাকুর বালকের ন্যায় আনন্দে গল্প করিতে করিতে আসিতেছেন। আমহার্ষ্ট ষ্ট্রীটে আসিয়া হঠাৎ তাঁহার ভাবান্তর হইল : যেন ঈশ্বরাবেশ হইবার উপক্রম। গাড়ী “রামমোহন রায়ের বাগান বাটীর কাছ দিয়া আসিতেছে। মাষ্টার ঠাকুরের ভাবান্তর দেখেন নাই; তাড়াতাড়ি বলিতেছেন, এইটী রামমোহন রায়ের বাটী। ঠাকুর বিরক্ত হইলেন; বলিলেন, এখন ও সব কথা ভাল লাগছে না। ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইতেছেন।’ সুতরাং ম রামমোহন রায়ের বাড়িখানা সম্বন্ধে নৈকট্যসূচক ‘এইটী’ শব্দের প্রয়োগ লক্ষণীয়। বাড়িটা তিনি যে আমহার্ষ্ট ষ্ট্রীটের ওপরই দেখেছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সেটাই তৎকালীন কলকাতা শহরের জনশ্রুতির প্রতিধ্বনি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *