রামকৃষ্ণ মিশন
তিন ধরনের সন্ন্যাসীর কথা স্বামীজী বলছেন, প্রমদাবাবুকে লেখা একটি চিঠিতে—”মানভিখারি, পেটবৈরাগী এবং উভয়ভ্রষ্ট।” যেসময় স্বামীজী এইসব বিচার করছেন, সেই সময়টায় তিনি ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পরিব্রাজক অবস্থা। দুটি পথের সংযোগখণ্ডে সামান্য দ্বিধান্বিত। ঠাকুরের মহাপ্রয়াণের পর যাঁরা আর ঘরে ফিরে গেলেন না, ঠাকুরের অন্তিম ইচ্ছায় বরানগরে এক পোড়ো জমিদারবাড়িতে তাঁরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছেন, গেরুয়াও ধারণ করেছেন। একটা আশ্রমের আকার অস্পষ্ট হলেও দেখা যাচ্ছে। ঠাকুরই নরেন্দ্রকে এঁদের নেতা নির্বাচন করে গেছেন। সেই মুহূর্তে নেতার মনে কোন আশ্রম-ভাবনা আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না, কারণ তাঁর অন্বেষণ সবে শুরু হয়েছে। গুরু কি চেয়েছেন? “আমার সিদ্ধাই করার জো নেই, তোর মধ্য দিয়ে আমি করব।”
আমি সমাধি চাই—বললেন শিষ্য।
তোমাকে আমি সমাধির স্বাদ দিয়েছি, ঐতেই সন্তুষ্ট থাক। চাবি রইল আমার হাতে। তোমাকে আমার কাজ করতে হবে, নরেন্দ্রনাথ-গুরু বললেন।
কাজটা কি, পরিষ্কার করে বলবেন তো! একটা আশ্রম, মন্দির, মা ভবতারিণীর প্রতিষ্ঠা। দশনামী সম্প্রদায়ের একটি আখড়া, অনেক সন্ন্যাসী, ধ্যান-জপ, ঘণ্টা, আরতি, আপনার প্রচার।
রামকৃষ্ণ অত সহজ নয় বৎস! সে যদি হতো তো নিজেই করে ফেলতাম! ওরে, আমার রসদদারের কি অভাব ছিল? রামকৃষ্ণ কে বল তো? গৃহী, সন্ন্যাসী, সমাজসংস্কারক, সমাজসেবী? দূর বোকা, ওর কোনটাই নয়। রামকৃষ্ণ হলো সময়ের সারথি। চিরকালের মানুষের চিরসখা। শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্ট করে বলেছিলেন—
“মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্যাজী মাং নমস্কুরু।
মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্ৰতিজানে প্ৰিয়োঽসি মে।।” (গীতা, ১৮।৬৫)
আমি তা বলিনি। কেন? কারণ, আমি আরো এক ধাপ এগিয়ে আছি। আমি গুরু হতে চাই না, আমি মন হতে চাই। আমার অদৃশ্য উপস্থিতি বায়ুর মতো। সংসার যত যন্ত্রণা দেবে, যত তুমি সংসার থেকে সরবে ততই আমার কাছে আসবে। আমাকে অনুভব করবে। অনুভূতি আর প্রেম, এই হলো ধর্ম। মনে নেই, তোমার প্রশ্নের উত্তরে আমি বলেছিলাম, ঈশ্বরকে দেখা যায়, এই ঠিক তোমাকে যেমন আমি দেখছি। মাইরি বলছি, তাঁকে দেখা যায়, তবে হ্যাঁ, এই নয়নে নয়—প্রেমের চোখে দেখা যায়। ভগবান যেমন অর্জুনকে বলেছিলেন, তুমি নিজের প্রাকৃত স্থূল চক্ষু দ্বারা আমার প্রকৃত রূপ দেখতে পাবে না, তাই তোমাকে আমি অপ্রাকৃত জ্ঞানচক্ষু দান করছি। ঐ চোখ দিয়ে আমার অঘটন- ঘটনসামর্থ্যরূপ যোগশক্তি দর্শন কর।
“ন তু মাং শক্যসে দ্রষ্টুমনেনৈব স্বচক্ষুষা।
দিব্যং দদামি তে চক্ষুঃ পশ্য মে যোগমৈশ্বরম্।।” (গীতা, ১১।৮)
শোন নরেন্দ্রনাথ, তুমি হলে চিরযুবা। তোমার আধুনিক শিক্ষা, তোমার সংশয়, বিচার, প্রশ্ন, অস্থিরতা হলো চিরকালের যুবধর্ম। তোমার বিদ্রোহ, তোমার আঘাত, তোমার তৃষ্ণা, বিতৃষ্ণা, হতাশা আমারই পরীক্ষা, আমার ধর্মেরই পরীক্ষা। কারণ, তোমাকে অবশেষে বলতে হবে—
“তস্মাৎ প্রণম্য প্রণিধায় কায়
প্রসাদয়ে ত্বামহমীশমীড্যম্।
পিতেব পুত্রস্য সখেব সখ্যুঃ
প্রিয়ঃ প্রিয়ায়াইসি দেব সোম।।” (গীতা, ১১।৪৪)
—হে পরমপূজ্যদেব, আপনাকে দণ্ডবৎ প্রণাম করে আপনার প্রসন্নতা প্রার্থনা করছি। পিতা যেমন পুত্রের, সখা যেমন সখার, প্রিয় যেমন প্রিয়ার অপরাধ ক্ষমা করেন, আপনিও সেইরকম আমার অপরাধ ক্ষমা করুন।
তুমি অর্জুনের কথাই তোমার মতো করে বলবে—”তাঁহার জীবদ্দশায় তিনি কখনো আমার প্রার্থনা গরমঞ্জুর করেন নাই—আমার লক্ষ অপরাধ ক্ষমা করিয়াছেন—এত ভালবাসা আমার পিতামাতায় কখনো বাসেন নাই।”
তোমাকে বলতে হবে—”রামকৃষ্ণের জুড়ি আর নেই, সে অপূর্ব সিদ্ধি, আর সে অপূর্ব অহেতুকী দয়া, সে Intense sympathy বদ্ধ জীবনের জন্য— এজগতে আর নাই।”
সিমপ্যাথি সব ‘প্যাথি’র ঊর্ধ্বে। একথা যখন মেনেছ তখন বিশ্বকে তুমি সেই ‘রামকৃষ্ণ ধর্ম’ই দাও। এতে নতুন কিছু নেই। এ বহুদিনের শবসাধনার শব, শুধুমাত্র রামকৃষ্ণতন্ত্রে জেগে উঠে সব সাধনার সঙ্গমে পরিণত হয়েছে। তুমি সেই তন্ত্রের তান্ত্রিক। তোমার পথে গোলাপ বিছাইনি আমি। জীবের দুঃখের, দিশাহীনতার কণ্টকে আস্তীর্ণ। তুমি দারিদ্র্য সহ্য করে দরিদ্রের বন্ধু হবে, ধর্মের মূঢ়তা দেখে প্রকৃত ধার্মিক হবে, দিশাহারা হয়ে দিশা খুঁজে পাবে, শত্রুতা সহ্য করে তুমি চিরমিত্র হবে। ধর্ম প্রসাধন নয়, ধর্ম সাধন। ভিতর থেকে ফুটবে। কাগজের ফুল নয়, কুঁড়ির আবেগে ফোটা ফুল।
আমি তোমাকে সমাধিতে থাকতে দিইনি। দিতে কি পারতাম না নরেন? শালা, আমি কি ঢ্যামনা সাপ? আমি জাত গোখরো। সবচেয়ে বড় বস্তু তোমাকে দিয়েছি, যা তোমাদের ষোলজনের আর কাউকে আমি দিতে পারিনি। বজ্র ধরতে গেলে আধার চাই! আমি তোমার আধারে ঢেলে দিয়েছি শাশ্বত সেই প্রার্থনার প্রার্থিত বস্তু—যাতে তুমি বলতে পার চাবুকের শক্তিতে—
“তেজোহসি তেজো ময়ি ধেহি। বীর্যমসি বীর্যং ময়ি ধেহি।
বলমসি বলং ময়ি ধেহি। ওজোহস্যোজো ময়ি ধেহি।
মন্যুরসি মন্যুং ময়ি ধেহি। সহোহসি সহো ময়ি ধেহি।।” (বাজসনেয় সংহিতা, ১৯।৯)
আমি তোমাকে সচেতন করেছিলাম এই বলে, গুরুগিরি আর বেশ্যাগিরিতে কোন পার্থক্য নেই। একথাও বলেছিলাম, হেগো গুরুর পেদো শিষ্য। তোমাকে বলেছিলাম, যে-সে লোক গুরু হতে পারে না। বাহাদুরি কাঠ নিজেও ভেসে চলে যায়, অনেক জীবজন্তুও চড়ে যেতে পারে। হাভাতে কাঠের ওপর চড়লে কাঠও ডুবে যায়, যে চড়ে সেও ডুবে যায়! তাই ঈশ্বর যুগে যুগে লোকশিক্ষার জন্য নিজে গুরুরূপে অবতীর্ণ হন। সচ্চিদানন্দই গুরু।
আমি গুরু কেন হতে যাব! আমি শ্রীকৃষ্ণের মতো সখা। বলিনি—যে রাম, যে কৃষ্ণ, ইদানীং সে-ই রামকৃষ্ণ? রামের সত্যনিষ্ঠা, রামের আদর্শ, কৃষ্ণের পরিচালনা ও সখাপ্রীতি, দূরদর্শিতা, জ্ঞান—এইসব মিলিয়ে যে-আধার তার নাম শ্রীরামকৃষ্ণ। আমি ‘জয় গুরু’ মার্কা গুরু নই। সেরকম হলে নরেন্দ্রনাথ ‘বিবেকানন্দ’ হতো না। তোমার দ্বিধাতে আমার প্রকৃত প্রকাশ—”হয় তিনি অবতার—যেমন তিনি নিজে বলিতেন, অথবা বেদান্তদর্শনে যাঁহাকে নিত্যসিদ্ধ মহাপুরুষ ‘লোকহিতায় মুক্তোঽপি শরীরগ্রহণকারী’ বলা হইয়াছে।”
তুমি আমার মতোই স্বীকার করেছ—”ধর্ম দলে নহে, হুজুগে নহে।” ভারতটাকে চক্কর মেরে দেখে এলে কিসের আবেগে! বরানগরে তোমাদের আখড়া, একটা ছবি, তোমাদের আত্মারামের কৌটো, সভা, মিছিল, চাঁদা সংগ্রহ, চূড়াওলা মন্দির, মোহান্ত, প্রণামী! রামকৃষ্ণ লোপাট! কে মনে রাখত স্বামী বিবেকানন্দকে—যদি আগুন না জ্বলত, যদি হৃদয় না কাঁদত, যদি মহাক্রোধে ফেটে না পড়ত; সব নস্যাৎ করে, তাই না গর্জন করে বলেছিলে-
“আর তোমরা কি করছ? সারা জীবন কেবল বাজে বকছ। এস, এদের (জাপান, চীন) দেখে যাও, তারপর যাও—গিয়ে লজ্জায় মুখ লুকোও গে। ভারতের যেন জরাজীর্ণ অবস্থা হয়ে ভীমরতি ধরেছে! তোমরা দেশ ছেড়ে বাইরে গেলে তোমাদের জাত যায়!! এই হাজার বছরের ক্রমবর্ধমান জমাট কুসংস্কারের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে বসে আছ, হাজার হাজার বছর ধরে খাদ্যাখাদ্যের শুদ্ধাশুদ্ধতা বিচার করে শক্তিক্ষয় করছ! পৌরোহিত্যরূপ আহাম্মকির গভীর ঘূর্ণিতে ঘুরপাক খাচ্ছ! শত শত যুগের অবিরাম সামাজিক অত্যাচারে তোমাদের সব মনুষ্যত্বটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে—তোমরা কি বলো দেখি? আর তোমরা এখন করছই বা কি? আহাম্মক, তোমরা বই হাতে করে সমুদ্রের ধারে পায়চারি করছ। ইউরোপীয় মস্তিষ্কপ্রসূত কোন তত্ত্বের এক কণামাত্র—তাও খাঁটি জিনিস নয়—সেই চিন্তার বদহজম খানিকটা ক্রমাগত আওড়াচ্ছ, আর তোমাদের প্রাণমন সেই ৩০ টাকার কেরানিগিরির দিকে পড়ে রয়েছে; নাহয় খুব জোর একটা দুষ্ট উকিল হবার মতলব করছ! ইহাই ভারতীয় যুবকগণের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষা। আবার প্রত্যেক ছাত্রের আশেপাশে একপাল ছেলে—তাঁর বংশধরগণ—’বাবা খাবার দাও, খাবার দাও’ করে উচ্চ চিৎকার তুলেছে!! বলি, সমুদ্রে কি জলের অভাব হয়েছে যে, তোমাদের বই, গাউন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা প্রভৃতি সমেত তোমাদের ডুবিয়ে ফেলতে পারে না?”
কালের পথে সরে এসে স্বামীজীকে আমরা এখন সম্পূর্ণরূপে দেখতে পাচ্ছি। কী আগুন! জীবন ছেড়ে জ্যোতিঃ হয়ে আমাদের জগৎ-পরিমণ্ডলে ভেসে আছেন। কখনো মনে হয় কাঁদি, যেমন শরশয্যায় শায়িত পিতামহকে ঘিরে আঁধার কুরুক্ষেত্রে সপার্ষদ শ্রীকৃষ্ণ অশ্রুমোচন করেছিলেন। কখনো মনে হয় বিবেকাগ্নিতে লোহাটাকে পুড়িয়ে ইস্পাত করি। কখনো মনে হয়, তাঁর মতো ‘ইমিটেশন অফ ক্রাইস্ট’ থেকে বলি— “For we have taken up the cross, Thou hast laid it upon us, and grant us strength that we bear it unto death. Amen!’
ধর্মের ইতিহাসে পূর্বে এমনটি আর কখনো ঘটেনি। গুরু-শিষ্যের এই সমন্বয়! জাগতিকভাবে, সোস্যাল স্ট্যাটাস অনুসারে দুজনের অবস্থান দুই মেরুতে। একজন দূর গণ্ডগ্রামের ধর্মযাজী ব্রাহ্মণসন্তান। আধুনিক শিক্ষা থেকে দূরে। পরে মন্দিরের বেশকার, কিছুকাল পূজারী, অতঃপর ‘বিজ্ঞানী’। তারপর বিদ্রোহী। অবশেষে তোপ, কামান-সমন্বিত এক ফিল্ড মার্শাল। যে আসে সে উড়ে যায়। অতঃপর বিশ্বপ্লাবী এক প্রবাহ। সেই প্রবাহে পণ্ডিত, প্রবক্তা, তার্কিক—সব ভেসে চলে গেল এঁটো পাতার মতো।
অন্যজন খাস কলকাতার ধনী-বাড়ির সন্তান। সুদেহী। শিক্ষিত, সুরূপ, সর্বগুণান্বিত। এলাইট। এইবার, এস তুমি নরেন্দ্র। একটা সেতু তৈরি করি। একটা ‘ফিউশন’। তোমার ঘরে রামকৃষ্ণ। মানে আশি শতাংশ ভারতের অনুপ্রবেশ। কলকাতার খোল ভাঙা—এইটাকেই আমি বলতে চাই ঠাকুরের ‘হাটে হাঁড়ি ভাঙা।’ নিজেকে ‘আমি অবতার’ বলে আত্মপ্রচার করার মতো সঙ্কীর্ণ তিনি ছিলেন না। বরং তাঁর সংশয় ছিল—”আমি কে বল তো!” নরেন্দ্রকে ভাঙা মানে চিরকালের যুবশক্তির মোহ ভাঙা, সঙ্কীর্ণতা, আচ্ছন্নতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, দিশাহীনতা ভাঙা। কথা পরে, তর্ক পরে, বেদবেদান্ত পরে। আগে কাজ, আগে উপলব্ধি, আগে সহমর্মিতা, আগে বীরের চোখে জল। পরে দেখা যাবে ঈশ্বর কোথায়, কোন্ তালুকে তাঁর বসবাস, কোন্ বীজমন্ত্রে দেউড়ি খুলবে।
“বাগ্বৈখরী শব্দঝরী শাস্ত্রব্যাখ্যানকৌশলম্।
বৈদষ্যং বিদুষাং তদ্বভুক্তয়ে ন তু মুক্তয়ে।। (বিবেকচূড়ামণি, ৫৮)
যা করেন সবাই—বাগ্বৈখরী, বাক্যবিন্যাস, শব্দচ্ছটা—ওসব ভাঁওতা, শাস্ত্রব্যাখ্যার কৌশলমাত্র। পণ্ডিতদের পাণ্ডিত্য-প্রকর্ষ শুধু ভোগের জন্য, মুক্তির জন্য নয়। কে বলছেন! স্বয়ং শঙ্করাচার্য। তিনি দুটোই দেখেছিলেন—প্রচলিত ধর্ম ও ভূমি-সংলগ্ন জীবন।
স্বামীজী দুঃখ করে প্রমদাবাবুকে লিখছেন পরিব্রাজক অবস্থায়—”কিন্তু এবার অন্যপ্রকার রোগ। ঈশ্বরের মঙ্গলহস্তে বিশ্বাস আমার যায় নাই এবং যাইবারও নহে—শাস্ত্রে বিশ্বাসও টলে নাই। কিন্তু ভগবানের ইচ্ছায় গত ৫।৭ বৎসর আমার জীবন ক্রমাগত নানাপ্রকার বিঘ্নবাধার সহিত সংগ্রামে পরিপূর্ণ। আমি আদর্শ শাস্ত্ৰ পাইয়াছি, আদর্শ মনুষ্য চক্ষে দেখিয়াছি, অথচ পূর্ণভাবে নিজে কিছু করিয়া উঠিতে পারিতেছি না, ইহাই অত্যন্ত কষ্ট; বিশেষ, কলিকাতার নিকট থাকিলে হইবারও কোন উপায় দেখি না। আমার মাতা এবং দুইটি ভ্রাতা কলিকাতায় থাকে। আমি জ্যেষ্ঠ, মধ্যমটি এইবার ফার্স্ট আর্টস পড়িতেছে, আরেকটি ছোট।… ইঁহাদের অবস্থা পূর্বে অনেক ভাল ছিল, কিন্তু আমার পিতার মৃত্যু পর্যন্ত বড়ই দুঃস্থ, এমনকি কখনো কখনো উপবাসে দিন যায়।”
এই তো তোমার ‘ক্রস’ নরেন। ছিলে কলকাতার বড়লোক। বাগ্বৈখরী শব্দঝরীদের দলে। চুরমার করেছি। জান না ভগবানের ইচ্ছে। এখন লিখছ : “এবার তাঁহাদের মকদ্দমা শেষ হইয়াছে। কিছুদিন কলিকাতায় থাকিয়া, তাঁহাদের সমস্ত মিটাইয়া এদেশ হইতে চিরদিনের মতো বিদায় হইতে পারি, আপনি আশীর্বাদ করুন।”
“আপূর্যমানমচলপ্রতিষ্ঠং সমুদ্রমাপঃ প্রবিশন্তি যদ্বৎ।
তদ্বৎ কামা যং প্রবিশন্তি সর্বে স শান্তিমাপ্নোতি ন কামকামী।।” (গীতা, ২।৭০)
প্রমদাবাবুকে যা লিখছিলে, ভাবলাম, আমার নরেন বুঝি এন. আর. আই. হয়ে আমেরিকায় দর্শনের অধ্যাপক হতে চলেছে! না, অচলপ্রতিষ্ঠং, ব্রহ্মপ্রতিষ্ঠ পুরুষ হতে চাইছে! অজ্ঞ ব্যক্তির কাম্য শব্দাদিবিষয়সমূহ যত আসে আসুক, সমুদ্রে সব নদী যত জল ওগরায় ওগরাক, সমুদ্র কখনো বেলাভূমি লঙ্ঘন করে না। যদি ধর—বিষয় অশান্তি। যদি ছাড়—বিষয় শান্তি। তাই তুমি বলতে শিখেছ—”তাঁহাদের মামলা, তাঁহাদের দুঃখ।” তাই বলতে পারলে— “আদর্শ শাস্ত্র আমি পাইয়াছি, আদর্শ মনুষ্য চক্ষে দেখিয়াছি।” এই দুয়ের মিলনে তুমিই গড়বে সেই সঙ্ঘ
পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথ কি এই সঙ্ঘের কথাই বলেননি?
“অন্নহারা গৃহহারা চায় ঊর্ধ্বপানে,
ডাকে ভগবানে।
যে-দেশে সে ভগবান মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে
সাড়া দেন বীর্যরূপে দুঃখে কষ্টে ভয়ে
সে-দেশের দৈন্য হবে ক্ষয়।
হবে তার জয়।”
তোমার বীরের ভাষায়, তুমি লিখবে :
“ব্রহ্ম হতে কীট-পরমাণু, সর্বভূতে সেই প্ৰেমময়,
মন প্রাণ শরীর অর্পণ কর সখে, এ সবার পায়।
বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।”
ধর আমি, যে-আমি অশিক্ষিত, আর তুমি—তুমি শিক্ষিত। তুমি দেখলে কি? জ্ঞান ভিতরে থাকে। ‘পাওয়ার হাউসে’ গিয়ে বসতে পারলে সমস্ত ‘সার্কিট’-এই সহজে যাওয়া যায়। পুঁথির বিদ্যায় চাকরি মেলে। আত্মজ্ঞানে শাস্ত্রের চোখ খোলে। শ্বাস ফেলে, নড়ে চড়ে।
আর তুমি কি দেখলে? দারিদ্র্যের দুঃখ। কি পেলে? দরিদ্রের ঈশ্বর অন্ন। বলেছিলাম, কলিতে অন্নগত প্রাণ। শাস্ত্র, লেকচার, নৃত্য, ভাগবতে পেটের জ্বালা কমবে না। সৎকর্মই কলির ধর্ম। তাই তুমি বলতে পারলে—”আমার মহাভয় শশীর ঐ ঠাকুরঘর। ঠাকুরঘর মন্দ নয়, তবে ঐটি all in all করে সেই পুরনো ফ্যাসনের nonsense করে ফেলবার একটা tendency।”
তাই বলতে পারলে—”পরমহংস মশাই নরেনকে হেন বলতেন, তেন বলতেন—কেন বলতে গেলে? আর আজগুবি ফাজগুবি যত—পরমহংস মশায়ের বুঝি আর কিছুই ছিল না?… মিছামিছি কর্তাভজার দল বাঁধতে আমার ইচ্ছা নাই। I will wash my hands off you forever!”
তাহলে, তোমার হাতে যাদের দিয়ে গেলাম, যে-ভার, দায়িত্ব, নেতৃত্ব—তার পরিণতি?
শিকাগো থেকে তুমি অগ্নি-অক্ষরে লিখলে : “আমি আসছি… দুহাজার, দশ হাজার, বিশ হাজার সন্ন্যাসী চাই, মেয়ে-মদ্দ। চেলা চাই—at any risk। গৃহস্থ চেলার কাজ নয়, ত্যাগী… young educated men-not fools। হুলস্থূল বাঁধাতে হবে। জায়গায় জায়গায় centre, মেয়ে-মদ্দ যে আসে দে মাথা মুড়িয়ে, তারপর আমি আসছি। মহা spiritual tidal wave আসছে—নীচ মহৎ হয়ে যাবে, মূর্খ মহাপণ্ডিতের গুরু হয়ে যাবে তাঁর কৃপায়।… life is ever expanding, contraction is death.”
বিবেকানন্দ-প্লাবন এল। শতবর্ষের কর্মতরঙ্গে মহান ঐ রামকৃষ্ণ মিশন। বুদ্ধ দিলেন সঙ্ঘচৈতন্য, শঙ্কর দিলেন জ্ঞানতরঙ্গ, রামকৃষ্ণ দিলেন চৈতন্যদীপ, বিবেকানন্দ বিবেকরূপী সেই ‘ক্রশ’ (cross ) “ that we bear unto death. Amen!”