রামকৃষ্ণ নামের মাস্তুল
পরিবেশে চুর হয়ে আছি ঠাকুর। অহরহ দোলা দিয়ে যাচ্ছে। কোদলানো পথে গাড়ি করে গেলে যেমন হয়। লাফাচ্ছে, ঝাঁপাচ্ছে, টাল খাচ্ছে, টোল খাচ্ছে। স্থির থাকতে দিচ্ছে না। এ কেমন ভ্রমণ! কবে একটু মসৃণ পথে আমার হাওয়া-গাড়ি ফুরফুর করে চলবে? নাকি এইভাবেই সারাটা পথ চলবে?
এ-প্রশ্ন তোমার একার নয়। সব সংসারীরই এক প্রশ্ন। ঢেউ আসছে, ঠেলে তুলছে, মারছে সপাটে আছাড়। তটভূমি, সোনালী বালি খামচে ধরার চেষ্টা করছে। আর জলে নয়। অপসৃয়মান বালি আবার হড়কে ফেলে দিচ্ছে লোনা জলে। নাকানি-চুবানি। অসহায়। একরাশ ডাবের খোলার মতো দুলতে দুলতে ভাসছে একা তুমি নও, আরো সবাই। এক-একজনের এক এক নাম। এই তোমার ভবসংসার।
যতক্ষণ নিজে হাঁচড়-পাঁচড় করবে ততক্ষণ মুক্তি নেই! কারণ, মুক্তি তোমার হাতে নেই। শরীরে নেই। সক্রিয় চেষ্টায় নেই। আছে তোমার মনে। আছে তোমার প্রশ্নে ও আমার উত্তরে। যেমন, আমিও জানি, “প্রায় মেঘ ও বর্ষা লেগেই আছে, সূর্য দেখা যায় না!” এই তো সংসার। “দুঃখের ভাগই বেশি।” কেন? সে দুঃখ তোমার নিজের তৈরি। তোমার মোহ! জেনে রাখ,
‘কামকাঞ্চন-মেঘ সূর্যকে দেখতে দেয় না।” এই মেঘমুক্তির উপায় কি? কোন্ বাতাসে এই মেঘ উড়ে যাবে? তাঁর শরণাগত হও, আর ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা কর, যাতে অনুকূল হাওয়া বয়—যাতে শুভযোগ ঘটে। ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তিনি শুনবেনই শুনবেন।
অতি সহজ বিধান, আবার অতি কঠিন। কঠিনতমও বলা চলে। ব্যাকুলতা কেমন করে আসবে? আসবে ধাক্কা খেতে খেতে। আহত ক্ষত-বিক্ষত হতে হতে। তখন আপনিই মন বলবে—
“মন-মাঝি তোর বইঠা নেরে।
আমি আর বাইতে পারলাম না।।”
অসহায়বোধ থেকেই আসে আত্মসমর্পণের ইচ্ছা। যতক্ষণ ভোগ, যতক্ষণ কাম-কাঞ্চন, সংসারে আসক্তি, যতক্ষণ আস্বাদনের ইচ্ছা, আহা দেখি না একটু নেড়েচেড়ে, বিড়ালের আরশোলা ধরা, ততক্ষণ ব্যর্থ চেষ্টা। হবে না। সুতো— মনসুতো ঈশ্বর-ছুঁচে ঢুকবে না। কামনার ফেঁসো বেরিয়ে আছে। ভক্তি-লালায় মসৃণ করে নিতে হবে। সংসারী লোকেরা যখন সুখের জন্যে চারিদিকে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় আর পায় না, আর শেষে পরিশ্রান্ত হয়; যখন কাম-কাঞ্চনে আসক্ত হয়ে কেবল দুঃখ পায় তখনি বৈরাগ্য আসে, ত্যাগ আসে। ভোগ না করলে ত্যাগ অনেকের হয় না।
অনেক ছটফটানির পর হঠাৎ বিচার আসে। কি ভোগ সংসারে করবে? কাম-কাঞ্চন ভোগ? সে তো ক্ষণিক-আনন্দ—এই আছে, এই নেই। আমি বললে হবে না, নিজে পরখ করে দেখ। মনে একটা খাতা খোল। ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট বুকের মতো। একপাশে ডেবিট, আর একপাশে ক্রেডিট। যত বাতি গলে গেল, খেলা কি তত জমল? জ্বালা যত পেলে, আনন্দ কি সেই পরিমাণ হলো? বুঝতে পারছ না? তুমি অজ্ঞান। যারা অজ্ঞান, ঈশ্বরকে মানে না, অথচ সংসারে আছে, তারা যেন মাটির ঘরের ভিতর বাস করে। ক্ষীণ আলোতে ঘরের ভিতরটি দেখতে পায়। তাদের হাতে আতসকাঁচ তুলে দিয়ে লাভ কি! আতসকাচের ওপর সূর্যের কিরণ পড়লে কত জিনিস পুড়ে যায়। কিন্তু ঘরের ভিতর ছায়া, সেখানে আতসকাচ নিয়ে গেলে ওটি হয় না! ঘর ত্যাগ করে বাইরে এসে দাঁড়াতে হয়। তোমার হাতে আমি আতসকাঁচ দিয়েছি। মনের চোরকুটির ছেড়ে বেরিয়ে এস। কাম-কাঞ্চনের খুপরি পরিত্যাগ কর।
জ্ঞানের পৃথিবী বাইরে নেই। জ্ঞান দিয়ে পৃথিবী সাজাও। বাইরে থেকে ভিতরে নয়। ভিতর থেকে বাইরে যাও। নিশ্চেষ্ট হয়ে সমর্পণ কর। সে কিরকম? তাহলে শোন—
একটি পাখি জাহাজের মাস্তুলে অন্যমনস্ক হয়ে বসেছিল। জাহাজ গঙ্গার ভিতর ছিল, ক্রমে মহাসমুদ্রে এসে পড়ল। তখন পাখির চটকা ভাঙল।
ছিলে মায়ের কোলে, পিতার নিরাপদ আশ্রয়ে, জননী জাহ্নবীতে, পিতার অর্ণবপোতে, পৌগণ্ডলীলায়। হঠাৎ দেখলে কেউ নেই। সময়ের স্রোতে ভেসে গেছ মহাসমুদ্রে। তখন পাখির চটকা ভাঙল, সে দেখলে চতুর্দিকে কূলকিনারা নেই। তখন ডাঙায় ফিরে যাবার জন্যে উত্তরদিকে উড়ে গেল। অনেক দূর গিয়ে শ্রান্ত হয়ে গেল, তবু কূলকিনারা দেখতে পেল না। তখন কি করে, ফিরে এসে মাস্তুলে আবার বসল।
“পাখি পুবে গেল, পশ্চিমে গেল, পাখি দক্ষিণে গেল। অকূল পাথার! যখন দেখলে কোথাও কূলকিনারা নেই, তখন সেই যে মাস্তুলের ওপর বসল, আর উঠল না। নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে রইল।”
শরণাগত। এই শরণাগতি এলে ভবার্ণব হয়ে যাবে কৃপাসমুদ্র। সংসার- পোত হয়ে যাবে নির্ভর, নির্ভার তরণী! তখন মনে আর কোন ব্যস্তভাব বা অশান্তি রইল না। নিশ্চিত হয়েছে, আর কোন চেষ্টাও নেই।
এই তো আমার রামকৃষ্ণ নামের মাস্তুল।।