সপ্তম পরিচ্ছেদ : সমধিসংগ্রহ–জেব-উন্নিসা
এখন একবার নির্মলকুমারীকে ছাড়িয়া মোগলবীর মবারকের সংবাদ লইতে হইবে। বলিয়াছি, যাহারা রূপনগর হইতে পরাঙ্মুখ হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছিল, ঔরঙ্গজেব তাহাদিগের মধ্যে কাহাকে বা পদচ্যুত, কাহাকে বা দণ্ডিত করিয়াছিলেন। কিন্তু মবারক সে শ্রেণীভুক্ত হয়েন নাই। ঔরঙ্গজেব সকলের নিকট তাঁহার বীরত্বের কথা শুনিয়া তাঁহাকে বহাল রাখিয়াছিলেন।
জেব-উন্নিসাও সে সুখ্যাতি শুনিলেন। মনে করিলেন যে, মবারক নিজে উপযাচক হইয়া তাঁহার নিকট হাজির হইয়া সকল পরিচয় দিবে। কিন্তু মবারক আসিল না।
মবারক দরিয়াকে নিজালয়ে লইয়া আসিয়াছিল। তাহার খোজা বাঁদী নিযুক্ত করিয়া দিয়াছিল। তাহাকে এল্বাস পোষাক দিয়া সাজাইয়াছিল। যথাসাধ্য অলঙ্কারে ভূষিত করিয়াছিল। মবারক পবিত্রা পরিণীতা পত্নী লইয়া ঘরকরনা সাজাইতেছিল।
মবারক স্বেচ্ছক্রমে আসিল না দেখিয়া জেব-উন্নিসা বিশ্বাসী খোজা আসীরদ্দীনের দ্বারা তাহাকে ডাকাইলেন। তথাপি মবারক আসিল না। জেব-উন্নিসার বড় রাগ হইল। বড় হেমাকৎ-বাদশাহজাদী মেহেরবানি ফরমাইয়া ইয়াদ করিতেছেন–তবু নফর হাজির হয় না–বড় গোস্তাকী।
দিন কতক জেব-উন্নিসা রাগের উপর রহিলেন–মনে মনে বলিলেন, “আমার ত সকলই সমান |” কিন্তু জেব-উন্নিসা তখনও জানিতেন না যে, বাদশাহজাদীরও ভুল হয় যে, খোদা বাদশাহজাদীকে ও চাষার মেয়েকে এই ছাঁচেই ঢালিয়াছিলেন;-ধন দৌলত, তক্তে তাউস সকলই কর্মভোগ মাত্র, আর কোন প্রভেদ নাই।
সব সমান হয় না, জেব-উন্নিসারও সব সমান নয়। কিছু দিন রাগের উপর থাকিয়া, জেব-উন্নিসা মবারকের জন্য একটু কাতর হইলেন। মান খোওয়াইয়া–শাহজাদীর মান, নায়িকার মান, দুই খোওয়াইয়া, আবার সেই মবারককে ডাকিয়া পাঠাইলেন। মবারক বলিল, “আমার বহুৎ বহুৎ তসলিমাৎ, শাহজাদীর অপেক্ষা আমার নিকট বেশকিম্মৎ আর দুনিয়ায় কিছুই নাই। কেবল এক আছে। খোদা আছেন. “দীন্” আছে। গুনাহগারী আর আমা হইতে হইবে না। আমি আর মহালের ভিতর যাইব না–আমি দরিয়াকে ঘরে আনিয়াছি |”
উত্তর শুনিয়া জেব-উন্নিসা রাগে ফুলিয়া আটখানা হইল এবং মবারকের ও দরিয়ার নিপাতসাধন জন্য কৃতসঙ্কল্প হইল। ইহা বাদশাহী দস্তুর।
মহালমধ্যে নির্মলকুমারীর অবস্থানে, জেব-উন্নিসার এ অভিপ্রায় সাধনের কিছু সুবিধা ঘটিল। নির্মলকুমারী, ঔরঙ্গজেবের নিকট ক্রমশ: আদরের বস্তু হইয়া উঠিলেন। ইহার মধ্যে কন্দর্প ঠাকুরের কোন কারসাজি ছিল না; কাজটা সয়তানের। ঔরঙ্গজেব প্রত্যহ অবসর মত, সুখের ও আয়েশের সময়ে, “রূপনগরী নাজনীকে” ডাকিয়া কথোপকথন করিতেন। কথোপকথনের প্রধান উদ্দেশ্য, রাজসিংহের রাজকীয় অবস্থাঘটিত সংবাদ লওয়া। তবে চতুরচূড়ামণি ঔরঙ্গজেব এমন ভাবে কথাবার্তা কহিতেন যে, হঠাৎ কেহ বুঝিতে না পারে যে, তিনি যুদ্ধকালে ব্যবহার্য সংবাদ সংগ্রহ করিতেছেন। কিন্তু নির্মল ও চতুরতায় ফেলা যায় না, সে সকলই কথারই অভিপ্রায় বুঝিত এবং সকল প্রয়োজনীয় কথার মিথ্যা উত্তর দিত।
অতএব ঔরঙ্গজেব তাহার কথাবার্তায় সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হইতেন না। তিনি মনে মনে এইরূপ বিচার করিলেন,-“মেবার আমি, সৈন্যের সাগরে ডুবাইয়া দিব, তাহাতে সন্দেহই করি না–রাজসিংহের রাজ্য থাকিবে না। কিন্তু তাহাতেই আমার মান বজায় হইবে না। তাহার রূপনগরী রাণীকে না কাড়িয়া আনিতে পারিলে আমার মান বজায় হইবে না। কিন্তু রাজ্য পাইলেই যে আমি রাজমহিষীকে পাইব, এমন ভরসা করা যায় না। কেন না, রাজপুতের মেয়ে, কথায় কথায় চিতায় উঠিয়া পুড়িয়া মরে, কথায় কথায় বিষ খায়। আমার হাতে পড়িবার আগে যে শয়তানী প্রাণত্যাগ করিবে। কিন্তু এই বাঁদীটাকে যদি হস্তগত করিতে পারি–বশীভূত করিতে পারি–তবে ইহা দ্বারা তাহাকে ভুলাইয়া আনিতে পারিব না? এ বাঁদীটা কি বশীভূত হইবে না? আমি দিল্লীর বাদশাহ, আমি একটা বাঁদীকে বশীভূত করিতে পারিব না? না পারি, তবে আমার বাদশাহী নামোনাসেফ্ |”
তার পর বাদশাহের ইঙ্গিতে জেব-উন্নিসা নির্মলকুমারীকে রত্নালঙ্কারে ভূষিত করিলেন। তাঁর বেশভূষা, এল্বাস পোষাক, বেগমদিগের সঙ্গে সমান হইল। নির্মল যাহা বলিতেন, তাহা হইত; যাহা চাহিতেন, তাহা পাইতেন। কেবল বাহির হইতে পারিতেন না।
এ সব কথা লইয়া যোধপুরীর সঙ্গে নির্মলের আন্দোলন হইত। একদা হাসিয়া নির্মল , যোধপুরীকে বলিল,-
সেখানে কি পিঁজিরা সোনে কি চিড়িয়া
সোনে কি জিঞ্জির পয়ের মে,
সোনে কি চানা, সোনে কি দানা,
মট্টি কেঁও সেরেফ খয়ের মে।
যোধপুরী জিজ্ঞাসা করিল, “তুই নিস কেন?”
নির্মল বলিল, “উদয়পুরে গিয়া দেখাইব যে, মোগল বাদশাহকে ঠকাইয়া আনাইয়াছি |”
জেব-উন্নিসা ঔরঙ্গজেবের দাহিন হাত। ঔরঙ্গজেবের আদেশ পাইয়া, জেব-উন্নিসা নির্মলকে লইয়া পড়িলেন। আসল কাজটা শাহজাদীর হাতে রহিল–বাদশাহ নিজে মধুর আলাপের ভারটুকু আপন হাতে রাখিলেন। নির্মলের সঙ্গে রঙ্গ-রসিকতা করিতেন, কিন্তু তাহাও একটু বাদশাহী রকমের মাজাঘষা থাকিত–নির্মল রাগ করিতে পারিত না, কেবল উত্তর করিত, তাও মেয়েলী রকম মাজাঘষা, তবে রূপনগরের পাহাড়ের কর্কশতাশূন্য নহে। এখনকার ইংরেজী রুচির সঙ্গে ঠিক মিলিবে না বলিয়া সেই বাদশাহী রুচির উদাহরণ দিতে পারিলাম না।
জেব-উন্নিসার কাছে নির্মলের যাহা বলিবার আপত্তি নাই, তাহা সে অকপটে বলিয়াছিল। অন্যান্য কথার মধ্যে রূপনগরের যুদ্ধটা কি প্রকারে হইয়াছিল, সে কথাও পাড়িয়াছিল। নির্মল যুদ্ধের প্রথম ভাগে কিছুই দেখে নাই, কিন্তু চঞ্চলকুমারীর কাছে সে সকল কথা শুনিয়াছিল। যেমন শুনিয়াছিল, জেব-উন্নিসাকে তেমনই শুনাইল। মবারক যে মোগল সৈন্যকে ডাকিয়া চঞ্চলকুমারীর কাছে পরাভব স্বীকার করিয়া, রণজয় ত্যাগ করিতে বলিয়াছিল, তাহা বলিল; চঞ্চলকুমারীর যে রাজপুতগণের রক্ষার্থ ইচ্ছাপূর্বক দিল্লীতে আসিতে চাহিয়াছিল, তাহাও বলিল। বিষ খাইবার ভরসার কথাও বলিল; মবারক যে চঞ্চলকুমারীকে লইয়া আসিল না, তাহাও বলিল।
শুনিয়া জেব-উন্নিসা মনে মনে বলিলেন, “মবারক সাহেব! এই অস্ত্রে তোমার কাঁধ হইতে মাথা নামাইব |” উপযুক্ত অবসর পাইলে, জেব-উন্নিসা ঔরঙ্গজেবকে যুদ্ধের সেই ইতিহাস শুনাইলেন।
ঔরঙ্গজেব শুনিয়া বলিলেন, “যদি সে নফর এমন বিশ্বাসঘাতক হয়, তবে আজি সে জাহান্নামে যাইবে |” ঔরঙ্গজেব কাণ্ডটা না বুঝিলেন, তাহা নহে। জেব-উন্নিসার কুচরিত্রের কথা তিনি সর্বদাই শুনিতে পাইতেন। কতকগুলি লোক আছে, এদেশের লোক তাহাদের বর্ণনার সময় বলে, “ইহারা কুকুর মারে, কিন্তু হাঁড়ি ফেলে না |” মোগল বাদশাহেরা সেই সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। তাঁহারা কন্যা বা ভগিনীর দুশ্চরিত্র জানিতে পারিলে কন্যা কি ভগিনীকে কিছু বলিতেন না, কিন্তু যে ব্যক্তি কন্যা বা ভগিনীর অনুগৃহীত, তাহার ঠিকানা পাইলেই কোন ছলে কৌশলে তাহার নিপাত সাধন করিতেন। ঔরঙ্গজেব অনেক দিন হইতে মবারককে জেব-উন্নিসার প্রীতিভাজন বলিয়া সন্দেহ করিয়া আসিতেছিলেন, কিন্তু এ পর্যন্ত ঠিক বুঝিতে পারেন নাই। এখন কন্যার কথায় ঠিক বুঝিলেন, বুঝি কলহ ঘটিয়াছে, তাই বাদশাহজাদী, যে পিপীলিকা তাঁহাকে দংশন করিয়াছে, তাহাকে টিপিয়া মারিতে চাহিতেছেন। ঔরঙ্গজেব তাহাতে খুব সম্মত। কিন্তু একবার নির্মলের নিজমুখে এ সকল কথা বাদশাহের শুনা কর্তব্য বোধে, তিনি নির্মলকে ডাকাইলেন। ভিতরের কথা নির্মল কিছু জানে না বা বুঝিল না, সকল কথাই ঠিক বলিল।
যথাবিহিত সময়ে বখশীকে তলব করিয়া, বাদশাহ মবারকের সম্বন্ধে আজ্ঞাপ্রচার করিলেন। বখশীর আজ্ঞা পাইয়া আট জন আহদী গিয়া মবারককে ধরিয়া আনিয়া বখশীর নিকট হাজির করিল। মবারক হাসিতে হাসিতে বখ্শীর নিকট উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, বখশীর সম্মুখে দুইটি লৌহপিঞ্জর। তন্মধ্যে এক একটি বিষধর সর্প গর্জন করিতেছে।
এখনকার দিনে যে রাজদণ্ডে প্রাণ হারায়, তাহাকে ফাঁসি যাইতে হয়, অন্য প্রকার রাজকীয় বধোপয় প্রচলিত নাই। মোগলদিগের রাজ্যে এরূপ অনেক প্রকার বধোপায় প্রচলিত ছিল। কাহারও মস্তকচ্ছেদ হইত; কেহ শূলে যাইত; কেহ হস্তিপদতলে নিক্ষিপ্ত হইত; কেহ বা বিষধর সর্পের দংশনে প্রাণত্যাগ করিত। যাহাকে গোপনে বধ করিতে হইবে, তাহার প্রতি বিষপ্রয়োগ হইত।
মবারক সহাস্যবধনে বখশীর কাছে উপস্থিত হইয়া এবং দুই পাশে দুইটি বিষধর সর্পের পিঞ্জর দেখিয়া কর্তব্যবৎ হাসিয়া বলিল, “কি? আমায় যাইতে হইবে?”
বখশী বিষণ্ণভাবে বলিল, “বাদশাহের হুকুম!”
মবারক জিজ্ঞাসা করিল, “কেন এ হুকুম হইল, কিছু প্রকাশ পাইয়াছে কি?”
ব। না–আপনি কিছু জানেন না?
ম। এক রকম–আন্দাজী আন্দাজী। বিলম্বে কাজ কি?
ব। কিছু না।
তখন মবারক জুতা খুলিয়া একটা পিঞ্জরের উপর পা দিলেন। সর্প গজাইয়া আসিয়া পিঁজরার ছিদ্রমধ্য হইতে দংশন করিল।
দংশনজ্বালায় মবারক একটু মুখ বিকৃত করিলেন। বখশীকে বলিলেন, “সাহেব! যদি কেহ জিজ্ঞাসা করে যে, মবারক কেন মরিল, তখন মেহেরবানি করিয়া বলিলেন, “শাহজাদী আলম্ জেব-উন্নিসা বেগম সাহেবার ইচ্ছা |”
বখশী সভয়ে, অতি কাতরভাবে বলিলেন, “চুপ! চুপ! এটাও |”
যদি একটা সাপের বিষ না থাকে, এজন্য দুইটা সর্পের দ্বারা হন্য ব্যক্তিকে দংশন করান রীতি ছিল। মবারক তাহা জানিতেন। তিনি দ্বিতীয় পিঞ্জরের উপর পা রাখিলেন, দ্বিতীয় মহাসর্পও তাঁহাকে দংশন করিয়া তীক্ষ্ণ বিষ ঢালিয়া দিল।
মবারক তখন বিষের জ্বালায় জর্জ্জরীভূত ও নীলকান্তি হইয়া, ভূমে জানু পাতিয়া বসিয়া যুক্তকরে ডাকিতে লাগিল, “আল্লা আকবর! যদি কখনও তোমার দয়া পাইবার যোগ্য কার্য করিয়া থাকি, তবে এই সময়ে দয়া কর |”
এইরূপে জগদীশ্বরের ধ্যান করিতে করিতে, তীব্র সর্পবিষে জর্জরীভূত হইয়া, মোগলবীর মবারক আলি প্রাণত্যাগ করিল।