৯৯
পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়ায়েছি মনোবীজ, আহা,
আকাঙ্ক্ষার নিঃসঙ্গ সন্তান;
অথবা ঘাসের দেহে শুয়ে শুয়ে কুয়াশায়
শুনেছি ঝরিতে আছে ধান;
অথবা সন্ধ্যার নীল জানালায়
অদৃশ্য কোকিল এসে গায়
এইসব বেদনার কর্কশ-রেডিয়ামে সারেনাকো’ তাহা ॥
.
সমগ্র চৈত্র-বৈশাখ মাস গ্রামে-গ্রামে ঘুরে বেরিয়েছে সে। সকল ভ্রমণের মধ্যে সে এমনকী গিয়েছে ভগবানগোলার পঞ্চবুধুরি শ্রীপাটে। সেখানে ময়না বৈষ্ণবীকে স্মরণ করেছেন বহুজন। তার সুখ্যাতি করেছেন। কত পরিশ্রমী ছিল সে, কতখানি ঈশ্বরানুগত প্রাণ, প্রেমময় হৃদয়ের অনুভবে সিক্ত করে গাইত যে-গান সে, তা শ্রীপাটের বাতাসে আজও ভেসে বেড়ায়। তার গাঁথা মালাগুলি, সে-ও ছিল বিস্ময় এক প্রকার। কতই সৌন্দর্য ছিল তাতে! কতই বৈচিত্র! এমনকী বৃদ্ধ কৃষ্ণপাদ প্রভুজি মহারাজ তাকে স্মরণ করে অশ্রুময় হয়েছেন। বলেছেন— মহাপ্রভু গোপীদাসের সুযোগ্য ধর্মিণী ছিল সে। এমনকী ভগবতীর অংশে যে জন্ম হয়েছিল তার, এ বিষয়ে কোনও সংশয় তাঁর নেই এখন।
তিনি আক্ষেপ করেছেন। ময়না বৈষ্ণবীর দ্বারা শ্রীপাট আরও অনেক সমৃদ্ধ হতে পারত। হল না যে, সে ক্ষতি পূরণ হবার নয়।
সিদ্ধার্থ ঘুরে ঘুরে দেখেছে শ্রীপাট। খুঁজেছে ময়না বৈষ্ণবীর হৃদয়ে মহাশক্তির উৎস। এমনকী সে চলে গিয়েছিল বাঁশুলি গ্রামে। সেখানে তার কাজের মাঝে সে দেখে নিয়েছিল ময়না বৈষ্ণবীর ভিটে। বাঁশুলি গ্রামে যাবার সময় দুলু বাউলকে নিয়েছিল। সে যা প্রত্যাশা করেছিল, ঘটেছে তেমনই। বৈরাগী ঠাকুর বৈষ্ণবীর ভিটে হতে মাটি তুলে জিভে ঠেকিয়েছে। কপালে ঠেকিয়েছে। কিছু তুলে নিয়েছে ঝুলিতে। তার চোখমুখ তখন ছিল এমন যেন বৈষ্ণবীকেই সে স্পর্শ করছে অনায়াসে। বৈরাগী ঠাকুর ছাড়াও তৌফিক সঙ্গে ছিল তার। যদিও সে তৌফিককে দিয়েছিল সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদার স্বাধীনতা
তার দলত্যাগের সিদ্ধান্ত জানাবার পর তৌফিক স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার সরল মুখাবয়বে তৈরি হয়েছিল ভ্রূকুটি জটিল। বেশ কিছুক্ষণ নির্বাক থাকার পরে বলেছিল—আমি জানি, তুমি সমস্ত পরিণতির কথা ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছ। তবু, জানতে চাইছি সিধুদা, এরপর?
সে জিগ্যেস করে—এরপর কী!
—তোমার এত পরিকল্পনা, এত কাজ, এসবের কী হবে?
—করব। করতে হবে।
—সি পি আই এম এক বিরাট সংগঠিত দল। এ রাজ্যে ওদের ক্ষমতার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই তুমি জানো। ওদের কাছ থেকে তোমার কাজের কোনও সাহায্য বা সমর্থন তুমি আশা করো?
—ধরে নিলাম, পাবো না। তা হলে কি সেই অপ্রাপ্তির ভয়ে আমি সিদ্ধান্ত বদলাব? এমনও হতে পারত, দল থেকে আমিই বহিষ্কৃত হলাম। সে ক্ষেত্রে ওই বহিষ্কারই কি আমার সব কাজের ইতি টেনে দিত? আমি কি থেমে যেতাম?
তৌফিক জবাব দেয়নি। দুর্ভাবনায় তার মুখে লালচে আভা ফুটেছিল। আঙুল দিয়ে মাথার চুলগুলিকে এলোমেলো করে দিচ্ছিল সে বারংবার। তার শরীরী ভাষায় প্রকাশিত হয়ে পড়ছিল অসীম মানসিক অস্থিরতা।
এই অস্থিরতাকে চেনে সিদ্ধার্থ। চরম সিদ্ধান্ত নেবার আগে সে আক্রান্ত হয়েছিল এমনই। কিন্তু এখন সে শান্ত। আগামীর চিত্র সম্পূর্ণ অন্ধকারে তার। তবু সে শমে থাকতে পারছিল। এ এক এমন সময়, যখন তার পায়ের তলায় চেনা পথ ফুরিয়েছে। সম্মুখে দুর্গম গিরি কান্তার মরু-প্রান্তর। চলতে হলে, পথ করে নিতে হবে। সময়সাপেক্ষ সে কাজ। আয়াসসাধ্য। কিন্তু অসম্ভব নয়। মানুষের ইতিহাসে স্পার্টাকাস তা প্রমাণ করে গেছে।
সে তৌফিককে বলে—প্রকৃতপক্ষে দল আমি ছাড়িনি তৌফিক। আমি ছেড়েছি দলের মধ্যেকার অপরিচ্ছন্নতাকে। দল তো মানব-চরিত্রের মতোই। তারও মধ্যে আমরা আশা করি সততা, ন্যায়, সত্যপরায়ণতা, সহিষ্ণুতা এবং প্রেম প্রীতি ভালবাসার পরিচয়। যখন এগুলির বিপরীতে ভরে যায় সমস্ত লক্ষণ, তখন সমগ্র প্রকৃতি বদলে গিয়ে জন্ম নেয় এক বিজাতীয় সত্তা। একই সত্তার পরিবর্তিত রূপ। কিন্তু সম্পূর্ণ পৃথক। দল ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ দল মানে একটি দর্শনও তো বটে। একটি মতবাদ। দলের সেই দর্শনের জায়গায় আমি তো কিছু ছাড়িনি। আমি যা কিছু শিখেছি, জেনেছি সমস্ত এই দল থেকেই। সি পি আই এম-এর সাংগঠনিক প্রক্রিয়া অতুলনীয়। ভবিষ্যতে আমার এই শিক্ষণ কাজে লাগবে। তৌফিক সংগঠন একটি দক্ষতাই শুধু নয়। এ এক বিজ্ঞান। একে অধ্যয়ন করতে হয়। একে শিখতে হয়। এর প্রচলিত ধারণাকে স্বীকার এবং অস্বীকার করতে হয়। নির্মাণ ও বিনির্মাণ করতে হয়। যখন কোনও সংগঠন তার বিফলকে অস্বীকার করে জোর করে সফল উপস্থাপিত করতে চায়, তখন তার অবক্ষয়ের শুরু। আমার বিদ্রোহ এই সংশোধনবিহীনতার বিরুদ্ধে। আমার বিদ্রোহ, যার কাছে প্রশিক্ষিত তারই বিরুদ্ধে। দ্রোণাচার্যের কাছ থেকে অস্ত্রবিদ্যা লাভ করে পাণ্ডবরা একসময় তাঁরই বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল যেমন! সেখানে দ্রোণাচার্য বা পাণ্ডব, আলাদাভাবে বিবেচ্য ছিল না। গুরু বা শিষ্য, এমত বিচারও সেখানে সমুপস্থিত ছিল না। সেখানে ছিল একটাই বিষয়। ন্যায়-অন্যায়।
তৌফিক বলেছিল—ভীষণ তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিচ্ছ তুমি সিধুদা। তোমার এ ব্যাখ্যা ক’জন শুনবে?
—আমি তো সকলকে শোনাতে চাই না। যে শুনতে আগ্রহী হবে, তাকে শোনাব। যার কাছে ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে, তার কাছে ব্যাখ্যা করব। তত্ত্ব ছাড়া মানুষের চলে না তৌফিক। তত্ত্বই মানুষকে প্রাণিত করে। প্রত্যেক মানুষই, সারাজীবন, বিবিধ তত্ত্ব নির্মাণ করতে করতে, অনুসরণ করতে করতে যায়। তা ছাড়া এত কথা বলারও কোনও মানে হয় না। লঘুক্রিয়ার আগে এ বহ্বারম্ভ হয়ে যাচ্ছে। আমি তো কিছুই করিনি তৌফিক এ পর্যন্ত। কোনও কাজই করিনি। কাজ করতে শুরু করলে তা আপনি পথ করে নেবে।
—কিন্তু ধরো, তোমার তো একটা ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। বহু লোক তোমার কাছে আসে। তুমি তাদের সাহায্য করো। এমনকী অর্থনৈতিক সাহায্যও তুমি করে থাকো। তা ছাড়াও, তোমার পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্যেও তো অর্থের দরকার আছে। তুমি দল ছেড়ে দিয়েছ জানলে তোমার উৎসগুলো বন্ধ হয়ে যাবে না তো?
—তৌফিক, দল থেকে যেদিন মোটরবাইক দেওয়া হয়েছিল আমাকে, সেদিন তুই খুব খুশি হয়েছিলি, মনে আছে?
—হ্যাঁ।
—সেই বাইক আমি দলীয় দপ্তরে জমা দিয়েছি। তার জন্য কি আমার কোথাও যাওয়া আটকেছে? কিছু উৎস বন্ধ হতে পারে, কিছু খুলেও তো যেতে পারে! মির্জা বলেছে, ‘আমরা তোমাকে চিনি। তোমার যে-কোনও দরকারে আমাদের আগের মতোই পাবে।’ এরকম আরও অনেকেই বলেছে। বলবে। সে বিশ্বাস আমার আছে তৌফিক। দলের বাইরেও, মানুষ হিসেবে একটা পরিচয় তো আছে আমার।
—আমি কী করব সিধুদা?
—সেটা তোকে ঠিক করতে হবে তৌফিক। দলে থাকলে তোর রাস্তা সোজা। আমার সঙ্গে থাকলে কোনও রাস্তাই নেই। প্রতিদিন পাথর সরাতে হবে। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিস। তোকে আমি খুব ভালবাসি রে তৌফিক। তুই যদি দলে থেকেও যাস, তোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভাল থাকবে।
—আমার তো ভাবার কিছু নেই। তুমি আমাকে সঙ্গে নেবে কি না বলো।
—আরও সময় নে তৌফিক।
—তোমার কথা বলো সিধুদা, তুমি আমাকে সঙ্গে নেবে তো?
সে দেখেছিল তৌফিকের ব্যাকুল মুখ। তার মধ্যে কোথাও কোনও প্রতারণা ছিল না। সে জানে, তৌফিকের মতো সৎ ও সুন্দর হৃদয় বিরল। সে প্রতারণা শেখেনি। তার মধ্যেকার শক্তিকে সিদ্ধার্থ চিহ্নিত করেছে অনেক আগেই। তৌফিক তার পক্ষে থাকলে তার সহস্রজনেরই থাকা হয়। সে তৌফিকের হাত চেপে ধরে। সহসা আবেগ এসে রুদ্ধ করে স্বর। কোনওক্রমে সে বলে—তৌফিক, আমি তো কারওকে বলতে পারি না আমার সঙ্গে যাবার কথা।
তৌফিক বলে—আমাকেও না?
—না। তোকেও না। কারওকে কি বলা যায়?
—আমাকে বলা যায়, সিধুদা।
—বেশ।
.
এই-ই প্রাপ্তি জীবনের। এই-ই। এই ভালবাসা, এর বাইরে আর কী চাইতে পারে মানুষ! হতে পারে, কোনওদিন তৌফিকের সঙ্গে তার মতবিরোধ হল। অথবা পারস্পরিক উপলব্ধির জায়গায় সৃষ্টি হল শূন্যতা। হতে পারে এমন, এবং তারা তখন দূরে চলে যেতে পারে। জীবনের সকলই পরিবর্তনশীল। কিন্তু তাই বলে এ মুহূর্ত মিথ্যে নয়। এই ভালবাসা অর্থহীন নয়। তৌফিকের এই ভালবাসাকে সে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেছিল। একটি বৃহৎ দল হতে বেরিয়ে, একাকী সে, পাশে একজনকেও পেয়ে গেলেই হয়ে গেল একটি দল।
তৌফিক বলেছিল—আরও অনেকেই, বিশেষত তরুণ কর্মীরা, তোমার সঙ্গেই থাকতে চাইবে সিধুদা, যদি তুমি চাও।
—যে কেউ-ই চাইলে আমার সঙ্গে আসতে পারে। যে কেউ-ই।
সে কি অন্য কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ দেবে? নাকি নিজেই গড়ে তুলবে একটি সংগঠন—এ প্রশ্ন তাকে করেছে বহুজন। শহরের অনেক দোকানদার, রিকশাওয়ালা, পুরসভার চতুর্থ শ্রেণির কর্মীবৃন্দ। জানতে চেয়েছে গ্রামের গ্রামান্তরের মানুষ।
পরমেশ্বর সাধুখাঁর হত্যার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে সকল অগ্রণী সংবাদপত্রে। টেলিভিশনে। সেখানে তার দলত্যাগের খবর বিশেষ কিছু ছিল না। ছিল একটিমাত্র বাক্যই কেবল। এবং সি পি আই এম বিরোধী একটিমাত্র সংবাদপত্রে। ‘এই ঘটনার প্রতিবাদে দল ছাড়লেন বহরমপুরের তরুণ জনপ্রিয় নেতা সিদ্ধার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়।’ কিন্তু সে গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখেছে, ছড়িয়ে গিয়েছে সংবাদ। মুখে মুখে। হাওয়ায় হাওয়ায়। একজন কংগ্রেসকর্মীর হত্যায় তার দল ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিভ্রান্ত করেছে মানুষকে। বহু বহু প্রশ্নের জবাব সে দিয়েছে এ পর্যন্ত।
আপনি কি কংগ্রেসে যোগ দেবেন, সিধুবাবু?
আপনি কি আলাদা কোনও দল গড়ে তুলবেন?
আপনার এই দলত্যাগ কি পরিষ্কার বলে দিচ্ছে না, পরমেশ্বর সাধুখাঁ হত্যার চক্রান্ত সি পি আই এম পার্টির মধ্যেই করা হয়েছিল?
এ কথা অস্বীকার করতে পারেনি সে। যদিও প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কারওকে দোষী সাব্যস্ত করা উচিত নয়। কিন্তু তার চেয়ে অধিক আর কে জানে, সকল হত্যা চিহ্নিত হবার জন্য প্রমাণের অপেক্ষায় বসে থাকে না!
সে জানে, কারা ছিল মিছিলের শেষভাগে সেদিন। সে জানে, এ হত্যার মন্ত্রণা দিয়েছিল কে! সে জানে। অন্যরাও জানে। কিন্তু কোনওদিন তার প্রমাণ হবে না। আর হলেই-বা কী! যারা মেরেছে, তারা ধরা পড়লেও, কে তাদের নিয়োগ করেছিল, আঁকা-বাঁকা পথে হারিয়ে যাবে তার নাম।
পরমেশ্বর সাধুখাঁ সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব, কিন্তু মনে মনে সকলেই জানেন, এ রাজ্যে কংগ্রেসের অবস্থান নখদন্তহীন, নুলো, ন্যুব্জ। এই হত্যা ঘিরে যে প্রতিবাদ উঠেছিল, সি বি আই তদন্তের দাবি জানিয়ে উঠেছিল যে আলোড়ন, তার জের স্তিমিত হয়ে এসেছে। সি পি আই এম সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে এই হত্যার দায়। বরং পরমেশ্বর সাধুখাঁর মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে দলের সাধারণ সম্পাদক পর্যন্ত। মিহির রক্ষিত বলেছেন, কিছু দুষ্কৃতী তাঁর মিছিলের সুযোগ নিয়েছিল। সম্পূর্ণ সাজানো এই চক্রান্ত। দলের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির গায়ে কালিমালেপনই এর উদ্দেশ্য। তিনি স্বেচ্ছায় কালো ব্যাজ পরেছিলেন তিনদিন। স্বয়ং গিয়েছিলেন দেবেশ্বর সাধুখাঁর সঙ্গে দেখা করে দুঃখপ্রকাশ করতে। এমনকী সি বি আই তদন্তের প্রয়োজনীয়তার দাবী তুলতেও তাঁকে দেখা গেছে।
রাসুদা বিবৃতি দিয়েছেন, এ হল কংগ্রেসের ভিতরকার অন্তর্দ্বন্দ্বের ফল। কারণ, সকলেই জানেন, লালবাগ এলাকার কংগ্রেস নেতা দিলীপচাঁদ সিংহের সঙ্গে সাধুখাঁ পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল না। এই অভিযোগকে প্ররোচনামূলক বলে দাবি করেছেন দিলীপচাঁদ সিংহ। তিনি বলেছেন—কখনও কখনও মতবিরোধ হয়েছে ঠিকই। কারণ পরমেশ্বরবাবু ছিলেন প্রাচীন আদর্শের মানুষ। কিন্তু তাই বলে আমাদের মধ্যে সুসম্পর্কের কোনও অভাব ছিল না। কংগ্রেসের কোনও কোনও নেতার স্বার্থপরতার জন্য দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের যে প্রচার ঘটে গেছে, সি পি এম তারই সুযোগ নিতে চাইছে। পরমেশ্বরবাবুকে হত্যা করে কেউ ব্যক্তিগত ক্রোধ চরিতার্থ করেছে। না হলে, সকলেই জানেন, পরমেশ্বর সাধুখাঁ ছিলেন অজাতশত্রু পুরুষ।
চলেছে এই চাপান থেকে উতোর। উতোর থেকে চাপান। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ এলাকার সর্বত্র যে স্বতঃস্ফুর্ত শোক নেমে এসেছিল, কংগ্রেসের তৎপরতায় যে বন্ধ রাখা হয়েছিল স্কুল, কলেজ, দোকান-পাট দু’দিনের জন্য, তা দেখানো হয় টেলিভিশনে। খবরের কাগজগুলিতে প্রথম-প্রথম পাতার পর পাতা জুড়ে ছাপা হচ্ছিল এ খবর। এখন ছাপা হয় সামান্য কয়েক লাইন। তার অধিকাংশই জুড়ে থাকে পুলিশের ব্যর্থতার কথা হয়তো কেন্দ্রে এখন কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকলে এই হত্যার বিরুদ্ধে আলোড়ন আরও তীব্র হত। হয়তো সি বি আই তদন্ত হলেও হতে পারত। কিন্তু কংগ্রেস এখন শক্তিহীন। দলীয় দ্বন্দ্বে কাহিল। বড় বড় নেতারা বিবিধ কেলেঙ্কারীর দায়ে অভিযুক্ত। কে কার সম্মান রক্ষার জন্য এগিয়ে আসবে?
সমস্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার এই দলত্যাগ কোনও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়। তবু, সে যে সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে এই তার পরম প্রাপ্তি। যেহেতু কংগ্রেসকর্মী হত্যার বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ, সেহেতু সকলেই ভাবছে সে কংগ্রেসে যোগ দেবে। এক্ষেত্রে সকল সন্দেহ নিরসন করেছে সে। বলেছে, না কংগ্রেস নয়।
—তা হলে? তা হলে কি আপনি নতুন দল গড়বেন সিধুবাবু?
সে বলেছিল সর্বত্রই—দেখুন, আমি মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। সে-কাজের জন্য মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। যদি সার্বিক মঙ্গলের জন্য, কল্যাণের জন্য, আমাদের সংঘবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন হয়, আমরা হব। ক্ষমতা দখল আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য কল্যাণ। উন্নয়ন। বৈজ্ঞানিক পন্থায় বাঁধ নির্মাণ এবং ভাঙন প্রতিরোধের জন্য জনচেতনা তৈরি করা, এই-ই আমাদের প্রথম কাজ।
সে চেয়েছিল সকলের স্বতঃস্ফুর্ত যোগদান। সে চেয়েছিল তাদের আন্দোলনের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার। তা ছাড়া সে, দল ছেড়েও স্বপ্ন বুনে যাওয়া সে, তারও প্রয়োজন ছিল বোঝা সে কতখানি! দলের সমর্থন ছাড়া সে কতটা!
বোধিসত্ত্ব তাকে বলেছিলেন-তোমার নিজের মনে কোনও দ্বিধা আছে কি?
সে বলেছিল—না।
—তা হলে কাজ থামিয়ো না। মানুষকে বুঝতে দাও যে তুমি একা হলেও সক্রিয়। সক্রিয়তাই মানুষের প্রধান ক্ষমতা। জীবনের কোনও সিদ্ধান্তই ভুল নয় যদি তুমি তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারো। আমি তোমাকে চিনি। আগেও বলেছি, তোমার মধ্যে আছে নেতৃত্ব-ক্ষমতা। নেতৃত্বের অন্যতম গুণ হওয়া দরকার বিশাল হৃদয়। সে-হৃদয় মানুষের দোষ-গুণ যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিচার না করে কাছে টানবে। সহকর্মী বা অনুগামী, যাই-ই হোক না কেন, তাকে ভাল না বাসলে মন পাওয়া যায় না। আমি জানি তোমার নিজস্ব ন্যায়-নীতিবোধ আছে। তাকে সুদৃঢ় করো। তার সম্পর্কে যেন সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা তোমার থাকে। তোমার ভুল-ভ্রান্তি বিচার করবে কাল, সময়। কিন্তু তুমি যা বিশ্বাস করবে, তার মধ্যে যেন কোথাও ফাঁক না থাকে। নীতির ভিত্তি হল স্বনির্ভরতা। যে নিজেকে অবিশ্বাস করে, হাজার নিয়ম গেঁথেও তাকে দিয়ে মহৎ কাজ করানো যায় না। এক দলের নীতির সঙ্গে অন্য দলের নীতির পার্থক্য আছে। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে নীতি একটি বিচ্ছিন্নতাকামী বৈশিষ্ট্য। কিন্তু প্রকৃতপক্ষেই তা নয়। নীতি একটি গঠনমূলক বোধ। নিজস্ব বিশ্বাসের ভিত্তি। সত্যের ধারণা। নীতিবোধের সুপ্রয়োগ মানবজীবনের উন্নয়নকে নিশ্চিত করে।
সে বলেছিল—কিন্তু দাদু, মানসিক দ্বন্দ্ব না থাকলে উত্তরণ কী করে সম্ভব?
বোধিসত্ত্ব বলেছিলেন—দ্বন্দ্ব তো মানুষ মাত্রেই থাকে। দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়েই তুমি কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারো। কিন্তু দ্বন্দ্বই আধুনিক যুগের লক্ষণ, এই অন্তঃসারহীন প্রচারে বিশ্বাস কোরো না। দ্বন্দ্ব মানবচরিত্রের লক্ষণ। কিন্তু দেখো, দ্বন্দ্বই যেন অবলম্বন হয়ে না ওঠে। দ্বন্দ্বের কারণে অযথা কালক্ষেপও এক ধরণের পরিহার কৌশল। এই যে তুমি এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছ, তা দ্বন্দ্বে অস্থির থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবার জন্যে?
—না।
—তোমার মূল জোর কোথায়? ভেবে দেখেছ কি?
—দেখেছি। আমি বিশ্বাস করি মানুষই মানুষের শক্তি। পারস্পরিক আদান-প্রদান এবং সংযোগের মাধ্যমে এই শক্তি কেন্দ্রীভূত হয়।
—দেখো, তোমার পদক্ষেপের মধ্যে তুমি নিজেই নিজের ভাবনায় বিরোধিতা করছ।
—কীভাবে?
—তুমি কোনও গোষ্ঠীবদ্ধতায় যেতে চাইছ না। পারস্পরিক আদান-প্রদান এবং সংযোগের মাধ্যমে যে-শক্তি কেন্দ্রীভূত হয়, তা শেষ পর্যন্ত এক গোষ্ঠীবদ্ধ শক্তি। এই শক্তি ছাড়া মানুষ অচল। বিশেষত যারা ব্যক্তিগত জীবনকে ছড়িয়ে দিয়েছে সমষ্টিতে। সিদ্ধার্থ, গোষ্ঠীবদ্ধতাই মানুষের আদিতম ক্ষমতা। আজও কোথাও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আর ক্ষমতা না থাকলে, শক্তি না থাকলে, তুমি কিছুই করতে পারবে না।
—মানুষের জন্য কাজ করতে করতে দল আপনি গড়ে উঠবে না দাদু?
—উঠবে। প্রাথমিক আবেগ দ্বারা। তারপর তাকে লালন-পালন করতে হবে ভাই। গড়ে ওঠাকে গড়ে তুলতে হবে। পৃথিবীতে যে-কোনও সম্পর্ককেই লালন করতে হয়। যত্ন করতে হয়। নইলে সেই সম্পর্কের প্রাণ বাঁচে না। কাজের প্রয়োজন আছে। তার সঙ্গে সঙ্গে যে-কোনও সংগঠনের প্রচার ও প্রসারের প্রয়োজন আছে। শোনো, যে অপ্রিয় কথাটি কেউ তোমাকে বলবে না, তা আজ আমি তোমাকে বলে যাই। কারণ আমি তোমার সবচেয়ে আপনার জন। আজ এ-কথা বলার সময় এসেছে কারণ বহু দূরের মন্দিরে বেজেছে ঘণ্টাধ্বনি, তা শুনতে পেয়েছি আমি।
সে চমকে তাকিয়েছিল বোধিসত্ত্বের দিকে। তাঁর মুখ সমাহিত ছিল। পরমেশ্বর সাধুখাঁর হত্যার ঘটনায় তিনি তীব্র বেদনা পেয়েছিলেন। সেই বহু আগেকার একদিনের মতো সারাদিন অন্নগ্রহণ করেননি।
সেদিন, বোধিসত্ত্বের কথা শুনতে শুনতে তার মনে হয়েছিল, দাদু তার একমাত্র আপনার। তার শ্রেষ্ঠ ভালবাসার জন। অথচ দাদুর যত্ন সে কখনও করেনি। জানতে চায়নি বোধিসত্ত্বের কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না। তাঁর চিকিৎসার কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে কি না।
তার হৃদয়ের সকল কথা দৃষ্টিতে ভাষা পেয়েছিল বুঝি। বোধিসত্ত্ব তা পড়ে ফেলেছিলেন সহজেই, নিজেকে পড়ার মতো। বলেছিলেন—চিন্তা কোরো না। সময় হলে আমি তোমাকে ডেকে নেব। তুমি যা হয়ে উঠতে চাও, তা হয়ে ওঠো। তাতেই আমার শান্তি। আমি ভাল আছি। আমার জন্য উদ্বিগ্ন হোয়ো না। এবার তোমার দুর্বলতা কোথায় তা বলি। তুমি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ব্যগ্র নও।
—নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার ব্যগ্রতায় একরকম স্বার্থপরতা আছে দাদু। নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা আছে। তা আমাকে পীড়িত করে।
আমি তোমার মন জানি। ভাবনা জানি। হ্যাঁ, স্বার্থপরতা আছে এর মধ্যে। কিন্তু এটাই বাস্তব। আগেকার রাজন্যবর্গ অশ্বমেধ যজ্ঞ করতেন কেন? নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য নয়? সাম্রাজ্যের প্রসার ও প্রচারের জন্য নয়? সেইসমস্ত রাজচক্রবর্তীগণের অধিকাংশই সুশাসক ছিলেন। তুমি যদি শুভশক্তি হও, তোমার শক্তি যদি অপরিমেয় না হয়, তা হলে অশুভশক্তিসম্পন্ন প্রতিযোগীরা তোমাকে ধ্বংস করে দেবে। মানুষ তোমার ওপর আস্থা রাখবে কেন, যদি তোমার শক্তি না থাকে? আরও তীব্র হও। আর উদগ্র হও। নিজের প্রতিষ্ঠার জন্য, নিজের রক্ষার জন্য আক্রমণাত্মক হও। নইলে তুমি শেষ হয়ে যাবে। সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করো। নিজস্ব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করো। কীভাবে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়? ধর্মের দ্বারা। বাণিজ্যের দ্বারা। রাজনীতি দ্বারা। হ্যাঁ, রাজনীতি শব্দটিকে তুমি এক্ষেত্রে যুদ্ধ হিসেবেও ভাবতে পারো। বিশ্বের দিকে তাকাও, দেখো, যুগে যুগে, কালে কালে, এমনকী এই বর্তমান সময়েও, সাম্রাজ্য বিস্তারের এই তিনমাত্র পথ। হ্যাঁ, এর সহায়ক শর্ত কিছু আছে। ক্ষেত্রবিশেষে শর্তও পরিবর্তিত হয়। কিন্তু এই তিনই প্রধান। কী কী গুণ থাকলে কোনও জাতি বা কোনও ব্যক্তি, ক্ষুদ্র গণ্ডি ছেড়ে ব্যাপকতার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় জানো? শৌর্য, বীর্য এবং জিগীষা। এমনকী প্রবল জিযৃক্ষাও এক্ষেত্রে কার্যকরী হয়।
সিদ্ধার্থর মনে হয়েছিল, সে এক বিশাল সমুদ্র পার হয়ে এল। ভাবনপ্রক্রিয়ার বহু অন্ধকার সে পেরিয়ে এল বোধিসত্ত্বর হাত ধরে। তার প্রেরণার উজ্জীবন ঘটিয়ে দিয়েছিলেন বোধিসত্ত্ব। এবং সে নিজের শক্তি পরীক্ষা করতে চেয়েছিল। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে বুঝে নিতে চেয়েছিল, কী তার অবস্থান।
বোধিসত্ত্ব বলেছিলেন—সদ্য দল ছেড়ে এসে আজ এই মুহূর্তে তুমি একা। এখন নানাবিধ প্রতিক্রিয়া তোমার হবে। জাগবে অভিমান। অনাস্থা। অবিশ্বাস। প্রশ্রয় দিয়ো না। এসব প্রশ্রয় দিয়ো না। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস, দেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, সমস্ত যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন প্রায়। কিন্তু মহাশক্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। ভেবে দেখো, বিদেশে রয়েছেন, শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ নয়, হাতে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। নিরন্তর অর্থচিন্তা করতে হচ্ছে। দেশ থেকে যে-কাগজগুলি বেরোয়, সেগুলি সংগ্রহ করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। চিঠিপত্র খোলাখুলি লিখতে পারেন না, লিখলে ব্রিটিশ সরকার বিবাচন করে দেয়। বাধার অন্ত নেই। তারই মধ্যে দেশে দেশে ভারতবর্ষের হয়ে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন! তারই মধ্যে সংগঠনের কাজ করে যাচ্ছেন। চূড়ান্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও স্বপ্ন দেখছেন ভারতের স্বাধীনতা! একজনকে লিখেছিলেন—I know I stand quite isolated today but I am not sorry for that. I shall continue to say and to do what I consider right, even if that brings upon me untold suffering and unpopularity. অথচ দেখো, ইতিহাস ক্রমে এই প্রমাণ দিচ্ছে, সুভাষচন্দ্র বোস শ্রেষ্ঠ নেতৃত্বক্ষমতা নিয়ে এসেছিলেন ভারতবর্ষে। তিনি যদি বেঁচে থাকতেন, ভারতবর্ষের ইতিহাস, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান অন্যরকম হত। সংকল্প রাখো। ন্যায় এবং সত্যের সংকল্প রাখো। সত্যের দিকে পিঠ ফেরালেই দেখবে সামনে অনিবার্য পরিণতি। মৃত্যু। একটা কবিতা শোনো, সুভাষ বোসের প্রসঙ্গই যখন উঠল, তাঁর একটা প্রিয় কবিতা শোনাই। পি এইচ পিয়ার্সের লেখা। কবিতার নাম রিনানসিয়েশন। মানে জানো তো? ত্যাগ!
Naked I saw thee,
O beauty of beauty,
And I blinded my eyes
For fear I should fail
I blinded my eyes,
And I closed my ears,
I hardened my heart
And I smothered my
I turned my back desire
On the vision I have shaped
And to this road before me
I turned my face
I have turned my face
To this road before me
To the dead that I see
And the death I shall die.
তেসরা জ্যৈষ্ঠ সে এক মহামিছিলের আয়োজন করে। আশ্চর্য সে মিছিল। ফরাক্কা থানার বেওয়া থেকে শুরু হয়েছিল তার যাত্রা। শেষ হয় পদ্মাপারের শিবনগরে, যেখানে পদ্মা খেয়ে ফেলেছে অধিক পঁচাত্তর শতাংশ। একটুকরো ডাঙাজমি ঝুলে আছে কোনও ক্রমে। নদীগর্ভে চলে যাবে যে-কোনও দিন।
ভৌগোলিক বিচারে জেলা মুর্শিদাবাদের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত এই যাত্রা। ফরাক্কা থেকে জলঙ্গী।
সিদ্ধার্থ বলেছিল, যার যতদূর ইচ্ছে যাবেন। যেখান থেকে খুশি মানুষ যোগ দিতে পারবেন এ মিছিলে। এর ফলে বেওয়া থেকে শুরু করে সমরেশগঞ্জ থানার ধুলিয়ান নিমতিতা হয়ে, সুতি থানার গিরিয়া হয়ে, জঙ্গিপুরের বড়শিমুল, লালগোলার পাহাড়পুর, ফতেপুর পেরিয়ে, ক্ৰমে কান্তনগর, হনুমন্তনগর, আখেরিগঞ্জ, মাঝারদিয়ার, কাতলামারি, রাজনগর হয়ে শিবনগরে পৌঁছেছিল যে-মিছিল, আরও কত গ্রাম-গঞ্জ মধ্যে মধ্যে, সেইসব পেরিয়ে পৌঁছেছিল যে-মিছিল, যাতে যোগ দিয়েছিল উত্তর থেকে আসা চান্দুর ইত্যাদি গ্রামের মানুষ, পশ্চিম থেকে আসা বীরথম্বা, মোবারকপুর, রাতুরি, আইরা প্রভৃতি গ্রামের মানুষ, দক্ষিণ থেকে আসা গড্ডা, রৌতরি, গোমুণ্ডি, বাঘান, কলাবিবির মানুষ, মধ্য হতে আসা চতুষ্কোনা, তেকোনা, পেতনির চরের মানুষ। এবং আরও কত গ্রাম হতে আসা, আরও কত কত অখ্যাত স্থান হতে।
এসেছিল তারা যে-মিছিলে, দলে দলে যোগ দিয়েছিল যে-মিছিলে, প্রকৃতপক্ষেই তা যেন হয়েছিল এক রিলে মিছিল। একদল চলেছিল, অন্য দলের হাতে মিছিলের ভার দিয়ে তারা ফিরে গেছে। কখনও জনসমাগমের বিরলতা ছিল না তবু। নদীর স্রোতধারার মতোই, মূলপ্রবাহের সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছিল উপস্রোত এবং মূলস্রোতকে আরও ভারী, আরও পরিপূর্ণ করে তুলছিল।
সিদ্ধার্থ চেয়েছিল মৌন মিছিল। চেয়েছিল নীরবতার মধ্যে থেকে অস্তিত্বের প্রমাণ। সেই বিপুল বিস্ময়কর জনস্রোতের হাতে ছিল প্রতিবাদের ভাষা লেখা পোস্টার। মুখে কোনও স্লোগান ছিল না বলেই সেই মৌন মিছিলের লেখাগুলি ছিল বিস্ময়কর রকমের সরব। অনেক ভাবনা-চিন্তা করে তারা লিখেছিল পোস্টার। সে, তৌফিক, বসির খান, মির্জা এবং, এবং নিবেদিতা। তৌফিকের সঙ্গে সে এসেছিল আলোচনায়। যোগ দিয়েছিল। বিস্তীর্ণ বিষণ্ণতার ওপার হতে আবেদন করেছিল সে সিদ্ধার্থর কাছে—আমাকে নাও তোমাদের কাজে। না হলে আমি পাগল হয়ে যাব।
তারা লিখেছিল সেই পোস্টার। গ্রামে গ্রামে ঘুরে লিখিয়েছিল। গোটা চৈত্রমাস তারা ছিল অবিশ্রান্ত।
সেইসব কথা বিঘোষিত হয়েছিল সর্বত্র। সকলের কাছে। প্রচারিত হয়েছিল, কারণ খবরের কাগজগুলি লিখেছিল এই বিস্ময়কর মিছিলের কথা।
আমাদের আছে মানুষের মতো বাঁচার অধিকার।
আমরা বাঁচতে চাই।
ভাঙনের দুর্নীতি বন্ধ হোক।
বাঁধ নিয়ে রাজনীতিক-ঠিকেদার আঁতাত চলবে না।
ভাঙন প্রতিরোধের জন্য আসুন আমরা একত্র সামিল হই।
অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে কৃষিজমি বাঁচান।
মুর্শিদাবাদে গড়া হোক নতুন নতুন শিল্প-কারখানা।
অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে আসা মানুষের চাপ থেকে আমরা মুক্তি চাই।
নদীর প্রকৃতি বিষয়ে সচেতন হোন।
চাই শিক্ষা।
চাই স্বাস্থ্য।
আমাদের সন্তান যেন নিরক্ষর না থাকে।
চাই সকল তথ্য জানবার অধিকার।
চাই খাদ্য।
চাই বাসস্থান।
আমাদের সন্তান যেন অনাহারে না মরে।
চাই কাজের অধিকার।
চাই নিরাপত্তা।
এ জেলার বেকারত্ব ঘোচানোর জন্য পরিকল্পনা চাই।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হোক।
চাই গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
আমাদের সন্তান যেন বিনা চিকিৎসায় না মরে।
চাই সেচ ব্যবস্থার সার্বিক উন্নতি।
অনাবৃষ্টি মানেই যেন অনাহার না আসে।
আমরা লড়ব দুর্নীতির বিরুদ্ধে।
আমরা লড়ব সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে।
আমরা লড়ব মৌলবাদী প্ররোচনার বিরুদ্ধে।
আমরা লড়ব জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে।
আমরা লড়ব প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে।
আমাদের লড়াই জীবনের জন্য।
সম্পূর্ণ পথ হাঁটেনি কেউ-ই। সিদ্ধার্থও হাঁটেনি। কারণ প্রায় একশো কিলোমিটারের পদযাত্রায় হাঁটা সম্পূর্ণ সম্ভব ছিল না। অতএব প্রকৃতপক্ষে সে-মিছিল ছিল অজস্র মানব এককে মিলে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মিছিলের শেষপ্রান্তে লক্ষ জনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে কেঁদেছিল সিদ্ধার্থ সেদিন। সে মৌনতাই চেয়েছিল বলে লোক সোল্লাস ছিল না। কিন্তু সে দেখেছিল প্রত্যাশা। অপরিসীম প্রত্যাশা। সকল দৃষ্টিপাতে। জীবনের জন্য স্বতঃস্ফূর্ত পদযাত্রা এই। কাগজগুলিতে লিখেছিল, ‘জনগণের নির্বাক প্রতিবাদ, নিরুচ্চার দাবি। ‘
পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য তৈরি হচ্ছে তারা। গ্রামে গ্রামে ঘুরে নদীবিজ্ঞান সম্পর্কে তারা সচেতনতা গড়ে তুলবে এবার। সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে এগিয়ে নেবে সংগঠনের কাজ। এখুনি তাদের দলের কোনও নাম থাকবে না। সমাজসেবামূলক একটি ছোট প্রতিষ্ঠানের মতোই সক্রিয় থেকে তারা নিজেদের সংঘবদ্ধ করবে। এখন তাদের প্রত্যেকটি দিন মূল্যবান। প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত ভারী। এখন তাদের সমস্ত কিছুই দাবি করে সুচিন্তার অভিজ্ঞান। এরই জন্য প্রস্তুতি চলেছে তার। নিরন্তর।
ডায়রি নিয়ে বসে হিজিবিজি লিখছিল সে। তার ভাবনার কিছু এলোমেলো রূপরেখা ফুটে উঠছিল পাতায় পাতায়। গ্রীষ্মের গরম বাতাস এসে ঢুকে পড়ছিল জানালা মাধ্যমে।
সে ভাবছিল, এই তার প্রাথমিক কাজ। মুর্শিদাবাদের মানুষকে নিয়ে জীবনের জন্য গড়ে তোলা আন্দোলন। মুর্শিদাবাদের মানুষ—কেমন তারা? কেমন?
.
এখানে দারিদ্র চরম। বেকারত্ব অগুনতি। এমনকী প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাও এখানে পৌঁছায়নি গ্রামে গ্রামে। আমজনতার জীবনে সমৃদ্ধি নেই, নিরাপত্তা নেই, নিশ্চয়তা নেই। তবু মুর্শিদাবাদে বর্ণচেতনা বা ধর্মচেতনার কোনওটাই বৃহৎ হয়ে দেখা দেয়নি কোনও কালে। এখানে যা আছে, তা এক মিশ্র সংস্কৃতি। যদিও সংস্কৃতি সর্বত্রই হয়ে থাকে মিশ্র। মানুষের সংস্কৃতিকে অবিমিশ্রভাবে, বিশুদ্ধভাবে পাওয়া যায় না কোথাও-ই। কারণ সংস্কৃতিকে আপাতভাবে রক্ষণশীল মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা নিত্য পরিবর্তনীয়। মুর্শিদাবাদ কোনও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এ জেলায় মিশ্রণের পরিমাণ অধিকতর। কারণ এ দেশের এক প্রাচীন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল এই মুর্শিদাবাদে মিশেছে হিন্দু আর মুসলমান, বৌদ্ধ আর খ্রিস্টান। মিশেছে প্রাচীন অধিবাসীর সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে আসা নিত্যনতুন সব মানুষ।
সব মিলিয়ে এই সংস্কৃতি যেমনই হোক, তা ধারণ করে এক সহিষ্ণু সমাজচেতনা। এই চেতনা ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে। সেদিক থেকে মুর্শিদাবাদের মানুষ এক মহত্ত্বেরই পরিচয় দিয়ে এসেছেন। এতকাল।
এই মহত্ত্বকে শ্রদ্ধা করে সিদ্ধার্থ। এই মহত্ত্বের ওপর সে নির্ভর করে। এই মহত্ত্বকেই সে দেখতে পায় ভারতবর্ষের অন্তরে।
কিন্তু ভারতের অন্য একটি রূপ আছে। যা তাকে শঙ্কিত করে। কিছুদিন আগেই চতুষ্কোনায় সতী হয়েছেন এক মহিলা, কিন্তু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বিপুল জনসংখ্যার প্রতিভূ হতে পারে না। অসম্ভব হীন এবং লজ্জাজনক সেই ঘটনা সংবাদপত্রের একটি কোণে স্থান পেয়েছিল ঠিকই, তবে রাজস্থানের রূপ কানোয়ারের মতো গুরুত্ব পায়নি। নিরন্তর ডাইনি হত্যার মতোই সংক্ষিপ্ত ও স্বাভাবিক ছিল সে-সংবাদ। এর কারণ হতে পারে এই যে, ওই মহিলা প্রথম থেকেই নিজেকে এক সতীমায়ের প্রতিনিধি বলে মনে করতেন। তাঁর ভরও হত। অতএব যুক্তিবাদের বিচারে তাঁকে বিকারগ্রস্ত বা ধান্দাবাজ বলা যায় বলে মনে করে সিদ্ধার্থ। শেষ পর্যন্ত এই ঘটনা এক বিকারগ্রস্ত মহিলার আত্মহত্যার ঘটনা। এবং এখানে কেউ তাঁর ওপর জোর করেনি। পুড়তে প্ররোচনা দেননি। শোনা গেছে, অনেকদিন আগেই তিনি ঘোষণা করেছিলেন স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যাবেন। সতীদেবীর একজন প্রতিনিধির পক্ষে এমন ঘোষণা খুব অস্বাভাবিক নয় বলেই লোকেদের মনে হয়েছিল কারণ তারা ধরে নিয়েছিল, এ ঘোষণাই মাত্র। বাস্তবে তা ঘটবে না। ঘটলেও জ্বলন্ত চিতায় জীবিত মানুষের অবস্থান তারা কল্পনাও করেনি। করলে বাধা দিত নিশ্চিতই। তারা ভেবেছিল, এমন তো হয়, স্বামী মারা গেলেন শুনে স্ত্রীরও মৃত্যু হল, তেমনই, কিংবা এক স্বেচ্ছামৃত্যুর সংকল্প, যা এক সাধক বা সাধিকার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়, অতএব স্বামীপরায়ণা সতী সমাধিস্থ অবস্থায় দেহত্যাগের সংকল্প নিলেও নিতে পারেন, সে নিয়ে কিছু বলার থাকে না। স্বামীকে শ্মশানে নিয়ে যাবার পূর্ব মুহূর্তে সেই নারীর দেহ হতে প্রাণের সমস্ত লক্ষণ লুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু চিতা হতে ওই দেহ জ্বলন্ত উঠে এসেছিল অলৌকিক!
নাড়ি স্তব্ধ ছিল যার, হৃদি ক্রিয়া করছিল না, তাকে মৃত ছাড়া আর কী ভাবা যেতে পারে? কেউ কেউ বলছে, এ এক সমাধিস্থ অবস্থা যা অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে আয়ত্ত করা সম্ভব। জীবন্ত শরীরকে মৃত করে রাখার মৃতকল্প সমাধি এই। কিন্তু মৃত নয়, মৃতকল্প সতী, এমন ভাবনা জনতার আসেনি। ফলে এমনিভাবেই ঘটে গিয়েছিল অঘটন এবং নিন্দুকে এর মধ্যে অবৈধ প্রেমের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিল। কারণ মরণকালে সেই সতীনারী তাঁর সকল কর্মের সহচর দেবরটিকে অগ্নিময় জড়িয়ে-জাপটিয়ে ধরেছিলেন। সেই মরণ-আলিঙ্গনের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে চিতা রচিত হয়েছিল তিনজনের। ধর্মনিষ্ঠ, অলৌকিকের প্রতি বিশ্বস্ত লোকেরা এ ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছিল অন্যভাবে। বলেছিল, অলক ঘোষালের পৃথিবীর ভোগ ফুরিয়েছিল। মা তাকে টেনে নিয়েছেন। সতীই গতি করেছেন তাঁর ইহকালের সাধনসঙ্গীর।
যাই ঘটুক না কেন, সিদ্ধার্থ মনে করে মুর্শিদাবাদের জনমানসের নিরিখে এ এক বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে নয়। সামগ্রিকতায় ভারতকে দেখলে তাঁর মধ্যে সবিশেষ মাত্রায় আছে ভূত প্রেত ডাইনি সতী জাদুটোনা তন্ত্র মন্ত্র কাপালিক শবসাধক এবং শব-ভক্ষণকারী অঘোরী। আছে জাত-পাতের দ্বন্দ্ব অদ্যাবধি। মহত্ত্বের পাশাপাশি বিচিত্র সংস্কার রেখে যাচ্ছে চিহ্ন।
সম্পূর্ণ কুসংস্কারমুক্ত দেশ হবে না? হয় না? সিদ্ধার্থর মনে হয়, মানুষ যতদিন অমোঘ পরিণতি ওই মৃত্যুর কাছে পরাস্ত হবে, ততদিন বিবিধ অবাস্তবতায় বিশ্বাস তার ঘুচবে না।
এবং এ সমস্ত ঘটনাই অকিঞ্চিৎকর। সামান্য। কারণ সমস্ত ভারত জুড়ে এখন এক শোকের প্রবাহ। তার মহামিছিলের মাত্র চারদিন পরেই আত্মঘাতী জঙ্গী হানায় খুন হয়ে গেলেন রাজীব গাঁধী। দলমত নির্বিশেষে এই হত্যার নিন্দা করেছে প্রত্যেকে। শোকার্ত হয়েছে। রাজীব গাঁধী, পূর্ণ বিকশিত শতদলেরই মতো সুন্দর পুরুষ, নিন্দিত এবং প্রশংসিত, কলঙ্কিত এবং অভিষিক্ত, বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত দেহ তাঁর পড়ে আছে, এ দৃশ্য মর্মান্তিক। হৃদয়বিদারী। কত বড় সংগঠক ছিলেন তিনি? কত পূর্ণরূপে সফল প্রধানমন্ত্রী? সে বিচার অন্য। কিন্তু সুদর্শন, সুভাষিত, ভদ্র এই যুবক নেতার প্রতি আমজনতার ছিল অন্য ভালবাসা। সে-ভালবাসা দিকে দিকে প্রকাশিত এখন। শহীদের প্রতি এক অপূর্ব আবেগ প্রস্ফুটিত। সাময়িকও যদি হয় তা, তা হলেও তাকে মর্যাদা দিতে হয়।
.
এমন ভাবনার মাঝখানে ফোন বাজল। ধরল সে। ও প্রান্তে রাসুদার কণ্ঠ—তুই আছিস তো?
সে বলল—আছি রাসুদা।
—আর কেউ আছে?
—না।
—আমি আসছি।
—আসুন আমি দাঁড়াচ্ছি নীচে।