2 of 3

রাজপাট – ৯৮

৯৮ 

চৈতিক মাসের শেষে
হে কন্যা সুশাগ ললিতা।
সব সখী খায় শাগ
 অভাগীর মুখে তিতা ।।
আঁধিয়া বাড়িয়া অন্ন
শোঙ্গরাইলাম পাতে। 
আমার ঘরে নাই সাধু 
খাইতে দিব কাকে ।।

.

সারা গ্রামে খবর রটে গেছে। বলাই মণ্ডল একখানি কিতাব লিখেছেন। 

কী কিতাব? কীসের বই? 

পদ্যের বই একখানি। 

পদ্যের বই। পদ্যের বই। 

এ এক ঘটনা বটে। গ্রামদেশে এ এক ঘটনা বটে যে একজন লোক একখানি আস্ত ব‍ই লিখে ফেলল! 

বলাই মণ্ডল একজন জ্ঞানচর্চা করা মানুষ, এ সংবাদ সকলের জানা। কিন্তু তাই বলে আস্ত একখানা বই তিনি লিখে ফেলবেন, তা কি কেউ ভাবতে পেরেছিল? 

চতুষ্কোনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই নিয়ে আজ সভা। সুকুমার পোদ্দার সভাপতি। প্রধান অতিথি উজ্জ্বল পরামানিক। কারণ তাঁরই উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে এ গ্রন্থ। 

আজকের সভার আয়োজক পঞ্চায়েত। উদ্যোগ নিয়েছিল বদরুদ্দিন। এ সভায় সংবর্ধনা দেওয়া হবে বলাই মণ্ডলকে। 

কবিতা বুঝুক না বুঝুক, বিদ্যাচর্চা করুক না করুক, সারা গ্রাম আজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আছে। অলক ঘোষাল, সে-ও উঁকি মেরেছিল। ভিতরে যায়নি। তার আছে জরুরি কাজ। অনেক অনেক বেশি জরুরি সে-কাজ। এ কাজে সাহস দরকার। সতর্কতা দরকার। তার বড় ভরসা, অশোক সঙ্গে আছে। সে বুঝিয়েছে অশোককে, অমর ঘোষাল এক চিরকালের বোঝা। আর শিখারানি অধিগত করেছে কিছু অতিপ্রাকৃত বিদ্যা। যার দ্বারা ধীরে ধীরে সকলকে মেরে সে হয়ে যাবে এই বাড়ি, এই মন্দিরের অধীশ্বরী। অশোকও পার পাবে না এমনকী। যদি বিবাহ করে কোনও দিন অশোক, তার বউ মরে যাবে, যেমন বরষা অসুস্থ এখন 

তার চেয়ে আগাম ব্যবস্থা নেওয়া ভাল। আগাম প্রতিরোধ। এতে দোষ কী? নিজেদের জান-প্রাণ বাঁচাবার জন্যই এ পথ। আত্মরক্ষার জন্য যে-কোনও পন্থাই উত্তম। 

অশোক রাজি হয়ে গেছে। শর্ত দিয়েছে। ওই মটরমালা হার দিতে হবে তাকে। টালবাহানা করে শেষ অবধি মেনে নিয়েছে অলক। হতে পারে, অশোকও তারই মতো কোনও নারীকে পেয়েছে। হতে পারে। এমনকী বুঝেছে অলক, তার চেয়ে অশোকের এই কর্ম বিষয়ে উদ্বেগ কম। দীর্ঘকাল ধরে যে-পথে সে উপার্জন করে আসছে, তাতে পাকিয়ে উদ্বিগ্ন-বিবিগ্ন সে হয় না সহজেই। 

আনন্দে ভরে যাচ্ছে মন তার। এবার তার ও বর্ষার মাঝে আর কেউ থাকবে না। আবার শঙ্কায় ভরে যাচ্ছে মন। শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাক সব হবে তো? 

তার সহায় অশোক। তার সহায় পূর্ণ চক্রবর্তী। অনুপান দেবেন তিনিই। দু’টো দু’রকম। একটিতে সম্পূর্ণ প্রাণ চলে যাবে। একটিতে প্রাণ যাবে থেমে থেমে। ঘোরের মধ্যে। লোকসমক্ষে প্রকাশিত হবে, শিখারানি সতী হয়েছেন। ইচ্ছা স্ববশে থাকবে না তাঁর। 

অনুপানের উপাদান খরিদ করা ও প্রস্তুতির জন্য কিছু অর্থ দণ্ড দিতে হয়েছে অলকের। তবে কিনা, বৃহৎ প্রাপ্তির জন্য এ সামান্য বলি। বরষার জন্য, প্রিয়তমা বর্ষা নামে নারীর জন্য অলক সকলই দিতে প্রস্তুত। আর শুধু বর্ষাই-বা কেন? এ তার নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও সাবধানতা সতীনারী শিখারানিকে আরও বেশি দৈবী হতে দেওয়া চলে না। আরও বেশি ক্ষমতার অধিকার দেওয়া চলে না। এই নারী এখনই যেন মুঠোর বাইরে চলে গেছে। ভর পড়লে চেনা মেয়েমানুষটিকে অচেনা লাগে তারও। বুকে ভয় জাগে। অতএব আত্মরক্ষা। অতএব উত্তম পন্থা। 

সন্ধ্যায়, শিখারানি পুজো করছে যখন, অশোক চেপে ধরল অমর ঘোষালকে। অলক পূর্ণ চক্রবর্তীর অনুপান ঢেলে দিল তাঁর মুখে। ধপ করে পড়ে গেল অমর ঘোষালের চোখের পল্লব! কোনও বিক্ষেপ বিনা নিথর হয়ে গেল দেহ তাঁর। তাঁকে বিছানায় শুইয়ে তারা সরে এল। 

এবার দ্বিতীয় কাজ। কঠিনতম কাজ। দু’জনেই ওঁৎ পেতে থাকল। শিখারানি পূজা করে বেরুতেই তাকে চেপে ধরল অশোক। অলক অনুপান ঢেলে দিল গলায়। কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ল শিখারানি। তাকে ধরাধরি করে তারা বসিয়ে দিল অমর ঘোষালের পায়ের কাছে। ঘোষালের দুই পা তুলে দিল কোলে। শিখারানির দেহ ঝুঁকে পড়ল অমর ঘোষালের শরীরে। অশোক, মটরদানা হার খুলে নিল শিখারানির গলা থেকে 

এবার জনে জনে খবর দিল তারা। প্রচার করল, অমর ঘোষাল মারা গেছেন। সেই শুনে সতী-সাধ্বী শিখারানি সেই যে স্বামীর পা কোলে করে বসেছেন, আর কথাটি বলছেন না। একবার বলেছেন শুধু—আমায় তাঁরই সঙ্গে দাহ কোরো। আমি দেহ ছেড়ে চললাম। 

লোকে লোকে ভরে গেল বাড়ি। মেয়েরা গলায় কাপড় দিয়ে কাঁদতে লাগল। সকলেই বলল একটাই কথা—উনি সতী হতে চেয়েছিলেন। সতী হতে চেয়েছিলেন। 

এবার ভিড় ঠেলে এসে দাঁড়ালেন পূর্ণ চক্রবর্তী। বললেন—সতী হতে চেয়েছিলেন, তাই বলে তো জলজ্যান্ত মানুষটাকে পুড়তে দেওয়া যায় না। 

—তাই তো, তাই তো। 

সমস্বরে বলেছিল জনতা! 

—তা হলে কী করা যায়? 

—অমর ঘোষালের জন্য মাচা বাঁধো। তারপর জোর করে ওঁকে তুলে নিতে হবে। 

মাচা বাঁধা শুরু হল। সকলেই দেখল সতী পতিদেহ কোলে করে বসে আছে। সকল আয়োজন সমাপ্ত হলে, পূর্ণ চক্রবর্তী শিখারানির কাছে গিয়ে ডাকলেন—মা, মাগো, পতিদেহকে মুক্তি দাও মা! 

রোগা-ভোগা পাগল অমর ঘোষাল, তিনি তো মারা যেতেই পারেন। তাঁর জন্য কারও কোনও দুঃখ নেই। জনতা রুদ্ধশ্বাস। সতীদেবীর কী হয়! এই মুহূর্তে সকলেই তার মৃত্যুকামনা করে। এক অলৌকিককে প্রত্যক্ষ করা যায় তা হলে। 

কিন্তু সকলকে হতাশ করে শিখারানি জড়িয়ে জড়িয়ে বলে—অঁ আঁ আঁ এঁ অঁ অঁ। 

পূর্ণ চক্রবর্তী তার অনুবাদ ঘোষণা করেন—বলছেন, শ্মশানে যাব। 

সত্যিই শ্মশানে যাবারই বাসনা সে প্রকাশ করল কি না এ নিয়ে কারও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকল না। অলৌকিক দেখার অভিপ্রায়ে তার জড়ানো স্খলিত স্বর সকল উপস্থিত কর্ণজোড়ায় এমনই অনূদিত হল। অতএব ভক্তপ্রাণ উপছে ওঠে সজল বাসনায়। ভিনধর্মী যারা, তাদের কেবল ওপরে কৌতূহল। অন্তরে তাদেরও লাগে বিশ্বাসের ছোঁয়া! 

—মা মা গো! মা! সতী মা! 

সমস্বরে ধ্বনি তোলে জনতা। পূর্ণ চক্রবর্তী বলেন—বেশ, শ্মশান অবধি চলুক। তারপর ফিরিয়ে আনলেই হবে। 

হঠাৎই ঢলে পড়ে শিখারানি। লোকে বলে—কী হল? কী হল? 

পূর্ণ চক্রবর্তী নাড়ি ধরেন। বলেন- ছেড়ে গেছেন। দেহ ছেড়ে গেছেন। 

—মা! মাগো! সতী মা! 

মহিলারা প্রকাশ্যে রোদন শুরু করে— ও মা গো! ও মা! 

পুরুষদের ভ্রূ কুঁচকে যায়। পুরু গোঁফের পাশে বিষাদের ছিটেফোঁটা লাগে। এমন কাণ্ড! চোখের সামনে এমন অলৌকিক কাণ্ড! একজন তার মেয়েকে ঠেলে দেয়— অ্যাই পুটি, যা, সতীমায়ের পায়ের ধুলা নে! 

তখন পুটি, খেন্তি, বুচি, রমা, সন্ধ্যার হুড়োহুড়ি লেগে গেল পুণ্যবতীর পায়ের ধুলা নেবার জন্য। আয়েষা, লফিজা, ফতিমাদের ইচ্ছে করছিল যেতে কিন্তু তারা সংযত রইল। কে যেন পা ছুঁতে গিয়ে ছুঁয়ে লুটিয়ে কাঁদতে লাগল। তার দেখাদেখি আরও একজন কাঁদতে লাগল। কান্না ও মাতৃআহ্বানে শোরগোল। দেখেশুনে অলক-অশোকের ঘোর লেগে যায়! কিংবা হতে পারে ভয় অথবা পাপবোধ কিংবা অন্য এমন কোনও মিশ্রানুভূতি যার বিশ্লেষ অসম্ভব— যা খুনের প্রক্রিয়াতেও ঘটায় অশ্রুপাত। লোকে দেখে, অলক অশোক চোখের জল ফেলে ফেলে একাকার! 

জয়ধ্বনি ওঠে ফের। একই মাচায় তোলা হয় সতী আর পতিকে। কয়েকজন প্রস্তাব দেয়, কিছুক্ষণ থাক দেহ। গ্রামান্তরের লোক এসে দেখে যাক। কিন্তু প্রবল আপত্তি করে অলক, অশোক। জোড়া শব যেতে থাকে অতএব। পতির দেহে পতিত সতীর দেহ যেতে থাকে। সঙ্গে যায় তোশক বালিশ। শবযাত্রীর দীর্ঘ মিছিল সঙ্গে সঙ্গে যায়। শিখারানির জটাচুল ঝুলে থাকে মাচা হতে। আঁচলের প্রান্তভাগ ওড়ে। 

মধ্যরাতে শ্মশানে সাজানো হল চিতা। পতি ও সতীর শব তোলা হল জয়ধ্বনি-হরিধ্বনি সমেত। চৈত্রের শুখা বাতাসে দাউদাউ জ্বলে উঠল। অলক দাঁড়িয়ে ছিল নিকটেই। মুখাগ্নি করেছে।

হঠাৎ, জ্বলন্ত শবদেহ উঠে বসল চিতায়। সকলে হাঁক দিল—চাপ দে। বাঁশ দিয়ে চাপ

শঙ্কর আসার আগেই বাঁশ নিয়ে এগিয়ে এল অলক। কিন্তু চাপ দেবার অবকাশ পেল না। সেই উঠে বসা জ্বলন্ত দেহ কুঁকড়ে ছিটকে উঠল চিতা হতে। ঝাঁপ দিল। অলকের দেহ আঁকড়ে পড়ল চিৎ হয়ে চিতার ওপর। 

আগুনে দগ্ধ হতে হতে পা ছুঁড়ছিল অলক। লোকে ছুটে এল। টানল পা ধরে। কিন্তু ছাড়াতে পারল না। কী এক কঠিন আলিঙ্গন আটকে রেখেছে তাকে। লোকের বিপুল চেষ্টায় আগুন হতে টেনে আনা হল যখন তাকে, সে ঊর্ধ্বাঙ্গ পোড়া এক বীভৎস মরদেহ! 

তখন, ফেলে রাখা তোশক বালিশ ধরে টানাটানি ছেঁড়াছিঁড়ি করছিল শ্মশান-কুকুর। নরম পিঁজরা বালিশ হিংস্র দাঁতে ছিঁড়ে এল সহজেই। হাওয়ার দাপটে উড়ে উড়ে গেল তুলো। আর চিতার আলোয় ঝকঝক করে উঠল সোনার অলংকার কিছু! কে যেন দেখল! ঝাঁপাল! কাড়াকাড়ি পড়ে গেল মানুষের। মধ্যরাতের শ্মশানে লেগে গেল লাশের উৎসব। যারা বিবশ দাঁড়িয়ে ছিল, প্রত্যক্ষ করছিল অপ্রাকৃত দৃশ্য, চোখে পড়ল তাদের, একটি কুকুর দাঁতে কামড়ে নিয়ে চলেছে অলংকার। লেজ তুলে তীর বেগে ছুটছে। ক্ষিপ্ত কয়েকজন তার পশ্চাতে ধাবমান। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *