2 of 3

রাজপাট – ৯৭

৯৭ 

চৈত মাসে চৈতী হাওয়া
কুকিলায় ধরে তান।
ঘরে বইস্যা গায় কন্যা 
গুনগুনাইয়া গান ।।
গানের কলিতে কন্যার
আকাশ ভরিল। 
এই মাস গেল কন্যার
বর না জুটিল ।।

.

যতক্ষণ সে বাড়িতে থাকছিল, ততক্ষণই মায়মুনার দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল তার। সে কী করবে? অবাধ্য চোখ তার! অবাধ্য হৃদয়! 

কিন্তু সে, ইতিপূর্বে কখনও ন্যায়-নীতির পরোয়া করেনি, এমন মানুষ সে, তবু ভাবতে বাধ্য হচ্ছে, এ অপরাধ। বড়ভাইয়ের স্ত্রীর দিকে এভাবে তাকানো অপরাধ। 

আর মায়মুনা? তার ভিতরে কী হয়? চোখে চোখ পড়লেই সে ঠোঁট কামড়ে ধরে। পালিয়ে যায় দ্রুত। এমনকী কখনও চায়ের গেলাস এনে দিলে মুখ ফিরিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়। তার ইচ্ছে করে হাতখানি হাতে নিতে। বুকভরা ভালবাসা নিয়ে ডাকতে একবার— মায়মুনা! মায়মুনারে! 

ঠোঁটে জিভে এই নাম বহুবার নাড়াচাড়া করে সে। ইচ্ছে হয়, মায়মুনাকে জিগ্যেস করে একবার—এইখানেই বিয়া বসতে রাজি হলে কেন তুমি মায়মুনা? তুমি যে কথা দিয়েছিলে আমাকে… 

না। সরব উচ্চারণে মায়মুনা কোনও কথা দেয়নি মোবারক আলিকে। কিন্তু কথা কি মানুষ শুধু মুখেই দেয়? চোখে চোখে দেয় না? 

গোবর কুড়োতে কুড়োতে সেই যে অপলক মুহূর্ত কিছু, তার ভাষা জানে মোবারক আলি। জানে। জানে এই যে মায়মুনা বলেছিল—মিঞা, আমি তো তুমারৈ। আমারে ঘরে নিয়া চলো মিঞা! 

অসহ দহনে বুকের মধ্যে জ্বালাপোড়া করে মোবারক আলির। এবং সে রুষ্ট হয়। বাপের প্রতি রুষ্ট হয়। ভাইয়ের প্রতি রুষ্ট হয়। মায়মুনার বাপ খোদাবক্সের প্রতি রুষ্ট হয়। আপাদমস্তক এক যন্ত্রণাময় রোগ তাকে ঘিরে ফেলে। তাপিত হৃদয় হতে উঠে আসা তাপ শরীরের কোণে কোণে ফোস্কা ফেলে দেয়। ওঃ! কোনও ওষুধে এই রোগ সারে না। কেবল যদি মায়মুনা তাকে স্পর্শ করত! একবার, অন্তত একবার হাত রাখত তার জর্জরিত পাঁজরগুলির ওপর, জ্বালা জুড়ত। সারা জীবন এইটুকুই সম্বল করে বেঁচে থাকতে পারত সে। ওঃ ওঃ ওঃ! মোবারক আলি এক দারুণ প্রেমিক পুরুষ! যথার্থ প্রেমিকের মতোই সে উদাসী থাকে। উচাটন থাকে। তার অর্থের লোভ ছাপিয়ে গিয়ে তার ভাবন অধিকার করে মায়মুনা। কিছু টাকা সে পেয়েছে। তাই দিয়ে একখানি শাড়ি মায়মুনাকে খরিদ করে দিতে সাধ যায়। সংসারে অভাব, তবু সে হাতে তুলে সংসারে কিছু দিতে পারেনি এখনও। দিত, অর্ধেকই দিয়ে দিত সে, নয়তো অর্ধেকের বেশিই দিয়ে দিত, যদি মায়মুনা তারই বিবি হয়ে আসত এ সংসারে। 

ইদানীং রাত্তিরে সে জেগে থাকে অনেকক্ষণ। আবার ভোরের আগেই তার ঘুম ভেঙে যায়। উদাস একেলা সে বসে থাকতে চায়। যদিও অপার সময় নেই তার আগেকার মতো। এখন সে প্রভূত কাজ করে। কারণ অনির্বাণ পোদ্দার সে দায়িত্ব দিয়েই শুধু নিশ্চিন্ত থাকে না। কাজ বুঝে নেয়। খোঁজ রাখে সর্বাংশে। ইদানীং বিবাহ করে সে খুশি। তবু উদ্বেগ আছে তার। অস্বস্তি আছে। কারণ বোল্ডার দিয়ে পাড় বাঁধাবার অনুমতি মেলেনি এখনও। সকলেই রয়ে গেছে বর্ষার অপেক্ষায়। 

.

চৈত্রের বিভ্রান্ত দুপুরে, যত দূরে চোখ যায় রৌদ্রের ঝিলিমিলি, মাটি হতে উঠে আসছে পোড়া- পোড়া গনগনে তাপ, সে এসে বসেছিল বলাই মণ্ডলের আমবাগানে। 

নদী খেয়ে নিচ্ছে বাগান। তবু এ বাগান কী স্নিগ্ধ! কচি-কচি আমের কুশিতে সেজে আছে গাছগুলি। মুকুলের গন্ধ, বউলের গন্ধ এখনও বাতাস ভরেছে। কেননা কিছু গাছ এখনও মুকুলিতই শুধু। ফল ধরে নাই তাতে। এরা আগফলনের গাছ নয়। আর সমস্ত শাখাপ্রশাখার অগ্রভাগে চকচকে গোলাপি পাতা সাজানো থরে থরে। হঠাৎ দেখলে যেন মনে হয় উত্থিত শিশুভাগ! 

সে গাছে ঠেস দিয়ে দেখছিল। চেয়েছিল নদীপানে। জোয়ার লেগেছে। নাকি ভাটির মুহূর্ত এসে পড়ল! জোয়ারের জল টেনে টেনে নিয়ে যাবে সমুদ্দুরে। সে দেখছে। ভাবছে। জেলেঘরে জন্ম হয়েও সে জেলে নয়। জানে না কিছুই সে জলবিজ্ঞান। 

তখন কারও হেঁটে যাওয়া শুনল সে। আমবাগানের মধ্যে দিয়ে জেলেপাড়ায় অহরহ যায় লোক। সে তবু, কৌতূহল বিনাই, তাকাল গাছের আড়াল হতে। কেননা এ-ও ঠিক, এ আমবাগান, নানাবিধ রহস্য ঘিরে রাখে। লিখে রাখে, বহু প্রেমিক ও প্রেমিকার বিধিলিপি-সংবাদ। 

সে তাকাল! আর স্তম্ভিত হয়ে গেল! হৃদক্রিয়া উথালি দিল বুকের খাঁচায়! ও কে? ও কে? ও যে মায়মুনা! হ্যাঁ হ্যাঁ মায়মুনা! এই নির্জন দুপুরে, চৈত্রের ঝাঁ-ঝাঁ আমবাগানে কেন এল মায়মুনা? একলা এল কেন? 

তার ভুবন টালমাটাল হল। অস্তিত্ব টালমাটাল হল। অনিবার ইচ্ছা চালিত করল তাকে! একবার, মাত্র একবার কাছে পেতে পারে না সে? এই নির্জনে? কে জানবে? যদি দেখে ফেলে কেউ? কে দেখবে এই উন্মত্ত দুপুরে? 

সে সকল সম্ভাবনা ঠেলে-ঠেলে দেয়। ইচ্ছাশক্তির দ্বারা তামাম দুনিয়াকে আমবাগানের বাইরে প্রতিহত রাখে। নিষেধের তর্জনী তুলে বলে—দাঁড়াও! খবরদার! এক পা এগোবে না! আমার মেয়েমানুষটাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে দাও তোমরা! সে ইচ্ছার তীব্র পীড়নে পায়ে পায়ে এগোয় মায়মুনার দিকে। কী যেন খুঁজছে মায়মুনা। কী খুঁজছে? 

সে পিছনে দাঁড়ায়। ডাকে। কেঁপে যায় স্বর তার—মায়মুনা! 

চমকে ফিরে তাকায় মায়মুনা। দু’চোখে ত্রাস, লজ্জা, বিহ্বলতা মেশামিশি তার। সম্পর্কে দেবর-ভাজ। তবু এত কেন লজ্জা মেয়েটির? তার নিজেরও অন্তরে অরুণবর্ণ প্ৰণয় আছে বলেই তো? সে অনড় দাঁড়িয়ে থাকে। চোখের পলকও ফেলতে ভুলে যায়। কী এক ঘোরের মধ্যে মোবারক আলি বলে – মায়মুনা, মায়মুনা… 

তার কথা হারিয়ে যায়। কতবার মনে মনে বলা সংলাপ এলোমেলো হয়ে যায়। সে ভেঙে ভেঙে থেমে থেমে বলে—তুমি আমার….বুকের…তুমি আমার… আকাশের চান্দ…মায়মুনা… 

—না না না! 

মায়মুনা দু’ হাতে কান চাপা দেয়। পালিয়ে যেতে চায়। তার পলায়নপর হাত ধরে ফেলে মোবারক। মায়মুনার ঘোমটা খসে পড়ে। খোঁপা ভেঙে চুল ছড়িয়ে পড়ে পিঠময়। মোবারক প্রলাপের মতো বলে—একবার! মায়মুনা! একবার! আর না! একবার! 

—না না না! আমারে ছাড়িয়া দ্যাও মিঞা! ছাড়িয়া দ্যাও আমারে! 

মায়মুনা কাতরায়। তবু যেন ঘন হয়ে আসে। দূরে যাবার তরে আকুলতা দর্শায়, তবু যেন নিবিড় হয়ে আসে। কাঙ্ক্ষিতের সমীপে আসার ক্ষুধিত লুক্কায়িত কামনা, সাধ, তাকে ঠেলে ঠেলে দেয়…এবং সহসা বজ্রপাত হয়। মাটি ফাটিয়ে, আকাশ বিদীর্ণ করে, চিৎকার বাজে— মায়মুনা! ছেনাল মাগি! তোর মনে মনে এত! 

মোবারক আলির হাত খসে যায়। মায়মুনা এক ঝলক তাকিয়ে সাদা হয়ে যায়। বিশাল বিপুল পাহাড়ের মতো কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আকবর আলি। পাশে ইসমাইল। প্রকাশ 

হায়! কোথায় গিয়েছিল তারা? এ সময়ই এল কেন আমবাগানে? জীবনে অভিসারের এই শ্রেষ্ঠ সময়! 

মায়মুনা ছুট লাগাতে চায়। পালিয়ে যেতে চায় দুরে। ইসমাইল ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। এলোপাথারি কিল-চড় মারতে থাকে। প্রকাশ কোনও কথা না বলে উল্টোদিকে চলে যায়। আকবর আলি বলে—ওকে ছেড়ে দে ইসমাইল। 

ছাড়া পেয়ে আর দৌড়য় না মায়মুনা। ধীর পায়ে হাঁটে। উপলব্ধি হয়ে গেছে তার। অযথা পলায়নে কী বা লাভ! সে রক্তহীনের দৌর্বল্যে, দৃষ্টিহীনের শূন্যতায় শ্রান্ত ক্লান্ত অবসন্ন পায়ে হাঁটে। আকবর আলি মোবারক আলির দিকে আগুন-চোখে তাকায়। তারপর মায়মুনাকে অনুসরণ করে। 

মোবারক আলি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর সে-ও চলতে থাকল ঘরমুখো। তার সকল বুদ্ধি গুলিয়ে গিয়েছে। সে জানে না কী হবে! তবু, এমত পরিস্থিতিতে মায়মুনাকে একা সে ছেড়ে দিতে পারে না! অতএব চলেছে সে ভূতগ্রস্তের মতো। 

গৃহে ফিরে ঠা-ঠা রোদ্দুরে আঙিনায় বসে পড়ল মায়মুনা। যেন খোলা আকাশের নীচে পিঠ পেতে দিল। কত মারবে ওরা? মারুক। সে সহ্য করবে। সকল মার সে সয়ে যাবে নীরবে। কিন্তু আকবর আলি তাকে মারল না। নীরবে দেখল কিছুক্ষণ। ইসমাইল দাওয়ার এক কোণে বসে আছে মুখ নিচু করে। বোনের এ অপরাধে গ্লানিময় মুখ তার। 

আকবর আলির চোয়াল শক্ত। চোখ রক্তবর্ণ। সে ডাকল মহম্মদ আলিকে। ডাকল খালেদাকে। আফসানাও এসে দাঁড়াল পায়ে পায়ে। কী হয়েছে? কী হয়েছে? প্রশ্ন সকলের। আকবর আলি বলল—ছোটবিবিকে তালাক দেব আমি। 

—কী! 

মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে শুরু করল আফসানা। তার দুঃখ হয়েছিল আকবর আলি নিকে করেছিল বলে। কিন্তু এমন সর্বনাশা দণ্ড তো মাঙেনি সে খোদাতায়ালার কাছে! 

ইসমাইল ত্রস্তে তাকাল আকবর আলির দিকে। অস্ফুটে বলল—দুলাভাই! 

মহম্মদ আলি বললেন—কী হয়েছে কী? 

গোটা গোটা অক্ষরে, স্পষ্ট উচ্চারণে, যা দেখেছে সবিস্তার বলে গেল আকবর আলি। তার স্বর কাঁপল না। ঝাঁ-ঝাঁ রোদ্দুরেও কণ্ঠ শুকিয়ে গেল না! 

খালেদা অবাক গলায় বললেন – মায়মুনা তো তেমন মেয়ে নয়। কী রে মায়মুনা? কেন গিয়েছিলি আমবাগানে? বল তো মা? 

মায়মুনা নীরব। মোবারক আলি এসে দাঁড়িয়েছে তখন। সে বলল—মায়মুনার দোষ নেই। আমিই ওর হাত ধরে টেনেছিলাম! 

ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল সকলের চোখ-মুখ। আকবর আলি বলল—মায়মুনা নিজে তা বলুক। বলুক ও কেন গিয়েছিল। কী হয়েছিল। 

খালেদা তাড়া দেন—বল, মায়মুনা, বল। 

আফসানা জড়িয়ে ধরে মায়মুনাকে। কথা বলতে প্ররোচিত করে তাকে। কিন্তু মায়মুনা নীরব নিথর থাকে আগাগোড়া। 

আকবর আলি বলে—ও নষ্ট ছেনাল মেয়ে। আব্বা, ওকে তালাক দেওয়াই সাব্যস্ত হল তা হলে? 

মোবারক আলি এগিয়ে এল তখন। দাঁড়াল আকবর আলির মুখোমুখি। বলল—একটা নিষ্পাপ মেয়েকে গালি দিয়ো না বড়ভাই! অত তালাক-তালাক ভয় দেখাচ্ছ নাকি? দাও তালাক! আমি বিয়ে করব ওকে। কী ভেবেছ? ওর যাবার ঠাঁই হবে না? 

মায়মুনা কেঁপে ওঠে আফসানার দুর্বল আলিঙ্গনে। নিষ্ঠুর হাসে আকবর আলি। বলে—তাই নাকি? এই তা হলে মতলব তোর? মোবারক? তা হলে তো ছাড়া যায় না ওকে। কী বল? তালাক তো দেওয়া যায় না তা হলে? 

মোবারক আলি নির্বোধ চেয়ে থাকে আকবর আলির দিকে। তখন মহম্মদ আলি একটি বাঁখারি তুলে নেয়। ‘পাজি নচ্ছার হারামজাদা, আপনা ভাবি মা সমান, তার দিকে তুই নজর দিস’ বলতে বলতে পিটতে থাকেন মোবারক আলিকে। মোবারক আলি প্রতিরোধ করে না। মার খায়। মারের চোটে গায়ে দাগ পড়ে এবং বাঁখারি টুকরো টুকরো হয়ে যায়। মোবারক আলিকে আড়াল করার জন্য আসে না একজনও। একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন মহম্মদ আলি নিজেই। ধাক্কা দেন তিনি মোবারক আলিকে। বলেন—বেরো। বেরিয়ে যা। এ বাড়িতে তোর জায়গা নাই। দোজখের পোকা তুই! সংসারের বিষ! এ বাড়িতে তুই কোনওদিন ঢুকবি না! 

মোবারক আলি ঘরে গেল। দু-চারটে জামাকাপড় তার নিয়ে, বেরিয়ে পড়ল চুপচাপ ফিরেও তাকাল না। শুধু তার দুই চোখে জ্বলতে লাগল আগুন॥ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *