2 of 3

রাজপাট – ৯৫

৯৫ 

এই মাস গেল কন্যার 
না পুরিল আশ। 
লহরী যৌবন ধরি 
নামিল ফাল্গুন মাস ।।
ফাল্গুন মাসে হে কন্যা 
ফাগুয়া খেলায় রাজা। 
ডালমূল ভাঙিয়া যখন 
কুহুলি তোলায় ভাষা ।। 
তোলাও রে তোলাও রে কুহুলি 
পাড়িয়া মারিম ছাও। 
আমার দেশে নাই সাধু 
সাধুর দেশে যাও ।।
গাছে থাইক্যা পঞ্চ কথা 
সাধুরে বুঝাও রে কুহুলি 
সাধুর দেশে যাও ।।

.

অনাবৃষ্টির শুষ্কতা সত্ত্বেও, নীরস পৃথিবীর ওপর নেমে এসেছে বর্ণময়, রসঘন বসন্ত। শিমুলে পলাশে লেগেছে ঘোর লাল। বর্ষা কৃপণ ছিল। কিন্তু বসন্তের এই রূপজ্যোতিতে কোথাও কার্পণ্য নেই। আমবাগানে যথারীতি আমের বউল এসেছে। দক্ষিণা হাওয়ায় তার গন্ধ ভেসে যায়। 

ইতিমধ্যে সুকুমার পোদ্দারের আমবাগান হতে নদীগর্ভে গিয়েছে চারটি আমগাছ। বলাই মণ্ডলের গিয়েছে ছ’টি। শোনা যাচ্ছে, সুকুমার পোদ্দার পুরনো গাছগুলি কেটে বিক্রি করে দেবেন কাঠ। নতুন গাছগুলি থাকবে, থাকে যতদিন। 

মরণোন্মুখ সমস্ত গাছ, আয়ুর কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে সব। তবু তারা মুকুল ফুটিয়েছে। রেখেছে ফলের বাঙ্ময় প্রতিশ্রুতি। 

ধরিত্রী কুসুমবতী এখন। রসোধরা। শুধু ফসল যাদের ফলল না, তাদের দৃষ্টি হতে বসন্তের রঙ মুছে গেছে। শিমুল, পলাশের ডালে বা বকুলকুঞ্জ হতে ডেকে উঠছে কুহুলি কোকিল, কিন্তু মানুষের মন পড়ে আছে বর্ষা ঋতুর অপেক্ষায়। সকলেরই হৃদয়ে এক আকুল প্রার্থনা—এসো এসো এসো বর্ষা! নীলচন্দ্রাতপমণ্ডিত এ ধরণীকে ঢেকে দাও মেঘচ্ছায়ায়। 

বর্ষা, বর্ষা, বর্ষার অপেক্ষা। এসো বরষা এসো। কতজনা, কতরকমে তারে চায়। বলাই মণ্ডল চান, আসুক বর্ষা, সবুজ ফসলে ঢেকে যাক ধু-ধু মাঠ। সুকুমার পোদ্দার চান, বর্ষা আসুক। বোল্ডার ফেলার অনুমতি পেলেই, আহা, কোটি কোটি কোটি কোটি। আকবর আলি চায়, বর্ষায় ভরে যাক নদী। অসংখ্য ইলিশ এসে ধরা দিক জালে। আর অলক ঘোষাল চায়, বর্ষা আসুক তার ঘরে। 

কিন্তু হে বর্ষা, তার যে আসতে অনেক দেরি। সেই ফাঁকে ঘটে যাক দু’একটা জরুরি কাজ। এমনই জরুরি অনির্বাণের বিবাহ। হেমকলস গ্রামের প্রাণেশ রায়ের মেয়ে লাজুর সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত বিবাহ হচ্ছে তার। এই ফাল্গুনেই। সুতরাং পোদ্দারবাড়িতে ব্যস্ততার অন্ত নেই এখন। ব্যস্ততা এমনকী সারা চতুষ্কোনা গ্রামে। কারণ একমাত্র ছেলের বিবাহ-মহোৎসবে নিমন্ত্রিত হবে সারা গ্রাম। কাজে-কর্মে অংশও তাদের নিতে হয় অতএব। সুকুমার পোদ্দার গ্রামের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তিনি যাকে যা আদেশ করবেন, যে-দায়িত্ব দেবেন, যেখানে যেতে বলবেন, সকলই পালনীয়। এ বিষয়ে কারও কোনও অভিযোগ-অপ্রীতি নেই। 

তবে সকল ব্যস্ততার মধ্যে অধিক হল শিখারানি এবং অলক ঘোষাল। হোমযজ্ঞের বিপুল আয়োজনে গত ছ’দিন তাদের কোনও বিশ্ৰাম ছিল না। 

অনির্বাণ পোদ্দারের বিবাহিত জীবনে যাতে কোনও দুরাত্মা বিঘ্ন না ঘটায়, তারই জন্য এ আয়োজন। 

অনির্বাণের নামেই জ্বালা হয়েছে এ কুণ্ড। অনির্বাণ অগ্নিকুণ্ড। সাতদিন ধরে এ কুণ্ড নিভবে না।

পূর্ণ চক্রবর্তীর নিকট হতে কিছু-বা পূজাবিধি শিখেছে অলক এবং হোমযজ্ঞে তার প্রয়োগ ঘটিয়েছে। কিন্তু তাতে তার বিশেষ কোনও সুবিধা হয়নি। লোক আসছে। পায়ে পড়ছে শিখারানির। ইতিমধ্যে সে যে-প্রচার ঘটিয়েছিল গ্রামময়, তার দ্বারা ভক্তি অধিক উপচিয়ে উঠেছে। গ্রাম হতে লোক আসছে। গ্রামান্তর হতেও। বেশিরভাগই নারী। তাদের ভুলুণ্ঠিত প্রণাম পেয়েও দেবীগোত্রীয়া শিখারানির মনে সুখ নেই। সে স্তম্ভিত। ভাবিত। কোনওকিছুর আদি-অন্ত পাচ্ছে না সে। 

এক-একজন আসছে আর বলছে এক-একরকম কথা। 

—মা! মাগো! আমাদের ছেড়ে যেয়ো না মা! 

সে বিস্ময়ে বলেছে—তোমাদের ছেড়ে কোথায় যাব? 

উত্তর পেয়েছে—মাগো! দেবী তুমি! সতীর অংশ! তোমার লীলা বোঝা ভার। তুমি যে বলেছ মা, স্বামী স্বর্গে গতি পেলে তুমি সহমরণে যাবে। আহা! কী ভক্তি গো! একালে এমন পতিভক্তি দেবী ছাড়া আর কার হবে? স্বামী তোমার শতায়ু হোক মা, কামনা করি, তুমি আমাদের মাঝে থাকো। 

শিখারানি সচকিত হয়েছে। এমন বাসনা তো সে কারও কাছে প্রকাশ করেনি! সহমরণ! ভাবতেই শিউরে উঠছে সে। কিন্তু আপাতভাবে তাকে থাকতে হচ্ছে স্থির। দার্শনিক। সে বলছে—তা বললে কি হয় মা? যার যখন সময় হবে, সতী ডেকে নেবেন। অধিক পরমায়ু মানে তো অধিক দিন ইহভোগ। ইহকালের যন্ত্রণা। যত তাড়াতাড়ি ঈশ্বরের পদতলে পৌঁছোই ততই মঙ্গল। 

এত কথা সে শিখল কোথায়? কবে? শিখেছে। লোকের মুখেই লোকভজানো কথা শিখেছে। ইহকালের দুঃখ, পরকালের শাস্তি, আত্মার অবিনাশী শক্তি, ইত্যাদি হাজার শিখেছে। স্বার্থ তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছে বিশেষ যোগ্য করে। শৈশবের খেলা আজ তার জীবিকা। কিন্তু এই কথাগুলি বলার সময় তার অন্তরাত্মা ত্রাহি ত্রাহি করেছে। কীসের সহমরণ? কে মরতে চায়? সে তো মরণ আবাহন করেনি! প্রার্থনা করেনি। সে বরং স্বপ্ন দেখছে এক নতুন জীবনের। অমর ঘোষাল সুস্থ হয়ে উঠবেন। সে এক শান্তিনীড় গড়ে নেবে। নিষ্পাপ, নির্মল বাসা। গোটা আঙিনায় লাগিয়ে দেবে নয়নতারা, সন্ধ্যামালতীর চারা। ফুল ফুটে থাকবে সারাক্ষণ। 

অলক কী করবে? অলক? অলককে ছেড়ে দেবে সে? স্বপ্ন হতে বাস্তবে নেমে আসে সে। ভাবে। অলক অলক! অলক তার পীড়া, তার পীড়ন! অলক তার বিবমিষা, তার ক্লেদ! অলক তার পাপ, তার মিথ্যাচার! তবু অলক তার! তার একার। স্বামী তার সামাজিক বন্ধন। কিন্তু অলক তার অর্জন। স্বামীর প্রতি প্রেম যদি থেকে থাকে তার, তবে সেই প্রেম আরোপিত, বাধ্যতামূলক। স্বামীর প্রতি প্রণয় তার পূর্বেকার বিন্যস্ত কেশ। আর অলকের প্রতি তার প্রেম তার মাথার সমস্ত জটাজুটভার। অলককে সে ছাড়বে না। পাপের সঙ্গী সে, পাপ পাপ পাপের সঙ্গী, তার নগ্ন দেহের যাবতীয় আঁচড় কামড়, তার খোলা বুকে যাবতীয় লালা ফেলা! অলক ছাড়া তার চলে না, চলে না। 

তার অধিকারবোধ এমন, তীব্রতা এমন, সে সর্বনাশে ধায়, সর্বনাশে জাগে, সর্বনাশে ঘুমোয়, ঘুমোয়। যদি বিয়ে করে আনে অলক তাকে। সে বিষ দেবে। আগুন লাগাবে গায়ে। ওই ডবগা মেয়ের বুক-পেট খণ্ড খণ্ড কেটে ছড়িয়ে দেবে নুন-মরিচের গুঁড়ো। একবার বিয়ে করুক। 

কিন্তু কিন্তু কিন্তু! ভাবতে ভাবতে ঝিমিয়ে পড়ে সে। এলিয়ে পড়ে। এক নির্মল জীবনের স্বপ্ন ফের দেখা দিয়ে যায়। কোনও জটিলতা নেই। দারিদ্র্য নেই। রোগ-ভোগ নেই। দুমুঠো অন্নের জন্য পাপাচার নেই। এক মধুর জীবন, এক মধুময় ললিত জীবন তাকে ডাকে। ডাকে। অবস্তুগামী মন অমৃতধাবন হতে চায়। 

এই দোলাচলে বিদ্ধ সে, বিদীর্ণ অস্থির। ছটফট-ছটফট করতে করতে সে শুধু চায় চায় চায়।

কী? 

চায় জীবন! 

জীবন! 

মরণকে চায় না সে। ভাবে না। কখনও ভাবলেও জীবনের আকাঙ্ক্ষা মরণের সকল ইচ্ছার টুটি টিপে ধরে। তাকে দলে, মাড়িয়ে, লঙ্ঘন করে দেখা দেয় স্বমহিমায়। 

তা হলে? তা হলে এবম্বিধ প্রচার করল কে? কেন? হতে পারে, লোকে নিজেই গড়ে নেয় কথা। একজন কল্পনা করে এবং সেই কল্পনার ভাষা বিলিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে, লোকমুখে মূর্তি পেতে পেতে তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তার এই দেবী হয়ে ওঠা, সে-ও কি এমনই নয়? সতীর স্বঘোষিত অংশ কি নয় সে? 

.

সে কাজে মনোনিবেশ করতে চায়। অগ্নিকুণ্ডের আঁচে, এই বসন্ত সময়েও দরদর ঘামে। তার জটাজুটের তলে কুটকুট আকুলি-বিকুলি করে উকুনের ঝাড়-বংশ। তবু, ইদানীং, মনে মনে, দেবী সেজে সালংকারা হয়ে ওঠার সাধ যায় তার। আহা! কত অলংকার রয়েছে গোপন, সে ব্যবহার করতেও পারে না। সকলই অঙ্গে তুলতে ইচ্ছে যদি জাগে তার, দোষ কী! দোষ নেই। 

সে কাজ করতে করতে ভাবে। আজ তার দায়িত্ব বিরাট। অনির্বাণের ফুলশয্যার রাত আজ। আজই সে দুর্বিনীত দুরাত্মাকে ধ্বংস করবে পুরোপুরি। এ নিয়ে উদ্বিগ্নও সে। যদি এরপরও অনির্বাণ কিংবা পোদ্দারগৃহিণী তার দর্শন পেয়ে যায়! সে মন শক্ত করে। অলক বলেছে রাখো! ওসব ভূত-প্রেত সত্যি দেখে ভাবো নাকি তুমি? 

—তা হলে? 

সে জানতে চেয়েছে। অলক বুঝিয়েছে—ওসব মনের ভুল। যাগ-যজ্ঞ করলে মনে জোর পাবে। আর ওসব ভূত-পেত্নী দেখবে না। লোকে কী বলে জানো? 

—কী? 

—কাঁধ থেকে ফেলতে না পেরে অনির্বাণই কায়দা করে মেয়েটাকে মেরেছে।

-–এ কি সত্যি? 

শিউরে উঠেছে সে। কাঁধ থেকে নামাতে না পারলে তবে মেরে ফেলাই পথ! 

শেষ পর্যন্ত সাতদিনের যজ্ঞের জন্য সাত হাজার টাকা নিয়েছে তারা পোদ্দারগৃহিণীর কাছ হতে। মোটমাট হাজার টাকাও খরচ ধরলে ছ’ হাজার টাকা থেকে যাবে হাতে। কিন্তু তাতে তার লাভ কিছু নেই। সমস্ত টাকা অলক রেখেছে নিজের কাছে। কী করবে ওই টাকা দিয়ে অলক? অত টাকা সংসারে খরচ করবে, নাকি ওই মেয়েটাকে গয়না গড়িয়ে দেবে? ভেবে ঈর্ষায় জ্বলে যায় বুক। ঈর্ষাগ্নি সমেত সে হোমাগ্নির নিকটতর হয়। কলাপাতার ওপর, গোবরমাটি ছেনে, খড় মিশিয়ে তুলতুলির পুতুল বানাচ্ছে সে। একখানি ছবি সে সংগ্রহ করেছে তুলতুলির। অনির্বাণের কাছে ছিল। দু’পাশে দুই বিনুনি ঝোলানো নিষ্পাপ কিশোরী মুখের সাদা-কালো ছবি। একদা এই মুখকে অনির্বাণ ভালবেসেছিল। সারাক্ষণ এই মেয়েটিকে কাছে চাইত বলে ছবি রেখেছিল। সে-ই দিয়েছে বার করে। আজ অনির্বাণ এই মেয়েটিকে চায় না। মেয়েটির দর্শন চায় না। কেন না সে প্রেত এখন। কেন না সে অতীত। হায়! প্রেম অতীত হয়ে গেলে বড় অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে যায় প্রেমের আধার। 

এখন সন্ধে নেমেছে। বাইরের লোককে আর ঢুকতে দেওয়া হবে না। সে আর অলক কাজ সাজাচ্ছে। এই ক’দিন গা ঘেঁষাঘেঁষি কাজ করতে করতে অলক কিছু-বা নরম। সে-ও, কী এক তাড়নায়, কামিনী হয়ে উঠেছে। যাগ-যজ্ঞের সময় যা করেছে সে, এবং এখন, দেহে ব্লাউজ রাখেনি, পূজাকালে শরীরে চুঁচ-বেঁধানো পোশাক রাখতে নেই। পরনে তার কেবল এক শাড়ি অতএব। মাঝে-মাঝে, নানা ছলে, সে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে তার স্তন। সতেজ। ঈষৎ ভারী। এবং বড় পুষ্ট বৃত্ত দু’টি তার। ইতিমধ্যেই অলক দু’আঙুলে নিষ্পেশিত করেছে। এখন সংযত তারা। ঢাকাঢুকি। সুমিত্রা আসবেন। মাঝে মাঝে এই জগৎ, এই জীবন, এই সম্পর্কসমূহ তার কাছে বিস্ময়কর রকমের যৌনার্থ হয়ে যায়! জীবনধারণের জন্য খাদ্য এবং জীবন মানেই যৌনতা সে লক্ষ করে চারিপাশে। হয়তো, যদি মা হতে পারত তা হলে জগৎ অন্য অর্থে ধরা পড়ত তার অনুভবে। 

সে বিবিধ ভাবতে ভাবতেই সুমিত্রা উপস্থিত হলেন। বাড়িভর্তি লোক। হাতে তাঁর সময় নেই বেশি। উৎসব-অনুষ্ঠানের পাশ কাটিয়ে এসেছেন। আর এসেই গড় করেছেন তিনি শিখারানির পায়ে। এবং শিখারানি সুমিত্রার মাথায় হাত রাখল নির্দ্বিধায়। তার চোখ মায়াবী। দেহ শান্ত। মুখে মৃদু হাসি। সে বলল—সব ভালয় ভালয় হয়ে যাচ্ছে তো মা? 

সুমিত্রা উদ্বেল। বললেন—তোমার কৃপায় এখনও পর্যন্ত সব ঠিক আছে। আজ রাতটুকু পেরোলেই আর তো বিঘ্ন নেই মা? 

শিখারানি বলল—না। যতক্ষণ দুই দেহ পৃথক, ততক্ষণ আত্মা মাঝখানে দাঁড়াবার অবকাশ পায়। দুই দেহ এক হলে, মা, বিবাহ হল জন্ম-জন্মান্তরের মিলন, সে মিলনের পরে আর তৃতীয়ের স্থান কোথায়? সে দেহী হোক বা বৈদেহী, তার স্থান নেই। 

—মা, মাগো, আশীর্বাদ করো মা। মানসিক করেছিলাম, সব ভালয় ভালয় কাটলে সতীমাকে একগাছি মটরমালা গড়িয়ে দেব। মাগো, তুমি তা গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করো। 

শিখারানির বুকে ঝলক লাগে। মটরমালা! সে কি সোনার? সোনার 

আপাতভাবে নিরাসক্ত থাকে সে। সুমিত্রা একটি ছোট কাপড়ে খুতি থেকে বার করেন সোনার মটরমালা। পূজাঘরের স্তিমিত আলোর নীচেও সেই অলংকার হতে বিভা ঠিকরোয়। অলকের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। শিখারানির দৃষ্টিতে তা ধরা পড়ে যায়। অলক বলতে চায়, এইখানে, এই পাথরে রাখুন ওই স্বর্ণহার! কিন্তু তার বলার আগেই সুমিত্রা হারখানি শিখারানির গলায় পরিয়ে দেন। অলক হতাশ বোধ করে। হারখানি দেখামাত্র সে বর্ষার কণ্ঠশ্রী কল্পনা করেছিল। অতএব, হতাশভাবে সে শুনতে থাকে সুমিত্রা বলছেন—মা, তুমি সাক্ষাৎ সতী। দেবী তুমি। আমার এই সামান্য অঞ্জলি নাও। 

আপ্লুত উল্লসিত শিখারানি জটাজুট নাড়িয়ে বলে—পাগলি মা তুমি। কী দরকার ছিল এসবের? আমি সামান্য জন। এসবে আমার কোনও আকর্ষণ নেই। 

সুমিত্রা বলেন-তুমি তো সামান্যা নও। এই তুচ্ছ বস্তুতে তোমার কী প্রয়োজন! কিন্তু আমার তো মন মানে না মা। আমরা সাধারণ লোক। মাকে সাজাতে ইচ্ছে করে। মাগো, আশীর্বাদ করো মা! আমি আজ আসি। বাড়িতে কত লোক! চরণে প্রার্থনা করি মা! সুস্থ সুন্দর নাতির মুখ দেখতে দিয়ো। নির্বিঘ্নে বংশরক্ষা হয় তা দেখো মা! সোনার মুকুট গড়িয়ে দেব তোমাকে মা। 

—থাক থাক! মা, থাক! 

শিখারানির বুক ধুকধুক করে। সাগ্রহে কামনা করে সে। হোক হোক, খোকা হোক। একটা কেন? জোড়া হোক। যমজ হোক। কিন্তু, কিন্তু এত সুখ শিখারানির কপালে সইবে তো? সোনার মুকুট পরার কপাল তার? সে শান্তভাব বজায় রেখে বলে—হবে মা! তুমি পুণ্যবতী! তোমাকে দেখেই বুঝি, তুমি শুদ্ধাত্মা মাগো! তোমার বংশের প্রদীপ হবে খুব বড়মানুষ। খুব ধন করবে। যশ পাবে। এই আমি বলে দিলাম। 

সহসা সে চিৎকার করে! উঁচু গলায় বলে—সতীমায়ের আশীর্বাদ যদি থাকে আমার ওপর তবে আমার কথা ফলবেই মা, ফলবেই। 

এক মুহূর্তে অলৌকিক হয়ে যায় প্রতিবেশ। সুমিত্রার দেহ কণ্টকিত হয়। শিখারানিকে পুনঃপ্রণাম করে তিনি বলেন—মা। অনুমতি দাও। 

শিখারানি বলে—হ্যাঁ মা। এসো তুমি। মনে আছে তো? রাত্রি ঠিক বারোটায়।

—হ্যাঁ মা। বারোটায়। 

সতীমায়ের নির্দেশ। রাত্রি ঠিক বারোটায় নগ্ন দেহে পরস্পর লগ্ন হবে অনির্বাণ ও লাজু। নতুন দম্পতি তারা। সেই সংলগ্নতায় যদি সঙ্গম হয় হোক, না যদি হয়, তবু যেন লিঙ্গ স্থাপিত হয় যোনির ওপর। 

গতরাত্রে শিখারানি নিজে গিয়েছিল পোদ্দারবাড়ি। কালরাত্রির পৃথক শয্যায় বসে ছিল লাজু। কোমল মেয়েটি। লাবণ্যবতী। সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে তাকে দেখাচ্ছিল বড়ই লক্ষ্মীমন্ত। 

তাকে ঘিরে বসেছিলেন সুমিত্রা ও শিখারানি। সুমিত্রা বলেছিলেন—ইনি যা বলবেন, মন দিয়ে শোনো। তেমন তেমন সব করবে। তোমাদের কল্যাণ হবে তাতে। 

লাজু মুখ নিচু করে শুনছিল। শিখারানি বলছিল। বলতে বলতে তার নিজেরই রসোৎপত্তি ঘটছিল ভিতরে। কুমারী জীবনের প্রথম পুরুষ স্পর্শ! ওঃ ওঃ! কী দারুণ অনুভূতি! কী অপার্থিব সুখ! 

আর শুনতে শুনতে লাজুর মুখ লাল হয়ে যাচ্ছিল। বিশেষত শাশুড়ি সমীপে সে কুঁকড়ে যাচ্ছিল লজ্জায়। কিন্তু উতলা আতঙ্কিত সুমিত্রার সে-বোধ ছিল না। গোটা প্রক্রিয়াকেই তিনি দেখছিলেন কল্যাণী যজ্ঞের অঙ্গ হিসেবে। 

এবং লাজুকে শিখিয়ে পড়িয়ে শিখারানি গিয়েছিল অনির্বাণের কাছে। অনির্বাণ মনোযোগে শুনেছিল সব। তারপর বলেছিল- বিয়ের যজ্ঞ যখন হয়, হাত উৎসর্গের সময়, সে এক ঝলক, মাত্র এক ঝলক, লাজুর পরিবর্তে দেখেছিল তাকে। তারপর মিলিয়ে গিয়েছিল। কিছু-বা আতঙ্কিত সে, খুঁজেছিল আশেপাশে! যদি দেখা যায়! কিন্তু আর সে আসেনি। 

শিখারানি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিল—নিশ্চিন্ত হও। ফুলশয্যা হয়ে গেলে আর সে আসবে না! কোনওদিন আসবে না! 

.

সুমিত্রা চলে যেতেই অলক বলল— হারটা খুলে দাও। 

ফুঁসে উঠল শিখারানি—কেন? এটা আমার। আমাকে দিয়েছে। 

—ইস! তোমার! 

মুখ বিকৃতি করল অলক। বলল—এটা সতীমায়ের সম্পত্তি। তোমার কী করে হয়! 

—এটা আমার। তুমি টাকা নিয়েছ। অতগুলি টাকা। তা হলে আজ থেকে সব আধাআধি ভাগ হোক। 

—আধাআধি? তা তোমার ও তোমার স্বামীর পেটখোরাকির ভারটাও তুমিই নাও তা হলে!

—বেশ। তাই নেব। আমার আর তাঁর আলাদাই রান্না করব আমি। খরচখরচা আমি বুঝব। উত্তেজনার মাথায় কথাগুলো বলেই শিখারানির মনে হল, এ কী করছে সে! এ কী বলছে! খাল কাটছে প্রশস্ত নিজেরই হাতে। এবার এসেই পড়বে স্বয়ং কুমির! সে সুর নরম করল। খানিকটা আপোস রফার ধাত। বলল— আর তোমরা যাবে কোন চুলোয় শুনি। 

—সে আমাদেরটা আমরা বুঝে নেব। 

—তা তো বলবেই। পরের মেয়ে না আমি। এখনও আপন ভাবতে শিখলে না। 

তার গলায় অভিমানের খাঁটি টান। অলক চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল— প্রথম থেকেই তো কথা ছিল, যা আয় হবে, সব আমার কাছে জমা থাকবে। 

—কথা কিছুই ছিল না। তুমি আর আমি তো কোনও চুক্তিপত্রে সই করে কাজে নামিনি অলক। প্রথম থেকে এমনটাই হয়ে আসছে যে টাকাপয়সা তুমিই রাখছ। আমি কিছু বলিনি কারণ তোমাকে আমি আপনার বলেই ভেবেছি। 

—খুব কথা শিখেছ দেখছি তুমি! 

—শিখব না! এতটি বছর কথা দিয়েই না চালালাম। সরল সাধারণ মেয়ে ছিলাম। এই সংসারই আমাকে জটিল-কুটিল করে তুলল। এই না আমার কপাল! এককালে সব হারিয়ে তোমাকে সাথী পেয়েছিলাম। ভাবলাম, তবু তো একজন আমার আছে। আজ আমার কপাল আবার পুড়েছে। আজ আমার গলায় সোনা দেখে তোমার চোখ কটকটায়। কারণ আমি সব বুঝি 

—কী! কী! কী! কী বোঝো তুমি? 

—এ হার অন্য কারওকে দেবার মতলব তোমার। 

—না। কখনও না। এ সতীর সম্পত্তি। দেবীর সম্পত্তি। একে আলাদা করে সরিয়ে রাখব আমি। 

শিখারানি ঠোঁট মুচড়ে হাসে। অলক তার কারণ নির্ণয় করতে পারে না। বুঝতে পারে না তার অর্থ। শিখারানি ভাবছে তখন, সতীর সম্পত্তির তুই কী বুঝিস রে মাগচাটা মিনসে? হারামজাদা? যেই রূপ দেখলি, ওমনি ঢলে পড়লি! জানতেও পারলি না কোন সাত রাজার ধন আছে আমার। 

অলক ভাবছে, এই মহিলা কি শাপশাপান্ত করবে? বাণ মারবে বর্ষার উদ্দেশে? নাকি মেরেছে এরই মধ্যে! ডানদিকের কাঁকালে মাঝে মাঝে ব্যথা ওঠে বর্ষার ইদানীং। তখন তার মুখ-চোখ নীলচে দেখায়। শরীরের সব শক্তি ফুরিয়ে গিয়ে তাকে করে তোলে হতচেতন। পূৰ্ণ চক্রবর্তী চিন্তিত। থানকুনির রস দিচ্ছেন মেয়েকে। পুনর্নবার রস দিচ্ছেন। বলছেন, আর দিন কয়েক দেখে নিয়ে যাবেন বহরমপুরের হাসপাতালে। সুতরাং ভয় করছে অলকের। শিখারানি বাণ মারতে পারে এমন সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিতে পারছেন না পূর্ণ চক্রবর্তী নিজেও। নইলে ভাল সুস্থ মেয়েটি হঠাৎ এমন ব্যথাকাতর হয়ে উঠবে কেন! 

পূর্ণ চক্রবর্তী বলেছেন—এইবার ব্যবস্থা করো। ব্যবস্থা করো অলক। 

ব্যবস্থা করতে চায় সে। শুধু সাহস অর্জন করে উঠতে পারছে না। কিন্তু এবার ব্যবস্থা নিতেই হবে। আর উপায় নেই। বর্ষা বর্ষা বর্ষা! বর্ষা তার চক্ষের মণি, বক্ষের ধন। তার কোনও ক্ষতি অলক সইতে পারবে না। জানে। শিখারানি জানে কিছু। নইলে এত লোক, এতজন বশ মানে! পোদ্দার গৃহিণী পর্যন্ত সোনার হার গলায় পরিয়ে দিয়ে যায়! তার বুক গুড় গুড় করে। এই আত্মা তাড়াচ্ছে শিখারানি, কিছু না জানলে পারে কী করে? এই এতসব নিয়মকানুন, পুতুল বানানো, ছবি সামনে রেখে হোম-যজ্ঞ করা, এই এতসব শিখারানি জানত বুঝি আগেই! নাকি সতীদেবী তাকে স্বপ্নে সব বলে দিয়ে যান। অথচ পূর্ণ চক্রবর্তীর কাছে সে শুনেছে, এবম্বিধ পদ্ধতি অনুসরণ করেই থাকেন গুণিন কিংবা তন্ত্রজ্ঞ সাধু-সন্ন্যাসী-কাপালিকের দল। 

নিজের হাতে গড়া পুতলিকে নিজেই অতএব ভয় পেতে থাকে অলক ঘোষাল। আরও বেশি শক্তিধারিণী হয়ে ওঠার আগেই নিকেশ করে দিতে হবে সমস্ত সম্ভাবনা—এমনই সে অটল হয়ে উঠতে থাকে ক্রমশ। 

শিখারানি বলে তখন—এসব ভাবনা এখন থাক না অলক। সতী মায়ের গয়না পরে পালিয়ে তো যাচ্ছি না আমি। এর মীমাংসা পরে কোরো। 

অলক, শিখারানির কথায়, প্রথমে চমকে উঠেছিল। এবার আর কথা বাড়াল না সে। চুপচাপ হোমকুণ্ডের জন্য ছোট ছোট করে কাটতে লাগল কাঠ। শিখারানি গোবরমাটি ও খড় দিয়ে বানানো পুতুলের মুখে বসাতে লাগল আতপ চালের চোখ নাক ঠোঁট ভুরু। অপরিপক্ক দু’টি বেলফল বসিয়ে গড়ে তুলল স্তন। কানে দিল করবীফুলের দুল। সিঁথিতে দিল জবাফুলের মঞ্জরি। তুলতুলি নামের রেলে কাটা-পড়া অতীত মেয়েটি, অতএব, গোবর-মাটি ফল-ফুল দ্বারা আরও একবার ধ্বংস হওয়ার জন্য জন্ম নিতে থাকল নতুন করে দৈবীশক্তিসম্পন্ন নারী শিখারানির হাতে। গাঁদাফুল দিয়ে সে বানাচ্ছে চুল যখন, অশোক এল। হাতের ব্যাগ নিয়ে সরাসরি ঢুকে এল পূজার ঘরে। ঢুকেই বলল—বউদি, এই ব্যাগটা কোথায় লুকনো যায় বলো তো? 

একটু থমকে ফের বলল—তোমরা এখনও এ ঘরে? কিছু বিশেষ ব্যাপার নাকি? 

এবার তার চোখ গেল শিখারানির কণ্ঠদেশে। চোখ গেল কেবল কাপড়ে ঢাকা উত্তুঙ্গ স্তন দু’টির দিকেও। বহুদিনের উপোসি শরীর তার অস্থির উদ্বেল হল। কিন্তু সকল ছাপিয়ে চোখ ফের স্থির হল কণ্ঠে। দৃষ্টি ঝিকিয়ে উঠল তার। সে বলল—আরে! গলায় ওটা কী পরেছ! আসলি না নকলি? 

শিখারানি জবাব দিল না। অশোকের চোখের ঠিকরোনো লোভ সে স্পষ্ট দেখেছে। কিন্তু কথা বলল অলক—আসলি, আসলি। 

—বলিস কী! দেখি দেখি! কোত্থেকে এল! 

কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে অশোক। অলক বলছে— পোদ্দারের বউ দিয়ে গেছে।

—বলিস কী! 

অশোক হাত বাড়াচ্ছে শিখারানির গলার দিকে। 

—সরো। সরে যাও। 

ধমকে উঠছে শিখারানি। গোবর মাটি তেল সিঁদুর আতপ চাল মাখা হাত তুলছে নিরস্তের ভঙ্গিতে। তার জটাজুটে নির্দেশ-ভঙ্গিমা। চোখে কড়া নিষেধ। হঠাৎ ফণা তোলা সাপিনীর মতোই সে হয়ে উঠল বুঝি-বা। 

অশোক থমকাল। শিখারানির এমন মূর্তি সে দেখেনি ইতিপূর্বে 

অশোকের উদগ্র লোভ অলককেও বিপর্যস্ত করেছে বুঝি। সে-ও ফুঁসছে অন্তরে। ওই হারে অশোকের কোনও অধিকার নেই। অশোক এর প্রতি দৃষ্টি দিলে সে ছাড়বে না কিছুতেই। সে বললও বউদির জিনিস। বউদি বুঝবে। তোর অত হাঁটকাবার কী দরকার! তোর ব্যাগে কী আছে? কী লুকোতে চাস? 

অশোক গুম হয়ে গেল একটু। অলক হঠাৎ শিখারানির পক্ষ নিয়ে কথা বলায় সে বিভ্রান্ত হয়েছে। সে জানে বর্ষার সঙ্গে অলকের আশনাই ঘোরালো হয়ে উঠেছে। আর শিখারানির সঙ্গে লেগেছে কুটিল অস্বীকারের যুদ্ধ। এরই মধ্যে এমন পক্ষাবলম্বন কেন? হঠাৎই বুদ্ধি ঝিকিয়ে উঠল তার মাথায়। এ কথার অর্থ হল, হারটির প্রতি অলকেরও লোভ রয়েছে। সে, এ বিষয়ের বক্তব্য আপাতত স্থগিত রেখে রাত্রে বোঝাপড়া করে নেবে বলে ভাবল। সে বলল— কিছু মাল আছে ব্যাগে। গতিক ভাল না। পুলিশ আসতে পারে। কোথায় লুকনো যায় এটা? 

শিখারানি আড়চোখে তাকায়। ব্যাগ সে কোথায় আলাদা করে লুকোবে? তারই কথার প্রতিধ্বনি তোলে অলক। বলে—পুলিশ এলে কি রেখে-ঢেকে খুঁজবে নাকি? যেখানে রাখবি, সেখানেই পেয়ে যাবে। তোর জন্য আমরা সব ফাঁসব। 

—এই ঘরে রাখ না। 

অলককে অনুরোধ করে অশোক। 

—খামোখা ঝামেলা পাকাস না। এই ঘর আমাদের রুটি-রুজি। এখানে পুলিশ হামলে পড়লে আর কি লোকে আসবে? 

অশোক পকেট হতে নোটের তাড়া বার করে। সোনার মটরমালা দেখে যে-লোভ ঝিকিয়েছিল অশোক ও অলকের চোখে, তারই কিয়দংশ ফুটে উঠল শিখারানির চোখেও। সে বলে উঠল— তা অশোক, এত টাকা আয় করছ, বউদিকে একটা শাড়িও কি কিনে দিয়েছ কখনও! 

অশোক ও অলকের চোখে অর্থপূর্ণ কথা চালাচালি হয়। পিঠোপিঠি ভাইয়ের নিজস্ব চোখের ভাষা। অলক বলতে চায়—আজ রাতে তো তুই নিবি। কিছু মাল ছাড়। 

অশোক বলতে চায়—যখনই আসি, তোর হাতে তো দু’চার পাত্তি দিই বাবা! সেসব কোথায় হাপিস হয়ে যায়? 

আপাতত পাঁচটি একশো টাকার নোট সে বাড়িয়ে দিল শিখারানির পানে। বলল— বউদি! তুমি হলে দেবী। সতীর অংশ। তুমিই আমাকে উদ্ধার করবে তা জানি। এটা রাখো। শাড়ি কিনে নিয়ো নিজের খুশিমতো। 

শিখারানি টাকা ক’টি নিয়ে আঁচলে বাঁধল। অলক বলল-তার মানে ব্যাগ রাখছ তুমি!

—রাখছি রাখছি। 

—কোথায় রাখবে শুনি। 

ঘরের কোণ দেখাল শিখারানি। খোলা কোণ। কোনও আড়াল-আবডাল নেই। অশোক সেখানেই ব্যাগ রাখল। শিখারানি, বড় বড় পাটকাঠি, বেলের ডাল, নারকোলের ছোবড়া দিয়ে ব্যাগ ঢেকে দিল অতি নৈপুণ্যে। দেখে মনে হয়, পূজার বস্তুগুলি স্তূপ করে রাখা। 

অশোক, অলককে আড়াল করে শিখারানিকে চোখ টিপল। বলল— কখন মিটবে এসব?

—বারোটার আগে নয়। 

.

রাত্রি ঠিক সাড়ে এগারোটায় অনির্বাণ ও লাজুকে ঘরে ঢুকিয়ে দিলেন সুমিত্রা। আত্মীয়-স্বজনের লাগল এ বড়ই বিসদৃশ। এখনও এক পংক্তি খাওয়া বাকি। এখনই এমন! সুমিত্রা বললেন— জ্যোতিষের বিধান আছে। 

—কোন জ্যোতিষ গো? 

—কে গো? 

—সে কী বলেছে গো? 

—সে কিছু অমঙ্গলের কথা বলেনি তো? 

কৌতূহল ছেঁকে ধরল সুমিত্রাকে। সুমিত্রা দেখলেন, কারও মুখে বাঁকা হাসি। কারও ঠোটে অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত। কারও চোখ উদগ্র কৌতূহলে বিস্ফারিত। পারিবারিক গোপনীয়তা জেনে নেওয়ার আগ্রহাতিশয্য মুখে মুখে। অনির্বাণের দরজায় কান পাতছে বউ-ঝিরা। তিনি কিছু নিষেধও করতে পারছেন না। 

তখন বংশির মা এল ত্রাতা হয়ে। শিখারানির কাছে যাবার পরামর্শ সে-ই দিয়েছিল। সেই সুবাদে কিছু কিছু গোপন কথা জানবার অধিকারিণী হতে সে পেরেছে। এখন সে গিন্নির অতি নিকটজন। তারই দাপটে সে বলে উঠল—হ্যাঁ গো মেয়েরা, যাও দেখি। সরে পড়ো। শুনছ মা বলছেন জ্যোতিষের বিধান আছে। কিছু বোঝো না নাকি? ওদের একা হতে দাও। 

বড়লোক আত্মীয়ার গেরেমভারী ঝি। তার দুর্বিনয়ে ইতি-উতি সরে পড়ে লোকজন। নিন্দের উথালি ইচ্ছায় তলপেট ভারী হয়ে যায় তাদের। পরে কখনও আসবে সেই সুযোগ। আসবেই। 

.

আর অনির্বাণ দাঁতে দাঁত চেপে লাজুর মুখোমুখি দাঁড়ায়। তার হাত ঘামছে। পা ঘামছে। শরীর ঝিমঝিম করছে। সে শক্ত হয়। শক্ত হতে চায়। তবু ভয় করে তার। বিষম ভয়ে অস্থির-অস্থির পাগল-পাগল লাগে। এখুনি, এখুনি, ঘোমটা উন্মোচিত করলেই সে দেখবে, সে দেখবে, কাকে কাকে কাকে? হ্যাঁ হ্যাঁ লাজু, লাজুই তো, লাজুকে। হ্যাঁ হ্যাঁ লাজুকে। 

সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। কাঠের মতো দাঁড়িয়ে থাকা লাজুকে বিবস্ত্র করতে থাকে অনভ্যস্ত হাতে। তার সারা শরীর হতে বড় বড় ফোঁটায় নেমে আসে স্বেদবিন্দু। সে চোখ খোলে কিন্তু লাজুকে দেখে না। দেখে না তার অপরিপক্ক স্তন, আধফোটা, তুলতুলিরই মতো অবিকল; দেখে না তার চোখ হতে গড়িয়ে পড়া অশ্রু অবিরল, তুলতুলিরই মতো। দেখে না সে। দেখতে চায় না। বরং সে দেওয়ালঘড়ি দেখে। আর ছুটে গিয়ে আলো নিভিয়ে দেয়। ফিরে আসে। শ্বাসে-প্রশ্বাসে, জোরে, ঠেলে দেয় মেয়েটিকে। দ্রুত দ্রুত দ্রুত হাতে মুক্ত করে স্বদেহের নিম্নাবরণ। এবং চড়ে বসে। পাগলা ঘোড়ার মতো চড়ে বসে পর্বতে গিরিখাতে অরণ্যানী জুড়ে। আঘাতের পর আঘাতের পর আঘাত করে গুহার প্রাচীরে। ফিনকে ওঠে লাভার রুধির। যে-মিলন মধুর হওয়ার কথা ছিল, যে-স্মৃতি মহিমামণ্ডিত করে রাখার কথা ছিল আজীবন, যে-সম্পর্ক আবেগ-ধোয়া হয়ে, অমলিন বিশ্বাস ও নির্ভরতা হয়ে, ক্রমশ রচনা করতে পারত সুখ ও শান্তির নিবিড় জগৎ— তার সবটাই হয়ে গেল প্রয়োজনের শুষ্ক কর্কশ কঙ্করে লিপ্ত। হয়ে গেল যজ্ঞের নিষ্ঠুর উপকরণ! 

.

তখন, জ্বলন্ত হোমকুণ্ডে তুলতুলির প্রতিরূপ পুতুলের দেহ খণ্ড খণ্ড নিক্ষেপ করতে থাকে শিখারানি। বলতে থাকে— 

হে অতৃপ্ত প্রেত, তোমার বিনাশ হোক। 
হে অপঘাতদায়ী প্রেত তোমার নবজন্ম হোক। 
হে অবিনাশী আত্মা, তোমার মুক্তি হোক। 

অন্ধকার বারান্দায় অশোক অপেক্ষা করে শিখারানির জন্য। রাত্রি একা একা মধ্যযামিনী হয়ে ওঠে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *