৮৬
ভাদ্দর গেল আশ্বিন আইল
দ্যাশে দুগ্গা পূজা।
কেউ দ্যায় আঁস মইষ
কেউ দেয় পাঁড়া ॥
ঢাক ঢোল বাজে আরও
লোকে সাজ করে।
দুগ্গা দুগ্গা বলি মায়
মানত দ্যায় মন্দিরে॥
আঁডু পানিত নাইম্যা কইন্যা
আরও মানত করে।
লইক্ষ বলি দিবাম আমি
সাধু আইওক ঘরে ॥
দেউড়ি রুদ্ধ হয়নি আজ। মুনিষ দু’টি উঠোনে শুয়েছে। নীচের তলায় একটি ঘরে ঠাকুরমশাই শুয়েছেন। একটি ঘরে সিদ্ধার্থ ও মোহনলাল। গত কয়েকদিন ধরেই মোহনলাল এ-ঘরে শুচ্ছে। তার ওপরের নির্দিষ্ট ঘরখানা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে নয়াঠাকুমার বড় নাতনি এবং নাত-জামাইকে। নিজেদের শিশুকন্যাকে নিয়ে ও ঘরেই ঘুমোচ্ছে তারা।
নয়াঠাকুমার ছেলেরা যে যার ঘরে অধিষ্ঠিত। পাঞ্চালির জন্য নির্ধারিত ঘরখানির দখল নিয়েছে বড় হয়ে যাওয়া নাতিরা। বাবা-মায়ের সঙ্গে শুতে তারা স্পষ্টতই নারাজ এখন।
ঘুম আসছিল না সিদ্ধার্থর। দুলু বাউলের গানের কথা সে ভাবছিল। বৈরাগীঠাকুর গান করে চমৎকার। কথা সুর সব এসে বুকে আঘাত করে। নানা গানের মধ্যে সে শুনিয়েছে এক গাঁজার গান। বাউল সম্প্রদায় বিবিধ নেশার বড় ভক্ত। এই নেশা নিয়েই গান বেঁধেছেন এক বাউলগুরু সোলেমান।
গাঁজারে তোর পাতায় পাতায় রস।
একদিন না খেলে মন করে টস টস ॥
সিদ্ধির নেশা বাটি বাটি মদের নেশার পরিপাটি।
গুলির নেশায় শরীর মাটি একটানে হয় ফস।
হিরোইন স্লো পয়জন তা খেয়ে তোর কী প্রয়োজন।
জমিজমা বিকাস এখন ডহরে বসে চাষ ।।
সোলেমান কয় ওসমান গনি জান লিয়ে তোর টানাটানি।
খাও গে এখন গঙ্গার পানি কাম হবে তোর বশ।
.
গাইবার আগে, এ গানের পরিচয় দিয়েছিল দুলু বাউল। জলঙ্গিনিবাসী বিখ্যাত গুরু ও গায়ক সোলেমান ফকির। ওসমান ছিলেন তাঁর অন্যতম প্রিয় শিষ্য। সুদর্শন, সুগায়ক ওসমান নেশা করে শেষ হয়ে গেলেন। শুধু গাঁজা নয়, শুধু গুলি নয়, শেষ পর্যন্ত হেরোইন খেতেন ওসমান চোখের সামনে প্রিয় শিষ্যকে ক্ষয় হয়ে যেতে দেখে সোলেমান ফকির বেঁধেছিলেন এ গান।
সিদ্ধার্থ জানে, নেশার বস্তু সীমান্ত পেরিয়ে মুর্শিদাবাদে ঢুকে পড়ে প্রত্যহই। চারপাশে ছড়িয়ে যায় অতঃপর। কেউ হতাশায়, কেউ লোভে, কেউ কেবল এক মজার টানে পড়ে যায় এই নেশার ঘোরে। প্রশাসনের কোনও তৎপরতা নেই এই সীমান্তচালান বন্ধ করার জন্য। সীমান্তব্যবসা একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশা হয়ে উঠেছে মুর্শিদাবাদের যুব সমাজে। নারী ও পুরুষ সমানভাবে এতে যুক্ত। এই পেশার ওপর নির্ভর করেই লোকে বিবাহ করে। সংসারধর্ম ও সন্তান প্রতিপালন করে। সে স্থির করে, এর বিরুদ্ধে অভিযান করবে সে কোনওদিন। সীমান্ত-চোরাচালানের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবে। তার সকল কাজের পরিকল্পনায় যুক্ত হল আরও একটা কাজ। কিন্তু তখন মির্জার কী হবে? তার প্রিয় মির্জার? তারা কি বৈরী হয়ে উঠবে পরস্পর? হায়! এমন জড়িয়ে গেছে সততা-অসততা, ন্যায়-অন্যায়, অপরাধ- নিরপরাধ—এক চাইলে আর এসে দাঁড়ায়। প্রয়োজন আড়াল করে নৈতিক চেতনাকে। সিদ্ধার্থ অসহায় বোধ করে।
বাইরে থেকে একটা সিগারেট খেয়ে আসবে বলে উঠে বসে সে। শরতের রাত্রি। হালকা হিম সে বোধ করছিল গায়ে। তার ভাল লাগছিল। সে চাইছিল, দ্রুত শেষ হয়ে যাক এই বৎসর। বৃষ্টি নিয়ে, ফসল নিয়ে, সমৃদ্ধি নিয়ে নতুন বছর আসুক।
গায়ে শার্ট চাপিয়ে বোতাম লাগাচ্ছে সে যখন, মোহনলাল উঠে বসল। বলল— ঘুম আসছে না।
—হুঁ।
—বাইরে যাচ্ছিস?
—হ্যাঁ।
—চল। আমিও যাই।
—চল।
বেরিয়ে পড়ল দু’জনে। দুলু বাউলের কথা তখনও ভাবছিল সিদ্ধার্থ। কাল গ্রাম ভ্রমণে যাবে শুনে দুলু বাউল সঙ্গে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে। বলেছে—যেখানে যাবেন যান। আমি নিয়ে যাব এক জায়গায়?
—কোথায়?
জানতে চেয়েছিল সে। দুলু বাউল রহস্য করে বলেছিল—কলাবিবির বন পেরিয়ে, শ্মশান পেরিয়ে চল্লিশ মাইল হাঁটাপথ। যাবে তো বাবা?
—যাব।
—এমন যে বলবে তুমি, তা জানতাম। দেখো। সে গ্রাম এক। জঙ্গলের মধ্যে কেমন দিকহারা। ছন্নছাড়া। এর কিছু নদীয়া, কিছু মুর্শিদাবাদে। এর নিকটেই বর্ধমান। প্রায় গায়ে লেগে। দেখো তুমি। দেখো। দেখবার মতো বটে।
—কী নাম সে গ্রামের?
—ধুলামাটি। ধুলামাটি বাবা।
কথা আছে, আগামীকাল তেকোনা হতে বেরুবার সময় আখড়া থেকে দুলু বাউলকে ডেকে নিয়ে যাবে সিদ্ধার্থ। সে নিজেও আছে ধুলামাটি গ্রামের অপেক্ষায়
যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে তাকাল সিদ্ধার্থ। এবং তাকিয়েই থমকে গেল। নয়াঠাকুমার ঘরে আলো জ্বলছে তখনও।
সে বলল—এই! মোহন!
—উঁ?
—ঠাকুমা ঘুমোননি এখনও!
মোহন দেখল পেছন ফিরে। বলল—না মনে হয়। ঠামার ব্যাপারটা আজ ভাল হল না। কী যে দরকার ছিল এসবের!
সিদ্ধার্থ চুপ করে রইল। মোহনলাল সন্ধ্যায় একবার এই মন্তব্য করেছে। সে শুনেইছে শুধু। এ ব্যাপারে তার কী বলার থাকতে পারে! ওঁরা তার প্রিয়জন। আপনজন। কিন্তু প্রিয়ত্ব দিয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নির্ধারিত হয় শুধু। পারিবারিক অন্তর্ভুক্তি ঘটে না। পরিবার কিছু শর্তাবলী রাখে। সমাজ সেই শর্তের স্রষ্টা! নীরবেই সে এগিয়ে যেতে লাগল সামনের দিকে। বেশি হাঁটতে তার ইচ্ছে করছিল না। সে চাইছিল, আর একটু এগিয়ে ইসমাইলের দোকানের সামনে বসতে। একটা সিগারেট ধরাল সে। মোহনলালও ধরাল একটা। সিদ্ধার্থ তাকাল একবার মোহনলালের দিকে। কিছু বলল না। আগে, একই সঙ্গে দু’টো সিগারেট কখনও ধরায়নি তারা। একটাই সিগারেট ধরিয়ে ভাগ করে নিয়েছে।
মোহনলাল সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল—হারার ব্যাপারটা কী হল বল তো? ও কি সত্যিই খুন করেছে, নাকি ফেঁসে গেল?
সিদ্ধার্থ চুপ থাকল কিছুক্ষণ। ইসমাইলের দোকান এসে গিয়েছিল। বাঁশের বেঞ্চ দেখিয়ে সে বলল—বসবি?
—চল।
সিদ্ধার্থ বলল এবার—ব্যাপারটা আমিও বুঝলাম না। ও তো আমাকে বলল, ও মারেনি।
—তোর কাছে সত্যি বলতে যাবে কেন?
—জানি না। অনেক কিছুই তো বলেছে। যেগুলো বলা যায় না, এমন অনেক কিছু।
—কী রে?
সিদ্ধার্থ এক মুহূর্ত ভাবল। হারাধনের কথাগুলো মনে পড়ল তার। উকিল রতন সেহনবিশকে নিয়ে গিয়েছিল সে। হারাধন তার হাত ধরে বলেছিল— সিধু, আমি জানি, আমার পাশে তুই ছাড়া কেউ থাকবে না এখন। তোর কাছে কিছু লুকোব না আমি। বিশ্বাস কর, ওকে আমি খুন করিনি। ওকে মেরেছিলাম। চটি দিয়ে মেরেছিলাম।
আরও অনেক কথা, হৃদয়ের নিগূঢ় অন্ধকার হতে তুলে আনা কথা সে বলেছিল। বলেছিল আবেগে, অসহায়তাবোধে, যন্ত্রণায়। সেইসব কথা, সে কি মোহনকে বলা যায়?
সে যখন চলে যাবার জন্য দাঁড়িয়েছে, হারাধন হাত চেপে ধরেছিল তার। সংশোধনাগারের ওই সামান্য সাক্ষাৎ-ব্যবস্থায়, বধূহত্যার আসামি হারাধন, তার হাত চেপে ধরে বলেছিল— আবার আসবি তো?
— আসব।
বলেছিল সে। হারাধনের কাঁধে হাত রেখেছিল। হাজার অন্যায় হারাধন করেছিল মৌসুমির সঙ্গে। সে জেনেছিল। তবু সে অবিশ্বাস করতে পারছিল না, হারাধন খুন করেনি। রতন সেহনবিশের ওপর ভরসা রাখতে চাইছিল সে।
হারাধন বলেছিল—আমার বাবা-মাকে দেখিস সিধু। ভাইবোনগুলোর খোঁজ নিস। কী যে হল। ওরা সব শেষ হয়ে যাবে।
—ভরসা রাখ।
বলেছিল সে। হারাধনকে উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছিল। কিছু-বা দ্বিধা, কিছু বা লজ্জায় সে বলেছিল—তোকে একটা অনুরোধ করব, সিধু। রাখবি?
—কী?
ফিসফিস করে বলেছিল সে—মাকে নিয়ে আসবি একবার? খুব দেখতে ইচ্ছা করে। মা একদিনও আসেনি জানিস?
—মা? মানে পেতনির চর থেকে…
—না না। মা না। মানে, আমি বলছিলাম….
কথা শেষ করতে পারেনি সে। সিদ্ধার্থ স্থির তাকিয়েছিল তার দিকে। ভেবেছিল, কী বিচিত্ৰ এই পৃথিবী! কত বিচিত্রতর এই পৃথিবীর সম্পর্কের পরিচ্ছেদ! নিজেই সে বলেছিল- অসিতস্যারের স্ত্রীর কথা বলছিস?
—হ্যাঁ হ্যাঁ! অপ্রতিভ হয়েছিল হারাধন।
সে বলেছিল—বেশ। চেষ্টা করব।
চেষ্টা করেওছিল সে। গিয়েছিল অসিতস্যারের বাড়ি। মৌসুমি তাকে কঠিন স্বরে বলেছিলেন—আমি যাব? আমি? কখনও না। সন্তানের মতো করে এ আমি কাকে পুষেছিলাম? এ তো কালসাপ! ওকে বলে দিয়ো, পত্নীহন্তারকের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই।
সে, কিছু বলবে না, এমন সংকল্প করেও, বলেছিল—আপনার দায় নেই কোনও? —না কোনও দায় নেই। তুমি এখন আসতে পারো।
সে চাইলে চাপ দিতে পারত। চাইলে বলতে পারত —আমি সব জানি। আর কত অভিনয় করবেন?
কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলেনি সে। বলে কী লাভ! এই ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে গিয়ে সে কী করবে? এই বোঝাপড়া তোলা থাক হারাধনের জন্যই। হয়তো কোনওদিন প্রমাণিত হবে, সে খুন করেনি। ছাড়া পাবে সে। তখন হিসেব-নিকেশ করে নেবে।
সে চলে এসেছিল। হারাধন যাতে কষ্ট না পায়, তার জন্য বলেছিল—উনি আসবেন, পরে কোনওদিন।
হারাধন আশায় বুক বেঁধেছিল—আসবে? মা আসবে বলেছে?
— হ্যাঁ!
এই তো সেদিনের সব কথা। কিন্তু এত কথা কি বলা যায়? মোহনলালকে বলা যায়? না, যায় না। দু’জনেরই বন্ধু সে। কিন্তু এক বন্ধুর ব্যক্তিগতকে আর এক বন্ধুর কাছে খুলে দিতে সে পারে না।
মোহনলাল বলে তাকে—কীরে? চুপ করে আছিস?
—না। ওদের সম্পর্ক ভাল ছিল না।
—মেরে দিয়েছে। স্রেফ মেরে দিয়েছে।
—এভাবে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়। হারা আমাদের বন্ধু। আমাদের ওকে বিশ্বাস করা উচিত।
—ছাড় তো! বিশ্বাস! এর মধ্যে ওই মহিলার হাত আছে।
—কোন মহিলার?
—অসিত স্যারের বউয়ের। মা-ছেলের সম্পর্ক! আরে যাঃ! মা-ছেলের ওই সম্পর্ক হয়? বর্ধমানে দেখেছি তো। ওই মহিলার জন্য নেশাগ্রস্তের মতো করত হারাধন।
কোন কথায় কী বলা হয়ে যায়, এই আশঙ্কায় চুপ করে রইল সিদ্ধার্থ। মোহনলাল বলল— উকিল নিয়েছে?
—আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম। ওর জন্য আর কে ব্যবস্থা করবে?
—খরচ? খরচ লাগবে না?
—সামান্য কিছু দিয়েছি আমি রতনদাকে। রতনদা আমার খুব ঘনিষ্ঠ। এখন এমনিই কাজ করে দেবেন। পরে যদি ও নির্দোষ প্রমাণিত হয়, চাকরি ফিরে পেয়ে সব শোধ করে দেবে। আসলে রতনদার দক্ষিণা নিয়ে আমি ভাবছি না।
—তবে?
—ভাবছি ওদের পরিবারের কী হবে?
—কী আবার হবে? এতদিন যেমন চলছিল, সেরকমই চলবে।
দু’জনেই চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। আর কোনও কথা এসে ঝাঁপ দিল না দু’জনের মধ্যে। এক বিশাল তারাগুনিয়া আকাশ। তার নীচে তারা বসে রইল নীরব। শুক্লা দশমীর চাঁদ মাথার ওপর। কোজাগরী পূর্ণিমার দিকে গমন করছে এখন। তার চন্দ্রিমায় ইসমাইলের দোকানের সম্মুখে পড়েছে গাছের পাতার ছায়া। শিল্পীর হাতে আঁকা নিখুঁত চিত্রকলা। সিদ্ধার্থর মনে হচ্ছিল যেন দু’ হাতে আঁজলা ভরে তুলে নেওয়া যাবে ওই ছবি। বাতাসে কটু ঘ্রাণ ভরে ভেসে এল তখন। বৃষ্টি হয়নি বলে মল-মূত্র আবর্জনা জমে জমে সকল সুন্দরকে করেছে মলিন।
একসময় বড়-সড় জুম্ভণ তুলে মোহনলাল বলল—চল। যাবি?
—চল।
ফিরে চলল তারা। বাড়িতে ঢোকার পথে দেখল, নয়াঠাকুমার ঘরে তখনও জ্বলছে আলো। লণ্ঠনের ম্লান হলদেটে সেই আলো জমাট বেঁধে আছে জানালায়। ঠাকুমা এখনও ঘুমোননি।