৮৫
আশ্বিন মাসে হে কন্যা
দুর্গা অষ্টমী।
ধানে দুর্বায় করে পূজা
বিধবা ব্রাহ্মণী ।।
পুজুক পুজুক দ্যাবতা
মাগিয়া বর লব।
আমার সাধু ফিরলে দ্যাশে
লক্ষ মইষ দিব ।।
বিসর্জন শেষে ঘরে ফিরেছেন সবাই। মায়ের মূর্তির সামনে প্রণাম রচনা করে ঠাকুরমশাইকে ঘিরে দাঁড়িয়েছেন। চাটুজ্যেবাড়ির সঙ্গে রয়েছেন সেনবাড়িরও সব। পূজাস্থল হতে শালগ্রাম শিলা এখন তুলে নিয়ে যাওয়া হবে ঠাকুরঘরের নির্দিষ্ট আসনে। সকলে কাপড়ে পা ঢেকে বসবেন ঠাকুরঘরে। ঠাকুরমশাই বিসর্জনের কল্যাণী জল ঘট হতে ছড়িয়ে দেবেন মাথায়। এরপর গড় হয়ে ঈশ্বরের প্রতি প্রণাম নিবেদনের পালা। ঈশ্বরকে প্রণাম করা হলে পরিবারের মধ্যেকার বয়ঃজ্যেষ্ঠদের প্রণাম ও আলিঙ্গনের পর্ব।
মা এসেছিলেন, মা চলে গেলেন। বিসর্জনের পর সকলেরই মন রয়েছে ভারাক্রান্ত। পূজার দিনগুলি যেন বড্ড দ্রুত ফুরিয়ে যায়। তার ওপর, এই প্রাণহীন প্রতিমাকে আটকে রাখা হল, সংস্কারগ্রস্ত মন কুডাক দেয়! কে জানে, দেবীর মনে কী আছে! খরার এ বৎসর দেবীর কল্যাণ স্পর্শ হতে বঞ্চিত। অতএব আগামী বৎসরের জন্য ঘোরতর আশঙ্কা জেগে রয়।
ভাল রেখো মা, সুখে রেখো। আগামীবার বৃষ্টি দিয়ো মা। ফুলে-ফলে-ফসলে ভরে উঠুক ধরণী। লোকের হাতে পয়সা নেই। তাই ব্যবসা মন্দা গেছে এবার। সকল সংসার উছলে উঠুক। ক্রয়ক্ষমতা বাড়ুক মানুষের। ব্যবসার হোক শ্রীবৃদ্ধি! সন্তানেরা ভাল থাকে যেন, সুখে থাকে যেন! এমনই কামনা সকল হৃদয়ে। জোড়হাত করে, মাথা নত করে, এমনই সব প্রার্থনা হৃদয়ে জারি রেখে শান্তিবারি গ্রহণ করেছিলেন সবাই। ঠাকুরঘরে গাদাগাদি ধরে গিয়েছেন সকলেই। বাইরে কেবল নয়াঠাকুমা আর সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থ দেখছিল চুপচাপ। সে চোখ বন্ধ করে কোনও প্রার্থনা করছিল না। নয়াঠাকুমা স্থির বসে আছেন। বিরাট সংসার তাঁর। বহুজনের জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে হয় তাঁকে। গভীর মনঃসংযোগে সে কাজ তিনি করে চলেছিলেন। পাশাপাশি পাঞ্চালির জন্য তাঁর হৃদয় পুড়ছিল। ময়না বৈষ্ণবীর জন্য শোক উঠছিল উথলিয়ে। ইদরিশ ও মাসুদার ছোট মেয়েটির জন্যও শোকসন্তপ্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ময়না বৈষ্ণবীর একটি গান মনে পড়ল তাঁর। পূজায় এলে সে গাইত। সে গানের কথার দরদী স্পর্শে, সুরের দরদী মায়ায়, চোখে জল আসত। মা উমা! তুই আবার আসিস মা! আবার আসিস। সামনের বছর আমার মেয়েটাকে আনিস মা সঙ্গে করে। দু’বছর যাবৎ তাকে দেখি না।
প্রায় ধ্যানস্থ অবস্থায় নয়াঠাকুমার বেদনা গলে গলে বন্ধ চোখের ভিতর হতে অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে। ময়না বৈষ্ণবী, তার ঈষৎ ভারী স্বরে, সুরসমৃদ্ধ স্বরে, তাঁর পাশে বসে গান শোনায়
নবমীর নিশি গো
তুমি আর যেয়ো না
তুমি গেলে আমার উমা যাবে নয়নজলে
সেই জল আর শুকাবে না
সপ্তমী আর অষ্টমীতে
আমি সুখী ছিলাম দিনেরাতে
আজি আমার ক্ষণে ক্ষণে
নয়নজল কেন বাধা মানে না
প্রণাম ও প্রীতি আলিঙ্গনের পালা সারা হতে থাকে তখন। নয়াঠাকুমার চার পুত্রবধূ তাঁরা, শাশুড়িকে প্রণাম করেন একে একে। সিঁদুর-মাখা মুখ তাঁদের। পরিধানে মূল্যবান বস্ত্র এবং অলংকার। স্বাস্থ্যের দীপ্তি চোখে-মুখে। বধূগুলি সুন্দরী প্রত্যেকেই। সুরূপা। সুশীলা। তাঁদের দেখে নয়াঠাকুমার সুখ হয়। সুখে চোখে জল উপচে আসে। বধূগুলির পাশে পাশে মেয়ে পাঞ্চালিকেও তিনি দেখতে পান। তাঁরই ধবল রূপ পেয়েছে সেই মেয়ে। তাঁরই সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্যরাশি নিয়ে সে, পাঞ্চালি, সকল হৃদয় ঘুরে ঘুরে গান করে। তার সুর শোনে প্রত্যেকেই। সকলের মনে হয়, আহা সে যদি আসত! দাদাদের মনে হয়। বউদিদের মনে হয়। ছেলেমেয়েগুলি পিসির জন্য হয়ে ওঠে বেদনাবিধুর। বড়বধূ শাশুড়িকে আলিঙ্গন করে বলে— কাঁদবেন না মা। আজকের দিনে কাঁদতে নেই।
নয়াঠাকুমা সংযত হলেন। সংযত হতে পারেন তিনি। মুখে হাসি টেনে আশীর্বাদ করলেন প্রত্যেককে—আয়ুষ্মতী হও। সুখী হও।
সিদ্ধার্থ দেখছিল এই দৃশ্য। তার ভাল লাগে এইসব লোকাচার। দেশাচার। এইসব আচার-পার্বণের মধ্যে দিয়েও তো মানুষ বাঁধা থাকে পরস্পর। কাছে থাকে। জীবনকে সুন্দর করার জন্য, সালঙ্কারা করার জন্য, আরও বেশি বেঁধে বেঁধে থাকার জন্যই গড়ে ওঠেনি কি এমন সব লৌকিকতা? শুধুই বেঁচে থাকা উদ্দেশ্য যে-জীবনের, শুধুই অন্নসংস্থান উদ্দেশ্য যখন, তখন জীবন বড়ই অনাকর্ষক। বড়ই অর্থহীন। তার মনে হয়, জীবনকে নানা চিত্রে, নানা বিচিত্ৰে বৰ্ণময় করাও এক শিল্প। এক সৃষ্টি। জীবনের কাছে সেও এক মধুর দায়বদ্ধতা মানুষের।
নয়াঠাকুমার নাতি-নাতনিরা তাঁকে ঘিরে ধরেছে তখন। হইহই করছে তারা—চোখ বন্ধ করো ঠামা, চোখ বন্ধ করো।
—কেন রে?
—আজ তোমাকে একটা দারুণ সারপ্রাইজ দেব।
—এই বয়সে আর কোনও সারপ্রাইজ কি বাকি থাকে রে ভাই? সকল প্রাইজই আমার পাওয়া শেষ।
—ও ঠামা! এমনি করলে হবে না। চোখ বন্ধ করো তুমি।
—ওরে শোন, শোন তোরা। এ হল আশি বছরের দূরদৃষ্টি। এ চোখ বন্ধ হলেও দেখতে পায় সব।
—তোমার চোখ তা হলে বেঁধেই দিচ্ছি ঠাকুমা।
বড় নাতনি ইশারা করল। মধুঋতা নিজের দোপাট্টা খুলে শক্ত করে বেঁধে দিল নয়াঠাকুমার চোখ। নয়াঠাকুমা বলছেন—একী! একী! তোরা কি সব এই বয়সে আমায় নিয়ে কানামাছি খেলবি? কেউ কিছু বোঝার আগেই নয়াঠাকুমাকে পাঁজাকোলে তুলে নিল শৌভ। শুভ্র বলল— দুর্গামাঈ কি….
নাতিনাতনির দল আওয়াজ তুলল— জয়!
নয়াঠাকুমাকে ঘিরে ধরে তারা নিয়ে চলল তাঁকে ঠাকুরঘরে। বড়রা দাঁড়িয়ে দেখছেন হতবাক। কী এক নাটক হয়ে চলেছে তাঁদের সামনে। তাঁরা কেবলই দর্শক। নয়াঠাকুমা বলছেন—কী করিস? কী করিস তোরা?
ঠাকুরের আসনের সামনে তারা বসিয়ে দিয়েছে তাদের ঠাকুরমাকে। শৌভ, হাতে নিয়ে বৃদ্ধা ঠাকুরমায়ের হাত, স্পর্শ করিয়ে দিচ্ছে সিংহাসন। শুভ্র বলছে—দুর্গামাঈ কি….
সকলে বলছে—জয়!
—দুর্গামাঈ কি…
—জয়!
নয়াঠাকুমা একটানে খুলে ফেলছেন চোখের বাঁধন। হ্যাজাকবাতির চড়া আলোতেও সহসা তিনি কিছু ঠাহর পাচ্ছেন না। দু’হাতে চোখ ডলছেন তিনি। এলোমেলো চাইছেন এদিক-ওদিক। দিশেহারা! অসহায়! দেখছেন, তাঁর নিকটেই সিংহাসন। তাতে বিগ্রহ। পট। পূজার উপাচার। দেখছেন, ঠাকুরঘরের মেঝেয় তিনি বসে আছেন। তাঁর পাশে দীপ। ধূপ। তাঁর পাশে নাতি ও নাতনিরা। থরথর করে কেঁপে উঠছেন তিনি। তাঁর সমস্ত শরীরের রক্ত মুখে এসে জমেছে। দেহ স্বেদসিক্ত। তিনি চিৎকার করছেন—এ কী! এ কী! এ কী!
—ঠামা, তোমার অপমানের শোধ তুললাম আজ আমরা।
—কে? তোরা আমার অপমানের শোধ নেবার কে?
—ঠামা, এতদিন যে অন্যায় হয়েছে তোমার সঙ্গে, আমরা তা শেষ করলাম।
—কে? তোরা শেষ করার কে?
—ঠামা, তোমার স্পর্শে আমাদের সিংহাসন আজ পবিত্র হল।
—তোরা পবিত্রতার কী বুঝিস?
—আজ আমাদের পরিবার তোমাকে সম্পূর্ণ করে পেল।
—হায়!
—শাপ ঘুচল আমাদের।
—হায় হায়!
—আর কোনও কুসংস্কার রইল না।
—হায় হায় হায়!
—ঠামা তুমি খুশি? বলো, খুশি? তুমি তৃপ্ত?
—ঠামা তুমি সুখী তো? বলো, সুখী? তুমি প্রসন্ন?
—ঠামা তুমি আনন্দিত? বলো, আনন্দিত? আনন্দিত?
নয়াঠাকুমা চোখ বন্ধ করলেন। হায় তৃপ্তি! হায় সুখ! হায় প্রসন্নতা! হায় হায় হায় আনন্দ! ধ্যানস্থ হলেন তিনি। কোনও কথা বললেন না। সারা বাড়ি স্তব্ধ হয়ে গেল। কী হয়! কী হয় এখন!
ধীরে ধীরে নয়াঠাকুমার মুখ স্বাভাবিক হয়ে এল। সরে গেল রক্তোচ্ছ্বাস। গলায় আঁচল পেঁচিয়ে আভূমি প্রণত হলেন তিনি। উঠলেন।
নাতি-নাতনিরা ডাকল—ঠামা!
—রাগ করেছ ঠামা?
নয়াঠাকুমা ঠাকুরঘর হতে বেরিয়ে আসতে আসতে ডাকলেন—নন্দিনী! নন্দিনী!
নন্দিনী এগিয়ে এলেন—কী মা?
—মিষ্টি দিয়েছ মা? সকলকে মিষ্টি দিয়েছ?
—এই তো মা। যাই।
—আমি আমার ঘরে যাচ্ছি। বাউল এলে ডাক দিয়ো আমায়। গান শুনব।
নিজের ঘরে গিয়ে দোর দিলেন নয়াঠাকুমা। বড়রা তিরস্কার করলেন ছোটদের। কী দরকার ছিল এসবের? ছোটরা মাথা নিচু করে শুনল সেই তিরস্কার। নন্দিনী মিষ্টির আয়োজন করতে ছুটলেন। দুলু বাউলের আগমন প্রতীক্ষায় বসে রইলেন সকলে। সিদ্ধার্থ মোহনলালকে বলল—ক’টায় আসবেন বৈরাগীঠাকুর?
—সাতটায় বলেছিল।
—চল আগেই নিয়ে আসি আমরা।
—চল।
মোহনলাল মাথা নিচু করে চলতে চলতে হঠাৎ আর্দ্র স্বরে বলল—ঠিক হল না এটা। ঠিক হল না।
সিদ্ধার্থ তাকাল তার দিকে। চুপ করে রইল।