2 of 3

রাজপাট – ৮৩

৮৩ 

আশ্বিন মাসে ফাতেমা গো
স্বপনে দেখিয়া। 
কান্দিয়া উঠিলাইন মাগো 
দুই পুতের লাগিয়া ॥ 
শিশুকালে পুত্রশোক 
দিলা যে আমারে। 
সেই শোগ বাইট্যা দিলাম 
সগল ঘরে ঘরে ।।

অনাবৃষ্টিতে ফসলবিহীন ধু ধু মাঠ। পাম্পসেটে ভৈরবের জল তুলে যতটুকু হয়েছে চাষের কাজ, তাতে ফলন ভাল হয়নি। গভীর নলকূপ মাটির নীচে জলের নাগাল পায় না। তার গোল মুখগহ্বরে মাকড় জাল বোনে। অতর্কিতে ঢুকে পড়ে সাপ। একটু জলের জন্য জলঢোঁড়া ভিজে কাদায় পাক খায়। ঘরে ঘরে তণ্ডুলাভাব। ঘরের চালায় বাইতে থাকা পুঁই, লাউ, চালকুমড়োর লতা শুকিয়ে উঠছে। অথচ পেটের বড় দায়। ক্ষুধার আগুন নেভে না। শিশুরা কাতর চোখে মায়ের আঁচল ধরে ফেরে—খেতে দে মা। ভুখ লাগে। দু’টি খেতে দে মা 

মা অসহায় ক্রোধে চড়-চাপড় মারে। বুকে টেনে নেয় ফের। শুষ্ক মুখে আপন পুরুষের কাছে যায়। বলে—ওগো! কিছু বেওস্থা কর। ওদের কান্না আর যে প্রাণে সয় না। 

পুরুষ কী করে? হাত পাতে সমৃদ্ধ দুয়ারে। এভাবেই, এভাবেই ঋণ বাড়ে। বাড়ছে। চাষির ঘরে ঋণের পর ঋণ বাড়ছে। তারা হাত পাতছে চাটুজ্যেবাড়িতে, বরকত আলির কাছে, অর্জুন সেনের কাছে। সুদের কারবারি লোকগুলি সাইকেল নিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরছে। এই বিপদে লোকে চড়া সুদে টাকা ধার নেবে। তারপর রক্ত জল করা পরিশ্রমের টাকার সিংহভাগ চলে যাবে সুদখোরের হাতে। কতদিন চলবে এমন কেউ জানে না। একটি বৎসরের খরা, দুরারোগ্য ব্যাধির মতো ঢুকে পড়বে গেরস্ত বাড়িতে। বছরের পর বছর তখন লেগেই থাকবে খরা। এমনকী বানের জলে আকণ্ঠ ডুবে গেলেও খরা তাদের ছেড়ে যাবে না। 

চাটুজ্যেদের কাছে বা বরকত আলির কাছে ঋণ নেওয়া আছে অনেকেরই। এরপরেও বিপদে-আপদে আরও এক-দু’বার ঋণ নেওয়া চলে। কিন্তু ঋণের টাকা ফস্ বলতেই ফুরিয়ে যায়। তখন দাঁড়াতেই হয় সুদের কারবারির কাছে। 

এই ব্যবসা অন্যায্য, বেআইনি। কিন্তু কোন পেয়াদা এই অন্যায় বন্ধ করছে? এ হল জেনেও না-জানা, দেখেও না দেখার কারবার। হায়! সাময়িক এই উদ্ধারের জন্য বিষময় হয়ে যায় অধমর্ণ খাতকের জীবন। হয়তো দুপুরে চাট্টি ভাত মুখে দিচ্ছে, এল পাওনাদার। ক্ষুধার ভাত গলা দিয়ে নামল না। অন্ন ছেড়ে ঋণের বোঝা ঘাড়ে করে পালাতে হল খিড়কি দিয়ে। বউ এসে শুকনো মুখে দাঁড়াল পাওনাদারের দৃষ্টি সীমানায়। বলল সে তো বাড়ি নাই! 

যদি নারীলোভী না হয় পাওনাদার, চারটি গালি দিয়ে ফিরে যাবে। স্ত্রী কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে শুনবে সব। তারপর ঘরে ফিরে মাছি তাড়াবে স্বামীর ফেলে যাওয়া অন্ন হতে। স্বামী এসে ফিসফিস করে বলবে—চলে গেছে? 

—গেছে। এস। 

ঠান্ডা শকরি ভাত তখন গোগ্রাসে মুখে তুলবে স্বামী! সেই ভাত গেলার সময় মণ্ড মণ্ড আটকে থাকবে গলায় যদি ওই পাওনাদার হয় নারীলোভী। কারণ, পুরুষটিকে না পেলে সে নারীর শরীরের দিকে তাকায় লোলুপ। যদি সে শরীর হয় শীর্ণ, অর্ধভুক্ত, তবুও তাকায়। দৃষ্টি দিয়ে চাটে। খায়। ভোগ করে। কখনও সরাসরি শয়নের বাসনা প্রকাশ করে। লোভ দেখায় সকল ঋণ মকুব দেবার! 

ভৈরবের গর্ভে জল নেই। সরু নর্দমার জলের মতো তিরতিরে একফালি জলে রোদ্দুর পড়লে চকচক করে। আর হাঁটু অবধি থকথকে কাদা! তবু গ্রামে যত শিউলি গাছ, সবেতে ঝেঁপে ফুল এসেছে। আর কাশফুল। নদীর দুই ধারে কাশ, জমির আলে কাশ, নতুন চরায় গতবছরও ছিল কাশফুল। এবার বণ্টিত জমিতে সব কেটে সাফ করা 

মোটামুটি পথ নির্মিত হয়ে গেছে তেকোনায়। ইটের টুকরো-ফেলা পথ। কিছু-বা চওড়া পূর্ব হতে। এক বর্ষা গেলে এর কী রূপ হবে জানে না কেউ। 

এই সব নিয়েই এসে গেল দুর্গাপূজা। ফসল ভাল হয়নি বলে এবার পূজায় আড়ম্বর কম হওয়ারই কথা ছিল। তবু নেই-নেই করেও যা আয়োজন, তাতে লোকের চোখ ঠিকরোলে বলার কিছু থাকে না। আড়ম্বরের একমাত্র কারণ, নয়াঠাকুমার ছেলেরা এ বছর একত্রিত হয়েছেন। 

প্রতি বৎসরই কেউ না কেউ আসেন। কিন্তু চার ছেলের একসঙ্গে হওয়া ঘটেনি কতকাল! গত দু’-তিন বৎসরের পরিকল্পনায় এইবার সেই অসম্ভবকে সম্ভব করা গেছে। আসেননি কেবল নয়াঠাকুমার মেয়ে পাঞ্চালি। ছেলের পরীক্ষা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত তিনি। চার ছেলের আগমনের আনন্দ-উজ্জ্বলতার মধ্যে একটুকু বিষণ্ণ হয়ে আছেন নয়াঠাকুমা পাঞ্চালির জন্য। সে যদি আসত, সকল সন্তান একত্রিত হলে, নাতি-নাতনিসহ দেখে চোখ সার্থক করতেন। সুস্থ আছেন তিনি। কিন্তু বৃদ্ধ এ বয়স! একে বিশ্বাস কী! কখন চলে যাবেন! পরপারের ডাক এসে পৌঁছবে কখন 

মৃত্যুবিলাসিতা একবিন্দু নেই তাঁর। জীবনকে তিনি কানায় কানায় ভালবাসেন। এই এক তেকোনা গ্রামের মধ্যে, এই ভৈরব নদী, সেনবাড়ি, আম-কাঁঠালের গাছ, দিগন্ত-ছোঁয়া সবুজ ক্ষেত, ব্রত-পার্বণ এবং ঈদ ও মহরমের যতেক অনুষ্ঠানের মধ্যে তিনি জড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর জীবন। প্রতিটি দিন তাঁর কাছে নতুন হয়ে ধরা দেয়। যত শোক, যত বেদনা তিনি এ জীবনে পেয়েছেন, প্রেমানন্দ এবং সুখ পেয়েছেন তার চেয়ে ঢের বেশি। জীবনের কাছে তাঁর কোনও অভিযোগ নেই। মৃত্যুবিলাসিতাও নেই। ‘ডেকে নাও ঠাকুর’ কিংবা ‘মরলে বাঁচি’—এ ধরনের বাক্য কখনও তাঁকে বলতে শোনা যায় না। তাঁর ভাবনাতেও স্থান পায় না এমন সব। জন্মিলে মরিতে হবে-এ তো জানা কথাই। তার জন্য তৎপর হওয়ার কী দরকার? 

আজ তাঁর সংসার পরিপূর্ণ। চার ছেলে, চার বধূ। সব মিলিয়ে মোট ছ’জন নাতি নাতনি! বড় ছেলের ঘরের নাতজামাই এবং পৌত্রী অবধি সংসারে অধিষ্ঠিত। একজন সংসারি মানুষের এর চেয়ে বড় দাবি আর কী থাকতে পারে? 

তবু আজ, পাঞ্চালির আসতে না পারার শূন্যতাটুকুতে ঢুকে পড়েছে মৃত্যুচিন্তা। মৃত্যুবাসনা নয়, বরং ভয় একরকম। যদিও তিনি জানতেন, পাঞ্চালির পক্ষে আসা সম্ভব নয়, তবু তাঁর মনে হচ্ছে বারবার, যদি সে আসত, আসতে পারত যদি, ছবিওয়ালা ডেকে সকলকে নিয়ে একটি ছবি তুলিয়ে রাখতেন। বাঁধিয়ে রাখতেন শিয়রের দিকে, স্বামীর ছবির পাশে। কোনদিন চলে যাবেন, কোনদিন ডাক এসে যাবে, শিয়রে সংসারের ওই পরিপূর্ণতা রেখে চলে যাবেন। এমন পরিপূর্ণতা, যাতে আর পিছুটান না থাকে, পিছুডাক না আসে। এ বাড়ির কোণে কোণে যেন ঘুরে না মরে বিদেহী আত্মা তাঁর! 

হল না। হল না সে। পাঞ্চালি আসতে পারল না। পারবে না, জানিয়েছিল আগেই। তবুও তার শূন্যতা পীড়িত করে কেন? 

চার ছেলের পর একটিমাত্র মেয়ে, তার প্রতি রয়েছে এক অতুলনীয় টান। সে আসবে না জানতেন, সে ছিল একরকম। এখন সকলের মাঝে তার না-আসার শূন্যতায় বড় বেশি জমাট অন্ধকার। প্রস্তুতি থাকলেও সেই অন্ধকারকে সহন সহজ হয় না। 

ফাঁকে ফাঁকে নয়াঠাকুমার মনে পড়ছে ময়না বৈষ্ণবীর কথা। গত কয়েক বৎসর ধরেই সে এসেছিল পূজার সময়। সন্ধ্যায়, প্রতিমার নিকটে বসে শুনিয়ে গিয়েছিল গান। পূজায় তার আসা, তার গান, আত্মীয় সমাগমের মতোই সমারোহ হয়ে উঠেছিল। তার শুভ্র বেশ, ভূষণবিহীন সুদেহ জড়িয়ে থাকা সুর, তার করতালের ছন্দ, সবকিছুর মধ্যেই ছিল শিউলির ঘ্রাণ, কাশের শুভ্র ধবল ঔদার্য; তার হাসিতে ছিল, কথায় ছিল, শুভ্রনীল মেঘের আহ্বান। ময়না বৈষ্ণবী সে, এক সাধারণ নারী, জীবনের পরতে পরতে সে লেগে থাকে কী প্রকারে? 

ঢাক বাজছে। নীচের বারান্দায় দেবীমূর্তির সামনে এখন বাজছে বিসর্জনের বাজনা। এবারের দুর্ভাবনা গভীর। মূর্তির বিসর্জন কোথায় হবে? ভৈরবের জলে এখন ঘটি ডুবছে না। ঠাকুরমশাই বিধান দিয়েছেন, আপাতত ঘট বিসর্জন হোক। আগামী পূজার পূর্ব পর্যন্ত প্রতিমা রাখা চলে। অতএব দেবীমূর্তি আপাতত ঘরেই থাকুন। 

আপত্তি করেননি কেউ। করে লাভ নেই। চিরকাল ভৈরবে ভাসিয়ে আসা মূর্তি এবার কোন বিলে ভাসাতে যাবেন? দেবী পার্বতী, ভৈরবে বিলীন হবেন, এমনই প্রত্যাশিত। চিরকাল যা ঘটেছে, পূজা-পার্বণের যা পারিবারিক দপ্তর, তার বাইরে যেতে মন চায় না। অতএব বিসর্জিতা হয়েও, দেবীর খড়-মাটির দেহকাঠামো রয়ে যাবে। 

নয়াঠাকুমা মনে করতে পারেন, অনেক বছর আগে, তাঁর দ্বিতীয় পুত্রের জন্মের বার, এমনই খরা হয়েছিল, এমনই অনাবৃষ্টির শুখা ভৈরব নিতে পারেনি পার্বতীর দেহ। তখন এক বৎসর রাখা হয়েছিল প্রতিমা। পরের বছর বৃষ্টি হল এমন, বানভাসি এসে গেল। ঘর-বাড়ি ডুবে গেল। শুধু জেগে ছিল উঁচু ভিতের বাড়ির চালা। তাঁদের এই দোতলা বাড়ির একতলা ছিল জলমগ্ন। প্রতিমা নিজেই সেদিন নিরঞ্জন বরণ করেছিলেন। ভৈরবের জলে আপনাকে আপনি দিচ্ছিলেন ভাসিয়ে। এবারও কি তেমন ঘটবে? 

নিজের ঘরের জানালায় চুপ করে বসে থাকেন নয়াঠাকুমা। পাশের ঘরে, মোহনলালের অন্দর হতে হইচই উঠছে। নাতজামাই শুভ্রর স্বর চড়া। ঢাকের শব্দ ছাপিয়েও সেই স্বর নয়াঠাকুমার কানে পৌঁছল। কী আছে সেই স্বরে, কোন কথা, শোনার ইচ্ছা হল না তাঁর। ছেলেমানুষ সব। হইচই করবে। তাঁর মন তাতে আকৃষ্ট হয় না। ময়না বৈষ্ণবীর কণ্ঠে শোনা একটি গান তাঁর মনে পড়তে থাকে। শৈশব থেকে এ গান তিনি শুনেছেন। তবু, ময়না বৈষ্ণবী যখন গেয়েছিল, তখন নতুন করে উপলব্ধি করেছিলেন। যেন ওই শৈশবে শোনা গানের পথ ধরে তিনি প্রত্যাবর্তন করেছিলেন শৈশবেই। বড় কষ্ট হয়েছিল। মেয়েরা পিতৃগৃহে বারবার ফিরে-ফিরে যায়। বারবার নেড়েচেড়ে দেখে ফেলে আসা জীবন। ফেলে আসা শৈশব-কৈশোরের টুকরো-টুকরো স্মৃতি। তাঁর সে-উপায় ছিল না। কানামাছির মতো চোখ বাঁধা অবস্থায় তিনি হেথা-হোথা ঘুরে ঘুরে ছড়ানো এলোমেলো স্মৃতিগুলি সংগোপনে ছোঁবার চেষ্টা করতেন। শৈশবের শোনা, শৈশব হতে বারবার শোনা সেই গান গেয়ে ময়না বৈষ্ণবী তাঁকে টেনে এনে বসিয়ে দিয়েছিল শৈশবস্মৃতির স্তূপের ওপর। প্রাচীন বৌদ্ধ সমাধির মতো স্তূপ সেই। স্নিগ্ধ 

মঙ্গল           আরতি শ্রীগৌর কিশোর। 
মঙ্গল           শ্রীনিত্যানন্দ জোরই জোর 
মঙ্গল           শ্রীঅদ্বৈত ভকতই সঙ্গে। 
মঙ্গল           গাওয়েত প্রেম তরঙ্গে। 
মঙ্গল           বাজত খোল করতাল। 
মঙ্গল           নাচত হরিদাস ভাল 
মঙ্গল           ধূপদীপ লইয়া স্বরূপ। 
মঙ্গল           আরতি করে অপরূপ। 
মঙ্গল           গদাধর হেরি পঁহু হাস। 
মঙ্গল           গাওয়েত দীন কৃষ্ণদাস। 

মঙ্গল মঙ্গল মঙ্গল কানে বাজে নয়াঠাকুমার। দু’চোখে জল এসে যায়। এবার মোহনের বন্ধুরা আসেনি। কেন আসেনি? তাঁকে পীড়া দেয় এই অনুপস্থিতি। যা থেকে আনন্দ আসে, তাই ঘটুক, প্রতিবার, এমনই প্রত্যাশা করে মানুষ। অন্তত সিদ্ধার্থ যদি আসত! সিদ্ধার্থর মুখ মনে করেন নয়া ঠাকুমা। শক্ত কড়কড়ে তিলের নাড়ু খেতে বড় ভালবাসে ছেলেটা! 

—কেমন আছেন? 

তাকালেন নয়াঠাকুমা। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সিদ্ধার্থ। নয়াঠাকুমা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন—ওমা! কী কাণ্ড বল দিকি, তোকেই যে ভাবছিলাম এখন। আয় আয় বোস। হ্যাঁ রে, আজ পূজাশেষের দিনে এলি? বিসর্জনের দিন আসে কেউ? 

—কী ভাবছিলেন আমার কথা? 

—ভাবছিলাম তিলের নাড়ু খেতে কত ভালবাসিস…এইসব। এই খরার বৎসর! তবু উৎসবে-আনন্দে সবাইকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। হ্যাঁ রে। আমার কথার জবাব দিলি না তো? 

—আগে তিলের নাড়ু দু’একটা মুখে পড়ুক। নাড়ু আছে তো? 

—কৌটো ভর্তি আছে। এবার বল। 

সিদ্ধার্থ প্রণাম করতে করতে লাজুক হাসল। বলল— মোহন প্রতি বছর আসতে বলে আমাকে। এবার বলেনি তো! 

—বলেনি! 

এক মুহূর্ত থমকে গেলেন নয়াঠাকুমা। 

—মোহন তোকে আসতে বলেনি? তা হ্যাঁ রে ছেলে, আমরা তোর আপন নই? নেমন্তন্ন না করলে তুই আসতে পারিস না আমাদের কাছে? 

—তাই তো এলাম। 

—বেশ করেছিস। আয় বোস। আর সব বন্ধুদের আনলি না কেন? মোহন বলেনি বলে?

—না না ঠাকুমা। মোহন বলেনি, এটা কোনও বিষয়ই নয়। আমি ব্যস্ত ছিলাম নানা কাজে। কারও সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। আমি অষ্টমীর দিনই আসতে চেয়েছিলাম। 

—তা অন্যরা ঝট বলতে আসতেই বা পারবে কেন এখন! সব বিয়ে করেছে! হারাধন শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে বুঝি? 

সিদ্ধার্থ মাথা নিচু করল। কী বলবে সে? সে অনুমান করতে পারছে, নয়াঠাকুমাকে বলা হয়নি কিছু। সে নিজেও কিছু ভাঙল না। যদিও, এই বৃদ্ধার কাছে মিথ্যা বলতেও তার বাঁধছে। সে বলল—ঠিক জানি না। ওর সঙ্গে দেখা হয়নি কয়েকদিন। মোহন কোথায় ঠাকুমা? নীচে কাকিমার সঙ্গে দেখা হল। এ বছর আপনার বাড়ি তো ভর্তি। কিন্তু আপনার মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন? 

নয়াঠাকুমা হাসলেন। তাঁর সাদা চুল এবং নরম ত্বকের ভাঁজ থেকে ঝরে পড়ল কিছু বিষণ্ণতা। তিনি বললেন—মানুষের বাসনা তো পূর্ণ হয় না বাবা। ফাঁক থেকেই যায় কিছু না কিছু। পাঞ্চালিটা আসতে পারল না। তা ছাড়া, তা ছাড়া ময়না বৈষ্ণবীর কথাও মনে হচ্ছিল। তোদের কথাও ভাবছিলাম। তোরা না এলেও যে শূন্যতা থেকে যায়। 

ময়না বৈষ্ণবীর প্রসঙ্গে সিদ্ধার্থ বিষাদবিধুর হয়ে যায় নিজেও। ওই মহিলাকে সে দেখেছে মাত্র দু’দিন। তাতেই সে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে তাকে। আর এ বাড়িতে ময়না বৈষ্ণবী এসেছে কতবার। কতকাল। অতএব এই স্মরণ স্বাভাবিক। এই শোক স্বাভাবিক। নয়াঠাকুমার মতো ব্যক্তিত্বশালিনীও চোখ মোছেন সেই স্মরণে। সে হৃদয়ে তাপিত বোধ করে। কে হত্যা করল তাঁকে? ওই বীভৎস অসম্মানিত মৃত্যু প্রাপ্য ছিল না তাঁর। সে অপরাধী। শতদোষে অপরাধী। ময়না বৈষ্ণবীর হত্যাকারীকে খুঁজে বার করার জন্য কোনও আন্দোলন সে গড়ে তোলেনি কেন? রাজনৈতিক গতি তার বিবেক আচ্ছন্ন করে দিল তবে! 

সে প্রতিজ্ঞা নেয়। কোনওদিন, কোনওদিন এ কাজ সে করবে। খুঁজে নেবে সেই লোক! দশ বছর, বিশ বছর, এমনকী চল্লিশ বছর পরেও তো অপরাধীর সন্ধান পাওয়া যায়! 

অত বড় মঠের সদস্যা ছিল ময়না বৈষ্ণবী, তবু, সে-মঠও তো চাইল না প্রতিকার কোনও? চাপ তো দিল না যাতে ধরা পড়ে হত্যাকারী! 

এক অসামান্য নারীর সামান্য অন্তিম মেনে নিতে পারে না সে। এ জগৎ দুর্ভাগা বড়! এ মানবকুল বড় দুর্ভাগা! বাছবিচার জানে না তারা কে যোগ্য, অযোগ্য কে! কে আনে হিত, কে অহিত, বোঝে না। তাই কল্যাণ করুণ মুখে পথে পড়ে থাকে। সভ্যতায় দাপিয়ে বেড়ায় অকল্যাণের বৃহৎ পেশি। 

সে প্রতি পূজাতেই একদিন অন্তত এসেছে এ বাড়িতে। ময়না বৈষ্ণবীকে কখনও দেখেনি। কেন দেখেনি? বোধিসত্ত্ব বলেন—কার সঙ্গে কার কখন সাক্ষাৎ হবে তা নির্ধারণ করে কাল। কোনও কোনও সাক্ষাৎ ঐতিহাসিক সৃষ্টি ও ধ্বংসের কারক। 

তার সঙ্গে ময়না বৈষ্ণবীর দেখা শুধু ওইটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল? তার মনে হয় – সাময়িক নয় তা। তাদের সম্বন্ধ চিরকালের। সে যেন ময়না বৈষ্ণবীকেই অনুসরণ করে চলেছে নিজের অজ্ঞাতসারে। মোহনলালের কি ময়না বৈষ্ণবীকে মনে পড়ে এভাবেই? সে জানে না। এবার মোহনলাল সত্যিই আসতে বলেনি তাকে। তবে সোমেশ্বর একদিন দেখা হতে বলেছিলেন- আসছ তো? এসো কিন্তু। তুমি যা ব্যস্ত এখন! 

মোহনলাল বলল না কেন? ভুলে গেছে? নাকি সত্যিই সে চায় না সিদ্ধার্থ আসুক! সে প্রথমে ভেবেছিল, মোহনলাল বলেনি যখন, সে আসবে না। পরে মত পালটেছে। মোহনলালের কাছাকাছি হওয়া তার প্রয়োজন। কতখানি বদলেছে মোহন, তার থেকে দূরে গেছে কতখানি, জানা প্রয়োজন তার। বোঝা প্রয়োজন। বন্ধুবিচ্ছেদ কখনও হয়নি তার। নদীর মতোই, এ জীবনে, দু’জন দু’টি ভিন্ন মুখে ভেসে যেতে পারে, জানে সে। তবু, তার আগে, উপলব্ধি চূড়ান্ত হওয়া পর্যন্ত প্রতীক্ষা। হয়তো মুছে যাবে কোনও অভিমান যদি থাকে মোহনলালের ভেতর, হয়তো মিলিয়ে যাবে ভুল বোঝাবুঝি যদি থাকে কোনও। তার নিজের পক্ষে তো কোনও দূরত্ব নেই, কোনও অভিমান, কোনও ভুল বোঝা নেই। এবং সে জানে, গভীর করে জানে, এই পরিবারের সকলের প্রতি তার আছে টান। সমধিক নন্দিনীর প্রতি। নন্দিনীর মধ্যে সে পেয়ে যায় অপরূপ মাতৃত্ব মহিমা! যখন তার মা ছিল ইহজগতের, তখনও, এমনকী নন্দিনীকে সে গ্রহণ করেছিল মাতৃস্বরূপিণী! কিন্তু মাকে হারানোর পর, নন্দিনীর কোল তাকে একমাত্র মাতৃস্নেহ দেয়। সে জানে, বিশ্বাস করে সে, সম্পর্ক সর্বদা রক্তে-রুধিরে-শোণিতে জড়িয়ে থাকে না। সম্পর্কের বিস্তার বংশ-তন্তুর পরোয়া করে না। এই অসীম মহাকাশের সঙ্গে যে সম্পর্ক মানুষের, তারই অপরূপ প্রতিবিম্ব মানুষে মানুষে ঘটে যায়, ঘটে যেতে পারে। এই বোধ তার শক্তি, তার আনন্দ, তার সর্বস্ব। এমনই জীবনদর্শন ভাতে মর্মে মর্মে তার। কিন্তু নন্দিনীকে পেয়েছে সে মোহনের জন্যই তো! সে মোহনলালের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল। 

তখন সকল নাতি-নাতনিরা প্রবেশ করল নয়াঠাকুমার ঘরে। মোহনলাল পর্যন্ত। সিদ্ধার্থর সঙ্গে কমবেশি পরিচয় আছে সকলের। সেই পরিচয়ে সহজ উচ্ছ্বাসের দোলা লেগে থাকে। অতএব সিদ্ধার্থকে দেখে তারা খুশির প্রকাশ দেয়। 

সিদ্ধার্থ স্থির করে এসেছে আগামী দিন বেশ কয়েকটি গ্রামে যাবে সে। তৌফিককে বলা আছে। তিনটে নাগাদ সে চলে আসবে হরিহরপাড়ায়। সেইখান হতে যাবে তারা। গোমুন্ডি, বাপান। কালান্তর অঞ্চলের এইসব গ্রাম অবহেলিত বড়। দারিদ্রপীড়িত। সেইসব গ্রামে কোনও নেতা যায়নি কখনও। সরু, পায়ে চলা পথে, সেখানে পৌঁছয়, কেবল নির্বাচনের কালে, কিছু লোক। লোক হয়ে যায় তারা। লোক ভাড়া করে আনে। সিদ্ধার্থ যেতে চায় সেইখানে। কথা বলতে চায়। দেখতে চায় জীবনের সৌন্দর্যে দারিদ্রের অসহ পীড়নে হয়ে ওঠা ক্ষত কী গভীর! 

কাল দুপুরের আগেই বেরুতে পারলে ভাল হত। কিন্তু সে জানে, দুপুরে ভাত খেয়ে না এলে নন্দিনী কষ্ট পাবেন। এই এতটুকু কষ্ট সে নন্দিনীকে দিতে চায় না। তার মায়ের মতো অবিকল রূপ, তাঁকে সে দুঃখ দেয় কী প্রকারে! 

মোহনলাল বলে—কখন এলি? 

—এই তো কিছুক্ষণ। 

জবাব দেয় সে। 

—এই তিনদিন এলে না সিদ্ধার্থদা! তোমাকে আমরা খুব চাইছিলাম। 

তড়বড় করে বলে মধুঋতা নামের মেয়েটি। নয়াঠাকুমার ছোট নাতনি সে। ছোটছেলের মেয়ে। 

সিদ্ধার্থ হাসল। স্নিগ্ধ। কথা বলল না কিছু। পুজোর তিনদিনে না আসার জন্য বিবিধ অনুযোগ সাজিয়ে নিয়ে বসল প্রত্যেকেই। মোহনলাল বলল—আজ থাকছিস তো? রাতে বিসর্জনের পর বাউলগানের আসর বসাব। 

—থাকছি। 

বলল সিদ্ধার্থ। এবং সহসা তার মনে পড়ে গেল ইদরিশের কথা। সে যে পঞ্চরসের গান গেয়েছিল, তা চমৎকার। সে প্রস্তাব করে ইদরিশের নাম। এই আসরে গাইবার যোগ্যতা কি নেই তার? তবে ইদরিশ গভীর শোকার্ত ছিল সে জানে। সেই শোক পেরিয়ে গান গাওয়া সে শুরু করেছে কি? সকল প্রশ্ন সমেত সে প্রস্তাব করে। মোহনলাল তার প্রস্তাব সমর্থন করে। কিন্তু মধুঋতা নাক সিঁটকোয়। সে জানে না পঞ্চরস। আলকাপ, হাপু, টুসু, গম্ভীরা জানে না কিছুই। শহুরে ও প্রবাসী শিক্ষায় সে জানে কিছু বাউলগানের সংবাদ। অতএব নাকে কাঁদে নাঁ, নাঁ। শুধু বাউল! ওই বাঁউলটাকে কী সুন্দর দেখতেঁ! 

অতএব গানের সঙ্গে রূপেরও সম্ভার আমন্ত্রিত হওয়ার যোগ্যতা পেয়ে বসে। 

নয়াঠাকুমা এর-ওর মুখের দিকে তাকান। বলেন—কী করবি তোরা মোহন? কী বলিস?

মোহন বলে—বাউলগান হবে আজ! 

—বাউলগান? 

নয়াঠাকুমা চোখ থেকে চশমা খুলে নিলেন। বার্ধক্যের দু’এক গাছি সাদা ভ্রূ সমেত পেশি কুঁচকে উঠল। তিনি বললেন—বাউলগান হবে? কোথায়? 

—বাড়িতে। তুমি না বোলো না ঠাকুমা। সবার খুব ইচ্ছে। 

—আমি না বলব কেন বাপু? প্রতিমার বিসর্জন হচ্ছে না। ঢের সময় তো থাকবে বিকেল থেকে। ভালই হবে। 

নয়াঠাকুমার গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেল মধুঋতা—ওঃ! ঠাম্মা, এইজন্য তোমায় এত ভালবাসি! তুমি মায়ের চেয়েও বেশি আধুনিক। 

—আমি তোদের চেয়েও বেশি আধুনিক, তা জানিস? 

হইহই হাসি বাজায় সকলে। শৌভ, মেজছেলের পুত্র সে, গড় হয়ে যায় নয়াঠাকুমার পায়ে। ঘরে আনন্দের স্রোত বয়ে যায়। নয়াঠাকুমার মুখ হতে বিষাদের রেশ ধুয়ে-মুছে গেছে এখন। উজ্জ্বল সেই মুখে খুশি ও কৌতুকের নিখাদ কারুকাজ। সিদ্ধার্থ নয়াঠাকুমাকে দেখছিল। তার মনে হচ্ছিল, মানুষের শিশুস্বভাব সারাজীবনেও ঘোচে না। এই তার বিষাদ, এই তার খুশি। এই তার শোক, এই তার সাধ। এই না হলে মানুষের চলেই বা কী প্রকারে? নিরন্তর এত দুঃখ চারিপাশে! এত বঞ্চনা! যুদ্ধ এত! জীবনের এত এত অনিশ্চয়তা! তারই মধ্যে ভুলতে না পারলে, নিজেকে ভোলাতে না পারলে, মানুষ ভারসাম্য হারাবে। শিশুর নির্মলতা নিয়ে, উচ্ছ্বাস নিয়ে যতদিন বেঁচে থাকা যায়, ততদিনই পূর্ণ থাকে জীবনীশক্তি! তার বোধিসত্ত্বকে মনে পড়ে গেল এ সময়। কোনও সঙ্গ লাগে না তাঁর। লাগে না কোনও প্রীত বাতাবরণ। আপন ধর্মে, আপন কর্মে নিরন্তর ব্যাপৃত তিনি। কোথায়, কত দূর হতে লোক আসে তাঁর ওষুধ নিতে। কত প্রত্যাশা নিয়ে বলে—ডাক্তারবাবু! ভাল হবে তো? 

বোধিসত্ত্ব বলেন—আমি ডাক্তার হলে তুই ব্যাটা মোক্তার। 

—অ্যাঁ বাবু? 

হকচকিয়ে যাওয়া ওষুধপ্রার্থী অবাক চোখে তাকায়। 

—হ্যাঁ বাবু! 

বোধিসত্ত্ব ধমকে ওঠেন। সস্নেহ সেই ধমকে রোগী বড় ভরসা পায়। বোধিসত্ত্ব বলেন- ডাক্তারবাবু কী রে! আমি হলাম ঘোড়ার ডিমের ডাক্তার। তোরা তা হলে কী হলি? 

—আজ্ঞে, বাবু! 

—তোরা হলি ঘোড়ার ডিম! 

আপন রসিকতায় আপনি হাসেন তিনি। সদা প্রাণময়, সদা আনন্দিত মানুষটি সিদ্ধার্থর হৃদয় সাজিয়ে দিয়েছেন ফুলে-ফলে। সিদ্ধার্থর মস্তিষ্কে দিয়েছেন শক্তি। জেদ। ধৈর্য। আর স্বপ্ন! স্বপ্ন! স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা! এই দারিদ্র-লাঞ্ছিত ভারতের প্রতিটি মানুষকে দিতে হবে সহায়-সম্বল। জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনখানি লভ্য হোক হে ভারত, তোমার! 

কীভাবে ঘটবে এত কিছু, জানে না সে। কতদিনে এই দেশ হবে এক সমৃদ্ধ দেশ, জানে না সে। সে শুধু বিশ্বাস করে, দেখতে হবে, বুঝতে হবে, ছোট ছোট প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গড়ে তুলতে হবে বড় কাজ। বামফ্রন্ট যেমন নিরন্তর প্রচেষ্টায় বর্গাদারকে জমি ফিরিয়ে দিচ্ছে, ভূমিহীনের হাতে দিচ্ছে মৃত্তিকার ভার, তেমনই সুন্দর, তেমনই বৃহৎ কোনও কাজ। 

আবেগদীপ্ত হয় সে। সকলের হইচই, লঘু হাস্য-পরিহাসে, ঢাকের শব্দে ছড়িয়ে পড়ে বিসর্জনের সে সুর—তারই মধ্যে, দেশবোধে সে আবেগদীপ্ত হয়। এবং বিষণ্ণ হয়ে ওঠে ক্রমে। কোনও বৃহৎ উদ্দেশ্যই সফল হয় না কেন পুরোপুরি? এ দেশে ন্যায় এবং সততার অভাব বড়! ন্যায়বোধ ও সততা! কীভাবে একটি দেশের চরিত্র-লক্ষণ বদলে দেওয়া যায়? 

নয়াঠাকুমা বলেন তখন—গান গাইবে কে? সুন্দর বলে কাকে ঋতা? 

মোহনলাল বলল—দুলু বাউলকে বলব ভাবছি। দেখি আখড়ায় গিয়ে যদি থাকে সে। যাবি সিধু আমার সঙ্গে? 

—যাব। 

জবাব দিল সে। তার মনে পড়ল সেই দৃশ্যের কথা। এক নারীমূর্তির সঙ্গে চলে যাচ্ছে মোহনলাল। এই সম্পর্ক অদ্যাবধি বজায় আছে কি? মোহনলালের চোখের দিকে তাকাল সে। 

মধুঋতা বলল—সুখবরটা দিয়েছ মোহনদা? সিদ্ধার্থদাকে? 

—কী সুখবর? 

জানতে চাইল সিদ্ধার্থ। মোহনলাল লাজুক হাসল। নয়াঠাকুমা বললেন—ষষ্ঠীর দিন মোহনের বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেল। 

—তাই নাকি? বাঃ! 

সকলে কলকল করে উঠল—তোমারটা কবে? তোমারটা কবে? 

সিদ্ধার্থ নীরব হাসিতে এড়িয়ে গেল সকল উত্তর। সে জানে এরপরই আসতে থাকবে বহু প্রগল্ভ প্রশ্ন। হাজার রসিকতা। এই সমস্তই সে নীরব হাসির দ্বারা পাশ কাটিয়ে যাবে। সে বলল—কবে? বিয়ে কবে? 

নয়াঠাকুমা বললেন—আগামী ফাল্গুনে। 

হইচই-এর দল নয়াঠাকুমার ঘর হতে বেরিয়ে ফের মোহনলালের ঘরে অধিষ্ঠিত হল। সিদ্ধার্থকে নিয়ে মোহনলাল বেরুল আখড়ার উদ্দেশে। বাইকে পায়ের চাপ দিতে দিতে মোহনলাল বলল—তুই এসেছিস, খুব ভাল লাগছে। আমি এবার সাত কাজে খেয়াল রাখতে পারিনি। 

—আরে তাতে কী আছে? তোদের বাড়ির পুজোয় আসতে আমার নিমন্ত্রণ লাগে নাকি? বাইক নেবার কী দরকার? চল হেঁটে যাই। 

—চল। 

বাইক রেখে বেরিয়ে পড়ে তারা। সিদ্ধার্থ এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটি সিগারেট ধরায়। নন্দিনী বড় ব্যস্ত! এত জনের আগমনে, পূজার কাজে, আতিথেয়তার ত্রুটিহীন দায়িত্বে তাঁর সুকঠিন গৃহিণীপনা! সে একবার পিছন ফেরে। রাস্তা হতে দেখা যায় ঠাকুরের মূর্তিখানি। দেখা যায় পূজার আয়োজন। নন্দিনী সেখানে নেই। মোহনলাল এখনও তার কৈফিয়তকে প্রতিষ্ঠিত করছিল। সিদ্ধার্থ বুঝতে পারছে সব আর সমূহ আহত হচ্ছে সে। মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হলে প্রাথমিক আবডাল দেবার জন্য মানুষ ভদ্রতার আবরণ টানতে চায়! মোহনলাল বলে—আসলে দিন কয়েক আগে এমন একটা ঘটনা হল! 

—কী? 

—আমাদের এ অঞ্চলের মুসলিম লিগ নেতা, বেশ প্রভাব আছে এলাকায়, করম মণ্ডল নাম।

—হ্যাঁ। জানি। 

—রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন খুব ভাল। বাইরে যেতেন। কলকাতায় অনেক বাড়ি করেছেন। রাজমিস্ত্রির কাজে ওঁদের পরিবার রীতিমতো ঐতিহাসিক। 

— তাই? 

—হ্যাঁ। ওঁদের আদিপুরুষ কদম মণ্ডল ছিলেন হিন্দু। সেনদের আদিপুরুষ উদ্ধব সেনের সঙ্গে এসেছিলেন এই গ্রামে। মাথায় সোনার কলস বসানো যে শিবমন্দিরটির কথা শোনা যায়, সেটি গড়েছিলেন কদম মণ্ডল। এই বংশেরই একজন গড়েছিলেন চেহেল সুতুন। চেহেল সুতুন কী, মনে আছে তো? 

—হ্যাঁ। চল্লিশটি থামওয়ালা বাড়ি। মুর্শিদকুলি খাঁর প্রাসাদ। 

—হ্যাঁ। এরপর, শুনেছি সিরাজের প্রাসাদ গড়তেও মিস্ত্রি গিয়েছিল এই পরিবার থেকে। হাজারদুয়ারি নির্মাণেও হাত লাগিয়েছিল এই পরিবার। রাজমিস্ত্রির কাজ সত্যিই ভাল জানেন করমচাচা। আমাদের দোতলাটা নতুন করে উনিই করে দিয়েছিলেন। কিছুদিন আগে ওঁর একটা দুর্ঘটনা হয়েছে। 

—কী দুর্ঘটনা? 

—কলকাতায় একটি বহুতল বাড়ি তৈরির কাজ করতে গিয়ে পড়ে যান করমচাচা। 

—কী করে? 

—যে-বাড়িতে কাজ হচ্ছে, সে বাড়িতেই রাতে থেকে যেতেন ওঁরা। গরমে ছাতে শুয়েছিলেন। ঘুম চোখে ন্যাড়া ছাতের ধারে দাঁড়িয়েছিলেন প্রস্রাব করার জন্য। অন্ধকারে পা পিছলে যায়। 

— ইস্‌স্। 

—কোমর ভেঙে গেছে একেবারে। শিরদাঁড়া টুকরো-টুকরো। করমচাচা উঠে দাঁড়াতে পারবেন না আর কোনও দিন। 

কথা বলতে বলতে তারা পৌঁছে গিয়েছিল ইদরিশের বাড়ির নিকটে। সিদ্ধার্থ তাকাল বাড়িটির দিকে। এই সেই শোকার্ত সংসার। মনে আছে তার। কেমন আছে এরা? আজও কি এই বাড়ির নারীটি সন্তানের জন্য মধ্যরাতে গুমরে কাঁদে? 

সে ভাবছিল এমন। আর তখন মাসুদা এসে দাঁড়াল বারান্দায়। ভরা শরীর তার। গর্ভে সন্তানের অবস্থিতি পুরুষের চোখেও পরিস্ফুট। এ দৃশ্যে মন ভাল হয়ে গেল সিদ্ধার্থর। হোক, হোক। সন্তান হোক এই দম্পতির। নবজাতকের আগমনে সেই অসহ শোকের ওপর প্রলেপ পড়ুক আনন্দের, সুখের। ভাল থাকুক ওরা! ভাল থাকুক। 

মোহনলাল বলে চলেছিল—কী অদ্ভুত ব্যাপার জানিস! 

—কী? 

—বিঘে তিনেক জমিজমা ওঁদের। দুইভাই একসঙ্গেই থাকতেন। মূলত করম মণ্ডলের উপার্জনেই সংসারে ভাল টাকা-পয়সা আসত। করমচাচা পঙ্গু হয়ে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে ওই ভাই জমি ভাগাভাগি করে আলাদা হয়ে গেল। এদিকে করম চাচার দু’টি ছেলে এই আমাদের মতো। চারটি মেয়ে ছিল। দু’জনের বিয়ে দিয়েছে। বাকি আছে আরও দু’টি। খুব কষ্টে পড়েছে সব। বরকতচাচার বয়স হচ্ছে তো। পার্টিকর্মী হিসেবে এলাকার দায়িত্ব আস্তে আস্তে আমার ওপরেই এসে যাচ্ছে। 

সিদ্ধার্থ তাকাল একবার মোহনলালের দিকে। কিছু বলল না। রাজনীতিতে অভিজ্ঞ এবং অভ্যস্ত ব্যক্তির কাছে বয়স কি কোনও বাধা হতে পারে, যদি সে ব্যক্তি সুস্থ থাকেন? বরকত আলি অসুস্থ মোটেই নন। সে টের পায়, এলাকার ক্ষমতা কেড়ে নেবার যুদ্ধে জয়লাভ করতে চলেছে মোহনলাল। মোহনলাল বলে চলে তখন—জমিজমা ভাগাভাগি, কে কত পাবে, আমাকেই করতে হয়েছে সব। লিগের সমর্থক লোকজনও সব আমারই শরণাপন্ন হল। আস্তে আস্তে এমনই হচ্ছে এই এলাকায় সিধু, আমাকে না জিগ্যেস করে গাছের একটি পাতাও এখানে নড়বে না। 

সেটা কি ভাল? এরকম একমুখাপেক্ষী হওয়া কি ভাল? বলল না সিদ্ধার্থ। বলল না, নেতৃত্বের কাজ নয় জনগণের ভাবনক্ষমতাকে পঙ্গু করে দেওয়া। বরং, জনচেতনাকে জাগ্ৰত করে তোলাই নেতার ধর্ম। নীতি। 

মোহনলাল বলে চলল—মানুষ কত অকৃতজ্ঞ হতে পারে, এই প্রত্যক্ষ রাজনীতির জগতে এসে জানতে পারছি। ছাত্র রাজনীতিতে লোকচরিত্র ততখানি স্পষ্ট হয় না। 

সিদ্ধার্থ ভাবছিল, লোককে চরিত্র হিসেবে দেখলেই বড় অসুবিধা। তার হাজার গুণের সঙ্গে হাজার দোষ দৃষ্টিগোচর হবে তখন। এবং দোষের শক্তি গুণের চেয়ে অধিক বলে দূষণীয়ের আবরণে ঢেকে যাবেই গুণসকল। তখন চরিত্র হিসেবে দেখা মানুষের প্রতি জাগবে না ভালবাসা, জাগবে না সহানুভূতি। দোষ বিশ্লেষণের তিক্ততা প্রতিহত করবে কোমল অনুভূতিগুলিকে। এবম্বিধ মানসিক অবস্থায় মানুষের জন্য কাজ করা সম্ভব হয় কী প্রকারে? 

সকল সময়, দৃষ্টিভঙ্গিই কর্মের অনুপ্রেরণা। মানুষকে, সকল অসহায়তা সমেত দেখলে, হৃদয় সহায়ক হয়। ক্ষমার চেয়ে সুন্দর, ক্ষমার চেয়ে অধিক মানবিক আর কিছুই হয় না এ জগতে। যত যোজন-বিস্তৃতভাবে সম্ভব, এই ক্ষমাসুন্দরের দৃষ্টিই পাথেয় হওয়া উচিত। চরিত্র হিসেবে, দূরতর নির্মোহে না দেখে, মানুষকে দেখা উচিত আত্মীয়ের ঘনিষ্ঠতায়। 

তবু, সিদ্ধার্থ সে, জানে, ক্ষমারও আছে সীমা, আছে শেষ। মানুষ ভেদে ক্ষমার সীমায় তারতম্য ঘটে যায়। এমনকী, কোনও কোনও পর্যায়ে, ক্ষমাধর্মও অপরাধ বলে তার কাছে গণ্য হতে পারে। ময়না বৈষ্ণবীর হত্যাকারী ধরা পড়লে কি সে ক্ষমার কথা ভাববে? না! ভাববে না! যদি ভাবে কেউ, তাকেও নাশ করবে সে। দীপেন হাজরাকে কি সে ক্ষমা করতে পেরেছিল? হাফি আর বাপি? হয় না। ক্ষমা হয় না সব কিছুর। সবাকার। তা হলে কি সকল বৈশিষ্ট্যেরই আছে সীমা-পরিসীমা? নাকি সকল আদর্শই চূড়ান্ত করে রাখা হয় এবং মানুষ সেই চূড়ান্তের দিকে সারাজীবন ধাবিত থাকে! 

মোহনলালকে এসব কিছুই বলে না সে। কোনও তর্কে যায় না। যায় না কোনও বিশ্লেষণে। শুধু শুনে যায়। মোহনলাল বলছে—দাদার টাকায় খেল, পরল, সন্তান মানুষ করল এতকাল। দাদা পঙ্গু হয়ে ফিরতেই যে-যার নিয়ে আলাদা হতে চাইল। করমচাচার দুই ছেলেকে ডাকিয়ে বললাম, ‘সরাসরি আমাদের দলে যোগ দাও। এক বিঘে জমি বেশি পাইয়ে দেব তোমাদের।’ 

—রাজি হল তারা? 

জিগ্যেস করল সিদ্ধার্থ। মোহনলাল বলল— রাজি হল। হবে না কেন? যতদূর বুঝতে পারছি, এই এলাকায় লিগের সংগঠন পুরোপুরি করমচাচার হাতে ছিল। এখন কে এগিয়ে আসবে? এলেও করমচাচার ছেলেদের সুবিধে দেবে কেন? লোকে এখন যেদিকে সুবিধে পাবে, সেদিকেই যাবে। 

আখড়া এসে গিয়েছিল। জসিম বাউলের সঙ্গে দাওয়াতেই বসে ছিল দুলু বাউল। দিন কয়েক হল এই আখড়ায় ওসমান নামে এক নতুন বাউল এসেছে। সঙ্গিনীও আছে তার একজন। গুরু মহম্মদ সাঁইয়ের নির্দেশে তারা এখানে বসবাস করে যেতে এসেছে। ওসমান বাউলের সঙ্গিনীর নাম তারা। ওসমান বাউল এবং তারা গায় ভাল। দু’জনেরই গলার সুর প্রাণ স্পর্শ করে। এই পূজার কালে তারা কোনও অনুষ্ঠানে গানের বরাত পেয়ে চলে গেছে। দুলু বাউলেরও ডাক এসেছিল কয়েক জায়গায়। যায়নি সে। সিদ্ধার্থ ও মোহনলালকে দেখে উঠে দাঁড়াল তারা। স্মিত হাসিতে ভরে গেল দুলু বাউলের মুখ। নত হয়ে সে বলল— প্রণাম। তার নজরে পড়ল, মোহনলালের চোখ দু’টি ব্যগ্র চেয়ে আছে অন্দরের দিকে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *