2 of 3

রাজপাট – ৮১

৮১

ভাদ্রমাসে জন্মাষ্টমী 
হরি-জন্মমাস। 
সবার আনন্দে কিন্তু 
মোর হা-হুতাশ ॥ 
এই না মাসেতে গাছে 
জুড়া জুড়া তাল। 
পাপিষ্ঠ যৈবন গো অইল 
অভাগিনীর কাল রে। 
ফাঁকি দিয়া বন্ধু আমার 
কোথায় লুকাইল রে—

.

 মুর্শিদাবাদ বেরা ভাসান উৎসবে মেতেছে। প্রতি বছর ভাদ্রমাসের শেষ বৃহস্পতিবার এ উৎসব সম্পন্ন হয়। খাজা খিজিরের স্মরণে এই অনুষ্ঠান। জ্ঞানী ইলিয়াসকে মুসলমানেরা খিজির বলে নির্দেশ করে। হজরত ইলিয়াস জলের দেবতা। তাঁরই জন্য ভাসানো হয় কলার ভেলা। ভেলার ওপর নানা আকারের বাঁশ ও কাগজের গৃহ, তোরণ। সমস্ত ভেলা সাজানো থাকে আলোকমালায়। দিগন্ত প্রসারিত নীলাকাশে ভাদ্রের খণ্ড খণ্ড কালো মেঘ ও কলঙ্কিত বিদ্যুল্লেখা চকিত আলোক হেনে রচে যে অন্ধকার, তারই তলে, সন্ধ্যায় ভাসানো হয় ওই অজস্র আলোকবিন্দুসাজে সজ্জিত ভেলা। মুর্শিদাবাদের সৌধগুলিও সেদিন আলোর মালায় সাজে। 

নবাবি আমলে বেরা উৎসবে জৌলুসের কোনও তুলনা ছিল না। নবাববংশীয়রা ওই দিন স্বর্ণরৌপ্যখচিত পোশাক ও মণিমানিক্যে ভরা অলঙ্কারাদি পরিধান করতেন। নবাব প্রাসাদে এক বিরাট দরবার বসত। দেশীয় এবং ইউরোপীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ ওই দরবারে উপস্থিত থাকতেন। ঘন ঘন তোপধ্বনি করে উৎসবের সমারোহ বৃদ্ধি করা হত। আজ সেই নবাবও নেই নবাবি ও নেই। কিন্তু উৎসবটুকু আছে। মুর্শিদকুলির আমল থেকে চলে আসা এ উৎসব আজও জনগণকে মাতায়। নবাবের বংশধারায় যাঁরা বেঁচে আছেন অদ্যাবধি, নবাব মীরজাফরের উত্তরপুরুষ- তাঁরা অংশ নেন এ উৎসবে। 

সিদ্ধার্থ এই উৎসবে আনন্দ পায়। আকর্ষণ বোধ করে। ভেলা ভাসানো হলে দেখতে ভাল লাগে, যদি চোখে পড়ে। যদি সে থাকে নদীর কাছাকাছি। না হলে উৎসবে-অনুষ্ঠানে যোগ দেবার সময় মেলে কোথায় তার? কাজে কাজে সময় যায়। বাইরের সাজসজ্জা আয়োজন দেখে তার মনে পড়ে উৎসব এল। বরং উৎসবহীন এ এক অনন্ত জিজ্ঞাসার মতো তার কাছে। এত সহস্র গ্রামে কেন স্কুল নেই আজও? হাসপাতাল নেই কেন? অন্য সব সুবিধা ছাড়াও এই দু’টির তো থাকার কথা ছিলই আজ স্বাধীনতার পর এই চুয়াল্লিশ বছরে। নেই কেন? 

সামগ্রিক উন্নয়নের দায় কেন্দ্রের ওপরেই অধিক বর্তায়। গ্রামোন্নয়নের জন্য বামফ্রন্টের প্রচেষ্টা আছে। কিন্তু প্রয়োগযোগ্যতা নেই। এবং বামফ্রন্ট সময়ও পেয়েছে হাতে তেরোটি বৎসর। তার আগে? যখন ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস, কেন্দ্রে এবং রাজ্যে সমানভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, তখন কী হয়েছে? লুটেপুটে নেওয়া ছাড়া, নকশাল দমনের নামে অকংগ্রেসি যুবশক্তিকে নিধন করা ছাড়া, জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া আর কী আছে কীর্তি তাদের? 

রাসুদা এবং মিহির রক্ষিতের সঙ্গে, সে, তৌফিক এবং আরও কয়েকজন এসেছিল স্কুলের উদ্বোধন করতে। পর পর তিনটি গ্রামে খোলা হল তিনটি প্রাথমিক স্কুল। বাঁশের বেড়ার স্কুলবাড়ি। তাতে টিনের চালা। শিক্ষকের জন্য একটি চেয়ার ছাড়া আর কিছু নেই। ছাত্রছাত্রীরা পড়বে মেঝেয় বসে। 

আয়োজন সামান্যই। তবু হচ্ছে স্কুলবাড়ি। লোকে উজ্জ্বল উৎসাহে ঘিরে আছে অনুষ্ঠান। সব দেখে-শুনে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠছিল সে। সে বরাবর দেখেছে, মানুষ কত সামান্য পেলে খুশি হয়! খুশি থাকে! সামান্য প্রাপ্তির জন্য বুকে কৃতজ্ঞতা ধরে রাখে চিরকাল। কিন্তু সেই সামান্যটুকুও সাধারণের দরবারে পৌঁছয় না। 

চারিদিকে স্বার্থের রাজনীতি। স্বার্থের ফের। ঘুরে ঘুরে দেখছে সে। কোনও দল তার থেকে মুক্ত নয়। সব দলেই পাওয়া যাবে কয়েকজন ভাল, মন্দ কয়েকজন। কিন্তু ভাল ও মন্দের ভাগাভাগি করতে বসলে নিজেদের দলে ভালোর টুকরো সে অধিক দেখতে পায়। এ দলের শীর্ষে রয়েছেন বহুজনশ্রদ্ধেয় নেতৃত্বের সারি। সংগঠনের শৃঙ্খলা ও শক্তি তাঁদের দৃষ্টান্ত হওয়ার মতো। বাকি যা কিছু, সমস্তই টুকরো টুকরো। বিভাজিত। একটি দল গড়ে ওঠে। বড় হয়। কেন্দ্রে চড়ে বসে। এবং ভেঙে যায়। বেলুনের মতো। ফুলে ওঠে। ওড়ে। ফেটে যায়। যে-কোনও সংগঠনই বৃহৎ হলে তার মধ্যে নৈরাজ্যের বীজ জন্মায়। এ যেন ভারতীয় সংক্রামক ব্যাধি। জাতীয় দল হিসেবে, স্বাধীনতার আগে, কংগ্রেস গড়ে উঠেছিল যখন, তখন থেকেই এর সূত্রপাত। তাদের দলেও এই ব্যাধি নেই তা নয়। কিন্তু অল্প। সামান্য। কংগ্রেসের মতো বহু রাজার নাচনে গাজন নষ্টের পরিস্থিতি তাদের নয়। 

হ্যাঁ। স্বার্থের রাজনীতি নিজের দলেও সে দেখেছে স্পষ্টতই। দলের লোক হলে চাকরি মেলে সহজেই। দলের লোক হলে পাওয়া যায় ব্যাঙ্কঋণ। হাসপাতালে শয্যা পাওয়া যায়। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা মেলে চটজলদি। দলের লোক হলে হাজার সুবিধার হাতছানি। সে বোঝার চেষ্টা করে, এ কি তারাই এককভাবে আমদানি করেছিল? তাদেরই দলের ঐতিহ্য কি এ? না। 

ইতিহাস জানে সে। মানুষের আচরণবিধি ও বৈশিষ্ট্য ঐতিহাসিকভাবে চলে আসে পরম্পরায়। কংগ্রেসি আমলে যার সূত্রপাত ঘটেছিল, তা-ই ছড়িয়ে গেছে লোকে-লোকে, মর্মে-মর্মে। অথচ ওই দলটিই পারত একটি জাতীয় চরিত্র গঠন করতে। সারা ভারতে যতখানি ব্যাপ্ত ছিল কংগ্রেস, তেমন আর কোনও দল ছিল না। 

গ্রামে গ্রামে ভ্রমণ দিচ্ছে তাকে নতুন দৃষ্টি। নতুন ভাবনার দিগন্ত। 

জমিদারি লুপ্ত হয়েছিল। এসেছিল জোতদার শ্রেণি। কংগ্রেসের আমলে কারা ছিল জোতদার? ক্ষমতায় ছিল কারা? অধিক কংগ্রেসি। এই জেলা মুর্শিদাবাদে, সীমান্ত পেরিয়ে আসা উদ্বাস্তুদের গ্রামে-গ্রামে বসিয়েছিল কারা? ওই কংগ্রেসি ক্ষমতাশালীর দল। জেলার ভাল ভাবেনি তারা, রাজ্যের ভাল ভাবেনি, ভাবেনি দেশের কথা। শুধু দেখেছিল ভোট। ভোটের রাজনীতি দেখেছিল। 

আজ গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে লোকবাহুল্য। খোঁজ নিয়ে বুঝেছে সে, জিজ্ঞাসা করে বুঝেছে, সত্তর দশকের আদিতে বা ষাটের দশকের শেষে সীমান্ত পেরিয়ে আসা পরিবারগুলি ভরিয়ে দিয়েছে জনপদ। জায়গা নিয়েছে। বসেছে। স্থানীয় নেতৃত্বকে দিয়েছে অর্থ ও সমর্থনের প্রতিজ্ঞা এবং একের পর এক দখল করেছে সরকারি খাস জমি। দখলিকৃত জমির কোনও দলিল আজও পায়নি, এমন পরিবার বিস্তর। অথচ রেশনের পরিচয়পত্র আছে। যারা সীমান্ত পেরিয়ে আসে, তারাই তৎপর হয় এই পরিচয়পত্র পেতে। এবং স্থানীয় নেতৃত্বের মাধ্যমে তা পাওয়া যায় সহজেই। নেতাকে দিতে হয় কিছু টাকা, দলীয় তহবিলে দিতে হয় কিছু। তা হলেই পাওয়া যায়। বৈদুলিপুরে আগে ছিল জাল রেশনকার্ড ছাপাবার কারখানা। কংগ্রেসি জমানায় একজন পরিচিত নেতার গোপন দখল ছিল তাতে। শুধুই গোপন নয়। একসঙ্গে গোপন ও প্রকাশ্য। এখন, ওই একই বস্তু তৈরি হয় ভাদুরিয়াপুরে। সি পি আই এম-এর মদতপুষ্ট রাজু শেখ ও রহমৎ মোল্লা চালায় এ কারবার। এ সবই গোপন কিন্তু সকলই প্রকাশ্য। বর্ষ-বর্ষ ধরে চলে আসছে একই দস্তুর। ক্ষমতার কেন্দ্র পালটেছে। ব্যক্তি পালটেছে। কিন্তু চিত্র অবিকল। লোকে এসব জানে। জেনেশুনে চুপ করে থাকে। কারণ এই অবৈধ ব্যবস্থার মাধ্যমে কেউ-কেউ সুবিধা পায়। কেউ-কেউ ঝামেলায় জড়াতে চায় না বলে চুপ করে থাকে। তা ছাড়া, অলিখিত যা, তা হল ভীতি। ক্ষমতা যার হাতে, অস্ত্র, বৈধ বা অবৈধ, হাতে যার, তারা সংখ্যাল্প হলেও শক্তিমান। শক্তি দ্বারা তারা ছড়াতে সক্ষম হয় ত্রাস। প্রাণ হাতে করে বাঁচা মানুষের, দৈনন্দিন বাঁচা, কে আর প্রশ্ন তুলে অশান্তি বাড়াতে চাইবে? জীবন সংগ্রামের মার সহ্য করতে করতে কে আর ন্যায়নীতির জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করবে? 

অপারেশন বর্গা করে বামফ্রন্ট জোতদারের থেকে জমি নিয়ে ভূমিহীনকে দিয়েছে সেই জমি। হায়! সেই জমি ফিরে আসছে এক নবজোতদার শ্রেণির কাছে। নানা নামে, নানা বেনামে শত শত বিঘা জমি নিয়ে সার সার দাঁড়িয়ে আছে রক্তলাল পতাকা ওড়ানো জমিদার নয়, নবজোতদার। কে তাদের চিহ্নিত করে! করে না! কারণ দল চালাতে চাই অর্থের উৎস! উৎসমুখে অঞ্জলি দেয় তারা মোটা পরিমাণ! বিধিবদ্ধ সংস্কার, উন্নয়ন, প্রগতি দলীয় তহবিলে প্রদত্ত স্বেচ্ছাদানের ভারে মুখ থুবড়ে পড়ে। যাঁর হাতে রথের রশি তাঁরই ভারে রথের চাকা বসে গেলে ব্যবস্থা সচল থাকে কী প্রকারে? 

শক্তির বিনাশ নেই। মার নেই। শক্তি রূপ পালটায় শুধু। এই এল, এই গেল, তবু রয়ে গেল সব। এল রূপে-রূপান্তরে। এই এক প্রাকৃতিক আইন। এই অবিনাশী শক্তি। এই এক বিজ্ঞানসত্য। 

এমনই হয়ে আসছে কালে কালে। কাল যে ছিল স্বার্থান্বেষী শক্তিধারক, আজ সে নেই, কিন্তু তাকে দেখে তৈরি হয়েছিল আজকের নায়ক। আপামর জনসাধারণে চলে এই খেলা। এই নিয়ম। বড়-ছোট নির্বিশেষে। ভিন্ন দল। ভিন্ন নীতি। তবু মানুষের হৃদয় একাকার। যাঁরা ব্যতিক্রম, তাঁরা স্মরণীয়। আপামর জনচিত্তের থেকে আলাদা হয়ে ওঠার শক্তি থাকে সামান্যের—এ চিরসত্য। সেই সামান্যের শক্তি নগণ্য নয়। সাধারণের শক্তিকে তা চালিত করতে পারে। শক্তির, নিহিত শক্তির বিপুলতার ওপর নির্ভর করে নেতৃত্বের ঝাঁঝ। 

এই চক্রবৎ পরিবর্তনীয় শক্তির খেলায় অধিক প্রভাবিত হয় গ্রামদেশ। মফস্সল। এমনকী প্রত্যেকটি গ্রামও সমান প্রভাবিত হয় না। সে দেখেছে, গ্রামীণ জীবন রাজনীতির ওপর অধিকতর নির্ভরশীল। কারণ গ্রামের অধিকাংশ মানুষকেই বিবিধ সুবিধা পেতে গেলে পঞ্চায়েতের মুখের দিকে তাকাতে হয়। কৃষিজীবনের জন্য চাই বীজ, সার, চাই মিনিকিট, চাই সেচের সুবিধা, চাই গো-মহিষাদি বা হাঁস-মুরগির জন্য টিকা বা ওষুধ বা প্রজনন সুবিধা। এবং, গ্রামীণ জনজীবনে আপনার সামর্থ ও উদ্যোগে সমস্ত আয়োজন করার ক্ষমতা থাকে না নব্বই শতাংশ মানুষের। পঞ্চায়েতের মুখাপেক্ষী থাকা তাদের রাজনীতির মুখাপেক্ষীই করে শেষ পর্যন্ত। কারণ পঞ্চায়েতি-রাজের ধারক বাহক সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক কর্মীবৃন্দ! সরকারি কর্মচারীগণ, তাঁর সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পরামর্শে। তার বাইরে যাওয়ার সাধ্য কারওর নেই। 

যে-গ্রামে যত বেশি উন্নত মানুষ, যত বেশি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ, সেই গ্রামে রাজশক্তি সমঝে চলতে বাধ্য! এবং, কোনও গ্রাম, সমৃদ্ধ কি না, তারও অনেকখানি নির্ভর করে ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর! অঞ্চলের মাটি কেমন, জলের উৎস কেমন, শহরের সঙ্গে দূরত্ব কত, যোগাযোগ কেমন—এই সকলই জীবনধারণের জন্য গ্রাহ্য! জনকল্যাণ ও সমৃদ্ধির সংজ্ঞা বদলে গেছে অনেক। এখন শুধুমাত্র খাওয়া পরার সংস্থানই শেষ কথা নয়। যদিও অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মৌলিক চাহিদাও অধিকাংশে পূরণ হয়নি। তবু জনচেতনায় আজ এই জীবনের প্রতি দৃষ্টিতে লেগেছে নতুন রং। তারা জানে, বেঁচে থাকার জন্য, সুস্থ জীবনের জন্য লাগে বিদ্যুৎ, জলের উৎস, শিক্ষার ব্যবস্থা, চিকিৎসার সুবিধা, লাগে কাজের সুযোগ, এমনকী জানার অধিকার নিয়ে কথা ওঠে। সরকারি সুবিধা, পরিষেবা যথেষ্ট কি না তার বিচার আলাদা, সেই সুবিধাগুলি কী কী, পাওয়া যায় কীভাবে, কারা পেতে পারে, জানে না বিপুল জনগণ! 

মানুষ যদি শুধু প্রকৃতি-নির্ভর হয়ে বাঁচে, যদি জন্ম-মৃত্যুর মধ্যবর্তী এক অনিশ্চয় যাপনই তার লক্ষ্য হয়, তবে রাজার রাজত্বের কী-ই বা প্রয়োজন! 

এক রাজার যুগ গিয়েছে। এখন এসেছে সবাই রাজার রাজত্ব! সে-রাজত্বর প্রথম উদ্দেশ্যই হওয়ার কথা ছিল মানবকল্যাণ! জীবন-সমৃদ্ধি! অথচ সকল রাজা পরস্পর টুটি কামড়ে ধরে আছে সব ভুলে। 

এই ব্যাধি সহজে সারবে না। সহজে মরবে না এর সংক্রামক-ক্ষমতা। একে মারতে হবে ধীরে। অতি ধীরে। কিন্তু নিশ্চিতভাবে। 

সিদ্ধার্থ সে, বিশ্বাস করে, মানুষ যতখানি খারাপ, ততখানি ভাল। বা, প্রকৃত অর্থে, যতখানি খারাপ, তার চেয়ে বেশি ভাল। জীবিত ভালত্বের কাছে আবেদন করলে সাড়া পাওয়া যাবেই! যাবেই! 

ছোট ছোট বক্তৃতা করছিলেন রাসুদা এবং মিহির রক্ষিত। জনতা তাদের দাবি জানাচ্ছিল ভাবিকালের মন্ত্রী মিহির রক্ষিতের কাছে। এই ইস্কুল উদ্বোধনের অছিলায় প্রচার কমে এসে মিহির রক্ষিত আজ কল্পতরু। এমন হওয়াই সবচেয়ে বেশি সুবিধাজনক। জনগণের মুখে আশার ললিপপ গুঁজে দাও। তারা যদি বলে-গ্রামে বিদ্যুৎ নাই। উত্তর দাও- শিগগির ব্যবস্থা হবে। 

যদি বলে—গ্রামে অন্তত ছয়জনের বার্ধক্যভাতা পাওয়া দরকার। 

উত্তর দাও—নিশ্চয়ই। এ নিয়ে আপনারা দরখাস্ত করুন। তিনমাসের মধ্যে ব্যবস্থা হবে। 

—হাসপাতাল নাই। চিকিৎসক নাই। 

—হাসপাতাল হবে। যতদিন না হয়, সপ্তাহে একদিন ডাক্তার আসবেন গ্রামে। আমরা তার ব্যবস্থা করব। 

—সার, বীজ… 

—হবে… 

—সেচব্যবস্থা… 

—হবে… 

—পাম্প… 

—হবে… 

হবে হবে। সব হবে। কবে হবে? কেউ জানে না। কিন্তু এসব বলতে হয়। 

মিহির রক্ষিতের বলা হয়ে গেলে উঠে দাঁড়ালেন একজন। মাটিতে বসে থাকা জনতার মধ্যে থেকে এক শীর্ণপুরুষ। হাতজোড় করে তিনি বললেন—আপনারা এসেছেন, আমাদের গ্রাম ধন্য হয়েছে। আপনারা বক্তৃতা করেছেন, তাতে আমাদের প্রাণে আনন্দ হয়েছে। আমরা একবার চাই সিদ্ধার্থবাবুর বক্তৃতা শুনতে! 

সিদ্ধার্থ সচকিত হল। এ কী বলছেন মানুষটি! তার তো এখানে বলার কথা নয়। সে লক্ষ করল, মিহির রক্ষিতের মুখ ঝুলে পড়ল কেমন! 

মানুষটি বলে চলেছেন—উনি বললে আমাদের ভাল লাগবে। 

সমবেত জনতার মধ্যে রব উঠল—বলেন। সিদ্ধার্থবাবু বলেন। 

রাসুদা হেসে তাকালেন সিদ্ধার্থর দিকে। ইশারা করলেন। এখানে বিজলি নেই। তাই শব্দবর্ধনের ব্যবস্থাও নেই। এমনই সে বলতে ভালবাসে। জনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে নয়। মঞ্চে যতবার বলেছে সে, মনে হয়েছে তার, মঞ্চে উঠলেই বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। অথচ, সে বিশ্বাস করে, বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে বিষয়ের আদান-প্রদান না হলে, অভিব্যক্তি ও উষ্ণতার স্পর্শটুকুর বিনিময় না হলে এত কথার কোনও মানে হয় না। কথা তো শুদ্ধ কর্তব্যমাত্র নয়। কথার মাধ্যমে হৃদয়ের ভাব হৃদয়ে প্রেরিত হয়। 

অতএব, এই বিনা মঞ্চের আয়োজনে সে খুশি। রাসুদার অনুমোদনে সে দাঁড়াল। গলা পরিষ্কার করে নিল। নমস্কার করে নিল হাতজোড় করে। তারপর শুরু করল—উপস্থিত ভদ্রজনমণ্ডলী। আপনারা আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন। মুর্শিদাবাদের এই নাতালি নামের গ্রাম, এখানে একখানি স্কুল পত্তন করা হল। এক পক্ষ থেকে এ বড় লজ্জার যে স্বাধীনতার তেতাল্লিশ বছরেও আমাদের গ্রামে গ্রামে স্কুল নেই। পৌঁছয়নি বিদ্যুৎ। নেই সর্বব্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা এই লজ্জা আমাদের পরাধীনতার লজ্জার চেয়ে কম নয়। এই লজ্জা, এই দায় ছিল আমাদের পূর্বসূরিদের। আজ আমাদের সকলের ওপরেই তা বর্তেছে। আপনি, আমি কেউ-ই এক সুন্দর সমৃদ্ধ ভারতবর্ষ গড়ে তোলার দায় ঝেড়ে ফেলতে পারি না। 

দেশের অধিবাসী নিয়েই দেশ। দেশের নাগরিক নিয়েই দেশ। আমরা, যারা এই দেশের ভূমি অধিকার করি, এই দেশের জল, বায়ু, আলো, সম্পদ পেয়ে বেঁচে থাকি, এই আমরা, আসুন প্রত্যেকে সমৃদ্ধ দেশ গড়ার পক্ষে পা ফেলি। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে। দেশের মানুষই পারে দেশকে সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ করে গড়ে তুলতে। 

আমি আপনাদের মনে রাখতে অনুরোধ করব, ব্যক্তি থাকে, দল থাকে, মত থাকে, মতান্তর থাকে, কিন্তু সবার উপরে থাকে দেশ। দেশাত্মবোধকেই দিন সর্বাগ্রগণ্যতা। 

আজ ভারতবাসীর শিক্ষা নেই, স্বাস্থ্য নেই, খাদ্য নেই, জল নেই, মাথার ওপর নেই একফালি ছাতের আশ্বাস। আজও প্রকৃতির সামান্য নিষ্ঠুরতায় ধুঁকতে থাকে আমাদের জীবন। 

এই যে অনাবৃষ্টির বছর, দেখুন, মাঠে মাঠে শস্য নেই, আধুরা পড়ে আছে বিঘের পর বিঘে জমি। সেচব্যবস্থা এখনও বৃষ্টির অভাব মেটাতে পারেনি। বাঁধের পরিকল্পনা এখনও বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। একটা, মাত্র একটা মরশুম ক্ষেতে ফসল নেই বলে অনাহারে, অর্ধাহারে কাটাচ্ছে বহু জন। কেন? কাদের অক্ষমতায়? 

আসুন, অন্যের বিচার করতে করতে আমরা নিজেরও বিচার করি। তাকাই আমাদের কৃতকর্মের দিকে। শুধরে নিই সব ভুল, যদি কিছু থাকে। 

আসুন, ধর্মীয় বিদ্বেষ ভুলে, হানাহানি ভুলে, দলীয় বিরোধিতাকে পাশে সরিয়ে রেখে আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি। সব মানুষেরই থাকে কাজের কিছু-না-কিছু যোগ্যতা। সেই কাজ বড় হোক বা ছোট তার বিচার অনাবশ্যক। আমি শুধু আপনাদের সকলকে এই কথা মনে রাখতে অনুরোধ করব—যে যার কাজের জায়গায় একনিষ্ঠ হোন, সৎ হোন। সকলের একনিষ্ঠ কাজের মধ্যে দিয়েই জগৎ সুন্দর হয়ে ওঠে। এক সন্ধ্যায় সূর্য অস্তে যাবার আগে এই বিশ্বকে জিগ্যেস করলেন—আমি তো অস্তে যাচ্ছি, আমার যে আলো দেবার কাজ, তার দায় এখন তোমরা কে নেবে বলো? 

এ প্রশ্ন শুনে সকলে চুপ করে রইল। এক কোণে ছিল মাটির প্রদীপ। সে বলল— হে ঠাকুর! আমার যেটুকু সাধ্য, আমি করব! 

এই স্কুল থেকে তৈরি হোক ভবিষ্যতের সচেতন, কর্মনিষ্ঠ নাগরিক। দেশকে প্রগতির পথে নিয়ে যাক তারা। এই আমার একান্ত কামনা। এবং সেইসঙ্গে অনুরোধ, প্রত্যেকটি সন্তানকে স্কুলে পাঠান। ছেলেমেয়ের বিচার না করে প্রত্যেককে স্কুলে পাঠান। শিক্ষার মধ্যে দিয়েই আসে চেতনা, আসে ভাবনার ক্ষমতা। ভাবনার ক্ষমতা যত বাড়ে, জীবন তত সুন্দর হয়। সমৃদ্ধ হয়। নমস্কার। ইনকেলাব জিন্দাবাদ। 

গ্রাম্য মানুষগুলি, তাঁরা করতালি দিতে তেমন অভ্যস্ত নন। তবু সিদ্ধার্থর বক্তব্য শেষ হলে হাতে শব্দ বাজিয়েছিলেন তাঁরা। সেই প্রৌঢ় তার হাত ধরে বলেছিলেন—আবার আসবেন আপনি? 

সে বলেছিল—আসব। 

—আপনার কথা ভাল লাগে। আসবেন, দেখবেন আমাদের গ্রাম। সেচের ব্যবস্থা নাই। পানীয় জলেরও বড় অভাব। রাঢ় অঞ্চলের মাটি তো শক্ত। গঙ্গার এই পারে মাটির নীচে পাথরের দেওয়াল আছে। টিউকলে জল উঠে না গ্রীষ্মকালে। আসবেন। দেখবেন 

—আসব। আবার আসব। 

—আপনার কথা শুনলে মনে বল আসে। প্রাণ জুড়ায়। বলেছিল একজন। আজ শুনলাম।

—আপনাদের কথাই আমি ফিরে বলি। এইসব কথা আপনারাও ভাবেন না? 

—ভাবি। ভাবি তো। ভাবনার মিল পেলেই আনন্দ আসে। আমরা ভেবেছিলাম আপনি অন্তত আমার বড়ছেলের বয়সি হবেন। চল্লিশ-বিয়াল্লিশ। কিন্তু আপনি এখনও অনেক তরুণ। বেশ। বেশ। আসবেন। 

—আসব। 

—কথা দিলেন কি? 

সে হাত ধরেছিল প্রৌঢ়ের। বলেছিল—আপনাকে কী বলে ডাকব? 

—শামসুদ্দিন। আমি এ অঞ্চলে ইমাম। 

—চাচা! কথা দিলাম আপনাকে। আসব। 

শামসুদ্দিন স্নিগ্ধ হেসেছিলেন। কাঁধে রেখেছিলেন হাত। বলেছিলেন—আমি অপেক্ষায় থাকব। 

.

নাতালি গ্রাম থেকে যখন তারা যাচ্ছিল তালপুকুরে, তার মনে পড়ছিল শামসুদ্দিনের কথা। কী এমন বলেছে সে? তবু হয়ে গেছে আপনার জন! 

ক্ষেতখামারের ওপর দিয়ে যেতে হবে বলে একটি গাড়ি নিয়েছিল তারা। চকচকে সুমো। লোকজন ভর-ভরতি জিপ। বৃষ্টিহীন পথে পথে ধুলোর মেঘ। তাদের চোখে-মুখে ঢুকে যাচ্ছে ধুলোর কুচি। যতদূর চোখ যায় ধু ধু জমি। সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। গাছে গাছে পাতায় পাতায় ধুলোর আস্তরণ। স্থানে স্থানে অবাক দাঁড়িয়ে থাকা শিশুগুলি উদোম, শীর্ণ। বাচ্চা কোলে মায়েদের মুখ ফ্যাকাশে, প্রাণহীন, স্বাস্থ্যের দীপ্তি নেই কড়াক্রান্তি পরিমাণ। পুরুষেরা পরে আছে শতচ্ছিন্ন লুঙ্গি বা প্যান্ট। দারিদ্র এমনই বসত করে, কিন্তু অনাবৃষ্টি তাকে করেছে প্রকট। 

কারা পড়াবেন এইসব স্কুলে? গ্রামে গ্রামে তেমন শিক্ষিত কই? দূরান্তর হতে পয়দলে বা সাইকেলে আসবেন শিক্ষক। শিক্ষা দান করবেন মহান ব্রতের প্রতিজ্ঞায়। করবেন তো? কেন করবেন না? মাইনে যে দেওয়া হবে। বেতনভোগী শিক্ষাব্রতী তাঁরা! কর্মগত প্রাণ! অন্নগতও বুঝি! 

সিদ্ধার্থ জানে, দেখেছে বিভিন্ন স্থানে, কিছুকাল বড় আদর্শ ও কর্মপ্রেরণা থেকে যায় এমত শিক্ষাব্রতীদিগের প্রাণে। ধীরে ধীরে সেই আদর্শ, সেই প্রেরণা ফিকে হতে থাকে। সংসারের কত না কাজ! কত না কর্তব্য সব পড়ে থাকে ইতিউতি! সেইগুলি সারে কে? শিক্ষার ব্রতে এমনই দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়ে গেলে জীবনে ক্ষয়-ক্ষতি লেগে রয়। সেইসব সামলানো না গেলে অমহৎ এ জীবন। আর শিক্ষক তাঁরা, তাঁদেরও থাকে জমিজমা কিছু, সেইখানে সম্বৎসরের দেখাশোনা! নইলে কিষাণ মজুরেরা সব, ফাঁকি দিয়ে জান কয়লা করে দেবে। এই প্রাণ, পোড়া প্রাণ বটে, তবুও জ্বলে জ্বলে পুড়ে খাক অঙ্গার হওয়ার আগেই কেন না নেভাবে আগুন! 

এবং শিক্ষক মানুষ তাঁরা, ভবিষ্যতের সুনাগরিক গড়ে তোলার ব্রত মহান হয়ে স্কন্ধে চেপেছে ঠিকই। কিন্তু শিক্ষিত মানুষ তাঁরা, অধিক দায়িত্বসচেতন। অতএব তাঁদেরও কিছু যোগাযোগ থেকে যায় রাজনীতির মাঠে, ময়দানে। সেই সংযোগ প্রভূত সময় দাবি করে। সিদ্ধার্থ সে, সে তো জানেই, কেমন করে রাজনীতি গ্রাস করে সমস্ত সময়! 

অতএব, ইস্কুল পড়ে থাকে, ছাত্রগণ ছড়িয়ে ছত্রাখান, সপ্তাহে এক-আধবার আসা, দু’-চারিটি বালক-বালিকা ধরে শিক্ষার মহান ব্রত পালনীয় বলেই রক্ষা। আরে, এভাবেই গড়ে ওঠে এদেশের শিক্ষিত মানুষ। গ্রামে গ্রামে বেড়ে ওঠে অনাদৃত আগাছার মতো। বেড়ে ওঠে শহরের কোণঠাসা প্রাথমিক স্কুলে। ভাল স্কুলে পড়ে যারা, তারা ভবিষ্যতে হতে পারে বিশ্বনাগরিক। 

আহা! সেই গুরুমহাশয়ের দিনকাল হতে ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে যে, তা মানবেই যতেক নিন্দুক। সে নিজেও মাথা নত করে সেইসব পদপ্রান্তে যাঁরা সত্যই শিক্ষার ব্রতে রয়েছেন একনিষ্ঠ। রয়েছেন। দেখেছে সে। হরিহরপাড়ার দিকেই ভৈরবের পাড়ে কুশিগ্রাম। সেইখানে। একটি ছোট বিদ্যালয়। তাঁর নিজ হাতে গড়া। গ্রামবাসী বাঁশের দেওয়াল তুলে দেয়। খড় দিয়ে ছেয়ে দেয় চাল। নিকটেই ছোট্ট কুটিরে তাঁর বসবাস। হেমন্ত কাহালি নামে সেই মানুষ, কতকাল রয়েছেন গ্রামে। নিয়েছেন শিক্ষার ব্রত। আজ সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুগুলি ছাড়া কুশিগ্রামে নিরক্ষর একজনও নেই। মেয়েরাও এমনকী পাঠ নেয় তাঁর কাছে। দুটি কিশোর ভাই, তারা চাষ করে, সন্ধ্যায় শিক্ষকতাও করে। হেমন্ত কাহালি তাদের মাধ্যমিক ও পাশ করিয়েছেন। 

আশ্চর্য মানুষ এই হেমন্ত কাহালি। সংসারে একা। নিরন্তর আলো দিয়ে চলেছেন মাটির প্রদীপের মতো। দিন চলে রেশমের গুটি বেচে। সামান্য জমির ওপর সামান্য রেশমের চাষ। একা লোক। চলে যায়। 

অনেকদিন আগে সিদ্ধার্থ গিয়েছিল সেই গাঁয়ে। সে আর মোহনলাল গিয়েছিল। কুশিগ্রামের স্কুল দেখাবে বলেই তাকে নিয়ে গিয়েছিল মোহনলাল। বলেছিল—এমন মানুষ সিধু, দেখবি, তোর সারাজীবন মনে থাকবে। একটা আদর্শ নিয়ে এভাবে পড়ে থাকা সারা জীবন, একালে অন্তত ভাবা যায় না। 

এবং যথার্থ বলেছিল মোহনলাল। হেমন্ত কাহালিকে সে ভুলতে পারবে না। তাঁর কাজ, তাঁর জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা সে ভুলবে না কখনও। তাঁর বিশ্বাস, হেমন্ত কাহালি একজন সত্যিকারের বিপ্লবী। একজন সাচ্চা কমরেড। বিপ্লব মানে তো শুধু রক্তপাত, যুদ্ধ ও সংঘর্ষ নয়। শুধু এক প্রতিষ্ঠান ভেঙে অন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার লক্ষ্য নয়। একটি আদর্শ ও স্বপ্ন নিয়ে তার সম্পাদনা-কল্পে, নিজের জীবন নিবেদন করে দেওয়াও বিপ্লব। ব্যক্তিমানুষের প্রচেষ্টার হাত ধরেও সমাজে কল্যাণ প্রবেশ করতে পারে। হেমন্ত কাহালি সেই কল্যাণকামী মানুষ। 

তারা স্কুল দেখতে এসেছে শুনে উদ্ভাসিত হয়েছিল হেমন্ত কাহালির মুখ। ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছিলেন তিনি। তাঁর ছোট্ট রেশমের চাষ। স্কুল। তারা দেখেছিল পড়ানোর পদ্ধতি। গোটা পাঁচেক বই। বিভিন্ন পর্যায়ের। আর স্লেট-পেনসিল সম্বল। এই নিয়েই শিক্ষা চলে। কোনও পরীক্ষা নেই। পাশ-ফেল নেই। শুধু শেখার ইচ্ছায় শেখা। 

দেখতে দেখতে অনুপ্রাণিত হয়েছিল সে। তার একবারও মনে হয়নি হেমন্ত কোনও অসাধ্য সাধন করেছেন। সবকিছুই এত সাদা-মাটা, এত অনাড়ম্বর ছিল যে তার মনে হয়েছিল, এখানে এমনই হওয়ার কথা। অথচ অসাধ্যের সাধনাই করেছিলেন হেমন্ত। দশ বৎসর। তারা শুনেছিল সকল ইতিহাস। 

যে মেয়েটিকে ভালবেসেছিলেন, সে মারা গেল ক্যান্সার রোগে। তাঁর বয়স আঠাশ। মেয়েটির তেইশ মাত্র। শ্মশানে তাকে দাহ করে ঘরে আর ফেরেননি। পরিবারে ছিল তাঁদের বড় ব্যবসা। রেশমের কাপড় রফতানি করার প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্য বসতি। অতএব অর্থ তাঁরও ছিল প্রচুর। প্রেমিকার চিকিৎসায় লাগবে বলে বেশ কিছু টাকা সঙ্গে সঙ্গে রাখতেন। সেইসবই ছিল। নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। 

কোথায় যাবেন, ঠিক নেই। বেরিয়ে কী শাস্তি পাবেন, জানেন না তা-ও। তবু ওই শহর, হাসপাতাল, চেনা লোক, স্মৃতিময় পথঘাট অসহ্য লাগছিল। ট্রেনে চেপে বসলেন। দিল্লিগামী সেই ট্রেনে দেখা হল এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে। আশ্চর্য সেই মানুষ। বিশাল শরীর। জটাজুট ভর্তি মুখ-মাথা। ধবল গায়ের রঙ। ত্বকের কোথাও কালিমা নেই। মালিন্য নেই। শীতের সে মরশুমেও সন্ন্যাসীর পরিধেয় কেবল লাল শালু। খালি গা। গলায় রুদ্রাক্ষ ও স্ফটিকের মালা। 

হেমন্ত দেখেছিলেন, তবু দেখেননি যেন। কারণ আর সব সন্ন্যাসীর থেকে, তাঁর আপাত তফাৎ কিছু ছিল না। আপন শোকের আবর্তে তিনি জানালায় ঢুকপাত করে বসেছিলেন। তিরিশ না পেরোতেই নিয়তি তাঁকে দিয়েছিল যে আঘাত, তারই অতলে তিনি আর্ত ও একা ছিলেন। তাঁর কাছে, মুখোমুখি আসন হতে একটি স্বর ভেসে এসেছিল, তবু মনে হয়েছিল কত দূরের, কত যুগের ওপার হতে ভেসে আসা—দুখ কি বোঝ জ্যাদা হোতা হ্যায় তো দুখ বাঁট দেনা চাহিয়ে। 

তিনি চমকে তাকিয়েছিলেন। দেখেছিলেন বড় মায়াময় চক্ষু দু’টি সন্ন্যাসীর। চোখ অত গভীর সুন্দর হতে পারে যে, দৃষ্টি অত মায়াময়, যেন পলক ফেললেই মুক্তোদানার মতো ঝরে পড়বে স্নেহবিন্দু, হতে পারে যে, তাঁর জ্ঞানেও ছিল না। তিনি, সেই চোখ হতে চোখ ফেরাতে পারছিলেন না। পাশের যাত্রীরা তাকিয়েছিল উৎসুক। মহাশ্মশানে যে-অশ্রু তিনি সংযত রেখেছিলেন, হাসপাতালে যা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বার বার, তা-ই কণ্ঠ রোধ করছিল। উপচে উঠছিল চোখে। তিনি জোর করে চোখ ফিরিয়েছিলেন। সন্ন্যাসী তখন পরিষ্কার বলেছিলেন— মানুষের প্রাণের তীর্থ হল শ্মশান। কেন জানেন? সেইখানে, চিতায়, মরদেহের সঙ্গে সঙ্গে শোকও পুড়িয়ে ফেলা যায়। 

হেমন্ত চমকে উঠেছিলেন। তাঁর গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। নির্বাক তাকিয়েছিলেন তিনি। হাত জোড় করে বলেছিলেন—বাবু নয়, বেটা বলুন আমাকে। 

সন্ন্যাসী বলেছিলেন—

উনকে বেটে হ্যায় হাম সব 
ছোটে সে ছোটে প্ৰাণী 
জাগতে হুয়ে হ্যায় চেতনা পর 
য়হি আতমা সন্ধানী 

হেমন্ত বলেছিলেন—আপনি কে? 

সন্ন্যাসী বলেছিলেন—

কৌন হ্যায় হাম, কাঁহা চলে?
যো জানে উয়ো হি চলে।
যো না জানে উয়ো ভি চলে।
কাঁহা চলে ভাই কাঁহা চলে?
যিসকা লকস্ মহা জীবন
উয়ো চলে গঙ্গা কি পার।
যিসকা কোই লকস্ নেহি
উয়ো চলে হরদোয়ার ।। 

ধীরে ধীরে এক বোধ তৈরি হচ্ছিল তাঁর মধ্যে। চিতায় শোক জ্বালিয়ে আসতে পারেননি। সাধারণ মানুষ, কে-ই বা পারেন! লক্ষ্যহীন বেরিয়েছেন পথে। গন্তব্য নেই। কী চান, জানা নেই। শুধু চেনা গণ্ডির থেকে বেরিয়ে পড়ার তাগিদ। কিন্তু লক্ষ্য কিছু ছিল না বলেই সম্ভবত, চেনা জগৎ, সকল অতীত নিয়ে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ফিরছিল। তিনি বুঝেছিলেন। এইভাবে পিছুটান ছাড়িয়ে আসা যায় না। যার শুধু অতীত রইল সম্বল, যে কোথাও পৌঁছবার তরে কোনও নতুন ভুবন খুঁজল না, সে তো পিছুটানকেই কণ্ঠলগ্ন করে নিল। নিমেষে স্থির করেছিলেন তিনি। হরিদ্বার যাবেন। তাঁর জানা ছিল, বয়স্করা যায় সেখানে তীর্থ করতে। মুমুক্ষুরা যায়। তিনি কেন যাবেন? জানেন না। শুধু চেতনায় কোথাও এক আহ্বান। এসো। চলো। হরদ্বার। 

তাঁর বিমূঢ় হয়ে যাওয়া দেখে, নির্বাক হয়ে যাওয়া দেখে সন্ন্যাসী বলেছিলেন— 

এক লকস্ মিল গ্যয়া 
তো দুসরা নেহি সোচো 
পহেলা লকস্ পর রাখনা কদম 
দুসরা ওয়াহা জারি রহেগা 

বিহ্বল হয়েছিলেন হেমন্ত। হাতজোড় করে বলেছিলেন—আমাকে আপনার সঙ্গে নিন। সন্ন্যাসী বলেছিলেন—

নাইয়া চলে নাও কি সাথ 
নদিয়া কে সাথ পানি। 
সড়কমে সাথী সবকে চরণ 
ইসমে বনে কহানি ।।

সাধুর সঙ্গেই গিয়েছিলেন তিনি হরদ্বার। বিষাদ তাঁকে ছাড়েনি তখনও। শোক ঘিরে আছে আপাদমস্তক। তবু সেই সন্ন্যাসীর সঙ্গে তিনি পেয়ে যাচ্ছিলেন একপ্রকার মানসিক স্থিতি। আরাম নয়। সুখ নয়। শান্তি নয়। তা যে ঠিক কী ছিল, তা সংজ্ঞায়িত করা যায় না। তবু ছিল কিছু। সন্ন্যাসী এক আশ্চর্য মানুষ। তাঁর লক্ষ্য গোমুখ। গঙ্গার উৎস দর্শন। কোনও আশ্রম ছিল না তাঁর। কোনও দর্শনীয় রীতিমার্গ ছিল না। খাওয়া-দাওয়ার বাছবিচারও তাঁকে করতে দেখা যায়নি। হেমন্তকে বলেছিলেন—এ দেহের জন্য খাদ্য প্রয়োজন। ভগবানের এ দুনিয়ায় খাদ্যের অভাব নেই। গৃহছাড়া মানুষ। বাছবিচার আবার কী! যা পাব। খাব। এই খাওয়ার জন্যই আমি ঘর ছেড়েছিলাম তা জানেন? 

অদ্ভুত এক গল্প তিনি শুনিয়েছিলেন। সন্ন্যাসীরা পূর্বাশ্রমের বিষয় অনুক্ত রাখেন, এমনই তিনি জানতেন। কিন্তু এই সাধুটি ছিলেন খাপছাড়া। সকল নিয়মের বাইরেকার মানুষ। তিনি বলেছিলেন—পূর্বাশ্রম স্মরণ করেন আপনি? 

হা-হা করে হেসেছিলেন সন্ন্যাসী। বলেছিলেন —পূর্বাশ্রম ভোলা যায় নাকি? তা হলে স্মৃতিহীন পাগল হতে হয়। বিস্মরণ দরকার হয় না বাবু। দরকার মোহ কাটানো। বিতে হুয়ে হর পল সে নির্মোহ রহনা চাহিয়ে। য়হি সাধনা হ্যায় হামারা। আপনার মস্তিষ্কের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে দ্রুতগামী সব পল অনুপল। যাবার সময় আপনার সকল স্নায়ুতন্ত্রীতে আঘাত করে যাচ্ছে। রোগ, শোক, দুঃখ, বিচ্ছেদ, মৃত্যু, হাজার যন্ত্রণা। কত সহ্য করবেন আপনি? কত নেবেন ভার? নিতে নিতে, নিতে নিতে আপনার মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে। ব্যথা-বেদনার তলায় চাপা পড়ে ক্রন্দন করতে করতে মারা পড়বে বেচারা আত্মারাম। জীবনের যে উদ্দেশ্য, আনন্দলাভ, তা-ই আর হবে না কোনও দিন। যত নির্মোহ হবেন আপনি বাবু, তত আনন্দ! 

আনন্দের ছটা ফুলকি তুলত তাঁর চোখে-মুখে। এমনই আনন্দ মেখে তিনি গল্প করেছিলেন উত্তরকাশীর এক চটিতে বসে। গঙ্গা বয়ে যায় সেই চটির সামনে দিয়ে। তার দু’পাশে জনবহুলতা। পাদদেশে নদী ও মানুষ রেখে পাহাড়ের পর পাহাড় উঠে গেছে। উত্তরকাশী এক শহর। হোটেলে-দোকানে আকীর্ণ। তবু গঙ্গা বয়ে যায়। গঙ্গাদেবী। তার স্নিগ্ধ স্বচ্ছ শীতল জল নিয়ে বয়ে যায় সাগরসঙ্গমের দিকে। আর গঙ্গার দিকে চেয়ে সেই সন্ন্যাসী। হেমন্ত চেয়ে থাকেন সন্ন্যাসীর দিকে। 

অসম রাজ্যের এক ছোট শহরে থাকতেন তিনি ছোটবেলায়। কয়েক ঘর খাসিয়া থাকে সেখানে। তাদের ছেলেরা তাঁর বন্ধু। তারা মাঠে মাঠে গোরু চরায়, তিনিও সঙ্গে সঙ্গে ঘোরেন। তাঁদের বাড়ির নিজস্ব রাখালও থাকে সেই দলে। খিদে পেলে প্রায়ই ওরা মেঠো ইঁদুর পুড়িয়ে খায়। তিনিও খান। ঘৃণা ছিল না তাঁর মধ্যে। একদিন তাঁদের রাখাল বাড়িতে কথাটা বলে ফেলল। তাঁর বাবা শুনে ভীষণ রাগ করলেন। বললেন—বল অন্যায় করেছিস। গোবর খেয়ে মুখ শুদ্ধি করবি বল। 

বালকের এক গোঁ—না, আমি অন্যায় করিনি। খাসিয়ারা খেলে অন্যায় হয় না। অশুদ্ধ হয় না। আমি কেন হতে যাব? 

বাবা বললেন—তবে যা, গোরুর মাংস খেয়ে আয়। 

বালকের উত্তর—খেতে পারি। খেলে কী হয়? 

বেদম মারলেন তাঁকে বাবা। তারপর ঠাকুরঘরে সারাদিন বন্দি করে রাখলেন। বললেন— যতক্ষণ ও কবুল না করছে কি যে ও অন্যায় করেছে, ততক্ষণ বন্ধ থাক। 

বাবা বাড়ির কর্তা। তাঁকে সকলে ভয় পেতেন কিন্তু তাঁর কোনও ভয় ছিল না। তাঁর মনে হয়নি তিনি দোষ করেছেন। তো কবুল করবেন কেন? অতএব বন্দি রইলেন। প্রথমে কিছুক্ষণ বসে বসে গান গাইলেন। তারপর তাঁর খিদে পেল। ঠাকুরঘরে যা-যা রাখা ছিল—কলা, বাতাসা, সন্দেশ, খেজুর সব খেলেন। দুটো পানের পাতা ছিল, তা-ও খেলেন। এবার জলতেষ্টা পেল। ঠাকুরের ঘটে জল ছিল। পুরোটা খেয়ে ফেললেন। খেয়ে একটা লম্বা ঘুম দিলেন। ঘুম থেকে উঠে দেখেন বেলা পার হয়ে গেছে। এত জোর পেচ্ছাপ পেয়েছে যে থাকতে পারছেন না। কী আর করেন। ঠাকুরের শূন্য ঘটে পেট খালি করে পেচ্ছাপ করলেন। সন্ধ্যাবেলায় ঠাকুরঘর খোলা হল। ঠাকুরমশাই এসেছেন আরতি করবেন বলে। তিনি দেখলেন সত্যি কথা বলে দেওয়াই উচিত। প্রস্রাব ভর্তি ঘটে পুজো হবে—তা কী করে হয়! বললেন—ঠাকুরমশাই। ঘটের জলটা পালটে ফেলুন। 

বাড়ির আর সব পরিণত পুরুষদের মতো ঠাকুরমশাই-ও তাঁকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। তাঁর কথা শুনে চোখ রাঙিয়ে বললেন – কেন হে বাপু? তোমার আদেশ? সকালে জল ভরে পুজো করেছি, এখনই পালটাব কেন? 

তিনি বললেন-না। ঘটে তো আর জল নেই। আমি পেচ্ছাপ করেছি, তাই। 

—কী? কী? 

পুরুতমশাই লাফিয়ে উঠলেন। সেই স্মরণে সন্ন্যাসীর মুখ কৌতুকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি যেন পুরুতমশাইকে স্পষ্ট দেখছেন! এবং তাঁর চোখ দিয়ে দেখছেন হেমন্ত পুরুতমশাইয়ের টিকিটা একেবারে খাড়া হয়ে উঠল। বালক মোলায়েম করে বললেন—তা কী করব? তেষ্টা পেয়েছিল তাই ঘটের জল খেয়েছি। তারপর পিসাব পেয়েছিল তাই ঘটে পিসাব করেছি। মেঝেতে করলে তো ঠাকুরের জিনিসপত্রে লাগত। 

ছি ছি ছি ছি ছি ছি বলতে বলতে একলাফে ঠাকুরমশাই বাইরে বেরিয়ে গেলেন। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলেন—সর্বনাশ করেছে। সর্বনাশ করেছে! ও মানুষ না! ও দানব! ও দানব! 

মুহূর্তে সব রটে গেল। তিনি তখনও ঠাকুরঘরে বসে আছেন। বাবা মুক্তি দিলে তবে বেরুবেন। কিন্তু বাবা মুক্তি দেওয়ার বদলে এলেন হাতে খড়ম নিয়ে। সন্ধ্যাহিকের সময় খড়ম পরা অভ্যাস ছিল তাঁর। বাবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির অন্যরাও এল। বাবা তাঁকে মারতে শুরু করলেন। মারেন আর বলেন—বল পাপ করেছি, আর করব না। বল। 

তিনি ততই বলেন—কী করব? আমার জল তেষ্টা পেয়েছিল, তাই খেয়েছি। আর পেচ্ছাব পেয়েছিল, তাই করেছি। 

বাবা মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে গেলেন। তবু পাপ স্বীকার করাতে পারলেন না। শেষে বললেন—কাল থেকে যেন তোর মুখ না দেখি। 

এত রাগ হল, এত রাগ হল, তাঁর মনে হল এখুনি চলে যাবেন। কিন্তু মার খেয়ে ওঠার শক্তি ছিল না। কেউ তাঁকে ধরে তুলল না। সারা গায়ে ব্যথা। চাকলা চাকলা দাগ। হাড়ের মধ্যে বিষাক্ত বিছের কামড়। শরীর উত্তপ্ত। মাথা দপদপ করছে। সর্বোপরি মন ক্লিষ্ট, কাতর অভিমানী। কেউ এসে তুলল না তাঁকে? আদর করল না? রাত্রে আস্তে আস্তে উঠলেন। রান্নাঘর থেকে কেরোসিনের বোতল নিয়ে দেওয়ালে ছড়িয়ে আগুন লাগিয়ে দিলেন। কাঠের দেওয়াল ছিল তাঁদের। দাউ-দাউ করে ধরে গেল। লোকজন ছুটে আসতে না আসতে তিনি পালিয়ে গেলেন। সোজা ইস্টিশন। একটা মালগাড়ি যাচ্ছিল খুব ধীরে ধীরে। তার একটা খোলা দরজা ধরে ঝুলে পড়লেন। ব্যস। সন্ন্যাসী প্রসন্ন মুখে বলে চললেন— 

অব তক হম ঝুলে রহে 
জমানা নীচে নীচে। 
স্বরগ কিতনা দূর না জানে 
নরক পিছে পিছে ॥ 

সেই সন্ন্যাসী, হেমন্তর নাম জানতে চাননি কখনও। শোকের কারণ জানতে চাননি। নানা কথার ফাঁকে, নানা গল্পের ফাঁকে বলেছিলেন— দুনিয়ার শেষ কোথায় জানেন বাবু? পৃথিবীর শেষ প্রান্ত কী? 

—কী? পৃথিবী তো গোল। একভাবে তার কোনও শেষ প্রান্ত নেই। অন্যভাবে দেখলে সব স্থানই শেষ স্থান। প্রতিটি প্রান্তই শেষ প্রান্ত। 

—আমি এ ভূগোলের কথা বলছি না বাবুজি। আমি বলছি অন্য ভূগোলের কথা। জীবনের কথা। দুনিয়ার শেষ প্রান্ত হল শ্মশান। শ্মশান হোক, গোরস্থান হোক কিংবা শাস্তিস্তম্ভ। সেই হল শেষ। এখানেই দেহান্ত হয়। এক লোক ছেড়ে, চেনা ভুবন ছেড়ে মানুষ অন্য লোকে যায়। চলতা ফিরতা আতমা যো সাথ দেতা হ্যায় উসি যানেওয়ালা কো, উসকো শশান সে মিলতা হ্যায় নয়া জীবন। কেন কি, শ্মশান দিতে পারে এক জীবনের প্রতি নির্মোহ দৃষ্টিপাত। ওই যে পোড়া দেহ হতে ধোঁয়া ওঠে বাবুজি, আপনার কি মনে হয় না, আপনিও ওই ধোঁয়ারই মতো? এ পৃথিবীতে এসেছেন, চলে যাবেন। কোথায় মিলিয়ে যাবেন। দু’দশ বর্ষ পরে আপনাকে স্মরণ করবে না একটি লোক। আরে, মানুষ ধোঁয়া ছাড়া কী! এক মুহূর্তের পুতুল। কলকাতার মানুষ আপনি। কলকাত্তা কি রহনেওয়ালা হ্যায় আপ, উয়ো যো এসকালেটর হোতা হ্যায়, টিভি মে ইয়া ফিল্মোমে সায়দ আপনে দেখা। উসকো সোচিয়ে বাবুজি। ওই চলন্ত সিঁড়ির নীচের প্রান্ত এক লোক, উপরের প্রান্ত আরেক। কোথা হতে আসে জানে না কেউ। কোথায় যায় তাও জানে না। য়হি কুছ পল সবই লোঁগ সাথ বিতাতে হ্যায় এসকালেটর মে। য়হি জীবন হ্যায় বাবুজি। দুটি অন্তহীন অজ্ঞাত লোকের মধ্যে ওইটুকুই পরিচিত পৃথিবী। ওই এসকালেটর। শুনেছি কলকাতার ভূগর্ভ রেলেও চলে আসবে এসকালেটর। যখন সব কাজ শেষ হবে, সিঁড়ি চালু হবে, ভাল করে দেখে নেবেন। 

কখনও অধরা মনে হয়নি সেই সন্ন্যাসীকে, কখনও অলৌকিক মনে হয়নি। সারাক্ষণ আনন্দ-সন্ধানের কথাই তিনি বলতেন যে-কোনও জ্ঞানী ও প্রসন্ন মানুষের মতো। ধীরে ধীরে সেই আনন্দের খোঁজ তিনি জারি করে দিচ্ছিলেন হেমন্তের মধ্যেও। বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন —তাই করবেন বাবুজি যাতে মন শান্তি পাবে। যেখানে মন লাগবে সেখানেই থাকবেন। মন উচাটন হলে পাততাড়ি গুটিয়ে পালাবেন। তবেই না খুশি থাকবেন। মনকে কখনও বাঁধন দেওয়া উচিত নয়। তাকে খোলা রাখা উচিত। 

গোমুখের পানে চলেছিলেন সন্ন্যাসী। হেমন্তও চলেছিলেন। ওই উদ্দেশ্যে সন্ন্যাসীর সেটাই প্রথম যাত্রা ছিল না। এর আগে তিনি চেষ্টা করেছেন ছয় বার। নানা কারণে যাওয়া হয়নি। গঙ্গোত্রী হল শিবের স্কন্ধ। গোমুখ হল জটা। গঙ্গা, সেই কোন আদিকাল হতে জটা হতে বহমানা। সেই পবিত্র উৎসমুখে সময় না হলে পৌঁছতে পারে না মানুষ। দলে দলে যাত্রী যাচ্ছে কত। দেখছে। ফিরছে। তারা সব ভাগ্যবান। শিবশম্ভু তিনি, তিনিই ডেকে নেন, তিনিই ফিরিয়ে দেন। সন্ন্যাসীকেও ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি বারবার। আবার চলেছেন তিনি। যদি ডাক আসে। যদি আসে। বলেছিলেন-কে জানে বাবুজি, হয়তো আপনার ভাগ্যে দেখা হয়ে যাবে আমারও। সে-দেখা হয়নি। কারও-ই হয়নি। তার পরিবর্তে ঘটেছিল যে ঘটনা তা হৃদয়বিদারক। 

পায়ে না হেঁটে হেমন্ত এবং সন্ন্যাসী অংশীদারি ব্যবস্থায় জিপেই চলেছিলেন। উত্তরকাশী থেকেই আটজনের একটি দলের সঙ্গে যাত্রা শুরু হল। কমবয়সি যুবক সব। হেমন্তর চেয়েও ছোট। সন্ন্যাসীকে নিয়ে তাদের হাসি-মশকরা চলেছিল পুরোদমে। মশকরার মধ্যে শ্রদ্ধার ছিটেফোঁটা ছিল না। প্রকারান্তরে ভণ্ডামির ভেক বিষয়ে নিশ্চিন্ত যুবকেরা তাঁকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যই করছিল। ওই হাড় হিম করা শীতে সন্ন্যাসী তখন গায়ে চাপিয়েছেন একটি কম্বলমাত্র। হেমন্তকে দিল্লিতেই কিনতে হয়েছিল প্রচুর গরম পোশাক। যুবকদের বাচালপনায় তাঁর ক্রোধ জন্মাচ্ছিল। কিন্তু সন্ন্যাসী বলেছিলেন—ছোড়িয়ে বাবুজি, বাচ্চা হ্যায়, কুছ দিনোঁ বাদ আপনে আপ সমঝ যায়গা। 

বাচ্চা হ্যায়—বলার সময় তাঁর মুখে ছিল প্রসন্নতা। দুই দিঘল আঁখি হতে তাঁর স্নেহ উপচে পড়ছিল। হরশিল, ধারালি, ভৈরোঁঘাটি ধরে তাঁরা চলেছিলেন। শেষ ফেব্রুয়ারির ঠান্ডা জমাট বেঁধে ছিল পথে পথে। জিপের চাকায় পরানো ছিল লোহার শিকল। কোথাও বরফ জমে থাকলে, তার মসৃণতা গুঁড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল জিপ। চারপাশের শান্ত, মৌন সৌন্দর্যে প্রগলভ যুবকগুলিও এমনকী চুপ করে গিয়েছিল। দু’পাশে বরফমণ্ডিত সাদা পাহাড়। তুষারধবল মৌনী পর্বত! তার কোল বেয়ে নেমে আসছে হিমগলা হ্লাদিনীস্রোত! নেমে আসছে গঙ্গা! গঙ্গা! অই পরিত্রাণ অই কলুষনাশিনী! পতিতপাবনী! সেই আশ্চর্য রূপবান গাম্ভীর্য ও মগ্নতার প্রকৃতি, শিবেরই প্রতিরূপ হয়ে চলেছিল সর্বক্ষণ। আর গঙ্গা যেন পার্বতীর স্খলিত অঞ্চল! মহাদেবের সঙ্গে গভীর চুম্বনের বিহ্বলতা মুহূর্তে বুক হতে পড়েছে খসে। উত্তুঙ্গ ওই চূড়া যেন তাঁর স্তনযুগল! শ্বেতশুভ্র ওই স্তনে কান পাতলে শোনা যাবে উদ্ধত, উত্তেজিত, কামনাঘন, সৃষ্টিকামী, ধ্বংসোন্মুখ হৃদয় স্পন্দন! 

হেমন্তের হৃদয় হতে শোক-তাপ মুছে যাচ্ছিল। দুই চোখে এসে লাগছিল মহাতাপসের পরমার্শীর্বাদ। মনে হচ্ছিল, যা দেখেছেন জীবনকে ওই ব্যবসা, লাভালাভ, প্রেয়সী, বিবাহ, ওই চেনা ধরন বেঁচে থাকার, জীবন তার চেয়ে বড়। অনেক অনেক বড়। এক প্রেরণা জেগেছিল মনে। কিছু করতে হবে। কিছু পেতে হবে। কী? কী? আনন্দ! আনন্দ! 

ভৈরোঁঘাটি পর্যন্তই ছিল জিপের রাস্তা। তারপর হাঁটাপথ। পাহাড়ের পর সাজানো শুকনো সাদা পাহাড়। নৈঃশব্দ্যের মধ্যে এক মহাযাত্রার প্রস্তুতি নিতে ভৈরোঁঘাটিতে আশ্রয় নিলেন সকলেই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার মিটার উচ্চতায় বসে হেমন্তর জীবনের অর্থ বদলে যাচ্ছিল যখন, আকাশে তখন মেঘ ঘনিয়ে আসছে। এইসময় বারিপাত শুভ ছিল না। 

যে-সকালে ভৈরোঁঘাটি হতে গঙ্গোত্রীর দিকে যাত্রা করার কথা, সেদিন মেঘ দেখে সন্ন্যাসী বললেন—আজ যেয়ো না। পথে বিপর্যয় হতে পারে। আকাশে যা দেখছি, ঝড়-বৃষ্টি হবে। এখানকার বৃষ্টি মানে বরফগলা হিম জল। ঝড়ে বরফকুচি উড়বে। আজ যাত্রা থাক। 

আর নয় কিলোমিটার দূরে গেলেই গঙ্গোত্রীর চটি। নয় কিলোমিটার কী এমন! যুবকের দল বিদ্রোহ করল। যে-পথপ্রদর্শক ছিল সঙ্গে সে আকাশ দেখে বলল—এ মেঘ উড়ে যাবে। অভিজ্ঞতা আছে আমার। কিছুই হবে না। বরং সকাল-সকাল বেরিয়ে পড়লে গঙ্গোত্রী পেরিয়ে আর আট কিলোমিটার হেঁটে নিতে পারলে চিরবাসা চটিতে পৌঁছনো যাবে। তা হলে পরের দিনই ভুজবাসা পেরিয়ে গোমুখ যাওয়া যাবে। ফেরার তাড়া থাকবে না। ভুজবাসায় কাটিয়ে নেওয়া যেতে পারে গোটা একটা দিন। আর অত ধকল না সইলে আজ গঙ্গোত্রী, কাল চিরবাসা। 

পথপ্রদর্শকের কথাই মান্য করতে চাইল যুবকের দল। সন্ন্যাসী বারবার বারণ করলেন। বললেন—পাহাড়-পর্বতকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কোরো না। খেল নেহি সমঝ না ইসকো। পাহাড় কোনও অবিমৃশ্যকারিতা ক্ষমা করে না জেনো। 

দলের মধ্যে তিনজন বেঁকে বসল। তারা বলল, সন্ন্যাসীর কথাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তর্ক বেঁধে গেল দলের মধ্যে। সন্ন্যাসী বললেন—আপ মত যাইয়ে বাবুজি। 

—আপনাকে ছেড়ে যাব না ঠাকুর। 

বলেছিলেন হেমন্ত। 

সন্ন্যাসী বলেছিলেন—

সাথ সাথ কৌন চলে 
ছোড় চলে সব হাম
পাস পাস কৌন চলে 
আতমা অওর ভগওয়ান 

শেষ পর্যন্ত থেকে গিয়েছিল তিনজন। পথপ্রদর্শককে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল বাকিরা। পিঠে রুকস্যাক। মাথায় টুপি। শরীরে নওজওয়ানি শক্তি এবং অহংকার। প্রকৃতির প্রতিকূলতার মদ্যে উদ্ধত প্ৰাণসর্বস্ব গাছগুলির মতোই লাগছিল তাদের। আলোর প্রত্যাশী গাছ সব কতই না দীর্ঘ। শেকড়-বাকড়ে আঁকড়ে আছে মাটি-পাথর। তাদের মধ্যে দিয়ে জড়গঙ্গা নদী ত্রস্তে ঝাঁপ দিচ্ছে গঙ্গার বুকে। হিমশীতল দল। তাদের পাশ দিয়ে, মেঘচ্ছায়াময় সরু পথ দিয়ে চলে গেল তারা। উদ্ধত, অহংকারী নওজোয়ান। পাশে পাশে মালের বোঝা পিঠে নিয়ে পথপ্রদর্শক। আকাশকে তখনও লাগছিল না শঙ্কা জাগানোর মতো ভয়প্রদ। তবু, তারা চলে গেলে, সন্ন্যাসী বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। বলেছিলেন—মৃত্যু আহ্বান করলে মানুষের সাধ্য কী তাকে রোখে! 

তারা চলে যাবার ঠিক তিন ঘণ্টা পরে ঝড় উঠল। নিমেষে অন্ধকার হয়ে এল আকাশ। প্রবল তাণ্ডবে হাওয়া এল এমন যেন চটি উড়িয়ে নেবে। সমস্ত পোশাক পরে নেওয়া সত্ত্বেও সেই ঠান্ডায় শরীর জড় হয়ে গেল। শ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল। হু-উ-উ-উ হু-উ-উ-উ শব্দ পাহাড়ের এক চুড়ো হতে অন্য চুড়োয় দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। এক বিরাট দৈত্য প্রলয়ে মেতেছে যেন। বিদ্যুৎ ফালা ফালা করে দিচ্ছে বুক আকাশের। ছেলে তিনটির মুখ শুকিয়ে গেল। তারা এসে পা চেপে ধরল সন্ন্যাসীর— বাবা! রক্ষা করুন। 

সন্ন্যাসী পা ছাড়িয়ে নিলেন। বললেন—ভগবানকে ডাকো বাবুজি। 

হেমন্ত জিগ্যেস করেছিলেন—ওরা কি গঙ্গোত্রীর চটি পেয়ে যায়নি এতক্ষণে? সন্ন্যাসী বলেছিলেন—পথে খুব দেরি না করলে পৌঁছে যাওয়া উচিত। 

—গাইড তো অভিজ্ঞ? 

—জরুর। 

—সে মেঘ দেখে বুঝল না, আপনি কী করে বুঝলেন ঠাকুর? 

—ইয়ে মুঝে ভি পতা নেহি। আমাকে জিগ্যেস কোরো না তোমরা। 

প্রায় আধঘণ্টা ছিল সেই ঝড়। বর্ষণ চলল আরও কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে ঠান্ডা হল সব। দুপুর বারোটা পেরিয়েছে তখন। সন্ন্যাসী এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এবার তৎপর হয়ে উঠলেন। বললেন—চলুন বাবুজি। রওনা দিই। বাবুজিরা গিয়ে পৌঁছল কি না দেখি। কে জানে, পথে হয়তো ধস নেমে আছে। 

সন্ন্যাসী চলেছেন। সঙ্গে হেমন্ত ও তিনটি ছেলে। বৃষ্টিতে পিছল পথ। কনকনে ঠান্ডা। দ্রুত চলা যাচ্ছিল না। মন শঙ্কায় ভরে ওঠে। কী এক দুর্বলতা শরীরকে বার বার খাদের কিনারে ঠেলে দেয়! দু’ ঘণ্টার পথ পেরুতে তিন ঘণ্টা লাগল। এক জায়গায় এসে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন সকলে। 

পথের কিনারে, একটি বড় পাথরের তলায় হাঁটু মুড়ে বসে আছে দু’জন। মুখোমুখি। বুঝি প্রবল ঠান্ডায় পরস্পরকে জড়িয়ে ধরবে বলে তারা বাড়িয়েছিল হাত, বাহুসন্ধি অবধি পৌঁছে তা থমকে গেছে। জমে গেছে। ভয়ে বুঝি তারা ডেকেছিল পরস্পরের নাম ধরে, তাই খোলা মুখ, হাঁ করা। থেমে গেছে। জমে গেছে। চোখ দু’টি বিস্ফারিত। বেরিয়ে এসেছে ঠেলে। খাঁটি নিপুণ দু’টি পাষাণমূর্তির মতো তারা বসে আছে মৃত। তাদের চুলগুলি খাড়া হয়ে আছে। 

তিনটি যুবক ছেলে পথে বসে পড়েছিল। মৃতপ্রায় হয়েছিল তারাও। ভয়ে শোকে মুহ্যমান। সন্ন্যাসী বিচলিত হয়েছিলেন। বাকিরা কোথায়? মুখের কাছে হাত এনে চিৎকার করেছিলেন তিনি—হো-ও-ও-হো-ও-ও-ও! 

পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি ফিরেছিল ও, ও, ও, ও। কিছুক্ষণ নীরব। তারপর ধ্বনি উঠেছিল হো-ও-ও-হো-ও-ও! এবং বাঁক ঘুরে উলটো দিক থেকে এসেছিল তারা। পথপ্রদর্শক এবং আরও তিনজন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। কেন না পাহাড়ে সন্ধ্যা নামে দ্রুত। সন্ন্যাসী, দেহ দু’টি ওভাবেই রেখে চটিতে ফিরে যাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। গঙ্গোত্রী চটিতে ফিরে যা হোক ব্যবস্থা হবে। ওই সন্ধ্যায় দু’টি দেহ বয়ে অতখানি পথ চলা সম্ভব ছিল না। বাকিদের সুরক্ষার দাবিতে ওই সিদ্ধান্ত তাঁকে নিতে হয়েছিল। গঙ্গোত্রী চটিতে পৌঁছে সন্ন্যাসীর চোখে জল দেখেছিলেন হেমন্ত। জল ছিল প্রত্যেকের চোখে। আর ত্রাস। ছেলে দু’টি গাঁজা সেবন করছিল থেমে থেমে। মূল পথ থেকে সরে গিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে কখনও নতুনতর উত্তেজনার সন্ধান করছিল। অন্যদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়ছিল। এবং বাড়তে বাড়তে হয়ে গেল জীবন ও মরণের অপূরণীয় ফাঁক! 

পরদিন মৃতদেহগুলির ব্যবস্থা করে ফেরার পথ ধরেছিলেন সকলে। গঙ্গোত্রীতে গঙ্গাদেবীর মন্দিরে দাঁড়িয়ে সন্ন্যাসী বলেছিলেন— এবারও হল না। কিন্তু আবার আসব আমি। 

ভৈরোঁঘাটিতে পৌঁছে ভোরবেলা হারিয়ে গেলেন তিনি। কখন গেলেন, কোথায় গেলেন বলতে পারল না কেউ। 

গত দশ-বারো বছরে হেমন্ত চারবার গিয়েছিলেন গঙ্গোত্রী-গোমুখ। গঙ্গোত্রী থেকে চিরবাসা হয়ে ভুজবাসা পর্যন্ত কত তীর্থ-যাত্রীর সঙ্গে দেখা হয়। সেক্ষণে, সেই সরু পাথুরে রাস্তায়, পাহাড়ের অটল গাম্ভীর্যে, গভীর নীল স্তব্ধ আকাশের তলে, পথে পথে খুঁজেছিলেন সন্ন্যাসীকে। দেখা মেলেনি। তিনি বলেছিলেন—যতদিন বেঁচে থাকব, যাব। বার বার যাব। কোনও দিন দেখা তো হবেই তাঁর সাথে। 

সেই হতে পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে হেমন্ত এসেছেন কুশিগ্রামে। থেকে গেছেন। পুরোপুরি সন্ন্যাসী হতে পারেননি। পুরোপুরি সংসারীও না। গ্রামে শিক্ষার ব্যবস্থা করে আনন্দ পেয়েছেন। তাই থেকে গেছেন। 

তিনি বলেছিলেন—এত কথা কারওকে বলি না। কী জানি কী মনে হল। বললাম। 

.

তাঁকে মনে পড়ে সিদ্ধার্থর। তাঁর কথা মনে পড়ে। সে স্থির করে, আবার যাবে হেমন্ত কাহালির কাছে। এতদিন ধরে সে ঘুরেছে যত গ্রাম, সবখানেই সে পেয়েছে শ্রদ্ধেয় মানুষ, সবখানেই আত্মীয় আছে তার। আত্মার নিকটে থাকা কতশত মানুষ চারপাশে। তার হৃদয়ে আবেগ জেগে ওঠে। নিজের মধ্যেকার নিঃসঙ্গ মানুষটিকে ধমকায় সে নিঃসঙ্গতা বোধ করার জন্য। এত লোক, এত প্রিয় লোক চারপাশে, তবু মাঝে মাঝে এত নিঃসঙ্গ, এত একা লাগে কেন! বোধিসত্ত্ব না থাকলে সে যেন অসীম অনন্তকাল ধরে একা। 

সে নিজেকে নিজেই চড় মারে মনে মনে। নিজেকে নিজেই বোঝায়। একা নও, একা নও, একা নও তুমি। যে পারে সহজে আপন করে নিতে, তার আপনার লোক বহুজন। তুম বেসাহারা হো তো কিসিকা সাহারা বনো। আর সিদ্ধার্থ সে, মানুষের জন্য তার কাজ, সে তো নিজেই দশজনের পর একাদশ জন। 

সে একে একে ভাবে সকল মুখ। একে একে ভাবে সকল কাজ। আর ধুলো উড়িয়ে গাড়ি চলেছে তখন। উঁচুনিচু পথে চলেছে টলোমলো। এই ইস্কুল গড়ে তোলা, ভোটের সময় এমন কতই না কাজ। সে মনে করে না এই কাজ অন্যায়, এই কাজ অবান্তর। যদি অভিপ্রায় হয় ক্ষমতা অর্জন, তাতে দোষ কী! ক্ষমতা মানুষের কাজের মূল শর্ত। এবং এই ক্ষমতা-অভিলাষে হয়ে চলে তবু কিছু কাজ। যদিও, সে মানে, কাজের জন্য, প্রকৃত উন্নয়নের জন্য এটা কোনও পদ্ধতি নয়। 

সে মনে মনে নিজের কাজগুলি গুছিয়ে নিচ্ছিল। পুজোর আর বাকি মাত্র পনেরো দিন। এর মধ্যে ভাঙন প্রতিরোধ নিয়ে মিছিল করবেন মিহির রক্ষিত। তাদের প্রত্যেককেই সহায়তা দিতে হবে সেই কাজে। তারপর সে পেতনির চরের জন্য শুরু করবে প্রথম আন্দোলন। ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট পথসভা আছে। তবু এরই মধ্যে সে ঘুরে নেবে আরও কয়েকটি গ্রাম। 

নওয়াজ নামে একটি ছেলে ছিল দলে। মিহির রক্ষিতের ডান হাত বলা হয় তাকে। খাগড়ার ছেলে নওয়াজ। বহরমপুর এবং তার আশেপাশে তার বাহুবলও যথেষ্ট। সিদ্ধার্থ জানে, তৌফিক জানে, দলের নেতৃবর্গের সকল ঘনিষ্ঠরাই জানে, নওয়াজ শুধু মিহির রক্ষিতের ঘনিষ্ঠ নয়, রক্ষিতের স্ত্রী মঞ্জুষারও প্রিয়পাত্র। এই প্রিয়ত্ব নিয়ে, তার প্রকৃত স্বরূপ নিয়ে নানান রসপূর্ণ আলোচনা হয়ে থাকে। 

সিদ্ধার্থ এগুলিকে গুরুত্ব দেয়নি কখনও। নওয়াজ আশ্চর্য রূপবান পুরুষ। মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে আসা অভিজাত পাঠান তারা। আভিজাত্যের ছাপ আজও ধরা আছে আকৃতিতে। খাগড়ার বিখ্যাত পরিবার তারা। অর্থবান। এমন পুরুষ সে, মঞ্জুষার সঙ্গে তার হতে পারে কোনও আবেগসম্পর্ক। হতে পারে। না-ও পারে। তার কী! 

সিদ্ধার্থর এক পাশে বসেছিল নওয়াজ। সে হঠাৎ বলল—সিধু, তুমি কি ভেবে এসেছিলে তোমাকে এখানে বলতে বলা হবে? নাকি আগেই লোক ঠিক করে রেখেছ, অনুরোধ করার জন্য? 

সিদ্ধার্থর কান গরম হয়ে উঠল এ প্রশ্নে। তবু, শান্তভাবে সে বলল—কোনওটাই নয়। 

—জানতে না? 

—না। 

মিহির রক্ষিত এবং রাসুদা বসেছেন মাঝখানে। সেখান থেকে মিহির রক্ষিত বললেন— নওয়াজ, এসব প্রশ্ন তুমি কাকে করছ? তুমি কি জানো, গোটা বহরমপুরে যত লোক আছে তার মধ্যে সিদ্ধার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় এখন সবচেয়ে বিখ্যাত লোক! 

সিদ্ধার্থ চুপ করে রইল। নওয়াজ বলল —আরে, সিধু এত ভাল বক্তৃতা করেছে আজ, আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না যে ও হোমওয়ার্ক করেনি। 

রাসুদা ঘাড় ফেরালেন এবার। বললেন—নওয়াজ, তুমি যা পারো না, তা আর কেউ পারবে না?

—না না দাদা, তা কেন? 

নওয়াজকে অপ্রস্তুত দেখায়। রাসুদা বলেন— সিদ্ধার্থ স্কুল লেভেল থেকে ভাল বক্তৃতা দেয়। তুমি জানো না? ও মেধাবী ছাত্র ছিল। কলেজে তার পর দু’বছর সাধারণ সম্পাদক ছিল। ছোট থেকে রাজনীতি করছে। ও বলতে পারবে না তো কে পারবে! তা ছাড়া ও বাগ্মী। ভাল বলার গুণ ওর আছে। 

মিহির রক্ষিতের মুখ থমথমে হয়ে গেল। সামান্য বাঁকা হেসে তিনি বললেন—সিধু তো বলে বিখ্যাত হয়নি। খবরের কাগজে আর টিভিতে মুখ দেখিয়ে হয়েছে। 

—খ্যাতির প্রশ্ন এখানে ওঠে কী করে? 

—না না। ওঠে না। আর উঠলেই বা কী! খ্যাতি তো ভাল জিনিস। দরকারি জিনিস। আরে পার্টিতে সব দাদাই বিখ্যাত হতে চায়। আপনাকেই দেখলাম কোনও দিন খ্যাতির পেছনে ছুটলেন না। বাকি আমরা সবাই তো মুড়ি-মুড়কি। এক দর আমাদের। 

—মুড়ি-মুড়কির একদর হয় না কিন্তু। তোমার তো দেখছি কথা বলার জন্যও হোমওয়ার্ক লাগবে মিহির। 

—হাঃ হাঃ! যা বলেছেন দাদা! 

মিহির রক্ষিত অপ্রস্তুত হাসেন। এবং মুহূর্তে সে-ভাব কাটিয়ে বলেন—নাঃ! মানতেই হবে সিধু বলে ভাল। ওর শুধু একটা কথাই বলা বাকি ছিল। 

—কী? 

—জয়হিন্দ! বন্দেমাতরম! 

নওয়াজ হেসে উঠল জোরে। মিহির রক্ষিতও হাসলেন। রাসুদা ও তৌফিক ছাড়া অন্যদের মুখেও লেগে রইল হাসির প্রলেপ। সিদ্ধার্থর মাথা হতে বেরিয়ে আসছিল অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। প্রাণপণে শক্ত থাকছিল সে। বোধিসত্ত্বের কথা তার মনে পড়ছিল। বোধিসত্ত্ব সামান্য অসহিষ্ণুতা জাগলেই, কণ্ঠের সুরহীনতায় সুর দিয়ে গেয়ে ওঠেন— 

ক্ষত যত ক্ষতি যত মিছে হতে মিছে, 
নিমেষের কুশাঙ্কুর পড়ে রবে নীচে ।।
কী হল না, কী পেলে না, কে তব শোধেনি দেনা 
সে সকলই মরীচিকা মিলাইবে পিছে ।।

বোধিসত্ত্বকে ভাবতে ভাবতে, ওই গান ভাবতে ভাবতে শান্ত হয়ে এল সে। ওই ব্যঙ্গ, ওই ঈর্ষা, ওই কটু শব্দাবলীর অপশক্তি তাকে স্পর্শমাত্র করল না। তার চারপাশে ঘুরে ঘুরে পড়ে গেল ধুলোয়। শেষ দু’টি ছত্র মাথায় আবর্তন করে নিরাময় দিতে থাকল তাকে। 

—সত্যের আনন্দরূপ এই তো জাগিছে। সত্যের আনন্দরূপ, সত্যের আনন্দরূপ, সত্যের আনন্দরূপ, এই তো জাগিছে, জাগিছে। জেগে আছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *