৭৯
সাত-দিন সাত-রাত তাহাদের জানালায় পর্দায় উড়ে উড়ে কেবল ভেবেছি
এই কথা—
আবার পেতাম যদি সে শরীর—সে জীবন—তা হলে প্রণয় প্ৰেম সত্য
হত:
আজ তা বিস্ময়—
আজ তা বিস্ময় শুধু—শুধু স্মৃতি শুধু ভুল হয়তো কর্তব্য বিহ্বলতা:
সাত-রাত সাত-দিন পৃথিবীতে কেবলই ভেবেছি এই কথা।
তারপর মৃত্যু তাই চাহিলাম—মৃত্যু ভালো—মৃত্যু তাই আর একবার,
বিবর্ণ বিস্তৃত পাখা মেলে দিয়ে মাঝ-শূন্যে আমি ক্ষিপ্র শকুনের মতো
উড়িতেছি—উড়িতেছি— ছুটি নয়— খেলা নয়—স্বপ্ন নয়—যেইখানে
জলের আঁধার—
.
সব বাধা উড়ে গেছে আজ। খুলে গেছে সব গ্রন্থি। সব। সকল সম্পর্কের মিছে মিথ্যে সাজিয়ে তোলা ওই পরিহার করে উঠেছে নির্মম সত্য হাতে যৌন অভিজ্ঞতা।
সময় পেরিয়ে গেছে কত! কতদূর ভ্রমণের নেশা তার পায়ে পায়ে জড়িয়েছে মহাকাল। তারই একটি কোণে তারা। মা ও ছেলে। মা মা মা এবং ছেলে। সকল সম্পর্ক শেষে লীন পরস্পরে।
আজ সব বাধা উড়ে গেছে। উন্মাদ ক্রীড়ার তরে যা-কিছু অর্গল ছিল ভেঙে গেছে। মা ও ছেলে আজ পাশাপাশি আলিঙ্গনে নগ্ন রুপোলি ইলিশ। সারা দেহে মাখা আছে পরাগ রেণুকা। দেহে লিপ্ত।
মা তিনি মা। গর্ভজাত না হলেও, আপন রক্তের পুত্তলি না হলেও তাঁকে মা বলেই ডেকেছিল সে তখন। ডেকেছিল কত বর্ষকাল! ডেকেছিল চূড়ান্ত স্খলিত সময়ে যখন হাতে স্তনখণ্ড, রূপখণ্ড, খণ্ড খণ্ড করে দেওয়া সকল সংস্কার। ও পাগল! পাগল! মা বলে কাকে রে? গর্ভ যিনি দেন। স্তন্য দেন যিনি! এতেই সকলি শেষ! আর কিছু নাই? স্নেহ নাই? দৃষ্টি নাই? নাই নীরব ঘোষণা? মায়ের ছেলের এ সম্পর্ক, শুধু দেহ বেয়ে আসে নাকি? শুধু এক গর্ভঋণ? আর কিছু নাই?
শুয়ে ছিল। শুয়ে ছিল তারা আশ্লেষে-রমণে ক্লান্ত। আজ কতদিন পর বাঁধ ভেঙে গেছে। দেহে আছে দেহেরই পূর্ণ সমর্পণ। মৌসুমি-মায়ের দেহ, ভরা শরীরের নগ্ন রূপ ঢাকা আছে হারাধন পুরুষের বুকের পিঠের নীচে। সেই আদিকালে যে-রকম ছিল। মায়ের ছেলের মধ্যে ছিল না নিষেধ, পিতা ও পুত্রী চিহ্নিত হত না পৃথক, জন্মের লগ্নে ঘোষণা নারী বা পুরুষ এবং সেই তার একমাত্র পরিচয়। লিঙ্গ পরিচয়। আদিম সেই বোধে মা নেই বাবা নেই ভাই নেই বোন নেই—শুধু ভেসে থাকে যৌনক্ষুধার তৎপর আসঙ্গলিপ্সা। দীর্ঘ বিবর্তন যতগুলি নিষেধ কুড়িয়ে নাম দিল সভ্যতা—অদ্যাবধি তা নস্যাৎ হতে পারে। হয়। হারাধন এক যুবাপুরুষ, সকল নিষেধ ভুলে গভীর প্রবেশ করে নিষেধ-বিস্মৃত শ্রীমতীর অভ্যন্তরে।
মৌসুমি বলছেন——হারাধন!
—বলো মা।
–এত আনন্দ আমি কখনও পাইনি।
—জানি মা।
—শরীরে এত সুখ থাকে! এত! ওঃ ভগবান! এতকাল পর, আমার ঋতু যখন বন্ধ হতে চলেছে, এতকাল পর, আমি বুঝলাম!
—মা! আমি তোমাকে আনন্দ দেব। রোজ দেব। আর কোনও বাধা মানব না।
—আজ আমি চূড়ান্ত পাপ করলাম। তোকে ছেলে বলে ডেকে…হারাধন….আমি আজ মরলাম, মরলাম!
হারাধন মৌসুমির মুখ চুম্বন করে। খোলা বুকে নাক ঘষে দেয়। তার শরীরে অপূর্ব আরাম। যৌন অভিজ্ঞতা আছে বলেই সে জানে আজ সে পেয়ে গেছে এক অনাস্বাদিত-পূর্ব স্বর্গীয় সুখ। তার হৃদয়ে অনন্য প্রশান্তি। আনন্দ কানায় কানায়। আজ সে মরতে পারে। আজ সে পৃথিবীর সবচেয়ে তৃপ্ত মানুষ —অন্তত এই মুহূর্তের জন্য। সে এক হাতে মৌসুমির উদর বেষ্টন করে, এক পায়ে মৌসুমির ঊরু বেষ্টন করে। বলে—মা, আমরা বারবার মরব। বারবার। আমার ভয় নেই। লজ্জা নেই।
মৌসুমি আঁকড়ে ধরেন তার হাত। বলেন—আমার ভয় করছে। লজ্জা করছে। আমার অর্ধেক বয়েসি তুই।
—তাতে কী! মা!
—আমাকে মা বলে ডাকিস তুই!
—এ তো ডাক একটা মা। বরং এই ভাল হল। ছলনা থেকে বেরিয়ে এলাম। কী ডাকি সেটা তো বড় কথা নয়। বড় হল মনে মনে কীভাবে দেখি। কীভাবে চাই। মাগো, আমি ভালবাসি তোমাকে। পুরুষ নারীকে যেমন ভালবাসে, তেমন। আমাদের অকপট হওয়ার কাল পেরিয়ে গেছে। শুধু ছলনার আশ্রয় নিয়েছি বলে, মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছি বলে মৌকে আমাদের মধ্যে এনে আমরা জটিলতা বাড়িয়ে তুলেছি। এর তো প্রয়োজন ছিল না কোনও
—না, না। আমি পাপ করেছি। পাপ করেছি আমি।
—আমাকেই দাও মা। তোমার পাপের ভাগ দাও।
—না না। তোর নয়, তোর নয়। সব আমার। সব আমার। এই পাপে আর ভয় নেই। এই মরণ, এই মৃত্যু, বার বার চাই আমি। চিরকাল, চিরকাল চাই।
মৌসুমি পাশ ফিরে হারাধনকে আলিঙ্গন করেন। তাঁর চুল বালিশে ছড়ানো। তাঁর পোশাক বিনা ঠিকানায় কবে গেছে উড়ে। তাঁর কোমরের ভাঁজে-ভাঁজে আবেগ। এই অবেলায়, এই অনিয়মিত ঋতুচক্রকালে নির্বোধ আবেগ প্লাবিত করে তাঁকে। আবার নতুন করে যৌবন পেতে ইচ্ছে করে তাঁর। আবার প্রথম থেকে বাঁচতে ইচ্ছে করে। তীব্র আর্তি তাঁর কণ্ঠে ফোটে ফিসফিসে প্রকাশে। বলেন—আজ আমার মুক্তি হল হারাধন। পাপের মধ্যে দিয়ে মুক্তি হল।
—আজ আমারও মুক্তি ঘটেছে মা। আমি পেয়েছি মুক্তির স্বাদ! ওঃ! কী কষ্ট দিয়েছ তুমি! কী কষ্ট! কী কষ্ট!
–বেশ বেশ বেশ করেছি! তুই আমার! আমার! তোকে যা খুশি করব আমি। নষ্ট করে দেব তোকে।
—দাও দাও। নষ্ট করে দাও মা।
আবারও উত্তপ্ত শ্বাসবায়ু ঝড় তুলে দেয়। আবারও রচিত হয় চূড়ান্ত শরীরী উচ্ছ্বাস। শুখা নদী ভিজিয়ে দেবার মতো নেমে আসে দেহরস জোয়ারে জোয়ারে। উন্মত্ত মন্থনের পর শৈথিল্য আসে এক মহান সত্যের মতো। কিছুক্ষণ নীরবতা ঘিরে থাকে। শুখা মরসুমের খরতা এই শয্যা পর্যন্ত পৌঁছয় না। ঝলসে যাওয়া ফসলের কান্না পৌঁছয় না। কর্মহীন অর্ধভুক্ত কৃষক ও জেলের নিশ্বাস এক ফুঁয়ে উড়ে যায়। এখানে নীরবতার গায়ে কেবল লেগে আছে মিলনের দাগ। মৌসুমি বলেন- হারাধন, হারাধন।
হারাধন তাঁর পেটে হাত রাখে। সাড়া দেয়-বলো মা।
—এভাবেই দিস ওকে না? রোজ দিস? রোজ?
—না না না মা। বিশ্বাস করো। এইভাবে না। ওকে এইভাবে ইচ্ছেই করে না।
মিথ্যে কথা। মিথ্যে মিথ্যে মিথ্যে কথা। একজন পুরুষ, সে কীভাবে আলাদা আদর করবে!
—হয় মা। হতে পারে।
—হয়?
—হয় মা!
—ওকে ভীষণ হিংসে হয় আমার! ভীষণ ভীষণ হিংসে। ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে ওর চোখ খুবলে নিই!
—মা!
—ইচ্ছে করে মুখ পুড়িয়ে দিই ওর যাতে তুই না তাকাস।
—মা! আমার সোনা মা!
—মনে হয় গায়ে আগুন লাগিয়ে দিই। ও পুড়ে যাক! পুড়ে যাক! কেন তুই বিয়ে করলি? কেন? ওকে ভীষণ হিংসে হয় আমার!
—মা! তুমি…তুমি… তুমিই তো!
—কাল কী হবে জানি না। কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে, আমি এত তৃপ্ত, এত সুখী যে আমার এতটুকু হিংসে নেই। এতটুকু রাগ নেই আর। হারাধন!
—মা!
—আমি মিথ্যে বলেছি তোকে। ও আমাকে এমনি মারেনি রে। আমিই ওকে আগে মেরেছি। ও যে তোর সংসারে অকল্যাণ ডেকে আনছিল। কুলো কিনতে জানে না! কিচ্ছু জানে না! আমি মা হয়ে কী করে তা সহ্য করি বল! তাই! তাই! ওকে কিছু বলিস না তুই।
—মা! তুমি এত ভাল! এত বড় তোমার মন! ওকে বাঁচাবার জন্য সব দায় তুলে নিচ্ছ তুমি!
—না রে। এই সত্যি!
–না! এ সত্যি নয়!
—বিশ্বাস কর। বিশ্বাস কর!
—না! আমি বিশ্বাস করি না। মা! এত ভাল তুমি! এত বড়! কে তোমাকে বুঝবে!
বিশ্বাস করেনি সে। করেনি। মৌসুমি-মায়ের প্রতি আরও প্রেম আরও শ্রদ্ধা নিয়ে সে উঠে এল যখন, রাত্রি দশটা বেজে গেছে। সে চেয়েছিল থেকে যায় সারা রাত। মৌসুমি চেয়েছিলেন। তবু হয় না তো! সকল চাওয়া পূর্ণ হয় না।
শুনশান পথে সে ফিরছিল একা। এই ভরা ভাদরে তার দেহে-মনে বসন্তের রাগ। খরা নেই, তাপের প্রবাহ নেই, নেই শস্যহীন মাঠ ও প্রান্তর, নেই ভেসে থাকা ভূখণ্ড পেতনির চরা। তার চারপাশে কেবল বসন্ত রাগ। কেবল পরজের ধ্বনি। কেবলই ফাগের রঙে রাঙানো নিকুঞ্জ সারি সারি।
সে চলেছিল একা একা। গায়ে মেখে মৌসুমি-মায়ের শ্বাসের সুবাস। কিন্তু যতই নিজের গৃহের নিকট হল সে, ততই বিরস হল মন। মুখোমুখি হতে হবে তাকে। শাস্তি দিতে হবে চরম, চরম! কী শাস্তি? কী?
জানে না সে। জানে না। শুধু রাগ বাড়িয়ে নিতে থাকে। তীব্র তীব্র রাগ। মধুর কাঙ্ক্ষিত মিলন তাকে ক্ষমাশীল হতেও শেখায় না এতটুকু। বরং তার মনে হয়, স্ত্রীকে চরম শিক্ষা দিতে না পারলে মৌসুমি মায়ের প্রতি তার নিবেদন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এবং দরজাঘণ্টি বাজলে আলুথালু মৌসুমি দরজা খুলে দেয়। সে ঘরে আসে। শার্ট খোলে। পূর্ণ গতিতে পাখা চালিয়ে দেয়। মৌসুমি চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। সে ডাকে—শোন।
মৌসুমি দাঁড়ায়। সে দাঁতে দাঁত ঘষে। এবার যথার্থ ক্রোধ এসে যাচ্ছে তার। যথার্থ রোষ। মৌসুমিকে দেখামাত্র সে বলে—এত সাহস তোমার! এত!
মৌসুমি মুখোমুখি হয়। বলে—একতরফা শুনে এসেছ। পুরোটা শোন। আমারও বলার কিছু আছে।
—কী বলার আছে তোমার? কী?
সে মৌসুমির হাত ধরে। মোচড়ায়। মৌসুমি কঁকিয়ে ওঠে—উঃ! ছাড়! লাগছে!
—ছাড়ব! ছাড়ব তোমাকে! ওঁকে আমি মা বলি জানো? জানো? টুকরো টুকরো করে কুকুর দিয়ে খাওয়াব তোমাকে আমি!
মৌসুমি হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে প্রাণপণ। বলে—ছাড়ো! ছাড়ো! কী পেয়েছ কি তোমরা আমাকে? পোষা কুকুর?
হারাধনের হাত শক্ত শক্ত কঠিন কঠিনতর হয়ে চেপে বসে তার কবজিতে। ত্বকের আবরণে রক্ত জমাট হয়ে যায়। সে পরোয়া করে না আর। ব্যথা-বেদনার পরোয়া করে না। এতদিনের জমে ওঠা ক্ষোভ দুঃখ শোক যন্ত্রণা, একা একা সহ্য করা জ্বলন্ত অঙ্গার দহন, পুরো বিষে, পুরো আকারে, পুরো ক্ষতে গল-গল বেরিয়ে আসে পুঁজরক্ত হয়ে। গলগল বেরিয়ে আসে বিকার-বিবৃতি। সে চিৎকার করে-মা? তোমার মা? কীসের মা জানি না আমি? বুঝি না? ঘাসে মুখ দিয়ে চলি?
কী কী কী বোঝো? কী বোঝো?
হারাধন অতঃপর দুই কবজি ধরে তার। শক্ত শক্ত শক্ত নিরেট করে ধরে। ঝাঁকায়! ঝাঁকায়! সে বলে—ব্যভিচার করছ তোমরা! ব্যভিচার! মা-ছেলে সেজে নোংরামো করছ! লজ্জা করে না? আরে সাহস থাকে তো খুলে করো যা করার। ঘোমটা দিয়ে নাচছ কেন?
—কী বললে তুমি? কী বললে? আর একবার বলো?
–একবার কেন? একশোবার বলব। সবাইকে বলব। বাড়িতে বিয়ে করা বউকে দিনের পর দিন একা রেখে ওই বাড়িতে পড়ে থাকো কীসের জন্যে! প্রতিদিন! প্রতিদিন! নেশা তোমার! নেশা! কই! নিজের মায়ের জন্য তো দরদ দেখি না এত। একবারও তো শুনি না তাঁদের কথা! আমাকে শিখণ্ডি করে ভেবেছ যা খুশি তাই করবে? আমি তা হতে দেব না।
হাত ছেড়ে হারাধন ধাক্কা দেয় তাকে। মোক্ষম ধাক্কা দেয়। সে পড়ে যায় নীচে। ব্যথা পায়, নাকি পায় না। আঘাত লাগে তার দেহে, নাকি লাগে না। হারাধন দাপিয়ে ওঠে। পা ঠোকে মেঝেয়। লাফায়। চিৎকার করে কুকুর! কুকুর! কুকুরের রক্ত তোমার! বেশ্যার রক্ত! যেমন বাপ-মা, তেমনি মেয়ে! বদ চিন্তা ছাড়া কী আসবে তোমার মাথায়? দেবীর মতো মা আমার! তাঁর গায়ে হাত তুলেছ তুমি! তাঁকে সন্দেহ করেছ! পায়ের নখের যুগ্যি তুমি? ওই মায়ের পায়ের নখের যুগ্যি?
সে ঝাঁপায় মাটিতে। চেপে ধরে মৌসুমির কাঁধ। বলে বলো অন্যায় করেছ! বলো কাল মায়ের পা ধরে ক্ষমা চাইবে!
—না!
—বলো! বলো!
—না!
চুলের মুঠি ধরে সে। বলে বলো ক্ষমা চাইবে বলো!
—না! যা করেছি ঠিক করেছি! চড় মেরেছি! এরপর এলে ঝ্যাঁটা মেরে তাড়াব।
–কী কী কী বললি? কী বললি তুই কুত্তি!
সে একটানে খুলে ফেলে শাড়ি মৌসুমির। একটানে খুলে ফেলে শায়া। পা থেকে খুলে নেয় ক্ষয়-লাগা হাওয়াই চপ্পল। আর মারে। এলোপাথাড়ি মেরে যায় কপালে, গালে, মুখে, বুকে। মেরে যায় আপাদমস্তক। মৌসুমি শব্দ করে না এতটুকু। প্রতিবাদ করে না। হাত তুলে বাঁচায় না প্রহার। মারতে মারতে, মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে যায় হারাধন নিজেই। চটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মৌসুমির পেটে লাথি মেরে বিছানায় ধ্বস্ত শুয়ে পড়ে। এবার মৌসুমি অস্ফুট শব্দে নড়ে—মা! মাগো!
বমি ঠেলে ওঠে তার মুখে। সর্বাঙ্গে প্রহারের লাল ছোপ ছোপ নিয়ে নগ্ন শিথিল সে পড়ে থাকে। বমি, মুখ হতে বেরিয়ে গলায়, বুকে, কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে নামে। উড়ে উড়ে দেহে বসে অজস্র মশক। হুল ফুটিয়ে দেয়।
হারাধন, কী মনে হয় তার, দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ওঠে সহসাই। ডুকরে ডুকরে কাঁদে। কেন কাঁদে, জানে না নিজেই। হয়তো বা তীব্র ক্রোধের অবশেষ কান্না হয়ে নেমে এসে শান্ত করে তাকে। কিছু-বা করুণা জাগে তার! কিছু-বা মানবিক বোধ। শিক্ষা ও সুরুচির ভাপ লাগে মনে। তাড়া করে ফেরে পরিমিত আচরণের সামাজিক প্রশিক্ষণ। এ কী করল সে! এ কী করল! নিজের স্ত্রীকে জুতোপেটা করল! এসব কী হচ্ছে! কেন সে বিয়ে করল! অনুতাপে পরিতাপে দগ্ধে মরে সে। হৃদয়ে কোথাও আঁচড় লাগে। প্রেম সুন্দর এই সে জেনেছিল। প্রেম পবিত্র এই জেনেছিল। হায়! প্রেমও তবে পাশব করে দেয়। বিষ দেয় হৃদয়ে-মজ্জায়! বিবেকবুদ্ধির সর্বনেশে ধাক্কার সামান্য অভিঘাতে কী এক বোধ তাড়া করে তাকে! সে তোয়ালে ভিজিয়ে নিয়ে আসে। হাঁটু মুড়ে বসে মৌসুমির পাশে। বমি মুছে দেয়। স্বাভাবিক যুক্তির বোধ একটি-দু’টি করে ফুটে ওঠে মস্তিষ্কে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে যায় তার, হতে পারে মা-ই মেরেছিলেন ওকে আগে, হতে পারে, হতে পারে! মায়ের আচরণে সে-ও কি বিরক্ত হয়নি ইদানীং?
সে শাড়ি তুলে ঢেকে দেয় দেহ। আলতো ডাকে—এই! ওঠো! ওঠো! এই! সুমি, সুমি! মৌ!
মৌসুমি পড়ে থাকে নিঃসাড়। সে হাল ছেড়ে দেয়। দেহ জুড়ে ক্লান্তি তার, মন জুড়ে অতল অবসাদ! বিছানায় শুয়ে পড়ে সে। মশারি টাঙায় না। খায় না। শুয়ে পড়ে আর নিদ্রিত হয়। নিদ্রিত থাকে বহুক্ষণ
মধ্যরাত্রে কী এক তাড়নায় তার ঘুম ভেঙে যায়। দেখে, আলো জ্বালা আছে তেমনই। নেভানো হয়নি। যেন আলোর অস্তিত্বই নেই এমন নির্বিকারে মৌসুমি জানালার পাশে বসে আছে নিশ্চুপ। ওই শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে কোনও ক্রমে। দু’টি চোখ অপলক। রক্তলাল। খোলা চুলগুলি লক্ষ সাপিনীর ফণা হয়ে ছড়িয়েছে চারপাশে। মনে হল তার, স্বয়ং কেতকাই বসে আছেন ক্রুদ্ধ শোকাতুর। শৈশবে শোনা, বহুবার শোনা, মনসামঙ্গল তার মনে পড়ে যায়—
অষ্ট-কোটি নাগ লইয়া শিবের কুমারী।
বর-শিরো’পরি রহে হংসে ভর করি ॥
চন্দ্রাতপ উড়ি গেল নাগের নিঃশ্বাসে।
ভয় পেয়ে লখিন্দর চাহে চারিপাশে ॥
নাগের গর্জ্জন শুনি চায় মাথা তুলি।
সৰ্প সৰ্প বলি লখাই পড়িলেক ঢলি ॥
তার সাহস হল না কথা কইতে। সাহস হল না ডাকতে একবার। সে ঘুমিয়ে পড়ল আবার। সকালে, নির্দিষ্ট সময়ের আগেই, স্নান করে বেরিয়ে পড়ল। খোঁজ নিল না মৌসুমি কোথায়। কেমন। সুস্থ আছে কি না। বরং রাত্রের যতটুকু গ্লানি, এই সকালে আর টের পেল না। যা হয়েছে, ঠিকই হয়েছে, এমন ভঙ্গিতে হেঁটে গেল পথে। দরজা এমন, টানলেই বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ দরজা রেখে হারাধন অবিকার চলে গেল তাই।
বেলা হতে, নেমে এলেন নমিতা। কাল রাত্রে কিছু চিৎকার কানে গিয়েছিল তাঁর। দু’টি স্বরের পৃথক নির্ঘোষ। ভাবনায় ছিলেন তিনি। কী হল! মেয়েটা কি দুঃখে আছে আজও!
দরজাঘণ্টি দিলেন তিনি। একবার, দু’বার, তিনবার। সাড়া নেই। ভাবলেন, স্নানঘরে গেছে বুঝি। ফিরে গেলেন ওপরে আবার। খুঁটিনাটি সংসারের কাজ করতে করতে আধঘণ্টা পরে আবার এলেন। এই বয়সে, এই ভারী শরীরে, বার-বার সিঁড়ি বাইতে কষ্ট হয়। তবুও এলেন। দরজাঘণ্টি বাজালেন। একবার, দু’বার, তিনবার। সাড়া নেই। জানালার কাছে গিয়ে ডাকলেন এবার—মৌসুমি! মৌসুমি! দরজা খোলো! মৌসুমি!
সাড়া নেই। নমিতার মনে হল, প্রাগৈতিহাসিক কোনও স্তব্ধতা জুড়ে আছে চরাচর। সহসা বুক কেঁপে উঠল তাঁর। কী এক অমঙ্গল শঙ্কায় ছটফট করে উঠল প্রাণের ভ্রমর। তার ডানা- ঝাপটানি শুনে, নমিতা, তাড়াতাড়ি উঠে গেলেন ওপরে। স্বামীকে বললেন—এই, একবার নীচে এসো তো!
শিবব্রত, নমিতার স্বামী, খুঁটিয়ে পড়ছিলেন খবরের কাগজ, সম্পত্তির লোভে ভাইকে মেরে দেওয়ালে গেঁথে রেখেছিল একজন, পণের অর্থ পুরো মিটিয়েও রেহাই পায়নি এক গৃহবধূ, আরও আরও সম্পদ নিষ্কাশন করতে না পেরে বধূটিকে পুড়িয়ে মেরেছে তার স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ। পাঁচ বৎসরের ফুল্লকুসুম মেয়েটি ধর্ষিতা হয়েছে তার পাড়াতুতো কাকাটির দ্বারা। জাতীয় স্তরে খ্যাত এক নেতার বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে বৈদেশিক ঘুষ নেবার প্রমাণ! ত্রিকোণ প্রেমের জেরে মেয়েটির স্বামীকে খুন করে ঘরের মেঝেয় পুঁতে ফেলেছে তার প্রেমিক।
হায় হায়! কত না খবর! কত না খবরের পর খবর! জবর খবর! কাঁচামিঠে আমের পর আমসি, আমসত্ত্ব, আচার, চাটনি খবরের হরেক বয়াম ভরতি।
অতএব শিবব্রত এতটুকু ব্যস্ত না হয়ে সাড়া দিলেন—কী বলছ!
—ওঃ! কাগজ রাখো! নীচে এসো একবার।
বললেন নমিতা। শিবব্রত কাগজ সরিয়ে বললেন—কী হল বলবে তো?
—কতক্ষণ ধরে ডাকছি মেয়েটার সাড়া নেই।
—কোথাও গিয়েছে হয়তো। বাপের বাড়ি-টাড়ি। কাল তো দু’জনে ঝগড়া করছিল।
—তুমি শুনেছ?
—শুনব না?
—কোথাও গেলে তো আমাকে বলে যায়।
—রাগ করে গেছে হয়তো। তুমিও তো কতবার না বলে গিয়েছ।
—ওঃ! রসিকতা ছাড়ো। আমার ভিতরে কু ডাকছে। চলো না।
—সে তোমার স্বভাব। উদ্বেগে সারা হওয়া। চলো।
নেমে এলেন দু’জনে আবার। আবার দরজাঘন্টি বাজালেন। একবার, দু’বার, তিনবার। সাড়া নেই। শব্দ নেই। শিবব্রতর ভ্রূ কুঁচকে গেল। বললেন—ঠিক জান, ও কোথাও যায়নি?
নমিতা বললেন—হারাধন তো একাই বেরুল দেখলাম।
—মৌসুমি! মৌসুমি!
চড়া গলায় ডাকলেন শিবব্রত। একটানা দরজায় ঘণ্টি বাজিয়েও নিরস্ত হলেন না। জোরে জোরে ধাক্কা দিলেন দরজায়। প্রতিবেশীরা এসে দাঁড়াল জানালায়। বারান্দায়। কৌতূহলী হল তারা। কী ব্যাপার? কী ব্যাপার?
—সাড়া দিচ্ছে না।
—সাড়া দিচ্ছে না।
লোক জমে গেছে। ভয়ে ও শঙ্কায় মুখ শুকিয়ে গেছে নমিতার। তিনি বলছেন—ওগো! দরজা ভাঙো!
শিবব্রত বলছেন—দাঁড়াও। অত বিচলিত হয়ো না। আগে নিখিলেশকে ফোন করি। হারাধনকেও ডাকা দরকার।
এল তারা। হারাধন এল নিখিলেশকে সঙ্গে নিয়ে। বর্ণালী এলেন। প্রত্যেকেই ডাকল একবার—মৌসুমি! মৌসুমি! মৌসুমি!
নমিতা বললেন—তুমি যখন যাও, তখন কোথায় ছিল ও?
হারাধন বিমূঢ় হয়ে রইল। বলল—আমি, মানে, বেরুবার সময় ওকে দেখিনি।
—সে কী!
ভাঙা হল দরজা। জিজ্ঞাসার অবসান হল। শোবার ঘরের সংলগ্ন বাড়তি ঘরটিতে গলায় শাড়ির ফাঁস দিয়ে পাখা হতে ঝুলে আছে মৌসুমি!