৭৬
আমরা অপেক্ষাতুর;
চাঁদের ওঠার আগে কালো সাগরের
মাইলের পর আরো অন্ধকার ডাইনী মাইলের
পাড়ি দেওয়া পাখিদের মতো
নক্ষত্রের জ্যোৎস্নায় জোগান দিয়ে ভেসে
এ অনন্ত প্রতিপদে তবু
চাঁদ ভুলে উড়ে যাওয়া চাই,
উড়ে যেতে চাই।
.
হকসেদ মণ্ডলের উঠোনে ছড়িয়ে বসেছিল তারা। এ এক জ্যোৎস্নার রাত্রি। মূল সভা বসবে কাল। আজ রাতে কেবল কয়েকজন এই চরে আলোচনারত। সিদ্ধার্থ জানে, দারিদ্রের সঙ্গে আপামর মানুষের সংগ্রামের ছবি ইতস্তত ছড়ানো রয়েছে। এখন এই অন্ধকারে কেবল আবছায়া। কোমল বিশুদ্ধ জ্যোৎস্নায় সকল দারিদ্র্য ঢেকে গিয়ে, অস্বাচ্ছন্দ্য ঢেকে গিয়ে এক মধুময় পরিবেশ। যখন আঁধার টুটবে, ভোরের আলো ফুটবে, গৃহস্বামীর গৃহের আচ্ছাদন, মাথার ওপর ছাত, পচা খড় ও ভাঙা টালি হবে দৃশ্যমান। অন্ধকার কুঠুরির মতো ঘরের স্যাঁতসেঁতে বিছানা হতে নেমে রোদ্দুরে গায়ের শ্যাওলা শুকিয়ে নেবে মানুষ। শুরু হবে দিনমানের কাজ।
এখন লোকের মুখে রোজকার সংগ্রামের কথা। বঞ্চনার কথা।
সেই কবে তারা এসেছিল চরাচর দখলের তরে। সন্ধানে সন্ধানে তারা ছিল। নদীর বুকে চরা পড়লেই কিছু লোক বড় দুঃখ পায়। কারণ চরা হলে নদী বাঁক নেবে। ধ্বংস হবে গ্রামগঞ্জ। যাদের ভূমি আছে, তারা ভূমিহীন হবে। কিন্তু যাদের ভূমি নেই? ওই ধ্বংসেরই কবলে পড়ে যারা ভূমি হারিয়েছে কিংবা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিলেন যাদের পিতৃ-পিতামহ, নিঃস্ব অবস্থাতেই জন্মে যারা এতটুকু ভূমির জন্য ছিল সকাতর, তারা চরা দেখে খুশি হয়। লালায়িত হয়।
অতএব, চরা পড়তেই, কাশফুল ফোটার আগেই, সন্ধানী লোকের আনাগোনা শুরু হল রাতের অন্ধকারে। এপার ওপার হতে লোক এল। বেঁধে নিল সীমানা। খুঁটি পুঁতে দিল কেউ। বাঁশের বেড়া দিল। ওই রাতেরই অন্ধকারে শুরু হল জমি চুরি। একলোক আসে, দখল নিয়ে খুঁটি পুঁতে দিয়ে যায়, অন্যলোক কোনও বিরলে এসে খুঁটি সরিয়ে আপনার সীমানা গাঁথে। চলতে থাকে হীন স্বার্থপর খোঁটাখুঁটি। জমি দখলের আদিম লড়াই।
সীমানা কবলে রাখতে শুরু হল রাত্রিজাগরণ। শুরু হল এ পক্ষে ও পক্ষে হানাহানি। এ ওর মাথা ফাটিয়ে দিল, এ ওর হাত ভেঙে দিল। গালাগালি দিল পরস্পর। এবং ওই পারস্পরিক ঘৃণা, শত্রুতা, বিরুদ্ধতা নিয়েই তারা ঘর বাঁধল পাশাপাশি। ক’দিন মুখ ঘুরিয়ে রইল। অতঃপর গত ত্রিশ বৎসরে কত বন্যা, দুর্যোগ এল; কত আশঙ্কা, ভাগ্যবিপর্যয় কত, পাশাপাশি সইতে সইতে পুরনো শত্রুতা ভুলে পাড়া-প্রতিবেশী হয়ে উঠল আপনজন। বন্ধুজন। আনন্দ, উৎসব, শোক, দুঃখ ভাগ করে নেবার মায়াবী গৃহস্থী।
পুরনো সেই ক্ষোভ, ক্রোধ কখনও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। হাতাহাতি হয়ে যায় মাঝে মাঝে তৎকালীন প্রৌঢ় দখলদার কেউ বৃদ্ধ হয়েছেন, পরলোক প্রাপ্ত হয়েছেন কেউ, যাঁরা সন্ততিকে দিয়ে গেছেন জমির অধিকার, তাঁরা দখলের ইতিহাস ক্ষোভ ক্রোধ ঘৃণা সমেত বুনে দিয়ে গেছেন।
মাঝে মাঝে হলাহল উঠে আসে। কিছু-বা স্বার্থের সংঘাতে ভুলে যাওয়া রিপুরাজি প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে তীক্ষ্ণ কাঁটার মতো। অবিশ্রাম কটূক্তি ও শাপ-সম্পাত চলে আদানে প্রদানে। তবুও, ভূতনির চরের তুলনায়, নেহাতই ক্ষুদ্র এই প্রেতিনীর চরায় পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি বাস করে বাহান্ন ঘর মানুষ। জনসংখ্যা মোটামুটি তিনশো তিরিশ-চল্লিশ। সরকারি স্বীকৃতি নেই বলে ঘর ঘর ধরে আদম ও ইভের সুমারি বাকি থেকে গেছে।
ঠিকানাবিহীন তারা, ধরাধরি করেছে কতবার, কত নেতা, এই তিরিশ বৎসর ধরে কিছুই হয়নিকো চরাচরে। লোক আসে। নির্বাচনের কালে আসে। টাকা দিয়ে লোক ধরে নিয়ে যায়। কার নামে কে গিয়ে দাঁড়ায়, ঠিক নেই। শিখিয়ে পড়িয়ে দেয় দলের কর্মীরাই। হাতে টাকা দিয়ে পাখিপড়া করে দেয়—আপনার নাম ইবরাহিম তো কী! ভুলে যান! এই দিলাম টাকা! বলবেন আপনার নাম তারেক আলি। বলবেন।
—এই সমস্তই বড় অপমানের! নির্বাচনের অধিকার আমাদের নাই। সরকারি খাতায় এই জমি বাসযোগ্য নয় বলে কোনও পঞ্চায়েতের অধিকারী নয়। এ ছাড়া বিধানসভা বলেন, লোকসভা বলেন, কতগুলি নির্বাচন দেখলাম, কত জয়-পরাজয়, শুধু আমরাই অনধিকারী রইলাম সারা দেশে। কেবল ভাড়াটে ভোটদাতা হওয়া। মানে লাগে না? বলেন! মানে লাগে না? যাদের মান আছে, তারা যায় না। একেবারে দীন-দরিদ্র তারা, যায়, কিছু টাকার লোভে লোভে যায়। কী আর বলব! বারণও করা যায় না তাদের। চরায় কাজ-কামের সুযোগ নাই। নৌকায় চেপে কাজের সন্ধানে যায় কতজনা। কোনওদিন কাজ পায়। কোনও দিন খালি হাতে আসে। পারানির কড়িটুকুও গচ্চা যায়।
হকসেদ মণ্ডল একটানা এত কথা বলে দম দিলেন। আবার শুরু করলেন কথা।
—কৃষকসভায় হরেকৃষ্ণ কোঙারের বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য একবার আমার হয়েছিল। ওঃ! কী ভাষণ। শুনে মনে হয়েছিল আজ থেকে কুড়ি বছরের মধ্যে কৃষক-শ্রমিকের দুর্ভাবনা আর থাকবে না। তারপর কত কিছু দেখলাম। ইন্দিরা গান্ধীর জমানা এল। একাত্তরে বাংলাদেশের যুদ্ধ দেখলাম। হাজার হাজার উদ্বাস্তু এল এই জেলায়। ওই সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের অবস্থা খারাপ হয়েছিল। আমার খুব ভাল মনে আছে, বি টি রণদিভে বলেছিলেন, ইন্দিরা গাঁধীর অশ্বমেধের ঘোড়া বাংলাদেশ জয় করল। ভারতের রাজ্যে রাজ্যে ঘুরে বিজয়ী হল। কিন্তু যেই পশ্চিমবঙ্গে ঢুকল, ঘোড়া তখন গাধা হয়ে গেল। তারপরেও দেখলাম কত কী! সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের খুন করা দেখলাম। জরুরি অবস্থা দেখলাম। সাতাত্তরে বামফ্রন্টের সরকার গঠন দেখলাম। আর এস পি-র ত্রিদিব চৌধুরী, যাঁর নামে লোকে কপালে হাত ঠেকায়, তিনি সাংসদ হলেন। মুর্শিদাবাদ থেকে সংসদে গেলেন মাসুদাল হোসেন। আমরা একবার ত্রিদিব চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, ‘দেখব’, সেই পর্যন্তই রয়েছে। এর বাইরে আমরা আর কিছু পেলাম না। কোনও নেতা কোনও দিন এই চরায় ঘুরে দেখে যায়নি। আমরা এই তিনশো মানুষ অবহেলায় পড়ে আছি কতকাল। আজ আমাদের মাটির ছেলে হারাধন শিক্ষিত হয়েছে, আমাদের কত গর্ব। আমাদের চরায় এর আগে কেউ কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়নি। সে উদ্যোগ নিয়েছে এই চরাকে স্বীকৃতি দেবার জন্য। এ অতি আনন্দের কথা। তোমার মতো নেতা আমাদের চরায় এসেছে বলেও আমরা ধন্য।
শুধুই করতালিটা ছিল যা বাকি। নইলে হকসেদ মণ্ডলের কথাগুলি এই পর্বে হয়ে গিয়েছিল অনেকখানি সভায় বক্তৃতার মতো। সিদ্ধার্থ শুনছিল। হকসেদ মণ্ডলের কথা শেষ হতেই শুরু করল আরও একজন।
—গেল বৎসরের আগের বৎসর গো-মড়ক হল চরায়। বসন্ত হল। সঙ্গে গলা ফোলা। এ চরায় অধিকাংশ লোকই গোরু পালেন। চতুষ্কোনা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাণী স্বাস্থ্য শিবির চলছিল। সেখানে আমরা গেলাম। কিন্তু পঞ্চায়েতের অধীনস্থ নই বলে আমাদের পশুগুলির চিকিৎসা হল না। বলা হল, এই গ্রাম পঞ্চায়েতের চাপ মেটাতেই প্রাণান্ত হচ্ছে, সেখানে পঞ্চায়েতের বাইরের দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়। আমরা ফিরে এসেছিলাম। কোথায় যাব জানা ছিল না। দেশীয় চিকিৎসা দ্বারা চেষ্টা করা হল। লাভ কিছু হল না। হকসেদভাই একজন পশুর ডাক্তার নিয়ে এসেছিল। সে বলল, ‘গো-বসন্ত নয়। এটা অজানা রোগ। দেশ থেকে রিন্ডারপেস্ট নির্মূল হয়ে গেছে।’ একের পর এক গোরুগুলি বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে লাগল।
হকসেদ মণ্ডল বললেন—হ্যাঁ। বলেছিল ডাক্তার এই কথা। রিন্ডারপেস্ট নির্মূল হয়ে গেছে। আরে আমরা ছোট থেকে চাষ-বাস গোরু-বাছুর নিয়ে আছি, আমরা গোরুর রোগ জানব না! চোখের সামনে গোরুগুলি দাপিয়ে মরল। আমরা কিছু করতে পারলাম না। শেষ পর্যন্ত রমাপদ গিয়ে চতুষ্কোনার পঞ্চায়েত সুকুমার পোদ্দারকে ধরে পড়ল। বলো না, রমাপদ বলো।
রমাপদ দাস, সুকুমার পোদ্দারের মুনিষ, গলা ঝেড়ে শুরু করলেন—পোদ্দারবাবুকে গিয়ে ধরলাম। পায়ে পড়ে বললাম, গোরুগুলোন চোখের সামনে দাপিয়ে মারা যাচ্ছে, এ দৃশ্য দেখা যায় না। যেগুলি বেঁচে আছে, সেগুলিকে যাতে টিকা দেয় তার একটা ব্যবস্থা করে দেন। তা সেই শুনে বাবু রাজি হলেন। ছ’মাস চরা থেকে পাঁচজন মুনিষ বিনে মজুরিতে খেটে দেবে এই চুক্তি হল।
—বিনা মজুরিতে?
সিদ্ধার্থ কথা বলল এতক্ষণে। রমাপদ বললেন, হ্যাঁ। এ তো বরাবর আছে। উপকারের বিনিময়ে বেগার খেটে দেওয়া। তা লোকে তাতে কিছু মনে করে না।
—এ তো বেআইনি!
সিদ্ধার্থ বিস্ময় প্রকাশ করে ফেলল। রমাপদ বললেন- বাবু! আইন এখানে কে জানে! আর ভাবেই বা কে! কৃষক সংগঠনের লোক আসে। বলে এসব কথা। লোকে শোনে। ভুলে যায়। যা চলে সেটাই আইন। লোকে সুবিধে দেখবে, না আইন মেনে মজুরি চাইবে? এই দেখেন, ওই যে পোদ্দার বাবু রিল্ডারপেস্টের টিকা দেবার ব্যবস্থা করে দিলেন, তাতে কিছু গোরু বেঁচেছিল তো! লোকের কত বড় উপকার হল বলুন! তার জন্য লোকে খুশি হয়েই বেগার দিয়েছিল। সে কিছু না।
সিদ্ধার্থর মুখে কোনও কথা এল না। প্রচলিত নিয়ম লোকে ঘাড় পেতে মেনে নেয়। তার ন্যায়-নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। এখানে জননেতৃত্বের উচিত প্রথাবিরুদ্ধ হয়ে ওঠা। অর্থাৎ সুকুমার পোদ্দারের কাছেই আশা করার কথা এই বিরুদ্ধতা। সে ঠিক করল, এ বিষয়ে রাসুদার সঙ্গে পরে কথা বলবে।
প্রথম গোরুর প্রসঙ্গ তুলেছিল যে, মধ্যত্রিশের যুবক একজন, নাম রাশিদ, বলল— শুধু টিকার ব্যাপারটাই তো নয়। গো-পালনের জন্য কোনও সুবিধাই আমরা পাই না। এখানে গোরু চরাবার মতো মাঠ তো নেই। গোরুর জন্য শুধু খড় আর দানাই ভরসা। এতে গোরুর পুষ্টি হয় না। দুধও হয় না ভাল। প্রাণীসম্পদ বিকাশ দপ্তর থেকে গোখাদ্যের বীজ ও কাটিং বিনামূল্যে দেয়। আমরা পাই না সেসব। অথচ সবুজ গোখাদ্য উৎপাদনের জন্য অনেকে আর্থিক অনুদান পর্যন্ত পায়। বেলডাঙায় আমি দেখে এসেছি, অনেকেই নিজের জমির সামান্য অংশে গোরুর জন্য হাইব্রিডের নেপিয়ার ঘাসের চাষ করছে। কম মূল্যে বা বিনামূল্যে এরকম ঘাসের বীজ বা কাটিং পেলে আমরাও চাষ করতে পারতাম। গোরুকে ভাল করে খাওয়াতে পারলে গোরুর দুধ বেচেই একটা পরিবারের ভাতের সংস্থান করা যায়। কাছে বহরমপুর শহর আছে। সেখানে দুধের প্রচুর চাহিদা।
রমাপদ বললেন আবার— হাঁস-মুরগি পালনেও একই সমস্যা। মুরগির রানিক্ষেত বা হাঁসের প্লেগের টিকা না দিলে চলে না। পঞ্চায়েতের লোকেরা যেখানে রানিক্ষেতের টিকা বিনা পয়সায় পায় সেখানে আমাদের চরার লোককে পয়সা দিয়ে টিকা করাতে হয়। কতদিন তা সম্ভব? কতজন লোক তা পারে?
রশিদ বলে—ভগবানগোলা, লালগোলা, জিয়াগঞ্জ, বেলডাঙা, হরিহরপাড়া ও নওদায় কৃত্রিম প্রজনন-কেন্দ্র আছে। হিমায়িত গো-বীজের মাধ্যমে কৃত্রিম প্রজনন করানো হয়। আমরা সে সুবিধা পাই না। ভাগীরথী দুগ্ধ সমবায় সমিতি’র কোনও সুযোগ-সুবিধাও আমাদের কাছে আসে না।
—আর জেলেদের কথাটা একবার শোনান কর্তাকে।
বলে ওঠেন আয়াতুল্লা মাঝি।
—তুমিই বলো না। মাছ ধরা হল তোমাদের কারবার। তোমরাই বলো।
—এবার তো বৃষ্টি হল না, তাই নদীতে মাছ নাই। পুঁটি, বাটা, খয়রাও মিলছে না। জোয়ারের জলে ইলিশ যা কিছু ভেসে আসছে, আগদরিয়ার মাঝিরা তুলে নিচ্ছে সেসব। তা এবারের কথা ছাড়ান দেন। অন্যবারে যখন মাছ মেলে তখনও দু’বেলা পেট ভরানোর সংস্থান হয় না। এ চরায় নিজস্ব নৌকা নাই কারও। তা ধরুন ঋণ নিয়ে নৌকা কিনবে সে উপায় নাই। শাল-সেগুনের নতুন নৌকার দাম চল্লিশ হাজার পঞ্চাশ হাজার টাকা। বাবলা-খিরিশের নৌকা কুড়ি-পঁচিশ হাজারে মেলে, কিন্তু সে টেকসই হয় না। তা ছাড়া আমার মতো জেলের ঘরদোর বেচলেও নৌকা কেনার টাকা উঠবে না। এ চরায় আমার মতো পাঁচজন জেলেরও এ সামর্থ্য হবে না। মহাজনি নৌকায় মাছ ধরি আমরা। মহাজনকে ভাগ দিয়ে যা থাকে, তা আর কী! দরিদ্র মৎস্যজীবীদের জন্য সরকার কত কী করে শুনেছি। আমরা তার কিছুই পাই না।
—কত কী করে মানে, ঋণ দেয়, প্রশিক্ষণ দেয়। তবে সে আর পায় ক’ জনা! সমবায়ে নাম লেখাতে গেলে পার্টির জোর লাগে। ঋণ পেতে গেলেও একই অবস্থা। আমি তো চতুষ্কোনায় দেখেছি। দরিদ্র মৎস্যজীবীদের পক্ষে সরকারি ঋণ পাওয়া খুবই কঠিন। প্রকল্প নানারকম ই আছে। কিন্তু খাটে না। ওখানে তো পোদ্দারবাবুর নিকট হতে লোকে ঋণ নেয়। নৌকা সারায়। জাল বোনে। চাষিদের জমি থাকে বলে ঋণ পাওয়া তবু সহজ জেলেদের সে সুবিধে নাই। শুনেছি কোথাও কোথাও দরিদ্র মৎস্যজীবীদের জন্য সরকার ঘর করে দিয়েছে, নলকূপ বসিয়ে দিয়েছে জলের জন্য। কিন্তু কোথায় তা জানি না। তা, যেখানেই হোক, আর কেউ যদি পেয়ে থাকে, চরার মানুষ তা পাবে না কেন!
রমাপদ নাগাড়ে কথা বলেন। চতুষ্কোনায় পোদ্দারবাবুর জমিতে খাটেন বলে রমাপদর জানকারি অন্যদের চেয়ে বেশি। সকলের মধ্যে সমান জিজ্ঞাসা জাগে না। দেখবার, বোঝবার, জানবার প্রবণতা থাকে না সকলের। রমাপদর তা আছে। তা ছাড়া, সুকুমার পোদ্দারের আস্থাভাজন তিনি, তাঁকে জানতে বুঝতে হয় অনেক কিছুই। ওপর হতে তিনি এক বুঝমান, জ্ঞানী, সতর্ক মানুষ। পেতনির চরের মান্যগণ্য মানুষ হিসেবে হকসেদ মণ্ডলের পরেই রমাপদ দাসের স্থান। যদিও জমি তাঁর পাঁচকাঠা মাত্র। সে জমিতে আলু বেগুন টম্যাটোর চাষ দেয় রমাপদ দাসের ভাই হরিপদ দাস। হকসেদ মণ্ডলের তুলনায় জমির পরিমাণ নেহাতই কম। তবু, তাঁর জ্ঞানের কারণে, সুকুমার পোদ্দারের সান্নিধ্যের কারণে, গ্রামবাসীদের প্রতি প্রদত্ত শুভ ও সুকল্যাণী বুদ্ধির জন্য তিনি মান্যজন। বলিয়ে-কইয়ে মানুষ তিনি, এমন মানুষও তো সংসারের দর পান।
তবে ওই বলিয়ে-কইয়ে ভাব ও কাজকর্মের মধ্যেই রমাপদর জীবনের সারাৎসার। জীবন তাঁর সঙ্গে ভালরকম প্রবঞ্চনা করে সংসারকে অসার প্রমাণিত করে দিয়েছিল কবেই। রমাপদ তখন নওজোয়ান। চেহারা দেখে লোকে বলত —আহা! নবকার্তিক!
গায়ে শক্তি আজও আছে। কিন্তু তখন ছিল এর দ্বিগুণ পরিমাণে। যে-কাজ লোকে করত দু’বেলায়, সে-কাজ রমাপদ করতেন একবেলায়। এই জওয়ানি সত্ত্বেও, সংকল্প করেছিলেন বিয়ে করবেন না। এ এক দস্তুর রমাপদর পরিবারে। বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত এ পরিবারের শাখা-প্রশাখা জুড়ে হাজার দৃষ্টান্ত।
.
এ চরা দখল নিয়েছিলেন রমাপদর বাবা কালীপদ। সেই কালীপদর আরও চারভাইয়ের দু’ভাই অবিবাহিত রয়ে গিয়েছিলেন। সকলেই জানে-প্রাণে জড়ামড়ি করে একত্র থাকতেন। এখন রমাপদর খুড়াত ভাইয়েরা ভিন্নবাসী। এভাবেই ভিন্ন ভিন্ন হতে হতে চরা দখলকারী কুড়িটি পরিবার ত্রিশ বছরে পঞ্চাশ হয়েছে। সকল পরিবারেরই আত্মীয়-পরিজন ছড়ানো এ চরায়। সকলেরই আদি কাহিনি, পারিবারিক নানান সুখ-দুঃখ জটিলতা সর্বজনবিদিত। একটা সময় তো ছিলই, যখন চরার প্রতিটি মুখই ছিল পরস্পর চেনা। এখন, পুরুষেরা যদিও চেনা, কিছু বা নারীকুল অচেনা থেকে যায়।
কিন্তু সে হল গিয়ে অন্য কথা। যেমন কমলি নামের মেয়েটিকে চেনেনি হারাধন। রেজাউল আবছা চিনেছিল। সেরকম আছে আরও। একেবারে দু-তিন কাঠা সম্বলে বাঁচে এমন এ চরায় কম নেই। একেবারে ঘোর দরিদ্র তারা। ভিখিরির ওপরের দশা। সরকার দারিদ্র্যসীমা যা বেঁধেছে তার নীচে, অনেকই নীচে বহু লোক বাস করে এ জেলায়, এ চরায়। ভাতের পরিবর্তে তারা লতা-পাতা সেদ্ধ খায়। নদী-খাল-বিল হতে তুলে আনে গেঁড়ি-গুগলি। শীতে কুঁকড়ে শুয়ে থাকে বস্ত্রহীন। ঠান্ডায় রোগগ্রস্ত হয়ে মারা যায় কত জনা। তেমন দরিদ্র পরিবারগুলির অন্দরমহলে চেনাজানা ঘটাবার আগ্রহ তেমন জন্মে না। তা রুচিশীলও নয়।
যে-ভূমি পায়ের নীচে সতত অনিশ্চিত, তা-ও কিছু-বা সামাজিক রুচি ও শীলতাবোধের অনিবার্য জন্ম দেয়।
কিন্তু এইসব চেনাচিনি ছাড়াও, কিছু ঘটনার বার্তা গ্রামে বহে যায়। তাজা থাকে চিরকাল। যেমন রমাপদর বাড়ির কাহিনি। এই বাড়ি চিরকালই গল্প বটে। যে-কোনও মজলিসে, রমাপদ না থাকলে, তাঁর পরিবারের প্রসঙ্গ ওঠে।
যেমন এক কাহিনি হয়ে আছেন রমাপদর অবিবাহিত জ্যাঠামশাই শ্যামাপদ।
.
আধপাগলা ক্ষ্যাপাটে মানুষ। বাঁশের আড়বাঁশি বাজাতেন সময় পেলেই। লোকজনের ভিড় পছন্দ ছিল না। আঙিনার এক প্রান্তে একটি পৃথক মেটে ঘর তুলেছিলেন নিজেই। স্বপাকে আহার করতেন শ্যামাপদ। স্ত্রীলোকের স্পর্শ বাঁচিয়ে চলতেন। ভ্রাতৃবধূদের সম্বোধন করতেন মা বলে। পরিবারে এ নিয়ে চোরা গোপন হাসাহাসির শেষ ছিল না।
লোকে বলে, শ্যামাপদ ছিলেন গোপন সাধক। বলার কারণ, শ্যামাপদর ছিল পোষা সাপ কয়েকটি। ঝাঁপির মধ্যে নয়। জারে, ভাঁড়ে বা কলসিতেও নয়। সাপগুলি ঘোরাঘুরি করত তাঁর আশেপাশেই। চরায় সাপের সংখ্যা এখনকার চেয়ে তখন ছিল অনেক বেশি। কবেকার, কবেকার সাপ তারা। যখন নদীর গর্ভে জমে উঠছিল মাটি, সেইসময় একাকী তারা যে-যার গর্তে আশ্রয় রচেছিল। মানুষের পদার্পণের আগেকার, কাশফুল ফুটবার আগেকার কথা সেইসব মানুষের বসবাস শুরু হয়ে গেলে তারা কেউ কেউ হয়ে গেল বাস্তুসাপ। তাদেরই কয়েকজন বন্ধুবান্ধব শ্যামাপদর। শ্যামাপদ তাদের রীতিমতো মান-সম্মান দিতেন।
শ্যামাপদ রাঁধছেন, পাশে শুয়ে সাপ। শুয়ে আছে, বা বসে আছে কুণ্ডলী পাকিয়ে, এমন বলা যায়। উনুনের আঁচে তরকারি সেদ্ধ হচ্ছে। শ্যামাপদ বলছেন—বাইরে বৃষ্টি। এখন বাইরে গেলে ভিজবেন ঠিকই, তবে খাবার হিসেবে দু-একটা ব্যাঙ জুটে যেত আপনার
নীরবতা। কারণ সর্পে কথা কয় না। কেবল দেহখানি নড়েচড়ে ওঠে।
শ্যামাপদ বলে চলেছেন—আমি যা খাই তা তো রুচবে না আপনার। রুচলে থালায় দেব বেড়ে। খাবেন। আজ ভাত আর পুঁইডাটা সেদ্ধ। আপনার নিরামিষ চলবে কি? দুধ যে চলে না আপনার সে আর কেউ না জানুক, আমি জানি। এমনকী কলাও আপনার খাদ্যবস্তু নয়।
নীরবতা বজায় রেখে কুণ্ডলী খোলেন সর্প। ধীরে ধীরে এ পাশ হতে ও পাশে গিয়ে ফের কুণ্ডলী পাকান। অপর একজন বৃষ্টিভেজা হয়ে, হয়তো মধ্যাহ্নভোজন শেষ করে ফিরলেন তখন। শ্যামাপদ বললেন—আসুন, আসুন। বসুন। বিশ্রাম করুন। রান্না সারা হলে ধুন শোনাই আপনাকে। কী খেলেন আজ? আপনার প্রসন্নতা দেখে মনে হয় বুঝি পাখির ছানা পেয়েছেন!
তিনি মহাসর্প। তিনি শয়নচৌকির পায়া ধরে জড়িয়ে রইলেন। তরকারি নামিয়ে ভাত বসালেন শ্যামাপদ। ভাত আপনমনে ফোটে। তাকে নাড়তে-চাড়তে হয় না। শ্যামাপদ পিঁড়ি পেতে আড়বাঁশি নিয়ে বসলেন। ঠোঁটে বাঁশি ছুঁইয়ে ফুঁ দিলেন চোখ বন্ধ করে। মায়াময় ধুন নির্গত হলে ভাই-বউরা কাজের ফাঁকেও উৎকর্ণ হল। ওই উনি ধুন শোনাচ্ছেন মহাসর্পদের। আহা! কী সুর! অমন সুরের গুণেই সাপেরা বশ হয়ে থাকে!
সেই সুরঋদ্ধ বাঁশির ধ্বনি ছড়িয়ে যেত চরায়। মেঘের গুম-গুম শব্দের ঘোরে কাঁপন সঞ্চার করত বুঝি। বজ্র-বিদ্যুৎও এমনকী স্তব্ধ হয়ে শুনত সে-ধুন। একসময়, সেই সর্পেরা ঘুমিয়ে পড়েছে এমন বিবেচনা হলে, শ্যামাপদ বাঁশি থামিয়ে দিতেন। চরাচরে এক নৈঃশব্দ্য নেমে আসত। যেন বা শূন্যতা। এতক্ষণ, বাঁশির শব্দে, নদী হেসে উঠেছিল, ফসলের ভরা ক্ষেত হেসে উঠেছিল, ওই যে কালো মেঘ সুগম্ভীর—সে-ও যেন-বা ছিল খুশিয়াল। মানুষের মনে লেগেছিল দোলা। হিসেবি বৈষয়িক লোক, সে-ও বাঁশি শুনে কিছুক্ষণ ভেবেছিল যৌবনের রসকথা। দরিদ্র আতুর, সে সুখস্বপ্নে বিভোর হয়েছিল। রোগশয্যায় রোগী ভেবেছিল সুস্থতা।
বাঁশি সকলকেই দিয়েছিল এক সুখের স্বপ্নের বিভোর মোহময় কাল। বাঁশি থামলে সে সকলই অন্তর্হিত হল। মেঘ ডেকে উঠল গম্ভীরে। কর্কশ আছড়ে পড়ল বজ্র-বিদ্যুৎ। যেন-বা নৈঃশব্দ্য, যেন-বা শূন্যতা আঁকড়ে, বর্ষার ডুবু-ডুবু ভরাজলে হাঁকপাঁক করল ফসলের ক্ষেত। নদী ভাবল বিধ্বংসী হবে কি না। আর মানুষেরা দুঃখে-বেদনায়, রোগজর্জরে, হিসেবের ক্লেশে ডুবে গেল ফের।
কেবল সাপেরা নির্বিকার। তাঁরা কেউ ঢুকছেন। কেউ বেরুচ্ছেন।
সঙ্গে কেউ থাকলে শ্যামাপদ সাপ দেখিয়ে বলতেন—ওই তিনি, অতি প্রাচীন। কিছুদিন উপোসে আছেন। ক্ষুধামান্দ্য হয়েছে ওঁর।
লোকে হয়তো শুধল – সাপ নিয়ে থাক এমন, শ্যামাপদ, কোনওদিন না কামড়ে দেয়!
—না, দেয় না।
বলতেন তিনি।
—এঁরা সব আশীর্বাদক প্রাজ্ঞজন। অহিংস।
কেউ হয়তো জিগ্যেস করল—সত্যি বলো তো শ্যামাপদ। তুমি সাপ বশ করতে জানো!
—ছি ছি!
জিভে কামড় দিতেন শ্যামাপদ।
—বশ করা মহাপাপ। বশ করবে কেন তুমি। তোমার গুণে জনপ্রাণী আপনি বশ হবেন। তবে না!
এরপর আর কথা এগোত না তেমন। কারণ শ্যামাপদ বাঁশিতে ফুঁ দিতেন। সুর তুলে জ্বালা-যন্ত্রণা জুড়োতেন। তেজ-উত্তেজনা হ্রস্ব করতেন। সকল জিজ্ঞাসা নিরসন করে দেবার এই ছিল পন্থা তাঁর।
যদি কেউ ধৈর্য ধরে থাকত তবু। প্রশ্ন করত ফের—তোমার কোন গুণে সাপেরা বশ শ্যামাপদ? বাঁশির গুণে?
—সে আমি জানি না বাপু! তাঁরা ভালবেসে আসেন। ভালবেসে রয়ে যান। তাঁদের আশীর্বাদে সম্বৎসর সপরিবারে খেয়ে-পরে বেঁচে তো আছি।
–সাপের ভালবাসা! বলো কী শ্যামাপদ!
—কেন নয় ভাই? এ জগতে সকল প্রাণী ভালবাসা বোঝেন। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী, তাঁরাও বোঝেন। ভালবাসা মানুষের একার সম্পদ নয়।
এমন সব বাক্য, এমন অজানা জগৎ, এ চরার মানুষের কাছে তিনি এনে দিয়েছিলেন। নিত্যকার খাওয়া-পরা স্বার্থচিন্তার বাইরে এ জগতের মোহ ছিল বড় সুস্বাদের। এরপর বাকি থাকে এক করুণ অন্তিম। সেই হলে লোকে খুশি হত বুঝি। কেন না সেইমতো হলে, যতদিন চরার এ জীবন, ততদিন সেই করুণ গল্পগাথা শোনা যেত ঘরে ঘরে। কিন্তু হল না তেমন। না শ্যামাপদর, না সেই পরিবারের একজনেরও, সর্পাঘাতে মৃত্যু হল। সর্পসঙ্গ করতে করতেই একবার, তিনদিনের জ্বরে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন মানুষটি। সর্পভজা মানুষ তিনি, লোকে বলে, তাঁর মৃত্যুকালে শিয়রে বসে ছিল তারা। তেলচিটে মলিন বালিশের আশেপাশে কুণ্ডলী পাকানো সব প্রিয়জন। বন্ধুবান্ধব।
এক সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বললেন- কালী, কালী, আজ মা এসেছিল রে। মা আমাকে ডাক দিয়ে গেছে।
এই বলে সেই যে শুলেন, আর উঠলেন না। কালীপদ এসে দেখলেন, শ্যামাপদ শুয়ে আছেন জ্বরতপ্ত। জিগ্যেস করেছিলেন তিনি—কী হয়েছে দাদা?
এবং উত্তর শোনার পর্বেও বড় সতর্ক ছিলেন। ও ঘরে ভয়ে ঢুকতেন না কেউ। কোন কোণে তেনারা থাকেন! কখন কার লেজে পা পড়ে! তবু অসুস্থ মানুষের কাছে যেতেই তো হয়।
কালীপদর প্রশ্নের জবাবে শ্যামাপদ বলেছিলেন—ফিরছিলাম রে কালী। ও পাশের ডুমুর গাছের আড়াল হতে মা বেরিয়ে এল। হাত ধরে, বলল, ‘চল শ্যামা। আমার কাছে থাকবি চল।” আমি বললাম, ‘মা! যাই!’ মা বলল, স্পষ্ট বলল কালী, ‘কাল পূর্ণ হয়েছে।’ কালী, আমার কিছু হলে এই ঘর ভেঙে দিস তোরা। আর শ্রাবণে মনসা পূজিস।
শ্যামাপদর বাক্য সত্য হল। তিনদিনের জ্বরের পর তাঁর মৃত্যু হলে লোকে প্রাণ হাতে করে তাঁর দেহ বাইরে নিয়ে এসেছিল। মৃত্যুর পর সর্পেরা গিয়েছিল কোথায় কে জানে! দাহকর্মে কোনও বিঘ্ন ঘটল না। কালীপদ, শ্যামাপদর বাঁশিটাও দিয়ে দিলেন চিতায়। কিন্তু আশ্চর্য কাণ্ডটি ঘটতে দেখা গিয়েছিল মৃত্যুর পরেকার তিনটি রাত্রিতে। সারা রাত্রি ধরে ওই আগল তোলা ঘরে শোনা গিয়েছিল তীব্র শ্বাসপতনের শব্দ। ক্রোধের গর্জন তাকে বলবে না কেউ। বরং অবিরাম এক শোকতপ্তের ব্যথিত শ্বসন।
এ কোনও বানানো গল্প কথা নয়। চরার মানুষ, আঙিনায় দাঁড়িয়ে স্বকর্ণে শুনে গেছে।
শ্রাদ্ধ চুকে গেলে ভেঙে ফেলা হল ঘর। এ গর্ত ও গর্ত হতে বেরিয়ে এসেছিল কিলবিলে সাপ ও সাপের বাচ্চা। মারেনি তাদের কেউ। দ্রুত গমে আঙিনা পেরিয়ে তারা গিয়েছিল নতুন বাসভূমি সন্ধানে।
.
সে ছিল শ্রাবণমাস এক। আর সেই হতে মনসার পূজা প্রচলিত হল এই পরিবারে। প্রত্যেক শ্রাবণে পূজা। সারা শ্রাবণমাস ধরে এই পরিবারের সকল শাখায়, সকল গৃহে প্রতিদিন পাঠ হয় পদ্মাপুরাণ। আর পূজা হয় সংক্রান্তি শ্রাবণে। নিরক্ষর বধূরা দিনের পর দিন শ্রুতিমাধ্যমে মুখস্থ করে নেয় মনসাবন্দনা। কাহিনি। চাঁদসদাগরের বৃত্তান্ত।
পদ্মালয়ে পদ্মা তুমি বাসুকি-ভগিনী।
সংসার-সাগর হতে রক্ষ মা জননী ॥
অনন্তাদি অষ্টনাগ সর্পের প্রধান।
সব পায়ে পূজা যজ্ঞে হও অধিষ্ঠান ॥
এস মাগো সুহিশাখে কর আরোহণ।
পুত্র আয়ু ধন হেতু পূজিব চরণ ॥
পঞ্চগব্যে শীতলতোয়ে স্নান করাইব।
যথাসাধ্য উপচারে তোমারে অর্চিব ॥
পুত্র-আয়ু-ধন, সম্পত্তি কর গো প্রদান।
সর্পভয় হতে মাগো কর পরিত্রাণ ॥
নমি মাগো ভগবতী নমি বিষহরী।
সিদ্ধি দাও সিদ্ধিরূপা শঙ্করকুমারী ॥
এবং এক হতে আরে ছড়িয়ে পড়েছে এ পূজা। এক গৃহ হতে আর এক গৃহে ছড়াতে ছড়াতে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষ হয়ে গেছে। বিষহরির পূজা করেন সকলেই এ চরে। যেমন কিনা গোমুন্ডি গ্রামে আছেন বংশ পির। খাঁটি মুসলমান সেই সাধক হিন্দুর নিকট হতে নিত্য পূজা পান।
ধর্মের জিগির তুলে রাজনৈতিক বুদ্ধি যতই ফায়দা তুলুক–সে-সত্য প্রকৃত নয়। আসল কথা হল মানুষ মানুষকে ভালবাসতে চায়। চায় শান্ত, প্রেমময়, সমৃদ্ধ গেরস্থালি। ঘৃণা ও বিদ্বেষের মধ্যে দিয়ে যে জীবনাতিপাত—তাতে সার্থকতা কী! ধর্মের বিভেদ মানুষের সম্পর্ক গড়ার ইচ্ছাকে সাময়িক রুদ্ধ করতে পারে। চিরকাল পারে না। পাশাপাশি চলতে চলতে, কিছু বা আদান-প্রদান সত্য। প্রাকৃতিক। চিরকালই তা ছিল। মনসামঙ্গলের নানা কাহিনিতে তা ধরা আছে। যেমন সেই হাসান-হোসেনের কাহিনি।
পদ্মার জন্ম
চণ্ডীকে ছলনা করে লুকিয়ে শিব একাকী বৃষপৃষ্ঠে আরোহণ করে পুষ্পবনে বিহার করতে এলেন। ফুলের সৌরভে, রূপে, ফলের মমতায়, সবুজ শাখা-প্রশাখাগুলির প্রাণময় আন্দোলনের মধ্যে পরাগ ও রেণুর কারসাজিতে শিবের কামাসক্তি তীব্র হল। এমনই সে কামাতুরতা যে শিব অস্থির হয়ে উঠলেন। এইসময় কালীদহের তীরে একটি ফলবতী বিশ্ববৃক্ষে যুগ্ম বেলফল দেখে শিবের ভ্রম হল, এ যেন গৌরীর স্তনযুগল। উন্মত্ত হয়ে তিনি ফল দুটিতে আলিঙ্গন দিলেন। চরম সঙ্গম কল্পনায় শিবের মহারস স্খলিত হল। ব্যাঘ্রচর্মের আচ্ছাদনকে অন্তরাল করে সেই স্খলিত রস পদ্মপত্রে পড়ল। পদ্মের নাল বেয়ে সকল মহাবীর্য চলে গেল পাতালে আর সেখানে ওই বীর্য হতে এক অপরূপা কন্যার জন্ম হল। নাগরাজ বাসুকী তাকে প্রতিপালন করতে লাগলেন। নাম দিলেন তার পদ্মাবতী।
শিবের মহিমা
দিন যায়। পদ্মা একদিন ষোড়শী রূপসী যুবতী হয়ে উঠলেন। দেবী তিনি। সকলই অবগতা। বাসুকীকে একদিন বললেন-ভ্রাতঃ! তুমি আমাকে ভ্রাতৃস্নেহে প্রতিপালন করিয়াছ। তোমার অপার স্নেহে আমি কখনও কারও অভাব বোধ করি নাই। কিন্তু আজ পিতৃসন্দর্শনে যাইতে বড় ইচ্ছা করে। তুমি অনুমতি দাও।
বাসুকী পদ্মাবতীর পিতৃপরিচয় সম্যক অবগত ছিলেন। তিনি বললেন—অবশ্যই যাইবে তুমি পদ্মা। তোমার পিতা মহাদেব এক্ষণে কমলবনে বাস করিতেছেন। তুমি সেই স্থলে গিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ কর।
পদ্মা কমলবনে শিবের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। রূপসী, নবযৌবনা, সালঙ্কারা পদ্মাবতীকে দেখে শিব মদনে মোহিত হলেন। কামানলে অস্থির হয়ে তিনি পদ্মাকে রমণ করতে উদ্যত হলেন। সেই উত্থিতলিঙ্গ কামনামত্ত মহাদেবের দেহালিঙ্গনের আবেষ্টনীতে লজ্জায় স্বেদাপ্লুতা হলেন পদ্মা। বললেন—নিবৃত্ত হও পিতঃ! নিবৃত্ত হও! আমি তোমার আত্মজা।
প্রথম প্রতিক্রিয়ায় শিবের আলিঙ্গন শিথিল হল। কিন্তু তার পরেই তাঁর মনে হল, এই নারী অনিচ্ছুক, তাই মিথ্যা বলে প্রবঞ্চনা করছে। তিনি পুনরালিঙ্গনে উদ্যত হয়ে বললেন—চতুরা সুন্দরী, এত সহজে ভুলিবার পাত্র নহে এ ভোলানাথ। আইস। আলিঙ্গন দাও। আমার কামনা চরিতার্থ করা।
—পিতঃ, স্মরণ কর। পুষ্পবনে আমার জন্ম দিয়াছিলে তুমি।
শোন অনন্যা, মধুরা, বিলাসিনী! কী চাহ তা বল। এমন যৌবন লইয়া একাকিনী আমার সম্মুখে আসিয়া এমন ছলনা করিতেছ কেন? তোমার বাসনা প্রকাশ কর। তোমার অভীপ্সা আমি নিশ্চিতই পুরণ করিব। তুমি কি জ্ঞাত নহ আমার পরিচয়? জান না কি আমি মহাকাল। অমিত শক্তিধারী। যে-কোনও প্রাণীর যে-কোনও বাসনা পূরণে সক্ষম! এক্ষণে আমার কামনা অধীর হইয়াছে। তুমি ধরা দাও।
এবার পদ্মাবতী দারুণ ক্রুদ্ধ হলেন। ক্রোধে বিষ-নয়নে শিবের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেন। বিষের আঘাতে শিব হতচেতন হয়ে পড়ে গেলেন।
দুই হাতে কর্ণ ধরি চন্দ্র সূর্য সাক্ষী করি,
চাহে পদ্মা যে বিষ নয়নে।
প্রথম বিষের শিক্ষা, করিল বাপেরে পরীক্ষা,
ঢলিয়া পড়িল পঞ্চাননে ॥
শিবকে হতচেতন দেখে পবন ছুটলেন ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর কাছে। ব্রহ্মা-বিষ্ণু সব শুনে পদ্মাবতীর কাছে এলেন। অনেক করে বুঝিয়ে তাঁর ক্রোধ শান্ত করলেন। তখন পদ্মাবতী জীবমন্ত্র দ্বারা শিবকে পুনর্জীবিত করলেন। ব্রহ্মার কথায় তাঁর সকলই স্মরণে এল। পদ্মাকে নিজের কন্যা হিসেবে চিনতে পারলেন শিব। এমন কন্যারত্ন লাভে তাঁর আর আনন্দের সীমা-পরিসীমা রইল না। এবারে পদ্মাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি কৈলাস পর্বতের দিকে যাত্রা করলেন।
পিতা-পুত্ৰী
পদ্মাকে নিয়ে শিব কৈলাস পর্বতে চলেছেন। দেবী চণ্ডী আছেন সেখানে। তাঁর অজ্ঞাতে শিবের এই কন্যালাভ। অতএব শিবের ভয় করতে লাগল। না জানি দেবী চণ্ডী কী করে বসেন! হয়তো শিবকে সন্দেহই করে বসবেন তিনি। কটু কদর্য কথা কইবেন। কে জানে, যা রাগ পার্বতীর, হয়তো পদ্মাবতীকে প্রহারই করে বসবেন কখন!
তাঁকে চিন্তিত দেখে পদ্মা বললেন—কী ভাবিতেছ পিতঃ?
শিব বললেন—ভাবিতেছি, তোর মা কী বলিবেন!
দুর্গাদেবীর ক্রোধ সম্পর্কে পদ্মাবতীরও ভয় ছিল। তিনিও চিন্তিত হলেন। এবং এভাবেই পথ চলতে চলতে তাঁরা হালুয়া বছাইর নগরে পৌঁছলেন। বছাই হাল চাষ করে। তার অনেক জমি, অনেক হাল। পথে শিবের সঙ্গে সুন্দরী মনসাকে দেখে বছাই বলল—কে তুমি সুন্দরী? এই বৃদ্ধ আদমির সঙ্গে কোথায় চলিয়াছ? ওইরূপ কাঁচা বয়স তোমার! বৃদ্ধ সঙ্গে তোমার কী সুখ? এই দেখ, আমিও নবীন যুবা। আমি হালুয়াদের রাজা। আমাকে বিবাহ করিয়া সুখে থাক।
এই কথা শুনে শিব বললেন—খবরদার! আমার কন্যার পানে কুদৃষ্টি দিয়ো না!
—চোপ রও! তুমি ভণ্ড যোগী! কাহার কন্যাকে ফুসলাইয়া পলাইতেছ বৃদ্ধ ভাম?
এই কথা শোনামাত্র পদ্মার ত্রিনয়ন ক্রোধে রক্তবর্ণ হল। তিনি বছাইর প্রতি বিষদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। বছাই মাটিতে ঢলে পড়ল।
সংবাদ পেয়ে বছাইর মা ছুটে এসে পদ্মাবতীর চরণ ধরে কাঁদতে লাগল। বলল—মা! তুমি দেবী না মানবী আমি জানি না। আমার বছাই যদি কোনও দোষ করিয়া থাকে, তাহাকে ক্ষমা করো। তাহার প্রাণ ফিরাইয়া দাও।
পদ্মার মনে করুণার সঞ্চার হল। শিব টের পেয়ে বললেন—পদ্মে! এই উপযুক্ত সময়। সুযোগ উপস্থিত। ইহাদের নিকট পূজার দাবি কর।
পরামর্শ ধরল পদ্মার মনে। দেববীর্যে তাঁর জন্ম, তিনি স্বাভাবিকই দেবী। তদুপরি রূপ, গুণ, ক্ষমতা এবং ক্ষতি করার ক্ষমতা– কোনওটাই কম নেই। তিনি সাধারণ মনুষ্যকুলের পূজা না পান কেন?
তিনি বললেন—আমি নাগমাতা পদ্মাবতী। তোমরা এই গ্রামে প্রতি বৎসর শ্রাবণ মাসে যদি আমার পূজা কর, তবে আমি তোমার ছেলেকে বাঁচাইতে পারি।
বছাইর মা পূজা করতে সম্মত হলে পদ্মা বছাইকে প্রাণদান করলেন। এভাবে বছাইর রাজ্যে মনসা পূজা প্রচার লাভ করল। পদ্মা আবার শিবের সঙ্গে কৈলাসের পথে চললেন।
মা মনসা
যৌবনবতীকে দেখে লোকে কুদৃষ্টি দেয় বলে পদ্মা বৃদ্ধার রূপ নিলেন। বুড়া শিব ও বৃদ্ধা পদ্মা চলতে চলতে গোপের বাগানে উপস্থিত হলেন। রাখালিরা তখন গোরু দুইছিল। পদ্মা বললেন, বাবাসকল, আমরা ক্ষুধার্ত। কিছু দুধ দ্বারা আমাদিগের প্রাণরক্ষা কর।
রাখালরা বলল, এখনও এক ছটাক দুধ বেচি নাই। ভিক্ষা এখন দিতে পারিব না।
পদ্মা তখন বিষ দৃষ্টিতে গোরুগুলির দিকে তাকালেন। তারা মাটিতে ঢলে পড়ল। তা দেখে রাখালেরা পদ্মার পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলল—মা, তুমি নিশ্চয়ই কোনও দেবী। না বুঝিয়া আমরা তোমার নিকট অপরাধ করিয়াছি। আমাদিগে ক্ষমা করো। আমাদিগের গাভীগুলিকে বাঁচাইয়া দাও।
পদ্মা বললেন—পূজা করিয়া সন্তুষ্ট কর আমাকে। আমি তোমাদের গাভীগুলি বাঁচাইয়া দিব।
এই কথা শুনে রাখালেরা ভক্তিসহকারে পদ্মার আরাধনা করতে লাগল। এমন সময় সেই অঞ্চলের শাসনকর্তা হাসান হুসেনের লোক সেখানে উপস্থিত হল। পূজার মর্ম তারা বুঝতে পারল না। কাজের সময় অকাজ করছে ভেবে তারা রাখালদের মেরে তাড়িয়ে দিল। ছত্রাখান করে দিল পূজার আয়োজন। রাখালদের সঙ্গে তখন হাসান হুসেনের লোকের মারামারি বেঁধে গেল। উল্টে রাখালরা তাদের বেদম পিটিয়ে তাড়িয়ে ছাড়ল। হাসান কাজি তার লোকেদের এমন লাঞ্ছনার কথা শুনে সসৈন্যে গিয়ে গোপপল্লিতে আগুন লাগিয়ে লুঠতরাজ করতে লাগল।
অন্তরীক্ষ থেকে মনসা সবই দেখলেন। তিনি স্থির করলেন, হাসান কাজিকে দারুণ শাস্তি দেবেন। এই সংকল্পে তিনি নাগসৈন্যকে ডাকলেন। তারা কাজির বাড়িতে গিয়ে যাকে পেল তাকেই দংশন করতে লাগল। কাজির ছয় ভাই, দশ ছেলে সর্পদংশনে প্রাণ দিল। তাদের স্ত্রী ও মেয়েরা মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দিয়ে করুণ স্বরে কাঁদতে লাগল।
অবশেষে শুভাকাঙ্ক্ষী ব্রাহ্মণেরা কাজিকে পরামর্শ দিলেন—তুমি পদ্মার অপমান করিয়াছ। পূজা করিয়া তাঁহার শরণাপন্ন হও।
কাজি তা-ই করলে পদ্মা তুষ্ট হয়ে সকলকে বাঁচিয়ে দিলেন। সেই থেকে হিন্দু-মুসলমান সকলের মধ্যে মনসাপূজার প্রচলন হল।
নমি মাগো ভগবতী নমি বিষহরী।
সিদ্ধি দাও সিদ্ধিরূপ শঙ্করকুমারী ॥
অবোধ চাঁদ সদাগর বিবাদ করিল।
অবশেষে তোমার মা স্মরণ লইল ॥
ভোগৈশ্বর্যময়ী তব অপার মহিমা।
সুরেন্দ্রাদি দেব-নর সদা পূজে তোমা ॥
পরিবারে মনসাপূজা প্রচলিত হল এবং রমাপদ-হরিপদ পিঠোপিঠি দুই ভাই নবযুবক হয়েই বিবাহ সম্পর্কে অনাগ্রহ প্রকাশ করলেন। রমাপদ সরাসরি ঘোষণা দিলেন বিবাহ করবেন না, হরিপদ নীরব রইলেন।
পরিবারের ধারা দেখে কালীপদ এমন আশঙ্কা করতেন। বড় ছেলের ঘোষণায় এবার আতঙ্কিত হলেন তিনি। তাঁর বংশের প্রদীপ কি জ্বলবে না? ছোটছেলের মৌনতাকে সম্মতি ধরে নিয়ে তড়িঘড়ি পাত্রী খুঁজতে লাগলেন তিনি। দু’-চার পাত্রী দেখে অবশেষে নিজেরই শ্বশুরবাড়ির গ্রামে একটি সুলক্ষণা পাত্রী পেয়ে গেলেন শ্যালকের তৎপরতায়। পাত্রী পছন্দ হল। ঘরেও আটকাল না। তারাও সামান্য জমিজমা সম্বলে কৃষক পরিবার। কালীপদ শ্যালকের কাছ হতে পঞ্চাশটাকা ধার করে একেবারে মেয়ে আশীর্বাদ করে ফিরলেন।
এ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। গোল বাঁধল ঘরে ফিরে। হরিপদ সব শুনে বললেন—আমি তো বিয়ে করব বলিনি।
আত্মীয়-পরিজনেরা বললেন—তুমি তো বাপু বিয়ে করবে না তা-ও বলোনি।
—বলিনি তাতে কী! তাতেই বোঝা গেল আমি বিয়ে করব!
–তা আর কী করা যাবে? তোমার বাবা আশীর্বাদ সেরে এসেছেন। পাত্রী তো ফেরানো যাবে না। বিয়ে তোমাকে করতেই হবে।
—অসম্ভব।
—এরকম করতে নেই বাবা। পিতার সম্মান রক্ষা করা পুত্রের কর্তব্য।
—আমি বাবার হয়ে পাত্রীপক্ষের কাছে ক্ষমা চেয়ে আসছি। কিন্তু বিয়ে আমি করতে পারব না।
—কিছুতেই না?
–না।
সেই না আর ফেরানো গেল না। বাবা-মা, কাকা-কাকি, মামা-মামি, পাড়া-প্রতিবেশী সকলের অনুরোধ হরিপদ প্রত্যাখ্যান করলেন। সকলে তখন গিয়ে রমাপদকে ধরলেন। রমাপদ বললেন—না। আমি তো আগেই বলে দিয়েছিলাম। না।
এবারে কালীপদ এসে বড় ছেলের দু’টি হাত ধরলেন। বললেন—রমা। তুমিই আমাকে উদ্ধার করো। নইলে মিথ্যা আশীর্বাদের দায়ে আমাকে মহাপাতক হতে হবে।
রমাপদর চোখে জল এসে গেল। কেন তা কেউ জানল না। পিতার অসম্মানে বেদনাবোধে, নাকি আত্মপণের ভ্রষ্টতায়! জানতেও চাইল না কেউ। যে-যার নিজের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করে নিল।
বিয়ে হল। বউ এল ঘরে! শ্রীময়ী লাবণ্যবতী! শুভদৃষ্টির লগ্নে সেই বউ, জয়া নাম, ভেবেছিল—ইনি আমার স্বামী। কিন্তু এঁর তো আমার স্বামী হওয়ার কথা ছিল না।
আর সাঁঝবেলায় বউ আঙিনায় দাঁড়ালে, দুধে-আলতায় পা রাখলে, বরণডালার প্রদীপের আলোয় তার মুখ দেখে হরিপদ ভাবলেন—ইনি জয়া! আমার অগ্রজপত্নী। সম্মাননীয়া। অথচ আমারই স্ত্রী হওয়ার কথা ছিল এঁর।
যে-লগনে স্বামী-স্ত্রীর মনোমিলন হয়, সে-লগনে প্রস্তাবিত স্বামী-স্ত্রী রচনা করল মুগ্ধতা। পায়ে পায়ে অনর্থ এসে প্রবেশ করল সংসারে।
প্রথম রাত্রে রমাপদ বললেন—দেখো, তুমি বোধহয় জানো না, আমি বিবাহ করব না স্থির করেছিলাম।
জয়া বললেন—জানি।
—বেশ। জানোই যখন, তা হলে বলি, বিবাহিত জীবনের জন্য আমি এখনও প্রস্তুত নই। ভেবেছিলাম দীক্ষা নেব। হল না। কিন্তু আমার মন এখনও সেদিকেই পড়ে আছে।
—ও!
জয়া নামের সেই বধূ, গ্রাম্য তরুণী সে, শুনেছিল। ভেবেছিল— কী কঠিন এইসব কথা! ইনি কি এমনই ভারী! এমনই গম্ভীর! এঁকে দেখে স্বামী মনে হয় না। মনে হয় ভাশুরঠাকুর!
তার দেখা জীবনযাপনের সরল ছকবাঁধা ইঙ্গিতে, সম্ভাবনাময়, সাধারণ কৃষকের গৃহস্থী কল্পনায় এমন সব বাচনের প্রস্তুতি ছিল না কোনও। থাকা সম্ভবও নয়। নিরক্ষর সে। পুতুলের সংসার হতে বিবাহবিলাসী স্বপ্নের পর আপন বাস্তব সংসারে পা দিল যে-ধারণায়, তার সঙ্গে প্রকৃত পরিস্থিতির সংঘাত বেঁধে গেল।
রমাপদ ভাবেননি এইসব। ভাববার মতো পরিণত-বুদ্ধি তখন তাঁর ছিল কি না, তা নিয়ে সংশয় থাকে। তত্ত্বের ভাববিলাসিতা একরকম। জীবনের আঁকাবাঁকা রেখার সঙ্গে তার যোগ বিন্দুবৎ। জীবনরেখার সঙ্গে সম্যক পরিচয় ঘটে অভিজ্ঞতা-মাধ্যমে। কল্পনার পাখি সেই অভিজ্ঞতায় ডানা ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়ছে নিরন্তর।
তবে, পুরুষ ও নারী পরস্পরের নিকট পাতা ফাঁদ! ভুবনের এমনই অলঙ্ঘ্য নিয়ম। নেহাতই সৃষ্টিছাড়া না হলে ঘন সন্নিবেশ পরস্পরে আকর্ষণ করে। এক দৈহী মহিমা জাগে চৌম্বকরেখার ন্যায় বক্র ও সুবিন্যস্ত জাদু ভঙ্গিমায়। লিঙ্গের বৈপরীত্যে প্রাকৃতিকভাবে কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়াও এর জন্য দায়ী হয়ে পড়ে।
রমাপদ যখন মনের নিষেধগুলি টপকে টপকে ক্রমশ বিবাহিত জীবন যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন, আরও দ্রুতগতিতে নিকটতর হয়ে উঠছিল দু’জন। তাদের অলক্ষ্য গতিময়তা কারও আলাদা করে চোখে পড়েনি। কারণ দেবর ও অগ্রজবধূর ঘনিষ্ঠতায় আছে প্রত্যাশিত কৌতুকময় স্বাভাবিকভাব। কিন্তু ঘনিষ্ঠতায় যে অপ্রতিহত টান ছিল, মুগ্ধতা ছিল, ‘আমরাই পরস্পর হতে পারতাম স্বামী-স্ত্রী’—এই বোধের অধিকার ছিল, তা কারও দৃষ্টিগোচর ছিল না। বিধাতা স্বয়ং যাদের মিলন-সম্ভাবনাকে দিলেন বানচাল করে, তারা বেপরোয়া হল। কাছে এল। সকল বাধা তুচ্ছ করে লীন হল পরস্পরে। কেমন করে, কোন গোপনীয় প্রদেশে তা সম্ভব হল কেউ জানে না। কিন্তু একদিন জয়া নামের বধূটির দেহে মাতৃত্বলক্ষণ ফুটে উঠল। সংসারে খুশির অন্ত রইল না। কেবল রমাপদ হতবাক হয়ে গেলেন। বন্ধ ঘরের একান্তে তিনি পাথরের মতো শুয়ে থাকেন। সকাল হতে গম্ভীর মুখে কাজে বেরিয়ে যান। লোকে ভাবল, প্রথম পিতৃত্বের লজ্জা। তা ছাড়া, তা ছাড়া বলে না—
খাই না খাই না করে জামাই
মাইটখান উজাড় করে।
ঝোল আনিতে ভাতের ঠিকি
শুদাই সাবার করে ।।
সাধলে জামাই কাডল খায় না
হগ্গল লোকটি জানে।
শাউড়ির হাতে বথা আছিল
তাই ধরিয়া টানে ।।
বিয়ে করবে না, বিয়ে করবে না এমনই দিয়েছিল ঘোষণা। এখন দেখো, বছর না ঘুরতেই বউ পোয়াতি। তা এর জন্য সঙ্কোচ তো হবেই। লাজলজ্জা রাখতেই অমন গাম্ভীর্য রমাপদর। বিয়ে না হলে কী হত এই ছেলের, তা ভাবা যায়? শেষে দেখা যেত কোন অজাতে গিয়ে মিশেছে। আসল কথা হল, যত গর্জে তত বর্ষে না। ওই যে ব্রহ্মচর্যের ঘোষণা দিয়েছিল, তার মধ্যেই ছিল বিবাহের চাহিদা। লোকে অনেক ভাবই সোজা প্রকাশ করতে পারে না বলে বিপরীতভাবে বলতে চায়। তা রমাপদরও যে তেমনই দস্তুর, সে নিয়ে কারও সন্দেহ রইল না। বরং মুখে যিনি কিছু বলেন না, তাঁরই ওপর এক প্রকার শ্রদ্ধা অবিচল রইল। লোকে বলল— হ্যাঁ, ব্রহ্মচর্য যদি বল তো দেখতে হয় হরিপদকে। মুখে কিছু বলেনি। কিন্তু সময়কালে অটল হয়ে বসল তো!
রমাপদর গোচরে সকলই এসেছিল। সকল কথা। কিন্তু জনমানসে গড়ে ওঠা অটলবিহারীর বিরুদ্ধে তিনি কিছুই বলেননি। রাতের পর রাত, নীরবে, একটিও কথা স্ত্রীর সঙ্গে না বলে, কোনও অভিযোগ ছাড়াই তিনি দিনাতিপাত করছিলেন। ঘরের অন্ধকারে মুখ লুকিয়েও জয়ার সামগ্রিক পলায়ন ঘটছিল না। অমন পাথুরে নীরবতায় বিদ্ধ না করে রমাপদ যদি স্ত্রীকে গঞ্জনা দিতেন, প্রহার করতেন যদি, জয়ার সুবিধা হত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে শাস্তি এই অচেনা অকরুণে জয়া বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। অপরাধবোধ তাঁকে দ্বিগুণভাবে বিদ্ধ করছিল। দিনের পর দিন গেলে এক রাত্রে রমাপদর পায়ে মাথা রেখে তিনি বললেন—ক্ষমা করো।
রমাপদ বললেন—ক’দিন দেরি সইল না! এত দেহের দাবি? ছিঃ!
জয়া পায়ের ওপর পড়ে রইলেন। বলতে পারলেন না—আমার যে তাঁকেই স্বামী মনে হয়।
তিনি নীরবে পড়ে রইলেন। রমাপদ বললেন-এ কার পাপ? কার বদরক্তকে তুমি আমাদের বংশে নিয়ে এলে! হে ভগবান! আমি তো কারওকে বলতে পারব না এ আমাদের বংশের কেউ নয়, কেউ নয়।
–না না না।
আর্তনাদ করেছিলেন জয়া। রমাপদর পায়ে মাথা ঠুকে বলেছিলেন—ওগো, এ যে তোমাদেরই বংশের। বিশ্বাস করো! বিশ্বাস করো!
রমাপদর দেহে কাঁপন ধরেছিল। বিশ্বাসের তলানিও চলে যায় যখন, পায়ের নীচে চোরাবালির টান, প্রবল সেই পাতালের আকর্ষণের বিরুদ্ধে হাঁকপাঁক করতে করতে, বিকৃত গলায় রমাপদ বলেছিলেন—কে? কে? হরি?
—আমি ভুল করেছিলাম। আমি ভুল করেছিলাম। ক্ষমা করো।
মেয়ে হয়েছিল জয়ার। দিব্যি সুস্থ সবল মেয়ে। ছ’মাস বয়সে ফুটফুটে মেয়েটির জ্বর হল। একদিনের জ্বরে নেতিয়ে পড়ল সে। দ্বিতীয় দিন নৌকায় করে বহরমপুর হাসপাতালে যেতে যেতে শেষ।
আর সন্তান হয়নি রমাপদর। হরিপদও বিবাহ করেননি। কালীপদ এবং তাঁর স্ত্রী মারা যাবার পর এই তিনজনের সংসার। রমাপদ, জয়া, হরিপদ। রমাপদ সারা দিনমান চতুষ্কোনায়। চরে থাকেন জয়া এবং হরিপদ। প্রকৃত দাম্পত্য অতএব তাঁদের মধ্যেই বর্তায়। কালীপদর বংশরক্ষা হয়নি। রমাপদ এবং হরিপদর মধ্যেই তার শেষ। প্রকৃত ঘটনা রমাপদ বলেননি কারওকে। তবু লোকে জেনে গেছে। এ এক আশ্চর্য! লোকে জেনে যায় সকলই গোপন কথা। কোনও কথা চাপা থাকে না। বড় বড় কান পেতে দেওয়াল সমস্ত শোনে। বাতাস শ্রবণ হতে তরঙ্গ তুলে স্বর ফুটিয়ে ফিসফিস বলে যায় কানে কানে। জানিস জানিস জানিস…শোন শোন!
অতএব রমাপদর পরিবার এ চরায় আলোচনার বস্তু। গল্পগাছার বস্তু। রমাপদ তা জানেন। গা করেন না। দিনে দিনে এই যা হয়ে ওঠা, এই অনেক। গ্রামে এক বুঝদার মাতব্বর তিনি। লোকে মানে-গোনে। সুকুমার পোদ্দারের ঘনিষ্ঠ মানুষ, লোকে গুরুত্ব দেয়।
.
সকলের বক্তব্য শুনছিল সিদ্ধার্থ। তার মনে হচ্ছিল, মানুষগুলির ভাবনায় যুক্তি আছে যথেষ্ট। প্রয়োজনীয়তাই মানুষকে সঠিক উপায়ে ভাবিয়ে তোলে। এই চরের মানুষ, এদের অধিকাংশই নিরক্ষর। কিংবা সামান্য অক্ষর-পরিচয় সংবলিত। জীবন এই মানুষদের মধ্যে যে-চেতনা সঞ্চারিত করেছে, বক্তৃতা দিয়ে বা লিখিত বক্তব্যের কাগজ বিলিয়ে তা করা সম্ভব হত না। শিক্ষার মান নির্বিশেষে সাধারণ জনজীবনে অনেক বেশি অধিকার-সচেতনতা এসেছে এখন। হয়তো তা পূর্ণ নয়। সিদ্ধার্থ জানে, বাকি আছে অনেক, আরও অনেক। তবু, চোখের সামনা হতে ধীরে, অতি ধীরে উঠে যাচ্ছে যে কুয়াশার আবরণ, তার জন্য, বামপন্থী দলের একজন কর্মী হিসেবে সিদ্ধার্থ কিছু-বা গর্ব অনুভব করে।
অনেক সমস্যা আছে তাদের দলীয় সংগঠনে। সর্ষের মধ্যে ঢুকে বসে আছে অনেক ভূত। সে আর কোন দলে নেই! কেবল ভূতেরই দল হয়ে উঠছে যে আরও অনেক সংগঠন—তারও দৃষ্টান্ত মেলে।
সিদ্ধার্থ স্বীকার করে একথা যে, সারা ভারতে সি পি আই এম একটি অনন্য সংগঠন। এই সংগঠনের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব আছে সারা পশ্চিমবঙ্গের ওপর। বামদলগুলি ক্ষমতায় আসার পর গ্রাম পঞ্চায়েতের স্তরে ক্ষমতা ছড়িয়ে দিচ্ছে কুশলতায়। ক্ষমতার প্রতিবেশী হয়ে বসবাস করে অধিকারবোধ। অধিকার। পঞ্চায়েতের ক্ষমতাদ্রষ্টা মানুষ অধিকার বোধ করছে।
কিন্তু অধিক দৃষ্টান্ত ক্ষমতার অপব্যবহার। আরে গুছিয়ে নেবার প্রবণতা। পুনর্বার নির্বাচিত হয় কী না হয়, সমিতির মাথা হয়ে বসে কী না বসে, এই যা সুযোগ—এ হতে লুটে-পুটে নাও। এই এক প্রবণতা। ক্ষমতা পেলেই হয় না। তার ব্যবহারিক জ্ঞান দরকার। ক্ষমতার স্বাদ যারা জানেনি কোনও কালে, তারা ক্ষমতা হাতে পেয়ে হঠাৎ হয়ে উঠতে পারে স্বৈরাচারী। কেন্দ্রীয় শাসন হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে নৈরাজ্য আহ্বান করতে পারে। এ-ও একধরনের রাজনৈতিক আলোড়ন। এর জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং আঞ্চলিক শাসনব্যবস্থার পরিকল্পনা রুদ্ধ করে দেওয়া যায় না।
সকল সুবিধে, সকল অধিকারের বণ্টন আজও নয় প্রতুল, নয় সুষ্ঠু। এইখান থেকেই পূর্ণতার লক্ষ্যে যাবার কিছু দায় সিদ্ধার্থ তুলে নিয়েছে আপন স্কন্ধে। সকল দেশবাসীর মধ্যে এক বোধ জাগিয়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি বলে সে মনে করে। আমিই দেশ, আমারই মধ্যে আছে দেশ, দেশ বাদ দিলে আমার নেই কোনও অস্তিত্ব, আমি নইলে দেশও পূর্ণ নয়। দেশ ইট-কাঠ-মাটি- পাথর নয়। কেবল মানচিত্র নয়। লক্ষ-কোটি মানুষের হৃদয়ে গড়ে ওঠা বোধেরই নাম দেশ। আমিও সেই লক্ষ-কোটির মধ্যে এক। আমার দ্বারা কৃত দেশের ক্ষয়, আমারই ক্ষয় ঘটায়।
এই বোধ সে জাগরূক রাখতে চায় নিজের ভেতর। ছড়িয়ে দিতে চায় জনহৃদয়ে। একদিনে তা সম্ভব নয়। দু’দিনেও তা সম্ভব নয়। কতদিনে সম্ভব সে জানে না। সে শুধু চায়।
গণসঙ্ঘ নামে সন্ত্রাসবাদী দলটির নেতা নীলমাধবের একটি বিবৃতি ছাপা হয়েছিল কাগজে দিন কয়েক আগে। বহু প্রচারিত সেই খবরের কাগজের সাংবাদিককে দূরভাষে বিবৃতি দিয়েছিলেন সেই নেতা। নিজেকে সন্ত্রাসবাদী বলতে নারাজ এই যুবনেতা বলেছেন— আমি ভারতবাসীর মধ্যে জাগিয়ে তুলতে চাই দেশাত্মবোধ। ওই বস্তুটি না থাকলে একটি দেশ সমৃদ্ধ এবং সুরক্ষিত হতে পারে না।
নীলমাধবের বিবৃতিতে নিজের ভাবনার প্রতিধ্বনি শুনেছিল সিদ্ধার্থ। তার ভাল লেগেছিল। যদিও এই দলটির কর্মপদ্ধতির প্রতি তার এখনও কোনও সমর্থন নেই। তার মধ্যে হাজার ক্ষোভ, হাজার প্রশ্ন থাকলেও সে যতখানি প্রতিবাদী, ততখানি দ্রোহী নয়। এখন বিদ্রোহী কে-ই বা? রাজতন্ত্রের কালে বিদ্রোহ ঘটত। এখন, জননির্বাচিত সরকার ও রাষ্ট্র। তার বিরুদ্ধে কে বিদ্রোহ করবে? মানুষ নিজের গড়ে তোলার বিরুদ্ধে নিজেই যেতে পারে না। নিজেকে নস্যাৎ করতে পারে না নিজেই। তাই এখন আর বিদ্রোহ নেই। আছে সন্ত্রাস। দুর্বিনীত মাথা উঠলেই রাষ্ট্র তাকে নাম দেয় কেবলই সন্ত্রাস। তা প্রকাশ্য, তা ব্যাপক। তা লিখিত, মুখরিত। তাকে চেনা যায়। তার পক্ষে বা বিপক্ষে হওয়া যায় সহজেই। কিন্তু এ ছাড়াও যে হাজার সন্ত্রাস ছড়িয়ে গেছে মানবজীবনে, সেগুলি বড় গোপন। সেগুলি মূক। অনুচ্চ। উচ্চকিত নয় বলে, তাকে বলা ভাল ত্রাস। যাকে অবলম্বন করে নেতা হয়ে উঠতে চান মিহির রক্ষিতরা।
মিহির রক্ষিতকে মনে পড়ে তেতো হয়ে উঠল সিদ্ধার্থর মন। হকসেদ মণ্ডলের বাড়ি থেকে তারা ফিরে আসছে এখন। কাল সকাল দশটায় চরের লোক নিয়ে সভা করবে তারা। কীভাবে তাদের আন্দোলন শুরু হবে, কী কী দাবি তারা পেশ করবে প্রাথমিকভাবে, কবে তারা ঘেরাও করবে জেলাশাসকের দপ্তর, প্রয়োজন হলে পালা করে অবস্থান করবে তারা দিনের পর দিন ওই জেলাশাসকের দপ্তরের সামনে। সমস্তই স্থির হবে আগামীকাল। সিদ্ধার্থ টের পাচ্ছে, প্ৰস্তুত হয়ে আছে চরার মানুষ। এখন, এই খরার বর্ষে, কাজ নেই মানুষের হাতে। খাদ্য নেই দু’বেলা ভরপেট। শস্যহীন বিস্তীর্ণ মাঠ বিধুর বিকল। কারণ চরের মানুষ তারা, নালি কাটে না নদী হতে জমি পর্যন্ত। চরা এক অনিশ্চিত ভূ-ত্বক, এই প্রক্রিয়ায় আলগা হয়ে যেতে পারে। খসে পড়তে পারে ঝুরো ঝুরো হয়ে। পায়ের তলার মাটি খসাতে চায় কেই-বা। অতএব সেচনের জন্য ডোঙা ভরসা। তাই দিয়ে পর্যাপ্ত জল এমন পৌঁছয় না যা বৃষ্টিপাতের অভাব মোচন করতে পারে। জলতল নেমে যাওয়া শুথাপ্রায় নদী ভাগীরথী অতএব এ বৎসর চরার উর্বরা জমিকেও করেছে বন্ধ্যা। লোকের হাতে এখন তাই দীর্ঘ অবসর। এই অবসরে জীবনের জন্য কিছু বা বোঝাপড়া করে নিতে সকলে প্রস্তুত।
ফিরে আসছিল তারা স্তব্ধ। যে-যার মতো নীরব নিজস্ব জটিল ভাবনে। সিদ্ধার্থ আকাশের দিকে তাকাল একবার। উজ্জ্বল তারাগুলি অনিমেষ দৃষ্টি রাখছে পৃথিবীর পানে। ছোট-বড় হাজার তারায়, এ তারা ও তারা, সব তারায়, সুমঙ্গলা, অনির্বাণ, সব তারায়, সে বুঝি খুঁজল কারওকে। কাকে? সে ময়না বৈষ্ণবী। তার করতলে এসে লাগল বৈষ্ণবীর স্পর্শ। এই তো, এই সেই চরা, এই পেতনির চর, এ চরার মেয়ে কমলির জন্য চলে গেল মানুষটা।
না। কমলির জন্য নয়। বরং সকল নারীর জন্য। কমলি এক উদাহরণ মাত্র। প্রতিনিধিস্বরূপ। পাচার হয়ে যাওয়া নারী সে। অবমানিতা, লাঞ্ছিতা, অমানবিকতার শিকার নারী। সেই ময়না বৈষ্ণবী এই সকলের বিরুদ্ধতা। বিদ্রোহ। দ্রোহ। দ্রোহ। সংগ্রাম।
সিদ্ধার্থর বুকের মধ্যে মুচড়ে উঠল। ময়না বৈষ্ণবীর জন্য সহসাই ভার হয়ে উঠল তার হৃদয়। সে বলল মনে মনে—আপনার মরে যাওয়া উচিত হয়নি। কেন কেন কেন আপনি আমার কথা শুনলেন না?
এবং এক শোক, যথাবিধি ডেকে আনে বহু শোকের ভার। কচি দগ্ধ দেহগুলি মনে পড়ল তার। সে তাকাল আবার আকাশে। বলল যেন-বা—ওই হাজার হাজার তারার মধ্যে তোমরা কি কোথাও আছ?
কচি স্বরের কলরোল ধ্বনিত হল শ্রবণে তার—আছি আছি আছি গো!
—আঃ! তোমাদের দগ্ধ দেহ, পোড়া দেহ, আমি যে ভুলতে পারি না।
–ভুলে যাও। ভুলে যাও। সে বড় কষ্ট। বড় যন্ত্রণা। ভুলে যাও। ভুলে যাও।
এক ধবল নক্ষত্রের কাছে আবেদন করে বলল সে-পিসি। এই শিশুগুলিকে কোল দিন আপনি
—দিয়েছি বাবা। দিলাম। এরা সবই আমার বুকের ধন। কোলের সোনা। তুমি বিচলিত হয়ো না বাবা। তোমার কত কাজ!
সিদ্ধার্থ একটি পাথরে ঠোকর খেল। তৌফিক বলল— লাগল নাকি?
—না।
হারাধনের বাড়ি এসে গেছে। পাড়া গাঁয়ের আন্দাজে রাত্রি হয়েছে বেশ। সকলে অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। নারানমুদি হাঁক পাড়ল আলতার উদ্দেশে—ঠাঁই করো গো। এসে পড়েছে সব।
আলতার গলা পাওয়া গেল রান্নাঘরে—অ কচি! থালাগুলি ধো তো মা।
খাবার আয়োজনে বসল তারা। হারাধন লক্ষ করল, সারা বাড়িতে জ্বলছে চারটি লণ্ঠন। ডিবরি জ্বালিয়েই রাতের কাজ চলত এতকাল। সামান্য কেরোসিন সামর্থ্যের হাতে বানানো কুপি। লণ্ঠন ছিল একটি। কিন্তু প্রজ্জ্বলনের বিলাসিতা ঘটত ক্বচিৎ। বোতলের মুখটি ফুটো করে আলতার ছেঁড়া শাড়ি হতে লাগানো পলতেয় জ্বলত যে-আগুন, তাতে আলোর চেয়ে কালি হত অধিক। এখন অনায়াসে জ্বলা লণ্ঠনগুলি দেখে প্রথমে পরিতোষ বোধ করল হারাধন। কিন্তু তারপরই বিরক্তি এল তার। মনে হল, আলতা ও নারানমুদি বড় অবিবেচক। তারই উপার্জিত অর্থে যাপিত জীবন হতে কিছু সঞ্চয় না করে তারা গা ভাসাচ্ছে বিলাসিতায়। সে পাকঘরে গেল আলতার কাছে। বলল—এতগুলো লণ্ঠন একসঙ্গে জ্বেলেছ মা! তেল লাগছে না?
বাটিতে বাটিতে মাছের ঝোল তুলতে তুলতে আলতা বলল— ডিবরিটা খারাপ হয়ে গেছে। নতুন বানাব একটা। রোজ এত জ্বালি না। আজ লোকজন।
অকারণেই তেতো হয়ে গেল হারাধনের কণ্ঠ। কিংবা আজ দাম্পত্যকলহ হতে যে-তিক্ততা সে আহরণ করে এনেছিল, তারই উদ্গিরণ হল বুঝি। সে বলল— সিদ্ধার্থর কাছে তো আমাদের অবস্থা গোপন নেই। পাঁচশোটা লণ্ঠন জ্বেলে নবাবি করার আগে তো আমার কথা ভাবতে পারতে। দু’টো সংসার চালাতে আমাকে হিমশিম খেতে হয়।
আলতার মুখে কথা ফুটছিল না। রোজগেরে ছেলের ওপর চোপা করা যায় না, ক্রমশ বুঝছে সে। এই ছেলের দৌলতেই ইদানীং জুটছে দু’বেলার নিশ্চিন্ত আহার। খোড়োচালের পরিবর্তে ঢেউটিন লাগাবার পরিকল্পনা করছে নারানমুদি! অতএব, আলতা বলল— ভাবি রে বাবা। তোর কথা ভাবব না, তেমন স্বার্থপর নাকি আমরা? কালই বানাব একটা কুপি। হ্যাঁ রে, মৌসুমিকে সঙ্গে আনলি না কেন?
—মৌসুমিকে?
বিহ্বল শোনাল হারাধনের গলা। তার সকল জুড়ে থাকা যে-মৌসুমি, তাঁরই হৃদয়ভরা স্মরণে সে বলল—আসার ইচ্ছে ছিল খুব। কিন্তু আমিই বললাম পরে নিয়ে আসব। খুব অনুযোগ করছিল মা। এখানে নিয়ে আসিনি বলে।
আলতা অবাক হয়ে বললেন—ও! তুই তাঁর কথা বলছিস! তোর গুরুমা? তিনি কী করে আমাদের এই ভাঙাবাড়িতে আসবেন! আমি বলছি বউমার কথা। বউটার সঙ্গে তো ভাল করে মেলামেশাই হল না আমাদের। না আমরা ওকে চিনলাম, না ও আমাদের চিনল! একটু আসা-যাওয়া না হলে শ্বশুরবাড়িকে ও আপন করে নেবে কী করে বল তো!
মায়ের কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে উঠছিল হারাধন। তার স্ত্রী মৌসুমির সঙ্গে আলতার কথা প্রায় হুবহু মিলে যাচ্ছে।
আলতা কাজ করতে করতে বলে চলেছে—লোকে কত কথা বলে! বউ আসে না, এ কেমনধারা!
সে বলল—এলে শোওয়াতে কোথায়? মাথার ওপর?
আলতা শান্ত তাকাল। রক্তহীন মুখে, অযত্নের এলোমেলো চুলে, হাতের নীলচে শিরায় শিরায় লেগে থাকা ক্লান্তির ওপর হাসি টেনে সে বলল—হারু, তুই কীরকম রুক্ষ হয়ে যাচ্ছিস। আমাদের টাকা দিতে তোর যদি খুব কষ্ট হয়; তুই দিস না বাবা। আমাদের তো চলছিল একরকম করে।
—বাজে বোকো না।
—না রে। সত্যি বলছি। এত রুক্ষ তো ছিলি না তুই। কত পড়েছিস তুই। বিদ্যা তো মানুষকে আরও সুন্দর করে। করে না?
—ভুলটা কী বলেছি? মৌ এলে শুত কোথায়? বলো?
—তোর ভাইরা তো আজ সব বাইরে-বাইরেই থাকবে। এর-ওর বন্ধুর বাড়ি। তোর বাবা না হয় দোকানে শুয়ে পড়ত। আমি কচি আর বউমাকে নিয়ে ও ঘরে শুতাম। যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় ন’জন। একরাত্রির তো ব্যাপার। বউমা আসতে চায় না?
কথার জবাব না দিয়ে ঘরে চলে এল হারাধন। নাড়ু, তারু ও সারুর সঙ্গে চর বিষয়ে কথা বলছে সিদ্ধার্থ ও তৌফিক। সে গিয়ে বসল। কিন্তু কথায় তার মন রইল না। সিদ্ধার্থকে চরায় এনে দিয়েছে সে। এবার যা করার সে-ই করবে। এর বেশি কিছু করার দায় আপাতত বোধ করল না সে। পরে সিদ্ধার্থ যা বলবে, করবে সে। খাবারের আয়োজন হতে হতে সে চলে গেল মৌসুমির কাছে। মা মৌসুমি। বড় বেদনায় দিন যাপন করছেন তিনি। হঠাৎ হারাধনের মনে হল, বিক্ষুব্ধ তরঙ্গমালায়, সে আর মৌসুমি আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্ছে যেন, ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। তারা কি কাছে আসছে? নাকি সরে যাচ্ছে দূরে?
শিউরে উঠল সে। পারবে না। পারবে না সে। মৌসুমির থেকে দূরে যেতে পারবে না। তার মনে হল, সে ব্যাধিগ্রস্ত। চলৎশক্তিরহিত। এ ব্যাধি সারবে না কোনও দিন। কারণ এ ব্যাধির মূল রয়েছে বিবাহে। বিবাহে। তার ও মৌসুমি-মায়ের মধ্যে কালসর্পের মতো এসেছে অন্য মৌসুমি। তার স্ত্রী। কপালে হাত রেখে ভাবতে থাকল সে। কেন সে বিয়ে করতে রাজি হল? কেন, কেন, কেন!