2 of 3

রাজপাট – ৭২

৭২

ভাদ্র না মাসেতে হে কন্যা 
পাকিয়া পড়ে তাল। 
যুগীর যুগিনী হইয়া 
হস্তে লব থাল ।।
হস্তে লব থাল হে প্ৰিয় 
মাগিয়া যাব দেশে। 
দুই কানে দুই কুণ্ডল পিন্ধিয়া 
যাব সাধুর দেশে ।।

.

বিরস মুখে পূর্ণ চক্রবর্তীর বাড়ির দিকে হাঁটছিল অলক ঘোষাল। তার মাথায় ঘুরছিল শিখারানির শাপ-শাপান্ত। রাগ তার মাথা ফুঁড়ে বেরুচ্ছিল। এত বড় সাহস খানকি-মাগির যে, শাপমন্যি করে! তারই বুদ্ধিতে চলে আর তাকেই শাপমন্যি করে! কী ভেবেছিল ওই অসতী মেয়েটা? ওরই মুখপানে চেয়ে অলক ঘোষাল কখনও বিবাহধর্ম করবে না? আশ্চর্য! 

শাপমন্যির কথা ভেবে তার মুখ বেঁকে যাচ্ছিল। কে জানে, কার শাপ লেগে যায় কখন! তা ছাড়া ইদানীং শিখারানির জটাজুটের দিকে তাকিয়ে, ভর-পড়া দোলন আর রুক্ষ চেহারার দিকে তাকিয়ে তার নিজেরও কেমন বিভ্রম জাগে। সত্যিই ওর মধ্যে কোনও শক্তি এসে চেপে বসছে না তো! মরা মরা বলতে বলতেই তো রাম এসে জিহ্বাগ্রে অধিষ্ঠান করেন! কোনও শক্তিই যদি না থাকে, ওই নিমের কাঠি ভিজিয়ে খেয়ে লোকে সেরে ওঠে কী করে! সকলেই সারে না। তবু কিছু লোক তো সারে। আর অলক ঘোষাল নিজে তো জানে, ওর মধ্যে শুধু ফক্কিকারি ছাড়া আর কিছু নেই! তা হলে? এই যে শিখারানি সেদিন বাঁধন দিয়ে এল পোদ্দারবাড়ি, আর তো কোনও ভূত-প্রেতের অভিযোগ আসেনি। তা-ই বা হয় কী করে! 

অতএব শাপমন্যির কথা ভেবে সে বিষাদগ্রস্ত হচ্ছিল। 

চারপাশে ধু-ধু জ্বলে যাওয়া ক্ষেত। কয়েকজনের ক্ষেতে মাত্র উঠেছে ভাদই ধান। হৈমন্তিক ধানের গাছগুলি তেমন পুষ্ট হয়ে ফোটেনি। অলক ঘোষাল এখন এসব নিয়ে ভাবিত নয়। হিন্দুর ঘরে ঘরে এখন চলছে পূজা-পার্বণ। সামান্য সামর্থ দিয়েও লোকে শনি-সত্যনারায়ণ করছে। ভাদুলি ব্রত করছে আর মনসার পূজা। সেইসব পূজায় ডাক আসছে তার। লোকে সাধ্যমতো দু’টাকা-পাঁচ টাকা দক্ষিণা দিচ্ছে। সেই বা কম কী! পূর্ণ চক্রবর্তীরও ডাক পড়ছে এখানে-সেখানে। তবে পূর্ণ চক্রবর্তী বুঝদার। একাই সকল পূজা অধিকার করছেন না। ভাবী জামাইয়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন। 

ভাবী জামাই! তা নয়তো কী! পূর্ণ চক্রবর্তীর ইচ্ছা অলক ঘোষালের বুঝতে বাকি নেই। সে লোক অত কাঁচা নয়। বর্ষাকে দেখার পর নিজের ইচ্ছেও সে জানিয়ে দিতে দেরি করেনি। ইচ্ছেয় ইচ্ছে মিলেছে। কিন্তু মাঝখানে বাধা হয়ে আছে শিখারানি আর তার পাগল স্বামী। ওই দুই ভূতের দায়িত্ব নেবে কে! পূর্ণ চক্রবর্তী চান মেয়ের নিষ্কণ্টক জীবন। কোন বাপই তা না চায়! অতএব কণ্টক দু’টির কথা মাঝে মাঝেই তিনি স্মরণ করিয়ে দেন। যদিও নিজের মেয়ের বিষয়েও তিনি দিয়েছেন কিছু ধারণা। তাতে অলক এটুকু বুঝেছে, বর্ষা আর নিষ্কলঙ্ক নেই। প্রকৃত ঘটনা কী সে জানে না। জানতে চায় সে। কিন্তু এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত, প্রকৃত সেই ঘটনা, যা-ই হোক না কেন, বর্ষাকে সে নেবে। ফুল ফুটলে মৌমাছি এসে জোটে। লুটে-পুটে মধুও খায়। তা বলে কি ফুল পূজায় লাগে না? বর্ষা সুন্দর। আর অলক সেই সুন্দরের প্রতি মোহগ্রস্ত।

ধু-ধু মাঠের ওপর দিয়ে বিকেল দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। সকাল থেকে আজ আর বেরুনো হয়নি। দুপুরের ঘুমও জমেনি ভাল করে। শিখারানির অভিশাপ তাড়না করেছে অলককে। রোদ্দুর না ফুরোতেই বেরিয়ে পড়েছে সে, কারণ বর্ষাকে একবার চোখের দেখা দেখে নেবার জন্য তার মন চঞ্চল হয়েছে। শিখারানির শাপে বর্ষার কোনও ক্ষতি হবে না তো! শিখারানি যদি গোপনে বাণ মেরে বসে? কে জানে সে এইসব জানে কি না। যে প্রেত বাঁধতে পারে, সে কি বাণ মারতেও পারে না? অলকের মনে হয়, যেন বহু গুণ, বহু জ্ঞান জানতই শিখারানি। চেপেচুপে ছিল। এখন বার করছে একে একে। তার মনে শঙ্কা লেগে থাকে। বর্ষার কোনও ক্ষতি হলে সে বাঁচবে না। বাঁচবে না। মরে যাবে। বর্ষাকে বুকে আগলে রাখবে সে। সকল আঘাত হতে দূরে রাখবে। 

আস্তে আস্তে শিখারানির কাছ হতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে হবে, এমন ভাবল সে। কিন্তু নিজের কাছে অস্বীকার করতেও পারল না, দেহ বড় অবুঝ। দেহের দাবি যখন ওঠে তখন সে কারওকে মানতে চায় না। কোনও নিষেধ, কোনও শাপ-শঙ্কা! এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী! একমাত্র উপায় তাড়াতাড়ি বিবাহ করা। কিন্তু পূর্ণ চক্রবর্তী ধূর্ত লোক। অত সহজে মেয়ে দেবে না হাতে। সে সংকল্প করল, আজ একবার বিবাহের কথা পেড়ে দেখবে। কিন্তু কী সম্বলে বিয়ে করবে সে? 

অলক পূর্ণ চক্রবর্তীর বাড়িতে যায় সাধারণত সকালে বা সন্ধ্যায়। একবার গেলে থেকে যায় অনেকক্ষণ। এখন এই রোদ্দুর না শুকনো বিকেলে ও বাড়িতে গিয়ে হাজির হতে তার লজ্জা করল। একটু এদিক-ওদিক ঘুরে সন্ধ্যা লাগলে যাবে সে এমনই স্থির করল। কিন্তু এই এদিক-ওদিক সে যায় কোথায়? ভাবতে ভাবতে ফেরিঘাটের দিকে এল সে। 

নদীর জল নেমে গেছে। ডিঙি নৌকা পারাপার করছে কোনওক্রমে। সাঁকোর ধারে পা ঝুলিয়ে বসল সে। সমস্ত পাড় পাথরে বাঁধানো হবে। শুনেছে সে। কবে হবে? এখনও অনুমোদন আসেনি। এ বছর বৃষ্টি হল না একেবারে। বৃষ্টি হলে নাকি তাড়াতাড়ি অনুমতি পাওয়া যেত। পাড় বাঁধিয়ে কি ভাঙন আটকানো যায়? সে বুঝতে চেষ্টা করে। যায় হয়তো। বড় বড় বোল্ডারের কঠিন শরীর আটকে দেবে নদীর দংশন। 

সোনালি রং ধরছে রোদ্দুর। ভূমি তা শুষে নিচ্ছে দ্রুত। এমন রোদ্দুর শরতের আগমনবার্তা জানায়। কিন্তু বর্ষার পর শরৎ আসার যে আনন্দ, তা এবার কোথায়? নৌকা বাইচও হবে না এবার তা বোঝা যাচ্ছে। কোনও একটা বিড়ি কোম্পানি এবারের বাইচে ভাল টাকা পুরস্কার দেবে ঠিক ছিল। খুব জমে যেত বাইচ। কিন্তু বর্ষাই এল না। 

বর্ষা! বর্ষা! দু’বার উচ্চারণ করে সে। বর্ষা ছাড়া কেউ বাঁচে না। সে-ও বাঁচবে না। বর্ষা তার চাই। আহা! বর্ষা কী সুন্দর! 

সে বর্ষার কথা ভাবতে ভাবতে নদীর কালচে ঘোলা স্রোতের দিকে তাকায়। তখন পেতনির চর থেকে একটি ডিঙি নৌকা এসে ঘাটে লাগে। এই খরায় লোকের কাজ কমে গেছে, যাতায়াত কমে গেছে। সে ভাবতে থাকে, বর্ষাকে বিবাহ করলে আয় বাড়াতে হবে। পূর্ণ চক্রবর্তী, জ্যোতিষও জানেন কিছু, সে ওই জ্যোতিষবিদ্যা শিখবে বলে ভাবল। মোটামুটি আয়ত্ত করে, নিত্য কুণ্ডুকে ধরে যদি বহরমপুরে সোনার দোকানে বসা যায়, তবে নিত্য কুণ্ডুর স্বর্ণলক্ষ্মী তারও গৃহে এসে বাস নেবে না কি? সুন্দরী স্ত্রী ও সমৃদ্ধ জীবনের কল্পনায় বিভোর হয়ে উঠল সে। তার চাই। অনেক অনেক টাকা চাই। সুকুমার পোদ্দারের মতো টাকা। সুন্দরী স্ত্রী আর টাকা না থাকলে বেঁচে সুখ কী! 

তার স্বপ্ন ঘিরে ভাদ্রের সন্ধ্যা নামল। ভাগীরথীর কালচে জল গায়ে আঁধার মেখে আরও কালো হল। অলক ঘোষাল উঠল এবার। এতক্ষণ স্বপ্ন-কল্পনায় বিভোর ছিল, বেশ ছিল। এখন পথে যেতে যেতে তার আবার মনে হল ওই শাপ মন্যির কথা। বিরস মুখে সে এসে দাঁড়াল পূৰ্ণ চক্রবর্তীর ছোট মেটেবাড়ির উঠোনে। চক্রবর্তীর গিন্নি ঊষা তাকে দেখে আহ্বান করলেন—এসো বাবা। এসো। 

সে বসল দাওয়ায়। তাকাল এদিক ওদিক। জেলেপাড়ার টিউকল থেকে কলসিতে জল নিয়ে ফিরল বর্ষা। তার বাঁকা দেহের কাঁখে পূর্ণ কলস। মাথায় মস্ত খোঁপা। তীক্ষ্ণ নাকে জ্বলজ্বল করছে ছোট এককুচি নাকের ফুল। অলকের দিকে বাঁকা চোখে তাকাল বর্ষা। হাসির মৃদু ঢেউ উঠল ঠোঁটে। অলকের বুক দুলে উঠল। বর্ষা! কী সুন্দর! এরা সকলেই কেঠো বাঙাল ভাষায় কথা বলে। অলকের তাতে অসুবিধা হয় না। তারা যে-ভাষায় কথা বলে, তাতে বাঙাল ভাষার মিশ্রণ আছে। সে চুপ করে বসে রইল। বর্ষাকেই ভাবতে লাগল সে। এই মেয়েটি পরিপূর্ণভাবে তার হবে কবে! আদৌ হবে তো! 

ভাদ্রের সন্ধ্যা আলো ধারণ করে আছে ফিকে ভাবে। ঊষা লণ্ঠন জ্বেলে দাওয়ায় রাখলেন। ইতিমধ্যেই এঁদের উঠোনে গড়ে উঠেছে ঝাঁকড়া তুলসীগাছের মঞ্চ। বর্ষা সেখানে প্রদীপ দিয়ে শাঁখ বাজাল। গলায় আঁচল জড়িয়ে তুলসীমঞ্চে গড় হয়ে প্রণাম করলেন ঊষা। অলকও হাতজোড় করে কপালে ঠেকাল। কিছুদিন আগে পর্যন্ত সন্ধ্যায় তার কোথাও যাবার উপায় ছিল না। শিখারানির সঙ্গে হাত লাগিয়ে সতীমন্দিরের সান্ধ্যপূজা আয়োজন করত সে। এখন সেই নিষ্ঠায় ভাটা পড়েছে। সে ভাবছিল, ওই মন্দির হতে শিখারানিকে হঠানো দরকার। কারণ মন্দিরই তার মূল উপার্জন। শিখারানিকে ছেড়ে সতী-মা তো বর্ষার ওপরেও ভর করতে পারেন। কিন্তু শিখারানি কি এত সহজে তার জায়গা ছেড়ে দেবে! লোকেও কি মানবে এত সহজে? অলক ভেবে কূল-কিনারা পায় না। বর্ষার বিশাল খোঁপার দিকে চেয়ে তার বুক দুর-দুর করে। ওই মেঘরাশির মতো চুলে জট পড়লে সব সৌন্দর্য চলে যাবে। তা কি সে হতে দিতে পারে? তখন তার মনে হয়, জট পড়তেই বা হবে কেন! খোলা রেশমি চুল মেলে ধরে দুলে দুলে ভর পড়বে বরষারানি। দেখাবে তাকে দেবীপ্রতিমার মতো। সে কল্পনা করতে থাকল। শহর থেকে শ্যাম্পু এনে দেবে সে বরষারানিকে। শ্যাম্পু করা পিঠময় চুল। কপালে ডগডগে সিঁদুর, ব্লাউজ়হীন দু’টি ঢলঢলে স্তনের আভাস আঁচলের নীচে, তার ওপর স্বহস্তে শ্বেতচন্দনের প্রলেপ দেবে সে। দিনের সতীনারী রাত্রে হয়ে উঠবে পতির উল্লোল অঙ্কশায়িনী। স্বামী সে! স্বামী! স্বামীর জন্য যে এসব করে, সেই তো প্রকৃত সতী! ভেবে তার শরীর চনমন করে। কখন বর্ষা এসে ঘন হয়ে দাঁড়িয়েছে তার কাছে। ঊষা নেই কাছে-পিঠে। পূর্ণ চক্রবর্তীও নেই। বর্ষা বলছে—বাব্বা! এমুন বিভোর হইয়া কারে ভাবতেয়াছ অলকুদা? 

অলক চমকে উঠল। বর্ষার হাঁটু তার হাঁটুতে লেগেছে। আর একটু ঝুঁকলেই বর্ষার উন্নত স্তনশীর্ষে তার নাসাগ্র ঠেকে যাবে। কিন্তু এই সামান্য দূরত্ব এই মুহূর্তে অনতিক্রম্য। তার রক্ত দামাল হয়ে উঠল। ইচ্ছে করল দু’ হাতে বেড় দিয়ে বর্ষার ঈষৎ চাপা, ঈষৎ নমিত শ্রোণী নিষ্পেষিত করে দেয়। কিন্তু ইচ্ছেকে ইচ্ছেই রাখতে হল তার। বর্ষার কথার উত্তরে বলল—যদি বলি তোমারই কথা! 

— ইসস্! 

বলে, দু’হাত ওপরের দিকে তুলে আড় ভাঙল বর্ষা। অলকের দুই উরুর প্রায় মধ্যে সরে এল সে। অলক এদিক-ওদিক তাকাল। পূর্ণ চক্রবর্তীর সাড়া নেই। ঊষাও নেই সামনে। এমন সুযোগ মেলে কদাচিৎ। বর্ষা এখন আরও উগ্রভাবে কাছে এসেছে। খোঁপা খুলে ফেলে খোঁপা বাঁধছে আবার। একপাশের শাড়ি সরে গিয়ে ঠিকরে এসেছে স্তন। অলকের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। সে জানে, নারী কখন এমন উন্মুক্ত হয়! সে খসখসে গলায় বলছে—কাকিমা কই? 

হাসছে বর্ষা। দেহ মুচড়ে তুলছে। বলছে—মা গাই দুইতে গেছে। তিনবাড়ি গাই দোয় মা এখন। 

—কাকা? 

–কাকা? উঁ? কাকা? এখনই এল বলে। 

সে সাবধান হল। পূর্ণ চক্রবর্তীর প্রতি তার ভীতি আছে একরকম। সম্ভ্রম আছে। এই মানুষটির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এঁকে সে চটাতে চায় না। তবু, নারীর মোহ সম্মোহনের মতো। বর্ষার এই ঘিরে আসায় সে পাগল হয়ে উঠছে। নেমে আসা অন্ধকারের সুযোগে সে দুহাতে সাপটে ধরছে বর্ষার পেছনদিকের দুটি তাল করা মাংসের ডেলা আর সামনের মাংস দুটির দিকে হাঁ-মুখ বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তার হাত ছাড়িয়ে ছিটকে সরে যাচ্ছে বর্ষা। হাসছে। বলছে—কী অসইভ্য আপনে অলকদা! বাবারে কইয়া দিমু অখন। 

অলক চমকে উঠে অনুরোধ করছে বর্ষাকে। অনুনয় বিনয় করছে—না না। কাকাকে বোলো না। বর্ষা, আমি ক্ষমা চাইছি। 

গম্ভীর হয়ে গেল বর্ষা। বলল—তাইলে কন কার কথা ভাবতেয়াছেন। 

—বিশ্বাস করো, তোমার কথা। 

—সত্যি? 

—সত্যি-সত্যি-সত্যি! 

—এক্কেরে তিনসত্যি দিয়া ফালাইলেন? অলকদা? 

—বলো। 

–একখান কথা জিগামু? 

—বলো বর্ষা। 

—আপনে আমারে ভালবাসছেন? 

—প্রাণ দিয়ে ভালবাসি বর্ষা। প্রাণ দিয়ে। তোমাকে বিয়ে করব আমি বর্ষা। তুমি আমাকে ভালবাসো বর্ষা? 

—আমার কথা ছাড়ান দ্যান। আপনের কথা কন। মাইনষে কয়—

বর্ষা আধো অন্ধকারে এলোমেলো দোলে। অলক দম বন্ধ করে জিগ্যেস করে—কী বলে? কী? 

বর্ষা এক ঝটকায় অলকের সামনে চলে আসে। হিসহিসে গলায় বলে–আপনের লগে আপনের বৌদিদির শরীলের সম্পর্ক আছে। 

—কে বলেছে একথা? কে? 

সাপের ফণার মতো ছিটকে দাঁড়াল অলক। সারা শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে তার। কাক-পক্ষী জানে না যে-সম্পর্কের কথা তা লোকে জানবে কী করে! সে দারুণ বিস্মিত। এবং সতর্ক। লোকে কী জানে! কতটা জানে! আবার প্রশ্ন করল সে-কে বলেছে? কে? 

—শুনি। 

বলল বর্ষা। 

—বিশ্বাস করি নাই অবইশ্য। গ্রামের মাইনষেরে জন্ম থেইকা দ্যাখতাছি তো। জানি। কয়, ঘরে দুই দেওর আর পাগল স্বামী। আর কেও নাই। কিসু কি আর অয় না! আমি কই, কিন্তু হইছে তরা দ্যাকছস! আপনা রূপে দুনিয়া দেখে। বসেন বসেন অলকদা। অত রাগ ক্যান? 

অলক নিটোলভাবে বলল—–বউদি আমাদের মায়ের মতো জানো? 

—জানি না আবার? খুব জানি! 

—শিবশম্ভু! হর হর বাবা ভোলানাথ! 

পূর্ণ চক্রবর্তীর গলা পাওয়া গেল বাইরে। বর্ষা একটি ছোট চড়াই পাখির মতো তুভুক লাফে চলে গেল একেবারে পাকঘরে। পূর্ণ চক্রবর্তী আঙিনায় পা দিয়ে বললেন-বর্ষা! বর্ষা মা! 

—যাই বাবা! 

—কে? অলক? বস। আসি আমি। পোদ্দারবাবু লিখ্যা দিছিলেন। রেশন কার্ড করাইবার জন্য গ্যালাম। তা কি সহজে হয়? কখন আসছ? 

অলক কোনওক্রমে বলল—এই তো। কাকিমা দুধ দুইতে গেলেন। 

—তা বস। বর্ষা মা, একটু জল দে। 

—যাই বাবা। 

অলক বসল আগের মতো। ভাবতে থাকল। পূর্ণ চক্রবর্তীর নিশ্চয়ই অনেক টাকা। না হলে চলে কী করে। সে নিজে তো জানে। এই গ্রামে পুজো করে যে উপার্জন তাতে সংসার চালানো যায় না। প্রৌঢ় পূর্ণ চক্রবর্তী মাটি কাটার কাজ পারবেন না। চাষের কাজও না। অতএব তাঁর জীবিকার ভরসা পূজাপাঠ। জ্যোতিষী। ওষুধ-পত্র দেওয়া। এই সবকিছুই প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্ণ চক্রবর্তী এ গ্রামের মাটিতে ভালভাবে শেকড় ছড়াতে পারবেন। আর সেইখানেই শরিকি সমস্যা তার ও পূর্ণ চক্রবর্তীর মধ্যে। সে অঙ্কটা বোঝে। সে পূর্ণ চক্রবর্তীর জামাই হলে সকল ব্যবসাই পারিবারিক হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এই সকল অঙ্ক মিলতে গেলে সময় দরকার। মানুষের বিশ্বাসের ওপর এর ভিত প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত চলার সংস্থান নিশ্চয়ই পূর্ণ চক্রবর্তীর আছে। 

বিয়ের কথা কীভাবে পূর্ণ চক্রবর্তীর কাছে উত্থাপন করা যায় ভাবতে থাকল অলক। আগে থেকে তৈরি হয়ে কি কিছু বলা যায়! 

তার ভাবনার মধ্যেই ফিরে এলেন ঊষা। হাতে একখানি ঘটি। এই তাঁর দুধ নিষ্কাশন করার পারিশ্রমিক। এক ঘটি টাটকা, শুদ্ধ দুধ। গঞ্জিকাসেবী মানুষটার দুধ ছাড়া চলে কী প্রকারে! দেশে গাই ছিল নিজের, দুধের অভাব হয়নি। এখানে আরও থিতু না হওয়া পর্যন্ত গাই কেনার কথা ভাবা যাবে না। এক ঠাঁই হতে অন্য ঠাঁই শিকড় গেড়ে বসা কি সহজ? ভাষা এক, কিন্তু ভিন্ন-দেশ তো বটে। অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে আসা মানুষ তাঁরা, বুকের খোপে চটচটে ভয় লেগে থাকে সারাক্ষণ। একই প্রকৃতি দুই বাংলার, একই মাটির গন্ধ, তবু, ওই ভয়ের জন্যই, এই দেশ আপনার হয়ে উঠতে চাইছে না। অথচ নিদারুণ নিরাপত্তাহীনতায় কেটেছে যখন, ওই দেশ মনে হত বৈদেশিক। আপন লাগত না। তবে তাঁরা কোন দেশের? মাঝে মাঝে মনে হয় এমন। নিঃশঙ্ক বসবাসের কোল দেবে কোন দেশমাতৃকা! নাকি এপার নয়, ওপার নয়, তাঁরা চিরকাল থেকে যাবেন ভাসমান মধ্যবর্তী হয়ে? এক নেই-দেশের মানুষ! এই সকল প্রশ্নই জেগে থাকে কেবল। জবাব মেলে না। 

ঊষা দাওয়ায় একটি মাদুর বিছিয়ে দিলেন। পূর্ণ চক্রবর্তী বললেন—দাওয়ায় ক্যান? উঠানেই দ্যাও। যা পচা গরম। 

উঠোনেই গুছিয়ে বসল তারা। কাঁচা পেঁয়াজ আর লংকা দিয়ে মাখা মুড়ি দিয়ে গেল বর্ষা। যাবার সময়, অন্ধকারের সুযোগে একটু ছুঁয়ে গেল অলককে। অলক শিহরিত হল। যৌনভোগের অভিজ্ঞতা লব্ধ পুরুষ সে। কিন্তু শিখারানির দ্বারা এমন সব অনুভূতি তার কখনও হয়নি। কেন হয় এমন? একই দেহ, বিচিত্র অনুভবের ধারক হয় কী প্রকারে? মুড়ি চিবোতে চিবোতে একথা-সেকথা বলে যাচ্ছিলেন পূর্ণ চক্রবর্তী। একবার বললেন—আর কী! আমাগো তো দিন গেল গিয়া। মাইয়াডারে কাউর হাতে দিতে পারলে বুগডা আরাম হয়। 

এমন ধারা কথা আগেও বলেছেন পূর্ণ চক্রবর্তী। অলক শুনে চুপ করে থেকেছে। আজ কথাটা লুফে নিল সে। বলল-আপনি অনুমতি করলে বলতে সাহস পাই। 

পূর্ণ চক্রবর্তী গাঁজায় দম দিলেন। কলকে বাগিয়ে ধরে মৌজ করে টেনে বললেন—তা এই গ্রামে তোমার থিকা আপন আমার আর কে আছে। তুমি হইলা আমার পোলার লাখান। কথা কওয়ার তরে তোমার অনুমতি ন্যাওনের কোনও প্রয়োজন নাই। ন্যাও। দুই টান দ্যাও। শিবের প্রসাদ। 

বর্ষা ছিল কাছাকাছি কোথাও। হয়তো দাওয়ায় বসা। সেখান থেকে দাপিয়ে উঠে এল। বলল—দেখ বাবা! ওই নচ্ছার নেশা তুমি করতাছ কর। হগ্গলডিরে দিয়ো না। 

পূর্ণ চক্রবর্তী তাড়াতাড়ি হাত গুটিয়ে নিলেন। ত্রাসে বললেন-না না। আমি দিতাছি না অলকরে। অলক এইসব খাইয়ো না বাবা। খুব খারাপ। 

বর্ষা মুখে আঁচল চাপা দিল। ফিরে যেতে যেতে বলল—অলকদা ভালা মানুষ। নেশাভাঙ করেন না। তোমার শিবের প্রসাদে শেষে গাঁজাইল্যা হইয়া উঠেন আর কী! 

পূর্ণ চক্রবর্তী নিজেই একবার দম দিয়ে বললেন—তা দ্যাখো দেখি, বকবকাইয়া আমার মৌতাতটাই দিল মাটি কইরা। তুমি কী কইতাছিলা কও। 

অলক বলল যদি আজ্ঞা করেন, বর্ষার ভার আমি নিতে চাই। 

পূর্ণ চক্রবর্তী কলকে নামিয়ে রাখলেন মাটিতে। গাঁজায় দম দিতে দিতে মেয়ের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়া চলে না। তিনি দেখলেন, মাথার ওপর নক্ষত্ররাও উৎসুক। এ তারা, ও তারা, সব তারায় বরষার বিবাহমঙ্গলকথা! পূর্ণ চক্রবর্তীর হৃদি চঞ্চল হল। বর্ষা, ওই মেয়ে, বড় দুর্ভাগিনী! তার কথা ত্রস্তে বলতে হয়। তার ভাবনা গভীরে ভাবতে হয়। আর পাঁচটা মেয়ের সঙ্গে তাকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। 

অলককে আভাস-ইঙ্গিত তিনি এর আগে অনেক দিয়েছেন। কিন্তু অলক নিজে খোলাখুলি তার বাসনা ব্যক্ত করল প্রথম। এই মুহূর্তকে গুরুত্ব দিতেই হয়। অতএব, নীরবতার পর তিনি বললেন—সে তো আমাগোরও ইচ্ছা। কিন্তু কথা হইল তোমার রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা কী! আশ্রয়ের ব্যবস্থা কী! 

অলক বলে চলল একই কথা, যা পূর্বেও বলেছে বহুবার—রোজগার বলতে ওই মন্দিরই মূল। বাড়ি তো বাপ-ঠাকুরদার আমলের। সকলের সমান ভাগ। 

—আর মন্দির? হ্যায়ও তো তাই। 

—অশোক মন্দিরের উপার্জনে আগ্রহী নয়। 

—দ্যাখো, তোমারে আগেও কইছি, আইজও কই। কণ্টক দূর কর। খোলাখুলিই কই, তোমার ওই পাগল দাদা ও তার স্ত্রীর একটা ব্যবস্থা না হইলে তোমার হাতে মাইয়া দিই কী বইলা! 

—কিন্তু তাদের কী করব! 

—হেইডা ভাবতে হইব! যদি আমার ওপর নির্ভর করইতে পার তাইলে আমি পথ ভাবুম।

—আমি তো আপনার ওপর নির্ভর করিই। সে কি আর বলতে হয়? 

—তাইলে, কোনও কিছু গোপন না কইরা, সত্যি কথাগুলান খুইলা কইতে হইব অলক ডাক্তার বা উকিলের কাছে যেমুন সইত্য গোপন করলে চলে না, তেমুনি জ্যোতিষ বা বা গুণিনের কাছেও কিছু লুকাইলে চলে না। তোমার হস্তরেখা আমি পড়ছি। অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হওনের কথা লিখা আছে। 

অলক চমকে উঠল। তার সমস্ত বিচার-বুদ্ধি একাগ্র করে সে অনুধাবন করতে চাইল পূৰ্ণ চক্রবর্তীর কথা। সত্যি কি জ্যোতিষবিদ্যা এত কথা বলে? একটু আগে বর্ষাও তাকে এমনই ইঙ্গিত দিয়েছে। অবৈধ সম্পর্কের ইঙ্গিত। হতে পারে, লোকে অলকের সঙ্গে এই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা দেখে ঈর্ষাবশত কিছু রটনা করতে চাইছে। কিছু না জেনেও এই রটনা করা যায়। সুন্দরী যৌবনবতী বর্ষার ওপর বহু লুব্ধ চোখ থাকাই স্বাভাবিক। তারা অলকের সঙ্গে চক্রবর্তীদের ঘনিষ্ঠতা ভাঙবার চেষ্টা করবেই। সে স্থির করল কোনওভাবেই এই সম্পর্কের কথা সে স্বীকার করবে না। পূর্ণ চক্রবর্তী জ্যোতিষের দোহাই দিয়ে তাকে চাপে ফেলতে চাইছেন। 

পূর্ণ চক্রবর্তী বলে চললেন—আমি কইতাছি না হেই সম্পর্ক তোমার আছেই। তবে হওয়ার ইঙ্গিত আছে। আমি চাই, যদি কিছু থাকে তবে তুমি তা স্বীকার করবা। কতদূর আগাইছ, অপরপক্ষ কোনও অনিষ্ট করতে পারে কি না। আমার তরফেও যা কওনের আছে, আমি কমু। 

অলক মাথা নাড়ে—নিশ্চয়ই। আমার না বলার কিছু নেই। 

পূর্ণ চক্রবর্তী ধূর্ত চোখে তাকালেন—এমন যেন চোখ থেকে রশ্মি বিচ্ছুরিত হল। বললেন— তোমার বউদি যে ভর পড়েন তা কি স্বাভাবিক? 

—হ্যাঁ? 

—যদি সাজানো হয়, তাইলে যে-কেউই ওইভাবে ভরে পড়তে পারে। আমাগো বর্ষা ও পারে। দ্যাশে বর্ষার ভর হইত। 

—সে কী! এখন হয় না? 

—তুমি তো জানই। ভর হওনের লিগা লোক চিনন জরুরি। নাড়িনক্ষত্র না জানলে ভরে কাম দেয় না! 

—তা ঠিক। 

—বুঝতেই পারতাছ ভরে পড়ার অভ্যাস অর আছে। তোমার অসুবিধা হইব না। শুধু পথের কাঁটা সরাইতে লাগব। 

পূর্ণ চক্রবর্তীর ভাবনার সঙ্গে খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে অলকের ভাবনা। সে পুলকিত হল। বেরুবে, নিশ্চয়ই বেরুবে কোনও পথ। সে পূর্ণ চক্রবর্তীর কথার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। পূর্ণ চক্রবর্তী বলেন—তার আগে কও, বউদির সঙ্গে তোমার, মানে কোনও দুর্বলতা, সে তো আসতেই পারে। ওইরকম পাগল দাদা। আর একত্র বসবাস। এতে আমি কোনও দোষ দেখি না। তবে বুঝতে হইব দুর্বলতা কতখানি গভীর। 

—বউদি আমাদের মায়ের মতো। 

—তা বেশ। তা বেশ। মায়ের প্রতি দুর্বলতাও কম হয় না। সেক্ষেত্রে আমারে বর্ষার বিষয়ে ভাবতে হইব। 

—আপনি ঠিক কী চাইছেন! 

—দেখ বাপা, পথের কাঁটা দূর করাইবার লিগা যে-কোনও উপায় অবলম্বনই বিধিসম্মত। ওই এক পাগল মানুষ, তার জীবনের কী মূইল্য আছে? আর সতী-সাধ্বী তোমার বউদি, তিনি কি আর তোমার দাদারে ছাইড়া পৃথিবীতে থাকব্যান? দেহত্যাগ করাই তাঁর পক্ষে বিধেয়। 

অলক স্তব্ধ হয়ে গেল। কী বলছে এই লোকটা! দু’টি মানুষকে একসঙ্গে লোপাট করে দেওয়া কি সম্ভব! পূর্ণ চক্রবর্তী বললেন—রাজি আছ? একমত? স্ত্রীধন পাইবার লিগা বহু কিছু করতে হয়। এ আর এমন কী! সব ভার আমার উপর ছাইড়া দ্যাও। তয় হ্যাঁ, ঘনিষ্ঠতা থাকলে তা বন্ধ করতে হইব। ধীরে ধীরে কর। সময় ন্যাও। 

অলকের করতল ঘেমে উঠল। ঠান্ডা হয়ে গেল পায়ের পাতা। তার একবার মনে হল উঠে পালায়। কিন্তু বর্ষা এসে দাঁড়াল নয়ন জুড়ে। আহা! বর্ষার মতো মেয়ের জন্য কী না করা যায়! সে খসখসে ভয়ার্ত গলায় বলল— আ- আমাকে কী করতে হবে! 

—পরে কইতাছি। তার আগে আমার কথা কইয়া লই। 

পূর্ণ চক্রবর্তী সময় নিতে থাকেন। পাড়াগাঁয়ের খরা কবলিত রাত্রি ক্রমশ শান্ত হয়ে আসে। অলক অপেক্ষা করে। অতঃপর শুনতে থাকে এক হৃদয় বিদীর্ণ করা কাহিনী। দিনের পর দিন ধরে যা ঘটছিল, মাসের পর মাস ধরে যে-যন্ত্রণা স্তূপীকৃত হয়েছিল, তা বলা হয়ে যায় মাত্র কয়েকটি বাক্যে। 

.

ন’বছর বয়স থেকে ভর পড়ত বর্ষার। পারিবারিক গুণিনবিদ্যা, জ্যোতিষচর্চা, ভেষজ চিকিৎসার সকল বিদ্যা মেয়ের মধ্যে দিয়ে প্রয়োগ করতেন পূর্ণ চক্রবর্তী। এই কল তাঁকে করতে হয়েছিল কারণ অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার ব্যাপকতার ফলে ভেষজ চিকিৎসায় আর কারও আস্থা ছিল না। মানুষ দৈবে যতখানি বিশ্বাস করে, প্রাচীন শাস্ত্রে ততখানি নয়। অতএব বর্ষাকে এক দৈবী নারী করে তোলা ছাড়া পূর্ণ চক্রবর্তী নিরুপায় হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর বুদ্ধিতে কাজ দিয়েছিল। আধাগ্রাম আধাশহর সেই জায়গায় দৈবী জোয়ারে অচল সংসারে লেগেছিল সতেজ হাওয়া। লক্ষ্মী এসেছিলেন সংসারে। দেখতে দেখতে দৈবী বালিকা হয়ে উঠেছিল ষোড়শী তরুণী। রূপ তার ফেটে পড়ল। অতএব তার দৈবক্ষমতার খ্যাতি যতদূর ছড়াল, রূপের খ্যাতিও গেল ততদূর। ভাল ঘরে সম্বন্ধ এল। প্রচুর ধনী একটি পরিবার। তারা যেচে এসে দৈবী নারীর মাধ্যমে ধনলক্ষ্মীকে বন্ধনে বাঁধতে চাইল। পূর্ণ চক্রবর্তীও ভাল ঘর-বর দেখে গৃহলক্ষ্মীকে পর করে দিলেন। অষ্টমঙ্গলা পেরুল না, মরচে-পড়া ব্লেডে বুঝি দাড়ি কাটতে গিয়ে গাল কেটেছিল, ধনুষ্টঙ্কার হয়ে ছেলেটি মারা গেল। বরষা দুর্লক্ষণা, এমনই বিশ্বাস করে বসল সেই পরিবারের লোক। বিবাহ করেই যে স্বামীকে খায়, সেই অতিপ্রাকৃতিক নারী কি ডাকিনীর সমগোত্রীয় নয়? কুলোয় প্রদীপ সাজিয়ে লক্ষ্মী বরণ করেছিল যারা, তারাই কুলোর বাতাস দিয়ে লক্ষ্মীকে দূর দূর করে দিল। পূর্ণ চক্রবর্তীকে একটা খবর পর্যন্ত দেয়নি তারা। একলা, শোকাতুর মেয়েটিকে, স্বামীর দাহ হওয়ার আগেই ঘর থেকে বার করে দিয়েছিল। কপালে সিঁদুর, হাতে শাঁখা নিয়ে, এক-গা গয়না পরে, একে-তাকে বলে মেয়ে কোনও মতে ফিরে এসেছিল বাপের কাছে। চারিদিকে খবর রটে গিয়েছিল। লোকে বলল—দৈবীর নোয়া ক্ষয় হয়ে যায়। 

বেশ কিছুদিন পর আবার রোজগার শুরু করল মেয়ে। কিন্তু এতদিন যা হয়নি, এবার তা শুরু হল। এলাকার কিছু বখাটে যুবক, সকলেই ভিন্নধর্মী, উত্ত্যক্ত করতে শুরু করল বর্ষাকে। পূর্ণ চক্রবর্তী ভয় পেলেন। বুঝতে পারছিলেন, ওদেশে মেয়ের সম্মান রক্ষা হবে না। গোপনে গোপনে জমি-বাড়ি বিক্রয় করতে শুরু করেছিলেন এ দেশে পালিয়ে আসবেন বলেন। প্রতিবেশী ছিলেন মৌলবি লিয়াকত হোসেন, তিনি সাহায্য করেছিলেন। রাত্রে তাঁরই বাড়িতে, তাঁর বিবির হেফাজতে ঘুমোতে যেত বর্ষা। কিন্তু এত করেও শেষ রক্ষা হল না। এক সন্ধ্যায় যুবকেরা বর্ষাকে তুলে নিয়ে গেল। হারুন নামে একজন ছিল দলের পাণ্ডা। সে বলল— হিন্দু ঘরে তোমার আর বিয়ে হবে না। এমনি এমনি শুকিয়ে মরবে কেন? ধর্ম নিয়ে আমায় বিয়ে করো, আমি তোমাকে বেগম বানিয়ে রাখব। 

রাজি ছিল বর্ষা। কারণ তার সামনে সারা জীবন অনিশ্চয়তা নিয়ে পড়ে ছিল। কারণ পাগল করে দেওয়া জীবনের মুকুলিত বসন্তকাল ধর্মাধর্ম জানে না, জানে প্রেমময় শরীর। আঃ! তার উন্মাদ চাহিদার কাছে অন্য কোনও সত্য প্রজ্জ্বলিত নয়। রাজি ছিল বর্ষা। হারুনের জন্য সে বরখাবিবি হতে রাজি ছিল। কিন্তু পূর্ণ চক্রবর্তী রাজি ছিলেন না। হিন্দু ব্রাহ্মণের বংশ, নিত্য শিবের সাধক তাঁরা, তাঁদের মেয়ে ধর্মত্যাগ করবে! মৌলবির সাহায্য নিয়ে পুলিশে গেলেন পূর্ণ চক্রবর্তী। পুলিশ বর্ষাকে উদ্ধার করে আনল। 

সাতদিন ছিল বর্ষা হারুনের সঙ্গে। এর মধ্যেই তার কৌমার্য গিয়েছিল স্বামীর কাছে। হারুনের সঙ্গেও সংসর্গ হয়ে থাকতে পারে তার, পূর্ণ চক্রবর্তী নিশ্চিত জানেন না। তবে বিবাহ হয়নি তাদের তখনও। কারণ হারুনের বাড়িতে এই বিয়ের পক্ষে মত ছিল না। 

বর্ষাকে নিয়ে এসে পূর্ণ চক্রবর্তী আর দেরি করেননি। সব গুটিয়ে দেশান্তরী হয়েছিলেন। আশ্চর্য মানুষের মন, যে-মেয়ে হারুনকে বিয়ে করতে রাজি ছিল, সে কিন্তু দেশ ছাড়তে আপত্তি করল না। মাকে সে বলেছিল—বিয়েতে রাজি না হলে ও যদি আমায় মেরে ফেলত! 

ধর্মত্যাগ করার চেয়ে মৃত্যু ভাল ছিল। পূর্ণ চক্রবর্তী তা-ই মনে করেছেন। কিন্তু শিবের সাধক তিনি, মেয়ের সকল গোপন করে পাত্রস্থ করার পক্ষপাতী নন। তাই জানালেন সব। 

.

দুই জানুতে মুখ গুঁজে বসে ছিল অলক। সে ভাবছিল, কী হত যদি হারুনের সঙ্গে বিয়ে হত বর্ষার। হয়তো বর্ষা, তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া পুরুষটিকেই ভালবেসেছিল। তার মন বিষণ্ণ হল। ভালবাসার প্রক্রিয়া তাকে অধিকার করেছে এখন। বর্ষার জন্য তার বুকের মধ্যে টাটিয়ে উঠছে বেদনা। এই ঘটনাগুলির কোনওটাই তাকে বিরত করতে পারবে না। সে তো ভেবেছিল আগেই, দুঃসংবাদগুলি অনুমান করেছিল। কিন্তু প্রতিকারও সে ভেবেছিল। ভ্রমর ফুলের মধু খেয়ে গেলেও সেই ফুলে পূজা হয়। বর্ষা অলকের কাছে প্রস্ফুটিত ফুলই একমাত্র। তাকে পাবার জন্য সে সব করতে পারে। সব। গভীর আগ্রহে পূর্ণ চক্রবর্তীর সঙ্গে কাঁটা সরাবার পরামর্শ করতে বসল সে। পূর্ণ চক্রবর্তী প্রায় ফিসফিস করে বললেন—চারদিকে ঘোষণা দ্যাও, সতী-মায়ের স্বপ্নাদেশ হইছে, দাদা মারা গ্যালে বউদিও দেহত্যাগ সংকল্প নিছেন। আর… 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *