2 of 3

রাজপাট – ৭১

৭১

ভাদ্র মাসে নন্দোৎসব 
কাদায় গড়াগড়ি। 
ওই সময় চলে আরও 
তাল কাড়াকাড়ি।।
আয় রে তরা আয় মোরা 
ভুঁই নিরাইতে যাই। 
ভুঁই মোগো মাতাপিতা 
ভুঁই মোরগো পুত। 
ভুঁইর দৌলতে মোরগো 
আশি কোঠা সুখ।।

.

কোনও ক্রমে পূজা সারল সে। কোনও ক্রমে বেরিয়ে এল বাইরে। পায়ের সামান্য ব্যথা পরোয়া করল না। কিছু স্বর্ণালংকার ঘিরে রচিত হয়েছে এক ঘোর। সেই ঘোরের মধ্যে সে উনুন ধরাতে লাগল। অন্ন-ব্যঞ্জন প্রস্তুত করতে লাগল। আর ভাবতে লাগল। 

কার এই অলংকার? এ কি সতী-মায়ের? তাঁর বয়স কত ছিল? তিনি কি ছিলেন এক বালিকা মাত্র! নাকি এ আর কারও! 

ভেবে কূল পেল না সে। তার কেবলই মনে হতে লাগল এ এক বালিকার। এক বালিকা-বধূর। এমনকী সবজি কুটতে কুটতে তার মনশ্চক্ষে ভেসে এল সকালে-বিকালে খেলতে আসা সেই মেয়েগুলি। শীর্ণা, মধুরা, কোমলা, লাবণ্যময়ী। সেইসব বালিকারা, ছোট ছোট মা-দুর্গা সব, তাদেরই একজন, ফ্রকের তলায় মুকুলিত মৃদু স্তনের আভাস, শিখারানি তার দেহ কল্পনা করল, সে দেহ তার চেনা। তার মুখ কল্পনা করল। সে-মুখও সে দেখে আসছে জন্মাবধি। সে সেই দেহে দিল লাল পাড় সাদা শাড়ি। সেই চেনা মুখ বালিকার মাথায় দিল শীলতার শীল ঘোমটা। তার হাতে একে একে পরাল রতনচূড়, মকরমুখী বালা, চুড়ি, আংটি পরাল কোমল চাঁপাকলি আঙুলে, তিন লহরী হার পরাল গলায়, পায়ে দিল সোনার নূপুর, কপালে দিল টিকলি! অতঃপর সেই বালিকার কালো কপালে সে এঁকে দিল সিঁদুরের টিপ। টিকলির তলায় অবস্থিত করল ডগডগে সিঁদুরের টিপ। এবার ঢাক-ঢোল বাজল, কাড়া-নাকাড়া বাজল। ওই বালিকা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল এক সম্ভাবনাময় অগ্নিকুণ্ডের দিকে। তাকে ঘিরে আগুন, তাকে ঘিরে লকলকে শিখা, জ্বলে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে, আগুন ছোবল মারছে লাবণ্য শরীরে। জিয়ন্ত শরীর হতে উঠে আসছে যে দগ্ধ চিৎকার—তা আর্ত, বিপন্ন, অসহায়— বুকের হাড় ফাটিয়ে দেয় সে চিৎকার, হৃদয় ফুটো করে দেয়, হা-হা কান্নায় ভরে দেয় প্রাণ। ওঃ! ওঃ! এ অসহ্য! এ অসহ্য! শিখারানি টের পায়, তার দেহে ফোসকা পড়ছে। পোড়া মাংসের গন্ধ উঠছে। নিজেরই কণ্ঠ হতে নির্গত যে-চিৎকার তা কোনও পশুর কণ্ঠস্বরে। তার আবেদন সে বোঝে না নিজেও। জীবনের কাছে এই আবেদন? বাঁচতে চাইবার অনর্থ প্রলাপ? নাকি এ আবেদন মৃত্যুর কাছে! জীবনের যন্ত্রণা দ্রুত দ্রুত দ্রুত নিশ্চিহ্ন করে দেবার আকুল উন্মাদ প্ৰাৰ্থনা। 

হায়! সে বোঝে না। পোড়া চোখে পোড়া এ পৃথিবী দেখে। পোড়া গন্ধ পায় তার খুলিগহ্বরা নাসায়। তার সারাটি জীবন ধরে উঠে আসা পোড়া গন্ধ এই। সে যে বালিকা বয়স হতেই পুড়ে আসছে কেবল। তার মসৃণ ত্বকের তলায় যে গলিত দগ্ধ মাংসের অবস্থান— সে খবর রাখবার জন্য একজনও নেই এ জগতে। এ গন্ধ তার একার। এই জ্বালা-যন্ত্রণা তার একার। সে কুটনো ফেলে বঁটির ওপরেই বসে হাঁটুতে রাখে মাথা আর কান্নায় আকুল হয়। ফুলে ফুলে কাঁদে সে। উপচে উপচে কাঁদে। তার চোখের জলের সঙ্গে মিশে যায় নাকের জল, তার মিলিত ধারার সঙ্গে মিশে যায় মুখের লালাস্রোত। গঙ্গা-যমুনা সরস্বতীর মিলিত ধারার মতো তা ঝরে পড়ে অবিরল। অনর্গল। তার কান্নার স্রোতে ভিজে উনুনের আঁচ নেমে আসে। ভাত ফুটতে ফুটতে, টগবগ-বগবগ কত কথা বলতে বলতে অবশেষে নীরব হয়ে যায়, কাটাকুটি হয়ে যাওয়া ব্যথিত সবজিও তাকে দেখে। সে কাঁদে। কেঁদে যায়। কান্নার জন্য সহস্র কারণ তাকে ঘিরে নাচে। কিংবা উলঙ্গ ভিখিরির মতো অসহ্য বাড়িয়ে দেয় হাত। বলে-কাঁদো আমার জন্য, কাঁদো আমার জন্য, আমার আমার আমার জন্য…আমি দুঃখী, আমি বঞ্চিতা, আমি সন্তানহীনা, আমি ভোগ্যা, আমি পাপী, আমি আমি আমি অসতী…বেবুশ্যে একজনা… 

আত্মকরুণায়, আত্মগ্লানিতে, আত্মঘৃণায় ভরে যায় শিখারানির মন। কান্নার মধ্যে দিয়েই সকল গ্লানির মোচন। সকল ঘৃণার সমাপন। সে টের পায়, তার দেহে, তার পাপীদেহে, ব্যথা দেহে, বড় মমতায়, বড় স্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কেউ। কে সে? কে? সে চোখ তোলে। ভেজা মুখ তুলে খোঁজে। কে গো? কে গো? কে? সে মাটি। সে শান্ত। সে স্নেহ। সে অপূর্ব ক্ষমা। বুঝি সে সতী-মা স্বয়ং। সে দিশেহারা চায়। আর দেখতে পায়, তার পাশে অমর ঘোষাল। তার স্বামী। এলোমেলো চুল। কোটর স্তিমিত চক্ষু। খোঁচা খোঁচা দাড়ি মুখময়। উম্মাদ নয় সে। বরং তাপ্তী নদীর মতো স্নেহময় হাত তিনি বুলিয়ে দিচ্ছেন শিখারানির পিঠে। তিনি বলছেন—কেঁদো আঁ! কেঁদো আঁ! 

হায়! ওষুধে ওষুধে জিভ জড়িয়ে গেছে মানুষটার। কবে জড়াল এমন! কবে! সে তো টের পায়নি। 

—কাঁদো কোঁ? অ্যাঁ অ্যাঁ? 

শিখারানি না বুঝে-শুনে, হঠাৎ, অচ্ছুৎ স্বামীর গায়ে ঢলে পড়ে। মুখ ঘষে তাঁর কাঁধে। মাথা ঠোকে। তার জানু বিপজ্জনকভাবে ঘিরে থাকে ধারালো বঁটির পাত। সে ডুকরোয়—কেন এমন হয়ে গেলে তুমি? আমার যে সব গেল গেল। সব গেল। 

সহসা সে সজল চোখ নিয়ে স্বামীর মুখোমুখি হয়। তাঁর কাঁধে নিজস্ব সবল শক্ত কর্মঠ আঙুল দাঁড়ার মতো আঁকড়ে স্বপ্নজড়ানো গলায় বলতে থাকে—চল আমরা পালিয়ে যাই। যাবে? হ্যাঁ গো! শুনছ তুমি? শুনছ? চল না, এখুনি, একবস্ত্রে আমরা পালিয়ে যাই। আলাদা ঘর বাঁধব। আমি পেয়েছি গো… পেয়েছি… 

আরও কিছু বলে সে। প্রলাপের মতো বলে। এক কথার সঙ্গে আর কথা জড়িয়ে যায়। বোঝা যায় না কিছু। আলাদা করা যায় না। এতকাল পরে উন্মাদ স্বামীর বুকে সে উগরে দেয় অপাচ্য, অর্ধপাচিত টুকরো টুকরো পাপ। অমর ঘোষাল তার জটাসুদ্ধু মাথা টেনে রাখেন নিজের দেহ সংলগ্ন করে। সে বলে—আমার পাপ গো! কত পাপ! নরকে ঠাঁই হবে না আমার। 

—আঁ আঁ! 

–ক্ষমা করো। ক্ষমা করো। 

—ভাত খাব। ভাত দাও। 

শিখারানি স্বামীর বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। তার সম্বিৎ ফিরে আসে। অমর ঘোষালের স্নেহপরশ মুহূর্তে অগ্রাহ্য করে সে। কার কাছে কী বলছে! এ কি মানুষ! উন্মাদ! পাগল! বিবশ! সে এই স্নেহময়, এই উগ্র! দিবারাত্র নিদ্রা যাচ্ছে। জাগলে উদাস বসে থাকছে দাওয়ায়। খাওয়া, ঘুম, প্রাকৃতিক কৃত্যাদি সমেত এ এক জীব মাত্র! শিখারানি আঁচলে চোখ মোছে। অমর ঘোষাল বলেন—যা-ও মু-কে চো-কে জল দাও। 

শিখারানি তাকায়। কোনও কথা না বলে মুখে-চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে আসে। দেখতে পায় উনুনের হাঁড়ি নামিয়ে অমর ঘোষাল নিভন্ত চুল্লিতে ছড়িয়ে দিচ্ছে গুল, ঘুঁটের টুকরো। শিখারানির ভয় করে। কে জানে, হঠাৎ কী হবে, জ্বলন্ত উনুন তুলে হয়তো চাপিয়ে দেবে শিখারানির মাথায়। সে আদেশের গলায় বলে—যাও। ঘরে যাও। আমি দেখছি। 

অমর ঘোষাল কীরকম আহত চোখে তাকান। ধীরে ধীরে উঠে চলে যান ঘরে। ওই চোখ শিখারানির স্মৃতিতে গাঢ় দাগ হয়ে বসে। স্বামীর জন্য সামান্য কষ্ট হয় তার। নতুন করে রান্নার আয়োজন করতে করতে সে ভাবে, ভাবতে বাধ্য হয়, গত দু’বছর বা ততোধিক, অমর ঘোষাল আর উন্মাদ হয়ে ওঠেননি তেমন! তা হলে কি মানুষটা ভাল হয়ে উঠছেন! তার মনে আশার আলো জ্বলে ওঠে। 

রাত্রে একা বিছানায় শুয়ে তার ঘুম এল না চোখে। আশার পর জেগে উঠছে চিরকল্যাণী আশা। মানুষটা ভাল হয়ে উঠছেন তা হলে! পাগল কি ভাল হয়! ঈশ্বরের কৃপা থাকলে হবে না কেন! সে তো মনে করতে পারে না কোনও দিন অমর ঘোষাল তার মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়েছেন। তাকে বুকে জড়িয়ে বলেছেন—কেঁদো না। 

হোক তা বদলে যাওয়া, অকালবৃদ্ধ মানুষটির কণ্ঠ হতে আসা, রোগজর্জর বিকৃতজিহ্বা মানুষটির উচ্চারণ, হোক তা, তবু তা-ই স্নেহে পূর্ণ। একটি মূক পশুও এই স্নেহ অনুভব করতে পারত। এককালে যে ছিল রোদনের কারক, নিষ্ঠুরের প্রতিমূর্তি, সে কী করে হয় এমন স্নেহপরায়ণ ঈশ্বরের কৃপা না থাকলে। এবং এবং তার ওই ঈশ্বরের অলংকার প্রাপ্তি! 

সে নিদ্রাহীন চোখে ভাবতে থাকে নিরন্তর। ভগবানের করুণা, নাকি সতী-মায়ের দয়া, তার সকল দুঃখ কি দুর করতে উদ্যত হলেন এত দিনে! না হলে, কোন যুগের কোন কালের পাথর-চাপা অলংকার তার হাতেই উঠে আসবে কেন! 

কী করা যায়! কী করা যায় এখন! এই গয়নার কথা কাক-পক্ষী টের পেলে তার সর্বনাশ হবে। প্রাণ থাকতে কারওকে বলবে না সে এর কথা। যদিও বলার জন্য তার হৃদয়ে পুলক উলুক ঝুলুক করে। আর বছর দুয়েক আগে হলেও সে অলককে বলে দিত সব। এখন আর বলা যায় না। কিন্তু কিন্তু যদি অলক কোনওদিন দেখে ফেলে! যদি তারও হাত লেগে পাথর সরে যায় কোনওদিন আর বেরিয়ে আসে স্বর্ণপ্রভা গোপন ওই? না, না। তা হতে পারে না। এ অলংকার তার জন্য। শত শত বৎসর ধরে সতী-মা পায়ের তলায় এই গয়না শিখারানির জন্যই আগলে রেখেছেন। তবু, তবু, তবু… 

তবু একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়। তার এই মন্দভাগ্যে ঈশ্বরের ওপর অন্ধ বিশ্বাস রাখে সে কী প্রকারে! সে কি তা হলে সরিয়ে ফেলবে গহনাগুলি? সরিয়ে কোথায় রাখবে! বালিশের খোলের মধ্যে? 

না। ওই পাগলের ভরসায় দু-চার টাকা রাখা যায়, কিন্তু গয়নার জন্য তাঁকে ভরসা করা যায় না। তা হলে? 

ভেবে কোনও পথ পায় না শিখারানি। কিন্তু এই অলংকার প্রাপ্তিতে সে নিজেকে পাপমুক্ত বলে মনে করে বসে। যেন-বা পূজার মধ্যে দিয়ে সে সকল কলুষ নাশ করে বসে আছে। তা হলে? 

তা হলে কি সে আবার তার স্বামীর সঙ্গে সংসার গড়ে তুলতে পারে না? তার সুস্থ হয়ে যাওয়া স্বামী, তার সুস্থ হয়ে যাওয়া মন, দুই সুস্থতা মিলে একটি সুন্দর গৃহ সজ্জিত হয়ে উঠতে পারে। যদি সে গহনাগুলি নেয় আর বিক্রি করে দেয়, তা হলে কত টাকা হতে পারে? প্রাচীন কালের ভারী স্বর্ণালংকার! কিন্তু শিখারানি সে, সোনার দাম জানে না। সে কেবল কল্পনা করে। কত পাওয়া যাবে? ত্রিশ হাজার? চল্লিশ হাজার? উঃ! সে কত টাকা! তাই দিয়ে সারা জীবন চলে যায়! 

কিন্তু কার কাছে যাবে সে গয়না নিয়ে? খুঁজতে খুঁজতে সে পেয়ে যায় নিত্য কুণ্ডুর মুখ। তা বেশ। সে গেল নিত্য কুণ্ডুর কাছে। গয়না বিক্রি করে টাকা নিয়ে এল। তারপর? পয়সার সন্ধানী, অর্থলোভী দুই শকুন অলক আর অশোক কি সব কেড়ে কুড়ে নেবে না? জানতে চাইবে না এত টাকা পেল কোথায়? সতী মায়ের গয়নার ভাগ তারাও তো দাবি করতে পারে! তা হলে কি পালিয়ে যাবে? স্বামীকে নিয়ে পালিয়ে যাবে সে? তখন আবেগের ঘোরে, ব্যথিত প্রলাপের মতো যা বলেছিল, তাই মনে ফিরে ফিরে আসে। স্বপ্নের সোনালি রেখা। এক নারী, সকল ছন্দপতন মুছে ফেলে, সতীত্বের সংজ্ঞা মেনে স্বামীকে নিয়ে দিনাতিপাত করে শান্তি পেতে চায়। কোথায় আছে সেই ছায়াময় শান্তি? কীভাবে তা পাওয়া যায়? নতুন দেশে নতুন গ্রামে ঘর বাঁধবে আবার? কে জানে, কে জানে, ঈশ্বরের কৃপায় একটি শিশুও পেয়ে যেতে পারে তারা! শিশু! শিশু! কচি নরম শিশু একটি! আঃ! 

স্বপ্নে বিভোর হয়ে যায় সে। আর তার হৃদয় উত্তাল হয়। উত্তাল উদ্বেল হয়। ঘোর আশঙ্কা এসে কাঁধ চেপে ধরে। অনাবৃষ্টির উত্তপ্ত হাওয়া তীব্রতর উত্তাপ নিয়ে ফিরে যায়। উঠে বসে সে। তার ইচ্ছে করে, আবার গিয়ে গয়নাগুলি দেখে একবার। নাড়াচাড়া করে। পায়ে পায়ে নেমে আসে সে। অলকের দরজার সামনে নিঃশব্দে দাঁড়ায়। তার ঘুমন্ত ভারী শ্বাসপতন শোনে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেরুতে পারে না। অস্থির মনে আবার ফিরে আসে ভয়। সরাতে হবে। সরাতেই হবে। কোথায়? কোথায়? অতঃপর অমর ঘোষালের বালিশটিই তার সম্বল হয়ে দাঁড়ায়। সে স্থির করে, একটি কাপড়ে গয়নাগুলি মুড়ে, বালিশের খোলে ঢুকিয়ে আবার খোলের মুখ সেলাই করে দেবে। তুলোর সঙ্গে মিশে থাকবে গয়না। অমর ঘোষাল গয়না পাহারা দেবার মতো নির্ভরযোগ্য নয়। কিন্তু তার বালিশের খোল ছিঁড়ে-খুঁড়ে দেখবে না কেউ। আপাতত, এই খোলই তার কাছে নিরাপদ। 

অবশেষে, একটি সিদ্ধান্ত নিতে পেরে, তার খুশি হৃদয়ে ঘুম নেমে আসে। ঘুমের মধ্যে সে দেখে একটি ছোট নীড়। শান্তিময় সেই গৃহের নিকোনো আঙিনায় খেলে বেড়াচ্ছে শিশু কালাচাঁদ। লাউলতা উঠেছে ঘরের চালে। ভারী ভারী ফলন্ত লাউ সবুজ আলোর মতো। সেই ঘর তার। সেই ঘরে কী এক আনন্দে অমর ঘোষাল তার শাড়ি তুলে দিচ্ছে। পায়ের পাতা থেকে গোছ, গোছ থেকে ঊরু অনাবৃত করে দিচ্ছে। সে লজ্জায় উঠে বসছে। ধড়ফড় করে উঠে বসছে। 

কাক ডাকছিল বাইরে। আকাশে ভোরের আভা লাগছিল। এ সময়ে কারও চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসে, কারও জাগে কামভাব। অলক ঘোষালেরও জেগেছিল কামভাব আর সে শিখারানির ঘরে এসে তার শাড়ি তুলে দিচ্ছিল। বাস্তবের এই সংঘটন স্বপ্নে রূপ নিচ্ছিল নিজের মতো করে। আর শিখারানি উঠে বসেছিল। এবং অলককে দেখে, নিজের উন্মুক্ত অনাবৃত নিম্নভাগ দেখে, বহুদিন পর সংকুচিত হল সে। ঘৃণাবোধ আর পাপপোধ, বিরক্তি আর ঈর্ষা- এতগুলি অনুভূতির ঠিক কোনটি বা কতগুলি তাকে অধিকার করে নিল সে জানে না নিজেও। সে শুধু এক ঝটকায় নামিয়ে দিল শাড়ি আর বলল— না। 

—না! না কেন?! 

অলক হাত বাড়াল ফের। ঘরের আঁধারে তার মুখ স্পষ্ট হল না। শুধু চোখ দুটি শ্বাপদের মতো জ্বলে উঠল। শিখারানি ওই চোখ দেখে ভীত হল। তবু, জোর টেনে, চাপা স্বরে বলল—যা হয়েছে, হয়েছে। আর না। 

অলক কঠিন হাতে শিখারানির পা চেপে ধরল। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল শিখারানি। অলক দাঁতে দাঁত দিয়ে বলল— ছেনালি কোরো না। দেরি করতে পারছি না আমি। 

পুরুষ-শক্তির জোর দ্বিগুণ হল কাম অভীপ্সায়। শিখারানির আবরণ রইল না। পদদ্বয়ের মধ্যবর্তী অবকাশ বিস্তারিত হল। অলকের শক্ত ও কর্কশ জানু পুনঃপুনঃ আঘাত করল বর্ণময় দ্বীপের ত্রিভুজ। সে আঘাতে স্বেদসিক্ত হয়ে গেলে, নারীদেহটি অভ্যন্তরে হয়ে উঠল কামবিরোধীভাবে শুষ্ক। শ্বাসবায়ু আটকে রইল তার কণ্ঠের কাছে। 

পুরুষ অধিকার নিতে চাইছে যে-দেহের, সে প্রতিবাদ চায় কিন্তু জানে না প্রতিবাদ। একা নারীর বিরুদ্ধপক্ষ একা পুরুষ, অতএব যুদ্ধ অসম হলেও চলতে পারে কিছুক্ষণ। কিন্তু এক যোদ্ধা সমর্পণ করেই বসল নিজেকে, শুধু প্রতিটি চাপ এবং কামুক শক্ত লিঙ্গের প্রতিটি উন্মত্ত প্রবেশের তলা থেকে সে বলতে থাকল —লজ্জা করে না? অন্য মেয়ে দেখে তপ্ত হয়ে ফেরো আর আমার কাছে এসে দেহ মেটাও। লজ্জা করে না। 

—চুপ শালি। খানকি। 

পুরুষটির মুখ থেকে লালা ঝরে পড়ে। নখ বসে যায় রমণীর দেহে। রমণী আর্তনাদ করে। এই আর্তনাদকে শীৎকার বলে ভাবতে পারে কেউ। সে বলে—মরবে, মরবে। 

—চুপ। মুখ ভেঙে দেব। 

—ধনেবংশে মরবে যদি আর কোথাও বিয়ে করো। 

—চুপ। শাপান্ত করলে জিভ টেনে ছিঁড়ে দেব।

—সতী-মায়ের সামান্য কৃপাও যদি থাকে আমার … 

—চুপ। 

–সব যাবে তোমার। সব… 

–শালি! হারামজাদি! খালে তোর বাঁশ না ঢোকালে আমার নাম অলক ঘোষাল না।

—মরবে তুমি। মরবে। মরবে। মরবে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *