2 of 3

রাজপাট – ৭০

৭০

ভাদ্দর মাসে সকলে যে 
তালের পিঠা খাইন। 
সেই মাসে ফতেমা গো 
স্বপনে দেখলাইন।।
ছাউয়াল ছাউয়াল বইলা মাগো 
স্বপনে জাগিল। 
কোথায় রইলে বুকের ছাওয়াল 
বুকে দুঃখ দিল ॥
হায় হায় রে—

.

শাঁখারি বিদায় নিলে ঘরে এল শিখারানি। সূর্য আর মধ্যগগনে নেই। উঠোনে ছায়া পড়েছে শেফালিগাছের, নিমগাছের। পরিষ্কার উঠোন। পরিষ্কার ঘরের দাওয়া। এই পরিচ্ছন্নতা সাক্ষী থাকে শিখারানির গৃহিণীপনার। সে তো ভাল বধূ হতেই এ বাড়িতে এসেছিল। ছদ্ম যোগিনী হতে নয়। বাসন মাজতে মাজতে নিজের হাতের দিকে চাইল সে। সত্যি, হাতদুটি যেন রূপ ঠিকরোচ্ছে। নকল শাঁখায় কি আর হাতের শোভা খোলে! এঁটো বাসনে ছাই ডলতে ডলতে গুনগুন করে গান ধরল সে ভাল করিয়া বাজান গো দোতারা… ভাল করিয়া… সখি ভাল করিয়া… 

ভুল সুরে ভুল কথায় ভরা গান। তবু গানে থাকে হৃদয়ের সুখ-দুঃখের প্রকাশ। সে টের পায়নি কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে অলক। বলছে—বাঃ! শাঁকচুন্নির হাতে সোনার কাঁকন মানিয়েছে ভাল। 

শিখারানির গায়ের রং কালো। গড়ন দোহারা। মুখে চোখে কম বয়সের কমনীয় শ্রী ছিল। লোকে দেখে বলত-বাঃ! বেশ। 

অলক যে-মন্তব্যটি করল, তা শিখারানি দেবরের পরিহাস ভেবে নিতে পারত। কিন্তু নিল না। সে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল—তোমার চোখের মণিতে এখন চাঁদ ঠেকেছে কিনা, তাই সকলকেই শাঁকচুন্নি লাগছে। দেখ, পিরিতের রসের হাঁড়ি ঠোকা লেগে না ভেঙে যায়। 

অলক বলল —নিজের ঠাঁই ঠিক নেই বলে কি পরের দিকে চোখ ঠারবে? 

বাসন ধোয়া হয়ে গিয়েছিল। পাঁজা করে হাতে তুলে শিখারানি বলল—কী বলতে চাও কি তুমি? তখন একবার অপমান করে কথা বলেছ, কিছু বলিনি। ফের আমাকে খুঁচিয়ো না বলে রাখছি। 

–না! খোঁচাবে না। গুচ্ছের পয়সা দিয়ে উনি শাঁখা পরলেন। আর পিরিতি আমার কী দেখো! তোমার তো সকল লোকের সঙ্গেই পিরিতি। শাঁখারি বুড়োর সঙ্গেও যে এঁটুলির মতো সেঁটে রইলে! বিনি পয়সায় শাঁখা দিল নাকি তোমায়! 

—ছি ছি ছি! 

দাওয়ার ওপর ঝনাত করে বাসন রাখল শিখারানি। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল— বাপের বয়সি লোকটাকে নিয়ে এমন ইঙ্গিত করো তুমি! না হোক এই ধাধা রোদ্দুরে ঝিমিয়ে মানুষটা একটু জিরোতে বসেছিল। তাকে নিয়ে তুমি এমন ময়লা ইঙ্গিত করো? নরকেও ঠাঁই হবে না তোমার। ছিঃ! কী কুৎসিত মন তোমার! কী নোংরা! 

দুটি মানুষের ঘনিষ্ঠতার শর্ত ছিল কী? দু’জনেই চাহিদা বুঝে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছিল। শিখারানির প্রয়োজন ছিল বাঁচার অবলম্বন। বুদ্ধির, সাহচর্যের অবলম্বন। অলকের প্রয়োজন ছিল ।দেহতৃপ্তি। দেহের দাবি শিখারানিরও ছিল না এমন নয়। এই জড়ানো, এই এমনধারা জাপটানো সম্পর্ক মানুষ গড়ে তোলে সহজেই এবং সম্পর্ক ব্যথিয়ে উঠলে জড়ো করে বিষ। যত সহজে জড়ায়, ততখানি অবলীলাক্রমে ছাড়ায় না। বিষ ঢেলে, বিষ ঢেলে, দাঁতে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ছাড়ে। যে-শত্রুতা গোড়া থেকে জমে ওঠে, তা ভয়ঙ্কর। কারণ শত্রুতা মানেই এক বিষাক্ত বপন। কিন্তু পূর্বের ঘনিষ্ঠতা শত্রুতায় পর্যবসিত হলে তার বিষ পৃথিবীর আর সব বিষের চেয়ে গাঢ়। 

শিখারানি ও অলক—তাদের লেগেছে স্বার্থের সংঘাত। তারা আর বিশ্বাস রাখছে না পরস্পরে। শিখারানি বলছে—কী নোংরা তুমি! বিষ বিষ বিষ তোমার মন। 

অলক ধুয়ো দেয়—হ্যাঁ, আমি বিষ, তুমি সাপ। সাপ সাপ সাপিনী তুমি। 

—নোংরা! কুৎসিত! 

—হ্যাঁ! আমি নোংরা! আমি কুৎসিত! তুমি সতী-সাবিত্রী! ঢঙ করে শাঁখা পরা হচ্ছে!

—বেশ করেছি পরেছি। আমার টাকায় পরেছি আমি। 

—তোমার টাকা! তোমার! 

অলক প্রায় নেচে উঠল। বিষ হাসি মুখে ছড়িয়ে বলল—তোমার টাকা! কী করে? কী করে? 

—হ্যাঁ। আমার টাকা। আমার রোজগার। যা করার সব আমি করি। 

–হুঁ! আমি না থাকলে কী করতে শুনি! সতী-মা না হয়ে বেবুশ্যে হতে হত! অবশ্য হতে আর বাকি কী রেখেছ! 

—কী কী কী বললে তুমি! আমি বেবুশ্যে! অত বড় কথা বলতে পারলে তুমি আমাকে অলক! 

দাওয়ার ওপর কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ল শিখারানি! চোখে আঁচল চাপা দিল। তার মাথায় আঘাত করতে লাগল একটিই শব্দ—বেবুশ্যে! বেবুশ্যে! 

সকল কঠিন কথা, কড়া কথা হারিয়ে গেল তার। সে কাঁদতে লাগল! অসহায় কান্না! কী করবে সে। তার যে আর মরণ ছাড়া গতি নেই। তাকে দেখে অলকের মন গলল না এতটুকু। সে আঘাত করার জন্যই যেন আঘাত করতে লাগল শিখারানিকে। বলল যাও! বাইরে বসে ন্যাকাকান্না কেঁদো না। ঘরে যাও। 

শিখারানি বলল—কথাটা ফিরিয়ে নাও অলক। এ আমার সহ্য হবে না। ফিরিয়ে নাও। 

কোনও কথা না বলে অলক ফিরে গেল ঘরে। শিখারানিও নিজের ঘরে গিয়ে দোর দিল। এই দোর দেওয়া না-দেওয়া সমান। তবু এতটুকু নিভৃতি তার প্রয়োজন ছিল খুব। উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদল সে অনেকক্ষণ। লোকে সংসারে অশান্তি হলে, স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হলে, অসুখ-বিসুখ করলে তার কাছে আসে প্রতিকারের আশায়। দিনের পর দিন ওই প্রতারণার সঙ্গে থাকতে থাকতে, অভিনয়ের মধ্যে থাকতে থাকতে, সে তার মধ্যেই ভরিয়েছে তার জীবন। আজ সকল প্রতারণার প্রত্যাঘাত এসেছে তার কাছে। প্রতিকারের আশায় সে কোথায় যাবে? 

কী বলবে? তার মতো বঞ্চিত কি এ-জগতের কোথাও কেউ আছে? স্বামী থেকেও নেই। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নেই। এতটুকু ভাত-কাপড়ের জন্য সে ছল করে, প্রতারণা করে। কোলে একটা এল না যে, ভালবাসার আধার পূর্ণ হবে। হায়! তাকে ভালবাসার কেউ নেই। এতটুকু ভালবাসা কি পেতে পারত না সে? জীবনের কত-শত বঞ্চনাই তো ভালবাসার স্পর্শে সার্থক হয়ে ওঠে! সে কেন এমন একটু ভালবাসাও পেল না? একটা সময় সে তো ছিল নিষ্পাপ। পেটের দায়ে যে-পথ ধরেছে, শরীরের দায়ে যে-স্খলন ঘটিয়েছে, কোথাও যাবার নেই বলেই যে অশোকের দাবিও মিটিয়েছে, তারই জন্য কি ভালবাসা তার জীবনের আঙিনাও স্পর্শ করল না? অলকের মোহকে সে প্রেম বলে ভুল করেছিল। অথচ, ভালবাসা কোনও শর্তসাপেক্ষ নয় এমনই সে জেনেছে। কোন পথে আসবে প্রেম এবং হৃদয়কে পৌঁছে দেবে কোথায়, তার জন্য কোনও মহত্ত্বের দাবি কোথাও নেই। ময়না বৈষ্ণবীকে তার মনে পড়ে এই অবেলায়। ভালবাসার মর্ম তারই কাছে সে বুঝেছিল। ময়না বৈষ্ণবী! কী এক আশ্চর্য দৃষ্টি তার ছিল, হৃদয়ের অন্তঃস্থল অবধি যেন দেখতে পেত। 

.

সে কখনও শিখারানির দাওয়ায় আপনা হতে বসেনি। শিখারানি শুনতে পায় তার শ্রীকণ্ঠ সুমধুরা। এক আশ্চর্য আকর্ষণ সে অনুভব করে। অলকা-তিলকা পরা চিরপথিক সেই বৈষ্ণবীকে তার মনে হয়, এ-মানুষকে ধরা-ছোঁয়া যায় না। সে যেন মাটির ওপরে থেকেও মাটির মানুষ নয়। একেবারে মালিন্যহীন প্রাণ দেখার অপার্থিব অনুভূতিই শিখারানির হয়েছে ময়না বৈষ্ণবীকে দেখলে। তাকে অস্বীকার করার চেষ্টাও সে কম করেনি। অমন রূপ যার, অমন ভরা বয়সের থৈ-থৈ শরীর, একলা, স্বাধীন, পথচারিণী নারী—এমন জীবনে স্বেচ্ছাচারের মালিন্য কোলে কোলে ফেরে। ময়না বৈষ্ণবীর প্রতিটি অঙ্গে চোখ বুলিয়ে শিখারানি সেই মালিন্য খোঁজার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ভেবে পায়নি, তবু কেন এমন নিষ্পাপ লাগে তাকে! সে বোঝেনি। বুঝত না। বুঝত না বলেই একদিন সে নিজে ময়না বৈষ্ণবীকে পথ হতে ডেকে আনে। বলে—এসো না! কত বাড়ি যাও, আমার ঘরে দুটি ধুলো পা রাখো না কেন বোষ্টুমি-দিদি? 

ময়না বৈষ্ণবী দাঁড়িয়েছিল। হেসেছিল মৃদু। স্থির চোখ ন্যস্ত করেছিল শিখারানির দিকে। সেই মৃদু হাসি ও দৃষ্টির সামনে শিখারানির গায়ে কাঁটা দেয় তখন। সে বলে—এসো না একবারটি। ঘরে বসো। দুটি কথা কও। একটু জল-বাতাসা খেয়ে কেত্তন শোনাও। 

এসেছিল ময়না বৈষ্ণবী। দাওয়ায় বসে বলেছিল—ঘরে যাবার দরকার কী? এই বেশ ভাল জায়গা। 

শিখারানি বলে তখন—যদিও তুমি বোষ্টুমি, তবু বলি, সতীর থানে এসেছ, একটু দর্শন করো। 

ময়না বৈষ্ণবী ঝোলা হতে পান বের করে মুখে পোরে। শিখারানিকেও সাথে একখানা। শিখারানি নেয়। বৈষ্ণবী বলে—তা বলছ যখন, যাব। ভগবতীর ইচ্ছা হয়েছে, দর্শন দেবেন। পূজা কি তুমিই করো? 

—হ্যাঁ। 

—শুনি নাকি ভর হয় তোমার। সতীমায়ের দর্শন পাও। 

—হ্যাঁ দিদি। সবই তাঁর ইচ্ছা! 

এই চতুর ও বিচক্ষণ জবাব ময়না বৈষ্ণবী শুনেছিল ও পান চিবোতে চিবোতে শিখারানির জটা হতে পা পর্যন্ত দৃষ্টি বুলিয়ে বলেছিল—এই বেশ। সেবার পথ কী হবে, কে বলতে পারে? প্রেম, ভক্তি, ভালবাসা সকলমার্গগামী। অমৃতেও তার আগমন, গরলেও। সৎ হৃদয়ে তার অধিষ্ঠান, অসতেও। প্রেম, ভক্তি, ভালবাসা সব এক। একই চিৎশক্তির বিবিধ রূপ। বিবিধ প্রকাশ। দস্যু রত্নাকর মরা জপতে জপতে রাম বলেছিল। 

শিখারানি থমকে গিয়েছিল শুনে। নিহিত অর্থটি বুঝতে বেগ পেতে হয়েছিল তাকে। তখন ময়না বৈষ্ণবী তার খঞ্জনি পাশে গুছিয়ে রেখে বলে—গান তো শুনেছ। 

—হ্যাঁ গো! বড় মিঠে সুরেলা তোমার গলা। 

—আজ একটি গল্প শোনো। 

হাসিমুখে সে বর্ণন করেছিল সেই অদ্ভুত গল্প, যা তার বোধকে প্রশস্ত করেছিল, কামনাকে পরিশীলিত করেছিল, প্রায় একরকম দীক্ষামন্ত্রের মতো সেই গল্প প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে তার বুকে জেগে আছে অদ্যাবধি। 

.

রাজবাড়িতে কাজ করে মেথরের বউ মেথরানি। একদিন তার শরীরটা খারাপ করেছে। তাই মেথর চলল রাজবাড়ির ময়লা সাফ করতে। সান্ত্রী তাকে নিয়ে চলল খিড়কি দুয়ারে। ওদিকেই রাজা-রানির খাটা পায়খানা। পায়খানার তল থেকে মেথর সরিয়ে নেবে মলভর্তি চাড়ি। 

এ কাজ সারতে সে পায়খানার তলায় গেল। রানি তখন মলত্যাগ করতে বসেছেন। মেথর খানিক মুখ তুলতেই দেখতে পেল মসৃণ, ফর্সা, কোমল উরু, রেশমি যোনি, দুটি অর্ধেক চাঁদের মতো পশ্চাদ্দেশ। এক ঝলকে যতটুকু দেখা সম্ভব, দেখে, রানিকে পাবার জন্য কামনায় অধীর হল সে। আহা! ওই অংশটুকুই যদি জুঁইফুলের পাপড়ির মতো কোমল ও সুন্দর, তা হলে বাকি অংশের রূপ তো অসহ্য ঠেকবে! 

সে কাজ করল, পথ চলল, ঘরে ফিরল —সারাক্ষণ তার মনে জেগে রইল রানির শরীরের ওই অংশটুকু। সে খেতে পারে না, ঘুমোতে পারে না, কী এক অস্থির যন্ত্রণা তাকে তাড়িয়ে ফেরে। মেথরানি শুধোয়—কী হয়েছে তোমার? অসুখ-বিসুখ করে তো বদ্যির কাছে যাও। 

মেথর বলে—বদ্যির সাধ্য কী, এ অসুখ সারায়! 

–কী অসুখ তোমার, আমাকে তো বলো! 

–রানির শরীরের একটুখানি আমি দেখে ফেলেছি বউ। দেখা ইস্তক পাগল হয়ে গেছি। রানিকে আমার চাই। 

—হে ভগবান! তুমি কি সত্যি পাগল হলে? তুমি রানিকে পেতে চাও? রানিকে? তুমি? একজন সামান্য মেথর? অন্য কোনও মেয়ে হলে নয় ভাবা যেত। কিন্তু স্বয়ং রানি! মরণ ঘনিয়েছে তোমার। প্রাণের মায়া থাকে তো ওই মতলব ছাড়ো! 

বউ কত বোঝায়। স্বামী বউয়ের কথার যুক্তি স্বীকার করে। কিন্তু দুর্ভাগা মেথর, রানির শরীরের অংশটুকু ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না। তার মন গুড়ের মাছির মতো কামনার ফাঁদে পড়েছে। ক্রমে মেথর ক্ষ্যাপা-ক্ষ্যাপা হয়ে উঠল। খায় না, নায় না, ঘুমোয় না, কথা কয় না। একদিন সে ঘর ছেড়ে গেল। এখন সে পথের মানুষ। এখনও নিরন্তর রানির উরু ও যোনিদেশের কথা ভাবছে। একদিন এক বটগাছের তলায় বসে আছে, মনে সেই ভাবনা, কয়েকজন গ্রামবাসী এল তার কাছে। 

এতদিনে মেথরের চুল-দাড়ি বেড়ে উঠেছে। একই ভাবনা ভাবতে ভাবতে দৃষ্টি যেন কোন সুদূরে, কোন ক্রান্তদর্শনে নিবদ্ধ রয়েছে। খায় না, ঘুমোয় না, কথা কয় না। দেহ স্থির পাষাণবৎ। শোকের চোখে মেথর ধ্যানমগ্ন মুনিঋষির মতোই প্রতিভাত হল। তারা ফুল দিল, অর্ঘ্য দিল, ভোগ দিল। মেথর ফিরেও চাইল না। এমন অপার ঔদাসীন্য প্রত্যক্ষ করে লোকের আর সন্দেহ রইল না যে, ইনি একজন পবিত্র মহামানব। তাকে ঘিরে ভক্তের ভিড় জমল। দিকে দিকে তার কথা প্রচারিত হল। কিন্তু সে নির্লিপ্ত, উদাসী। 

এক মাসে তার খ্যাতি সারা দেশব্যাপী রটে গেল। রানিও তার কথা শুনলেন। পুণ্যাত্মাকে দর্শন করতে চাইলেন। দাস-দাসি, পাদ্য-অর্ঘ্য, ভোগ-প্রদীপ নিয়ে তিনি এসে দাঁড়ালেন মেথরের সামনে। মাটিতে লুটিয়ে, মেথরের পা ছুঁয়ে, সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে নৈবেদ্য রাখলেন সামনে। মেথর রানির দিকে ফিরেও তাকাল না। জানতেও চাইল না এই অপরূপা, অভিজাত, ভক্তিমতী রমণীটি কে। রানির উপস্থিতি তাকে স্পর্শও করল না। 

মেথরের কামনা ছিল উদগ্র। তা তাকে নিয়ে গেল সেই অবস্থায়, যেখানে সে সম্পূর্ণ নিষ্কাম। 

.

চরম বেদনা, চরম অপমানের মধ্যে, আজও এই কাহিনি মনে পড়ে শরীর কণ্টকিত হল শিখারানির। দু’চোখ ভরে জল। একবার মনে হল, ময়না বৈষ্ণবী জীবিত থাকলে সে সংসার ত্যাগ করে বৈষ্ণবীর সঙ্গে নিত। হায়, সে নেই। শিখারানির পোড়াকপাল। তার জন্য কেউ নেই। সে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ, বঞ্চিত, ব্যর্থ। কই, সে তো মেথরের মতো নিষ্কাম হতে পারল না। সেও ভালবাসে তো, ভালবাসে, তীব্র ভালবাসে। অলক অলক অলক, কেন তুমি আমাকে কষ্ট দাও? কেন অপমান করো? কেন আমাকে ছেড়ে অন্য মেয়ের কাছে যাবে তুমি? আমি তো তোমাকে আমার সর্বস্ব দিয়েছিলাম…সে আত্মগত বিলাপ করে। নদীর পাড় ভাঙে আর শিখারানির চোখ- নাক উপচে নামে বুকভাঙা কান্না। 

বহুক্ষণ কেঁদে খানিক হালকা হল সে। বিকেল গড়িয়ে গেছে। এখন আরও একবার স্নান করে ঠাকুরঘরে যাবার পালা। সে উঠল। মনে মনে বলল–ঠাকুর, না হয় ছল করি, মিথ্যাচার করি, পাপেরও সীমা নেই আমার। কিন্তু এই যে দু’বেলা তোমার পূজা করি, তাতে কি দোষ কাটে না? 

স্নান সেরে এসে ধোয়া শাড়ি পরল সে। তার মনে পড়ল, এই সেদিনও ভেজা কাপড় ছাড়ার সময়টায় ওত পেতে থাকত অলক। এই বিশেষ দৃশ্যের প্রতি, মুহূর্তর প্রতি তার আছে বিশেষ পক্ষপাত, বৃহৎ দুর্বলতা। ইদানীং সে আর আগ্রহ প্রকাশ করে না। নানা ঘটনাক্রমের মধ্যে দিয়েই মানুষ নিজের গুরুত্ব উপলব্ধি করে, গুরুত্বহীনতাও। মুখে বলে যা বোঝানো যায় না, তার অনেক বেশি ব্যঞ্জনা নিয়ে আসে ঘটনার অভিব্যক্তি। অতএব, এমনি করেই শিখারানি বুঝে যাচ্ছে তার গুরুত্ব কমছে। 

ঘরে বৈদ্যুতিক আলো নেই আজও। রাস্তার খুঁটি থেকে তার টেনে সতী-মায়ের মন্দিরে আলো জ্বেলেছে অলক। কিন্তু বাকি ঘরগুলোয় পারেনি। অশোক প্রায়ই বিদ্যুৎ সংযোগ নেবার কথা বলে, কিন্তু হয়ে ওঠে না। এভাবেই চলে যাচ্ছে দিনের পর দিন। 

টিমটিমে লণ্ঠন জ্বেলে একটি ছোট হাত-আয়নার কাছে দাঁড়াল শিখারানি। রোজই দাঁড়ায়। সিঁদুর দেয় কপালে, সিঁথিতে। দীর্ঘ অভ্যাসে শুধু সিঁথি আর কপালটুকুই দেখা হয় তখন। আর কোনও দিকে চোখ যায় না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখার বাসনা উড়ে গেছে কবেই। আজ এতদিন পর, শাঁকচুন্নি বেবুশ্যে ইত্যাকার অভিধাগুলি পাবার পর, শিখারানি লণ্ঠন এনে রাখল দেওয়ালের তাকে। হাতে আয়না নিল। আলোর কাছে মুখ এনে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল নিজেকে। তার মনে হল, সত্যিই সে এক শাঁকচুন্নি। মাথায় জটা। রুক্ষ চুল। মুখের কোমল লাবণ্য চলে গিয়ে ঘাঁটি গেড়েছে ধূর্ত প্রৌঢ়ত্ব। গালের হাড়ের ওপর, চোখের কোলে পরতে পরতে অন্ধকার। যত মিথ্যা সে বলেছে, যত তঞ্চকতা সে করেছে, যত পাকা প্রতারণা-সব এক-একবার করে কালি লেপে দিয়ে গেছে মুখে। 

শাস্ত হয়ে গেল সে! অলককে এতটুকু দোষ দিতে পারল না তাকে শাঁকচুন্নি বলার জন্য। সে নিজেই বিশ্বাস করে বসল, যাকে দেখেছে আয়নায়, শিখারানির আত্মা ঘিরে যে দেহের অস্তিত্ব, সে শিখারানি নয়। পূর্বের শিখারানি নয়। প্রেত। শিখারানির প্রেতমাত্র। সেই প্রেতের বুকের মধ্যে জ্বলে রইল ঈর্ষার হলুদ শিখা। শিখারানির প্রতিমূর্তি হয়ে জ্বলে রইল তা। 

এমনই বিচিত্র এ জগৎ, এমনই অত্যাশ্চর্য এ জীবনের লীলা—এক পুরুষ অলক—যার ধন নেই, মান নেই, রূপ নেই মনোহর, ধূর্ততায় এক কাহন সে, শিক্ষা নেই এমন যে আপন পিতৃনাম শুদ্ধ বানানে লিখতে পারে, তবু তাকে ঘিরে গড়ে ওঠে দুই নারীর অধিকারের লড়াই। ভালবাসা-বাসির সঙ্গে অধিকার-অনধিকারের বোধে থাকছে না কোনও প্রত্যক্ষ যোগ। অপছন্দের মানুষটির প্রতিও গড়ে উঠতে পারে অধিকার দখলের ইচ্ছা। এ আমার এই উপলব্ধিটুকুই সেখানে যথেষ্ট, এ কীরকমভাবে আমার, তা বিবেচ্য নয়। 

শিখারানির প্রতি অলকের এই বোধ জন্মাতে পারত, যদি শিখারানিকে অধিকার করতে আসত কোনও বাইরের পুরুষ। ভর-পড়া শিখারানির ভড়ং-সম্বলিত উপার্জনসমেত যদি সেই পুরুষ শিখারানিকে আত্মসাৎ করতে চাইত। হয়তো, অলক ঘোষালের মধ্যে তখন-শিখারানি আমাদের কুলবধু—এই বোধ জাগলেও জাগতে পারত, অথবা, বিবিধ রকমে হতে পারত এই অধিকারের প্রকাশ, যেমন, এই নারীকে আমি ভোগ করি, আমার ভোগ্যা এ, অপরের ভোগ্যা এ হয় কী প্রকারে! 

অশোকের ক্ষেত্রে এমন মনোভাব প্রকাশ পায়নি, তারও আছে নানাবিধ কারণ। বড়ভাই অমর ঘোষাল দ্বারা উপেক্ষিত অবহেলিত নারীসম্পদটির প্রতি মাত্র এক ভাইয়ের অধিকার জন্মায় না কোনও নিয়মেই। এবং এই সম্ভাবনা ছিলই, অলক এবং শিখারানির অবৈধলিপ্ত সংসর্গ অশোক জানতেই পারে ও তদ্দ্বারা কিছু প্রতিবাদ রচে, কিংবা ভবিষ্যতে আরও কোনও বিপর্যয় করে আহ্বান, যেমন, অলকের অনাগত বৈধ স্ত্রীর কানে লাগানি— ভাঙানির সম্ভাবনাকে ফেলে দেওয়া যায় না মোটে, অতএব, সে বরং ভাল যে মাঝে মাঝে অশোক অলকপথগামী হল আর দুই ভাই পরস্পরের মুখ শোঁকাশুঁকি করে লাঙ্গুল ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতে পারল শিখারানি বৃত্তান্ত, যা হতে তারা কেউ-ই অব্যাহতি পায় না। 

এমত ভোগ্যা শিখারানি, বুঝি-বা বেবুশ্যে তাকে বলা যায়, কারণ পুরুষ নারীকে একা ভোগ করতে চায় এবং বহুভোগ্যা নারীকে দেয় তকমা। যারা ভোগ করে, শুদ্ধতার বিচারও করে তারাই। আসলে সকলই অধিকারের ছক, সকলই ভোগের ইতিবৃত্ত। অতএব এমত ভোগ্যা শিখারানি একা একা গেল সতী-মায়ের মন্দিরে আর সারতে লাগল সান্ধ্যকৃত্য। ঘরখানি পরিষ্কার রাখতে হয়। সাজিয়ে তুলতে হয় ঠাকুরদেবতার ছবি চন্দনে সিন্দুরে। ভক্তির উপকরণে অভাব রচিত না হয় যাতে তারই আয়োজন। কিছুকাল পূর্বেও অলকের নিত্যসাহচর্য ছিল এই আয়োজনে। ইদানীং একা সে প্রায়শই। সে চুলের জটাভারে গুঁজে দিল একটি শুকনো জবা ফুল আর কাজ করতে লাগল। 

কখনও, মানুষের মন হয়ে থাকে এমনই ভারগ্রস্ত যে, ভারী মন অস্থির নয়, বরং শান্ত সমাহিত। সেই সমাহিত মনেই আসে বিনষ্টিকামনা, আসে শাপমন্যি। শিখারানিও করছিল তেমনই কামনা কিছু। ভাবনার মতোই, আত্মকথনের মতোই বলে চলেছিল সে—না হয় অভিনয়ই করি, কিন্তু ডাকি তো ঠাকুর তোমাকে! সতী-মা যদি সত্যি হও তুমি, তবে মিথ্যার ভিতর দিয়েই কিছু শক্তি আমি পেয়েছি নিশ্চিতই।… 

নিশ্চিতই। কারণ কারও রোগ তো সারে। তার মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিয়ে দেওয়া নিমের কাঠি রোগহরণ হয়ে ওঠে তো! এই যে বাঁধন দিয়ে এল সে পোদ্দারবাড়ি, তারপর হতে আজও পর্যন্ত সেই অতৃপ্ত আত্মা, সেই হতভাগী প্রেত দেখা তো দেয়নি আর। এ সম্ভব হয় কী প্রকারে! অতএব, কিছু শক্তি সে আত্মস্থ করেছে এমনই বিশ্বাসের ইচ্ছা, তাকে নির্ভরতা দেয় কিছু। সে বলে—সুখী হবে না তুমি ঠাকুরপো। অলক ঘোষাল তুমি মা-সতীর কৃপা পাবে না। ধনে-বংশে সর্বনাশ হোক তোমার যদি ওকে বিবাহ করো। ধনে-বংশে সর্বনাশ হোক হোক হোক! 

মেঝেয় জল পড়েছিল, কেননা ধোয়া-মোছার কাজে লাগে জল, চন্দনের ঘন রস তৈরি করতে লাগে জল এবং অসাবধানে সেই জল মেঝেয় পড়ে পিছল সে-ভূমিতে শ্রীমতী সেবিকা শিখারানির পা হড়কে গেল আর সে শরীরের ভারসাম্য রাখতে পারল না, ফলে পড়ে যেতে যেতে সে শূন্য আঁকড়াতে চাইল এবং পড়তে পড়তে সমস্ত শরীর তার অসহায় মেঝেতে শয়ান, পা গিয়ে লাগল সজোরে ওই সতী-পদচ্ছাপ লাগা পাথরে। পাথর সরে গেল। 

পা ব্যথায় ঝনঝন করছিল। সে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠতে উঠতে বলল—উঃ! মাগো!

এক ঝলকের জন্য তার মনে হল, সে অপরের অমঙ্গল কামনা করছিল বলেই কি পড়ল এমন। 

উঠল সে। লেগেছে বেশ। কনুই ছড়ে গেছে। কোমরে আঘাত লেগেছে। কপালের কোণ ফুলে গেছে। মাথা বেঁচে গেছে তবু। আর পা। পায়ে লেগেছে বড়। যন্ত্রণাকাতর সে। উঠে বসে পায়ে হাত বুলোতে বুলোতে দেখছে হাড় ভেঙে গেল কি না। দেখছে ফুলে গেল কি না। দাঁড়াল সে। কাঁপছে শরীর। কেন-না পড়ে যাওয়ার এই অতর্কিত প্রক্রিয়া তার স্নায়ুকে দুর্বল করেছে। সে পা ফেলছে। ব্যথা পা-কে ফেলছে ধীরে। যত্নে। ভালবেসে। আর চোখে পড়ে যাচ্ছে এক আশ্চর্য দৃশ্য। এ কী! এ এ এ কী! নড়ে গেছে! সতীর পাথর নড়ে গেছে! এ পাথর অনড় এমনই তো শুনেছিল সে। তারাও দিনের পর দিন, স্নান করিয়েছে, ধুয়েছে মুছেছে কতবার, নড়েনি তো, সরেনি একচুলও, আর আজ, তার পদাঘাতে, অনিচ্ছার পদাঘাতে সতীর পদচ্ছাপ সরে গেল! কতদিন পর! কতদিন কতদিন কতদিন পর! আর বেরুল এ কী! এ কী! আলোর বিভার মতো লাগে! 

আধ হাত গভীরতা গর্তের। ছ’আঙুল পরিমাণ চওড়া। তার মধ্যে হলদে আলোর উৎস যেন বিদ্যুতের খুঁটি হতে টানা তারের প্রান্তে ঝোলানো মিটমিটে আলোটুকুর প্রতিফলনে জেগে ওঠা বিভা! 

শিখারানি, পায়ের ব্যথা ভুলে, উবু হয়ে বসল। কোমরের ব্যথা ভুলে নিচু হল, কপালের আঘাতে ভুলে বাড়িয়ে দিল হাত। এ কী! এ কী! আধহাত গভীর গর্ত জুড়ে রুপোর ঘট একখানি। গায়ে মাটি জমে আছে। শুধু জেগে আছে তার বাঁকা গলা। ভেতরে তার সোনার আভা উঁকি দেয়। শিখারানি দু’ আঙুলে তুলে নিল আভাকিরণের বস্তু। একখানি সোনার বিছেহার। রাখল সে। তার শরীর কাঁপছে যেমন ম্যালেরিয়া জ্বরের আগে কাঁপে রোগী। সে কাঁপা হাত মুঠো করে ঢোকাল আবার। একখানি রতনচূড়। আরও একখানি। মকরমুখী বালা। কানপাশা। চূড়ো-বাঁধা আংটি। তিন লহরী হার। টিকলি। সোনার নূপুর। দশ গাছা চুড়ি। চুড়িগুলি ছোট, যেন বালিকার। আংটি ছোট। যেন চাঁপাকলি আঙুলের। রতনচূড় ভারী, তবু কোনও কোমলাঙ্গী ক্ষীণতনু মৃদুহস্তাই তা পরিধান করতে পারে। 

শিখারানি দিশাহারা। গলা শুকিয়ে কাঠ। কম্পিত হাতে সে দেখল নকশার খাঁজে খাঁজে জমে থাকা ধুলো, মাটি। তবু স্বর্ণপ্রভা কী মোহময়! 

তখন পথে কার স্বর শোনা যায়! কে যেন এগিয়ে আসে! শিখারানি সন্ত্রস্ত হল। দ্রুত হাতে গহনাগুলি পূর্ববৎ ফেলে দিল ঘটে। দু’হাতে টেনে দিল সতীর পদচ্ছাপ দেওয়া পাথর। ভাল করে দেখল, যেরকম ছিল, সেরকমই আছে তো! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *