৬৯
ভাদো মাসে শাছরো মতে
বিয়াশাদি মানা।
কিওর লাগি মানা তা
কেউঅই জানে না।।
বিয়াত সামান্যি কথা
দেপ্তাপূজা সইত।
এ মাসে করইন্না কাম
হক্কোলি রইত।।
দেশজুড়ি হক্কোল মানে
তুমি না মানবায় কিলা।
আচার-বিচার চল আছে
যে দেশো যিলা।।
.
পোদ্দার-গৃহিণীর মতো শাঁসাল খদ্দের পেয়েছে শিখারানি। অনাবৃষ্টিতে চাষ-বাসের অনিশ্চয়তায় সতীর থানে পূজাও পড়ছে ভাল। কিন্তু শিখারানির মনে সকল সুখ গিয়েছে। সেই যখন তার স্বামী অমর ঘোষালের বাতিলযোগ এসেছিল, এ যেন তখনকার মতো হাহাকার। তখনকার মতো একেলাপন।
স্বামী যার থেকেও নেই, তার মতো দুখী মেয়ে পৃথিবীতে আর কেউ হয় না। দুখীর দুখী অনন্ত দুখী সে। ভগবান তাকে সন্তানও দেননি। দেননি ধনধান্যের সুখ। লোক ঠকিয়ে চলে তার। হাজার দুর্বলতাকে ব্যবহার করে হাজার মিথ্যের বুনটে তার জীবনধারণ। কিন্তু দুখীকেও তো কিছু আঁকড়ে বাঁচতে হয়। খুঁজে নিতে হয় জীবনের অবলম্বন! অলক হয়ে উঠেছে শিখারানির সেই অবলম্বন। তার উন্মাদ যৌনতা, পাশবিক যৌনতা সত্ত্বেও অলকই তার সঙ্গী। তার দুঃখের সঙ্গী। পূজার সঙ্গী। তার পরামর্শদাতা বন্ধু। এবং অলক তার পাপের সঙ্গী। পুণ্যের সঙ্গীকে অবহেলায় ছাড়া যায়। কিন্তু পাপের সঙ্গী ঘনিষ্ঠতম। তাকে অধিকার করা যায়। তার সঙ্গে মারামারি খুনোখুনি করা যায়। কিন্তু ছাড়া যায় না। অলক এবং শিখারানি এমনই চির-আলিঙ্গনে পরস্পরের সঙ্গে আছে। পরস্পরকে অধিকার করে আছে। কিন্তু ঈশানের মেঘের মতো ধীরে ধীরে জুটে যাচ্ছে আকাশের ভাগীদার।
টের পাচ্ছে শিখারানি, ইদানীং অলক সরে যাচ্ছে। শরীরে সে ঝাঁপ দেয়। চাকুম চুকুম করে চেটে-পুটে খায় তাকে। কিন্তু দীর্ঘ সহবাসে পরস্পর চেনা হয়ে গেলে নর-নারী শুধু অভ্যাসের তাড়নাটুকু বুঝতে পারে। ওইটুকু ছাড়া অলক শিখারানিকে নিয়ে চিন্তিত হয় না। আগে সারাক্ষণ সে শিখারানির গায়ে গায়ে ঘুরঘুর করত। এখন তেমন কাছ ঘেঁষে না। মুখ গোঁজ করে পূজার কাজ করে। গম্ভীর অন্যমনস্ক থাকে। অনেক সময় বেরিয়ে যায়। পূজার কাজের বেলা বয়ে যায়, অলক ফেরে না। শিখারানি একা-একা কাজ সারে।
টাকা-পয়সা যা আয় হয়, সব অলকের হেপাজতেই থাকে বরাবর। আগে শিখারানি কিছু চাইলে সঙ্গে সঙ্গে এনে হাজির করত। অনেক সময় না চাইতেই কিনে আনত এটা-ওটা। এখন কিছু চাইলেই হাজার কৈফিয়ত। এই তো এনে দিলাম। এত তাড়াতাড়ি ফুরোয় কেন! পয়সা কি শস্তা?
‘আমায় দেখিয়ে রোজগার করবি, আবার আমাকেই হিসেব দেখাবি?’ শিখারানি মনে মনে ফোসে। ইদানীং অলকের চোখ এড়িয়ে টাকাটা-সিকিটা সরাচ্ছে শিখারানি। মানুষের মন না মতি। নিজের একটা সংস্থান থাকা ভাল। কিন্তু লুকোয় কোথায়? স্বামীর ঘরে গিয়ে বলে— সরো তো একটু।
অমর ঘোষাল ঘোলাটে চোখ মেলে তাকান। ঘষে ঘষে শরীরটা ঠেলে দেন দেওয়ালের দিকে। তাঁর শিয়রের বালিশে একটি আলগা খোল পরিয়েছে শিখারানি। বালিশে করেছে ছোট ফুটো। সেই ফুটোয় পয়সা গলিয়ে দেয়। ফুটোর মুখ বেঁধে দেয় দড়ি দিয়ে। তুলো বেরুতে পারে না। খোলের জন্য এই ব্যবস্থা আড়ালে থাকে।
কিন্তু এ আর এমন কী টাকা! অলক শকুনের নজরে ভক্তির পয়সা আগলায়।
অশোকও শিখারানির শরীরের ভাগ নেয়। এবং অশোকের যৌনতায় কোনও জান্তব বিস্তার নেই। তবু অশোককে অবলম্বন করেনি শিখারানির মন। হতে পারে, অশোক তার চেয়ে বয়সে ছোট বলে, তার আছে অশোকের প্রতি বাৎসল্য। যেমন ছিল সহদেবের প্রতি দ্রৌপদীর। তা ছাড়া অশোক তার সর্বক্ষণের সঙ্গী নয়। বাইরে-বাইরে ঘোরা ছেলে সে। দুটি রঙ্গ-রসিকতা করা, দুটি সুখ-দুঃখের কথা শোনা, কী পাড়া-প্রতিবেশী নিয়ে আলোচনার সময় কোথায় তার। দূরের সম্পর্ক এক জিনিস, কাছের সম্পর্ক আর এক জিনিস। শিখারানির মন তাকেই সঙ্গী চায়, যে সহজলভ্য। এমনকী এ-ও হতে পারে, অলকের সঙ্গে তার স্বামীর চরিত্র কোথাও মেলে। এই মিলই তাকে অলক ঘোষালকে অধিকার করার প্ররোচনা দেয়। যার যেথা ভজে মন। অলক কেমন—এ বিচার শিখারানি করেনি। সে যেমন, তেমনই গৃহীত। জীবনধারণের তাগিদ, শরীরের তাগিদ ছাপিয়ে অলক শিখারানির হৃদয়ে অধিকৃত।
কারণ যা-ই হোক, শিখারানি অলকের ওই দিন নেই রাত নেই পূর্ণ চক্রবর্তীর বাড়ি গিয়ে পড়ে থাকা পছন্দ করছে না। একদিন বলেছিল সে—আনবাড়ি গিয়ে এমন পড়ে থাকো কেন? কী ভাবে তারা?
অলক বলেছিল—কী ভাববে! পূর্ণ চক্রবর্তী গুণী লোক। তার কাছে শিখি।
শিখারানি ঘোর গলায় বলেছিল—হুঁ। পূর্ণ চক্রবর্তী গুণী লোক আর তাঁর মেয়েটি যুবতী।
অলক একটু তুতলে গিয়েছিল—ত-তাতে কী! আমি কী ওই ম-মেয়ে দেখতে যা-যাই ভাবো?
শিখারানির আর সন্দেহ ছিল না অলক মজেছে। ভাল রকমই মজেছে। তার ভেতরটা জ্বালা করে উঠেছিল। কানাঘুষো পৌঁছয় তার কাছে। অকারণেই অলকের সঙ্গে ঝগড়া করে সে। অলকও তেরিয়া জবাব দেয়। কিন্তু এভাবে দিন ভাল যায় না। হাজার অশান্তিতে ঝগড়ার অশান্তি মন বিকল করে দেয়। মনে হয়, কী হবে এই পূজা-পাতি করে! সব মিথ্যে! সত্যের দেবতার নীচে মিথ্যের দেবতার অন্ধকার আর ঘাঁটতে ইচ্ছে করে না।
মন্দিরের দাওয়ায় বসে চুপচাপ ভাবছিল শিখারানি। সকালের পূজা-পর্ব সেরে রাঁধাবাড়া করে রেখেছে। দুপুরের খাওয়া হলে খাওয়ার বাসন মাজা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। বাকি সময় তার অবসর। তাদের বাড়ির পাশে এক ফালি ফাঁকা জমি। ছোট ছোট মেয়েরা রোজ সকালে এখানে খেলা জমায়। স্কুলে যাবার তাগিদ যাদের নেই, কেবল গেরস্থালির কাজ সম্বল করে বেঁচে থাকবে যারা, তাদের দল। কেউ নিতান্ত বালিকা। কারও বুক গুটি পাকিয়েছে। এই সময় ছেলেদের সঙ্গে খেলা চলে না আর। তা ছাড়া এ গাঁয়ে ছেলেরা প্রাইমারি অবধি যায়। নিয়মিত না হোক অনিয়মিত। দু’-এক ক্লাস পাশ করে ছেড়েও দেয় অনেকে। ক্ষেতি-জমির কাজে লেগে পড়ে। ঘাস কাটে। অবসর সময় হাতে গুলতি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। পাখি মারে। ফল-পাকুড় অবধি পেড়ে নেয় গুলতি ছুড়ে।
কাজের অবসর হলেই শিখারানি এখানে বসে খেলা দেখে মেয়েদের। তার নিজের শৈশব মনে পড়ে যায়। কখনও মনে হয়, এই মেয়ের দলে তার নিজেরও তো একটা থাকতে পারত। মেয়ে চাই না, ছেলে চাই, এমন কোনও বায়নাক্কাই ছিল না তার। সন্তান হলেই সে সুখী হত। মানুষ করত বুকে চেপে
সে মাঝে মাঝে এই ছোট মেয়েদের চালকলা মেখে প্রসাদ দেয়। বাতাসা নকুলদানা দেয়। কারও কপালে এসে পড়া চূর্ণ কুন্তল সরিয়ে দিয়ে স্নেহভরে বলে—ওমা! কী রুক্ষ চুল! মা বুঝি তেল দিয়ে দেয় না!
মেয়েরা হি-হি করে হাসে। তার চুলের দিকে দেখিয়ে বলে—আর তোমার? তোমার চুলে জটা।
কুচোকাঁচাগুলো লাফায় আর চিৎকার করে—জটা! জটা! জটা!
কে তাদের শিখিয়েছে এক ছড়া। চালকলা বা বাতাসা খেতে খেতে তারা পরমানন্দে লাফায় আর ছড়া কাটে—
এক যে ছিল জটাবুড়ি।
চুলগুলো তার শনের নুড়ি।।
শনে ফুলকি পড়ল।
বুড়ি পুড়ে মরল।।
সে রাগ করে না। হেসে বলে—এই আমি বুড়ি? কই, আমার পাকা চুল?
মেয়েরা পালায় তখন। হেসে হেসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে। তারপর আপন খেলায় মেতে যায়। সে বসে বসে খেলা দেখে। কেউ পড়ে গেলে তুলে ধুলো ঝেড়ে দেয়। হাত-পা ছড়ে গেলে লাগিয়ে দেয় গাঁদা পাতার রস। বারোটা নাগাদ শিশুরা চলে যায়। চারপাশ নিঝুম লাগে তখন। শূন্য লাগে। সে যখন এমন পূজারিণী হয়ে ওঠেনি, তখনও এই শিশুদের খেলা তার চোখেই পড়ত না। সকল আঘাত-প্রতিঘাত সামলাতে সামলাতে কখন তার নিজস্ব চাওয়া-পাওয়া তৈরি হল, কবে গড়ে উঠল এক একান্ত জগৎ সে বুঝতেও পারেনি। এখন তার মনে হয়, এই স্বামী-দেবর-ভর-ভড়ং নিয়ে সে যে শিখারানি, সে অন্য কেউ। সে যখন একা, তখন সে আর এক মানুষ। তখন সে সত্য। শুদ্ধ। তার কামনাগুলির মধ্যে তখন এতটুকু মিথ্যে নেই। মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষায় পৃথিবীর পবিত্রতমা সে।
কতরকম খেলে ওরা। ওই মেয়েরা। এইসব খেলা শিখারানিও খেলেছে। এলাটিং বেলাটিং, হাডুডু, উপেনটি বায়োস্কোপ, বুড়োবুড়ি। আজ তারা লাগিয়েছে বুড়োবুড়ি খেলা। একটি মেয়ে
হয়েছে বুড়ো, অন্যজন সেজেছে বুড়ি। বুড়ো-বুড়িকে বলয়ে ঘিরে রেখেছে বাকিরা। হাতের শৃঙ্খলে তৈরি এ বলয়। বলয়ের এক কোণে বুড়ি জবুথবু হয়ে বসে আছে।
বুড়ো বলল— ভাত রাইন্ধ্যা দ্যাও তুমি।
হাল বাইতে যাইবাম আমি।
বুড়ি বলল— ভাত রান্ধইতে পারি না আমি,
বাপের বাড়িত যাইবাম আমি।
বুড়ো— বাপের বাড়িত যাইবা তুমি,
চুল ধরইয়া আনবাম আমি।
বুড়ি একটি করে কথা বলছে আর ব্যাঙের মতো লাফিয়ে স্থান পরিবর্তন করছে। তার উদ্দেশ্য সুযোগমতো হাতের শৃঙ্খল গলে বেরিয়ে যাওয়া। বুড়ার কথার জবাবে সে এবার বলল—
চুল ধরইয়া আনবা তুমি,
লেছুর দিয়া থাকবাম আমি।
বুড়া— লেছুর দিয়া থাকবা তুমি,
কান্ধে করইয়া আনবাম আমি।
বুড়ি— কান্ধে করইয়া আনবা তুমি,
থুথু দিয়া পলাইবাম আমি।
বুড়া— থুথু দিয়া পলাইবা তুমি
গঙ্গার নদীত ধুইবাম আমি।
বুড়ি— গঙ্গার নদীত ধুইবা তুমি,
জলের তলে পলাইবাম আমি।
বুড়া— জলের তলে পলাইবা তুমি,
জাল দিয়া ছাঁকবাম আমি।
বুড়ি— জাল দিয়া ছাঁকবা তুমি,
কাঁকড়ার গাথায় পলাইবাম আমি।
বুড়া— কাঁকড়ার গাথায় পলাইবা তুমি,
কোদাল দিয়া তুলবাম আমি।
বুড়ি— কোদাল দিয়া তুলবা তুমি,
ছনক্ষেতে পলাইবাম আমি।
বুড়া— ছনক্ষেতে পলাইবা তুমি
আগুন দিয়া পুড়ব আমি।
বুড়ি— আগুন দিয়া পুড়বা তুমি,
তোমারে থুইয়া মরবাম আমি।
বুড়া—আমারে থুইয়া মরবা তুমি,
তোমার লগে যাইবাম আমি।
তবে রে—বলে বুড়ি হাতের শৃঙ্খল গলে পালায়। বুড়া তাকে ধরতে যায়, কিন্তু বুড়ি শৃঙ্খলের বলয়ে প্রবেশ করে আবার। বুড়া প্রবেশ করতে চাইলে বাধা পায়। বলয় তার প্রতি সদয় নয়। অনেকক্ষণ এমন লুকোচুরি চলতে চলতে বুড়ো হাঁপাতে হাঁপাতে বুড়িকে ধরে দেয় বেদম মার। মারের চোটে বুড়ি কাঁদতে বসলে বুড়ো তার কান্না থামানোর জন্য একে একে এনে দিল কানের দুল, নাকের নথ, পায়ের মল, হাতের কাঁকন, গলার হার। সারা শরীর অলংকারে ভরে উঠলে সকলে মিলে গাইতে লাগল—
তোমরা হাইস্য নাকো বাবুরা
বুড়া আমায় মারিসে
বুড়া আমায় মারিসে
কান আমার কাটিসে
কাটা কানেতে আবার দুল পিন্দাইসে।
এইভাবে একে একে সকল অঙ্গ ঘুরে খেলা শেষ হবে। শিখারানি গালে হাত দিয়ে গান শুনছিল। অলক ঢুকল বাড়িতে। শিখারানিকে উঠতে হল। স্নান করেই খেতে চাইবে অলক। অমর ঘোষালকেও খেতে দেবে এইবেলা। দাওয়ায় পিঁড়ি পেতে, জলের ছিটে দিয়ে খাবার ঠাঁই করল সে। দু’জনের থালা দিল। কলতলায় ঝপাঝপ জল ঢালছে অলক। আসার সময় দু’খানি বালতি ভরে আনবে।
পিঁড়ি পাতা দেখেই অমর ঘোষাল বসে পড়ল। শিখারানি বলল—অলক আসুক, দিচ্ছি।
অমর ঘোষাল ভাষাহীন ঘোলাটে চোখে তাকাল শিখারানির দিকে। মাথার চুল প্রায় সব পেকে গেছে। গালে খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি। গায়ের ত্বক খড়ি-ওঠা। হাড়ের সঙ্গে সেঁটে আছে। শিখারানির বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল। এই লোকটা তার স্বামী। তার সব। এখন ঠুনকো তোবড়ানো টিনের পাত্রের মতো পড়ে আছে সংসারে। অমর ঘোষাল থালা নিয়ে খেলছেন। আঙুলের ডগায় থালা তুলছেন আর ফেলে দিচ্ছেন। শিখারানি এই লক্ষণ চেনে। এর অর্থ, তিনি অধৈর্য হয়ে উঠছেন। এখুনি ভাত না দিলে তিনি পাত্রত্যাগ করে উঠে যাবেন। হাজার সাধাসাধিতেও আর তাঁকে খাওয়ানো যাবে না! সে অলকের অপেক্ষা না করে তাড়াতাড়ি ভাত বেড়ে দিল। আয়োজন সামান্য। ধুঁধুল ভাজা আর আলু-কুমড়োর তরকারি। ধুঁধুল আর কুমড়ো তাদের ঘরের সবজি। বেড়ার ওপর ধুঁধুল গাছ আপনজালা জন্মেছে। কুমড়োর একটা চারা রাস্তার ধার থেকে তুলে এনে পুঁতেছিল শিখারানি।
খাবার দেওয়া মাত্র বড় বড় গ্রাসে গবগব করে খেতে থাকলেন অমর ঘোষাল। যেন তাঁর জঠর জুড়ে বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা। মুখের চারপাশে লেগে যাচ্ছে ভাত। ছুড়ে দেওয়া গ্রাসের কিছু মুখের ভিতরে যাচ্ছে, কিছু ঝরে পড়ছে। বিশ্রী লাগে এমন খাওয়া দেখতে। কিন্তু এই খাওয়ার ধরন রোজকার নয়। অমর ঘোষালের মস্তিষ্ক চঞ্চল হওয়ার পূর্বলক্ষণ এটি। শিখারানি লক্ষ করছিল সব। অলক আসতে না আসতেই উঠে পড়লেন অমর ঘোষাল। শিখারানি এঁটো পাত তুলতে তুলতে অলককে বলল— আজ ওষুধটা বাড়িয়ে দিতে হবে।
—বাড়ছে?
জিগ্যেস করল অলক।
–হুঁ।
ছোট করে বলল শিখারানি। এঁটো থালা রেখে হাত ধুয়ে অলককে খেতে দিতে বসল। নিজের খাবারও বেড়ে নিল থালায়। নীরবে খাওয়া শেষ করল দু’জনে। ইদানীং হচ্ছে এরকম। দু’জনের এঁটো তুলছে শিখারানি, দূর থেকে ডাক ভেসে এল-শাঁ-আ-খা-আ লাগে এ-এ-এ! শাঁখা-আ-আ।
এই ভরদুপুরে রোদ্দুর মাথায় করে হাঁক দিয়ে যাচ্ছে শাঁখারি। শিখারানি নিজের হাতের দিকে তাকাল। দু’হাতে প্লাস্টিকের নকল শাঁখা। কতদিন সত্যিকারের শাঁখা পরেনি সে। আজ বড় সাধ হল মনে। অলককে বলল—কটা টাকা দাও না, একজোড়া শাঁখা পরি।
অলক সঙ্গে সঙ্গে বলল —টাকা কোথায় পাব?
—এই তো ক’দিন আগে পাঁচশো টাকা পেলে। দাও না।
—টাকা দেখলেই শুধু খরচের চিন্তা।
–দাও না। সধবা মানুষ। একজোড়া শাঁখা পরব। না বোলো না।
—ওঃ! একেবারে সতী-লক্ষ্মী! সধবার তিন ডবল! কার ধব্য কোন শাঁখায় রাখবে শুনি?
মুখ বিকৃত করল অলক। গজগজ করতে করতে টাকা এনে দিল শিখারানির হাতে। অলকের মন্তব্যে শিখারানির কান-মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করছিল। একবার মনে হল, ছুড়ে ফেলে দেয় টাকাটা। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, এ তো অলকের টাকা নয়। এতে তারও সম্পূর্ণ অধিকার আছে। টাকাটা নিল সে। কিন্তু দাঁতে দাঁত পিষল। ওই মন্তব্য অলক যৌনোন্মত্ততায় করে থাকে, কিন্তু অন্যসময় কখনও করেনি। শিখারানি অতএব, লুফে নিল অপমান। ‘যার জন্য করি চুরি, সে-ই বলে চোর’ ভাবতে ভাবতে শাঁখারিকে ডাকতে বেরিয়ে এল সে।
চোখে পুরু কাচের চশমা পরা, শীর্ণ আধবুড়ো মানুষটি। হাতে ছোট বাক্স। একটি রং-চটা পুরনো তালি-মারা ছাতা মাথায় ধরে আছেন। এ গ্রামে মাঝে মাঝে আসেন তিনি। শাঁখা বিক্রি করে যান। গ্রামের বউ-ঝিদের চেনা মানুষ। শাঁখার বাক্সে মুসলমান রমণীদের জন্য থাকে কিছু কাচের চুড়িও। হিন্দু মেয়ে-বউদেরও সে চুড়ি কম পছন্দ নয়। শিখারানি শাঁখারিকে ডাকে—ও শাঁখারি!
শাঁখারি পা টেনে টেনে সতীমন্দিরের দাওয়ায় এসে বসেন। ছাতা ভাঁজ করে রাখেন পাশে। পুরু কাচের চশমার আড়ালে তাঁর চোখদুটি অস্বাভাবিক বড় দেখায়। সেই বৃহৎ দুটি চোখ মেলে তিনি বলেন—একটু জল পাব মা?
মানুষটিকে দেখে কষ্ট হয় শিখারানির। সে মন্দির হতে চারটি প্রসাদী বাতাসা আনে, জলের সঙ্গে দেয়। বাতাসা মুখে দিয়ে জল পান করেন শাঁখারি। তাঁর সন্তর্পণ চিবুনো ও মুখের মধ্যে বাতাসার নড়াচড়া দেখে বেদনায় বুক টসটস করে শিখারানির। আহা! মানুষটার হয়তো খাওয়া জোটেনি সকাল হতে! কী-ই বা খেতে দেয় সে। তার মনে পড়ে সন্ধ্যায় ঠাকুরের বৈকালি দেবার জন্য এনে রাখা আছে শশা ও কলা। তার থেকে একটা শশা কি দেবে এই শাঁখারিকে? অলক জানতে পারলে অনর্থ করবে। মাপা হিসেব তার। মাপা খরচ। হোক গে। তাপক্লিষ্ট মানুষটিকে শশা দিতে ইচ্ছে করে তার প্রবলভাবে। ইদানীং স্বাধীন কর্মের ইচ্ছা জাগে তার। স্বাধীনতার ইচ্ছা, যাকে কারও কারও চোখে স্পর্ধা বলা যায়। বৈকালির শশা শাঁখারিকে দিয়ে দেবার পরিণতি ভাবতে ভাবতে দ্বিধাজড়ানো স্বরে সে বলে ফেলে—একটা শশা কেটে দিই শাঁখারি?
—না, না।
শাঁখারি মাথা নাড়েন।
—আমি খেয়েছি মা, খেয়েছি। রোদ্দুরে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। সতীমায়ের প্রসাদ পেলাম, এই তো আমার ভাগ্যি।
—এই রোদ্দুরে বেরিয়েছ কেন শাঁখারি?
শিখারানি স্বরে মায়া মেখে প্রশ্ন করে। শাঁখারি বলেন না বেরুলে চলবে কেন মা? সামান্য যে দু’ ছটাক জমি, অনাবৃষ্টিতে ফসল ধরল না। অগত্যা বেরুতে হল। পেট তো মানে না। কী বৃষ্টি, কী রোদ—সংসারে সাতটা পেট, তার জোগান চাই যে!
শিখারানি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জঠরযন্ত্রণা জানা আছে তার। বস্তুত, এ পৃথিবীর বহু যন্ত্রণাই তার জীবন জুড়ে রয়েছে। তাকে নিশ্চুপ দেখে শাঁখারি বলে—সতীমাকে বোলো মা। আর বছর যেন বৃষ্টি দেন। এ বছর তো বর্ষা ফুরল।
—বলব শাঁখারি। কী এনেছ আজ?
—সব আছে মা। কাচের চুড়ি, গালার চুড়ি, শাঁখা। কী পরবে? আ ছি ছি। মায়ের হাতে প্লাস্টিকের শাঁখা কেন? এই হাতে কি নকল শাঁখা মানায় মা?
—তা কী করব বলো! শাঁখার যা দাম হয়েছে!
—তা ঠিক। সব জিনিসই তো আগুন মা। তা শাঁখা বার করি?— করো।
শাঁখারি বাক্স খোলে। এর আগে শিখারানি নিজের জন্য কখনও শাঁখারিকে ডাকেনি। পরের বাড়ি গিয়ে দেখে চোখের সাধ মিটিয়েছে। আজ বাক্স খোলার সঙ্গে সঙ্গে চোখ ধাঁধিয়ে গেল তার। গালার ওপর আয়না বসানো চুড়িগুলোয় আলো ঠিকরোচ্ছে। বড় ইচ্ছে হল, ওই বস্তুও কেনে একজোড়া। কিন্তু পয়সা নেই। সতীর ভর পাওয়া নারী শাঁখা ফেলে গালার চুড়ি কিনবে, তাও শোভন দেখায় না। সে অতএব শাঁখার দিকে মন দেয়। শাঁখারি বলেন —কী দেব বলো মা, লিচুকাটা নেবে? পলকাটা? নাকি সাবুদানা? না হলে এই বরফিটা নাও। তোমার হাতে মানাবে ভাল।
শিখারানি বাছাবাছি করে। সাদা শাঁখাগুলি জোড়া জোড়া করে সরু নীল সুতোয় বাঁধা। সরু মোটা নানানরকম। দাম কুড়ি টাকা জোড়া থেকে শুরু করে একশো দেড়শো টাকা জোড়া পর্যন্ত। অবশেষে শাঁখারি শিখারানির ক্ষমতা বুঝে একটি লিচুকাটা শাঁখা তুলে নেন। বলেন—এই পরো মা। তোমার গোল হাতে দিব্যি লাগবে।
বাছাবাছি করে অবশেষে শাঁখারির ইচ্ছেই মেনে নেয় শিখারানি। হাত বাড়িয়ে দেয় সে। শাঁখারি অভ্যস্ত হাতে চেপে চেপে খুলে নেন প্লাস্টিকের চুড়ি। বলেন—হাতে আঁচল চাপা দাও মা। সধবার হাত শাঁখা ছাড়া দেখতে নাই।
শিখারানি হাতে আঁচল বাঁধে। শাঁখারি হাত টিপে টিপে, চেপে চেপে শাঁখা পরাতে থাকেন। বলেন—লক্ষ্মীমন্ত হাত তোমার মা। অক্ষয় হবে তোমার শাঁখা। মাগো, তোমার এই দাওয়া কী ঠান্ডা! কী শাস্তি! একটু জিরোতে প্রাণ চায়।
—তা জিরোও না। রোদের তাত একটু কমলে নয় বেরিয়ো আবার।
—তা সে একটু। বিক্রি-বাটা করে ফিরতে হবে তো। এয়োস্ত্রীর শাঁখা পরার নিয়ম কী করে হল জানো তো মা?
শাঁখা পরিয়ে, দাম নিয়ে, বাক্সের ডালা বন্ধ করে, গল্প ফেঁদে বসেন শাঁখারি। শিখারানি বসে বসে শোনে। ক’টা এঁটো বাসন মাজা ছাড়া তো আর কাজ নেই। সে করে নেবে পরে। সে গল্পের মধ্যে ঢুকে যায়।
.
শিবের গৃহিণী পার্বতী স্বপ্ন দেখলেন, তাঁর হাত ঘিরে আছে শুভ্র শঙ্খবলয়। এমনই তার চমৎকারিত্ব যে অন্য সব অলংকারকে তা ম্লান করে দিচ্ছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে পার্বতী শিবের কাছে একজোড়া শঙ্খবলয় চাইলেন। শিব বিস্মিত হয়ে বললেন –শঙ্খবলয়? শাঁখা? সমুদ্রের শঙ্খ কেটে বানানো অলংকার?
পার্বতী জেদ করে বললেন—হ্যাঁ। সে আমার চাই।
—সে তো জেলের বউরা পরে। তুমি তা নিয়ে কী করবে?
—আমি পরব। আমায় এনে দাও একজোড়া।
শিব বললেন—দেখো গৌরী, অলংকার পরতে সাধ হয়, সোনা-রূপা পরো। অসময়ে বিক্রয় করে দু’টি পয়সা পাওয়া যাবে। রাঙা হাতে শাঁখা পরে হবে কী!
গৌরী বললেন—সোনা পরলে গায়ে ব্যথা করে। রুপো পরলে গায়ে ফোস্কা পরে। আমার বাপ রাজা-গজা পুরুষ। তাঁর সোনা-রুপার অভাব কী ছিল? শাঁখা আমার চাই চাই চাই।
—সে আমি এনে দিতে পারব না। তোমার বাবা ধনী মানুষ, তাঁর কাছে গিয়ে আবদার করো গে যাও।
পার্বতী বেজায় চটে গেলেন শিবের ওপর। ভস্মমাখা, গাঁজাখোর, নির্বোধ পতিকে ফেলে গৌরী গণেশের হাত ধরে সোজা চলে গেলেন বাপের বাড়ি। যারার আগে গালি দিলেন— বউকে একজোড়া শাঁখা জোগাতে পারো না ছাইমাখা বুড়ো? তা তোমার বিয়ে করা হয়েছিল কেন শুনি?
শিব তখন সিদ্ধির মৌতাতে ঢুলুঢুলু। অতশত শোনেননি। শুনলেও পাত্তা দেননি। আকাঙ্ক্ষিত বস্তু না পেলে কোন স্ত্রী স্বামীকে গঞ্জনা না দেয়। ওসব গায়ে মাখতে নেই। কিন্তু মৌতাত টুটলে শিব মুশকিলে পড়লেন। গৌরী ছাড়া তাঁর যে একদণ্ড চলে না। কী করা যায়, গালে হাত দিয়ে বসে বসে ভাবছেন। এই ভাবনায় নেশাও জমছে না। বউ গোঁসা করে বাপের বাড়ি গেল যেই, অমনি জামাই তাকে আনতে ছুটলে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়। শিব অকুল পাথারে পড়লেন।
তখন সেখানে এলেন নারদ। তিনি পরামর্শ দিলেন—মহাদেব। আপনি কেন না শাঁখারি সাজেন?
মহাদেব বললেন—সে না হয় সাজলুম। তারপর?
—কেন? শাঁখারি সেজে গিরিরাজের গৃহে যাবেন আপনি। কৌশলে গৌরীকে সঙ্গে আসতে অনুরোধ করবেন।
এই পরামর্শ খুব মনে ধরল শিবের। তিনি গরুড় পাখিকে ডেকে বললেন—ভাই গরুড়, কিছু শঙ্খ এনে দাও আমায় সমুদ্দুর থেকে।
গরুড় বলল— তা দেব এনে। কিন্তু শঙ্খ দিয়ে হবে কী?
শিব বললেন— শাঁখা পরতে চেয়েছিলেন শিবানী। দিতে পারিনি বলে গোঁসা করে পিত্রালয়ে গেছেন। তুমি শঙ্খ এনে দিলে শাঁখা গড়াব বিশ্বকর্মাকে দিয়ে। তারপর নারদের পরামর্শমতো শাঁখারি সেজে যাব পার্বতীকে আনতে।
গরুড় শঙ্খ এনে দিল। শিব শঙ্খগুলি নিয়ে বিশ্বকর্মার কাছে গিয়ে বললেন—ভাই বিশ্বকৰ্মা! কিছু শাঁখা গড়ে দাও আমায়।
বিশ্বকর্মা বললেন— তা দেব। কিন্তু মহেশ্বর, আপনার শাঁখায় কী প্রয়োজন?
শিব বললেন— শাঁখা পরতে চেয়েছিলেন শিবানী। দিতে পারিনি বলে গোঁসা করে পিত্রালয়ে গেছেন। গরুড় সমুদ্দুর থেকে এনে দিয়েছে শঙ্খ। তাই দিয়ে তুমি বানাবে শাঁখা। তারপর নারদের পরামর্শমতো শাঁখারি সেজে যাব পার্বতীকে আনতে।
বিশ্বকর্মা মুচকি হাসলেন। বুঝলেন গৌরী বিহনে শিবের দুর্দশা। কিন্তু যেখানেই নারদ, সেখানেই বিপত্তি। তাই বললেন— দেখবেন ঠাকুর। ধরা পড়লে কিন্তু লজ্জায় মাথা কাটা যাবে।
শিব হেসে বললেন— নিশ্চিন্তে থাকো!
বিশ্বকর্মা সঙ্গে সঙ্গে শাঁখা গড়তে বসে গেলেন। অপূর্ব মনোহর নকশা তুলে নানারকম শাঁখা গড়লেন তিনি। সাদা গুঁড়োর পাহাড় জমে উঠল। শাঁখের গুঁড়ি দেখে মহাদেবের ভস্মের কথা মনে হল। তিনি সেগুলি বেশ করে অঙ্গে মাখলেন। শাঁখাঘষা কড়ি নিলেন ডান বগলে। বাঁ বগলে নিলেন সিদ্ধির ঝোলা ও গাঁজার কলকে। শঙ্খের পসরা নিলেন মাথায়। বিশ্বকর্মা, নারদ, গরুড় সব দেখে তো অবাক। তাঁরা বললেন— দেবাদিদেব, আপনাকে যে চিনে ফেলবে।
—ফেলবে বুঝি?
সরলভাবে বললেন মহাদেব।
—তা কী করা যায়?
বিশ্বকর্মা বললেন-আসুন আপনাকে সাজিয়ে দিই।
নকল গোঁফ লাগিয়ে, পাগড়িতে জটাজুট ঢেকে, সভ্য ভদ্র পোশাক পরিয়ে বুড়ো শিবকে একেবারে নব্য বণিক যুবা করে দিলেন বিশ্বকর্মা। এবার শিব শাঁখার পসরা নিয়ে চললেন। গিরিরাজের দেউড়িতে এসে হাঁকলেন—শাঁখা চাই শাঁখা—আ আ
শিবের মধুনিন্দিত কণ্ঠ গৌরীর কানে পৌঁছল। তিনি জানালায় উঁকি মেরে দেখলেন, ও মা, এ কে! এ যে অন্য লোক! কিন্তু গলা যেন তাঁর!
এদিকে শিবের মনোহর রূপ দেখে, চিত্তবিবশকারী স্বর শুনে যত পুর-স্ত্রী সব হুড়োহুড়ি করে বেরিয়ে এসেছেন। মাথায় ঘোমটা অবধি তাঁরা তোলেননি। যদিও শিবকে চিনতে পারছেন না কেউ। তাঁরা তরুণ রূপবান শাঁখারির দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছেন হাত। শিবও জমিয়ে বসে, সকলের হাত টিপে-টুপে, প্রয়োজনের চেয়ে অধিক সময় নিয়ে সবাইকে শাঁখা পরাতে লাগলেন।
একে একে সকলের শাঁখা পরা হল। সবার শেষে এলেন গৌরী। সোনার খাটে বসে রুপার খাটে পা দিয়ে তিনি শাঁখা পরতে বসলেন। শিব বললেন—
যাবার সময় যাবি শঙ্খ নড়িয়ে চড়িয়ে।
আসবার সময় আসবি না শঙ্খ বজ্রাঘাত পড়িলে ॥
গৌরী বললেন—তা শাঁখারি, এ কথার মানে কী।
শিব বললেন—এ হল শাঁখারির গোপন মন্ত্ৰ।
গৌরী বললেন—তা শাঁখারি, তোমার পরিচয় কী!
শিব বললেন—সূর্যপুর থাকি আমি ইন্দ্রপুর ঘর। আমার নাম দেব শাঁখারি পিতা সদাগর ॥ এর থেকেও কিছু বোঝা গেল না। তখন গৌরী নীরবে শাঁখা পরতে লাগলেন। কিন্তু বিষম গোলমাল বাঁধল। গৌরীর হাতে কোনও শাঁখাই পরানো যায় না। যে শাঁখাই পরাতে যান, মট করে ভেঙে যায়।
তখন দক্ষের ঘরের বধূরা বলতে লাগলেন—
ফুলের মতো নরম গৌরী তুলোর মতো হাত।
ও শাঁখারি এ শাঁখা কেমন, শুধুই ভাঙার ধাত।।
শিব বললেন— শাঁখা আমার খারাপ নয় ভালমানুষের ঝি।
তোমাদের সব হাত গলালাম তখন ভাঙল কি!
মেয়েরা তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ল শাঁখা ভাঙার কারণ জানতে।
শিব বললেন—গৌরী নিশ্চয়ই তার স্বামীর মনে দুঃখ দিয়েছে, তাই এ দশা।
সকলে বলল—ও মা! কী হবে!
শিব বললেন—গৌরী বলুক, আজই স্বামীর কাছে ফিরে যাবে। তবেই হাতে শাঁখা লাগবে।
গৌরী এতক্ষণে তাঁর স্বামীকে চিনেছেন। ওই স্বর, ওই চোখ, ওই মৃদু মধুর হাসি, ত্রিভুবনে আর কার আছে! তিনি তিন সত্যি করলেন— যাব, যাব, যাব!
শিব গৌরীর হাতে, সবচেয়ে সুন্দর শাঁখাজোড়া পরিয়ে উধাও হলেন। দু’হাতে শাঁখা পরে পার্বতী আবার গণেশের হাত ধরে ফিরে এলেন স্বামীগৃহে। দু’জনে পরম সুখে বসবাস করতে লাগলেন। এক ফাঁকে, শিব গৌরীর গাল টিপে বললেন—শাঁখা পরার শখ মিটল?
গৌরী বললেন—না। মেটেনি।
—মেটাচ্ছি।
এই বলে শিব সকল সধবাকে স্বপ্নাদেশ দিলেন, স্বামীর কল্যাণে শাঁখা পরতেই হবে।
গৌরীর সাধ মিটল। দেশে শাঁখার প্রচলন হল।