2 of 3

রাজপাট – ৬৭

৬৭ 

আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস আইল 
আমার না ফুরাইল আশ। 
ভরা যৈবন লইয়া অভাগিনী
করে হা-হুতাশ রে॥ 
ফাঁকি দিয়া বন্ধু আমার 
কোথায় লুকাইল রে—

.

প্রায় নিবরষাই গেল বলতে হবে দু’মাস। আষাঢ়ের বর্ষণ তবু ভূমি স্পর্শ করেছিল। কিন্তু শ্রাবণে মেঘ করল যে দু’-চার দিন, তা মাটি ছুঁতে না-ছুঁতে গরম ভাপ হয়ে উড়ে গেল। গ্রীষ্মের দাহনের পর আকণ্ঠ বিপুল তৃষ্ণা ছিল মাটির, তা মিটল না। 

শুষ্ক আকাশের দিকে তাকিয়ে চাতকের আর্তি করুণ ছড়িয়ে পড়ছে— পি-পা-সা হা-য় মি-টি-ল না-আ, মি-টি-ল না-আ। পি-পা-সা হা-য় মি-টি-ল না-আ। হায় পি-পা-সা… 

ধরিত্রী, পশু, পাখি, মানুষ—সমগ্র প্রাণীকুলের আর্তিই যেন চাতকের কণ্ঠে ধরা হয়ে আছে। 

এরই মধ্যে ঘরে ঘরে মনসা পূজার আয়োজন হল। কিন্তু সকল বাজার আগুন। সবজি ফলেনি ভাল। পাটে যথাবিধি পচন ধরানো যাচ্ছে না। শুধুমাত্র সেচের জলে ফলেছে যে সামান্য ভাদই ধান, তাতে দেশের চাহিদা মিটবে না। 

খিদে না মিটলেও তবু ব্রত করতেই হয়। দেব-দেবী রাখতে হয় পূজায় সন্তোষে। ঘরে ঘরে সাপের উপদ্রব। তাই মনসাপূজার আয়োজন। আয়োজন সামান্যই। শুধু সারামাস পদ্মাপুরাণ পড়া। সংক্রান্তিতে ব্যয়সাধ্য পূজা। চ্যাংমুড়ি কানি বাঁ হাতের পূজা পেলেও তুষ্ট যে। 

গলায় রুদ্রাক্ষমালা পরম সুন্দর।
পদ্মার সম্মুখে বৈসে রাজা চন্দ্রধর ॥
নেত্রাবতী দেবী বৈসে পদ্মার দক্ষিণে।
মণ্ডলী করিয়া ঘট পাতে সেই স্থানে ॥
আতপ তণ্ডুল নৈবেদ্য সহ উপচার।
নানা ফল মিষ্টান্নাদি দধি মধু আর ॥
পূর্ব্বদিকে মনসার করিল আসন।
পশ্চিম মুখেতে চান্দ বসিলা তখন ॥
জয় ভেবী বলে চাঁদ দেয় পুষ্পপানি
তা দেখিয়া হাসে মাতা জগৎজননী।
দৈবের নিবন্ধ দেখ কে করে খন্ডনে। 
ভেবী বলিতে দেবী বাহিরায় চান্দের বদনে ॥

শস্যে স্বয়ম্ভর এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে মজুত আছে ধান, চাল। আকাল হলে সেইসব বাজারে এসে যাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু তার মূল্য পৌঁছবে যেখানে, সেখানে সকলের হাত যায় না। 

কৃষক পরিবারগুলি সাধারণত সম্বৎসরের খোরাকি চাল ঘরে মজুত রাখে। কিন্তু কৃষিজমিতে যারা মজুর, তাদের সেই সুযোগ কোথায়! দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ, কিংবা ধানের চুক্তি। এই বিনিময় হতে সঞ্চয় সম্ভব হয় না। ছোট ছোট কৃষকের ঘরে, জেলের ঘরে, মজুরের ঘরে অভাব শুরু হয়ে গেছে তাই। মাটি-কাটার কাজ হবে শুনে, রাস্তা নির্মিত হবে শুনে, অনির্বাণ পোদ্দারের কাছে কর্মপ্রার্থী মানুষের এখন নিত্য দরবার। 

অন্যান্যবার এইসময় জল-ভরা ক্ষেতে ধানের শীর্ষ জলের ওপর দিয়ে মাথা তোলার জন্য আঁকুপাঁকু করে। জলের তল যত ওপরে ওঠে, ধানের শস্যভারাপ্লুত দেহ, নিজেকে ততই দীর্ঘ করে নেয়। পচা পাটের কোষ্টার গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে থাকে। জলভারনত মেঘ এত কাছে এসে পড়ে ধরিত্রীর যে, মনে হয় হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারা যাবে। ঘরে ঘরে সোঁদা গন্ধ। বৃষ্টি থামে না। বহু বিরক্তি। পথ চলা দায়। আঙিনায় কেঁচোর উৎসব আর জনগণের পায়ে হাজা। তবু বিরক্তির মধ্যে জড়িয়ে থাকে আনন্দভরসা। এ নিয়ে রস-রসিকতারও বিরাম থাকে না। পাটের কোষ্টা কেমন হল দেখতে মিঞা সাহেবের দিন যায়। ঘরে সারাদিন তাঁর দেখাটি মেলে না। ধানের গুছি পুষ্ট হল কি না তারও নজরদারি করা চাই। কিন্তু সারাদিন প্রিয়দর্শন না হওয়ায় বিবিসাহেবার মুখ ভার। বর্ষার মেঘের মতোই তাঁর দুই চোখ জলভারানত। মিঞাসাহেব বিবি মন তোষণের জন্য কথা পাড়েন— 

হাত পাও খাইয়া করল হারা কোষ্টার জলেতে।
কোষ্টা লইয়া হিতোইলা কাম ছিল এই কহালে ॥
জলে জলে ঘুরিনু বিবি তোমারে ধরিয়া মনেতে। 
হারা দিন কোষ্টা লইয়া ভাত খাই বৈহালে ॥
রাগ কইরো না বিবি তোমারে খাড়ুগা দিমু পায়। 
যদি খোদার মর্জি হয়, কোষ্টার দর যদি যায় ॥ 

গ্রামের জীবনে সুখান্বেষণের অবলম্বন এই বর্ষা। বর্ষা ভাল হলে বউয়ের পায়ে রূপার খাডু উঠবে। চাই কী, নাকে সোনার নথও উঠতে পারে। সম্বৎসরের খোরাকি নিয়ে ভাবনা থাকবে না। 

এই বৎসর সকলই গেল। প্রবল অনাবৃষ্টি নিয়ে এল আষাঢ়ের শুক্লানবমীর দারুণ বর্ষণ। ধনীর গৃহিণী সুমিত্রা দিবারাত্র হায় হায় করছেন—হায় হায়, এতটুকু বৃষ্টি নেই, মানুষ যে না খেতে পেয়ে মরবে। 

কথা শেষ করেই তিনি মুখে তোলেন তৃপ্তির পান। তাতে সামান্য জর্দার ছিটে। অনির্বাণ তখন মোটরবাইকে শব্দ তোলে। এখন তার প্রচুর কাজ। ভীষণ ব্যস্ততা। সুকুমার পোদ্দার জনদরদি মানুষ, বলেছেন—কারওকে ফেরাস না। গ্রামে কাজ নেই। ফসল ফলেনি। যে আসবে তাকেই দিবি কাজ। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। 

তা বেশ। এখন মাটি কাটার কাজে খুব বেশি দক্ষতা লাগবে না। দক্ষ শ্রমিক চাই রাস্তা তৈরির সময়। তখন দু’জন দক্ষ লোকই আনাড়িদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারবে। সেদিক থেকে দেখলে অনির্বাণও এই কাজে নতুন। কিন্তু এই ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে নতুন করে বেঁচে উঠেছে সে। এই বাইক তারই জন্য খরিদ করেছেন সুকুমার পোদ্দার। 

অনির্বাণ নিষ্কৃতি চেয়েছিল গ্রামের জীবন থেকে। চেয়েছিল বহরমপুরে গিয়ে বসবাস করতে। খুব অসুবিধের কিছু ছিল না। কারণ বহরমপুরে সুকুমার পোদ্দারের আছে দু’টি বাড়ি। একটি ভাড়া দিয়েছেন ব্যাঙ্ককে। একটিতে ওই ব্যাঙ্কেরই কোয়ার্টার্স। নিজেদের প্রয়োজন ও বসবাসের জন্য দুটি ঘর সেখানে রাখা আছে। 

কিন্তু অনির্বাণের প্রস্তাবে সুকুমার পোদ্দার সম্মত হননি। বলেছিলেন— লোকে এমনিতেই আমাদের দায়ী করছে। তুমি বহরমপুরে চলে গেলে এই দায় আরও বেশি করে স্বীকার করে নেওয়া হবে। 

একমাস বাড়ি হতে বেরোয়নি অনির্বাণ। লোকে জেনেছিল তার টাইফয়েড হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে বহরমপুর থেকে নিয়মিত আসতেন ডাক্তার নিয়োগী। শহরে তিনি খ্যাতিমান এবং প্রতিষ্ঠিত। বিদেশ থেকে তিনি সংগ্রহ করেছেন তাঁর বিদ্যার স্বীকৃতি। অতএব সুকুমার পোদ্দার সাজিয়েছিলেন চমৎকার। তবু কোনও কোনও লোক আজও অবিশ্বাস করে এই অসুখের কথা। কীভাবে খবর রটে গেছে, অনির্বাণ তুলতুলির সঙ্গে ছিল মৃত্যুর সময়। রটনায় ঘটনা কিছু থাকে। লোকে মানে। 

অনির্বাণ এখন এক স্বাভাবিক যুবক। লোকে তাকে দেখে। গ্রামের জীবনে গল্পের খোরাকি আনে ব্যক্তিগত জীবন। কোথায়ই বা নয়! ব্যক্তিগত জীবনের আলোচনা মানুষের সুস্বাদু লাগে চিরকাল। সারা পৃথিবী জুড়েই। তবে, লোকেরও রয়েছে কিছু দাবি। কারও মৃত্যু ঘটে গেলে সেও কি ব্যক্তিগত থাকে? আজও মানুষ মৃত্যুকে সামাজিক পরিণতি দেয়। 

অতএব অনির্বাণ ও তুলতুলি আলোচিত হয়েই থাকে গোপনে, নিচুস্বরে। দিবাভাগে বা সান্ধ্য মজলিশে। পথে যেতে যেতে দুটি লোকের বা রাত্রে স্বামী ও স্ত্রীর আলাপে আলাপে। 

প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনার পর তুলতুলির দেহ যাতে দ্রুত আনা যায় তার জন্য তৎপর ছিলেন সুকুমার পোদ্দার। রেলের চাকায় গলিত, পিষ্ট তালগোল পাকানো দেহাবশেষ সম্পূর্ণ নতুন চাদরে আচ্ছাদিত করে আনার সময় তুলতুলির অক্ষত বিনুনি দৃষ্টিগোচর ছিল। তার পেটের ওপর দিয়ে চলে গিয়েছিল ভারী চাকা, মুখ রক্তে মাখামাখি ছিল। দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন নিম্নভাগ কোনওভাবে সংলগ্ন করেছিলেন মর্গের ডাক্তার। প্রকৃতপক্ষে কোনও অংশই তার অক্ষত, নিটোল ছিল না। তবু মুখখানা সে কিছুটা বাঁচিয়েছিল, হয়তো সনাক্ত হওয়ার জন্যই। সহদেব দাস দেখেছিলেন সেই মুখ। কন্যার মৃত মুখ তাঁকে করেছিল বিবশ। রোরুদ্যমান। তখন, বিপুল জনসমক্ষে, সহদেব দাসকে আলিঙ্গন করে, তাঁরই কাঁধে মাথা রেখে কেঁদেছিলেন সুকুমার পোদ্দার। 

—আমার মা লক্ষ্মী চলে গেল সহদেব—এমনই উচ্চারণ তিনি বিলাপে করেছিলেন। 

জনগণ একে সহানুভূতির অশ্রুই ভেবেছিল। এমনকী সহদেব দাস স্বয়ং তীব্র শোকের অভিঘাত সত্ত্বেও সুকুমার পোদ্দারকে অভিযুক্ত করতে পারেননি। করেছিলেন একজনই কেবল, তিনি আশা। তাঁর মাতৃহৃদয়ের শোক পোদ্দারকে সহ্য করতে পারেনি। আঙিনায় রাখা মরদেহ দেখতে দেখতে, মাটিতে মাথা ঠুকতে ঠুকতে তিনি বিলাপ করেছিলেন। অভিসম্পাত করেছিলেন পোদ্দারকে কেন এসেছেন? কেন এসেছেন আপনি? চলে যান। চলে যান। আমার তুলিকে আপনি মেরেছেন। কেন? কী দোষ করেছিল আমার মেয়ে? যদি মাথার ওপর ঈশ্বর থাকে, তবে এমনই সন্তানশোক যেন হয় আপনার। 

সুকুমার পোদ্দার মাথা নিচু করে সহদেব দাসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। সহদেব দাস ওই শোকাবহ সময়েও কর্তব্য বিস্মৃত হননি। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছিলেন তিনিও। পোদ্দারের হাত ধরে বলেছিলেন—কিছু মনে কোরো না ভাই। শোকে ওর মাথার ঠিক নেই। 

সুকুমার পোদ্দার বলেছিলেন—ঘরে আমার ছেলের যমে মানুষে চলছে। তবু আমি এসেছি। না, বউঠানের কথায় আমি কিছু মনে করিনি। সন্তানশোক বড় শোক। আমি তোমার পাশে থাকলাম সহদেব। যখন যা দরকার লাগে, সংকোচ কোরো না। 

সহদেব দাস কোনও সাহায্যের জন্য এখনও পর্যন্ত আসেননি। কিন্তু সুকুমার পোদ্দারের সঙ্গে তাঁর সকল কথা জনসমক্ষে হয়েছে। লোকে দেখেছে সুকুমার পোদ্দার কতখানি বন্ধুবৎসল, সহমর্মী! একটু বাঁকা চোখে দুনিয়া দেখা যাদের অভ্যাস তারা বুঝছে, কী কঠিন পরিস্থিতি এখন সুকুমার পোদ্দারের। সহদেব দাস যদি তাঁর শোককে নুড়ি-পাথরের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেন, সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে অভিযোগের পাহাড় তোলেন যদি, পোদ্দার এক জটিল, নিরেট সমস্যার মুখে পড়বেন। সুতরাং সহমর্মী তাঁকে হতেই হবে। শোকপালন করতেই হবে। ক্ষমতা, ভাবমূর্তি, জীবন ও তার দায়ের মধ্যেকার পারস্পরিক দেয়া-নেয়ার পথ নির্মম। 

টাইফয়েডের ছলনায় ঘরে শুয়ে থাকা অনির্বাণকে কড়া ঘুমের ওষুধ দিয়ে রাখা হয়েছিল টানা চারদিন। তন্দ্রার ঘোরেও সে তুলতুলিকে ডেকেছিল। যম আর মানুষের টানাটানিতে এবার যমের ঘটেছে পরাজয়। কিন্তু তাকে নিয়ে পোদ্দার দম্পতির উদ্বেগের সীমা ছিল না। রাত্রে সুমিত্রা শুতেন ছেলের পাশে। সুকুমার পোদ্দার শুতেন একা। ঘুমের ঘোরে হঠাৎ উঠে বসত অনির্বাণ। তার মনে হত মশারির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তুলতুলি। তার স্থির চোখ অনির্বাণের প্রতি নিবদ্ধ। সে চিৎকার করে উঠে বসত-কে? কে? ওখানে কে? 

সুমিত্রা ধড়ফড় করে জেগে উঠতেন—কী বাবা? কোথায়? কোথায় কে? 

—ওই, মশারির বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল মা। 

সুমিত্রা বোঝাতেন—ও তোমার মনের ভুল। কেউ আসেনি। 

আলো জ্বালাতেন তিনি। মশারি তুলে দেখাতেন। কেউ নেই। অনির্বাণ শুয়ে পড়ত। শুয়ে শুয়ে ভাবত। তার মনে হত, তুলতুলির যে-চোখ দেখল সে কিছু আগে, সে-চোখে প্রেম নেই। কঠিন সেই চোখ। সে-চোখে খুনের নেশা। কিংবা হত্যার প্রতিজ্ঞা এক। সে ফিসফিস করে ডাকত—মা! 

—কী বাবা!

সুমিত্রা সাড়া দিতেন। 

সে বলত-— ও আমাকে মেরে ফেলতে চায়। 

—না, না। 

সুমিত্রা বুকে জড়িয়ে ধরতেন অনির্বাণের মুখ। 

—আমি আছি তো বাবা। মা পাশে থাকলে কেউ ক্ষতি করতে পারে না। 

দারুণ ত্রাসে আকুল হয়ে উঠলেন সুমিত্রা। ছেলে এসব কী বলে? সে কি পাগল হয়ে যাবে! সত্যিই কি দেখে কিছু অনির্বাণ! কে জানে! অপঘাতে মরার পর আত্মার সদগতি হয় না। সে ঘুরঘুর করে। অতৃপ্তিতে ঘুরঘুর করে। সুমিত্রার নিজেরই ঘুম ছুটে গিয়েছিল ভেবে। যাব না যাব না করেও অনেক ভেবেচিন্তে একদিন সতীর থানে শিখারানির ভর পড়লে তিনি সেখানে উপস্থিত হলেন। শিখারানির পায়ের কাছে উপুড় হয়ে বললেন—মাগো! সতী মা! আমার ছেলেকে ভাল করে দাও। 

ভর পড়া শিখারানি দুলতে দুলতে বলল— ভাল হয়ে যাবে ছেলের অসুখ। এই মাটি লও। সোনার মাদুলি করে ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ো। কোনও অতৃপ্ত আত্মা তোমার ছেলের চারপাশে ঘুরছে। এই ওষুধ দিলাম, রোজ জলে ভিজিয়ে তাকে সেই জল দিয়ো। পীড়া সেরে যাবে। 

অতৃপ্ত আত্মার কথা বলায় দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল সুমিত্রার সতী মায়ের প্রতি। প্রথমে তিনি আসতে চাননি। কিন্তু বংশীর মা জোর করেছিল। বলেছিল— যাও মা, যাও। ছেলের এমন অসুখ। লোকে কত আকথা বলে। 

—কী বলে বংশীর মা? 

সুমিত্রা জিগ্যেস করেছিলেন। বংশীর মা বলেছিল—সে বলে অনেক কথা। সহদেবের বউ নাকি নিত্য শাপ-শাপান্ত করছে। লোকে বলে, মেয়েটা মরল ওই অনুর জন্যই। তার একটা পাপ নেই! 

—ছি ছি! ভগবান! 

—আরও বলে.মা।

—কী বলে? 

—মেয়েটার নাকি পেট হয়েছিল। 

—ছি ছি ছি! মিথ্যে! একদম মিথ্যে কথা বংশীর মা। 

—তা লোকে বলে মা। আমি কী করব। 

— হে ভগবান! 

—তাই তো বলি মা। ছেলে তোমার অসুস্থ। কার শাপ কখন লাগে কে বলতে পারে! যাও একবার সতীর থানে। ভর পড়লে সতী মায়ের পায়ে পড়। তাঁর আশীর্বাদে সব ঠিক হয়ে যাবে। মায়ের মন, যেখানে আশ্বাস পায়, তাকেই আঁকড়ে ধরে। সুমিত্রাও গিয়ে সতী মায়ের পায়ে পড়লেন। গাঁয়েরই নিত্য কুণ্ডুকে ডেকে মাটি পুরে সোনার তাবিজ গড়তে দিলেন। 

নিত্য কুণ্ডু জাত স্যাকরা। বহরমপুরে সোনার দোকান আছে তাঁর। লোককে চড়া সুদে টাকা ধার দিয়ে মহাজনী কারবারও করেন। তা ছাড়া স্যাকরাদের ধর্মই হল বন্ধকি কারবারের। লোকে বলে নিত্য কুণ্ডু কোটিপতি। তিনি মেটে ঘরের মেঝেয় লুকিয়ে রাখেন সোনার বাঁট। কিন্তু নিত্য কুণ্ডুর জীবনচর্যা দেখে তা বোঝার উপায় নেই। অতি সাধারণ, অতি দীন-হীনের মতো তাঁর বসবাস। 

সুমিত্রা নির্ভর করলেন তাবিজের ওপর। মানসিক করলেন, ছেলে ভাল হলে তোমায় সোনার মটরমালা দেব মা। 

মুখে উচ্চারণ করেননি। শিউলি গাছে ঢিল বেঁধে মনে মনে বলেছেন। 

—মটরমালা? 

কে যেন অলক্ষ্যে উল্লসিত হয়েছে।

—মটরমালা? 

—না না। সোনার চেন দেব। 

সোনার চেন! অলক্ষ্যে উল্লাস থামে না। 

—না না। কানের ফুল দেব একজোড়া। তাতে মিনে করা থাকবে। 

অলক্ষ্য কুপিত হয়। 

—কী! মটরমালা থেকে কানের ফুল! ছেলের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। 

–না না মা। না না। 

সুমিত্রা শিউরে উঠেছিলেন। 

—ছেলের জীবন নিয়ে খেলব না মা। যা বলেছি তাই। ওই মটরমালা। তুমি আমার ছেলে ভাল করে দাও। 

অনির্বাণ তাবিজ পরল। কাঠি ভেজানো জল খেল। আর সুকুমার পোদ্দার ডাক্তারের হাত জড়িয়ে ধরলেন। 

—ও কি ভাল হবে না ডাক্তারবাবু? 

ডাক্তার নিয়োগীর দখল ছিল মনোবিজ্ঞানের ওপর। কিন্তু এই চিকিৎসায় এখনও লোকের মন লাগেনি। মনের চিকিৎসককে লোকে বলে পাগলের ডাক্তার। এই অভিধা থেকে রেহাই পেতে, এবং জীবন পরিপাটি চালাবার জন্য যে দু’পয়সা দরকার, তার জন্যও, তিনি হয়েছেন ঔষধ বিশেষজ্ঞ। গোড়া থেকেই তিনি জানতেন, এই ছেলেটির মনঃসমীক্ষণের প্রয়োজন হবে। সুকুমার পোদ্দারের ব্যাকুলতা দেখে তিনি আলাদা করে মনোচিকিৎসকের কাছে যাবার পরামর্শ দিলেন না। হিতে বিপরীতও হতে পারত তাতে। ছেলেকে পাগল বলা হচ্ছে, এমন অভিমান করে বসতেন পোদ্দার। অতএব, নিজেই দায়িত্ব নিলেন তিনি। কথা বলা শুরু করলেন অনির্বাণের সঙ্গে। বোঝাতে শুরু করলেন, যা ঘটেছে তার জন্য নিজেকে অপরাধী ভাবার কিছু নেই। সে যে আত্মহত্যা করতে পারেনি, সে-ই বরং স্বাভাবিক। কারণ সুস্থ মানুষ স্বেচ্ছায় মরতে পারে না। তিনি বুঝিয়েছেন—দুঃখে মানুষ মরতে চায় ঠিকই। কিন্তু সেটা তার প্রকৃত বাসনা নয়। প্রাণীমাত্রই জীবনপ্রবণ। যে আত্মহত্যা করে, মনে রাখতে হবে, তার মধ্যে ওই প্রবণতা ছিল বলেই করেছে। তোমাদের বিয়ে হলে, বিয়ের পরেও কোনও দুঃখ, কোনও অশান্তি নিয়ে আহত হলে সে এরকম করতে পারত। তখন তোমার অবস্থা কী হত ভাব। বধূহত্যার দায়ে পড়তে তুমি। 

অনির্বাণ বলেনি, মৃত্যুর পথ বেছে নিতে প্ররোচনা সেও দিয়েছিল। জীবনের তীব্র টানে, এই কথা ভুলে যেতে চেয়েছিল সে। এই সকল সত্য গিলে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু তা সহজ ছিল না। জীবিত পূর্ণবয়স্ক মাগুর মাছ গিলে ফেলার মতোই তা কঠিন। 

প্রকৃত ঘটনা ডাক্তার নিয়োগীকে বলেছিলেন সুকুমার পোদ্দার। এবং টাইফয়েডের স্বীকৃতি দেবার জন্য, তথ্য গোপন করার জন্য প্রচুর ব্যয় করেছিলেন। সোনার মাদুলি গড়ার খরচের চেয়ে অধিক ছিল এই পরিমাণ। ডাক্তার নিয়োগী অতএব, সহানুভূতির সঙ্গে দেখেছেন গোটা ব্যাপারটাই। অল্প বয়সের অসহায় সিদ্ধান্ত, তাকে থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়ে দিয়ে লাভ কী, যখন সে শেষ পর্যন্ত জীবন নিয়ে ফিরেছে! থানা, পুলিশ, জেল, হাজত প্রভৃতির মধ্যে এই বেঁচে-ফেরা প্রাণটিও কি শুকিয়ে মরত না? যে গেছে, সে গেছে। তার জন্য থাক শোক, সহানুভূতি। কিন্তু যে আছে, তার জন্য জীবন আরাধনা করাই ধর্ম। অন্তত ডাক্তার নিয়োগী, এমন ধর্মই গ্রহণ করেছেন। যুগ্ম আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত তো আর খুনের সিদ্ধান্ত নয়। অতএব তিনি আলো জ্বেলে ঘুমোবার পরামর্শও দিয়েছেন। 

তা ছাড়া পর্যাপ্ত অর্থ ন্যায়-নীতি প্রয়োজনমতোই নির্ণয় করে নিতে পারে। এ-ও এক প্রাচীন জাগতিক ধর্ম। উৎকোচ চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকী কর্মতৎপরতাও ঘটায়। তা, উৎকোচ দোষের কি নির্দোষের। এ বলে দোষের। ও বলে দোষ কী! তাই মীমাংসা নেই। অতএব সুকুমার পোদ্দারের ব্যয় বৃদ্ধি এবং ডা. নিয়োগীর আয় বৃদ্ধি, এই দুইয়ের সমানুপাতে মসৃণ হতে থাকছিল অনির্বাণের জীবনপথ। 

মাদুলি পরার পর, আলো জ্বেলে শোবার পর, তুলতুলি আসেনি বেশ ক’দিন। বেঁচে থাকতে ব্যাকুল অনির্বাণ প্রেত তুলতুলির মৃত ঠান্ডা চোখের আতঙ্ক থেকে অব্যাহতি পেতে ডাক্তারের কথাগুলিকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেছিল। সত্যিই তো, তার অপরাধ কোথায়? সে তো বিয়ে করতেই চেয়েছিল। একবার রেজিস্ট্রি করে ফেললে সুকুমার পোদ্দারকে রাজি করানো যেত নিশ্চয়ই। নানান অজুহাতে সে-ই রাজি হল না। বলল— বাবার অপমান! 

প্রেমের বিয়ে কি কখনও নিষ্কণ্টক হয়? অপমান হয়। অপবাদ হয়। আবার মুছেও যায় সব। ডাক্তারই ঠিক। মৃত্যুর প্রবণতা ছিল তুলতুলির। সে গোড়া থেকেই বলত ‘মরে যাব’, ‘বাঁচব না’। জীবন কি এতই সহজ? তার জন্য একটু কাঠিন্য, একটু সংঘর্ষ সইতে হত না? 

অতএব সুকুমার পোদ্দারের ছেলে অনির্বাণ পোদ্দার অপরাধের কাঁটাগুলি তুলে তুলে ফেলে দিতে থাকল প্রতিদিন। সেরে উঠতে থাকল সে। মাসখানেক সময় নিয়ে তার চোখে একদিন নামল স্বাভাবিক ঘুম। রাতে বাতি নিভল। সুকুমার পোদ্দার ছেলের জন্য কিনে আনলেন নতুন মোটর বাইক। এবং ডাক্তার নিয়োগীর পরামর্শে ছেলেকে ব্যাপৃত করে দিতে চাইলেন কাজে। এমন কোনও কাজ যাতে অবসর থাকবে না। এবং নিজে সংযোজন করলেন আরও এক অভিজ্ঞতা। কাজের মধ্যে যদি নেশা ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, অর্থের নেশা, তা হলে কী-বা শোক, কী-বা দুঃখ, সকলই ভোলা যায়। 

রাস্তা বানানর অনুদান আসতেই লুফে নিয়েছিলেন সুকুমার পোদ্দার। এই কাজেই জড়িয়ে দিতে হবে অনির্বাণকে। দিয়েছেনও। তবু তুলতুলি অনির্বাণকে ছেড়ে গেল না। দীর্ঘদিন দর্শন না দিয়েও সে অপেক্ষা করে রইল কখন সুযোগ আসে। 

জীবনের এমনই টান, এমনই আকর্ষণ, সুখ-সম্পদের এমনই টান, এমনই আকর্ষণ, অনিৰ্বাণ নিজেও তুলতুলিকে ভুলে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। ডাক্তার নিয়োগীর কথা মতোই সে বুঝিয়েছিল নিজেকে, এটা তার জীবনের দুর্ঘটনা। ভাবাবেগ তাকে অন্ধ করেছিল। আর যে গেছে, তার জন্য গোপন শোকের আঁচ থাকুক কিছু-বা, যাতে বিবেক রক্ষা পায়, কিন্তু জীবনের স্বাভাবিক প্রাপ্তিগুলি তার জন্য স্থগিত হতে পারে না। জীবনের দাবি রক্ষা করাই ধৰ্ম। এ ধর্ম তাই রক্ষা করছে অনির্বাণ, তুলতুলি বিনাই। 

কে জানে মানুষ কখন অন্ধ, কখন চক্ষুষ্মান! যাকে ছাড়া বাঁচবে না এমন উপলব্ধি ছিল, সে-ই হয়ে উঠল জীবনের কাঁটা। সুস্থতার পর্বে অনির্বাণের শরীর জেগে উঠতে লাগল মাঝে-মাঝেই। লজ্জার মতোই এই জাগরণ। অতএব একদিন সে বলল—মা, আমি একা শুতে পারব এবার। 

একথা শুনে সুকুমার পোদ্দার বললেন—সম্বন্ধগুলোতে আবার যোগাযোগ করি? তুমি কী বলো? 

আসলে এমনই মনে হচ্ছিল তাঁর, অর্থের নেশার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যাক, আরও এক নেশা। তার নাম নারীদেহ। এক নারী বিপর্যস্ত করেছে তাকে, অপর নারী আত্মস্থ করবে। ডাক্তার নিয়োগীর পরামর্শ নিয়েছিলেন। বলেছিলেন—অনির্বাণ যদি রাজি থাকে, নিশ্চয়ই বিয়ে হতে পারে। 

সুমিত্রা বলেছিলেন—আমার আপত্তি নেই। তবে এক বছরও কাটল না মেয়েটা মরেছে!

সুকুমার পোদ্দার বলেছিলেন—আমাদের কি একবছর শোক পালন করার কথা?

—না। তা নয়। লোকে কী বলবে? 

—লোকে এখন যা বলবে, পরেও তা-ই বলবে! তা ছাড়া সম্বন্ধ দেখলেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। 

—ছেলের একটা মতামত আছে। 

এই প্রথম সুকুমার পোদ্দার কারও মতামতের অপেক্ষা করেছিলেন। বলেছিলেন— বেশ। অনুকে জিগ্যেস করো। 

বৈশাখে দশপুতুলের ব্রত করেছিলেন সুমিত্রা। কুমারীর পালনীয় এ ব্রত। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে এয়োতিরাও এ ব্রত করতে পারেন। তাঁর কামনা ছিল। ছেলের যেন একটি লক্ষ্মীমন্ত বউ হয়। ছেলে যেন সুখে থাকে। 

প্রতি পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণের পূজা করেছেন। সেখানেও একই কামনা করেছিলেন। ঘরে তাঁর লক্ষ্মী বাঁধা। সেই লক্ষ্মী যেন পুত্রবধূতে বসত করেন। এখন সেই কামনার ধন খোঁজার পালা। তাঁর মন আনন্দে ভরে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু মানুষের মনের গতি বড় বিচিত্র। নিজের মনের প্রকৃতি বোঝা মানুষের নিজেরও সাধ্য নয়। আনন্দের পরিবর্তে সুমিত্রার মন বিষণ্ণ হয়ে উঠল। তুলতুলি নামের মেয়েটিকে স্মরণ করে সকলের অগোচরে চোখে জল এল তাঁর। কী হত মেয়েটিকে বধূ করলে! তাঁদের তো, ঠাকুরের কৃপায়, অর্থের অভাব নেই। না হয় আসতই দরিদ্রের মেয়ে। অসবর্ণ বিবাহ, অসামঞ্জস্যের বিবাহ তো কতই হয়। হিন্দু-মুসলমানে অবধি বিয়ে করে সুখে সংসার করছে! 

বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে তাঁর। নিজের মনের অগোচরে পাপ নেই। তিনি তো জানেন, অনুও সঙ্গে ছিল। দু’জনেই পরামর্শ করে মরতে গিয়েছিল। কিছু দায় তাঁদেরও রয়ে যায়। অস্বীকার করলেও, উচ্চারণ না করলেও পাপের অংশ এসে লাগে। লাগে না? এই পাপের শাস্তি কোন রূপে সংসারে প্রবেশ করবে কে জানে! এবং এই ভাবনা এই আক্ষেপ গোপন করতে বুকে পাথরচাপা দিয়ে রাখেন তিনি। আহা! সেই মেয়েটিও তো ছিল এক মায়ের বুকের সন্তান! যদি অনুও চলে যেত অমনি করে! কী করে সইতেন তিনি! তুলতুলির মায়ের তো আরও দুটি আছে। তাঁর যে ওই একটিই ধন 

তবু, আশ্চর্য স্পৃহায় আশা করেছিলেন তিনি, অনির্বাণ এখন বিবাহ করতে চাইবে না। সেই বিশ্বাসেই বলেছিলেন- তোর বাবা বলছিলেন, পুরনো সম্বন্ধগুলো আবার দেখবেন। 

অনির্বাণ নীরব ছিল। সে ভাবছিল, সম্বন্ধ, মানে বিবাহ, মানে এক নারী। চকিতে তার মনে ভেসে উঠেছিল একজোড়া ধবল স্তন। ছোট ছোট দুটি বর্তলে বাদামি শীর্ষ। তার দেহে শিরশিরানি উঠেছিল। পুরুষাঙ্গে টান ধরেছিল। সে নীরব ছিল। 

সুমিত্রা আবার বলেছিলেন—তোর মত থাকলে তবেই…! 

তিনি কথা শেষ করেননি। অনির্বাণের চোখ দুটি জ্বলে উঠে তাঁকে থামিয়ে দিয়েছিল। তিনি জানেন, কোন ভাবনা ছিল তার চোখের ঝলকে—আজ তোমরা আমার মতের অপেক্ষা করছ মা! 

তিনি অসহায় বোধ করছিলেন। এই ভাবনায় ভুল কিছু নেই। তিনি বলতে যাচ্ছিলেন— তোর মনের অবস্থা আমি বুঝি বাবা। তবু, বিয়ে তো করতেই হবে। 

কিন্তু বলা হল না। তাঁকে বোঝাবার কোনও সুযোগ না দিয়ে অনির্বাণ বলল— কোথায়?

সুমিত্রা নির্বোধের মতো বললেন— কী? কী কোথায়? 

—সম্বন্ধ! 

সুমিত্রা হাসলেন। ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন—সে অনেক আছে। কেন?

অনির্বাণ, একটু থেমে, মুখ নিচু করে বলেছিল—কাছাকাছি দেখো না মা। 

সুমিত্রা থমকে গিয়েছিলেন। এক চিরকালের নারী জেগে উঠেছিল তাঁর মধ্যে। সে চিরকালের পুরুষকে কঠোর সমালোচনা করেছিল। পুরুষ, তোমাকে কখনও বিশ্বাস করতে নেই। তোমরা হৃদয়হীন। এই তোমাদের ভালবাসা? ছিঃ! শোকের পর্ব তোমরা এত তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যাও! ভুল আমাদের। তোমাদের নইলে আমাদের চলে না। তোমাদের জন্য আমরা সর্বস্ব দিই, মুখে রক্ত তুলে জীবনপাত করি। মরি আমরা তোমাদের জন্য। কিন্তু তোমরা? তোমরা এক পুরুষ, অন্য পুরুষের থেকে তফাত নও। সুকুমার পোদ্দারের ছেলে অনির্বাণ পোদ্দার, তোমাকে আমি গর্ভে ধরেছি তো কী! তুমি তোমার বাপের মতোই কঠোর, হৃদয়হীন, স্বার্থপর। 

তাঁর সংলাপ শোনা যায়নি। তাঁর সকল বাক্য নিরুচ্চারিত থেকেছে অন্তরে। পুরুষের প্রতি কিছু ঘৃণা কোন নারী পোষণ করে না হৃদয়ে! 

.

এতকিছু ঘটছিল যখন, তখনও তুলতুলি অনির্বাণকে ছেড়ে যায়নি। সে তার স্থির মৃত দৃষ্টি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। কেননা, গভীরতম প্রেম প্রতারণা জানে না। মিলনের আকাঙ্ক্ষায় সে চিরতৃষার্ত। তারা, অনির্বাণ ও তুলতুলি, কোনও ঘনিষ্ঠ নিভৃত মুহূর্তে বুঝি বা নিষ্পাপ অঙ্গীকার করেছিল, কেউ কারওকে ছেড়ে যাবে না কোনওদিন। অতএব তুলতুলি, দেহাতীত প্রেমে ঋদ্ধ, অনির্বাণকে ঘিরেছিল। কিন্তু হায়! ইহকাল নিজেকে নিজের রুচিমতো সাজিয়ে নিতে চায়। যেমন চাইছেন বুদ্ধিমান প্রভাবশালী সুকুমার পোদ্দার। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি অনির্বাণের জন্য বিবাহ মনস্থ করছেন। চিকিৎসকের মতে তাঁর মত আছে। এই বয়সে ছেলে-মেয়ে পরস্পরের প্রেমে পড়ে। কেন পড়ে? যৌন তাড়নায়। সে তাড়না বশ করলে দেহ বশ, চিত্ত বশ। তাঁর একমাত্র সন্তানের জীবন তিনি এলোমেলো করতে দেবেন কী প্রকারে? অতএব, সকল কর্ম হেলায় ঠেলে বৈশাখের শেষাশেষি সুকুমার পোদ্দার তাঁর শ্যালক এবং স্বয়ং অনির্বাণকে নিয়ে গিয়েছিলেন পাত্রী দেখতে মালদহ শহরে। 

শিক্ষিত পরিবার। পাত্রীর বাবা পঞ্চানন্দপুরে একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ভাল জমিজমা আছে। দুই ছেলে মালদহ শহরে দোকান দিয়েছে। ইতিমধ্যেই সেগুলি প্রতিষ্ঠিত। বড় জামাই স্কুল-শিক্ষক। তা ছাড়া ভদ্রলোক গ্রামের একজন মাথা। দলীয় মতবাদেও মিলেছিল। তিনিও সি পি আই এম সদস্য। হেডমাস্টারদের সংগঠনেরও একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। 

সবদিক বিচার করলে এর চেয়ে ভাল আর কিছুই হতে পারত না। মেয়েটিও ছিল উচ্চমাধ্যমিক পাশ। দেখতে-শুনতে ভাল। সম্পূর্ণ পাল্টি ঘর। 

মাস্টারমশাইয়ের মালদহের বাড়িতেই পাত্রী দেখার আয়োজন হয়েছিল। প্রথমদিকে সবই ঠিকঠাক চলছিল। পরস্পর বৈবাহিক হতে চলেছেন, এমনই ভাবনায় হাসি-ঠাট্টা চলছিল। মিষ্টির রেকাবে সজীব মিষ্টি, সুগন্ধী চা এবং একই দিয়াশলাই কাঠি থেকে ধরানো সিগারেট। এমনই খাপে খাপে মিলে যাওয়া সব—এ বিয়ে হবেই, ধরে নেওয়া যায়! শেষ পর্যন্ত, পাত্র-পাত্রী নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিক, এই আধুনিক অনুপ্রেরণায় ঘরে দু’জনকে রেখে অভিভাবকরা বাইরে এলেন। পাত্রীর বউদিদিরা রইলেন আশে-পাশে। অনির্বাণ দুটি প্রশ্ন করার জন্য নতমুখী মেয়েটির দিকে তাকাল। প্রশ্নগুলি সে ভেবে এসেছিল আগেই। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজে পড়লে না কেন, ইত্যাদি সব মামুলি বিষয়। কিন্তু মেয়েটির সঙ্গে একলা ঘরে থেকে, চোখ তুলে তাকাতেই সে দেখতে পেল তার লম্বা বিনুনি, দুই ভ্রূর মাঝখানে ছোট টিপ, ফরসা হাত, সরু আঙুল! তার কাঁপুনি ধরে গিয়েছিল। এবার মেয়েটি তাকাল তার দিকে। ঠান্ডা, মৃত চোখ। সে চোখে উদ্দীপনা নেই। কেবল শীতল পিপাসা। সহসা চিৎকার করে উঠেছিল অনির্বাণও কে? ও কে? ও কে? 

ভয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল মেয়েটি। ছুটে এসেছিলেন অভিভাবকেরা। দেখেছিলেন অনির্বাণ দু’হাতে মুখ ঢেকে থর থর করে কাঁপছে। ওই গরমেও তার হাত-পা ঠান্ডা। মুখ সাদা। সুকুমার পোদ্দার ছুটে এসে ঝাঁকিয়েছিলেন তাকে কী হয়েছে অনু? কী হয়েছে? কী বলছিস তুই? 

মেয়েটিকে নিয়ে ঘরে চলে গেছেন তার বউদিদিরা। অভিভাবকেরা দাঁড়িয়ে আছেন বিমূঢ়। অনির্বাণ বাবাকে আঁকড়ে ধরে বলেছিল—ও, ও, ও এসেছিল। আমি দেখলাম। স্পষ্ট দেখলাম! 

—কেউ নেই। কোথায় কে? কোথায়? 

কোথাও ছিল না। কোথাও ছিল না সে। যে যায়, সে যায়। সে কি আর আসে! সে তাকিয়েছিল ফ্যালফ্যাল করে। দারুণ স্নায়বিক ক্ষমতার অধিকারী সুকুমার পোদ্দার পাখার তলায় দাঁড়িয়েও ঘেমে যাচ্ছিলেন। তাঁর স্নায়ু দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। পাত্রীর বাবা পোদ্দারের শ্যালককে আড়ালে ডেকে ধমকালেন— ছিঃ! এত বড় সর্বনাশ করছিলেন আমার মেয়ের! 

শ্যালক নিরুপম রায় কোনওক্রমে বলেছিলেন—না, না। বিশ্বাস করুন! 

—কী বিশ্বাস করব? 

বলছিলেন হেডমাস্টার। 

—জানেন আপনাদের পুলিশে দেওয়া উচিত? পাগল ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে এসেছেন।

কিছুই বলার ছিল না তাঁদের। অনির্বাণের আচরণকে পাগলামি ছাড়া আর কী বলা যায়? 

.

ফেরার পথে সুকুমার পোদ্দার কিছুই বলেননি ছেলেকে। শুধু ডাক্তার নিয়োগীকে খবর দিয়েছিলেন। সব শুনে গালে হাত দিয়েছিলেন সুমিত্রা। এ কী হল! ছেলে তো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গিয়েছিল। তা হলে কি মটরমালা দেওয়া হয়নি বলে সতীমা রুষ্ট হলেন? 

এক সন্ধ্যায় সতীমায়ের দুয়ারে দাঁড়ালেন তিনি। ভর যখন পড়ে না তখন শিখারানি আর পাঁচজন সাধারণ নারীর মতোই। পুজো-আচ্চা করে। শেকড়-বাকড় দেয়। নিমের জল ছাড়াও এখন তার সংগ্রহে আছে বেলের শেকড়, শ্বেত অপরাজিতা, শ্বেতবেড়েলা, লজ্জাবতী, অশ্বগন্ধা, তুলসীর শেকড়। এইসব শেকড়ের ধারণাও তাকে এনে দিয়েছে অলক। সীমান্ত পেরিয়ে আসা একটি পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা জমেছে তার। পরিবারের সকলেই কিছু কিছু কবিরাজি চর্চা করে থাকে। নতুন এসেছে বলে লোকে এখনও তাদের বিশ্বাস করে না। ধর্না দেয় না দোরে। তারা যে এক বিদ্যার অধিকারী, তারও প্রচার হয়নি এখনও। 

পুরনো বসত ছেড়ে নতুন বসত করতে আসে যারা, নতুন মাটির সঙ্গে ভাব জমানো তাদেরই দায়। পূর্ণ চক্রবর্তী নামে এই মানুষটি একেবারে দীন-হীনের মতো এসে বসবাস শুরু করলেও তাঁর চোখ দেখলে বোঝা যায়, তাঁর অন্তরে বাস করে এক ধূর্ত পুরুষ, যে ক’দিনেই নিজের স্থায়ী জায়গা কায়েম করে নেবে। 

পূর্ণ চক্রবর্তী রোগা, ক্ষয়াটে। ক্ষয়াটে কারণ নিত্য শিবের পূজক চক্রবর্তীর গাঁজা সেবনের অভ্যাস আছে। কিন্তু সে যখন-তখন নয়। সন্ধ্যাহ্নিকের পর। এটুকু ছাড়া চক্রবর্তী সৎ ব্রাহ্মণ। তাঁর মাথায় শিখা আছে। গলায় আছে ঝকঝকে পইতে। পূজা-পদ্ধতি তিনি জানেন ভাল। এখানে আসার পর নিত্য গঙ্গাস্নান করে তিনি পইতে মাজেন। ইদানীং সুকুমার পোদ্দারের গৃহে সকল পূজা তিনিই করছেন। সেদিক থেকে অলক ঘোষালের প্রতিযোগী হয়ে উঠছেন তিনি। এবং এই প্রতিযোগিতায় তিনি হেরে যাবেন না নিশ্চিতই, কারণ বংশ-পরম্পরায় চালকলা বাঁধা বামুন তিনি। দীর্ঘ সময় ধরে করা পূজা তাঁর, সংস্কৃত উচ্চারণ সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ না হলেও কথায় কথায় সংক্ষিপ্ত পূজা পদ্ধতির পাতা তাঁকে ওলটাতে হয় না। 

এই সমস্ত কারণেই অলকের চিন্তিত হয়ে ওঠা উচিত ছিল। কিন্তু তার পরিবর্তে পূর্ণ চক্রবর্তীর আগমনে এবং ক্রমশ গড়ে ওঠা নিবিড়তর ঘনিষ্ঠতায় সে পুলকিত। এই পুলকের কারণ পূর্ণ চক্রবর্তীর যুবতী মেয়ে বর্ষা। বা বরষাও তাকে বলা চলে। নিত্যকার আটপৌরে উচ্চারণে সে বস্সা হয়েই থাকে অধিক সময় 

অলক সহজেই বর্ষা মেয়েটির সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে উঠছে। পূর্ণ চক্রবর্তী এবং তাঁর স্ত্রী ঊষার সম্পূর্ণ সমর্থন আছে এই অন্তরঙ্গতায়। 

চতুষ্কোনা গ্রামে এখন ব্রাহ্মণ পরিবার দুটি। পূর্ণ চক্রবর্তীর পরিবার থেকে শিখে আসা গাছ-গাছড়ার বিদ্যে অলক শিখারানিকে দিচ্ছে কিছু-বা, কিন্তু তার লক্ষণ বেচাল। 

সুমিত্রা সতী-মায়ের দুয়ারে দাঁড়িয়ে বললেন—কী অপরাধ করেছি মা? 

শিখারানি ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। গ্রামের সকল মহিলাকে সে সম্বোধন করে মা বলে, সকল পুরুষকে বাবা। এগুলো সবই দস্তুর। এগুলো করতে হয়। সে বলেছিল—আসুন মা। ঠান্ডা হয়ে বসুন। কেমন আছেন? 

—আমার আর ভাল কী মা! আমার ছেলে ভাল না থাকলে আর আমার কী! 

—কী হয়েছে মা! 

–ছিল ছিল ভাল ছিল। সেই পাপাত্মা যে ছাড়ছে না তাকে। 

শিখারানি একটু ভেবেছিল। খুব সাবধানে এই ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তার যে কাজ, তাতেও দরকার মেধাবৃত্তি। দরকার স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা। কখন কাকে কী বলেছিল, তা স্মরণ রাখতে হয়। বিপরীত কিছু হলে মুশকিল। এক্ষেত্রে সেকাজ আরও কঠিন। কারণ সতীমায়ের করুণাভিখারী স্বয়ং পোদ্দার-গৃহিণী। যাঁকে ভক্ত হিসেবে মনে মনে কতই না চেয়েছে শিখারানি। সে বলেছিল—একটা স্পষ্ট কথা বলুন মা। কিছু লুকোবেন না। 

সুমিত্রা মনে মনে সতর্ক হয়েছিলেন। কী জানতে চাইবে এই মেয়ে! কে জানে! অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন এরা! মানস চোখে হয়তো দেখে নেয় সত্য। কিন্তু বুক বেঁধেছিলেন তিনি। কখনও স্বীকার করবেন না তুলতুলির সঙ্গে ছিল অনির্বাণ। মুখে বলেছিলেন—বল মা। তোমার কাছে তো কিছু লুকোবার নেই। 

—আমাদের বাবাকে কে জ্বালাতন করছে? কোনও মেয়ের আত্মা? 

তুলতুলির সঙ্গে অনির্বাণের প্রেম এবং তার পরিণতি শিখারানির অগোচর ছিল না। এই এত বৎসর ধরে লোকচরিত্র নাড়াচাড়া করে সে-ও এখন অভিজ্ঞ। পাকাপোক্ত। সে নিশ্চিত ছিল আঘাত লেগেছে সঠিক জায়গায়। 

শিখারানির প্রশ্ন শুনে সুমিত্রাও হাঁপ ছেড়েছিলেন। যাক, মোক্ষম প্রশ্নটি করেনি তা হলে। তিনি বললেন—মা, তোমার তো কিছু অগোচর নেই। 

শিখারানি কোনও কথা না বলে ধ্যানে বসেছিল। লাল পাড় শাড়ি পরা, হাতে শাঁখা-পলা, এতদিনের প্রচেষ্টায় নির্ভুল পদ্মাসন, জটাজুট ভরতি চুল এলায়িত। একপাশে জড়ো করা ফুল- বেলপাতার গন্ধ, পুজোঘরের চন্দন, ধূপ, ধুনো ও গুম্বুলের অন্তর স্নিগ্ধ করা ঘ্রাণ, কোণে রাখা বামনহাটি, ক্ষীরিকা, শ্বেতবেড়েলা, অশ্বগন্ধা প্রভৃতির মূল, কাণ্ড, শাখা হতে নিঃসৃত সোঁদা গন্ধ—সব মিলে পুরনো এই ঘরটিতে শান্তির সৌরভ জাগায়। হৃদয়ে কী এক আস্থা জেগে ওঠে। পীড়িতের, তাপিতের অস্থির চিত্তের ওপর শীতল শ্বেতচন্দনের প্রলেপের মতো বিশ্বাস বিছিয়ে যায়—আছে! সেই শক্তি আছে! অলৌকিক অপার্থিব শক্তি! তার ওপর শিখারানি যতখানি সম্ভব একজন নিখুঁত পূজারিণী! সুমিত্রার মনে ভক্তিভাব জেগেছিল তাকে দেখে। ভরসা বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিছুক্ষণ সম্পূর্ণ নীরবতা। একসময় চোখ খুলল শিখারানি। অপলক সুমিত্রার দিকে তাকিয়ে বলল—ছেলের বিয়ে দেবেন মা? 

সুমিত্রা বিস্মিত হলেন। গদগদ হয়ে উঠলেন ভক্তিতে। কী ক্ষমতা! কী আশ্চর্য ক্ষমতা! তিনি প্রণত হয়ে বললেন-ছেলের বিয়ে কি দিতে পারব না মা? 

—পারবেন না কেন? 

শিখারানি আশ্বাস দিল। 

—তবে কিছু যজ্ঞ করতে হবে। পাত্রী দেখুন। ছেলের বিয়ে ঠিক করুন। বাকিটা আদেশ জানতে হবে মা। 

—সে কবে হবে মা? 

—সতীমায়ের কৃপা হলে আদেশ করবেন। 

শিখারানি সময় নিয়েছিল। এ নিয়ে অলকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। সুমিত্রা শিখারানির আশ্বাস পেয়ে উঠেছিলেন। ঢিল খোলার কথা ভাবেননি। আরও দেখতে হবে। ছেলেটা বিয়ে করুক। থিতু হোক। সুকুমার পোদ্দারের গৃহিণী তিনি, সঙ্গদোষেই পেয়ে গেছেন চাতুর্য কিছুটা। তিনি জানেন, ভক্তি ভাল। ভক্তি প্রয়োজনীয়। কিন্তু হাত খোলার আগে বুঝে-শুনে নেওয়া দরকার। কাছা-খোলা ধরন হলে সংসারি লোকের হল না। সেসব বিবাগী মানুষের সাজে। 

গাঁয়ের সকল পথে শহরের মতো আলো নেই। দুটি আলোর মধ্যবর্তী অন্ধকার বৃহৎ। সেই অন্ধকার পথে চলতে চলতে সুমিত্রার মনে হয়েছিল, একা আসা ঠিক হয়নি। বৈশাখের তারা জ্বলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়েও ভয়ে তাঁর গা ছমছম করছিল। হঠাৎ মনে হল, একটি শাড়ি-পরা অল্পবয়সি মেয়ে তাঁর সামনে সামনে চলেছে। তিনি ডাকলেন—কে গো তুমি! দাঁড়াও একটু। 

মেয়েটি দাঁড়ায়নি। তিনি হাঁটার গতি বাড়ান। সেই মেয়েটিও গতি বাড়াল। কিছুদূর যাবার পর হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, এ কোন পথে এসে পড়েছেন তিনি! এ তো তাঁর বাড়ির পথ নয়। তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। কিছু দূরে ওই যে অন্ধকারে ঢাকা বিষণ্ণ বাড়িটি, এ তো সহদেব দাসের বাড়ি। এখানে কে নিয়ে এল তাঁকে! ভয়ে তাঁর গলা শুকিয়ে গেল। তবু কী এক অমোঘ আকর্ষণে এক-পা এক-পা করে তিনি বাড়িটির কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালেন। আশে-পাশে কেউ নেই। এমনকী সেই মেয়েটিও উধাও। তাঁর কানে এল চাপা একঘেয়ে কান্নার স্বর। কোনও ছেদ নেই, উত্থান-পতন নেই, একটানা নিরবচ্ছিন্ন অনন্ত বিলাপ। সুমিত্রা কানে হাত চাপা দিলেন। তারপর এই বয়সেও, ভারী শরীরে ছুটে চললেন পথ দিয়ে। প্রলাপের মতো বলতে থাকলেন—আমাদের ক্ষতি করিস না মা। আমাদের ছেড়ে দে। দুটি পায়ে পড়ি তোর। ছেলেটাকে ক্ষমা করে দে মা। ও বেঁচে থাক। তোর পায়ে পড়ি মা। ছেলের মা হয়ে তোর পায়ে ওর প্রাণভিক্ষা চাই। মা রে! আমি নিজে কর্তাকে নিয়ে যাব গয়ায়। তোর সৎকারের ব্যবস্থা করব। 

সেদিন বাড়ি ফিরে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন সুমিত্রা। অজ্ঞান অবস্থায় আঁ-আঁ করে চিৎকার করেছিলেন। চোখে-মুখে ঠান্ডা জল ছিটিয়ে, পাখার তলায় শুইয়ে তাঁর জ্ঞান উদ্ধার করা হয়েছিল। নানাভাবে তাঁকে জিগ্যেস করা হয়েছিল, কী হয়েছে, কী দেখে তিনি এত ভয় পেয়েছেন! তিনি বলেছেন— সাপ! বিশাল এক দুধগোখরো! তার গায়ে পা পড়েছিল আর কী। 

রাত্রে সত্যি কথা বলেছিলেন কেবল স্বামীর কাছে। 

—শুনছ, আজ আমি ওকে দেখেছি। 

সুকুমার পোদ্দার বুঝতে পারেননি। বলেছিলেন-কাকে? 

—অনু যাকে দেখতে পায়। 

—সহদেব দাসের মেয়েকে? তোমারও কি মাথা খারাপ হল নাকি সুমিত্ৰা? 

সুকুমার পোদ্দার উত্তেজিত হয়েছিলেন। সুমিত্রা কাতর স্বরে বলেছিলেন—বিশ্বাস কর! আমি দেখেছি! 

হ্যাঁ। এখন আমাকে ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-রাক্ষস-খোক্কস সব বিশ্বাস করতে হবে। আবার ঠাকুরমার ঝুলি পড়া শুরু করি না কেন! পক্ষীরাজ ঘোড়াও দেখতে পাব তা হলে। 

বিশ্বাস করছ না? আমিও করতাম না। ভাবতাম অনুর মনের বিকার। 

—হ্যাঁ বিকার। মনের বিকার। তুমি যা দেখেছ, শুনে রাখো, তোমারও বিকার। তোমাদের দু’জনকেই এবার পাগলা গারদে না পাঠিয়ে আমার উপায় নেই। 

—তুমি বিশ্বাস করো। সে আমাকে পথ ভুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সহদেব দাসের বাড়ির কাছে। 

সুকুমার পোদ্দার চুপ করে ছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর ঠান্ডাভাবে বলেছিলেন—অনুর মতো তোমারও মন দুর্বল হয়েছে সুমিত্রা। মেয়েটার মৃত্যুর জন্য তুমিও হয়তো মনে মনে আমাকে দুষছ। এসব তোমার দুর্বল মনের প্রমাণ। 

—না না বিশ্বাস করো। 

সুমিত্রা বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর কঠিনহৃদয় স্বামীর কথাগুলির মধ্যে কোথাও বেদনার আভাস ছিল, যা তাঁকে স্পর্শ করেছিল। তিনি বলেছিলেন—না। আমি দুষছি না তোমাকেই। তবু একটা মেয়ের জীবন তো চলে গেল। কপালজোরে আমাদের ছেলেটা ফিরেছে। 

—দেখো সুমিত্রা, আমার কথা শুনে কেউ আত্মহত্যা করবে ভাবলে তো কোথাও নিজের মত দেওয়া চলবে না। সব জায়গায় অন্যের মতেই আমাকে চলতে হবে। ভাব তো, ওই মেয়ে যদি তোমার ঘরে বউ হয়ে এসে আত্মহত্যা করত তবে কী হত! আমরা সবাই জেলে যেতাম। 

—মা গো! 

—মন শক্ত করো সুমিত্রা। মনের দুর্বলতার সুযোগেই সংসারে অমঙ্গল ঢোকার সুবিধে পায়। ধৈর্য ধরো। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছুদিন একা একা চলাফেরা কোরো না। সঙ্গে লোক রাখো। 

সুমিত্রা বুক বেঁধেছিলেন। হয়তো স্বামীর কথাই ঠিক। এ সবই তাঁর মনের ভুল। সত্য গোপন করলে প্রচণ্ড চাপ পড়ে শরীরে-মনে। কেবলই মিথ্যার বুনোট দিয়ে চলতে চলতে, হতে পারে, তাঁর দুর্বল চিত্ত ভুল দেখেছিল। ডাক্তার নিয়োগী সব শুনে বলেছিলেন—মেয়েটি আপনাদের বাড়িতে আসত? 

তিনি বলেছিলেন—না। 

—তার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হত আপনার? 

—না। 

—তার চেহারা পরিষ্কার মনে আছে তো? ছবির মতো? 

—ছবির মতো? আসলে অনেকদিন তো দেখিনি। শাড়ি ধরেনি যখন এধার ওধার খেলে বেড়াত, দেখতাম। পরে তো আর সেরকম… 

—দেখুন, আপনি যা দেখেছেন, তার সবটাই মনের কল্পনা। যদি মেয়েটিকে সম্পূর্ণ মনে থাকত আপনার, আপনি তার মুখ দেখতে পেতেন। মনে ছিল না বলেই আপনি তাকে পেছন থেকে কল্পনা করেছেন। 

এত সব ব্যাখ্যা সত্ত্বেও পোদ্দার-গৃহিণী আবার গিয়েছিলেন সতী মায়ের থানে। গিয়ে আদ্যোপান্ত বলেছিলেন। শিখারানি বলেছিল— আপনার বাড়িটা বেঁধে দিয়ে আসতে হবে মা। তাতেও ওই আত্মা দূর করা যাবে না। কিন্তু গৃহ সুরক্ষিত হবে। আপনি ছেলের বিয়ে ঠিক করুন। আত্মা চিরকালের জন্যে তাড়ানর পথ আমি পেয়েছি। 

সুমিত্রা বলেছিলেন—কী করতে হবে আমাকে মা? 

—সামান্য খরচপত্র আছে। অলক সব বুঝিয়ে দেবে। আর এই বিষ্যুদবারে রাত্রি বারোটায় আপনাদের বাড়ি যাব আমি। বেঁধে দিয়ে আসব। 

—কী কী লাগবে মা? 

যা লাগবে, সব আমি নিয়ে যাব। আপনি শুধু আনবেন আপনার আর আপনার ছেলের পাঁচ-ছ’গাছি করে চুল। গোপন অঙ্গের চুল লাগবে কিন্তু মা। 

কাজটা সহজ ছিল না পোদ্দার গৃহিণীর পক্ষে। এতকিছুর আয়োজন করা। স্বামীকে সম্মত করা। ছেলেকে বোঝানো যৌনকেশ প্রয়োজন এই কাজে। কিন্তু ছেলের মঙ্গলের জন্য বুক বাঁধলেন তিনি। গরজ বড় বালাই। নিজেকে বোঝালেন—যাকে জন্ম দিলেন, নিজের হাতে যাকে একটু একটু করে গড়ে তুললেন, সেই সন্তান, সেই নাড়িছেঁড়া ধন, সে তো আমারই অংশ। তাকে লজ্জা কীসের! অতএব, ছেলেকে বললেন- বাবা, তোর ভালর জন্যই এসব করা। স্নান ছেড়ে বেরোবার আগে দিস। মায়ের কাছে লজ্জা নেই। 

বললেন ঠিকই, তবু সংগ্রহ করতে গিয়ে লজ্জায় নিজেরই শরীর উত্তপ্ত হয়ে উঠল। মন শক্ত করে সকল করলেন। শিখারানি যেমন বলেছিল, সেরকমই ব্যবস্থা হয়েছিল। রাত্রি সাড়ে এগারোটায় অলককে সঙ্গে নিয়ে এল শিখারানি। তার চুল খোলা। জটাজুটে ভারী সেই চুল দেখলে ভরসা জাগে। ত্রাসও। কপালে মস্ত তেলসিঁদুরের টিপ। এই প্রথম পোদ্দারের বাড়িতে এল সে। বড় দালানের দোতলা বাড়ি। জিনিসপত্রে ঠাসা। একটি থালায় একপাত্র জল, সর্ষের দানা ও জ্বলন্ত প্রদীপ নিয়ে সে সারাবাড়ি ঘুরেছিল। প্রতিটি ঘর। ঘরের প্রতিটি কোণ। বৈদ্যুতিক আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার আদেশে। সে ঘুরছিল আর দেখছিল। কত জিনিস এঁদের! কী প্রাচুর্য! এ দিনের কাজের জন্য সে নিয়েছিল পাঁচশো টাকা। পোদ্দারের প্রাচুর্যের কাছে পাঁচশো টাকা কীই বা! তাই ভূত তাড়ানোর শেষতম পদ্ধতি, যা তুলে রাখা আছে, তার জন্য অলক দাবি করেছে তিন হাজার টাকা। সুমিত্রা রাজি হয়েছেন এই টাকা দিতে। 

.

সেদিন সারা বাড়ির কোনায় কোনায় জল আর সর্ষে ছড়াল শিখারানি। নির্দেশ দিল— তিনদিন এইগুলি ঘরে থাকবে। তিনদিন ঘরে ঝাড়ু পড়বে না। 

এরপর শুরু হল ঘর বাঁধার কাজ। দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ এ কাজ। তিনহাজার টাকার প্রতিশ্রুতিসমেত পাঁচশত টাকা পারিশ্রমিক নিলে একটু সময় সাপেক্ষ করতেই হয় গোটা পদ্ধতি। শিখারানি প্রথমে বাড়ির পূর্বদিক আন্দাজ করে একটি পেরেক পুঁতে দিল বাড়ির বহির্ভাগে। সঙ্গে মা ও ছেলের চুল। অলক একটি কাঠি পুঁতল পাঁচিল ঘেঁষে। শিখারানি সেই কাঠিতে সুতো প্যাঁচাল। এবার সুতো টেনে নিয়ে চলল বাড়ির চারপাশ ঘিরে। উত্তরকোণে থেমে আরও একটি পেরেক পুঁতল। পেরেকের সঙ্গে মা ও ছেলের চুল। আবার সুতো এগিয়ে চলেছে। বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছে সে। ভূতনাথ-ভূতনাথ শোনা যাচ্ছে। সতীমা-সতীমা শোনা যাচ্ছে। বাকি সব অস্পষ্ট। 

.

বাড়ির চতুর্দিকে পেরেক পোঁতা হল। সুতো টেনে বেঁধে দেওয়া হল কাঠিতে। ব্যস। সম্পন্ন হল বন্ধন। দুরাত্মা যতই চেষ্টা করুক, বাড়ির লোক থাকবে সুরক্ষিত। এবং এমনই গুণ শিখারানির বন্ধনের, আজ তিনমাসকাল যাবৎ অনির্বাণ আর তুলতুলি দর্শন করেনি। সুমিত্রাও করেননি। একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে উঠেছেন সকলেই। আত্মা সম্পূর্ণ তাড়ানো হয়ে গেলে শেফালি গাছের ঢিল খুলে সোনার মটরমালা দেবেন সতীমাকে সুমিত্রা। নিত্য কুণ্ডুর কাছে সেই মটরমালা বায়না করাও হয়ে গেছে। 

সুকুমার পোদ্দার পাত্রী দেখছেন। কিন্তু পাত্রী দেখতে আর নিয়ে যাচ্ছেন না অনির্বাণকে। অনির্বাণ মেনে নিয়েছে এই ব্যবস্থা। অনেক দেখেশুনে কীর্ণাহারের একটি পাত্রীকে নির্বাচন করেছেন সুকুমার পোদ্দার। একেবারে কীর্ণাহারের তা বলা যাবে না। কীর্ণাহার থেকে বাসে আরও দেড়ঘণ্টার যাত্রাপথ। বীরভূমের আরেক প্রান্তের অজগ্রাম হেমকলস। পাত্রীর বাবা ভূস্বামী। কিন্তু ইনিও স্কুলের মাস্টার। কীর্ণাহারেই একটি স্কুলে পড়ান। প্রত্যহ আলপথে আধঘণ্টা হেঁটে বাস ধরেন। কারণ বাসরাস্তা থেকে গ্রামে ঢোকার কোনও অন্য পথ নেই। এককালে সক্রিয়ভাবে বাম রাজনীতি করেছেন। এখন আর সেসবে নেই। তবে গ্রামে তিনি একজন মান্য ব্যক্তি। প্রাণেশ রায় নামে এই ব্যক্তির দুটি ছেলে, মেয়েও দুটি। বড় ছেলে মেধাবী। যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। পাত্রী বড়মেয়ে। কীর্ণাহার থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছে। ছোট মেয়ে তৃতীয় সন্তান। সে একাদশে পড়ে। ছোট ছেলে নবম শ্রেণির ছাত্র। 

অন্য কোনও দিকে না আটকালে আর কিছুদিনের মধ্যেই এখানে সম্বন্ধ পাকা করবেন সুকুমার পোদ্দার। তাঁর কোনও দাবি নেই। শুধু বলেছেন— মেয়েকে সাজিয়ে দেবেন। কেন-না আমার স্ত্রীর মতে গহনা হল স্ত্রীধন। তার মধ্যে লক্ষ্মীর বাস। 

প্রাণেশ রায় তাতে রাজি। লক্ষ্মীর আরাধনা করা যে তাঁরও লক্ষ্য। এক লক্ষ্মী বিদায় দিয়ে আর এক লক্ষ্মী ঘরে আনবেন। দুই যাবে। দুই আসবে। তাঁর ইচ্ছে আছে, ছেলে পাশ করে চাকরি পেলেই, বাস রাস্তা থেকে বাঁধানো পাকা পথ, আপন খরচে, করে দেবেন স্বগৃহ পর্যন্ত কারণ ছেলে তো গাড়ি কিনবেই! তাতে চেপে গ্রামে আসবে না? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *