2 of 3

রাজপাট – ৬৬

৬৬ 

আইল শ্রাবণ মাস 
লইয়া মেঘারানি 
নদীনালা ভইরা আইসে 
শ্রাবইন্যা পানি ॥ 
শুক্‌না নদীতে ঢেউ 
তোলপাড় করে। 
বাণিজ্যি করিতে সাধু 
যায় দেশান্তরে ॥ 

ইন্দ্রপূজা ও মেঘারানির কুলা নামানো সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে তা বলা যাবে না। রাত্রেই আকাশে দেখা দিল চাপ চাপ কালো মেঘ। বিদ্যুতের ঝলক উঠল। ঘরে ঘরে কিষাণ-কিষাণি সব জোড়হাত ঠেকাল কপালে। অন্তরে কামনা— বৃষ্টি দাও ঠাকুর। শুখা ক্ষেত ভিজিয়ে দাও। ধরিত্রীকে দাও শান্তি। খাল-বিল জলে ভরে উঠুক। 

বিছানায় শুয়ে আকাশে বিদ্যুতের ঝলক দেখতে পাচ্ছিলেন বলাই মণ্ডল। বড় ধরনের বজ্রপাত ঘটছে না। মেঘের গর্ভে চাপা গোঙানি। যেন কার গোপন কান্নার ধ্বনি মেঘের জমাটে প্রতিধ্বনিত হয়ে বিরাট ব্যাপ্তি নিয়েছে। কার কান্না এ! বলাই মণ্ডল আপন হৃদয়ে শুনতে পান ওই গোঙানির অনুরণন। 

হায়! এ কি তাঁরই হৃদয়ধ্বনি আকাশে বেজে উঠল? শয্যা হতে উঠে আসেন তিনি। জানালার শিকগুলি ধরে দাঁড়ান। লোহার ঠান্ডা গরাদে গাল রাখেন। মনে হয় দূর থেকে ভেসে আসছে ক্রন্দনধ্বনি। এক নয়, দুই নয়, সমবেত কান্নার শব্দ। এতখানি রোদন কীসের জন্য? কার জন্য? কাকে স্মরণ করে ঝরে কান্না এমন অপার্থিব? কোন ব্যক্তি এমন ভাগ্যবান! 

ব্যক্তি নয়। এতক্ষণে এই ক্রন্দনধ্বনি চেনা লাগে তাঁর। হৃদয়ের অন্তঃস্থ গোঙানি স্বরূপে ধরা দেয়। এ যে মৃতের সমষ্টির জন্য জীবিত সমষ্টির কান্না! নিজেরও একদিন মৃত্যু হবে জেনে নেওয়া সত্ত্বেও, এ জগতে কিছুই নয় চিরস্থায়ী, এ সত্যের উপলব্ধি সত্ত্বেও জীবিত কাদে মৃতের মায়ায়। আসলে জীবন কখনও মরণকে প্রত্যক্ষ করে না। যেমন সূর্যোদয় দেখে না সূর্যাস্ত কোনও দিন। তাই, যে থাকে, সে কাঁদে। 

তিনি দেখতে পান, গ্রামের প্রান্তে যে-শ্মশান, তারই চত্বরে সারি সারি দেহ। পড়ে আছে কল্যাণ, মাধব, শৈবলিনী, তাদের ঘিরে বসে রোদন করছে স্বপ্না, বিমলা, দিবা, নিশি, সন্দীপ। হায়, তাঁর সহকারবৃক্ষগুলি, তাঁর ভাই বন্ধু আত্মীয়গণ আজ শ্মশানগামী। ওই কান্নার শব্দে তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ হল। বিচিত্র আগ্রাসনের মধ্যে তিনি সম্পূর্ণ অসহায়। নদী আসছে বৃক্ষগুলি গিলে নিতে। কানাই আসছে বৃক্ষগুলি ছেদন করতে। অভিমানে বুকে পাথরের ভার জমে। মৃত্যুর দূত হয়ে আসা কানাই মণ্ডল যে তাঁর প্রিয়। তাঁর আপন। আপন সহোদর সে। আর ওই নদী, ওই ভাগীরথী নদী, এ নদীর সুধায় তিনি আজীবন লালিত। ওই নদী তাঁর মাতৃস্বরূপিণী। মা যদি আগ্রাসী হয়, ভাই যদি আগ্রাসী হয়, তিনি কার কাছে যাবেন! তিরস্কার করবেন কাকে! কোথায় অভিযোগ করবেন! 

সকল করাল আগ্রাসন তাঁকে ঘিরে ধরে নৃত্য করে। তিনি ঠান্ডা গরাদে গাল চেপে দাঁড়িয়ে থাকেন। আকাশে চাপ চাপ মেঘ। বৃষ্টি দেবে কি তারা? আনমনে সৌদামিনী খেলে যায়। তাঁর শৈশব মনে পড়ে। খেলা মনে পড়ে। কত খেলেছেন আমবাগানে! বাবার চোখ এড়িয়ে নিজের গাছের ফল বন্ধুদের সঙ্গে মিলে নিজেই করেছেন চুরি। চৌর্যবৃত্তির সেই বিমল আনন্দ আজ আর নেই। শুধু স্মৃতি আছে। সব কিছু চলে যায়। যায়। স্মৃতি হয়ে থেকে যায় সামান্যই। সেইটুকু জানা। সেটুকুর কিছু প্রিয়, কিছু-বা অপ্রিয়। সেটুকুই সম্বল করে চলা অজানা ভবিষ্যের দিকে। যতখানি স্মৃতি আছে তাঁর, স্মরণের প্রাচুর্যে ধরা, তাতে আছে গাছগুলি, এইসব গাছগুলি। আদিম বৃক্ষের মতো পুরাতন কিছু। কিছু বা নূতন। গাছ দেখিয়ে বাবা বলতেন—এই যে, এ হল সবচেয়ে প্রাচীন। মহাবটের মতো এর বংশধারা। এর থেকে জন্মেছে এতসব বাগানের গাছ। 

তিনি বলতেন, ঠাকুরদা গাছ। খুঁজে খুঁজে দেখতেন কোন গাছে আম পাকল প্রথম। দেখতে পেলে বাবাকে এসে বলতেন—ঠাকুরদা গাছে পাঁচখানা আম পেকেছে বাবা। 

সেই ঠাকুরদা গাছ কানাইয়ের সীমানায়। কাল তাঁর মৃত্যু হবে। মহাবটের মতো বিস্তৃত সে-বৃক্ষের মৃত্যু হবে। ওঃ! সে যে দারুণ রক্তপাত হবে! 

বলাই মণ্ডলের দম বন্ধ হয়ে আসে। এই নিধন-যজ্ঞ তিনি কেমন করে সইবেন! আস্তে আস্তে লোহার গরাদে কপাল ঠোকেন তিনি। আঘাত করেন ক্রমাগত। যেন ঝরিয়ে ঝরিয়ে তিনি রক্তপ্রপাত, দেখবেন, কেমন করে বয়ে যাবে গাছের শোণিতস্রোত! যতখানি তাদের রুধির, ততখানি তাঁরও বয়ে যাক। লহু লোহান হয়ে যাক জানালা, কবাট, নদী, মাটি! 

তীর্থর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সে অনুমান করেছিল, বলাই মণ্ডল বিনিদ্র রয়ে যাবেন আজ। তারও মন খারাপ। মন খারাপ তার মায়ের, বোনের। আহা! গাছগুলি কাটা হবে! কবেকার গাছ সব! সেও কল্পনা করে এক মানবশরীর ওই সব গাছ। যিশুখ্রিস্টের মতো দু’দিকে ছড়ানো দুই হাত। হাতের মতোই সব শাখা ও প্রশাখা। এক হাত কাটা গেল। দুই হাত কাটা গেল। কাটা গেল মুণ্ড। ধড়। খণ্ড খণ্ড হাড়-মাংসের মতোই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে চেরা কাঠ। 

সে শিউরে ওঠে। নেমে আসে শয্যা হতে। বাবা কোথায়? বাবা? এই মুহূর্তে সে বাবাকে আশ্রয় করতে চায়। কিংবা বাবার প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি, অপার ভালবাসা, সব নিয়ে সে তাগিদ বোধ করে বাবার আশ্রয় হয়ে উঠবার। পৃথিবীর সকল পরিপূর্ণ সুন্দর সম্পর্কই এমন। পরস্পরকে জড়িয়ে থাকার। পরস্পরের আশ্রয় হয়ে উঠবার। বলাই মণ্ডল ও তীর্থ মণ্ডল, পিতা ও পুত্র, একই সংবেদন তাদের হৃদয়ে অনুরণিত হয়। তরুণ মায়ায় বলাই মণ্ডলের প্রতি গভীর সমবেদনা নিয়ে তীর্থ দেখতে পায় জানালায় অবয়ব তাঁর। সে এগিয়ে যায়। দু’হাতে বাবার পিঠ আঁকড়ে আলতো গাল চেপে ধরে। বলাই মণ্ডল কেঁপে ওঠেন। হাতে স্পর্শ করেন ছেলের চুলভরতি মাথা। কালের চপল গতিতে এই ক্ষণটুকু স্তব্ধ হয়ে থাকে। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বলাই মণ্ডল। তাঁর মনে হয়, পাতাভরতি আমগাছগুলি যেন তীর্থরই চুলভরা মাথা। তখন বিজলি চমকায় আবার। পিতা-পুত্রের ঘন নিশ্বাস সন্নিবিষ্ট হয়ে জানালা দিয়ে উড়ে যায়। কারা যেন সার সার দাঁড়িয়ে থাকে বাহিরের প্রাঙ্গণে। অবয়বহীন তারা। ছায়ামাত্র। তবু কী অসম্ভব করুণ তাদের চোখমুখ। ওই আমবাগানে আশ্রয় নিয়েছিল। আজ তারা ত্রস্ত। বিচলিত। চেনা মাটি ছেড়ে, আশ্রয়ী বৃক্ষগুলি ছেড়ে যাবে কোথায়? কার কাছে যাবে? কে তাদের দেবে বলাই মণ্ডলের মতো এমন সহানুভূতিপূর্ণ অবস্থান অধিকার! 

বলাই মণ্ডলের গৃহ ঘিরে তারা ভেসে ভেসে বেড়ায়। তড়িদালোকে ক্ষণমাত্রের জন্য দৃশ্যমান হয়ে মিলিয়ে যায় হাওয়ায়। তাদের শ্বেতবসনের প্রান্ত বলাই মণ্ডলের চোখে লাগে। তিনি টের পান, তারাও চলে যাবে, বিদায় নিয়ে যাবে। বিদায় বিদায়। বৃক্ষগুলিকে দিতে হবে শেষ আলিঙ্গন। তিনি বলেন—যাবি তীর্থ? 

—যাব। 

তীর্থ জানতে চায় না কোথায় এই যাওয়া, কেন যাওয়া। সে কেবল সম্মতি দেয়। তার জানা। এই সকলই তার জানা। জন্মাবধি দেখে আসা বৃক্ষগুলি, তাকে কোলে-কাঁখে নিয়েছেন তাঁরা, তাঁদের নিধন আয়োজনে ব্যথাতুর শ্বাসের শব্দ তারও শ্রুতিগোচর। 

বলাই মণ্ডল বলেন—চল যাই। 

তারা হাতে টর্চ নেয়, ছাতা নেয় যদি বৃষ্টি আসে এই সম্ভাবনায়। কী এক বিশ্বাস! মেঘারানির কুলোর প্রতি কী এক বিশ্বাস! ওই বজ্র-বিদ্যুতে ভরা আকাশ নিখিল, বিশ্বাসের টানে ভূমিলগ্ন হয়ে যেতে চায়। বলাই মণ্ডল বুঝি-বা তাকে নিঃশব্দে আবাহনও করেন। এমনকী তীর্থ সে, সে-ও বারিপাত চেয়ে বসে গভীর পীড়িত হৃদয়ের কোণে। প্রস্তুত হয় বেরুবার জন্য। ভাঙন লাগার পর তারা এমন রাত্রি করে বেরিয়েছে কতদিন! বলাই মণ্ডল অস্থির হয়ে জেগে উঠেছেন। বলেছেন—চল দেখে আসি। নদী কতখানি এল। 

তারা জানে, এই শুরু। এমন দেখতে হবে কতদিন! বিস্তারকামী নদীকে কি প্রতিরুদ্ধ করতে পারবে বোল্ডারের শক্তি! তারা নিশ্চিন্তে ঘুমোবে কি রাতে! নাকি নদী একদিন খলবল করতে করতে, ছলাৎ ছলাৎ তুলতে তুলতে জানালায় দাঁড়াবে এসে পূর্ণিমা চাঁদের মতো! তারা জানে না। কেবল এক অনিবার আগমন প্রত্যক্ষ করে আর দিন গুনে গুনে যায়। 

দিবসালোক গ্রাস করে না এমন দুর্ভাবনা। কেবল রাত্রি হলেই মনে হয় গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে সর্বনাশ। অথচ নদী দিন-রাত্রি হিসেব করে না। সর্বনাশ করার জন্য খোঁজে না রাত্রির আঁধার। তবু দুঃসময়কে অন্ধকারের সঙ্গে একাকার করে দেখে মানুষ। 

বলাই মণ্ডল বললেন—তোর মাকে ডেকে দে তীর্থ। দরজা বন্ধ করে দিক। 

প্রথমদিন তারা গিয়েছিল চুপিচুপি। কারওকে কিছু না জানিয়ে। কিন্তু পরের দিনগুলিতে তা সম্ভব হয়নি। মায়া জেনেছেন। ঘরে মেয়ে নিয়ে একা থাকবেন তিনি, নিরাপত্তার কারণে তাঁকে ডেকে দিতে হয়। 

নিঃশব্দে পথ চলেছে বাবা আর ছেলে। আরও সব তাদের আশেপাশে আগে-পরে চলেছে। কখনও তারা এক লহমার তরে তারুণ্যে উত্তীর্ণ তীর্থকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। গা শিরশির করছে তীর্থর। ভয় নেই। আর ভয় নেই। সে জেনে গেছে, অশরীরী অতীত বর্তমানের সঙ্গে সঙ্গে ফেরে। কারণ বর্তমান নিমেষমাত্র। তার সম্মুখে অনন্ত ভবিষ্যৎ। পশ্চাতে অনন্ত অতীত। অতীত এবং ভবিষ্যতের বিন্দুবৎ ফাঁকটুকুই পূরণ করে আছে বর্তমান। 

তারা অতএব, অতীত সমভিব্যাহারে চলে। অনিবার্য সম্ভাবনাগুলি সম্পর্কে নির্মোহ হতে না পেরে, নির্মম হতে না পেরে, ব্যথা-বেদনার সংকল্প সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যায়। 

তীর্থ বলে –বাবা। মেঘ করেছে দেখো। 

বলাই মণ্ডল সাড়া দেন—হুঁ! 

—ভাঁজুইব্রত করলে সত্যি বৃষ্টি হয় বাবা? 

—তীর্থ! বিশ্বাসের শক্তি অবিশ্বাসের চেয়ে বড়। কেন জানিস? 

—কেন বাবা? 

–কারণ বিশ্বাস অস্তির কামনা করে। মানবজাতির মানসিক শক্তি অপরিমিত। তার দ্বারা কত কী করা যেতে পারে মানুষ জানে না। এই মেঘে বৃষ্টি তেমন হবে না তীর্থ।

—কেন বাবা? 

—এই মেঘে রস নেই। বর্ষার মেঘভার এতক্ষণ ভেসে থাকতে পারে না। বারি হয়ে ঝরে পড়ে। এ মেঘ উড়ে যাবার মতো পলকা। 

—তা হলে? 

মানসিক শক্তির জোর মেঘ এনেছিল, আমি বিশ্বাস করেছি। হয়তো সারা গ্রাম একাগ্র হয়ে বৃষ্টি আহ্বান করলে বৃষ্টি পড়ত। হয়তো এমন হবে কোনও দিন। মানসিক শক্তির দ্বারা মানুষ অনায়াসে সকল ইচ্ছা পূরণ করবে। 

তারা পৌঁছল আমবাগানের সীমানায়। বলাই মণ্ডল এসে দাঁড়ালেন ঠাকুরদা গাছের কাছে প্রণত হলেন। সারা বাগান জুড়ে শোকের রোদন উঠল। সেই অশরীরী নিঃশব্দ রোদন বড় করুণ। তীর্থ দু’হাতে কান চাপা দিল। বলাই মণ্ডল গাছ আলিঙ্গন করে বললেন- তোমরা আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *