2 of 3

রাজপাট – ৬৩

৬৩ 

শাওনে শয়নে ছিলেন 
শ্যামের মন্দিরে। 
কে জানে এ হেন পিয়া 
যাইবে বহু দূরে ॥ 
ছাড়িয়া গিয়েছে পিয়া 
নিদারুণ ব্যথা। 
শাওনের গগনেতে 
তাহারই বারতা।।

.

আমবাগানে জমেছে লোক। জমির আলে আলে দাঁড়িয়েছে সারিবদ্ধভাবে। গৃহস্থের আঙিনায় মেয়েদের ভিড়। মাথায় কাপড় দিয়ে, মুখে সেই আঁচলের প্রান্ত চাপা দিয়ে তারা দাঁড়িয়ে আছে উৎসুক। যুদ্ধের মনোভাব তাদের নেই, ঘেরাও-এর উৎসাহ নেই, বুঝি-বা সব মিলিয়ে এক কৌতুক চোখে-মুখে। একটা অন্যরকম কিছু দেখতে পাবার মজা। পাড় ভাঙতে থাকার সমূহ বিপন্নতায়, অনাবৃষ্টির শুখা অভিশাপেও তারা কৌতুকী। জীবনে তাদের নিত্য সংগ্রাম এবং এই জীবন পুরুষের মুখাপেক্ষী। হেঁসেল সামলানো এবং বিড়ি বেঁধে কিছু-বা উপার্জন করা—সন্তান উৎপাদনের মতোই, তাদের লালন-পালনের মতোই সহজ স্বাভাবিক। এসবের দ্বারা স্বাধীন চিন্তার অবকাশ জন্মে না। চিত্তের স্বাধীনতা রচিত হয় না। এই স্বাধীনতা আসে তখনই, যদি ঘরের পুরুষ হয় বেখেয়ালি নেশাখোর কিংবা ছেড়ে চলে যায় এককালীন নারীকে সন্তান-সন্তুতি সমেত অসহায় করে দিয়ে। জীবনযাপনের ব্যাকুলতা তখন তাদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে শেখায়। বাধ্য করে এক প্রকার। কিংবা, এই যে সমাগত বিপদাপন্নতা, গঙ্গার আগ্রাসনে ভূমির রোদন-এইসব চিরচেনা সমস্যার আবেদন, প্রত্যক্ষ আঘাতের পূর্বে আর অনুভূত হয় না। যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে বাঁচতে, যন্ত্রণাই হয়ে ওঠে কৌতুকের বিষয়। 

কয়েকদিন ধরে বদরুদ্দিন সকলকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছে। কী করতে হবে। কীভাবে দিতে হবে স্লোগান। এর আগে ভাঙন বিষয়ে আলোচনা করতে সিদ্ধার্থ এসেছিল। লোকে তার কথা জিগ্যেস করছে। শিশুদের স্কুলে ঘটে যাওয়া বিশ্রী দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে গিয়েছে সর্বত্র। কারণ খবরের কাগজে এ খবর প্রকাশিত হয়েছে। টেলিভিশনের লোক এসে আহত শিশুদের ছবি নিয়ে গেছে। কথা বলেছে নিবেদিতা বাগচীর সঙ্গে। শিশুদের অভিভাবকদের সঙ্গে। এবং সিদ্ধার্থর সঙ্গেও। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক বিরোধ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সাংবাদিকরা। তাঁরা কথা বলেছেন মিহির রক্ষিতের সঙ্গে। আসাদুর রহমানের সঙ্গে। 

এই ঘটনায় মুর্শিদাবাদের সাধারণ মানুষ ব্যথিত হয়েছে। ব্যথিত হবে না এমন ঘটনায়, সে-মানুষ বিরল। যেখানে যে এ খবর পড়েছে, শুনেছে, শিউরে উঠেছে সে-ই। 

মুর্শিদাবাদের মানুষ এই বেদনাবোধের সঙ্গে সঙ্গে ধন্য ধন্য করেছে সিদ্ধার্থকে। সাধারণ মানুষ, সারাজীবন একজন নায়কের সন্ধানে ফেরে। ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে, জনগণের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কারওকে দেখলে তারা নায়কের আগমন-সম্ভাবনায় আপ্লুত হয়। হৃদয়ের সকল শ্রদ্ধা ও সম্মান অর্পণ করে নির্দ্বিধায়। দুঃখে জর্জর, সমস্যায় কন্টকিত জীবনে তারা খোঁজে ত্রাতা একজন। পারলৌকিক মোক্ষ নির্দেশক ত্রাতা নয়, এই দেশ ভারতবর্ষে তার অভাব কী, মানুষ চায় ইহজীবনের পথপ্রদর্শক। একজন সত্যিকারের নেতা। এমন একজন নেতাকে পেলে তারা বর্ষ বর্ষ ধরে তাঁকে বুকে আগলে রাখে। এমনকী সেই বর্ষ বর্ষ পার করে শতবর্ষ পরেও প্রিয় নেতার জীবদ্দশা আকাঙ্ক্ষা করে বসে থাকে হৃদয়। এবং এভাবেই অমরত্ব লাভ করে মানুষ সাধারণ মানুষের পুঞ্জীভূত আবেগ, সম্মিলিত প্রেম তাঁকে অমরত্ব দেয়। মাটির সিংহাসন হতে প্রকৃত জননায়ক কখন উঠে আসেন গণহৃদয়ে, তার দিনক্ষণ লেখা থাকে না। 

সিদ্ধার্থ নামের এই যুবক যেন হয়ে উঠছে ওই হৃদয়াসনগামী। মানুষ তাকে বুকে তুলে নেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। অপরের জন্য যে বারংবার প্রাণ তুচ্ছ করতে পারে—তার চেয়ে বড় আর কে? 

সেকালের রাজাকে সম্মুখসংগ্রামে যেতে হত। যুদ্ধক্ষেত্রে আপন প্রাণ বাজি রেখে প্রজার প্রাণ রক্ষা করতে হত। একালের জনপ্রতিনিধির সে দায় নেই। তাঁরা যুদ্ধ বাধিয়ে তোলেন কেবল। পাড়ায় পাড়ায়। লোকে লোকে। মানুষে মানুষে। দেশে দেশে। যুদ্ধ ঘৃণার। যুদ্ধ ক্ষমতা দখলের। যুদ্ধ স্বার্থের। সেইসব যুদ্ধের কুশীলব, তারা সকলেই সাধারণ মানুষ। প্রাণ যায় তাদের। রাজা বসে থাকেন সুরক্ষিত। জনগণের রাজা। তাঁকে রক্ষা করে ব্যক্তিগত দেহরক্ষী, রক্ষা করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, রক্ষা করে দল। 

এমতাবস্থায় প্রাণ তুচ্ছ করে যে, সে কেন নয় ব্যতিক্রম? কিন্তু যাঁরা ঈর্ষী, যাঁরা সিদ্ধার্থর নায়কোচিত খ্যাতিলাভে লুব্ধ, তাঁদের আছে অখণ্ড যুক্তি। এই যে বিভিন্ন ঘটনায় বারবার জড়িয়ে পড়া সিদ্ধার্থর, এ কি কাকতালীয় নয়? সেদিন ওই ইস্কুলের সামনে সিদ্ধার্থ না-ও থাকতে পারত, অন্য কেউ থাকতে পারতেন, যিনি থাকতেন, তিনিও একই আবেগে আগুনে ঝাঁপ দিতেন জীবনের পরোয়া না করেই। সিদ্ধার্থ, আসলে, ঘটনাচক্রে হয়ে উঠছে খ্যাতিমান। 

কিন্তু সাধারণ মানুষ, তারা এই যুক্তির অপেক্ষা রাখে না। কী হলে কী হত বা হত না তার তর্কে না গিয়ে হৃদয়ের শূন্য সিংহাসনের জন্য আরাধ্য পাত্র খোঁজে। তারা জানতে চায়—উনি আসবেন না? উনি? 

—কে? 

—সিদ্ধার্থ। সিধুবাবু? 

—না। উনি সেরে ওঠেননি যে এখনও। 

—কবে সেরে উঠবেন? উনি কবে সুস্থ হবেন? 

—উনিই তো এসেছিলেন প্রথম। প্লাবন ও ভাঙন প্রতিরোধের জন্য একটি বড় পরিকল্পনা ছিল তাঁর। তিনি কবে আসবেন?

—আসবেন। তিনি আসবেন।

—হে ঈশ্বর ওঁকে সুস্থ করে দাও।

—খোদাতালা ওঁর ভাল করুন। 

মানুষের আশীর্বাদ তার প্রতি বর্ষিত হয়। সে জানে না। সে মনস্তাপ নিয়ে শুয়ে থাকে। দ্রুত সেরে উঠতে চায়। চায় আরও কাজ। আর তার বুকে ক্রোধ জমে। ঘৃণা জমে। গোপনে ফেনিল হয় নীল বিষ। শুধুই ক্ষমাশীল থাকতে পারে না সে। শুধুই সৎ, শুধুই ভাল, শুধুই নিরুপদ্রব পবিত্র থাকতে পারে না। সে পরিণত হয়ে ওঠে। পরিণত মানুষ হয়ে ওঠে ক্রমশ। রাগ, দ্বেষ, ঘৃণা সমেত, স্নেহ-প্রেম সমেত, ভালবাসা, ঔদার্য, ক্ষমতালিপ্সা সমেত সে এক পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে থাকে। যেন দীর্ঘকাল তার মধ্যে ছিল দেবতার লক্ষণ। কেবল ক্ষমা। কেবল রচিত সততার অনুগমন। কেবল শুদ্ধতার বিচার। এখন দেবত্ব অতিক্রম করেছে সে। দেবতার চেয়েও বড় যে মানুষ, তা-ই হয়ে ওঠা তার প্রয়াস। 

দেবতা, সে কেবল ধারণামাত্র। মানুষের কামনার চূড়ান্ত প্রতিরূপ। তাঁকে ধরা যায় না কিন্তু ধরার ইচ্ছায় জীবনাতিপাত করতে হয়। যে-মানুষ মানুষকে ভালবাসে, সে দেবতার চেয়ে বড়। কারণ সে উদাহরণ। তাকে ধরা যায়। সে ধারণামাত্র দেয় না, দেয় বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠা। 

লোকে সিদ্ধার্থকে নিয়ে আলোচনা করে। বলে— সিধুবাবুর কাছে যাও। সাহায্য পাবে। সে কারওকে ফেরায় না। 

বদরুদ্দিন, সিদ্ধার্থ সুস্থ হলেই আবার নিয়ে আসবে গ্রামে, এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এখন লোকে তারই কথামতো প্রস্তুত। 

জোয়ারের জলে নদী কিছু ভরন্ত হলে তাঁরা এলেন এক ভুটভুটি চেপে। লঞ্চ নিয়ে আসতে তাঁদের সাহস হয়নি। যদি চরায় আটকে যায়। তাঁদের আগমন সংবাদ পেয়ে সুকুমার পোদ্দারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছেন মিহির রক্ষিত, পোদ্দার এবং পার্শ্বচরবৃন্দ। তাঁরা দ্রুত পায়ে হাঁটছেন। ভঙ্গিতে তাঁদের ব্যস্ততা। প্রতিজ্ঞা। করব, নয়তো মরব—এমনই অভিব্যক্তি। এই পরিবেশে তা মানিয়েছে চমৎকার। জনমনে বলভরসা জাগছে। হ্যাঁ হবে। এবার হবে একটা কিছু। সিদ্ধার্থর অভাব আর বোধ করছে না কেউ। ইনিও যে নেতা 

হ্যাঁ, বড় নেতা। সিদ্ধার্থর চেয়েও বড়। 

হ্যাঁ। উনি এবার দাঁড়াবেন। 

কোথায়? কোথায় দাঁড়াবেন? 

বিধানসভা নির্বাচনে। বহরমপুর কেন্দ্রে দাঁড়াবেন। 

পোদ্দারবাবুর অনেক জানাশোনা। 

হুঁ। দেখাল বটে সুকুমার পোদ্দার। রাস্তা উঁচু হচ্ছে। পাড় বাঁধা হচ্ছে। 

তা তো করবেই। এত ক্ষমতা। কিছু করবে না? 

কিছু না করলে ভোট পাবে কেন? 

আর নিজের ছেলেকে শুনছি ঠিকেদারি পাইয়ে দিয়েছে। কী ধুরন্ধর ছেলে রে বাবা! সহদেবের মেয়েটাকে মেরে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

বড়লোকের সবই সয়। করত আমাদের ঘরের কেউ। 

ওই পোদ্দারই ঘর জ্বালিয়ে দিত। 

শুনেছি দু’জনা একসঙ্গে মরতে গিয়েছিল। ছেলেটা পালিয়ে এসেছে।

থাম দেখি। ওসব কথায় কাজ কী! মেয়েটাই বা মরল কোন দুঃখে। 

পেট বাধিয়ে বসেছিল নিশ্চয়ই। যা ঢলাঢলি করত। 

মেয়েরাই তো মরে। ওই জন্য বাবা-মাকে মেয়ে সামলে রাখতে হয়। 

অনির্বাণ ড্যাংডেঙিয়ে বিয়ে করবে এবার। 

শুনলাম তো, পোদ্দার সম্বন্ধ দেখছে। 

তা ছেলে এবার লক্ষ টাকা কামাবে। 

তা কামাক। কিন্তু কাজটা হোক। পরের দেখলে নিজের দেখতে বারণ করব কেন?

তুমি বারণ করলে শুনছে কে? ঠিকাদারির পয়সা দু’নম্বরিতে আসে। মাল দেবে দু’নম্বরি। কাজ দেবে দু’নম্বরি। তবে না পয়সা। 

গ্রামের ছেলে গ্রামের কাজটা ভাল করবে নিশ্চয়ই। 

কিছু বেকার ছেলে কাজও পাবে। 

হ্যাঁ! কত যে বেকার বসে আছে! ছেলেগুলো খারাপ পথে চলে যাচ্ছে সব। 

কুৎসা, নিন্দা, অপবাদের আলোচনার সঙ্গে জড়ামড়ি করে থাকে আশার বুদ্বুদ। হবে, কিছু হবে। করবে, কিছু করবে। আসলে জীবিতের সবচেয়ে বড় অবলম্বন হল আশা। জীবন প্রবঞ্চিত হয়, তবু আশা করে। ক্ষয়িত হয়, তবু আশা করে। আশাই হয়ে উঠেছে জীবনের লক্ষণ একপ্রকার। তাই, সন্দেহ ও সমালোচনার তীব্র গরলও শেষ অবধি এনে দাঁড় করিয়ে দেয় ওই শব্দটির কাছে। আশা আশা আশা! 

বদরুদ্দিন তখন হাত নেড়ে ভুটভুটি ডাকছে। ভুটভুটি অর্ধবৃত্ত বাঁক নিয়ে পাড়ঘাটায় থামল। তিন বৎসর আগে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রালগ্নে বাঁশের মাচা দেওয়া পাড়ঘাটা বাঁধিয়ে দিয়েছিল পঞ্চায়েত। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে, পঞ্চায়েতের টাকায় বাঁধিয়েছিলেন সুকুমার পোদ্দার। সেই বাঁধানো ঘাটের অর্ধেক তলিয়ে গেছে এই ক’মাসে। বাকি অর্ধেক বাঁধানো অংশ কাত হয়ে ঢুকে আছে জলে, ভূগর্ভে তলিয়ে যাবার অপেক্ষায়। 

এখন সেই ভাঙা ঘাটের পাড়ে আবার দেওয়া হয়েছে নতুন বাঁশের সাঁকো। সাঁকোর খোঁটায় দড়ি বাঁধছে ভুটভুটির মাঝি। সরকারি বাবুরা বসে আছেন ভুটভুটির পাটাতনে চেয়ার পেতে, ধোপদুরস্ত। বেশ বড় এ নৌকা। একদিকের পাটাতনেই ধরে গেছে পাঁচটি ঘেঁষাঘেঁষি চেয়ার। পাঁচটি চেয়ারে তিনজন বাবু। তাঁরা সকলেই পদস্থ আধিকারিক। দুটি খালি চেয়ারে, যেন আগে থেকেই জানা ছিল কারা আসবেন, কারা বসবেন। কারণ মিহির রক্ষিতকে নিয়ে সুকুমার পোদ্দার ভুটভুটি চাপলেন। তাঁরা বসলেন খালি চেয়ার দুটিতে। অপেক্ষমাণ জনতা দেখছে, সরে যাচ্ছে নৌকা। ভুটভুটির শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দুই পাড়ে। মাছেরা, জোয়ারের জলে উদ্বেল হয়েছিল যে সামান্য সংখ্যক, তারা চলে যাচ্ছে জলের গভীরে। জেলে-ডিঙিগুলি জাল ফেলতে ফেলতে তাকাচ্ছে এদিকেই। ওই চলেছেন সরকারি আধিকারিকবৃন্দ। চলেছেন সি পি আই এম নেতা মিহির রক্ষিত। চলেছেন গ্রামপ্রধান সুকুমার পোদ্দার। হবে। এবার একটা কিছু হবে। হয়তো বেঁচে যাবে জেলেদের বসত। নইলে কোথায় যে যাবে তারা! পথের দু’ধারে সরকারি খাসজমি জুড়ে অস্থায়ী বসবাস কিছুদিন। তারপর? 

তারপর জানে না কেউ। ভবিষ্যৎ মানেই এক ভয়াবহ অন্ধকার। ভবিষ্যৎ অন্ধকার। 

ভূমি হারালে ফিরে পেতে বর্ষ-বর্ষ কেটে যায়। একটুকু ভূখণ্ড, একটুকু জমিবাড়ির জন্য হা- প্রত্যাশী মানুষ গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বাঁচে। স্বার্থ, কলহ, ক্লেদাক্ত সেই জীবন হতে আকাশের প্রসারতা বিদায় নিয়ে যায়। ভূমির বড় আকাল গো! লোকে বাঁচে কী প্রকারে? থাকে কোথায়? খায় কী? অন্ন-বস্ত্রের বড় আকাল গো! যার যায়, তার যায়। অন্যে তার দুঃখ বোঝে না। বিলাপ করতে করতে ক্ষয়ে যায়, নিঃশেষ হয়ে যায় কত প্রাণ! অথচ এই পুরনো পৃথিবীতে, জান্তব ভূমিকা থেকে ক্রমবিবর্তিত মানুষের আরও দরদী হওয়ারই কথা ছিল। 

বাঁধ হবে নাকি? বাঁধ হবে? বাঁধ হলে পাড়সংলগ্ন জমি সরকার অধিগ্রহণ করে নেবে। মূল্য পাবে জমির মালিক। তবে সে আর এমন কী মূল্য! কিন্তু না বলার উপায় নেই। দশের স্বার্থে একের স্বার্থ বিসর্জন দিতেই হবে তো। কার কার জমি যাবে? তা যাবে। সুকুমার পোদ্দারের যাবে। বলাই মণ্ডলের যাবে। ইরফানের যাবে। মকবুলের যাবে। রাম সরকারের যাবে। 

আরে সে যখন যাবে তখন। এখন দেখতে হবে কী হয়। পাড়ে ভাঙন লেগেছে। ভাঙন আটকাবার জন্য পাড়-সংলগ্ন জমি পাগলেও ছেড়ে দেবে। এখন শুধু অপেক্ষা। কী সিদ্ধান্ত হয়! কী বিধান দেন সরকারি বিশেষজ্ঞ! প্রযুক্তিবিদ! 

জনতা অপেক্ষা করে। মাথার ওপর শ্রাবণের নির্মেঘ আকাশ দলা দলা রোদ্দুর ঢেলে দেয়। রোদ্দুরের অসহ উত্তাপ। মাঠে কাজ করা, রোদ্দুর নিত্য সহ্য করা মানুষগুলি পর্যন্ত ঘেমে-নেয়ে ওঠে। শরীর তাদের অবসন্ন হয়ে যেতে চায়। 

ওদিকে ভুটভুটি ক্রমশ ভাঙন দেখতে দেখতে এগোয়। বিশেষজ্ঞরা কোনও কোনও জায়গায় ভুটভুটি যন্ত্র বন্ধ করে কেবল ভেসে থাকেন। ভাল করে পর্যবেক্ষণ করেন ভাঙনের ধরন। 

ছবির মতো শান্ত সাজানো ওই গ্রাম। মনে হয়, চিরকালের মতো স্থির। কোনও লয় নেই, ক্ষয় নেই। অনিবার্য যুদ্ধের আগের স্তব্ধতায় যেমন শাস্তিকে নিথর মনে হয়, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, যুদ্ধ হবে না, তেমনই এই গ্রামের অস্তিত্ব! কিন্তু শুধু কালচক্র নয়, এই শান্তশ্রী গ্রামের জন্য ফাঁদ পাতে মানুষ ও 

মাঝখানের চড়ায় ধাক্কা খেয়ে জলস্রোত চাপ সৃষ্টি করছে এ পাড়ে। তাই ভাঙন ধরছে দ্রুত। আরও আগে কেন ভাঙেনি, সেটাই আশ্চর্য। আজ প্রায় ত্রিশ বৎসর হল ওই চড়া জেগে উঠেছে। আকারে বৃহৎ নয়। প্রকারে শক্ত নয় পেতনির চর। ছোটখাটো বন্যায় চড়া ডুবে যায় পুরোপুরি। বড় রকমের বন্যা হলে চড়া চিরকালের জন্য সম্পূর্ণ ডুবে যেতে পারে। ওপরের মাটি ভাসিয়ে নেমে যাবে উচ্চতা। নদী তার ওপর দিয়ে বয়ে যেতে পারবে অনায়াসে। এই ধারণাতেই চড়ায় বসবাস সরকারি স্বীকৃতি পায়নি। পেতনির চর ভূতনির চরের মতো গুরুত্বপূর্ণও হয়ে ওঠেনি। সরকারি খাতায় শূন্য এ চড়া। কিন্তু গত ত্রিশ বৎসরে এই চড়া বাসযোগ্যই আছে। শুধু তার জাগরণে চতুষ্কোনা ধ্বংস হতে চলল। এতদিন কেন ভাঙন লাগেনি, সে এক আশ্চর্য। হয়তো পাড়ের আমবাগান প্রচণ্ড শক্তিতে ধরে রেখেছিল মাটি। রোধ করেছিল ভূমিক্ষয়! 

সুকুমার পোদ্দার বা মিহির রক্ষিত—কেউ-ই এই সরকারি আধিকারিকদের অপরিচিত নন। তাঁদের মধ্যে কথা হয়। কিছু কথা চোখে। কিছু মুখে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিছু করা দরকার। পাড় বাঁধিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কোটি টাকার প্রকল্প চটজলদি অনুমোদিত হবে না। বর্ষা নামলে আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে পাড়ে বোল্ডার ফেলে লোহার জালি দিয়ে বেঁধে দেওয়া যেত। সে-ও কিছু কম টাকার প্রকল্প নয়। কিছু কাজ করে, বাকি টাকা পাঁচজনের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা হলেও কম পড়বে না পরিমাণে। 

ভুটভুটি মাঝনদীতে নিয়ে গিয়ে কথা হয় তাঁদের। হিসেব-নিকেশ হয়। যত বেশি বোল্ডারের কাজ, তত বেশি পয়সা। পূর্তবিদ্যার বিশারদ যিনি, প্রয়োজনের তুলনায় দ্বিগুণ বোল্ডারের প্রস্তাব দেবেন। সেই বোল্ডার আসবে। জমা হবে। তারপর? তারপর? 

মাঝিরা ভুটভুটি থামিয়ে দিয়েছে এখন। নৌকা ভাসছে। মাঝনদীর ফুরফুরে বাতাসে দেহ জুড়িয়ে যাচ্ছে জনসেবকদের। কেবল মাথার ওপর রোদ্দুরই যা অসুবিধের। সরকারি আধিকারিকবৃন্দ টুপি মাথায় দিয়েছেন। মিহির রক্ষিতকেও তাঁরা ধার দিয়েছেন একখানা। সকলের নধর শ্রীঅঙ্গ কালা হলে চলে কী করে! 

কেবল সুকুমার পোদ্দারের মাথায় টুপি নেই। তিনি বলছেন—চাষাভুসো মানুষ আমি। রোদে-জলে অভ্যাস আছে আমার। 

মাঝিরা পর্দা দিয়ে হাওয়া আড়াল করে চা তৈরি করছে। চিনেমাটির প্লেটে সাজিয়ে এনে দিচ্ছে মিষ্টি, কেক, কাজুবাদাম। 

—এখন দরকার ছিল বিয়ার। 

বলছেন পূর্তবিদ। 

—হা হা হা বিয়ার। 

সমর্থন করছেন অন্যরা। এই ভাঙন দেখে আর মন বিষণ্ণ হয় না। দেখতে দেখতে চোখ সয়ে গেছে। তাই বিয়ার খেতে ইচ্ছে করে। হাসিও পায় ভাঙনের মাঝে দাঁড়িয়ে। 

মিহির রক্ষিত বলছেন—আপনি চাষা? আপনি চাষা? আপনার মতো চাষা যদি আমরা হতাম! মোট কত জমি আছে আপনার বলুন তো? 

—থাকলে কী হবে? 

মিষ্টিতে কামড় দিয়ে সুকুমার পোদ্দার বলেন—দেখছেন তো সব চলে যাবে ভাগীরথীর গর্ভে। 

—আরে সব যাবে কী? 

মিহির রক্ষিত বলেন। 

—আমাদের কাছে সব খবর থাকে মশাই। আপনার সারা মুর্শিদাবাদ জুড়ে জমি আছে। 

—কী যে বলেন! 

—ঠিকই বলি। তা ছাড়া চিন্তা কী! ভগবান এক হাতে নেন, অন্য হাতে দেন। এই যে রাস্তার ঠিকাদারি, এবার পাবেন পাথরের ঠিকাদারি —আর কী চাই! আপনার ছেলের সঙ্গে আমার ছেলেটাকেও লাগিয়ে দেব। বড় হয়েছে। এখনই কাজে লাগিয়ে দেওয়া দরকার। 

—নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই! 

–বাড়িতে লক্ষ্মীপূজা লাগান ভাল করে। 

—আরে আমি পূজা করি না। ওসব আমার স্ত্রী করেন। 

—আরে কমিউনিস্টের স্ত্রীরাই ভক্তিমতী হন। সে তো সবাই জানে। 

—হা হা হা। 

হাসি ওঠে। কেকে কামড় পড়ে। দু’পাটি ধারালো দাঁতের মাঝখানে পড়ে পিষে যায় কাজুবাদাম। দূরে জেলেরা জাল তোলে। মাছ নেই। এমন অনাবৃষ্টি, মাছের প্রজনন হয়নি। ভাগীরথীতে ইলিশ নেই। অন্য মাছই-বা কই! সরকারি বিলগুলিতে পর্যন্ত জাল ফেলে তুলে নেওয়া হচ্ছে ছোট-বড় সব মাছ। মাছের আকালে সেগুলি বিকোচ্ছে আকাশ-ছোঁয়া মূল্যে। সে-জন্য নয়। মাছ না তুললে উপায় নেই। বিলের জলস্তর দ্রুত নামছে। এরপরও বৃষ্টি না হলে মাছের মৃত্যু হতে থাকবে। তখন সম্পূর্ণ ক্ষতি। 

কিন্তু স্বাধীন মৎস্যজীবীদের নদীই ভরসা। নদীতে মাছ নেই। তারা জাল তুলে শূন্য জালে শূন্য দৃষ্টি ফেলে। আবার জলে ছুঁড়ে দেয়। যদি পায়। আশা আশা আশা। অনিশ্চিত দিনগুলি, বিনা উপার্জনের দিনগুলি আশা সম্বল করে দিবারাত্র যাপন করে। 

ভুটভুটি ফিরে আসার অপেক্ষায় পাড়ে বসে পড়ে কৃষকরা। বেলা বাড়ছে। পেটে ভুখ লাগছে। তবু বসে থাকছে সকলে। কারও কারও ট্যাকে গোঁজা লাল রঙের পতাকা। সংগ্রাম বলে কথা! সহজে তো আদায় হবে না। ঘেরাও করতে হবে। এই জীবনের জন্য, জমি-জমার জন্য, গৃহস্থীর জন্য ঘেরাও চাই, সংগ্রাম চাই, লড়াই চাই। লড়াই লড়াই লড়াই চাই। লড়াই করে বাঁচতে চাই। তার জন্য বসে থাকা চলে ভুখা-পেটে কিছুক্ষণ। 

তখন মিহির রক্ষিত প্রশ্ন করেন—কিন্তু বর্ষা না এলে! এ যা লক্ষণ! বর্ষার তো দেখা নেই। সুকুমার পোদ্দার বলেন—এবার অনাবৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। আষাঢ় মাসে শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে ধারাবর্ষণ হলে সেবার দেশে খরা হয়। 

—একালেও লোকে মানে এসব? 

পূর্তবিদ রায় বলেন—কিছু কিছু মেলে মিহিরবাবু। সবই উড়িয়ে দেবেন না। 

—ধুর ধুর! যতসব কুসংস্কার! 

রায় বলেন—আপনাদের ব্যাপার অবশ্য আলাদা। আপনাদের হল—যা নেই মার্ক্স-এ, তা নেই বিশ্বে। মার্ক্সই হলেন আপনাদের বিগ্রহ। 

মিলটা লাগসই হল না তেমন। কেউ-ই হেসে গড়িয়ে পড়লেন না। পরিবেশ একটু থমথমে হয়ে উঠল বরং। রাজনীতিবিদকে নীতি তুলে গালাগালি দেওয়া অনেকটা অস্পৃশ্য পশুসন্তান বলার মতোই গর্হিত কাজ। 

পরিস্থিতি সামাল দিতে একজন আধিকারিক ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এমন একটি উপার্জনের সম্ভাবনা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মুখে নিজেদের মধ্যে মন কষাকষি হওয়া ভাল নয়। তা ছাড়া রাজনীতি করা মানুষ, প্রতিষ্ঠিত নেতা—এঁরাই এখন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। মানুষের প্রাণ এঁদের হাতে। তিনি তাড়াতাড়ি বলেন—হাতে সময় বেশি নেই। আসল কথা হয়ে যাক। 

—হ্যাঁ হ্যাঁ। আসল কথা। 

সকলে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। ফিরতে হবে। আবার ডাঙায় অপেক্ষা করে আছে ঘেরাও উৎসব। সুকুমার পোদ্দার বলেন-তা খরা কি অনাবৃষ্টি তো সরকারিভাবে ঘোষিত হয়নি। হয়েছে কি?

—না। ঘোষণা হয়নি। 

—তা হলে প্রচণ্ড বর্ষায় আপৎকাল সম্ভাবনা আনার অসুবিধে কোথায়? রায়বাবু চাইলেই তা করতে পারেন। 

—তা পারেন। ওঁর হাতেই তো সব। 

বলে ওঠেন বাকিরা। পোদ্দার বলে চলেন- প্রবল বর্ষণে গ্রাম ভেসে যাবার সম্ভাবনা আছে বলেই আপনি বোল্ডার ফেলে পাড় বাঁধাবেন। 

—ঠিক কথা। ঠিক কথা। 

—আগে বর্ষা হবে। পাড় ভেসে যাবে। তারপর আপনি ব্যবস্থা নেবেন, তা কী করে হয়?

রায় বলেন—না, এটা সেরকম ব্যবস্থা তো নয়। এ হল আপৎকালীন ব্যবস্থা। দেখা যাক। করে ফেলব আমি। দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি কি আর পড়বে না? পড়লেই কাজ হয়ে যাবে। 

—আর ঠিকাদারিটা? 

—ঠিকাদারি পেতে আপনার ছেলের অসুবিধা হবে না। উনি তো রাস্তা তৈরি করছেন। আপৎকালীন ব্যবস্থায় হাতের কাছে ওঁকে পেয়ে বোল্ডার সরবরাহের দায়িত্ব ওঁকেই দেওয়া যেতে পারে। 

—ব্যস ব্যবস্থা পাকা। 

হাত তোলেন মিহির রক্ষিত। 

—ওই কথাই রইল তা হলে। এবার তবে ফেরা যাক। 

সুকুমার পোদ্দার বলেন – আমার বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা হয়েছে। তার আগে ঘেরাওটা সামলে দেবেন দাদা। 

মাঝনদী থেকে ভুটভুটি এসে সাঁকোয় লাগে। জনসেবকেরা একে একে নেমে আসেন। জনতা ব্যস্তসমস্ত হয়। জানতে চায়—কী দেখলেন? 

—বুঝলেন কেমন? 

—কী ব্যবস্থা নেবেন? 

মিহির রক্ষিত উঁচু গলায় বলেন—এঁরা কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। বলছেন আরও কিছুদিন দেখতে হবে। 

তাঁর উদ্দেশ্য জনতাকে উসকে দেওয়া। যা হয়ে আছে, যা ঘটবে, তাকে জনতার মুখ দিয়ে বলিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে নেওয়া চাই। 

পূর্তবিদ রায় নিপুণ সহায়তা করেন মিহির রক্ষিতকে। বলেন—আরও দেখা ছাড়া পথ নেই। সাধারণত চড়া পড়লে নদী বড় রকমের বাঁক নেয়। সেরকম কিছু হচ্ছে কি না তা আগে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। 

—না না না না। 

জনতা সম্মিলিতভাবে চিৎকার করে। 

—আমাদের দাবি মানতে হবে। 

বলে তারা। তাদের হাতের লাল পতাকা শূন্যে আন্দোলিত হয়। বৃত্তাকারে তারা ঘিরে ধরে জনসেবকদের। সমাধান চায় তারা। বলে— আমাদের জীবনের প্রশ্ন। 

আমাদের প্রাণের প্রশ্ন। 

কোথায় যাব আমরা? 

পাড় বাঁধাতে হবে। বাঁধাতে হবে। বাঁধাতে হবে।

নইলে আমরা ছাড়ব না। ছাড়ব না। ছাড়ব না। 

আমাদের ঘেরাও চলবে। চলবে চলবে। 

গা বাঁচানো ফাঁকা বুলি শুনছি না। শুনব না, শুনব না। 

আন্দোলন জমে ওঠে। বদরুদ্দিন শ্লোগানে নেতৃত্ব দেয়। এরকম চলতে থাকে আধঘণ্টা সময় যাবৎ। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। এবার খেলা ভাঙার খেলা নইলে চলে না। হাজার কাজ পড়ে আছে সরকারি সেবকদের। জনপ্রতিনিধিবর্গের। পোদ্দারের গৃহে ঠান্ডা মেরে আসছে সুস্বাদু খাবার বড় ভোজনের আগে এই ছোট ভোজন নইলে পাকস্থলী ক্রন্দনমান। তার পেশিগত আক্ষেপ এমনকী এই জনপ্রতিনিধি এবং সেবকদের নিকটেও মানানসই। অসহ বেদনার। তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলার অনুষ্ঠান করেন। তারপর হাত তোলেন মিহির রক্ষিত। 

—আপনারা শান্ত হোন। এঁরা কী বলছেন শুনুন। 

আপাতত বোল্ডার ফেলে আপৎকালীন ব্যবস্থা নেবার কথা ঘোষণা করেন রায়। জনতা উল্লসিত হয়ে ওঠে। কতখানি বিজ্ঞানসম্মত সমাধান আছে এই প্রস্তাবে, জনতা জানে না। যিনি বিজ্ঞান জেনে জনতার সেবা করতে এসেছেন, তাঁর লোভ কেবল পরিকল্পনাকে স্বীকৃতি পাইয়ে দেবার জন্য ছলনা করে গেল। লোভের বন্ধু লোভ। লোভের বন্ধু সর্পিল কূটনীতি। রাজনীতি ও আমলাতন্ত্র তাতে সিদ্ধকাম। 

বদরুদ্দিন হাঁক দেয়—মিহির রক্ষিত জিন্দাবাদ। 

—জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ। 

—সুকুমার পোদ্দার জিন্দাবাদ। 

—জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ। 

দূরে আমবাগানের প্রান্তে ভাঙা পাড়ের নিকটে দাঁড়িয়ে এই শ্লোগান শুনতে পান এক কবি এবং এক সম্পাদক। 

কবি বলেন—জিন্দাবাদ বলছে। তা হলে বোধহয় কোনও ব্যবস্থা হল। 

সম্পাদক বলেন—এগুলি কী আমের গাছ? 

—নানান জাতের আছে। আমার বাগানে আছে কোহিতুর, বেগম-পসন্দ আর ল্যাংড়া।

—কোহিতুর? বেগম-পসন্দ? এরকমও নাম হয় বুঝি আমের? 

সম্পাদক বিস্ময় প্রকাশ করেন। কবি বলেন—আরও আছে। বীরা, জাহানকোষা, শাদুল্লা, রানিপসন্দ, আনারস, চাঁপা, মোলামজাম, চন্দনকোষা, কোহিনুর, গোপালভোগ, লক্ষণভোগ, ভবানী। আর ফজলি, সিন্দুরি, বোম্বাই তো আপনারা জানেন। আসুন না আমের মরশুমে পরেরবার। ততদিন যদি আমার গাছগুলি থাকে, খাওয়াব। না থাকলেও খাওয়াব। আসুন। 

সম্পাদক নীরব হয়ে যান। বলতে পারেন না, থাকবে আপনার গাছ। কী করে বলবেন? ভাঙন দেখতেই যে এসেছেন তিনি এই বাগানে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *