2 of 3

রাজপাট – ৬১

৬১ 

ভুলে যাই ওর কথা— আমার প্রথম মেয়ে সেই
মেঘ দিয়ে ভেসে আসে যেন 
বলে এসে: ‘বাবা, তুমি ভাল আছ? ভাল আছ?— ভালবাসো?’
হাতখানা ধরি: ধোঁয়া শুধু কাপড়ের মতো শাদা মুখখানা কেন!
‘ব্যথা পাও? কবে আমি মরে গেছি— আজো মনে কর?’ 
দুই হাত চুপে চুপে নাড়ে তাই 
আমার চোখের ‘পরে, আমার মুখের ‘পরে মৃত মেয়ে,
আমিও তাহার মুখে দু’ হাত বুলাই; 
তবু তার মুখ নাই—চোখ চুল নাই। 

.

অসহ্য এ নির্জন ঘোর। অসহ এ নিদ্রাবিহীনতা। এ দু’দিন যাবৎ ঘুম নেই খর চোখে। যেন আগুনের আঁচে ক্ষতিগ্রস্ত চক্ষুদ্বয় হয়ে গেছে চিরনিদ্রাহারা। অথচ সে চাইছিল ঘুমিয়ে পড়তে চাইছিল পোড়া দগ্ধ দৃশ্যগুলি থেকে মুক্তি পেতে এক মুহূর্তের জন্য হলেও। কিন্তু ভাপ লাগছিল তার। সর্বাঙ্গ জুড়ে ভাপ লাগছিল। যেন ওই শিশুদেহগুলির সেঁকা মাংস এখনও তার গায়ে লেপ্টে আছে। 

বোধিসত্ত্ব সারাক্ষণ বসে আছেন কাছে। চাইছেন নিরাময় তার। দগ্ধ ক্ষতগুলি খুঁজে খুঁজে অতি যত্নে লেপে দিচ্ছেন ঔষধ। গায়ে পোশাক রাখতে পারছে না সে। কারণ কোথাও কোথাও চামড়া পুড়ে খাক। এর যন্ত্রণা কিছুই নয় তার তুলনায়, যা তার হৃদয়ে ঘটে যাচ্ছে। কী করে সম্ভব! কার পক্ষে সম্ভব এই কাজ! 

তীব্র ঘৃণাবোধে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে তার মুখ, কারণ এক কুটিল সন্দেহ ঘনিয়ে উঠেছে তার চেতনায়। ওই সন্দেহ হুতাশনের মতোই পুড়িয়ে দিচ্ছে তার অন্তর। 

তার ঘৃণাবিকৃত মুখকে যন্ত্রণাদীর্ণতা বোধ করে বোধিসত্ত্ব ঝুঁকে পড়ছেন তার ওপর–কষ্ট হচ্ছে ছোটবাবু? জ্বালা করছে? 

সে ভাষাহীন তাকাচ্ছে বোধিসত্ত্বের দিকে। বলছে—দাদু, আমাকে ভুলতে হবে। 

–কী ভুলতে হবে ছোটবাবু? 

—ওই দৃশ্য! তা ছাড়া… তা ছাড়া… কী এক সন্দেহ হচ্ছে আমার! 

—কী সন্দেহ? 

—পরে বলব তোমাকে দাদু। 

—ছোটবাবু, সন্দেহ ব্যাপারটা বিশ্রী। তুমি এটা প্রশ্রয় দিয়ো না। 

—শুধু সন্দেহ নয় দাদু। অনুমান। 

—হ্যাঁ। অনুমানের মধ্যে বরং থাকে কিছু যুক্তির শৃঙ্খলা। সেসব পরে ভেবো। এখন ঘুমোতে চেষ্টা করো তুমি। 

—ঘুম আসছে না। 

বোধিসত্ত্ব চুপ করে থাকেন। সে-ও চুপ করে যায়। ভাবে। এ কি সত্যি হতে পারে? কেন নয়? লোভ মানুষকে নরকের শেষ দ্বারে টেনে নিয়ে যায় না? 

ফায়ার ব্রিগেড তদন্ত করে বলেছে, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে বিদ্যুতের তারই আগুন লাগার কারণ। ঘরে বৈদ্যুতিক তারে বিস্ফোরণ হয়েছিল আর অগ্নিময় হয়ে গিয়েছিল ঘুরন্ত পাখা। দেওয়াল। টেবিল। বেঞ্চ। 

এই ঘটনাকে স্বাভাবিক দুর্ঘটনা না বলে ষড়যন্ত্রমূলক হিসেবে বিবৃতি দিয়েছে পুলিশ। যদিও প্রথমে তারা সম্পূর্ণ দুর্ঘটনাই বলেছিল। কিন্তু শিশুরা কিছু সুস্থ হয়ে উঠলে যে-বিবৃতি দেয়, তাতে তাদের বক্তব্য পরিবর্তন করতে বাধ্য করেন পরমেশ্বর সাধুখাঁ। প্রকৃত তদন্তের দাবিতে থানা ঘেরাও করেছিলেন তিনি। 

শিশুরা বলেছে যতখানি সম্ভব। প্রচণ্ড আতঙ্কের মধ্যে ভয়ে ভয়ে, থেমে থেমে। 

.

সিঁড়ি লাগিয়ে কাজ করছিল কাকুরা। আমরা দেখছিলাম। দুটো তারে ঘষে ঘষে আগুন জ্বালাচ্ছিল। আমরা বললাম—কী করে পারলে? 

কাকুরা বলল—ম্যাজিক! 

আমরা বললাম—আরও ম্যাজিক দেখাও। 

কাকুরা বলল—আরও ম্যাজিক? তা হলে জানালা বন্ধ করে দাও। 

হুড়োহুড়ি করে জানালা বন্ধ করে দিলাম আমরা। একজন কাকু বলল—দরজাও বন্ধ করতে হবে। 

সায়ন ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। 

কাকু বলল—ছিটকিনি লাগাও। ওটাই তো ম্যাজিক! 

—কী ম্যাজিক? 

—আমরা এই মইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে মন্ত্র বলব, ওমনি ছিটকিনি খুলে যাবে। 

—কিন্তু ছিটকিনি লাগাব কী করে? আমাদের হাত যায় না যে। দিদিমণিকে ডাকি? 

কাকু বলল—মাথা খারাপ? দিদিমণি এলে ম্যাজিক দেখতেই দেবে না। তোমরা এক কাজ করো। 

কাকু যেরকম বলল, আমরা সেরকমই করলাম। 

চার-পাঁচজন মিলে দিদিমণির টেবিল তারা নিয়ে গিয়েছিল ঠেলে ঠেলে দরজার কাছে। তার ওপর ধরাধরি করে তুলেছিল দিদিমণির চেয়ার। সায়ন সবচেয়ে ডানপিটে। সে-ই টেবিল বেয়ে চেয়ার বেয়ে উঠেছিল এবং ছিটকিনি আটকেছিল। 

কাজটা সহজ ছিল না তাদের পক্ষে। কিন্তু সায়ন বলেছিল—আমি পারি। আমি বাড়িতে আটকাই। 

তার বন্ধু রেজাউল বলেছিল—আমিও পারি। দেখবি? 

একটা কাকু বলেছিল—এবার চেয়ার-টেবিল ঠিক জায়গায় রাখো তো। না হলে দিদিমণি বকবে কিন্তু। 

এক কাকু ছিল ওপরের ধাপে। তার কাঁধের কাছে মাথা তুলেছিল আর একজন। সে বলেছিল—এতটা দরকার ছিল না হাফি। 

হাফি বলেছিল—চুপ কর। হাসিল করতে হবে। তুই নিজে জানিস না? 

–লাগিয়ে চলে আয়। 

—না। কেউ এসে পড়লে? 

—ওদের বেরুতে দিতে হবে। 

—কী? মুরগিগুলোকে? পরে বের করব। তুই নেমে যা বাপি। মই ধর। হেলছে। 

তারা আবার ঘষে ঘষে নামিয়েছিল চেয়ার। ঠেলে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিল টেবিল। ম্যাজিক দিয়ে ছিটকিনি খোলার দৃশ্য দেখতে আর তর সইছিল না। তাদের টিফিন পড়ে ছিল। শুধু শান্তশিষ্ট ববিতা, কাজল আর নিহারুল টিফিন খাচ্ছিল জায়গায় বসে। 

হাফিকাকু—দেখো ম্যাজিক—বলতেই আগুনের ঝলক দেখতে পায় তারা। ধোঁয়ায় ভরে যায় ঘর। মাথার ওপর পাখাটাও জ্বলছিল দাউদাউ করে। তারা চিৎকার করছিল। একমাত্র দিদিমণির চেয়ারের দিকেই আগুন ছিল না। তারা ভয় পেয়ে সেইখানে জড়ো হয়েছিল। কিন্তু কাজল, ববিতা, নিহারুল ওই জ্বলন্ত পাখার তলা দিয়ে আসতে পারছিল না। তারা ডেকেছিল কত—কাকু! ছিটকিনি খুলে দাও। খুলে দাও। 

.

কারা এই হাফি আর বাপি? তারা কেন এসেছিল? বিদ্যুৎবিভাগ বলেছে তারা ওইদিন, ওই রাস্তায় কোনও মিস্ত্রি পাঠায়নি। স্কুল থেকে অল্প দূরেই পড়ে ছিল মই। সে-মই তাদের নয়। কী হাসিল করার কথা বলেছিল হাফি? কে তাদের নিয়োগ করেছিল? কেন করেছিল? 

সিদ্ধার্থ আগুন-জ্বলা উত্তপ্ত মাথায় নিজের মতো করে সমাধান সন্ধান করে। নিবেদিতা বাগচীর স্কুল পণ্ড হলে কার লাভ? কার? 

অন্য আর একটি স্কুলের। যাদের ছাত্রসংখ্যা কমে আসছিল। তা হলে কি… তা হলে কি….

নিবেদিতা বাগচীকেই দোষারোপ করে তাকে গ্রেপ্তারের দাবি তুলেছে বামদলগুলি। তাদের বক্তব্য, অরক্ষিত পরিকাঠামোয় এতগুলি শিশুর জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করেছে নিবেদিতা বাগচী। বিদ্যুতের কাজ করতে আসা লোকগুলির কথা উড়িয়ে দিচ্ছে তারা। এই বাড়ির কোনও কাজেই হয়তো লাগান হয়েছিল তাদের। এখন অস্বীকার করা হচ্ছে। 

অতএব নিবেদিতা বাগচীকে মাঝখানে রেখে যুযুধান হয়ে উঠেছে দুই রাজনৈতিক দল। সিদ্ধার্থ উপস্থিত না হলে একটি শিশুকেও বাঁচানো যেত না, এমনও দাবি করছে তাদের দল। এমনকী খবরের কাগজের পাতায় উঠে এসেছে শিরোনাম—সি পি এম যুবনেতার সাহসী উদ্ধার। 

মিহির রক্ষিত বিবৃতি দিয়েছেন, তাঁদের দলীয় কর্মীরা সবসময়েই সামাজিক কল্যাণ বিধানের জন্য জীবন তুচ্ছ করে। 

সেই মুহূর্তে কি মনে ছিল তার জীবনের কথা? তার মনে পড়ে না কিছু। তার মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু চিৎকার। আ-আ-আ-আ। 

সে যখন ঢুকল ভিতরে, প্রথমে আগুনের ঝলকে ও ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল দৃষ্টি। কিন্তু দৃষ্টি ছাড়াও মানুষের আছে আরও নানাবিধ প্রখরতা, তীব্র অনুভূতির। তার দ্বারা সে টের পেয়েছিল, তার বামদিকে আগুনের হলকা কম। সে অন্ধের মতোই হাতড়ে বাঁ দিক বরাবর এগিয়ে গিয়েছিল। তার পিঠ পুড়ছিল। কাঁধ পুড়ছিল। চোখ জ্বলছিল। দম আটকে আসছিল ধোঁয়ায়। তারই অবসরে সে আবছা দেখেছিল তাদের। দেওয়ালে পিঠ দিয়ে, গায়ে গা লাগিয়ে একদলা কীটের মতো জড়ামড়ি করে ছিল তারা। সে সামনে পেয়েছিল যাকে, তুলে বেরিয়ে এসেছিল। দ্রুততার কাছে হার মানে আগুনের দহন ক্ষমতা। এবং চেতনায় ছিল না সে। প্রায় হতচেতন অবস্থায় কোনও অপরাজেয় শক্তি তাকে চালিত করেছিল। জল পড়ে আগুন ধ্বস্ত হতে থাকলে তার কাজ কিছু সুবিধাজনক হয়। এবং তৌফিক ঢুকে গেলে ত্বরান্বিত হয়ে যায়। 

সে অস্থির বোধ করে। ছটফট করে একা-একাই। বহু লোক দেখতে এসেছিল তাকেই। যেন সে-ই শিশু এক। পুড়ে গেছে। 

এই ক্ষত, এই অসহনীয় দৃশ্যাবলী কোনও দিন যাবে তার স্মৃতি থেকে? আর কত অপমৃত্যুর সাক্ষ্য দেবে সে! তার অন্তরাত্মা সকল অপঘাত মৃত্যুর বেদনায় কান্না জমে জমে ওঠা মুক্তোবিন্দুর মালা গাঁথে! 

.

সে জানে না, তখন বহরমপুর শহর থেকে দূরে, মুর্শিদাবাদ জেলার পশ্চিমপ্রান্তে একটা লোক একটি শিশুকে আদর করছিল। শিশুটির বয়স তিন-চার বছর। লোকটি বছর ছাব্বিশের। সে বলছিল— আমার চাঁদ কে? 

শিশুটি বলল—আমি। 

—আমার সোনা কে? 

—আমি! 

—আমার সোনার গলায় দেব কী? 

—সাতনলি হাল। 

—আমার চাঁদের গলায় দেব কী? 

—নত্তমালা। 

—কানে দেব… 

—মাকলি … 

—হাতে দেব… 

–করুন। 

—পায়ে দেব… 

—পুল। 

—নূপুরে থাকবে… 

—দুনি জুমকো। 

—আমার সোনার বিয়ে হবে কার সঙ্গে? 

—নবাজাদা ছাহেনছার ছঙ্গে। 

—আমার সোনা কী করে? 

—ফলিং ধলে। ঘুলে ঘুলে। কোলে চলে। আদল কলে। 

—আমাকে একটু আদর করো তবে। 

শিশুটি ছটফট করল এবার—ছাল আব্বু! আমি খেলতে দাব। 

—যা। 

ছেড়ে দিল লোকটা। শিশুটি ছাড়া পেয়ে নাচতে নাচতে ছুটল। 

এইসব কাণ্ড এতক্ষণ ধরে দেখছিল একজন। সে লোকটিও ওই বছর ছাব্বিশের। সে বলল—একটা কথা মনে হচ্ছে বারবার। 

–কী? 

জিগ্যেস করল প্রথম লোক। 

—আগুনে পুড়িয়ে এলি যাদের, তাদের বয়স এই চাঁদের মতোই। 

—আমি একা পোড়ালাম? তুই পোড়াসনি? 

—হ্যাঁ, আমিও ছিলাম। কিন্তু আমার ইচ্ছা ছিল না। 

—ইচ্ছা ছিল না? বায়না কি আমি একা নিয়েছিলাম শুয়োরের বাচ্চা? 

—গালি দিস না হাফি। উপরে থুকলে নিজের গায়েই লাগবে। বায়না আমিও চেয়েছিলাম। তাতে কী? ওই কথা তো ছিল না। তুই বাড়াবাড়ি করলি। 

—কী বাড়াবাড়ি করলাম অ্যাঁ? আগুন লাগাবার কথা ছিল না? 

—ছিল। কিন্তু দরজার ছিটকিনি তুলে দগ্ধে মারা? এ কাজ তো করতে বলা হয়নি। 

—কিছু বোঝো তুমি? বাল-বিচি বোঝো! মুখে কেউ বলে না। বুঝে নিতে হয়। আগুন দিলাম আর কুচো শয়তানগুলো বেরিয়ে গেল। বালতি করে জল এনে নিভিয়ে দিত। এতে লাভ কী হত? ত্রিশ হাজার টাকা সুপারি নিয়েছি কি মুখ দেখাব বলে। 

—পাপ হয়ে গেছে আমাদের হাফি! দারুণ গুনাহ্ করেছি আমরা! আমি সারাক্ষণ বাচ্চাদের কান্না শুনতে পাচ্ছি কানে। 

—হাসালি। যেন এই প্রথম মাল ঝটকালি তুই। জানে মারিসনি যেন আগে কারওকে শালা। 

—সেগুলো বড় মছলি ছিল ভাই। 

—বড় মছলি আর কুচো…. এসব ভেবে লাভ আছে? কাজ হল কাজ। বড়দের জান কি জান নয়? একটা বাচ্চাকে খাইয়ে-দাইয়ে পাকিয়ে বড় করতে কত মাল লাগে জানিস? কাজটা নামিয়েছি কিন্তু নিখুঁত। কোনও কথা হবে না। 

—তোর মধ্যে দিল নেই রে। বাচ্চার বাপ হয়ে একথা কী করে বলছিস তুই? মানুষের জান পাথর হয়ে গেছে তোর। ওই হাতে আর চাঁদকে আদর করিস না। 

—কী বললি তুই? কী বললি? 

হাফি উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তার চোখে আগুন জ্বলে। হাতে সে মুঠো পাকায়। বলে— আমার বাচ্চা আমার। তার সঙ্গে অন্যের কী তুলনা! শালা, দুনিয়ার বাচ্চা কি আমার বিবি পয়দা করেছে? বাইরের ময়লা বাইরেই ধুয়ে আসা ভাল বাপি। অত দর্দ মাড়াতে হয় তো বিবির শায়ার তলে মুখ গুঁজে বসে থাক। 

বাপি কোনও কথা বলে না। হাফি তার কাছে এগিয়ে যায়। দেখে বাপির মুখ বেঁকে-চুরে যাচ্ছে। চোখ ফেটে জল নামছে তার। হাফি বিরক্ত হয়ে ওঠে। বলে—আরে! তোর হল কী! তুই কি মেয়েছেলে হয়ে গেলি নাকি? 

বাপি নিজেও এমনকী বিরক্ত হয়ে ওঠে নিজের ওপর। এই ভাবালুতা তাকে মানায় না। পেশাদার লোকের বিচলিত হতে নেই। কিন্তু সে কী করে! তার মাথার মধ্যে ঘুণপোকা কুট-কুট করে নিরন্তর কাটছে। ঘুমোতে পারছে না। কিছুতেই ঘুমোতে পারছে না। নিজেরই হৃদয়বৃত্তির কাছে পরাজিত হয়েছে তার পেশাদারি নিষ্ঠুরতা। সে নিরুপায়। হঠাৎ বড় আবেগে সে হাফির হাত চেপে ধরে। বলে—চল হাফি আমরা এ কাজ ছেড়ে দিই। 

—পাগল হলি নাকি? 

হাফি একটি সিগারেট ধরিয়ে বলে। হাফির বিবি মাংস রাঁধছে। তার সুবাস ছড়িয়ে যাচ্ছে ঘরময়। বাপি বলে—পাগল না। ঠিক বলছি। বেঁচে থাকার জন্য এত নীচে নামতে হয় যদি, তা হলে বেঁচে থেকে কী লাভ? 

—কী করবি? 

হাফি সিগারেটে টান দিয়ে বলে। 

—সে ভেবে দেখব। 

—এ কাজ ছেড়ে দিলে আমরা আর বেঁচে থাকব? যত লোকের কাজ করেছি সবাই একসঙ্গে খুন করবে আমাদের। 

—পালাব।

—কোথায় পালাব? 

বাপি নিজের চুল ধরে টানে। উত্তর দিতে পারে না। হাফি বলে—মাল খাবি? 

—বার কর। 

দু’জনে বোতল খুলে বসে। বিলিতি মদের মধুগন্ধ ঘরে ছড়িয়ে যায়। বাপি অনেকখানি খেয়ে ফেলে একসঙ্গে। এবং কাঁদে। মাতালের কান্না নয়। এতটুকুও মাতাল হয়নি সে। একেবারে আসলি অশ্রু তাকে বেসামাল করে দেয় কেবল। সে বিড়বিড় করে—ওঃ! কী পাপ! কী পাপ করলাম! 

হাফি ধীরে ধীরে পান করে। লক্ষ করে বাপিকে। ভাবে। ঠান্ডা, শান্ত ইস্পাতের মতো ধাতব চিন্তার মধ্যে মাদক পড়ে ফোঁটায় ফোঁটায়। সে বলে – কাঁদিস না। 

বাপি কাঁদে তবু। 

—আচ্ছা একটু কেঁদে নে। 

বাপি তখন মদে দ্বিতীয় চুমুক দেয়। সিগারেট ধরায় একটা। কথা বলে না। হাফি তাকে তীব্র চোখে নজর করে চলে। বোঝার চেষ্টা করে, এর মনের গতি কোনদিকে! তারা দু’জন একসঙ্গে জন্মেছে। একসঙ্গে বড় হয়েছে। এ কাজে পেশাদারিত্ব অর্জন করেছে একসঙ্গে। পার্থক্য শুধু, হাফি বিয়ে করে বাপ হয়েছে। বাপি বিয়ে করেছিল। কিন্তু তার বউ মারা গেছে। কিন্তু এ পর্যন্ত পরস্পরকে বুঝতে কোনও অসুবিধে হয়নি। তাদের নাড়ির স্পন্দন হুবহু এক ছিল। তাদের ক্ষুধা পেত একই সময়। তাদের গোপন ভরসা ও ভোগবৃত্তিতে কোনও পার্থক্য ছিল না। তারা পরস্পরকে জেনেছে প্রতিবিম্বের মতো। এই প্রথম হাফির মনে হচ্ছে, বাপি যেন কীরকম আচরণ করছে। সে ধরতে পারছে না। তার অসুবিধে হচ্ছে। ক্রমশ নানাবিধ জটিল সন্দেহ পাক খাচ্ছে তার মাথায়। যেরকম করছে বাপি, পুলিশে গিয়ে সব বলে দেবে না তো? এইরকম চলতে থাকলে বাপি তাদের অনেকের পক্ষে বিপজ্জনক। সে ঠান্ডা ইস্পাতের মাথায় হিসেব কষে। বাপিকে নজরে রাখতে হবে। সেরকম হলে, সেরকম হলে … 

সে মদে চুমুক দেয়। দ্বিতীয় সিগারেট ধরায়। ভাবে, আপনি বাঁচলে বাপের নাম। স্বার্থ সবার আগে। সেখানে ভাই ভাই নয়। বন্ধু বন্ধু নয়। 

সে হাসি মুখে বলে—পাপ তোর কিছু লাগবে না। যা লাগবে আমার।

—লাগবে, লাগবে। এই পাপ আমাদের জন্মে ছাড়বে না। দেখিস। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *