2 of 3

রাজপাট – ৫৯

৫৯ 

আমার আকাশ কালো হতে চায় সময়ের নির্মম আঘাতে;
জানি, তবু ভোর রাত্রে, এই মহাসময়েরি কাছে
নদী ক্ষেত বনানীর ঝাউয়ের ঝরা সোনার মতন
সূর্যতারাবীথির সমস্ত অগ্নির শক্তি আছে। 
হে সুবর্ণ, হে গভীর গতির প্রবাহ, 
আমি মন সচেতন; —আমার শরীর ভেঙে ফেলে
নতুন শরীর করো—… 

.

এই পরিচিতি কি প্রাপ্য ছিল তার? ভাবছিল সে। কিছুই করা হয়নি এ পর্যন্ত। সে করতে চায়। কল্পনায় রয়েছে তার হাজারও কাজের বিস্তার। তার জন্য লাগে একটা গোটা জীবন। কিংবা সঠিক বলতে গেলে, জীবনব্যাপী কাজ করা চাই তার। অন্য কিছু নয়। কাজই কেবল। কী কাজ? কোন কাজ? মানুষের সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া। আপন সুখ-দুঃখের সঙ্গে অভেদ করে নেওয়া অপরের দুঃখ-সুখ! 

তবু, এই যে লোক চিনে বসে তাকে, এই যে তার কথার শিখায় আশার দীপ জ্বালিয়ে তোলে চোখে, এ তার হৃদয় জুড়ে শক্ত করে তোলে দায়বদ্ধতা। যোগাসন করতে করতে ভাবে যখন সে এ-সব, ভাবছে যখন, তার শরীরে সেই স্পর্শ এসে লাগল। ঠান্ডা অস্ত্র হাতে নেবার অনুভূতি। 

একজন কমিউনিস্ট সে, গণসাম্যবাদী, কিন্তু অস্ত্রধারণ সম্পর্কে বিরূপতা অধিকার করেছিল তাকে। সে বিশ্বাস করত, মানুষই মানুষের শক্তি। কল্যাণবিধানই মানুষকে জয় করার পথ। প্রেম-প্রেম, ভালবাসা। মানুষের প্রতি মানুষের। সহমর্মিতা। মানুষের জন্য মানুষের। আজও এই বিশ্বাসই তার সম্বল। তার সাধনা। কিন্তু ইদানীং ভাবছে সে, উদ্যত অস্ত্রের মুখ নমিত করতে গেলে অস্ত্রই কি একমাত্র পথ নয়? অপশক্তি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠলে কল্যাণকে হতে হবে আরও বেশি ক্ষমতাবান। ক্ষমতাকে ক্ষমতা দিয়েই পরাজিত করা সম্ভব। আদিম এ নিয়ম। কিন্তু সত্য। এই আদিমতার প্রতি বিরূপ ছিল সে। জীবন ধীরে ধীরে তাকেই এখন প্রসারিত করছে এই বোধে। সে উপলব্ধি করছে, সহিষ্ণুতা একটি গুণ। কিন্তু সহিষ্ণুতা শেষ পর্যন্ত মানবচরিত্রে দেয় স্থৈতিক আলস্য এবং অকর্মণ্য প্রবণতা। সে কী করবে? কী করতে পারে? ময়না বৈষ্ণবীকে ভাবে সে। ময়না বৈষ্ণবী প্রতিদিন, একটু একটু করে, তার ভেতরে অসামান্যা হয়ে উঠছে। প্রতীকী হয়ে উঠছে। সে শুভশক্তি। সে প্রতিবাদী। তাই সে ধর্ষিতা। সে নির্মল-হৃদয়, তাই অসুন্দর সইতে না পেরে আকাশের নীচে গিয়েছিল। নিঃস্বার্থ হিতাকাঙ্ক্ষী ছিল সে। তাই নির্মম মৃত্যু তাকে লুপ্ত করে দিল জগৎ হতে। 

সিদ্ধার্থ আরও মহৎ করে ভাবে। ময়না বৈষ্ণবী এক উপলক্ষ মাত্র। প্রকৃতপক্ষে যা ধর্ষিত হয়েছে, তা প্রতিবাদ। যা হত্যা করা হয়েছে, তা শুভবুদ্ধি। এই হত্যালীলায়, ধর্ষকামনায়, জড়িয়ে গেছে ধর্মাচরণ, আরক্ষাব্যবস্থা, রাজনীতি ও প্রশাসন। কোনটিকে কার থেকে পৃথক করবে সে? করা সম্ভব নয়। ধর্ম রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে চিরকাল। ধর্মের ভেক রাজ-দুর্নীতিকে আশ্রয় দিয়েছে। প্রশাসন রাজনীতির করকবলিত-এরও কোনও ব্যত্যয় নেই। জনহিতের জন্য আরক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু ব্যবস্থা যন্ত্র মাত্র। তাতে ঘুণ ধরে। কল-কব্জা খসে যায়। তার কোনও চেতনা নেই। ব্যবস্থার কোনও চেতনা থাকে না। তাকে যে-কোনও স্বার্থে ব্যবহার করা যায়। 

তা হলে সে কী করবে? কী করতে পারে? স্বার্থপরের শক্তি অহিত, অসুর। এবং বিরাট। এই বৃহৎকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই আর। মহতের সঙ্গেই কেবল বিরাটকে দেখলে চলে না। যা নীচ, তা-ও বিরাট হতে পারে। হিংস্রতার স্ফীতি ভয়ানক কিন্তু মহৎ স্বীকার্য বলেই তার কিছুমাত্র কম পড়ে না। এই সকল ক্ষুদ্রতা ও নীচতার জটিল ও বৃহৎ আবর্তে সে-ও একজন। ঘোলাজল তাকে স্পর্শ করে থাকে। পাঁক তাকে স্পর্শ করে থাকে। সহস্র স্নান দ্বারাও তার ধৌতি সম্ভব হয় না কারণ সে আপাদমস্তক রাজনৈতিক। আর রাজনীতি যার ধর্ম, সে সম্পূর্ণ শুদ্ধ থাকে কী প্রকারে? 

তা হলে সে কী করবে? সে দেখে এই দেশ——ময়না বৈষ্ণবী। এদেশের সকল শুদ্ধচিত্ত মানুষ—ময়না বৈষ্ণবী। আঃ! সে চায়, সে একান্ত চায়, পর্বতপ্রমাণ হয়ে উঠতে, রুখে দাঁড়াতে চায় অন্ধ, নোংরা, পঙ্কিল ও হিংস্র উন্মাদনার বিরুদ্ধে। 

চায়। কিন্তু এ কোনও গল্পকথা নয়। জাদু নয়। একা সে কণামাত্র। বিন্দুমাত্র। গোষ্ঠীই মানুষের শক্তি। দল। আদিম—গহন আদিম এই সত্য। তার কী পরিচয়, যদি তার দল না থাকে, রাজত্ব না থাকে, না থাকে উদ্ধৃত পতাকা? বার বার এ প্রশ্ন জাগে তার মধ্যে। সে তবে কী? সে কে? কেমন তার করণীয়? কোন সেই পরিচয় যা তাকে দাঁড় করিয়ে দেবে একা, যা তাকে দিয়ে বলাবে—হ্যাঁ আমিই, আমিই সেই, সেই, মানুষের পাশে মানুষ… 

হ্যাঁ। মানুষ। সম্পূর্ণ একক। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক। সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ। 

তা কি হয়? হওয়া সম্ভব? তাদের দল ব্যক্তির চেয়ে সমষ্টিকে অধিক বলে জানে। মহৎ বলে জানে। তাদের দল, তাদের সাংগঠনিক যন্ত্র, নিঃশব্দে গড়ে নেয় কর্মী, কর্মী একজন, ব্যক্তি নয়। যদি কোনওভাবে কোনও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ছায়া ফেলে দলের ওপর, তবে সেই ছায়ার খণ্ডনে তৈরি হয় আরও প্রলম্বিত ছায়া। এই প্রক্রিয়ায় কোথাও কল্যাণ নেই, ক্ষমতার অধিকার আছে। মায়া নেই, প্রেম নেই, শ্রদ্ধা-ভালবাসা নেই। মানুষের জন্য যেটুকু ক্রিয়া —খাদ্যদ্রব্যের মূল্য হ্রাস, জমিবণ্টন, ধর্মঘট ও রাস্তাঘাট নির্মাণ, স্লোগান ও রক্তদান শিবির —সমস্তই অছিলা মাত্র। হিতের অছিলায় ক্ষমতার আগ্রহ। 

সে-ও এই যন্ত্র। এরই হাতিয়ার। এই বৃহৎ ব্যবস্থার নাট-বল্টু। খসে পড়লে কোনও মূল্য নেই। তা হলে সে কী করবে? কী তার করা উচিত? সে কি এক ভাঙনের দিকে যাত্রা করবে এই অভিপ্রায়ে, একদিন সে অসম্ভব ন্যায়রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে! 

সে নিজস্ব নীতি স্থির করার চেষ্টা করে এবং দ্বন্দ্বে উপনীত হয়। কী করা উচিত, এই সম্পর্কে কিছু বোধ স্পষ্ট দেখা দেয়, কিছু হয়ে দাঁড়ায় জটিল। সম্ভবত এই-ই মানুষের ভবিতব্য যে, সে যত বেশি চিন্তা করবে তত বেশি দ্বিধাগ্রস্ত হবে। চিন্তার গভীরতাই মানুষকে দেয় বিবিধ বিপরীতমুখী তত্ত্ব। উদাহরণসহ তা এই বৈপরীত্যকে উপস্থাপিত করে। অতএব সে চিন্তাকুল হয়ে ওঠে। সমস্ত কাজের মধ্যে সে কেবল ভাবে। যে-কোনও নীতিই পরিগ্রহণ করার আগে প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস কেবল আত্ম আর বিশ্বাস থাকলেই হয় না। অনেক ভাঙা-গড়া, গ্রহণ-বর্জনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তা সুদৃঢ় হয়। মানবজীবনে এই প্রক্রিয়া ক্রমসঞ্চারমাণ। 

সিদ্ধার্থ যে-আত্মবিশ্বাস এ যাবৎকালে অর্জন করেছে, তার পরিচর্যা সে ঘটিয়ে চলেছে নিরন্তর। কারণ আত্মবিশ্বাস শাণিত করতে হয়। সাধারণকে করে তুলতে হয় অসাধারণ। দুর্বলকে জোরাল। প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় নিজেকে ফেলে, নিজের বিশ্বাস ও ধারণাকে ফেলে ঘষে-মেজে নিতে হয় ভবিষ্যতের জন্য। এভাবেই মানুষ নিজের শুদ্ধি ঘটিয়ে নিজেকে নতুন করতে করতে এগোয়। জীবনকে ভালবাসে যে, ভালবাসতে হয়—এই উপলব্ধি আছে যার, সে-ই চিরকাল নতুনে আগ্রহী। 

সিদ্ধার্থ অনুভব করে, সে জীবনকে দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে ভালবাসে। যেমন ভালবাসেন বোধিসত্ত্ব। যেন এক প্রজন্ম পেরিয়ে, জীবনের প্রতি অপূর্ব প্রেম বোধিসত্ত্বের কাছ থেকে উৎসারিত হয়ে তারই মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে যাচ্ছে। মাঝখানে যে-পুরুষ, তার পিতা, তিনি ছিলেন শূন্য হৃদয়। কিংবা যতেক অসুস্থ আবর্জনা অধিকার করেছিল তাঁর হৃদয়। 

সেই দিন, সেই চরম দিন, শ্মশানে সকলই মোচন করে, ভাগীরথীতে স্নাত হয়ে তারা শূন্য গৃহে ফিরেছিল যখন, সে এবং বোধিসত্ত্ব, ঘরময় সেই হাহাকারের মধ্যে সে আর্তনাদ করেছিল। অন্তরে চাপা আর্তনাদ। আত্মীয়-বন্ধুর দ্বারা গৃহে লোকসমাগম ছিল। তবু তার মনে হয়েছিল, এ বড় শূন্যতা! এ এক অসহ শূন্যতা! ঘরের কোণে কোণে বাতি জ্বলেছিল। কখন শুরু হয়েছিল সব আর শেষ হল কখন, সে-জ্ঞান তাদের ছিল না। বরং, সেই বিজলির আলোয় উদ্ভাসিত বাড়িকেও তার মনে হচ্ছিল চাপ-চাপ অন্ধকারে আবিল। 

অধিক রাত্রে, যখন পরিশ্রান্ত যে-যেখানে হোক শুয়ে পড়েছিল, সে, হৃদয়ে মাথা খুঁড়ে মরা যন্ত্রণা আর বইতে পারছিল না বলে, পায়ে পায়ে গিয়েছিল বোধিসত্ত্বের কাছে, তার একমাত্র সান্ত্বনা, একমাত্র আশ্রয়। 

খুব স্বাভাবিক যে, তিনি জেগে ছিলেন। সে, ঘরে অন্ধকার, প্রবেশ করেছিল নিঃশব্দে। বোধিসত্ত্ব আহ্বান করেছিলেন—আয়! 

সারাদিন কান্না তার বক্ষলগ্ন ছিল। তবু দাহ নেভেনি। এমনকী নেভেনি আজও। নিভবে কি কোনও দিন? 

বোধিসত্ত্ব পিঠে বালিশ দিয়ে বসেছিলেন ওই অন্ধকারে। সে কাছে বসেছিল। বোধিসত্ত্ব তাকে কোলের ওপর জড়িয়ে নিয়েছিলেন। কান্না নয়, তবু কান্নার মতোই সে উচ্চারণ করেছিল কিছু কথা— কী যন্ত্রণা দাদু! আমরাও কেন মরে যাচ্ছি না? 

বোধিসত্ত্ব তাঁর বার্ধক্যের বুকে তার তরুণ মুখ চেপে বলেছিলেন—মৃত্যুর মধ্যে কখনও নিবারণ খুঁজিস না বাবা। জীবন মৃত্যুর চেয়ে বড় 

—আর পারছি না দাদু। 

—আমি পারছি কেমন করে ছোটবাবু? তোমার জন্য। আমার ফুরিয়ে আসা জীবনের সকল প্রাণ তো তুমি। আমার ভরসা হও। 

—ও দাদু! দাদু! 

সে আঁকড়ে ধরেছিল বোধিসত্ত্বকে। ওই নিষ্ঠুর যাপনের অন্ধকারের মধ্যেও তিনি বলেছিলেন—এই দীর্ঘ জীবনে কত দেখলাম। সব দেখেশুনে, ছোটবাবু, আজ এই অসহ্য শোকের মধ্যেও আমি বিশ্বাস করি, জীবন মৃত্যুর চেয়ে বড়। কারণ জীবন সকলের ধারক। রোগ, শোক, ক্ষয়, অসৎ, অন্যায়ের ধারক সে। সে-ই তো বড়, যে কোনও কিছুই পরিহার করে না। ভাল-মন্দ দুই-ই তার সম্পদ। 

সে ভোলেনি এইসব। ভুলবে না। চূড়ান্ত শোকে, বিপুল আনন্দে—সকলেরই মাঝে বোধিসত্ত্ব নির্মাণ করেছেন তার জীবনবেদ। 

.

তৌফিককে সঙ্গে নিয়ে হেঁটে আসছিল সে। তৌফিক তার পরবর্তী গ্রামযাত্রা বিষয়ে প্রশ্ন করছিল। সরালের পর আশেপাশের আরও কয়েকখানি গ্রাম সে ঘুরেছে। দেখেছে প্রায় একই বলেওছে প্রায় একই কথা। কিন্তু পাড়-ভাঙার সঙ্গে তাকে দেখতে হয়েছে দারিদ্র্য। চরম দুর্বিষহ দারিদ্র্য। এই সবই তার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। 

তৌফিক শুনছিল তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা। পরের বার সে যাবে। সে উৎসাহিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রতি সপ্তাহে যাবার পরিকল্পনা পাল্টাতে হয়েছে তাদের। এত কাজ করার আছে যে, এখানকার কাজ কিছু সামলে, তারপর আবার যাওয়া। সিদ্ধার্থর ইচ্ছে, মাসে অন্তত একবার সে এ-যাত্রা বজায় রাখে। সম্ভব হলে দু’বার। মাঝখানে আরও একটি বিষয় তাকে টানছে। পেতনির চরে বসবাসের স্বীকৃতি সে আদায় করতে চায়। হারাধনের এই প্রস্তাব সে গ্রহণ করেছে। 

হারাধনের বিবাহের পর থেকে সিদ্ধার্থর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ এখন অনিয়মিত। সিদ্ধার্থর ব্যস্ততাও তার কারণ। তবু সামান্য দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে যা, তাতে সিদ্ধার্থর চোখে হারাধনকে মনে হয়েছে আগের চেয়ে গম্ভীর। অন্যমনস্ক। সে কারণ জিজ্ঞাসা করেনি। 

পেতনির চরের বিষয়ে রাসুদার সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা সে বলেছে আজ। ভাঙনের মিছিল থেকে সরে দাঁড়াবার জন্য রাসুদা তার প্রতি ক্ষুণ্ণ হয়ে আছেন। ইদানীং মিহির রক্ষিতের সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। তাতে সিদ্ধার্থের কিছু এসে যায় না কারণ রাসুদার প্রতি তার শ্রদ্ধা সম্পূর্ণ বজায় আছে। সে বিচলিত বোধ করে তখনই যখন তার নিজের মধ্যেকার শ্রদ্ধাবোধ টলমল করে। 

রাসুদার কাছে এ প্রস্তাব করল যখন সে, রাসুদা বললেন— তোকে যে-কাজের ভার দিলাম সেটা করলি না। নিজের খুশিমতো কাজ করলে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবি তুই। দলই মানুষের শক্তি, তা মানিস তো? 

সে নীরব ছিল। রাসুদার ভর্ৎসনার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়নি। রাসুদা অতঃপর বলেছিলেন—তোর ওপর আমার অনেক ভরসা। তোর মধ্যে শক্তি ছিল। খামখেয়ালিপনা করে নিজেকে নষ্ট করিস না। 

সে এ-নিয়ে তর্ক করেনি যে, সে খামখেয়ালিপনা করছে না। ভাঙন বিষয়ে সে যে- আন্দোলনের পথ নিয়েছে, সেটাই সঠিক। কোনওদিন সে ব্যাপক আন্দোলনের সূচনা করে তা প্রমাণ করবে। কিন্তু এখনও তা বলার সময় আসেনি। সে বুঝতে পারছে গ্রামভ্রমণের অভিজ্ঞতা তাকে সমৃদ্ধ করবে। দেখার ব্যাপ্তির মধ্যেই থাকে কর্মের প্রণোদনা। 

তার নীরবতাকে পরিপূর্ণ আনুগত্যের সম্মতি ভেবে রাসুদা বলেছিলেন-তোকে ভাইয়ের মতো দেখি, তাই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগতভাবে একটা কথা বলি… 

এদিক-ওদিক দেখেছিলেন তিনি। কাছাকাছি ছিল না কেউ। রাসুদাকে সতর্ক থাকতে হয় গুপ্তচরের উপস্থিতি বিষয়ে। কাকে এত ভয় রাসুদার? মিহির রক্ষিতকেই নিশ্চয়ই। 

রাসুদা কথা শেষ করেছিলেন নিচু গলায়—তুই আমাদের দলের সম্পদ। একথা আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝি। আজকাল তো পড়াশোনা করে না কেউ। তত্ত্ব নিয়ে মাথা ঘামায় না। শুধু ক্ষমতার লোভ। মার্ক্সের দর্শনই যদি না বোঝে, দলকে সংগঠিত রাখবে কীভাবে? একটা নির্দিষ্ট তত্ত্ব অনুসরণ করা হয় বলেই, আমরা, আজ দশ বৎসর যাবৎ ক্ষমতায় আছি। আরও সংগঠিত করতে পারছি নিজেদের। সারা পশ্চিমবাংলায় আমাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের অবস্থানের নিরিখে, পশ্চিমবঙ্গ একেবারেই অনন্য অবস্থানে। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে কেন? কারণ দলে বর্তমান আছেন বেশ কয়েকজন সৎ, অভিজ্ঞ এবং তাত্ত্বিক নেতা। তাঁরাই পার্টির প্রাণ। কিন্তু ভবিষ্যৎ? আমাদের ভবিষ্যৎ কী! আজ থেকে কুড়ি বছর পর এই শ্রেণির নেতার চাহিদা তৈরি হবে দলে। তখন কারা উঠে আসবে? কারা হবে কর্ণধার? আমাদের যন্ত্র হয়েছে প্রচুর। যন্ত্রী নেই। হাতিয়ার আছে অগণিত। হাত নেই। নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা না থাকলে হাতিয়ার হাতের চেয়ে বড় হয়ে যায়। সময় তো ক্ষমা করে না কারওকে। অতএব, পাগলামি করিস না। সবদিক দেখে-শুনে চলতে হবে। তোর বয়স অল্প। অভিজ্ঞতা কম, আবেগ বেশি। অবশ্য আবেগ না থাকলে মানুষ আর মানুষ থাকে না বলেই আমার বিশ্বাস। আবেগ তো সম্পদ মানুষের। কিন্তু তোকে দেখতে হবে, তোর আবেগনির্ভর কোনও কাজ যেন অন্যের অস্ত্র হয়ে না ওঠে! 

রাসুদাকে কথা পরিবর্তন করতে হয়েছিল কারণ মিহির রক্ষিত ব্যস্ত পায়ে ঢুকেছিলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিলেন—শুনেছেন খবরটা? 

তারা তাকিয়েছিল। 

মিহির রক্ষিত বলেছিলেন— দীপেন হাজরার এক সঙ্গী খায়রুল মোল্লার বাড়িতে দু’কেজি হেরোইন ও চারটে বন্দুক পেয়েছে পুলিশ। 

—ছেলেটাকে ধরেছে? 

—না। পায়নি। পুলিশ তো বলছে খায়রুলই দীপেনকে সরিয়ে বডি গাপ করেছে।

সিদ্ধার্থ তার চোখ-মুখ রেখেছিল অসীম নির্বিকার। মিহির রক্ষিত বলছিলেন— সারা শহর যেন সমাজবিরোধীতে ভরে গেছে। 

দাঁতে দাঁত পিষছিল সিদ্ধার্থ। লোকটা সাধু সাজার চেষ্টা করছে। 

তখন তার দিকে তাকিয়েছিলেন মিহির রক্ষিত। ভ্রূ কুঁচকে বলেছিলেন—সুখবরটা পেয়েছ? 

—কী খবর? 

জিগ্যেস করেছিল সে। রাসুদা বলেছিলেন—তোমার জন্য একটি মোটরবাইক আসছে। এ সপ্তাহেই পেয়ে যাবে। 

সে হেসেছিল। বলেছিল—বাঃ! বেশ সুবিধা হবে। 

মিহির রক্ষিত বললেন—আমরাই তো করালাম। 

রাসুদা বললেন—মাসে পঁচিশ লিটার তেল বরাদ্দ। এর বেশি প্রয়োজন হলে খরচ নিজের।

তখন তার বিস্ময় জাগছিল। মিহির রক্ষিতের সুর যেন অন্যরকম। কেন, সে বুঝতে পারছিল না। কিংবা অন্য একটি সন্দেহ ঘন হয়ে উঠছিল তার মধ্যে, কারণ সে জানে, দেওয়ালের থাকে নিজস্ব কান এবং বাকশক্তি। আর অন্ধকারের থাকে নিজস্ব চোখ এবং নির্লজ্জ গুপ্তচরবৃত্তি। দীপেন হাজরার প্রকৃত খবর মিহির রক্ষিতের কাছে পৌঁছে যাবার সুদূর সম্ভাবনা নেই, তা নয়। তা হলে, মিহির রক্ষিতের ব্যবহার পরিবর্তনের কারণ হিসেবে ধরতে হবে তিনি ভয় পেয়েছেন। এতদিন সিদ্ধার্থ ছিল নির্বিষ। এখন ক্ষতি করার শক্তি অর্জন করেছে সে। এবং এই শক্তি তাকে দিচ্ছে মিহির রক্ষিতের সম্ভ্রম। সে চিন্তান্বিত হয়ে উঠছিল। 

ঠিক সেই সময় রাসুদা পেতনির চর বিষয়ে তার আন্দোলন-পরিকল্পনা ব্যক্ত করেছিলেন। সিদ্ধার্থকে বিস্ময়ের চূড়ায় তুলে এই পরিকল্পনাও সমর্থন করলেন মিহির রক্ষিত। বললেন—এ তো আমাদের আরও আগে ভাবা উচিত ছিল। খুব ভাল প্রস্তাব। 

স্থির হয়েছে, কীভাবে আন্দোলন করা হবে, সে নিয়ে আলোচনা করা হবে সন্ধ্যায়। 

নির্বাচন এগিয়ে আসছে। এখন কিছুদিন ঘন ঘনই আলোচনা হবে তাদের। এবং বিধানসভা নির্বাচন শেষ হলেই, এক বছরের মধ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন চলে আসবে। তার ওপর, বর্তমান কেন্দ্রীয় মোর্চা সরকারের স্থায়িত্বের প্রতি আস্থা কারও নেই। যে-কোনও দিন সরকার ভেঙে দেওয়া হবে। নতুন করে হবে লোকসভা নির্বাচন। হয়তো তার জন্য জোর প্রস্তুতি নেবারও সময় পাওয়া যাবে না। 

সিদ্ধার্থ ভাবছিল, পর পর এতগুলি নির্বাচন হতে থাকলে রাজনৈতিক দলগুলি কেবল প্রচারকল্পেই ব্যস্ত থাকবে নিরন্তর। না থেকে উপায় নেই। তা হলে সত্যিকারের কাজ হবে কখন! দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে জনজীবনের মান উন্নত হতে পারবে না। 

মোটরবাইক প্রাপ্তির কথা শুনে তৌফিক উত্তেজিত। প্রথমেই সে বলেছে—তুমি বসবে। আমি তোমায় সব জায়গায় নিয়ে যাব সিধুদা। 

সিদ্ধার্থ হেসেছে। এই ছেলেটি তার ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠেছে প্রায়। নতুন নতুন কাজের পরিকল্পনা নিয়ে উদ্দীপিত। হঠাৎ, কাজের থেকে সুর পাল্টে সে বলল—একটা কথা তোমাকে বলার আছে সিধুদা। 

—বল। 

—আমার একটা থাকার জায়গা দরকার। 

—কেন রে? বাড়িতে কী হল? 

—বড় ভাই আর ভাবি আমাকে নিয়ে অশান্তি করছে খুব। আমার জন্য সারা বাড়ির অসুবিধা। 

—হুঁ। একটু ভেবে দেখি। 

কথা বলতে বলতে সাহেবপাড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল তারা। আকাশে মধ্যাহ্ন সূর্যের দহন। আষাঢ়নবমীর ওই শুক্লপক্ষীয় বৃষ্টির পর আর মেঘ জমেনি। সারা পৃথিবী যেন পুড়ে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। সেই পোড়া গন্ধ এসে লাগছে সিদ্ধার্থের ঘ্রাণে। শুধু মাটি-পোড়া গন্ধ এ নয়। দেহ-পোড়া গন্ধও। যেন শ্মশানঘাট এসে গিয়েছে সন্নিকটে। 

হঠাৎ চিৎকার শুনল সে। এই গরমের শুষ্ক দুপুরে পথে লোক কম। গ্রীষ্মের ছুটির পর স্কুলগুলি খুলেছে সবে। সে দেখল, জনবিরল এই পথেও ছুটে যাচ্ছে লোক। কোথায়? তখন চোখে পড়ছে তার। নিবেদিতা বাগচীর স্কুল, ‘প্রথম পাঠ’-এর দোতলার জানালা থেকে আগুনের হলকা উঠছে। একটি জানালা বন্ধ। একটি জানালা আধখোলা। তা থেকেই বেরিয়ে আসছে আগুন। তৌফিক তার হাত চেপে ধরে বলছে—সিধুদা! আগুন! 

সে বলছে—ছোট, তৌফিক! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *