৫৭
এখন অনেক দূরে ইতিহাস-স্বভাবের গতি চ’লে গেছে।
পশ্চিম সূর্যের দিকে শত্রু ও সুহৃদ তাকায়েছে।
কে তার পাগড়ি খুলে পুব দিকে ফসলের, সূর্যের তরে
অপেক্ষায় অন্ধকার রাত্রির ভিতরে
ডুবে যেতে চেয়েছিলো ব’লে চ’লে গেছে।
.
মানুষ হিসেবে নবাব আলিবর্দি খাঁয়ের কোনও তুলনা ছিল না। হিন্দু মুসলমান সকলের প্রিয় পাত্র ছিলেন তিনি। শান্ত ও শুদ্ধচিত্ত এই মানুষটি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ ও ধর্মভীরু। কেবল সিরাজের বেলাতেই তাঁর ন্যায়বোধ অন্ধ হয়েছিল।
তিনি যখন পাটনার নবাব তখন এক হিন্দু সাধু এলেন তাঁর কাছে। তাঁর ভাগ্যগণনা করে বললেন—হে মহামান্য নবাবসাহেব, আপনি মসনদ লাভ করবেন। বাংলা-বিহার-ওড়িশার সিংহাসন পাবেন আপনি!
আলিবর্দি বলেছিলেন—কেমন হবে সেই জীবন?
—নিষ্কণ্টক হবে না।
বলেছিলেন সেই সাধু। তার সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন—আপনি যে রোশনি জ্বালবেন, তার রেশ যতদিন থাকবে ততদিন। তারপর বড় অন্ধকার।
আলিবর্দি বলেছিলেন—হায়! আমিই কি সেই অন্ধকারের কারণ হয়ে থাকব?
—না। ইতিহাস আপনি লিখিত হয়। আপনি তাকে খণ্ডাবার কে? গড়ে তুলবারই বা কে? আপনি ইতিহাসের অংশ মাত্র। কিছুই আপনার হাতে নেই।
সাধুর কথা সত্য হল। আলিবর্দি খাঁ বাংলার মসনদে বসলেন।
অপুত্রক আলিবর্দির তিনটি মেয়ে ছিল। আমিনা, ঘসেটি ও ময়মানা। আলিবর্দি নিজের ভাই হাজি আহমদের তিন পুত্র নোয়াজেস মহম্মদ, সাইয়েদ আহমদ ও জয়েনুদ্দিনের সঙ্গে তিন মেয়ের বিবাহ দিয়েছিলেন। ঘসেটির সঙ্গে বিবাহ হল নোয়াজেস মহম্মদের। আমিনার সঙ্গে জয়েনুদ্দিনের এবং ময়মানার সঙ্গে সাইয়েদ আহমদের। বাংলার সিংহাসনে বসে তিন জামাতাকে তিন প্রদেশের শাসনভার দিলেন তিনি। জয়েনুদ্দিন পাটনায়। সাইয়েদ আহমদ পূর্ণিয়ায়। নোয়াজেস মহম্মদ ঢাকায়।
আলিবর্দি যখন পাটনার নবাব তখন আমিনার কোলে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হল। তার নাম মির্জা মহম্মদ। আলিবর্দি তাকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করলেন। তার নাম হল সিরাজদ্দৌলা।
দেখতে দেখতে নবাব, আলিবর্দির চোখের মণি হয়ে উঠল সিরাজ। তার জন্য আদর যত রইল, শাসন রইল না। আবদার যত সহ্য করা হল, অভিযোগ শোনা হল না। ফলে সিরাজদ্দৌলার শিক্ষা সম্পূর্ণ হল না। শৈশব থেকেই তিনি হয়ে উঠলেন খুদে নবাব। বিলাস ও কুপ্রবৃত্তির বিষ তাঁর মধ্যে অঙ্কুরিত হয়ে ফলে-ফুলে বেড়ে উঠল। তাঁর কুপ্রবৃত্তিকে ইন্ধন দেবার লোকেরও অভাব রইল না। যারা বিলাস ব্যসন, বহুনারী গমন ইত্যাদিকে নবাবির অন্যতম লক্ষণ মনে করত, তারা আলিবর্দি খাঁর ধর্মপরায়ণ উন্নত জীবনচর্চায় সন্তুষ্ট ছিল না। সেই অসন্তোষ নিয়ে তারা ঘিরে ধরল কিশোর সিরাজকে। সিরাজ মত্ত হয়ে উঠল।
আলিবর্দির জীবনযাত্রায় মুর্শিদাবাদের প্রাসাদ পবিত্র হয়ে উঠেছিল। দান-ধ্যান, শাস্ত্রব্যাখ্যা, ন্যায়বিচার চলত সারাক্ষণ। রাজপ্রাসাদে বারবণিতার প্রবেশাধিকার ছিল না। রাজকার্যের মধ্যে ছিল না কোনও নৃত্যগীতের বিলাসিতা। কিন্তু এই ধর্মাচারী প্রাসাদে সিরাজের দিন অসহ্য হয়ে উঠল। তিনি চান রঙিন জীবন। নারী, সুরা, নৃত্যগীতের বিলাস। অনেক ভেবে অবশেষে তিনি একদিন আলিবর্দির কাছে গিয়ে বললেন—একখানি জীর্ণ কম্বলে দশজন ফকির একত্রে বসিয়া বৎসর অতিবাহিত করিতে পারেন কিন্তু একটিমাত্র পুরাতন প্রাসাদে প্রবীণ এবং নবীন দুইজন ভূপতি একসঙ্গে বাস করিলে তাঁহাদের মানসম্ভ্রম শীঘ্রই উপহাসের বিষয় হইয়া পড়ে।
আলিবর্দি বুঝলেন। সিরাজের জন্য নতুন প্রাসাদ নির্মাণের আদেশ দিলেন তিনি।
রাজধানীর নিকটে ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে সিরাজের প্রমোদভবন নির্মিত হল। নাম হল হিরাঝিলের প্রাসাদ। গৌড়ের রাজপ্রাসাদের কারুকার্য করা পাথর সংগ্রহ করে সিরাজের ভবন সাজানো হল। সিরাজ সেই ভবনে স্বাধীনভাবে বসবাস করতে লাগলেন। আলিবর্দি তার জন্য মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করলেন।
দিন যায়। সিরাজের বিলাসের উপকরণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। একদিন সিরাজ উপলব্ধি করলেন, এই পরিমাণ বৃত্তিতে আর চলছে না। কীভাবে বৃত্তি বাড়ানো যায়? তাঁর কূট বালক মন বুঝেছিল, অনুরোধে-উপরোধে যা বাড়বে তাতে তাঁর বিপুল বিলাসব্যয়ভার অতিবাহিত হবে না। তাঁর চাই প্রভূত অর্থ। এবং অর্থ মানেই স্বাধীনতা। বেহিসেবি অর্থের বিনিময়ে বেহিসেবি স্বাধীনতা। বেহিসেবি স্বাধীনতার বিনিময়ে বেহিসাবি উল্লাস নারী, সুরা, শিকার, পীড়ন, তর্জন! হা সিরাজ, হা সিরাজ, হা হা হা সিরাজদ্দৌলা, সে মিতব্যয়ে বিশ্বাসী নয়, মিতাচারে তুষ্ট নয়! অতএব চতুর হলেন ভাবীকালের নবাব সিরাজ। ফন্দি আঁটলেন জব্বর। কেউ তা টের পেল না।
সিরাজ আলিবর্দিকে পাত্র-মিত্রসমেত হিরাঝিলের প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানালেন। আলিবর্দি সকল পাত্র-মিত্র এবং মুর্শিদাবাদে উপস্থিত রাজা-মহারাজাদের নিয়ে সিরাজের প্রাসাদে পদধূলি দিলেন। সকলকেই সাদর অভ্যর্থনা করলেন সিরাজ। লোকে হিরাঝিল প্রাসাদের প্রশংসা করতে লাগল। ঘুরে ঘুরে প্রাসাদ দেখতে লাগল। বিস্ময় উপচে পড়ছে তাদের চোখে। লোভ ঝিলিক দিচ্ছে তাদের দৃষ্টিতে। ইনশাল্লাহ্! এই না হলে ভাবী নবাবের প্রাসাদ! ভগবান যাকে দেন একেবারে ছপ্পর ফেড়ে দেন!
দেখাশোনা শেষ হলে দরবার কক্ষে বসবে মজলিশ। সিরাজ তখন নবাবকে নিয়ে গেলেন প্রাসাদের অন্দরমহল দেখাতে। পরিদর্শন শেষ হলে তিনি দরবার কক্ষে আসবেন।
আজ সেই প্রাসাদ আর নেই। কাল তাকে খেয়েছে। নদী তাকে গর্ভে ভরেছে। কিন্তু সেই সময় হিরাঝিলের প্রাসাদ, অর্থাৎ লোকে যাকে মনসুরগঞ্জের প্রাসাদ বলত, তা ছিল দর্শনীয় স্থাপত্য। ভিন্ন ভিন্ন মহলে বিভক্ত এই প্রাসাদের একটি মহলই একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাসাদ হতে পারত। প্রাসাদের একধারে ছিল হিরাঝিল। লোকে বলে, ঘসেটি বেগম ও নওয়াজেস মহম্মদের মোতিঝিলের অনুকরণে সিরাজ ওই হিরাঝিল খনন করেন।
এই বিশাল প্রাসাদ একদিনে দেখে ওঠা সময়সাপেক্ষ ও শ্রমসাধ্য।
সময় বয়ে যায়। নবাবের দেখা নেই। অভ্যাগতরা শঙ্কিত হয়ে উঠছেন। এত দেরি কেন? নবাব-রাজা-সুলতান-সম্রাটের ইতিহাস চিরকাল আত্মীয়বধের রক্তে কলঙ্কিত। তা ছাড়া, সিরাজের স্বভাব-চরিত্র বিষয়ে সকলে অবগত আছেন। উচ্ছৃঙ্খল, বিলাসী, চপলমতি এই কিশোরকে বিশ্বাস নেই। তবে কি… তবে কি… নিরুচ্চার প্রশ্ন সকলের মনে মনে ফেরে।
সিরাজ তখন কক্ষ হতে কক্ষান্তরে নিয়ে চলেছেন নবাবকে। একটি কক্ষে এসে নবাব দেখলেন তিনি একা। সিরাজ পাশে নেই। নবাব ডাকলেন সিরাজকে। সাড়া নেই। কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে দ্বারপ্রান্তে এলেন। দ্বার রুদ্ধ। অন্য দ্বার দিয়ে বেরুতে গেলেন, সে-ও রুদ্ধ। নবাব আলিবর্দি সিরাজকে ডাকেন আর সিরাজ হা-হা করে হাসেন। প্রতিটি রুদ্ধদ্বারের প্রান্তে তাঁর হাস্যধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়। নবাবের কৌতুক জাগে। তাঁর চোখে সিরাজ বড় ছেলেমানুষ মাতামহের সঙ্গে দৌহিত্রের লুকোচুরি খেলা তো সাজেই।
কিন্তু খেলার সময় দীর্ঘ হয়ে উঠল। নবাব ক্লান্ত হলেন। এবার শেষ হওয়া চাই। তামাম বাংলা-বিহার-ওড়িশার নবাব, হিন্দুস্থানের বাদশার বল-ভরসা, নবাব আলিবর্দি খাঁ রুদ্ধ দ্বারের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে দ্বার খুলে দেবার জন্য অনুনয় করলেন। সিরাজ দ্বার খুললেন না। এবার নবাব নিরুপায় হলেন। তাঁর উপলব্ধি হল, তিনি বন্দি হয়েছেন। হায়! যাঁকে তিনি আপন প্রাণাপেক্ষা অধিক প্রিয় মনে করেন, যাঁকে অদেয় কিছু নেই, যাঁর জন্য এই সাম্রাজ্যকে নিঃশত্রু ও নিষ্কন্টক করে তোলার জন্য তিনি অবিশ্রাম প্রাণপাত করছেন, তাঁর এমন কূটকৌশল! এমন ছলনা! আহাহা! নাদান বাচ্চা আর কাকে বলে! এবার তিনি বললেন—তুমি আমার প্রিয়পাত্র। এরূপ কৌশল করিবার প্রয়োজন কী ছিল। কী চাহ তাহা বল।
সিরাজ বললেন—আমার প্রাপ্য মাসোহারা বৃদ্ধি করুন।
—বেশ। করিলাম।
—অঙ্গীকার করুন।
—অঙ্গীকার করিলাম।
—যুদ্ধশাস্ত্রে নগদ অর্থই একমাত্র মুক্তিপত্র। রাজা-বাদশাহের মুখের কথায় বিশ্বাস কী!
নবাব অসহায় বোধ করলেন। সমুদয় পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাঁর লজ্জা হল। তিনি একান্ত অনুরোধে বললেন—আমি অঙ্গীকারবদ্ধ হইয়াছি। তুমি আর কেন অবিশ্বাস কর? তুমি তো আমাকে জানিয়াছ। হে প্রিয় দৌহিত্র, দ্বার খুলিয়া দাও। যাহা হইবার তাহা হইয়াছে। এ-কথা বাহিরে প্রকাশিত হইলে লোকে বড়ই উপহাস করিবে। রাজা-মহারাজাগণ আমার অপেক্ষা করিতেছেন।
সিরাজ নিষ্ঠুরের মতো বললেন—বৃদ্ধ নবাবের পক্ককেশ রাজা-মহারাজাদিগের নিকট যদি এতই মূল্যবান বস্তু, তবে তাঁহারাই কেন অর্থদানে নবাবের বন্ধনমোচন করুন না।
অপেক্ষমাণ রাজা-মহারাজার কাছে এ সংবাদ পৌঁছল। তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সিরাজের স্বভাব তাঁরা জানতেন। তিনি যা চান তা কবলিত না-হওয়া পর্যন্ত তাঁর শান্তি নেই। অগত্যা যাঁর কাছে যা ছিল, সব একত্র করে প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা সিরাজকে দিয়ে নবাবকে মুক্ত করা হল।
আশ্চর্য নবাব আলিবর্দি খাঁ! আশ্চর্য তাঁর স্নেহ। সিরাজদ্দৌলার এ আচরণে তিনি ক্রুদ্ধ হলেন না। বরং দৌহিত্রের কাছে বুদ্ধিকৌশলে পরাজিত হয়ে পরম কৌতুক লাভ করলেন। সহাস্যে বলে বেড়ালেন—সিরাজের ন্যায় বুদ্ধিমান আর নাই। কী কৌশলই না আঁটিয়াছিল।
সিরাজের অর্থবল বৃদ্ধি পেল। তাঁর পাপেরও কোনও সীমা রইল না। নারী, সুরা, বিলাসে ভাসা সিরাজের চাই নিত্য নতুন নারীদেহ। তাঁর অনুচরেরা ছলে-বলে ভদ্র গৃহস্থকন্যারও সর্বনাশ করতে লাগল। বাংলার ঘরে ঘরে সিরাজদ্দৌলা হয়ে উঠল মহাপাপের অন্য নাম।
কিন্তু শুধু নারী-সুরা নিয়ে মত্তই ছিলেন না সিরাজ। চতুর রণকৌশলী এবং সুযোদ্ধা ছিলেন তিনি। প্রায় শৈশব থেকেই আলিবর্দি খাঁয়ের সঙ্গে তিনি বহুবার যুদ্ধযাত্রা করেছেন। অতএব নবাবি পাবার জন্য অচিরেই লালায়িত হয়ে উঠল তাঁর মন। আফগানরা তাঁর পিতা জয়েনুদ্দিনকে হত্যা করেছিল। আলিবর্দি খাঁ অনেক যুদ্ধ করে আফগানদের পরাস্ত করে পাটনায় পুনরধিকার স্থাপন করেছিলেন। শিশু সিরাজকে নামমাত্র নবাব করে পাটনার শাসনভার তিনি অর্পণ করেছিলেন তাঁর একান্ত প্রিয়, অনুগত, বিশ্বস্ত, সুযোগ্য পরিচালক রাজা জানকীরামের ওপর।
পনেরো বৎসর বয়সে পার্টনার নবাবি হস্তগত করার অভিলাষে সিরাজ আলিবর্দি খাঁয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। সেইসঙ্গে পার্টনার দুর্গ আক্রমণ করলেন। একটি চরমপত্র তিনি লিখে পাঠালেন নবাবকে। আলিবর্দি খাঁ এবারও কিন্তু সিরাজের ওপর ক্রুদ্ধ হলেন না। বরং যুদ্ধে সিরাজের কোনও ক্ষতি না হয়—এই ভাবনায় ব্যাকুল হলেন। সিরাজ চেয়েছিলেন সম্মুখ সমরে শক্তিপরীক্ষা–হয় তোমার জয়, নয় আমার। হয় তুমি থাকবে, নয় আমি থাকব। কিন্তু আলিবর্দি খাঁ যুদ্ধের কথা চিন্তাও করলেন না। একটি অসামান্য পত্র তিনি লিখে পাঠালেন সিরাজকে। পত্র না বলে এই রচনাকে শের বলা ভাল। অর্থাৎ নবাব, ছুরিকাঘাতের বিনিময়ে গোলাপ দেবার মতো তাঁর অপরূপ স্নেহ দ্বারা, কল্যাণ কামনার দ্বারা, সিরাজের যুদ্ধ-অভীপ্সার জবাব দিলেন একটি ফারসি কবিতা লিখে—
গাজি কে পায়ে সাহাদাৎ আন্দার্ তাসো পোস্ত
গাফেল কে শাহিদে এক্ ফাজেল্ তার্ আজ দোস্ত্।
—যাঁরা ধর্মের জন্য সম্মুখ সমরে জীবন বিসর্জন দিতে প্রস্তুত থাকেন, তাঁরা প্রায়ই ভুলে যান, সংসার-সংগ্রামে স্নেহের অত্যাচার যাঁরা নিয়ত সহ্য করেন, তাঁরাই প্রকৃত বীর।
ফার্দায় কেয়ামৎ ইঁ বা আঁ কায়মানাদ।
ই কোস্তা দুমানা ওঁয়া কোস্তায়ে দোস্ত।
—পরকালেও তাঁদের মধ্যে তুলনা হয় না। ধর্মবীর শত্রুর হাতে নিহত হন, কিন্তু সংসারি বীর কেবল স্নেহভাজন আত্মীয়দের নির্যাতনেই জীবন বিসর্জন দিয়ে থাকেন।
আলিবর্দির হৃদয়ের কত গভীর স্নেহ এই কবিতার মধ্যে ব্যক্ত হয়েছিল, অপার স্নেহের কী অসহ্য অসহায়তা ফুটে উঠেছিল ছত্রে ছত্রে তা উপলব্ধি করেননি তখন সিরাজ। আলিবর্দি যেন নিরুচ্চারে বুঝিয়েছিলেন—তোমাকে ভালবাসি, তাই তোমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরব না আমি, সে তুমি আমাকে যতই হানো। আমি সইব। কত অত্যাচার করবে তুমি আমার ওপর! সইব আমি।
পাটনা দুর্গ আক্রমণ করেও জানকীরামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেননি সিরাজ। বরং তাঁর পরাজয়ের পরেও আলিবর্দির নির্দেশে জানকীরাম সিরাজের জন্য সসম্মান বসবাসের আয়োজন করেছিলেন। সিরাজ সতেজ জবাব দিলেন— চাই না এসব। আমি পরাস্ত। আমাকে যোগ্য শাস্তি দেওয়া হোক।
সিরাজ দর্শী, সিরাজ লুণ্ঠক, নারীলোলুপ কিন্তু যোদ্ধা! বীর, কৌশলী যোদ্ধা! তাঁর জিদ এবং অপরিণতমনস্ক হঠকারী সিদ্ধান্তে আলিবর্দি ব্যাকুল। আহা! কোনও ক্ষতি না হয় ছেলেটার! নাদান বাচ্চা। না বুঝে একটা কাজ করে ফেলেছে। আল্লা, পরম শক্তিমান খোদা তুমি ওকে রক্ষা করো।
বাংলার বর্গিদমন ফেলে নবাব আলিবর্দি যখন পাটনায় ছুটে এলেন তখন তাঁর শিবিরে সিরাজদ্দৌলাকে নিয়ে আসা হল। নবাব দেখলেন, পঞ্চদশ বর্ষীয় সিরাজ রণক্লান্ত, একাকী, নিরস্ত্র। আলিবর্দির নিকটে এসে সিরাজ কদমবুসি করলেন। আলিবর্দির স্নেহ অশ্রু হয়ে গলে পড়ল। সিরাজ যে অক্ষত আছেন, এই আনন্দে তিনি আপ্লুত হলেন। সিরাজকে কোলের কাছে টেনে নিলেন তিনি। এবং পাটনার দরবারে উপবেশন করে সিরাজদ্দৌলাকে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার যুবরাজ হিসেবে অভিষিক্ত করলেন।
সিরাজের চেতনা ফিরল যখন বৃদ্ধ আলিবর্দি মৃত্যুশয্যায় শায়িত হলেন। চারপাশে শত্রুর পদধ্বনি, সর্বত্র চক্রান্তের ছায়া। সিরাজ উপলব্ধি করলেন, কী বিশাল স্নেহছত্রতলে সুরক্ষিত ছিলেন তিনি। কালের কীট সে-ছত্রের বস্ত্র দংশন করেছে। স্নেহশীল মানুষটি তাঁকে ছেড়ে এবার মহাকালের নির্দেশে গমন করছেন কোন অজানায়।
ধর্মপ্রাণ ন্যায়পরায়ণ আলিবর্দি খাঁ—বেহেস্তেই তাঁর স্থান নির্দিষ্ট হয়ে ছিল। কিন্তু সিরাজদ্দৌলা এ ভুবনে হয়ে গেলেন একাকী। মাতামহের অন্তিম শয্যায় তাঁর কণ্ঠলগ্ন হয়ে রইলেন সিরাজ। সুরা ত্যাগ করার প্রতিজ্ঞা করলেন। জিদ্দি, অমার্জিত, সম্ভোগী বালক সিরাজ হয়ে উঠলেন মনোযোগী, দায়িত্বশীল, বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ। আলিবর্দি খাঁ, অন্তিমকালের আহ্বান উপলব্ধি করে সিরাজের জন্য শেষ বাক্যগুলি বলতে শুরু করলেন।—
“আমি কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে অসিহস্তে জীবনযাপন করিয়াই সংসার হইতে অবসর গ্রহণ করিলাম। কিন্তু কাহার জন্য এত যুদ্ধ যুঝিলাম, কাহার জন্যই বা কৌশল-নীতিতে রাজ্যরক্ষা করিবার জন্য প্রাণপণ করিয়া মরিলাম? তোমার জন্যই তো এত করিয়াছি।
“আমার অভাবে তোমার কীরূপ দুর্গতি হইবে, তাহা ভাবিয়া কত রজনী জাগরণে অতিবাহিত করিয়াছি; তুমি তাহার কিছুই জান না। আমার অভাবে, কে কীভাবে তোমার সর্বনাশ করিতে পারে, তাহা আমার কিছুই অপরিজ্ঞাত নাই।
“হোসেন কুলি খাঁর বিদ্যাবুদ্ধি এবং খ্যাতি-প্রতিপত্তি ছিল। শওকতজঙ্গের প্রতি তাঁহার ঐকান্তিক অনুরাগ জন্মিয়াছিল। আজ হোসেন কুলি জীবিত থাকিলে তোমার পথ কণ্টকশূন্য হইত না। সে হোসেন কুলি আর নাই।
“দেওয়ান মানিকচাঁদ তোমার প্রবল শত্রু হইয়া উঠিত। সেইজন্য আমি তাঁহাকে রাজপ্রাসাদ-দানে পরিতুষ্ট করিয়া রাখিয়াছি।
“এখন আর কী বলিব? আমার শেষ উপদেশ শ্রবণ কর। ইউরোপীয় বণিকদিগের কীরূপ শক্তিবৃদ্ধি হইতেছে, তাহার প্রতি সর্বদাই তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখিও। তাহারাই তোমার একমাত্র আশঙ্কার স্থল।
“পরমেশ্বর আমার এই দীর্ঘজীবনকে আরও কিছুদিন পৃথিবীতে জীবিত রাখিলে, আমিই তোমার এ আশঙ্কা নির্মূল করিয়া দিতাম। কিন্তু তাহা হইল না। এ কার্য এখন তোমাকেই একাকী সাধন করিতে হইবে।
“ইহারা তেলেঙ্গা প্রদেশের যুদ্ধ ব্যাপারে লিপ্ত হইয়া যেরূপ কুটিলনীতির পরিচয় দিয়াছে, তাহা দেখিয়া তোমাকে সর্বদা সতর্ক থাকিতে হইবে। ইহারা দেশের লোকের গৃহবিবাদের উপলক্ষ করিয়া সে দেশ আপনাদের মধ্যে বাঁটিয়া লইয়া, প্রজাদিগের যথাসর্বস্ব লুটিয়া লইয়াছে।
“কিন্তু সমুদায় ইউরোপীয় বণিকদিগকেই একসঙ্গে পদানত করিবার চেষ্টা করিও না। ইংরাজদিগেরই সমধিক ক্ষমতাবৃদ্ধি হইয়াছে। সেদিন তাহারা অস্ট্রিয়া দেশ জয় করিয়া আসিয়াছে। তাহাদিগকেই সর্বাগ্রে দমন করিও।
“ইংরাজদিগকে দমন করিতে পারিলে, অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকেরা আর মাথা তুলিয়া উৎপাত করিতে সাহস পাইবে না। ইংরাজদিগকে কিছুতেই দুর্গনির্মাণ বা সৈন্যসংগ্রহ করিবার প্রশ্রয় দিও না। যদি দাও, এ দেশ আর তোমার থাকিবে না।’
.
আলিবর্দি খাঁ কতখানি দূরদর্শী ছিলেন তা প্রমাণিত হয়েছিল। হতভাগ্য সিরাজ আলিবর্দির অন্তিম উপদেশ মান্য করেও নিকটজনের বিশ্বাসঘাতকতায় শেষরক্ষা করতে পারলেন না। পলাশির যুদ্ধে তাঁর শোচনীয় পরাজয় ঘটল। শুরু হল সেই অন্ধকার। কেবলই অন্ধকার। এক হিন্দু সন্ন্যাসী, আলিবর্দি খাঁর ভবিষ্যৎ গণনা করে সে অন্ধকারের কথা বহুকাল আগে বলে গিয়েছিলেন।