2 of 3

রাজপাট – ৫৬

৫৬ 

আইল আষাঢ় মাস 
বরষা সময়। 
পক্ষী আদি দেখে সব 
বাসার সঞ্চয়॥ 
আষাঢ়ে নবীন মেঘ 
গগন ছাইয়ে 
শ্যামবরণ মেঘ 
রইল দাঁড়ায়ে ॥ 

বিকেল নাগাদ যে-গ্রামে পৌঁছল তারা, তার নাম সরাল। এ গ্রামেরই দুয়ার থেকে সেদিন সে এবং তৌফিক প্রত্যাবর্তন করেছিল। 

যতদূর চোখ যায় আবাদহীন ধু ধু মাঠ। মাঠের প্রান্তে জমে উঠেছে কালো মেঘ। দীর্ঘদিন পর মেঘ ফুটল আকাশে। আষাঢ়ের প্রথম মেঘ। দেখে মনে হয়, কালো শুকনো মাটি যেন হঠাৎ চাপ চাপ হয়ে উঠে পড়েছে শূন্যে। যেন বৃষ্টির বারতা আনার জন্য এই তার অভিযান। 

বৃষ্টি না হলে চলছেও না আর। মাটি ফেটে যাচ্ছে। ফসল ঝলসে গেল। নদী-খাল-বিলের জলস্তর নেমে গিয়েছে নীচে। টুলু পাম্প আছে যাদের, তেল খরচ করে পাম্প চালাতে চালাতে তাদের বহু ব্যয় হয়ে গেল। পাম্পেও উঠে আসছে ঘন কাদাজল। এমন চললে পাম্প অকেজো হয়ে যাবে যে-কোনও দিন। 

ছোট চাষিরা মাথায় হাত দিয়েছে। এখুনি বর্ষা না এলেই নয়। এমন চলতে থাকলে আর ক’দিনের মধ্যেই গাঁয়ে ঘরে পানীয় জলের আকাল দেখা দেবে। বর্ষা এখন বড়ই আকাঙ্ক্ষিত। 

খোলা শুকনো জমির আলের ওপর দিয়ে তারা চলেছিল। মেঘ ঘিরে আসাতে দ্রুত নেমে আসছে অন্ধকার। আলের ওপর দিয়ে চলা ছাড়া উপায় নেই। এ পথেই তারা সরাল গ্রামের জনবসতিতে পৌঁছবে দ্রুত। বসির খান উতলা হয়ে উঠেছে। তাদের দু’জনের কাঁধে দুটি ঝোলা। দু’-এক রাত্রি কাটাবার মতো পোশাকের সামান্য আয়োজন। বসির খান বলছে—বৃষ্টি আসার আগে গ্রামে পৌঁছতে হবে যে করে হোক। 

সিদ্ধার্থ বলছে—আসুক না বৃষ্টি। ক্ষতি কী। যা গরম, একটু ভিজলে ভালই লাগবে।

—আপনার জ্বর হয়েছিল। তাই ভাবছি। 

—ভেবো না বসিরভাই। ও এমন কিছু নয়। 

তারা এগিয়ে চলল। দূরে একটি বৃক্ষতলে দু’জন লোক। তারা পাশাপাশি বসে কথা বলছিল। আকাশে মেঘের ঘনঘটা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে কোনও ব্যস্ততার ভাব নেই। সিদ্ধার্থ, বসির খানের সঙ্গে লোক দুটির নিকটবর্তী হলে একজনকে চেনা লাগল তার। বাউলের বিচিত্র পোশাকে এক সৌম্য পুরুষ। কোথায় দেখেছে এই বাউলকে ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়ল তেকোনা গ্রামের কথা। মোহনলালের সঙ্গে সে গান শুনতে গিয়েছিল একদিন আখড়ায়। মধুকণ্ঠে গান গেয়েছিলেন এই বাউল। নাম মনে নেই তার। সে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বাউল বলল—প্রণাম। আমাকে চিনতে পারছেন কি? লীলা দেখুন! কার সঙ্গে যে কার কোথায় দেখা হয়ে যায়! 

সিদ্ধার্থ বলল—প্রণাম। তেকোনা গ্রামের আখড়ায় আপনিই তো গান শুনিয়েছিলেন বৈরাগী ঠাকুর। 

দুলু বাউল হাসল। মাথা নাড়ল দু’বার। বলল—বাঃ বাঃ! খুব ভাল বলেছেন। বৈরাগী ঠাকুর! ওই হল এখন আমার আসল পরিচয়। তবে কিনা পূর্ণ বৈরাগী আর হতে পারলাম কই! পূৰ্ণ বৈরাগ্য আছে যার, সেই বৈরাগী। তা বাবা, আপনি এখানে! 

—আমিও তো একই প্রশ্ন করছিলাম। 

—বাবা, বাউল মানুষ আমি। ঘুরে বেড়ানোই আমার ধর্ম। মাঝখানে সে ধর্ম ভুলেছিলাম। তা পথ আমাকে পথে টেনে এনে তবে ছাড়লে। এখন শান্তিতে আছি। 

–আমি সরাল যাব বলে বেরিয়েছি। 

দুলু বাউলের সঙ্গের লোকটি এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। টাকমাথা। মধ্যবয়সি। কালো এক মানুষ। চওড়া কাঠামো। একটি বিড়ি তিনি এতক্ষণ নীরবে পান করছিলেন। তাঁর সারা মুখ জুড়ে চিন্তার সরু-সরু রেখা। তিনি বললেন—সরালে কার বাড়ি যাবেন? 

সিদ্ধার্থ বলল—নির্দিষ্ট কারও বাড়ি নয়। আমি এসেছি কাজে। রাত্রে কারও বাড়িতে আতিথ্য নেব। 

—কোথা হতে আসছেন আপনি? কী কাজ? 

দুলু বাউল কথা বলে এবার অশ্বিনী, ওঁকে সমাদর করো। গৃহে আতিথ্য দাও। কত বড় মানুষ উনি, তা জানো? উনি হলেন নেতা। জননেতা। সিদ্ধার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়। নাম শোনো নাই?

অশ্বিনী নামে মানুষটির মুখে-চোখে কোনও পরিবর্তন ঘটে না। তবে হাত জোড় করে ছোট নমস্কার তিনি করেন। বলেন—আমি অশ্বিনী হালদার। সরালে থাকি। বাবুরা আমার বাড়িতেই থাকবেন। আজ বাউল, তুমিও চলো। গরিব মানুষ আমি, দুটি জলভাতের বেশি দিতে পারব না। 

দুলু বাউল বিড়বিড় করে—তাই দিয়ো, তাই দিয়ো। জননেতার কাছে লজ্জা কী? 

আল বরাবর হাঁটতে থাকে তারা। সবার আগে আগে অশ্বিনী হালদার। তারপর সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থর পিছনে দুলু বাউল। বসির খান সবার শেষে। অশ্বিনী হালদার বলেন—সরালে কী কাজে বাবু? পার্টির কাজে? 

সিদ্ধার্থ বলে—হ্যাঁ। পার্টির কাজেই। নদীর ভাঙন প্রতিরোধ করার জন্য একটা বড় আন্দোলন করতে চাইছি আমরা। তার জন্য সারা মুর্শিদাবাদের ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষকে নিয়ে কমিটি তৈরি হবে। 

—কত বিষয়ের কত কমিটি, সে ওই নামে মাত্র। আরও কমিটি বাড়িয়ে কী লাভ বাবু? কাজের কাজ তো আর কিছুই হবে না। 

দুলু বাউল মৃদু ধমক দেয় তাঁকে—অশ্বিনী, এই লোকের ক্ষমতা জানো তুমি? 

সিদ্ধার্থ বাধা দেয়—না, না। আমার আবার কী ক্ষমতা? সব মানুষ একত্রিত হলে তবেই ক্ষমতা জন্মায়। একা মানুষের কোনও ক্ষমতা থাকে না কি? ওঁকে বলতে দিন। 

—হ্যাঁ। বলব। বলব। গঙ্গা রাক্ষুসি হয়ে অর্ধেক গ্রাম গ্রাস করে নিল বাবু। কে ঠেকাতে পারল! উল্টে নদীর পাড় হতে মাটি কেটে কেটে নিয়ে যাচ্ছে। ইটভাটা করে লক্ষ টাকা কামায়। এদিকে আমাদের জমি বন্ধ্যা হয়ে গেল। 

কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছে। গ্রামের ঘনবসতি দৃষ্টিগোচর হয়। হাওয়া উঠছে দমকা। শুকনো মাঠের ধুলো ঢুকে যাচ্ছে চোখে-মুখে। খোলা মাঠের ক্ষমতাশালী হাওয়া তাদের ঠেলে দিতে চায়। পূর্বপ্রান্তে শ্রীকৃষ্ণের বুকের মতো জমাট মেঘরাশি। দ্রুত পা চালিয়ে তারা গ্রামের পথে ঢোকে। বড় বড় ফোঁটা পড়ছে এবার। একটি দুটি তিনটি। শুকনো ধুলোর ওপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে শব্দ উঠছে ঠাপ-ঠুপ-ঠাপ। ধুলোভেজা গন্ধ উঠে বুক ভরিয়ে দিচ্ছে। এই গন্ধের মধ্যে কোনও রাজনীতি নেই, প্রতারণা নেই, কমিটি নেই। সিদ্ধার্থ বুক ভরে এই গন্ধ নিচ্ছে। দুলু বাউল নিচ্ছে। বসির খান নিচ্ছে। মেয়ে-বউরা নিচ্ছে। দ্রুত পা ফেলে ঘরে ফিরছে গাভীগুলি। শিশুরা লাফাচ্ছে খুশিতে, বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি। 

আর তখন বৃষ্টি নেমে আসছে দ্রুত বেগে। ঝর-ঝর, বর-বর শব্দে নেমে পড়ছে আকাশ ভেঙে। অশ্বিনী বলছেন—–ঢুকে পড়ুন, ঢুকে পড়ুন। এই বাড়ি। 

তারা সকলেই দৌড়ে এসে উঠছে ইটের দেওয়ালের ওপর খড়ের ছাউনি দেওয়া, কাঁচা মেঝের বাড়ির দাওয়ায়। দেখছে বৃষ্টি। ঘন হয়ে আসা সন্ধ্যার মধ্যেও তাদের পতন দৃশ্যমান। সিদ্ধার্থ বলল—যাক! বর্ষা এল তা হলে। 

শিশুরা ছুটোছুটি করছে পথে। ভিজছে। সিদ্ধার্থ হাত বাড়িয়ে দিল বৃষ্টিতে। বড় বড় ফোঁটা, অবিশ্রান্ত, হাতে চাপড় মারল যেন। যেন খুশিতে বলে উঠল—বন্ধু, ভাল আছ তো? 

গুম-গুম শব্দ উঠল আকাশে। আকাশের এ প্রান্ত হতে ও প্রান্ত পর্যন্ত ফালা ফালা হয়ে বেরিয়ে গেল বিদ্যুৎরেখা। অশ্বিনী বললেন—ভিতরে আসেন আপনারা। গ্রামে বিদ্যুৎ নাই। লণ্ঠন জ্বালাব বাবু, তার তেলও নাই। একটা কুপি জ্বেলে রান্না-খাওয়া সারি। বৃষ্টি কমলে আমি না হয় একটু তেল আনব। কষ্ট হবে আপনাদের। খুব কষ্ট হবে। 

সিদ্ধার্থ বলল—কোনও কষ্টই কষ্ট নয়। আপনারা যেভাবে থাকবেন কাকা, আমরাও সেভাবেই থাকব। তা ছাড়া আজ তো আনন্দের দিন। আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি এল। ফসলগুলো যেন ঝলসে যাচ্ছিল বৃষ্টির অভাবে। 

একটি ঘরে একটু উঁচু চৌকি। আর একখানা কাঠের চেয়ার। তারা তিনজন চৌকিতেই বসেছে পা ঝুলিয়ে। অশ্বিনী বসেছেন চেয়ারে। দুটি কিশোরী উঁকি মেরে দেখে গেছে একবার। অশ্বিনী তাদের উদ্দেশে বলছেন—বৃষ্টি থামলে চা কর শঙ্করী। চা আছে? গোরু দোয়া। দুধ দিয়ে চা কর। 

এবার সিদ্ধার্থর দিকে ফিরলেন তিনি। বললেন—আজ বর্ষা হওয়া খারাপ হল বাবু। 

বর্ষণের শব্দে কথা বলতে হচ্ছে জোরে। সিদ্ধার্থ বলছে—খারাপ? কেন খারাপ? 

অশ্বিনী উত্তর দেন—প্রবচনে বলে সেই কথা। আমরা চাষাভুসো মানুষ, প্রবাদ-প্রবচন মেনে চলি বাবু! কথায় বলে, 

কী কর শ্বশুর লেখাজোকা।
আষাঢ়ে নবমী শুকল পাখা॥
যদি বর্ষে মুষলধারে।
মাঝ-সমুদ্রে বগা চরে॥
যদি বর্ষে ছিটে-ফোঁটা 
পর্বতে হয় মীনের ঘটা॥
যদি বর্ষে ঝিমি-ঝিমি
শস্যের ভার না সহে মেদিনী॥
হেলে চাকি বসেন পাটে।
চাষার গোরু বিকায় ঘাটে॥ 

মানে বুঝলেন না বাবু? আষাঢ়ের শুক্লপক্ষে নবমীর দিন যদি মুষলধারে বৃষ্টি হয়, তা হলে সে-বৎসর অনাবৃষ্টি হবে। ছিটে-ফোঁটা বৃষ্টি হলে, সে-বৎসর এত বর্ষণ হবে যে পর্বতে মাছের ঘটা দেখা দেবে। আর এ তিথিতে ঝিমি-ঝিমি বর্ষণ হলে ফলন হবে প্রচুর। আর বৃষ্টি যদি না হয় তা হলে সারা বৎসর আর ফসল ফলবে না। আজ তিথি দেখুন বাবু। শুক্লপক্ষের নবমী। 

সিদ্ধার্থ বলে—এগুলো কি ফলে কাকা? 

—ফলে। ফলবে না কেন? খনার জিহ্বা মিথ্যে হয় না। 

কেউ কোনও কথা বলে না। অশ্বিনী উঠে যান। সম্ভবত গোরু দোহন ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে। সিদ্ধার্থ ভাবে, এই বর্ষণমুখর রাত্রে তারা তিনজন এই গৃহে অতিথি হওয়ায় অশ্বিনী হালদারের অসুবিধা হল নিশ্চয়ই। ভাগাভাগি করে এ বাড়ি ও বাড়ি থাকলে হয়তো চাপ কিছু কম হতে পারে। অশ্বিনী হালদারের কাছে এই প্রস্তাব করবে বলে ভাবল সে। তার মন পড়ে আছে ওই প্রবচনে। সত্যি কি অনাবৃষ্টি হবে এবার? দুলু বাউল কথা বলে তখন—বাবা, আপনি কত কত গ্রামে ঘুরবেন? 

সিদ্ধার্থ বলে—গঙ্গা ও ভাগীরথীর পাড়ের গ্রামগুলো প্রধানত। এবার মধ্যে মধ্যে যত গ্রাম পড়ে। 

—তার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আমার গো। 

–কার কথা? 

—যার জন্য প্রাণ দিতে বসেছিলেন আপনি। ময়না বৈষ্ণবীর কথা। সে-ও এমনি ঘুরে বেড়াত গাঁয়ে। তার মতো করে মুর্শিদাবাদের গ্রাম বুঝি আর কেউ চিনত না। 

—আপনি তাঁকে চিনতেন? 

—হ্যাঁ বাবা! বড় ভাল করে চিনতাম। ফরাক্কার প্রান্ত হতে, ভূতনির চর হতে, কালান্তর পর্যন্ত সকল গাঁয়ে সে ঘুরে বেড়াত। আমি রহস্য করে বলতাম, তা একটা গাড়ি কিনে নাও বোষ্টুমি। সে বলত, মন-গাড়ি আছে আমার। হাওয়াগাড়ির দরকার কী! অনেক বড় হৃদয় ছিল তার। মানুষের ব্যথায় ব্যথিত হত সে। পোড়া কপাল আমাদের, তাকে রাখতে পারলাম না গো। 

দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুলু বাউল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিদ্ধার্থ। তার শ্বাসের সঙ্গে মিশে থাকে যন্ত্রণা, অপমান, কষ্ট। আর দুটি দীর্ঘশ্বাস মিশে, কষ্টে কেঁপে, বাহিরের বারিপাতে গিয়ে মেশে। এবং ওই মুহূর্তে, আষাঢ়ের শুক্লানবমীর বারিধারা, ময়না বৈষ্ণবীর জন্য দুটি মানুষের বেদনার অশ্রুপাত হয়ে যায়। 

বিদ্যুৎ চমকের মতো সিদ্ধার্থর মধ্যে উন্মত্ত হিংস্রতা মাথা তোলে। প্রতিশোধস্পৃহা গর-গর করে অন্তরে। কাঁধের ক্ষত স্পর্শ করে সে। যতদিন যাচ্ছে, এই ক্ষত তার হৃদয়ক্ষত হয়ে উঠছে। কিছুই করতে পারল না সে। মানুষটার জন্য কিছুই করতে পারল না। তার ময়না বৈষ্ণবীকে মনে পড়ে। ময়না বৈষ্ণবীর দুটি চোখ মনে পড়ে। কী প্রেমময়, কী মধুর স্নেহপ্রবণ ছিল সেই চোখজোড়া। তার নিজস্ব নয়ন সজল হয়ে যায়। কষ্টে সে হিংস্র হয়ে যায়। এবং সকল হিংস্রতার প্রতিজ্ঞা করে—যদি পাই ওদের, যদি পাই, টুকরো টুকরো করব। টুকরো টুকরো করে মাছের খাবার করে দেব। 

সে নিরুচ্চারে রাখে এই প্রতিজ্ঞা। এই জেলা মুর্শিদাবাদে খাল-বিল নদ-নদীর অভাব কী! মাছেরও সীমা-সংখ্যা নেই। সকল দুরাচারীর কাটা মাংস খাবে মাছ। বেশ খাবে। 

.

দুলু বাউল কথা বলে তখন সে পথে পথে ঘুরত ভ্রমণের নেশায় আর মানুষের ভালবাসার টানে। আপন ঘর ছিল না তার। তবু গাঁয়ে গাঁয়েই ছিল তার একটি দুটি আপন ঘর। আপনিও তো ভালবাসেন মানুষকে। 

—কী জানি! মানুষকে ভালবাসা বড় কঠিন। 

—বাসেন, ভালবাসেন। না হলে অমন করে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেউ! এমন করে কেউ পথে নামে। সে-ও ভালবেসে পথে এসেছিল, আপনিও ভালবেসে পথে এসেছেন। আর আমি কী করছি জানেন? 

–কী? 

—তার ভালবাসাটি খুঁজে পাবার চেষ্টা করছি। এই দু’দিন আগে পর্যন্ত আমি ছিলাম আপনাতে আপনি আচ্ছন্ন। বাহিরকে দেখিনি। তাই চোখও ছিল অন্ধ। আপন খেলায় বেলা গিয়েছে, তাকেই ভেবেছি আনন্দ। হঠাৎ দেখলাম, আনন্দ কই! এ যে আমি আনন্দের ঝঙ্কারের কণ্ঠলগ্ন হয়ে তার শূন্যগর্ভ গালে চুমু খেয়েছি! শবসাধনা করতে করতে ভেবেছি, এই হল জীবনসাধনা। হায় হায়! ঘোর যখন ভাঙল, চোখের আঁধার যখন ঘুচল, দেখলাম পাঁকে মাখামাখি হয়ে আছি। মানুষ হয়ে মানুষকে ভালবাসলাম কই! এমন মানুষ যার সঙ্গে প্রেম নেই, দেহবন্ধ নেই, স্নেহ নেই, জন্মবন্ধ নেই, তাকে ভালবাসলাম কই! এইবার বাবা, পাঁক ধুতে ধুতে যাব। সে যেমন করে ভালবাসত, তেমন ভালবাসা খুঁজতে খুঁজতে যাব। তা দেখুন বাবা, আপনিও পথে নামলেন, সে-ও নেমেছিল, আমিও নেমেছি। তবু আমাদের পথগুলি মিলছে না যেন। 

সিদ্ধার্থ বলল—মিলছে না কে বলল বৈরাগীঠাকুর? মেলালেই মেলে। আপনার বলা ভালবাসাই তা মেলায়। 

—আপনার মন বড় শমে আছে বাবা। পবিত্রে আছে। 

—তাই যদি হয়, তবে আমাকে তুমি সম্বোধন করুন। 

—বাঁচলাম বাবা। তোমার মুখটি এমন, দেখলে আপন ভাবতে মন চায়। 

—তিনিও আমাকে আপন করে নিয়েছিলেন। 

—কে? বোষ্টুমি? 

—হ্যাঁ। 

—জানি। তা জানি। নইলে তোমাকে বলবে কেন সব প্রাণ খুলে? তুমিই বা তার জন্য ঝাঁপ দেবে কেন? তা ছাড়া, তার দৃষ্টি আর আমার দৃষ্টি মিলেছিল কোথাও। তাই তো তার পথেই আমি পথের সন্ধান নিলাম। এখন তোমাকে দেখে একটি নিবেদন করতে বড় ইচ্ছে করছে। 

—কী? বলুন না। 

—তোমার যজ্ঞে আমাকেও নাও বাবা। 

—আমার যে সামান্য কাজ। কোথায় শেষ করব, কীভাবে শেষ করব, কিছুই জানি না। আমার কোনও সম্বল নেই। আমি জানি না যে-কাজ শুরু করেছি, শেষ করতে পারব কি না। 

—অনেক বড় কাজ করবে তুমি। তুমি মানুষের কল্যাণ করবে। আমাকে নিও তোমার কাজে। হ্যাঁ বাবা। 

—বেশ তো। যখন আপনার খেয়াল হবে, আসবেন আপনি। গ্রামে ঘুরব আপনার সঙ্গে।

—কথা দিলে তো বাবা? 

—লোকই আমার ভরসা ঠাকুর। লোক পেলে আমি না বলব? 

.

মেঘের গর্জন কমে এসেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বেশ। বৃষ্টিধারা কিছু স্তিমিত। কাচের গ্লাসে করে চা এল তাদের জন্য। স্টিলের বাটিতে এল মুড়ি। ছেলে নেই অশ্বিনী হালদারের। ছিল একটি। বারো বছর বয়সে সর্পাঘাতে মারা গেছে। এখন তাঁর সম্বল দুটি মেয়ে। শঙ্করী আর পার্বতী। তাদেরই একজনের এক হাতে চা, এক হাতে মুড়ির বাটি। অন্যজনের হাতে লণ্ঠন। ইতিমধ্যেই কেরোসিনের ব্যবস্থা করেছেন অশ্বিনী হালদার। 

সিদ্ধার্থ বলল—কাকা, আমরা তিনজন এক জায়গায় থাকলে আপনার অসুবিধে হবে। আমাদের আলাদা বাসায় দিয়ে দিন। 

—অসুবিধা আপনাদের হলে তাই করে দিই। 

—না, না। আমাদের কোনও অসুবিধা হবে না। 

—তবে থাকেন। কাল আপনে কার সঙ্গে কথা বলতে চান তার ব্যবস্থা হবে। 

এতক্ষণে কথা বলল বসির খান—আমি কিন্তু মুসলমান। তাতে কোনও … 

তার কথা শেষ হল না। ছি-ছি করে উঠলেন অশ্বিনী। বললেন— এ আপনি কী কথাটা বললেন? সারা মুর্শিদাবাদ জুড়ে হিন্দু-মুসলমান গায়ে গা লাগিয়ে বাঁচে। আমি আপনার ঘরে অতিথি হলে কি আপনি হিন্দুবাড়ি খুঁজবেন আমার জন্য? 

বসির খান অপ্রতিভ হয়। বলে-না। না। আমি ক্ষমা চাইছি। 

অশ্বিনী বলেন—সারা পৃথিবীতে এই মুর্শিদাবাদ একমাত্র জায়গা যেখানে হিন্দু-মুসলমানের কোনও লাঠালাঠি নেই। কোনও অপরিচয় নেই। 

বসির খান আবার বলে—অন্যায় হয়ে গেছে কাকা। 

অশ্বিনী তখন বলেন—তা আমার পরিচয়টাও দিই। এখন গ্রামে ভাগাভাগি ধর্মে হয় না। পার্টিতে হয়। আমি এই পঞ্চায়েতের একজন প্রতিনিধি। হেরে গিয়েছিলাম। আর আমি কিন্তু কংগ্রেস করি। এখন আপনারা ভেবে দেখেন আমার বাড়িতে রাত্রিবাস করবেন কি না। 

সিদ্ধার্থ চৌকি থেকে নেমে আসে। অশ্বিনীর হাত ধরে ক্ষমা চায়। বলে, তার কাজের জন্য পার্টির পরিচয় বড় নয়। যে-আন্দোলন সে গড়ে তুলতে চলেছে তাতে সকল দলের লোককেই তার প্রয়োজন। অশ্বিনী শান্ত হয়ে আসেন। আবার বৃষ্টি নামে বড়-বড় ফোঁটায়। শঙ্করী আর পার্বতী নামের মেয়ে দুটি বারান্দায় জল রেখে গেছে। তারা একে একে হাত-মুখ প্রক্ষালন করে নেয়। সকলে মিলে গুছিয়ে চৌকিতে বসে। সিদ্ধার্থ একটি গানের অনুরোধ জানায় দুলুক্ষ্যাপার কাছে। দুলু বাউল বলে—তা একটা কথা শুধু আছে। একটা অনুমতি দিতে হবে। 

–কী? 

—একটু সেবন করে নিই বাবা। 

দুলুক্ষ্যাপা তার ঝুলি হতে গাঁজার সরঞ্জাম বার করে। সিদ্ধার্থ দেখে, লণ্ঠনের আলোয় আগ্রহী মুখগুলি। অশ্বিনী হালদার, বসির খান— দু’জনেই সাগ্রহে তাকিয়ে আছে দুলুক্ষ্যাপার হাতের দিকে। কলকে প্রস্তুত হয়ে হাতে হাতে ফিরল। সিদ্ধার্থর কাছে এল যখন সিদ্ধার্থ প্রত্যাখ্যান করল এই নেশাবস্তু। বরং সে সিগারেট ধরাল অশ্বিনী এবং দুলুক্ষ্যাপার অনুমতি নিয়ে। গাঁজার গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছে ঘর। ঘন বর্ষণের জোলো বাতাস গাঁজার গন্ধে মিশিয়ে দিচ্ছে সোঁদা গন্ধ। খোড়োচালেও জল পড়ে গন্ধ উঠছে কেমন। সে-গন্ধ বড় আপন মনে হয়। বাজ পড়ল একবার। আর সেই শব্দে ভয় পেয়ে অশ্বিনী হালদারের গোহালের গাভী ডেকে উঠল। দোতারায় শব্দ তুলল দুলুক্ষ্যাপা। সঙ্গে সঙ্গে কিশোরী মুখগুলি এসে জমল দরজায়। শঙ্করী আর পার্বতী। উৎসুক চোখে তাঁরা বলল—গান হবে বাবা? 

— হবে। 

–আমাদের শুনতে ইচ্ছে করে বাবা। 

দুলু বাউল বলে—শোনো মা, শোনো। আসো! বসো। 

খালি চেয়ারটিতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে দু’বোন। আঁধারে তাদের হাতের বিড়িবাঁধার দাগগুলি ঢাকা পড়ে যায়। কিশোরী মেয়ে তারা, ইস্কুলে যায় না, কেবল গৃহস্থালী করে, বিড়ি বাঁধে। আকাশে বিদ্যুৎ-বিজলি উৎসারিত হয়। মেঘ গম-গম করে। পাকঘরের উনুনে ঠিলা ঢুকিয়ে ফুঁ দেয় অশ্বিনী হালদারের বউ। অশ্বিনীর বিধবা মা, রাত্রে চোখে ভাল দেখেন না। তবু কুপির আলোয় টিপে টিপে চালের কাঁকর বাছেন। বজ্রবিদ্যুতের শব্দ পার করেও দোতারার সুর তাঁদের কানে পৌঁছয়। দুলুক্ষ্যাপা এ গৃহের চেনা মানুষ। সে ধরে এক গান। বজ্র সাক্ষী রেখে মিঠে স্বর বেরোয় তার— 

বল মন রাম কি রহিম করিম কালুল্লা কালা
তার কোনো ভিন্ন ভেদ নাই ॥ 
এক নিরঞ্জন জগৎ আলা মক্কা কাশী
বৃন্দাবনে তিন জনে একুই ধামে 
হিন্দু মুসলমান মনে মানে 
সাক্ষী নিতাই নবীর চেলা ॥ 
শিব আর দুর্গা কালী 
তারে আলি ফতিমা বলি 
তার বেটা হোসেন আলি মদিনা করল আলা, 
বিশু বলে মন রসনা 
মনের গোল থাকতে কিছুই হবে না 
খুঁজে লেও দেল পুরাণে 
খুঁজলে পাবে তাঁহার লীলা ॥

পরপর চারখানা গান গেয়ে থামল সে। পাকঘরে আওয়াজ উঠল—ও শঙ্করী, ও পার্বতী, একবার এদিকে আয় মা। 

ছুটল কিশোরী দুটি। দুলুক্ষ্যাপা বলল—দেখো দেখি। মাইয়ার মন রয় গানে, তারে সংসারে টানে। মায়েরা না থাকলে কি আর গান জমে! 

সে গাঁজার কলকে জমাল আবার। সিদ্ধার্থ সিগারেট ধরাল। চুপচাপ বসে থেকে শঙ্করী ও পার্বতীকে দেখতে দেখতে বিষণ্ণ হয়ে উঠছিল বসির খান। তাদের আফরোজার মতোই তো মেয়ে দুটি। হায়, জীবনের তিক্ততা তাকে যেন কাঁটামারা জুতোয় মাড়িয়ে দিয়ে গেল। এই ধাক্কা সামলে কি আফরোজা কখনও সুস্থ চোখে দেখতে পাবে জীবনকে? 

সিদ্ধার্থ প্রসঙ্গ তুলল তখন। অশ্বিনীর দিকে তাকিয়ে বলল-মাটি বন্ধ্যা হয়ে যাবার কথা কী বলছিলেন আপনি? 

অশ্বিনী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। দু’চোখে গাঢ় ঘোর নিয়ে তাকান। বলেন-আমার ছেলে বেঁচে থাকলে আজ তোমারই মতো হত। তোমাকে তুমি বলতেই মন চায়। 

সিদ্ধার্থ বলে—নিশ্চয়ই। আপনি আমার পিতৃতুল্য মানুষ। কী হয়েছিল ওর? 

—আমার ছেলের? সর্পাঘাত। এমনই বর্ষায় জাত সাপ কামড় দিয়েছিল পায়ে। বাঁধন দিলাম। ওঝা ডাকলাম। হাসপাতাল নেবার ব্যবস্থা করতে করতেই শেষ। 

অন্ধকারে শোক এসে ছোবল মারে সকলকেই। অশ্বিনী বলেন ঠাকুর যখন মারে, সব দিক দিয়েই মারে বাবা। ওই জমি দেখলে, অনাবাদি পড়ে আছে কতখানি? 

—হ্যাঁ। আমি ভাবছিলাম, কেন এমন। 

—এমন ছিল না বাবা। চার ফসলি জমি ছিল আমার। দু’বিঘা আট কাঠা জমি, সম্বৎসর ভরা থাকত। ঘরে অভাব ছিল না। তোমার কাছে কী লুকোব, এখন তোমাদের তিনজনকে খাওয়াতে আমার প্রাণান্ত। লজ্জায় মরে যাই। তিন বছর আগেও আমার এমন ছিল না। সব গেছে ওই মাটি-কাটাদের জন্য। 

—মাটি-কাটা? 

—বছর বছর নতুন ইটভাটা উঠছে বাবা। এই এলাকা ঘুরতে এসেছ, দেখতে পাবে। বাঁধের মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে সব। নদীপাড়ের মাটি কেটে নিচ্ছে। এই গ্রামে আমরা গঙ্গা থেকে সেচের জল আনতাম। পাম্প চালাবার সাধ্য নেই। গঙ্গার জলে আমাদের কখনও খরার শঙ্কা হয়নি। কিন্তু মাটি-কাটার দল মাটি তুলে তুলে নিচু করে দিয়েছে পাড়। জল আর আনা যায় না। উলটে বর্ষায় প্রচুর বালি এনে ফেলেছে প্লাবনের জল। শুখা মরসুমে জল পেলে ভূমি কর্ষণ করে বালিতে মাটি মিশিয়ে চাষযোগ্য করে নেওয়া যায়। সেচ দিতে পারছি না। কর্ষণ করব কী করে! জমি পড়ে আছে বন্ধ্যা হয়ে। উপায় নেই। বলদগুলো বেচে দিয়েছি। এবার মাটি-কাটাদের কাছে জমি বেঁচে দেব। যাদের জন্য সর্বস্বান্ত হলাম, তাদের কাছেই জমি বেচে দেব। যারা কিনবে, তারা সব পয়সাওয়ালা লোক। পাম্পে জলসেচ করে আবাদ করবে। 

—কাদের এই ইটভাটাগুলি? আপনারা প্রতিবাদ করেন না? 

—প্রতিবাদ? কে প্রতিবাদ করবে? ঘাড়ে যে মাথা একটাই। আমার মতো লোক তো ভাটা চালায় না বাবা। যারা চালায় তারা সব কেউকেটা মানুষ। এই দেখো, এই অঞ্চলের সকল ইটভাটার মালিক কে তাই বলি। সীতারাম ইটভাটার মালিক হল আমাদের গঞ্জের কাউন্সিলার বিকাশ সিংহ। কংগ্রেসি চেয়ারম্যান সরফরাজ আলির আছে গোলাপ ইটভাটা। ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা ইফতিকার আলির আছে একটি। সি পি এম কাউন্সিলার জাকির বিশ্বাসের আছে একটি। এরা সবাই লোক দিয়ে মাটি কাটায়। আমরা কার বিরুদ্ধে যাব? ওপর ওপর সব আলাদা দল। আড়ালে সব এককাট্টা। সব ইটভাটার মালিক। এলাকার বহু বেকার ছেলে ইটভাটায় কাজ পায়। তারা সবাই কোনও না কোনও দলের কর্মী। কাউন্সিলার বিকাশ সিংহ, সেও সি পি এমের লোক, বক্তৃতা দিয়েছিল, ‘ইটভাটাও ক্ষুদ্র শিল্পের মধ্যে পড়ে। বেকারত্বের জন্য এ অঞ্চলের যুবকেরা বিপথগামী হয়ে পড়ছে। তাদের সুপথে ফেরাবার জন্য আসুন আমরা ইটশিল্পকে জোরদার করে তুলি।’ এর আগের প্রধান ছিল আবদুল খালেক। সে বলেছিল, ‘অনেকে মাটি কাটার বিরুদ্ধে নানা প্ররোচনামূলক কথা বলে। কিন্তু আমরা জানি, মাটি কাটলে কাটা গর্ত গঙ্গার পলিতে ভরাট হয়ে যায়, তাই ভাঙন বাড়ে না। তাই ইটভাটা শুধু অর্থনৈতিক সুফলই দেয় না, ভূমি রক্ষাও করে।’ সরকারি কর্মচারীরা ঘুষ নেয়। তারা কোনও প্রতিবাদ করে না। আমরা কী বলব? মাটি-কাটার ফল আমরা পাচ্ছি প্রতি বছর। এবার আমাকেও হয়তো ওই ইটভাটাতেই কাজ করতে হবে সংসার চালানোর জন্য। এ বছর বলদগুলো বেচে দিয়েছি। এরপর জমি বেচব। রোজ রোজ যাই। নিষ্ফলা জমির ওপর গিয়ে বসে থাকি। দেখি। আর ক’দিন। তারপর ওই জমি অন্যের হয়ে যাবে। এত কথা আমি তো অন্যের সামনে বলতে পারতাম না। তাই এখন বললাম। জানি না কী হবে। আর হলেই বা কী! ল্যাংটার নাই বাটপারের ভয়। কী আর যাবে! প্রাণে যখন কথা কইবার তাগিদ এসেছে, কয়ে ফেলি। তুমি বললে ভাঙন প্রতিরোধের জন্য কমিটি করবে। আন্দোলন করবে। আশাহীন মনে তবু আশা জাগল। কথায় বলে আশায় মরে চাষা। আমরা তো মরলাম। ভবিষ্যতে আমাদের মতো ছোট চাষি যাতে না মরে তা তোমরা দেখো। কিছু করো বাবা। কিছু করো। 

.

এরপরে আর কথা জমে না। রাত গড়ালে মোটা চালের ভাত, ধুঁধুল ভাজা ও শুকনো লঙ্কা পোড়া দিয়ে আহার করে তারা। এর বেশি আয়োজন আর সম্ভব হয়নি অশ্বিনী হালদারের পক্ষে। জমির আয় বন্ধ। মেয়ে দুটিকে প্রথমে বিড়ি বাঁধায় লাগায়নি সে, এখন স্ত্রী ও মেয়েদের আয়েই চলে সংসার। 

পাত্র ত্যাগ করার আগে বাটিতে বাটিতে সামান্য দুধ এনে দেয় অশ্বিনী হালদারের স্ত্রী। সন্ধ্যায় গাভী দোহন করা টাটকা দুধের সুস্বাদ তারা নেয়। যথাযথভাবে অতিথি সৎকার করতে না পারার সকল গ্লানি ধুয়ে যায় ওই দুধের খাঁটি গন্ধে 

যে-ঘরে বসেছিল, সে ঘরেই শয়নের ব্যবস্থা হয় তাদের। অশ্বিনী হালদার বলেছিলেন— তিনজনা এক বিছানায়, তা যদি অসুবিধা হয়… 

তারা সকলেই প্রতিবাদ করেছিল—কোনও অসুবিধে হবে না। 

বৃষ্টি খানিক ধরেছিল। আবার নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে ছাতা মাথায় দিয়ে বাড়ির বাইরে জলবিয়োগ করে এসেছে তারা। শয়ন করেছে পাশাপাশি। দুলু বাউল বলছে- বড় করুণ এই ইতিহাস। 

সিদ্ধার্থ বলছে—ঘুরতে ঘুরতে এমন জানতে হবে আরও। 

—তার আবেদন শুনলে? 

—কী? 

—কিছু করো। 

—করতে তো চাই বৈরাগীঠাকুর।

—তুমি পারবে। তুমি শুদ্ধচিত্ত।

—আমি শুদ্ধচিত্ত নই ঠাকুর। 

—কেন এ-কথা বল? 

—আমার ক্রোধ হয়। হিংসা প্রতিহিংসা জন্মায় মনে। 

—তুমি তো মানুষ বাবা। মানুষ মাত্রই এইসব আছে কম আর বেশি। 

—অপরাধীকে ক্ষমা করে দিতে পারতাম আগে। এখন পারি না। ক্রোধ জেগে ওঠে। আমি কি অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি তবে? 

—সহিষ্ণুতা যেমন মানবিক গুণ, অসহিষ্ণুতাও তেমনি গুণ। অপরাধীকে ক্ষমা করা মহত্ত্ব, কিন্তু অপরাধমাত্রই কি ক্ষমার যোগ্য? এ ভুবনে কোনও কিছুই সরল-সাদা নিয়মে চলে না। অপরাধের সীমা আছে মহত্ত্ব প্রদর্শনের জন্য। সীমা অতিক্রম করলে ক্ষমা প্রদর্শনও হয়ে দাঁড়ায় অমানবিক। 

—আমারও তেমনই বিশ্বাস। কিন্তু মানুষকে আমি কখনও, কোনও অবস্থাতেই ঘৃণা করতে চাইনি। কিন্তু এখন ঘৃণা জাগে আমার। দুর্বৃত্তের প্রতি ঘৃণা জাগে। আমার মধ্যে পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে বৈরাগীঠাকুর। 

—পরিবর্তন জীবনের ধর্ম বাবা। আত্মবিশ্বাস রাখো। তুমি শুদ্ধচিত্ত। ঘৃণা যদি জাগে তোমার কারও ওপরে, জানবে তা ন্যায্য কারণে জেগেছে। 

—আমারও আছে এ বিশ্বাস। তবু, মানুষের মধ্যে থেকে মানুষকে ঘৃণা করতে কষ্ট হয়। 

—কেমন মানুষের প্রতি তোমার ঘৃণা? 

—যেমন ময়না বৈষ্ণবীর খুনিদের প্রতি। 

—হায় ঈশ্বর! জগদানন্দ! বাবা, মনে মনে তুমি বড় ছেলেমানুষ আজও। আর হবে না-ই বা কেন? তোমার বয়স কী! শোন বাবা, ওদের আর কে না ঘৃণা করে। 

—খুনি একজন না একাধিক আমি জানি না। ধরুন, তাদের কেউ আপনার সামনে পড়ল। আপনি কী করবেন? 

—খুন করব। 

.

চমকে ওঠে বিদ্যুৎ। মেঘে গুড়গুড় করে। বাজ ফেটে পড়তে চায় বিদ্যুতের পিছু পিছু। নদীতে জলবৃদ্ধি হয় আর বৃষ্টির চাপে খড়ো চালের ভার নুয়ে আসে। টুপটুপ জল পড়ে দুলুক্ষ্যাপার গায়ে। জল পড়ে সিদ্ধার্থর গায়ে। কেবল বসির খানের জায়গাটুকু অক্ষত থেকে যায়। উঠে বসে তারা। দুলুক্ষ্যাপা বলে—আহা! এদের শয্যা ভিজে যাবে গো! 

সিদ্ধার্থ বলে—পয়সার অভাবে চাল ছাইতে পারেনি। 

বসির খান বলে—সরে আসুন সব এদিকে। শয্যা গুটিয়ে নিন। 

একজনের জায়গায় তারা তিনজন গুঁড়িসুড়ি মেরে বসে। গৃহস্বামীকে জানিয়ে প্রতিকার চাইবার কথা তারা ভাবতেও পারে না। দুলুক্ষ্যাপা আপন মনে গুনগুনায়— 

বাউল কি মুখের কথায় হয় 
নারীর পা ধোয়া জল খাচ্ছে সদাই 
তারাই বাউল হয়।। 
বাউল হয় প্রেমেরি পাগল 
তোমরা ভাই করেছ গন্ডগোল 
নারীর পদে মাথা রেখে 
বলছে রে মা বোল।।

চৌকির কাঠে জল পড়ছে চার-পাঁচ ফোঁটায়। শব্দ হচ্ছে ডাব ডুব ডুবা ডুব ডুব ডুব। এ শব্দ যেন দুলু বাউলের গানের সঙ্গত। তবু দুলু বাউল থেমে যাচ্ছে একসময়। গ্রামের রাত্রি বড় দীর্ঘ। এই দীর্ঘ রাত না ঘুমিয়ে কাটাতে হবে তাদের। বসির খান ডাকে—–বাবাজি। 

—বল বাবা। 

—হবে নাকি?

—হোক। 

বৃষ্টি ধরল একটু। ব্যাঙ ডাকছে উচ্চৈঃস্বরে। কিছুক্ষণ মন দিয়ে শুনলে ঝালাপালা হয়ে যায় কান। কতরকম যে সুর আর স্বর তাদের! কতরকম ভাষা! 

দুলুক্ষ্যাপা হাতড়ে হাতড়ে গাঁজার সরঞ্জাম বার করে। সিদ্ধার্থ সিগারেট ধরায়। সামলে খেতে হবে তাকে কারণ সিগারেট সম্বলে তাকে রাত্রি জাগতে হবে। বসির খান বলে—মুর্শিদাবাদের নবাবের মধ্যে সেরা নবাব কে? 

—আলিবর্দি খাঁ। 

—সিরাজদ্দৌলা নয়? 

—সিরাজদ্দৌলা মহানায়ক। সেরা হবার সুযোগ সে পেল কোথায়? 

—আমার বিচারে সিরাজের ওপরে আর কেউ নাই। 

—একদিকে সেকথা ঠিক। পলাশির যুদ্ধে সিরাজের হার তাকে চিরকালের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছে। ভারতবাসীর হৃদয়ে সে চিরকালের আসন পেয়েছে সম্মানের। 

—গল্প শুনবেন?

—তুমি বলবে? 

—হ্যাঁ। 

—তুমি জানো? 

—গাইড বলে যতটা জানি। তা ছাড়াও সিরাজ বিষয়ে যত লেখা পাই, পড়ে ফেলি। ভাল লাগে। 

—বাঃ! শোনাও তা হলে। 

তারা নড়ে-চড়ে বসে। বর্ষা সঙ্গী করে রাত্রি গভীরের দিকে যায়। বসির খান গাঁজায় দম দিয়ে শুরু করে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *