2 of 3

রাজপাট – ৫৫

৫৫ 

অনেক আঁধার আলো দেখেছি, তবুও 
আরো এক বড় আলো অন্ধকারের প্রয়োজন
এখন গভীরভাবে বোধ করে মন 
আকাশ প্রান্তর পথ নক্ষত্রলোকের দিকে গিয়ে। 
সারাদিন এঁকেবেঁকে নদীটির ঢেউ 
মিশে যায় শাদা কালো রঙের সাগরে; 
সারাদিন মেঘ পাখি উঁচু উঁচু গাছ 
যেন প্রায় সূর্য স্পর্শ করে। 

.

গঙ্গা নদী মুর্শিদাবাদকে পলি দ্বারা উর্বরা করে যেমন, ভরায় যেমন, তেমনি ভাসায় দু’পাশ থেকে। কেন-না মুর্শিদাবাদের গা ঘেঁষেই বাংলাদেশের সীমানা বরাবর গিয়েছে পদ্মা। আর মুর্শিদাবাদের বুক চিরে গিয়েছে গঙ্গা। কিংবা ভাগীরথী। লোকে একেও গঙ্গা বলে, ওকেও গঙ্গা বলে। কখন কোন গঙ্গাকে ভাগ্যের জন্য দায়ী করছে বোঝা মুশকিল হয়। ভাঙন ও প্লাবন এ জেলার চিরসঙ্গী যেমন, তেমনি উর্বরতাও। নদীর জলস্রোতে ভেসে আসা পলি ভূমিকে ধন্য করে। ফসলপ্রদায়ী করে। 

আবাদই এ জেলার লক্ষ্মী। আল্লার মেহেরবানি হয়ে ফুটে ওঠা ফসলই এ জেলার সম্পদ। তবু প্রতি মুহূর্তের পা ফেলা ভাঙন ও প্লাবনকে সঙ্গে করে—এ এক দুর্ভোগ। জীবনকে কি মনোহররূপে সাজিয়ে তোলা যায়, যদি সারাক্ষণ জীবনের সঙ্গে সঙ্গে চলে ধ্বংসের করাল ভ্রূকুটি? 

এ জেলায় পাড়ভাঙার আছে শতেক কারণ। প্লাবনেরও আছে শতেক কারণ। 

আঁকাবাঁকা নদীপথের জলরাশি অন্তরে বহন করে যে ঘূর্ণিস্রোত তাই কেবল নয়, জলের ঘূর্ণিতে সৃষ্ট কেন্দ্রাতিগ বলের চাপও নয় কেবল, এ জেলায় ভূমিক্ষয় হয় জলস্তরের ওঠানামার জন্যও। 

বর্ষার ভরা নদীর জল ভূমিস্তরে ঢুকে পড়ে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে সৃষ্টি করে চাপ। জল নেমে গেলে পাড়ের জমিতে প্রবেশ করা জলের চাপে পাড়ের মাটি ঠেলে বেরিয়ে আসে। কারণ ভূমিতে প্রবিষ্ট জল, জলস্তর নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার নদীতে ফিরে আসতে চায়। 

এই প্রক্রিয়ায় ফরাক্কা থেকে জলঙ্গী পর্যন্ত গঙ্গার, বা পদ্মাও যাকে ডাকা চলে, তার দক্ষিণ পাড় ভাঙতে ভাঙতে চলেছে। এই অংশে আছে প্রায় দশ মিটার উঁচু খাড়া পাড়। পলিস্তর দ্বারা গঠিত এই পাড়ের ওপরের দু’মিটার মতো অংশ কাদামাটির স্তর। এই স্তর জমাটবদ্ধ। কিন্তু এর নীচে আছে মাইকা মিশ্রিত সাদা বালির স্তর। এই স্তর ভঙ্গুর। অবতল বাঁকগুলোতে জলের আঘাতে ওই স্তর দ্রুত ক্ষয়ে যায়। নীচের বালুস্তর সরে যায়। নদীর পাড় বরাবর দেখা যায় দীর্ঘ ফাটল। এবং বিস্তীর্ণ এলাকা ভাঙতে ভাঙতে যায়। 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাঙনের কেন্দ্রস্থলও বারবার বদলে যায়। ফরাক্কা ব্যারেজ হওয়ার পরে প্রাকৃতিক ভাঙন-প্লাবনের প্রবণতার ওপর ভারী হয়ে চেপে বসেছে আরও কিছু কারণ। নয়নসুখ, সাঁকোপাড়া, ধুলিয়ান অঞ্চলের কথাই ভাবা যাক। এ অঞ্চলের লক্ষণই ছিল ভাঙন- প্রবণ হয়ে ওঠা। কিন্তু ফরাক্কা তৈরি হওয়ার পরে গঙ্গার তির্যক স্রোত ফরাক্কা ব্যারেজের দক্ষিণ দিকের চুয়ান্নটি গেট দিয়ে বেরিয়ে এই অঞ্চলকে আঘাত করছে। ক্ষয়প্রবণ ধুলিয়ান ভেঙে পড়ছে আরও দ্রুত। আহিরণ থেকে ধুলিয়ান পর্যন্ত চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়কের অংশ চলে গেছে গঙ্গাগর্ভে এবং নতুন করে তা গড়ে উঠছে আরও পশ্চিম অংশে। উনিশশো আশি সালে সাঁকোপাড়ার নতুন রেলপথের সঙ্গে গঙ্গার দূরত্ব ছিল প্রায় পাঁচশো কুড়ি মিটার। বর্তমানে ওই দূরত্ব কমে দাঁড়িয়েছে দু’শো মিটারের মতো। ধুলিয়ান শহর ভেঙে গিয়েছে বারবার। কিন্তু অক্ষয় জীবনের মতো সে গড়ে উঠেছে আরও পশ্চিমে সরে গিয়ে। আরও ঘেঁষাঘেঁষি ঘিঞ্জি হয়ে। এমন সব উদাহরণ হাজার রয়েছে মুর্শিদাবাদে। গিরিয়া, খেজুরতলা, মিঠিপুর, শেফালিপুর, ফাজিলপুর দারুণভাবে ভাঙন কবলিত। আখেরিগঞ্জ খসে খসে পড়ছে কেবল ব্যাধি কবলিত মানব অঙ্গের মতো। হনুমন্তপুর, টিকলিচর, চরকেষ্টপুর চলে গেছে নদীগর্ভে। চিলমারি, হাসানপুর, রাজপুরও মানচিত্র থেকে মুছে যাবার অপেক্ষায়। 

নদীর প্লাবনের অন্যতম পরিণতি ভূমিক্ষয়। আবার পলি সঞ্চয়ের অন্যতম পরিণতি প্লাবন।

নদীজলে বাহিত ভূমিকণা, কঙ্কর জমে জমে, থিতিয়ে নদীগর্ভকে করে দেয় অগভীর। নদীর জলধারণ ক্ষমতা তাতে কমে যায়। কখনও পলি পড়ে নদীমুখ বন্ধ হয়ে যায়। তখন উজানে নদীর গতি কমে আসে। প্রাকৃতিক এই ঘটনাকে ত্বরান্বিত করে মানুষের লোভ ও চাহিদা। নদীতীরে বসতি গড়ার জন্য অপরিমিত বৃক্ষচ্ছেদনে ধরণীর ভূমিধারণ-ক্ষমতা হ্রাস পায়। চাষের জন্য সদ্যগঠিত চরের শক্ত ঘাস বা কাশবন উম্মলিত করার ফলেও ভূমি হয়ে যায় আলগা। প্লাবনে ওই আলগা ভূমি ভেসে পড়ে জলে। 

সারা মুর্শিদাবাদ জুড়ে প্রবাহিত গঙ্গা ও ভাগীরথী এমনই সব আলগা মাটি ভাসিয়ে জলবাহিত পলি দ্বারা ভরাট হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া এই নদীদ্বয় সুস্থিত হতে পারল না আজও। উজানের জল পর্যাপ্ত পরিমাণে আসে না এখানে। তাই পলিও ধুয়ে নিয়ে যেতে পারে না। 

বর্ষাকালের জল ধারণ করত বহু ছোট ছোট নদী। কিছু উপনদী তারা। কিছু ছিল শাখানদী। এখন সেগুলি বুজে গেছে। নদীর অববাহিকা এখন উর্বরা আবাদি জমি। অতএব বর্ষার অতিরিক্ত জল বড় নদীগুলির দু’কূল ছাপিয়ে প্লাবিত করে ভূমিডাঙা। 

এর সঙ্গে সঙ্গে আছে বাঁধের সমস্যা। অপরিকল্পিত বাঁধ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করে। নদীর বুকে চর জেগে ওঠে। আর চর জাগলেই নদী তার প্রবাহপথের অভিমুখ পাল্টাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাঁধের প্রাচীরে মাথা খুঁড়ে একদিন সব ভেঙে দেয়। মুক্তির উল্লাসের সঙ্গে ভাঙনের উন্মত্ততায় কারওকে করুণা করে না নদী, কারওকে ক্ষমা করে না। ভাঙে, ভাসায়, ভাঙে, ভাসায়, ভাঙতে ভাঙতে যায় মানুষের সাধের অসহায় গৃহস্থালী। ঘর-ভাসানো মানুষগুলি আবার আশ্রয় নেয় ওই বাঁধের ওপরেই। কেননা নদী ভূমিখণ্ড গ্রাস করে, কিন্তু জীবনের ইচ্ছা ভাসিয়ে নিয়ে যায় না। বেঁচে থাকার, ঘর বাঁধবার সকল আকুলতা সমেত ভূমিহারা মানুষ তাই বাঁধে আশ্রয় নেয়। বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ গেরস্থালি বাঁধতে, দিশাহারা মানুষ বাঁধের মাটি কাটে, ইট-ভাটার ব্যবসা করতে লোভী মানুষ বাঁধের মাটি কাটে, বাঁধ দুর্বল হয়ে যায়। আলগা মাটি ভেসে পড়ে নদীজলে এবং পলিসঞ্চয়ের ঘটনা ঘটতে থাকে অবিশ্রাম। 

ভীষণ পরিস্থিতি হতে মুক্তির পথ বাস্তুকার ও প্রযুক্তিবিদরা দর্শায় নানাবিধ। তারা স্পার তৈরি করে, বোল্ডার ফেলে পাড় বরাবর। কিন্তু এ নিয়ে মতবিরোধ কম নেই। অনেকে বলেন, স্পার নদীর অভিমুখ পরিবর্তন স্থগিত করে কিন্তু বিপরীত দিকের ভাঙনকে করে ত্বরান্বিত নরম মাটির ওপর বোল্ডার কখনও-ই কার্যকরী নয়। বরং বোল্ডারের চাপে মাটি ভেঙে পড়ে তাড়াতাড়ি। এবং বোল্ডারগুলি নদীগর্ভে গিয়ে গর্ভ ভরাট করে দেয়। এই বিপরীত ও বিরোধী মতামত চলেছে, চলছেই। একদল যাকে মনে করছে কল্যাণকারী, অপরদল তাকেই বলছে বিধ্বংসী। এমনকী, ওই যে বিশাল ফরাক্কা প্রকল্প, তাকেও অবিসংবাদীভাবে কল্যাণমুখী বলা যাচ্ছে না। ব্যারেজের উজানে জমে যাওয়া জলরাশি ধারণের জন্য নদীর সোজা গতিপথ বাঁকা হতে শুরু করেছে। ব্যারেজ তৈরির পর প্রায় পনেরো বছর ধরে যত পলি উজানে জমে উঠেছে, তার ফলে নদীর গভীরতা ও ঢাল কমে আসছে। বিশেষজ্ঞরা প্রত্যেকেই একথা একবাক্যে স্বীকার করেন যে নদীগর্ভ খুঁড়ে পলি নিষ্কাশন করে নেওয়া প্লাবন হতে মুক্তির প্রকৃষ্ট পন্থা। কিন্তু এ কাজ করা যায় সামান্যই। গরিব দেশ এই ভারতবর্ষ নদীখাত খুঁড়ে ফেলার বিপুল ব্যয়ভার বহন করতে পারে না। ব্যারেজ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রদত্ত প্রায় দশ বছর আগেকার প্রীতম সিং কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে কোনও কাজই হয়নি আজ পর্যন্ত। 

অতএব মালদহ ও মুর্শিদাবাদের গঙ্গাতীরের বসতি চিরবিপর্যয়ের মুখোমুখি, যা থেকে মুক্তির কোনও উপায় এখন লেখা নেই। 

.

দু’দিন ধরে ভাঙন নিয়ে ক্রমাগত পড়াশোনা করল সিদ্ধার্থ। নানা সময়ের খবরের কাগজের প্রতিবেদন ও পত্র-পত্রিকা জমিয়ে রেখেছিল সে। এই দু’ দিন অজস্র ফোন এসেছে তার। বাড়িতে এসেছে অনেক লোক। সে, জ্বর হয়েছে এই অজুহাতে, বাড়িতে আসা লোকজনের সঙ্গেই দেখা করেছে কেবল। বাইরে বেরোয়নি। 

জ্বর তার এসেছিল সত্যি। সে-রাতে বাড়ি ফিরে এসে সে স্নান করেছিল বহুক্ষণ এবং তার জ্বর এসেছিল। এমন জ্বর হলে সে পরোয়া করেনি আগে। কিন্তু এবার সে অনুভব করছিল, তার বিশ্রাম প্রয়োজন। তার গতি-প্রকৃতি তীব্র বাঁক নিয়েছে। এসবের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। জীবন কখন কার জন্য কী সাজিয়ে রাখে, তা জানা সম্ভব নয়। এইসব অতর্কিত বাঁক তাকে হৃদয়ে কিছু-বা চঞ্চল করেছে! তার ন্যায়নীতি-বোধে ঘটিয়েছে রদবদল। প্রাণনাশের শরিক হয়ে ও বিবেকযাতনা হয়নি তার বীর সেনানিদেরই মতো মানসিক গঠনে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই সে হয়ে উঠছে আশিরনখ যোদ্ধা একজন। তার চারপাশ বড় বেশি অস্ত্রময়। বড় বেশি গোলাবারুদে ঠাসা। একাকী সে নিরস্ত্র থেকে, অহিংস থেকে করে কী! দেহে ক্ষত হোক, লাগুক শোণিতদাগ, চরিত্রে লেগে যাক নিপাতকামনার ছাপ—সে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করবে না। এই কুশ্রী যুদ্ধ বিনাশ করার ব্রতে সে স্বপ্নিল। সারা শহর জুড়ে এখন কেবল একটাই আলোচনা। দীপেন হাজরার শাকরেদকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। দীপেনের বাড়ির পাশের গলিতেই। এবং সেই রাত থেকেই দীপেন ও তার আরেক শাকরেদ রাজু নিপাত্তা। পুলিশ সন্দেহ করছে, দলের কোনও অন্তর্ঘাতে আনিসকে মেরে দীপেনরা গা ঢাকা দিয়েছে। দীপেনের বউ পুলিশকে বিবৃতি দিয়েছে, গভীর রাত্রে রাজু ও আনিস দীপেনকে ডেকে নিয়ে যায়। কারওকে সাপ কামড়ানোর কথা তারা বলেছিল। তারপর ওই রাত্রেই তারা ব্যবসার আলোচনা করতে বসে। ওই সময় দীপেন তার স্ত্রীর উপস্থিতি নিষিদ্ধ করেছিল। কারণ, সে জানে, তার স্বামী মাদক চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। 

দীপেনের দলের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। দীপেনের নামে হুলিয়া বেরিয়েছে। সে শহরে বা আশেপাশে এলেই তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। দীপেনের স্ত্রী বলেছে, অন্ধকারে দীপেনকে সে চার-পাঁচজনের সঙ্গে বেরিয়ে চলে যেতে দেখেছিল। রাস্তায় অন্ধকার থাকায় সে ভাল করে কিছু বুঝতে পারেনি। 

এই সমস্তই সিদ্ধার্থ শুনেছে লোকমুখে। কোনও মন্তব্য করেনি। একটি স্থানীয় সাপ্তাহিক কাগজ আনিস নামে ছেলেটির মৃতদেহের ছবিসহ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এ একপক্ষে ভাল যে, সমাজবিরোধী হিসেবে যারা চিহ্নিত হয়ে যায়, তারা খুব সরল মৃত্যু দাবি করে বসে। পুলিশ তাদের মৃত্যুকে দলীয় অন্তর্ঘাত বা বিরোধী দলের কীর্তি বলে চালায়। দীপেন হাজরা, রাজু বা আনিসের জন্য সিদ্ধার্থর কোনও মায়াবোধ হচ্ছিল না। নিজেকে সামান্যতম দোষীও ভাবছিল না সে। সে ভাবছিল মিহির রক্ষিতের কথা। দীপেন হাজরা চলে গেল মানেই মিহির রক্ষিতের দক্ষিণহস্ত গেল। তিনি, কোনও খোঁজখবর না করে এমনিই কি ছেড়ে দেবেন? মির্জা বলেছিল, তার দলের ছেলেরা সবাই সন্দেহের ঊর্ধ্বে। এবং কেউ-ই তার হাতের বাইরে নয়। বিশ্বাসঘাতকতা তারা সহজে করবে না। তবু—তবু একটা কথা থেকেই যায়। সে কিছু-বা শঙ্কা বোধ করে। তবে, এ-ও ঠিক, মিহির রক্ষিতের সামনে এখন অনেক কাজ। সামনে নির্বাচন। আর নির্বাচনের আগে খুনের সঙ্গে নাম জড়িয়ে যাওয়া দীপেন হাজরার সংস্রব তিনি এড়িয়ে চলাই শ্রেয় মনে করবেন। তা ছাড়া দীপেন হাজরাদের বিনাশ নেই। মিহির রক্ষিত প্রয়োজনমতো আবার একজনকে তৈরি করে নেবেন। 

সিদ্ধার্থ সিগারেটে চুমুক দেয় আর ভাবে গভীর। এই প্রথম তার দ্বারা কোনও মৃত্যুদণ্ড সম্পাদিত হল। অতএব সে কিছু-বা বিচলিত, কিছু শঙ্কিত থাকবে, তা স্বাভাবিক। যে-বিচারক নিজের জীবনের প্রথম মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়, সে আন্দাজ করে, তার বিবেকদহন হয় আরও অনেক বেশি। কারণ বিচারক ঘটনা প্রত্যক্ষ করে না। শুধুমাত্র সাক্ষ্য ও সওয়ালের ওপর ভিত্তি করে সে আপন সিদ্ধান্তে পৌঁছয়। সিদ্ধার্থ ভাগ্যবান, সে ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছে। বার বার পেয়েছে। অতএব তার কোনও বিবেকযন্ত্রণা নেই। তবে, ভয় থেকে যাচ্ছে ঘটনার রেশমাত্র হয়ে। 

সে এই সন্ধ্যায় দলীয় দপ্তরে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। ছড়ানো কাগজপত্রের মধ্যে শুয়ে থেকে এসবই ভাবছে যখন সে, বোধিসত্ত্ব এলেন। হাতে তাপ মাপা যন্ত্র নিয়ে হাসিমুখে তিনি বললেন—ছোটবাবু আছেন কেমন? 

সে উঠে বসল। ভাল বলার আগেই যন্ত্রের পারদ প্রবেশ করল তার ভাল বলার জন্য প্রস্তুত হাঁ-মুখে। এমত তাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বোধিসত্ত্ব বললেন— পিত্ত, শ্লেষ্মা, কফ, বায়ু, যকৃৎ সবই তোমার প্রকৃতিস্থ আছে। তা হলে জ্বর কীসের প্রকাশ? উদ্বিগ্ন চিত্তের। 

সে তাকিয়ে আছে। মুখে তাপ মাপা চলছে বলে কথা বলতে পারছে না। 

বোধিসত্ত্ব বলছেন—মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হলেও জ্বর হতে পারে। অসুর দলনের ভার স্বয়ং কে নিয়েছিলেন তা তো জানো! দুর্গা! মহাকালের বিচারের পরে আর আস্থা রাখা যাচ্ছিল না বলেই দশহাতে অস্ত্র ধরেছিলেন তিনি। তাতে কোনও পাপ ছিল না। গ্লানি ছিল না। দাও দেখি। হয়েছে এতক্ষণে। 

সে যন্ত্রটি নিয়ে বোধিসত্ত্বের হাতে দিল। তিনি হাত ওপরে তুলে দেখলেন। বললেন, এখনও সামান্য অস্বাভাবিক। এটা ধরো। 

একটি ছোট কাচের শিশিভর্তি তরল তিনি ধরিয়ে দিলেন সিদ্ধার্থর হাতে। বললেন— সঙ্গে রাখবে। প্রতি দু’ঘণ্টা অন্তর দু’ ফোঁটা করে খাবে। দু’দিন তোমাকে কোনও ওষুধ দিইনি। কেবল দেহবিশ্লেষণ করলেই হোমিওপ্যাথিতে চলে না। মনও বিশ্লেষণ করতে হয়। 

সিদ্ধার্থ স্থির চেয়ে আছে বোধিসত্ত্বের দিকে। বোধিসত্ত্বও তার চোখে চোখ রেখেছেন। নীরবে। তবু হয়ে যাচ্ছে কিছু কথা বিনিময়। বোধিসত্ত্ব তার মাথায় হাত রাখছেন এবার। বলছেন—মানুষ নিরুপায়। আমিও। তুমিও। শুধু বিবেক জাগ্রত রেখো। বিচারের শক্তি যেন অত্যাচারীর শক্তিতে পরিণত না হয়। যতক্ষণ তোমার শুভবুদ্ধি আছে, ততক্ষণ কে তোমাকে সংহার করবে! 

সিদ্ধার্থ কোনওক্রমে বলে— দাদু! 

—অনেক কিছু করার আছে এখনও ছোটবাবু। It is not too late to seek a newer world. এটা একটা কবিতার কথা। আমার নয়। পুরো কবিতাটা তোমার জন্য নয়। আমার জন্য। তোমার জন্য শুধু ওই একটা লাইন। It is not too late to seek a newer world. একটা নতুন পৃথিবী খুঁজে নেবার জন্য খুব একটা দেরি হয়ে যায়নি। তোমার ক্ষেত্রে আরও ভালভাবে বলতে গেলে বলতে হয় কী জানো? 

–কী? 

–It is not too late to build up a newer world. তুমি পারবে। 

সে হাসে। টের পায়, বোধিসত্ত্ব আন্দাজ করেছেন কিছু এবং সমর্থন করেছেন। তার ভীতি ও শঙ্কাগুলি বিচ্ছিন্ন কচুরিপানার মতো ভেসে ভেসে যেতে থাকে। বোধিসত্ত্ব যেতে যেতে বলেন-বসির খান তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য নীচে বসে আছে। পাঠিয়ে দেব? নীচে আরও লোক অগেক্ষা করে আছে। 

সে সম্মতি দেয়। ওপরে সে ডাকে অতি অল্প ক’জনকেই। কিন্তু বোধিসত্ত্বের ইঙ্গিত সে উপলব্ধি করে। বোধিসত্ত্ব চলে যান। কতকগুলো অঙ্ক সে দ্রুত মিলিয়ে নেয়। সেদিন হয়তো বোধিসত্ত্বও নেমেছিলেন নীচে, বসির খানের কথা শুনেছেন। কিংবা সাবিত্রীদি কিছু বলে থাকবেন। সে কাগজপত্র গোছাতে থাকে। আর বসির খান এসে দাঁড়ায়। সে বলে— ভাল আছ তো বসির ভাই? 

—জি দাদা। 

—আফরোজা কেমন আছে? 

—আজ একটু ভাল আছে। ডাক্তার দেখাতে পারলে ভাল হত। কিন্তু … 

—কথা বলছে তো? 

—হ্যাঁ। খুব ভয় পেয়ে গেছে। 

হঠাৎ সে ছুটে আসে। পা চেপে ধরে সিদ্ধার্থর। সিদ্ধার্থ ছটফট করে- এ কী করছ! কী করছ! 

—আপনার জন্য, আপনার জন্যই ওর চরম ক্ষতি হয়নি। আপনার জন্যই ওকে ফিরে পেয়েছি। আপনার ঋণ… 

–কীসের ঋণ? কোনও ঋণ নেই। বসিরভাই, আফরোজা আমারও বোন তো। ওঠো। আমাকে লজ্জা দিয়ো না। 

বসির খান উঠে বসে। তার চোখ জলে ভরা। এবং একজন বলিষ্ঠ যুবকের চোখ জলে ভরে গেলে তাকে শিশুর চেয়েও বেশি অসহায় লাগে! সিদ্ধার্থ হাত ধরে তাকে বিছানায় বসায়। তার পিঠে হাত রাখে। প্রসঙ্গান্তরে যাবার জন্য বলে—নীচে ক’জন দেখলে? 

—পাঁচ-ছ’ জন তো হবেই। 

—চলো আমরা চা খেয়ে নীচে নামি। 

সাবিত্রীদিকে চা দিতে বলে সিদ্ধার্থ। বসির খান বসে আছে মুখ নিচু করে। সিদ্ধার্থ বলছে- আর কিছুদিন যাক। পুলিশকে বলে ওদের ক্লাবটা পুরোপুরি ভাঙিয়ে দেব আমি। তোমাদের জায়গাটা ঘিরে নিয়ো বসিরভাই। 

বসির খান বলে— মাঝে মাঝে ভয় লাগছে দাদা। 

—কীসের ভয়? 

—একটা লোককে আমি… আসলে কী যে হল আমার… আব্বুজির খুবলে নেওয়া চোখ মনে পড়ল, রক্তপাত মনে পড়ল, খুন চেপে গেল মাথায়। না হলে আমি… আমি… 

—যা হয়েছে তাকে যেতে দাও বসিরভাই। তুমি ওকে না মারলে আমাদের কাজটা সম্ভব হত না। তা ছাড়া ওদের পরিবর্তে আমরাও খুন হয়ে যেতে পারতাম। 

—তবু, একটা মানুষকে …। 

—মানুষ নয়। মানুষের কাজ ওরা করেনি। 

—আমারও… আমারও তাই মনে হয়। মানুষ নয় ওরা। 

—এসব আলোচনা থাক। এখানেই শেষ হয়ে যাক। ভুলে যাবার চেষ্টা করো বসিরভাই। জীবনে সবকিছু সোজাভাবে চলে না। 

কথাটা বলে অবাক হয়ে গেল সে। কে যেন বলেছিল তাকে এ কথা! কিছুতেই মনে করতে পারল না সে। অথচ কথাটা গূঢ় অর্থ সমেত তার মধ্যে এতকাল চেপে বসেছিল। আজ এই কথা সে ব্যবহার করছে নিজেই। 

চা খেয়ে নীচে নামল তারা। সার দিয়ে বসে আছে শরণার্থীর দল। সে যথাসম্ভব সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। সমস্যার সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এক বৃদ্ধ মানুষ, তিনি এসেছেন নদীর ওপারে গোপালনগর থেকে। 

গোপালনগর শুনেই চমকে উঠেছিল সিদ্ধার্থ ও বসির খান। বৃদ্ধ বলছেন তখন— ওই যেখানে খুন হয়েছে, গুণ্ডা দীপেন হাজরার বাড়ির অদূরেই বাড়ি আমার। 

সিদ্ধার্থ গম্ভীরভাবে বলছে— বলুন, আপনার প্রয়োজন কী? 

—বাবা, লোকে বলল, বহরমপুরে সিদ্ধার্থবাবুর কাছে যাও, তিনি সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন। কিন্তু এসে দেখছি, তুমি তো কচি ছেলে বাবা। তোমাকে বলতে সংকোচ হচ্ছে। আমার ছোট ছেলের চেয়েও ছোট তুমি। 

—তাতে কী? 

—না। আমি ভেবেছিলাম… তা সে যা-ই হোক, গোপালনগর উচ্চতর বিদ্যালয়ের স্কুলশিক্ষক ছিলাম, সাত বছর হল অবসর নিয়েছি, আজও একটি পয়সা পাইনি। সংসার আর চলে না বাবা। ছোটাছুটি করতে করতে প্রাণ গেল। প্রথম মেয়ে পার করেছি সামান্য জমি বেচে। ভিটে বেচে ছেলের দোকান করে দিয়েছি। কোনওমতে খেতে-পরতে পাই। টিউশনি করি নাই কখনও। আমার পেশার কাছে সৎ থাকার চেষ্টা করেছিলাম। তার মূল্য দিয়েছি। আর কোনও সম্বল নাই। ছোটমেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়েছে বাবা। কিন্তু আমার তো সামান্যও সঙ্গতি নাই। লোকে বলল, বহরমপুরের সিদ্ধার্থ, সে কারওকে ফেরায় না। 

সিদ্ধার্থ ভাবে কিছুক্ষণ। বলে—আপনার কাগজপত্রের কপি আমাকে দিয়ে যাবেন। দেখি কী করা যায়। আর মেয়ের বিয়ের কিছু সাহায্য কবে বিয়ে? 

—শ্রাবণ বাবা। একুশে শ্রাবণ। 

—দশদিন পরে আসুন। হবে তো? 

বৃদ্ধ আশীর্বাদ করতে করতে চলে যান। সিদ্ধার্থ হিসেব করে, এর মধ্যে মির্জা কিছু টাকা তাকে দিয়ে যাবে নিশ্চয়ই। সেরকমই কথা আছে। সেই টাকা এই বৃদ্ধকে দিয়ে দেবে সে। 

বসির খানকে সঙ্গে নিয়ে বেরুল সে এবার। দু’ দিন তৌফিকের খবর নেওয়া হয়নি। সে প্রথমে তৌফিকের বাড়ি যাওয়াই ঠিক করল। বসির খান যেতে চাইল সঙ্গে। পকেটে বোধিসত্ত্বর দেওয়া ওষুধের শিশি স্পর্শ করতে করতে তৌফিকের বাড়িতে পৌঁছল সে। তাকে দেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তৌফিক। বলল—তুমি আজ যাওনি সিধুদা! 

সিদ্ধার্থ বলল—না। আমারও জ্বর এসে গেল। 

বসির খান বলল—আপনার শরীর খারাপ? ছি ছি! আপনার খোঁজ করা হয়নি! 

সিদ্ধার্থ হাসল। বলল—তেমন কিছু হয়নি। এই যে দাদুর ওষুধ খাচ্ছি। 

পকেট থেকে শিশি বার করে দু’ফোঁটা খেয়ে নিল সে। তৌফিক বলল— তবে তুমি এর মধ্যে যাচ্ছ না? 

—যাব রে। 

–কবে? 

—দিন তিনেক পরেই বেরিয়ে পড়ব ভাবছি। 

—আমি যাব তো? 

—এবার না। পরের বার যাস। 

—কোথায় যাবে? 

জিগ্যেস করল বসির খান। 

গ্রামগুলো ঘুরব বসিরভাই। 

—আমি যাব আপনার সঙ্গে? 

—তোমার কাজ ফেলে যাবে, তোমার ক্ষতি হবে তো! 

—তৌফিকভাই যখন যাবে, তখন আমি যাব না। অন্য সময় যাব। আমাকে আপনার কাজে নিয়ে নিন দাদা। 

—বেশ! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *