2 of 3

রাজপাট – ৫৩

৫৩ 

জ্যৈষ্ঠে যমুনার জলে 
খেলেন বনমালী। 
শ্যাম অঙ্গে দিতাম জল 
অঞ্জলি অঞ্জলি ॥ 

সকালে গান হল না একবারও। থমথমে হয়ে আছে আখড়ার পরিবেশ। জব্বার মণ্ডল সুলেমান মণ্ডলের শাস্তি হয়েছে গ্রামে, এ সংবাদে পাথর হয়ে আছে সবাই। তা ছাড়া বুড়িয়াকে নিয়েও বিব্রত প্রত্যেকেই। সবচেয়ে বেশি বিব্রত দুলুক্ষ্যাপা নিজে। এক আশঙ্কাও ঘিরে ধরেছিল তাদের। যদি আক্রান্ত হয় আখড়া! 

মোহনলাল আখড়া বাঁচিয়েছে এ যাত্রা। কেন বাঁচিয়েছে, তা আন্দাজ করে দুলুক্ষ্যাপা। সে লক্ষ করেছে মোহনলালের চোখ। খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফেরে বারবার। সে চোখ প্রেমিকের কিনা, তা ভাল করে বোঝা হয়নি। রাত্রির ওই অভিসার জমে উঠল কেমন করে, জানা হয়নি তারও ইতিহাস। প্রেম থাক বা না-থাক, এই সম্পর্ক মধুর নিশ্চিতই। নারী-পুরুষ উভয়ের সম্মতিতে গড়ে ওঠা যে-কোনও সঙ্গমই মধুর। পৃথিবীতে মধুর সম্পর্ক যত বৃদ্ধি পায়, ততই মঙ্গল। দুলুক্ষ্যাপা তার ন্যায্য-অন্যায্য বিচার করে না। 

এই অবস্থায় আখড়া ছেড়ে দূর শহরে যাবার উপায় নেই। সকালেই সে বেদে-বউকে ডেকে এনেছিল। বেদে-বউ ছিল না তখন। কার বাড়িতে প্রসব ঘটাতে গিয়েছিল। একসময় এই বেদেরা ঘুরে ঘুরে বেড়াত। তেমন ভ্রাম্যমাণ দল আজও দেখা যায়। কিন্তু কয়েকঘর কেমন করে মাটির মায়ায় পড়ে স্থায়ী বসত গড়ে তুলেছে। হিন্দু-মুসলমানের ধর্ম-সংস্কৃতিতে তারা ব্রাত্যজন। কিন্তু তাদের চিকিৎসা নিতে, প্রসবের সময় সাহায্য নিতে আপত্তি হয় না কারও। কেন না, চিকিৎসকের কোনও জাত নেই। তেকোনার মতো গ্রামে দৈনন্দিন রোগবালাই সারাতে এইসব গ্রাম্য চিকিৎসাই একমাত্র ভরসা। 

সকালেও দুলুক্ষ্যাপা জলপটি দিয়েছিল বুড়িয়ার মাথায়। বুড়িয়ার ঘোর খানিক কেটেছে। কিন্তু তার চোখ দুটি হয়ে আছে লাল। দুলুক্ষ্যাপাকে দেখে সেই চোখ দুটি জলে ভরে উঠেছিল। দুলুক্ষ্যাপা স্নেহভরে বলেছিল—বিচলিত হবেন না আপনি। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সেরে উঠুন। 

এগারোটা নাগাদ বেদে বউ এল। তার নাকে রুপোর নথ। দু’হাতে রুপোর বালা। পায়ে নূপুর। গলায় রুপোর হাঁসুলি। মোটা-সোটা এই নারী শিশুর জন্ম ঘটাতে সিদ্ধহস্ত। জন্মনিরোধ করতেও। দু’-তিন মাস পর্যন্ত গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত করতে পারে সে। তিন মাসের বেশি হলে হাত তুলে দেয়। বলে— শহরে যাও। ডাক্তারের কাছে যাও। 

গ্রামান্তর থেকে তার কাছে লোক আসে। সেও গ্রামে-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ায় ভেষজ সংগ্রহের জন্য। এমনকী সাপ পেলেও ধরে আনতে ভোলে না। বিষধর সাপের বিষ বিক্রয় করে। বিষহীন সাপের চামড়া। লোকে বলে বেদেরা সাপের মাংস খায়। হয়তো। 

বেদে-বউ এসে বুড়িয়ার চোখ টেনে দেখল। নাড়ি দেখল। কপাল নিরিখ করে নিদান দিল। নিজেই সে কিছু পাতা বেটে আনল পাকশাল থেকে। অল্প অল্প করে বুড়িয়াকে খাওয়াল। বলল—সেরে উঠবে। ভয় নাই। সারা দিনে পাঁচ কাপ ভাড়ালির রস দিয়ো। বিচাকলার ভাড়ালি চাই। 

জসিম বাউল সংগ্রহ করেছে বিচেকলার থোর। পারুলবালা দায়িত্ব নিয়েছে ছেঁচে রস করে খাওয়াবার। মেয়েরা সব পাকশালে ব্যস্ত। সূর্য যখন প্রায় মধ্য গগনে, দুলু বাউল দেখল ধীরে ধীরে বুড়িয়ার চোখের লালাভা কেটে যাচ্ছে, দৃষ্টি হয়ে উঠছে স্বচ্ছ। পরিষ্কার। থোড়ের রস খেয়ে উঠে বসল সে। স্নানের ইচ্ছা প্রকাশ করল। দুলু বাউল বাধা দিল না। পারুলবালাই বুড়িয়াকে নিয়ে গেল স্নান করাতে। দুলুক্ষ্যাপা এসে মহম্মদ সাঁইয়ের নিকটে বসল। বেলা বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সকালের ভার কেটে যাচ্ছে অল্প অল্প করে। যেন রোদ্দুরে শুকিয়ে যাচ্ছে সকল শোক, তাপ, বিক্ষোভ ও বিতৃষ্ণা। বাউলের ধর্মও তাই। শোকাবহ ধরে রাখে না তারা। মহম্মদ সাঁই গুনগুন করছিলেন ক’টি পদ—

অমাবস্যা দিনে চন্দ্র 
থাকেন যে কোন শহরে।
প্রতিবতে হয় সে উদয়
দিষ্ট হয় না কেনে তারে ॥
মাসে মাসে চাঁদের উদয়
আমাবস্যে মাসন্তে হয়।
সুজ্জের আমাবস্যে নিন্নয়
জেন্তে হবে নেহাজ করে॥
ষোলো কলা হইলে শশী
তবে তো পুণ্যমাসী।
পনেরোয় পুন্নিমা হয় 
কিশিপণ্ডিতেরা কয় সংসারে ॥ 

দুলু বাউলের বসার ভঙ্গির মধ্যে এক সকল হারানো লোকের আর্ত রূপ ছিল। হরিমতি বললেন- বাবা, যাঁ হয়েছে তাকে মেনে নাও। কাল যেন একই নাটক দু’বার দেখলাম এমন ভাব হচ্ছিল। জানি না নাটকের আরও কত বাকি। তবে যা হয়েছে তাকে ভেবে লাভ নাই। সহজে নাও। সকল বিষয় সহজে নাও। কথায় বলে, অতীত পিছু ছাড়ে না। তোমার অতীতও ধাইছে তোমার পিছে পিছে সর্বক্ষণ! তুমি সুদর্শন, তুমি প্রেমী, তুমি মিষ্টবাক, সুগায়ক। নারী তোমার পথ ছাড়বে না। কিন্তু সে কেমন নারী? তোমার কপাল—তারা শহুরে মেয়েমানুষ। 

গুরু মহম্মদ সাঁই বললেন—তারে কিছু বলিস না ছেলে। 

তাঁর কথায় আর ঝাঁঝ নেই। গতরাতের বিরক্তি নেই। নেই গর্জ্যমান ক্রোধ। গুরু মহম্মদ সাঁই ভূয়োদর্শী মানুষ। সহজেই হতে পেরেছেন ক্ষমাময়। গত রাতে তাঁর অকরুণ রূপ মিলিয়ে গিয়ে ভরে উঠেছে করুণা! স্নেহভরেই তিনি এখন অনুরোধ করছেন তাকে কিছু না বলার জন্য। ছোটদের ক্ষমা করতে হয়। ছোটদের খেয়াল, ছোটদের জেদ, অভিমান, অবুঝপনা ক্ষমা করতে হয়। এখানেই বড়র চিরন্তন মহত্ত্ব। সেই মহত্ত্ব আছে গুরু মহম্মদ সাঁইয়ের। আছে দুলু বাউলের। গুরু বলেন—তারে কিছু বলিস না ছেলে! 

দুলু বাউল মাথা নাড়ে—না। কী বলব। 

—আমার সন্দেহ হয়েছিল, সে পারবে না। তার মনে এখনও বিশ্বাস জন্মায়নি। 

—তা হলে! আপনি… 

—তবু দীক্ষা দিতে গেছিলাম। তোর কথা ভেবে রে পাগল। নারী বিনা সাধন পূৰ্ণ হয় না। দুলুক্ষ্যাপা নতমুখী হয়। অপরাধবোধ হচ্ছে তার। এ কোন ভুল তাকে জড়িয়ে ধরল আষ্টেপৃষ্ঠে! গুরুমা হরিমতি বলেন—আমার একটি আদেশ আছে ছেলে। মায়ের আদেশ। তোমায় মান্য করতে হবে। 

মহম্মদ সাঁই বলেন—বাপেরও এই একটি আদেশ। 

দুলু বাউল সপ্রশ্নে তাকায়। 

—গণি বাউল আর নাই বেশিদিন। সে মাটিতে ফিরে গেলে জাহিরাকে তুমি নিয়ো 

হরিমতি প্রতিধ্বনি তোলেন—নিয়ো। তারে নিয়ো। 

দুলু বাউল করুণ চোখে তাকায়। চিরশিলা হয়ে যেতে চায় তার অন্তর। সে কতবার উপেক্ষা করেছে জাহিরাকে। জসিম বাউল এই প্রস্তাব দিয়েছিল, তাকেও সে ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন এঁরা তাকে কেন বাঁধতে চান! তার মনে পড়ে সেই দৃশ্য। চুপিসাড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে একজন। আঁধারে মিশিয়ে যাচ্ছে। জাহিরা বড় বেশি রক্ত-মাংসের। তার যে জাহিরাতে মন লাগে না। কে যেন ভেতরে বলে ওঠে, বুড়িয়া মেয়েটির কী ছিল? এমন কী ছিল? 

সে কেতাব-পড়া মেয়ে। 

তোমার কেতাব-পড়া নারী নইলে চলে না? 

না। সে-কথা নয়। কিন্তু বুড়িয়া এক, জাহিরা আর এক। 

এ যুক্তি বুড়িয়ার পক্ষে লাগে না। সব মানুষই ধরনে পৃথক। 

ভাল করে শুনে রাখো। বুড়িয়া আমার ভ্রম। আমি আবার কোনও ভুল করতে পারব না।

কাকে নিয়ে থাকবে তুমি! কাকে নিয়ে! 

.

হরিমতি জবাবের প্রতীক্ষা করছেন। মহম্মদ সাঁই জবাবের প্রতীক্ষা করছেন। দুলুক্ষ্যাপা তার যাবতীয় শক্তিতে প্রত্যাখ্যান সাজাচ্ছে। প্রত্যাখ্যান। 

—আমি পারব না মা। এ আদেশ ফিরিয়ে লন। 

—জাহিরা তোমাকে তার চন্দ্র করে বসে আছে যে। 

–না। 

গুরু এবং গুরুমা চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর গুরুমা বলেন—ভেবে দেখিস বাবা। নর-নারীর মধ্যে না-এর প্রাচীর আলগা। যদি প্রাচীর গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়, আমরা সুখী হব। ওই বুড়িয়া মেয়ে থাকবে না তোর সঙ্গে তা বুঝেছি। আমাদের বয়স হয়েছে। কে কখন চলে যাই! তোর একজন ভরসা করার লোক আছে জানলে সুখে মরতে পারব। 

দুলু বাউল বলে—মরার কথা ওঠে কীসে মা? 

—বাবা, সন্তানের ভাল-মন্দের কথা ভাবতে গেলে বাপ-মায়ের এই কথাই সবার আগে মনে আসে, আহা, আমি না থাকলে আমার ছা ভাল থাকতে পারবে তো? দেখিস না? লোকে কেমন লাইফ ইনসিওরেন্স করছে? 

—মা, সে অনেক কারণে করে। 

—আরে সংসারী লোকের জন্য হাজার কারণ তো থাকবেই। আসলে জীবনটাই বিমা করছে তো! আজ বলে যাই বাবা, জাহিরা অন্তরে মন্দ নয়। 

মহম্মদ সাঁই বলেন—আজ তা হলে আমরা বিকেল-বিকেল রওনা হই। 

দুলু বাউল আহত চোখে তাকায়। বলে কথা ছিল থাকবেন ক’দিন। 

গুরু হাসেন। বলেন—কথা, ছিল কথা, কথা ছিল। শোন— 

কথা ছিল চন্দ্ৰ 
বলে যোগেন্দ্র 
পুন্নিমে ফুটিলে ফলিবে সোনা। 
যোগের কেন্দ্র 
দশ সুরেন্দ্র 
কী ঘটাবে ঘটিবে যায় না জানা। 

কথা থাকে। কথা চলে যায়। আর মন লাগছে না এ-পানে। কী করি বল! নিশি বাউল আছে। তার সঙ্গে যাই। 

—এ কি আমারই অপরাধে প্রভু… 

—ছি ছি ছি। 

দুলু বাউলের কথা ফুরোয় না, মহম্মদ সাঁই ছি ছি করে ওঠেন। বলেন—তুই কেন অপরাধী হবি রে পাগল! নিজেকে দোষী ভাবতে নাই। যা হবার তা আপনি হবে। শুনলি না, কী ঘটাবে ঘটিবে যায় না জানা। সামনে পথ পড়ে আছে, কোথায় কী ঘটবে, কে বলতে পারে! চল দেখি, চল। কলকে ফেরা। আয়, আয়। প্রসাদ পাবি? প্রসাদ? ছেলে আমার অভিমানী বড়। 

কলকে সেজে ওঠে। গাঁজার গন্ধ ভরে আখড়ায়। গুরুর প্রসাদ সকলের হাতে হাতে ফেরে। তপনতাপে বিহ্বল আকাশ। তার শরীর হতে যেন নেমে আসছে পোড়া গন্ধ। সূর্য জ্যেষ্ঠা নক্ষত্ৰ হতে পাট চুকিয়ে পূর্বাষাঢ়ার দিকে চলেছেন। আর্দ্রা নক্ষত্রও তাঁর অপেক্ষায়। মেঘ নেই যে তাঁর পথ আড়াল করবে। অতএব দিকে দিকে চোখ ঝলসানো আলো আর রসহীন হা হা প্রান্তর। দুলুক্ষ্যাপা সেইদিকে চেয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। এমন ঝলসানো দিনেও পথ চলতে চলতে কতদিন দেখা হয়েছে ময়না বৈষ্ণবীর সঙ্গে। সে যে রোদ-জল কোনও কিছুই পরোয়া করত না! গুরু বলেন—আর কিছুতে ফাঁকি পেলেও একটি বিষয়ে ফাঁকি পাবে না। সে বস্তু কী? প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তিনি মজার মুখে হাসেন। চেঁচিয়ে ওঠেন—সুর রে বোকার দল, সুর। সব ছেড়ে চলে যেতে পারে। কিন্তু সুরের সঙ্গে প্রাণের একবার যদি মিলন হয়, আর ছাড়াছাড়ি নেই। 

ডুব দে রে মন সুরসায়রে 
সেথা দানা দানা 
মুক্তোকণা 
কুড়িয়ে পাবি জীবন ভরে 
ডুব দে রে মন সুরসায়রে। 

নিশি বাউলের দিকে তাকিয়ে বলেন—বাজা তোর গাবগুবাগুব। 

জসিম বাউলকে বলেন—আন দোতারা। 

দুলু বাউলের দিকে চেয়ে বলেন—মুখে অত কালি ঢেলে বসে থাকলে হবে? হেমন্ত মুখুজ্জের মতো সুধাকণ্ঠ পেয়েছিস শালা, গান করে যা। ধর দেখি, ধর। ওইটে ধর। লালন না, লালন না, বাদশা ফকিরের সেই গান ধর। বাহার বাউলের গান—মানুষকে সেখায়েত করে…. 

দুলু বাউল ধরে— 

মানুষকে সেখায়েত করে মহাপাপী সে। 
মানুষকে না ভালবেসে ভাল পেল কে ॥ 
মানুষ ভজন মানুষ পূজন আদম রসুল মানুষ দু’জন। 
এই মানুষে সাঁয় নিরঞ্জন খুঁজে নিবি নে ॥  
মানুষকে না ভালবেসে আজ জিল পড়েছে ফাঁসে। 
এই মানুষে আল্লা মিশে কালাবিল্লায় কে ॥ 
মানুষেরই যত্ন করো তবে বেহেস্তের রাহা ধরো।
বাহার বলে যদি পারো উয়াও হরফ হে ॥ 

বিকেলবেলা বিদায় হয়ে যান সকলে। আখড়া নিঝুম পড়ে থাকে। এই ক’টি মাত্র লোক নিয়েই বসবাস। তবু অতিথিসমাগমের জৌলুস দৈনন্দিনের অভ্যাসকে শূন্য করে দেয়। যেন লোকাভাবে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে আকাশ, বাতাস, আঙিনা, মাটি। 

গুরু বিদেয় করে দুলুক্ষ্যাপা বুড়িয়ার কাছে এসে বসল। প্রায়ান্ধকারে চুপচাপ শুয়েছিল বুড়িয়া। দুলু বাউল বলল—কেমন বোধ করছেন এখন? 

—ভাল। 

কথা আসে না। বহু প্রসঙ্গ উত্থাপিত হওয়ার অপেক্ষায় চুপ করে থাকে। নীড়ে ফেরা পাখিরা ডালে বসে ডানা ঝাপটায়। দেখতে দেখতে রাত্রি নেমে আসে। পারুলবালা থোড়ের রস খাইয়ে যায় বুড়িয়াকে। হালকা পথ্য দেয়। সকলেরই মুখে লেগে আছে বিষণ্ণতা। 

দুলু বাউলের আর রসপানে মন লাগে না। সে উদাস মনে শয্যার কাছে দাঁড়ায়। বুড়িয়ার কপালে হাত রাখে। কপাল শান্ত। শীতল। বেদে-বউকে মনে মনে ধন্যবাদ দেয় সে। বুড়িয়া বলে-বসুন। 

সে বসে। 

বুড়িয়া বলে—আমি অপরাধী। আমার খুব খারাপ লাগছে। 

দুলুক্ষ্যাপা বলে—কীসের অপরাধ? কোনও অপরাধ নাই। 

—আছে। 

আবার দু’জনে নীরব হয়ে যায়। দু’জনের রসসাধনার স্মৃতি ছায়ার মতো ঘুরে ঘুরে বেড়ায় ঘরে। গণি মিঞা কাশে। জড়ানো ঘরঘরে গলায় ডাকে—জাহিরা, জাহিরা। 

তার কোনও প্রাকৃতিক ত্যাগের প্রয়োজন হয়ে থাকবে। কিংবা পিপাসা।

বুড়িয়া বলে—আমি এবার ফিরে যেতে চাই দুলেন্দ্র। 

—বেশ। 

—আমি পারলাম না, আমি ক্ষমা চাইছি। 

–করে যেতে চান? 

—কালই। 

–একটু সেরে উঠুন আগে। 

—না। কাল পারব। 

—বেশ। 

দুলু বাউল দাড়িতে হাত বোলায়। বড় বড় চুলগুলির বাঁধন খুলে ফেলে আবার নতুন করে বাঁধে। তার মনে হয়, নিরালম্ব সে। শূন্যে বিরাজমান। গুরু বলছিলেন, পথ বাকি। কোথায় কী ঘটতে পারে, কে বলবে। ঘটুক। যা-ই ঘটুক, সে শান্ত মনে নেবে। তার আর কিছু পাবার নেই। কিছু হারাবার নেই। সকল হারানো শেষ করে সকল পাওয়ার কণামাত্র শুরু হয়েছে। কানায় কানায় সেই পাওয়ার পাত্র ভরে না উঠলে সে থামবে না। যা গেছে তা ক্ষুদ্র। যা সে পেতে চলেছে, তা বৃহৎ। পাবার সম্ভাবনা চিরকালই মহৎ। 

বুড়িয়া বলে—আমি কি ক্ষমা পেলাম? 

—আপনার কোনও অপরাধ নাই। ক্ষমা কীসের! 

—আমি কে, জানতে চান না? 

—আর আগ্রহ নাই। আপনি বুড়িয়া, তা তো জানি। 

—আপনি একদিন জানতে চেয়েছিলেন। আমি বলিনি। আজ বলব। 

—বেশ। 

—আমি বাবা আর মা থাকতাম। আর থাকত আমার কাকা। আমার বাবার সবচেয়ে ছোটভাই। ছোটকাকা। হার্ডওয়ারের ব্যবসা ছিল বাবার। কাকার তাতে অংশ ছিল না। কিন্তু কাকা বাবাকে সাহায্য করত। বাবা কাকাকে বেতন দিতেন। 

.

দূরে শেয়াল ডেকে ওঠে। গাঁয়ের কুকুরগুলিও ডাকে ওই ডাকের অনুসরণে। কোথাও এতটুকু চাঁদের আলো নেই। বুড়িয়া বলে চলে – আমার যখন দু’বছর বয়স তখন মা মায়ের এক মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। ছ’মাস ছিল। তারপর বাবা মাকে ফিরিয়ে আনে। মা’র মাথায় তখন সামান্য গোলমাল দেখা দিয়েছে। বাবাকে বলত, আমার বাউল খুঁজে দাও। বাবা বলত, খুঁজছি। পেলেই তোমার কাছে নিয়ে আসব। 

—হে ঈশ্বর! 

—মাঝে মাঝে দুলেন্দ্র—দুলেন্দ্র বলে ডাকত। ঘুরে বেড়াত ঘরময়। 

—কে? কে? কী তোমার মায়ের নাম? 

—আমাকে ঘর থেকে বার করে দিত মাঝে মাঝে। বলত, যা দুলেন্দ্রকে খুঁজে আন। শান্তিনিকেতনে যাকে জিগ্যেস করবি, সে-ই তার ঠিকানা বলে দেবে। 

—ওঃ! 

—আমি বাইরে বসে থাকতাম। ছোট তো তখন। ভাবতাম যাব। শান্তিনিকেতন যাব। মায়ের জন্য খুঁজে আনব দুলেন্দ্রকে। কিন্তু ছোট ছিলাম বলে একা কোথাও যেতে ভয় করত। তবু সংকল্প করেছিলাম। খুঁজে আনব। ঘরের বাইরে বসে বসে আকাশ-পাতাল ভাবতাম। বাবা দোকান থেকে ফিরলে আমাকে নিয়ে ঢুকতেন। আমি বাবাকে জিগ্যেস করলাম, দুলেন্দ্র কে বাবা! বাবা বললেন, তোমার মা তাঁকে ভালবাসতেন। আমি বললাম, তা হলে তুমি মা-কে বিয়ে করলে কেন? বাবা বললেন, তোমার মাকে যে আমি ভালবাসতাম সোনা। আমার বয়স তখন বারো। শুনলাম, জানলাম। এক জটিল অঙ্কের মধ্যে ওই বয়সেই ঢুকে পড়লাম আমি। বাবা মাকে ভালবাসে। মা আর-একজনকে। সকলেই যেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কিছুতেই পরস্পরের মুখের দিকে চাইছে না। তখনই আমার মধ্যে প্রশ্ন জেগেছিল। কাকে বিয়ে করা উচিত, যাকে আমি ভালবাসি? না যে আমাকে ভালবাসে! 

দুলেন্দ্রর সঙ্গে মা চলে গিয়েছিল বাউল হতে। ফিরে এসেছিল পাগলের মতো। এসে বাবার পায়ে পড়েছিল। মাকে দেখে বাবার মনে হয়েছিল, মা কারও হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইছে। বাবা, মাকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু মা শান্ত হল না। একটু পাগল-পাগল ভাব। পালাল। ফিরে এল। বাবা মাকে অযত্ন করলেন না। কিন্তু মায়ের থেকে সরে সরে রইলেন। কিংবা মা-ই বাবাকে দিতেন সরিয়ে। মা-র তখন দু’জন প্রেমিক। বাবার বন্ধু শীতলকাকু। আর আমার কাকা। ছোটকাকা। এসব দেখতে দেখতে আমি বড় হচ্ছিলাম। মা ফাঁক পেলেই আমাকে দুলেন্দ্রর গল্প করত। দুলেন্দ্র কী সুন্দর! কত মেধাবী! কী আশ্চর্য গান গায়। বলত, বুড়িয়া, তুই আমাকে দুলেন্দ্র এনে দিবি? একদিন রাগ হল। বললাম, আর কত চাই তোমার? শীতলকাকা। ছোটকাকা। আর কতজনকে ঠকাবে মা? মা সেদিন আমাকে ভয়ানক মারল। বাবা বললেন, তোর মায়ের মন জুড়ে আছে দুলেন্দ্র। ও সবার মধ্যে দুলেন্দ্রকে খুঁজে বেড়ায়। দুলেন্দ্র, দুলেন্দ্র, দুলেন্দ্র শুনতে শুনতে আমিও মনে মনে দুলেন্দ্রকে কবে থেকে যেন চাইতে লাগলাম। মনে হল, কোনওদিন যদি পাই তাকে, দেখব, কেমন সে। কী দিয়েছিল মাকে। দেখব, কী সেই সাধনপদ্ধতি, যার তাড়নায় মা পাগল হয়ে গেল! 

দুলু বাউলের কণ্ঠ শুষ্ক হয়ে গিয়েছিল। মাথা ব্যথা করছিল। বুড়িয়া বলছিল—মা একদিন বলল, বুড়িয়া, আমি পাপ করেছি। গুরুর কাছে দীক্ষা নিতে গিয়েও পারিনি। পালিয়ে এসেছি আসর থেকে। দুলেন্দ্রকে কষ্ট দিয়েছি আমি। গুরুকে অপমান করেছি। কী করব? আমি কী করব? কী বিশ্রী সব পদ্ধতি! কিন্তু, কিন্তু, তোমাকে পারতে হবে। তোকে দীক্ষা নিতে হবে। পারবি না? পারবি না? মার চোখে উন্মাদ দৃষ্টি। আমি না বলতে পারলাম না। একথা বলার পরদিন মা মারা গেল। পাগলামির জন্য কড়া ঘুমের ওষুধ খেত। নইলে ঘুম হত না। বাবা দিত রোজ একটা করে। না হলে আমি দিতাম। চাবি নিয়ে নিজেই আলমারি খুলে সব ওষুধ খেয়েছিল। স্বীকারোক্তি ছিল একটা। তাতে লেখা ছিল তেরোজনের নাম। তাদের সকলের প্রতি মা ভালবাসা জানিয়েছিল। কিন্তু ওই তেরোজনের কোথাও বাবার নাম ছিল না। বিভিন্ন সময়ে মা ওই তেরোজনের সঙ্গে সংসর্গ করেছিল। 

—থাক! থাক! আর বলতে হবে না। 

কাতর শোনায় দুলু বাউলের গলা। বুড়িয়া বলে চলে—আমার পনেরো বছর বয়স। মা মারা গেল। বাবাকে যে মা কোথায় রাখত, তা আর বোঝা গেল না। মা ছিল পাখি, বাবা ছিল মায়ের আশ্রয়দাতা গাছ। বোধ হয় এর বেশি আর কোনও সম্পর্ক মায়ের সঙ্গে বাবার ছিল না। কিন্তু সেটা মায়ের পক্ষ থেকে। মহাবৃক্ষ আমার বাবা তাঁর পাখিটিকে প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিলেন। তেমন ভালবাসা সহজে মেলে না দুলেন্দ্র। ব্যবসা বিক্রি করে দিলেন বাবা। সমস্ত টাকা লিখে দিলেন আমার নামে। কাকাকেও দিলেন বেশ কিছু। নিজে একেবারে বাড়িতে বসে গেলেন। মাঝে মাঝে বলতেন, আমি কেন দুলেন্দ্রকে খুঁজে আনলাম না। কেন আনলে না, বাবা? একদিন জিগ্যেস করলাম। বাবা বললেন, ঈর্ষা হয়েছিল রে বুড়িয়া। ভয়ও হয়েছিল। দুলেন্দ্রকে পেলে যদি তোর মা চলে যায়! কিন্তু কী হল বল। আমি তো পেলাম না তাকে। হয়তো দুলেন্দ্রকে পেলে তোর মায়ের রোগ সেরে যেত। বাবার দেওয়া টাকায় ছোট করে ব্যবসা খুলল ছোটকাকা। মা মরার এক বছর যেতে না যেতে বিয়ে করল। 

—হে ভগবান! 

—মাকে তো ভালবাসত না। মা’র শরীরটা চাইত কেবল। বেশিরভাগ পুরুষই তো তাই। প্রেমিক হওয়ার ভান করে। কিন্তু আসলে কেবল শরীর-শরীর খেলোয়াড়। মা বোকা। যতজনের সঙ্গে শুয়েছিল, ভেবেছিল সবাই মায়ের প্রেমিক। সত্যিকারের প্রেমিক যে ছিল মায়ের, আমার বাবা, তাকে মা চিনতেই পারল না। প্রেম-প্রেম করে মানুষটা শেষ হয়ে গেল চোখের সামনে। কাকা আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। শীতলকাকা কিন্তু আসত। বাবার সঙ্গে দু’-চারটি কথা বলেই আমার কাছে আসত। জড়িয়ে ধরত। আদর করত আমাকে। বলত, তোকে দেখলে শর্বরীকে মনে পড়ে। আমি সব বুঝতাম। আমি জানি আমি মায়ের মতো দেখতে নই। বাবার মতো। সাদামাটা। বিশেষত্বহীন। কিন্তু বাবার যা ছিল না তা তো আমার ছিল। এই শরীর। আসলে শীতলকাকু আমার শরীর চাইত। আমিও দিতাম। ওই বয়সে শরীরে পুরুষের ছোঁয়া যে কী মাতাল করে দেয়! 

—ছিঃ! 

—কীসের ছিঃ! শীতলকাকুই আমার নথ ভেঙেছিল। 

—ছি বুড়িয়া! 

—খারাপ লাগছে? নথ ভাঙায় বেশ্যারা? না? 

—আর না। বুড়িয়া। আর না। 

—একদিনে কি হয়? রোজ অল্প অল্প করে চেষ্টা করত যাতে আমার ব্যথা কম লাগে। ছোট থেকে দেখছিল। লোকটার একরকম স্নেহ ছিল আমার ওপর। কখনও পাশব হয়ে ওঠেনি। একদিন আমিই ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আঁচড়ে কামড়ে দিলাম। বললাম আজ চাই-ই। হল। কী রক্তপাত! ওঃ দুলেন্দ্র! আপনি থাকলে সে-রক্ত গায়ে-মুখে মাখতেন। 

—ওঃ বুড়িয়া! 

—এবার আমি শীতলকাকুকে বললাম, কাকে করে বেশি আনন্দ কাকু? আমাকে না মা-কে? কাকু আমার গায়ের ওপর পড়ে ছিল। উঠে দাঁড়াল। কী রকম বোকার মতো তাকাল আমার দিকে। চলে গেল। আর এল না। সহজ সত্য খুব ধারাল হয় তো, সকলে তার প্রকাশ সইতে পারে না। 

—কী ভয়ংকর! আমি সহ্য করতে পারছি না বুড়িয়া। আপনি আর কথা বলবেন না। আপনি দুর্বল। অসুস্থ। এইসব শুনে আমার কী হবে? 

—ওই শুরু হল। পুরুষের জন্য ভেতরটা হাঁকপাক করে। প্রেমে পড়ি। সর্বস্ব দিই। আবার সব ধুয়ে-মুছে ফেলি। মায়ের মতো। অবিকল মায়ের মতো। মাঝে মাঝে গুনতাম ক’জন হল। তেরোজন ছাড়াতেই হবে আমাকে। কোনও মেয়ে যদি চায় পুরুষের সংখ্যা বাড়াতে, তা হলে সহজেই পারে। এই করে আঠারো বছর হয়ে গেল। বাবাকে বললাম শান্তিনিকেতনে পড়তে যাব। বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। একদিন কীসব কাগজপত্র সই-সাবুদ করালেন আমায়। আমি শান্তিনিকেতনে এলাম। গান পারি। ছবি পারি। নাচ পারি। পরীক্ষার ফলও, এতকিছুর মধ্যেও ভাল। পড়তে লাগলাম। ছবি আঁকা শিখছি। দুলু বাউলের প্রতি সেই আকর্ষণ ফিকে হয়ে এসেছিল। ছোটবেলার সংকল্পের কথাও আর মনে ছিল না। কিন্তু বাউলের টান এড়াতে পারিনি। ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন আখড়ায় যেতাম। গান শুনতাম। কত প্রেম হল। কত প্রেমিক এল গেল। কতবার ঘোর এল। ঘোর ভাঙল। এক-একজনকে মনে হত, এই সে, এই সমুদ্র। পান করলে কোনওদিন ফুরোবে না। কিন্তু চুমুক দিতে না দিতেই শেষ। অখাদ্য অপেয় নোনাজল। পুরুষের মধ্যে তৃপ্তিকর স্বাদ পাওয়া কী যে কঠিন! 

—আহা! আহা! 

—ব্যতিক্রম শুধু একজন। 

–ব্যতিক্রম পেলেন? 

—হ্যাঁ। 

—কে? 

—রিচ। রিচার্ড নারায়ণমূর্তি। 

—বেশ। এ খুব আনন্দের যে একজনকে আপনি পেয়েছেন। তাই দিয়েই তো জীবন কেটে যায় বুড়িয়া। অধিকাংশ মানুষের খুঁজতে খুঁজতে দিন ফুরিয়ে আসে। প্রাণের মানুষের সাক্ষাৎ অবধি পায় না। আপনি ভাগ্যবান। 

—ভাগ্য জানি না। তবে রিচার্ড আমার কাছে বিস্ময়। রিচার্ড আমার অমোঘ। আমার তন্ময়। 

—এই একজন। এর মাধ্যমে নিজেকে পূর্ণ করুন বুড়িয়া। 

—এই একজন। যাকে পান করা দূরের কথা, ছুঁতে অবধি পারলাম না। 

–সে কি খুব দুরের বুড়িয়া? 

—না। সে এত কাছের, এত বেশি করে সে ধরা দেয়, যে তাকে ধরতে পারি না। 

—ওঃ! কিন্তু যাকে ছোঁয়া গেল না, সে পেয় না অপেয় বোঝা গেল কী করে! 

—বিশ্বাস দিয়ে। হৃদয় বিশ্বাসে মিলায়। প্রেমও বিশ্বাসে মিলায়। রিচ আমাকে বিশ্বাস দিয়েছে যে, এখানে এসে তা বুঝলাম আমি। 

—ভাল। তারপর? 

—শান্তিনিকেতনে আসার ছ’মাস পর বাবা চলে গেলেন। একইভাবে। মায়ের মতোই।— আত্মহত্যা! 

—ওই… ওই… 

—হ্যাঁ। ওষুধ খেয়ে। 

—ওঃ! ভগবান! 

—আমাকে চিঠি লিখেছিলেন। মা বুড়িয়া, এতদিন যক্ষের মতো তোর ধন আগলে বসেছিলাম। বয়ঃপ্রাপ্ত না হলে যদি সব তোর ঠকিয়ে নেয়। এ পৃথিবীতে তুই বড় একা রে! পড়বেন সেই চিঠি? আছে। 

—না। বলুন। শুনি। 

—হ্যাঁ, লিখেছিলেন, তুই একা হয়েই জন্মেছিস। কারণ আমি বা তোর মা যে যার নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত রইলাম। আরও আগেই আমার মরা উচিত ছিল। তোর মা যখন আমার সঙ্গে সংযুক্ত অবস্থাতেও দুলেন্দ্র-দুলেন্দ্র করত, তখনই আমার মরা উচিত ছিল। পারিনি। তোর মা-কে ফেলে মরেও আমার শান্তি ছিল না। এখন সে যেখানে আছে, আমিও সেখানেই চললাম। পরপারের বিশ্বাসে বুক বেঁধেছি। 

—কী আশ্চর্য মানুষ! 

—হুঁ! আশ্চর্য! আশ্চর্য প্রেমিক! তাঁর রূপ ছিল না। তাঁর কথায় কবিতার শক্তি ছিল না। চোখে শিল্পীর স্বপ্নাবেশ ছিল না। নিতান্ত সাদামাটা আটপৌরে একটা লোক। কিন্তু লোকটার প্রেমিক-হৃদয় ছিল। দুলেন্দ্র! পৃথিবীতে কিছু মানুষ প্রেমিক হয়েই জন্মায়। বাবা তেমনই ছিলেন। এরপর লিখেছিলেন, আমি দুলেন্দ্রকে খুঁজিনি। তুই-ও খুঁজিস না। জীবন দেবতার অর্ঘ্য। তাকে মালার মতো সযত্নে গেঁথে তুলতে হয়। দুলেন্দ্র ছিল তোর মায়ের জীবনের মরীচিকা। তাকে পরিহার করাই ভাল। তার জন্য আমাদের সব গেল। আশীর্বাদ রইল আমার। তোর জীবন সার্থক হোক। পূৰ্ণ হোক। 

—তাঁকে আমার প্রণাম। 

—যতীন বাউলের ওখানে আপনার কথা শুনতাম। কিন্তু খুঁজিনি আপনাকে। চোখের সামনে আপনাকে দেখে মায়ের কথা মনে পড়ল। ভাবলাম, দেখি, কী এই দুলেন্দ্র। কেমন। মাকে কী দিয়েছিল! বাউলের সাধনপদ্ধতি নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম। দীক্ষার পদ্ধতি সে বইতে লেখা ছিল। মা সহ্য করতে পারেনি। দীক্ষার সময় পালিয়ে গিয়েছিল। আপনাকে দেখে জেদ এল মনে। মনে হল আপনার মাধ্যমেই মায়ের আরব্ধ কাজ শেষ করি। দীক্ষা নিই। কিন্তু পারলাম 

–না। পারলাম না। 

—থাক। থাক। ও কথা থাক। 

—আপনি মাকে কী দিয়েছিলেন দুলেন্দ্র? 

—মানুষ মানুষীকে যা দেয়। 

–আমি তো কই খুঁজে পেলাম না। 

—আমার দুর্ভাগ্য। 

—না। আসলে এক মানুষ অপর মানুষের জন্য নির্দিষ্ট। নির্ধারিত। সেই সঠিক মানুষটার সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত মন তৃপ্ত হয় না। শাস্ত হয় না। আবার সকল মনই যে তৃপ্তি খোঁজে, তা-ও নয়, অতৃপ্তির সাধনাও করে মানুষ। আজ আমার মনে হয় অন্য কথা। 

–কী? 

—মা আপনাকে ভালবাসেনি। মা কারওকে ভালবাসেনি। নিজেকেও না। মা এক তৃষ্ণা নিয়ে এসেছিল। সে তৃষ্ণা মেটবার নয়। আপনাকে খুঁজে পেলেও মা সারত না। 

—কে জানে! 

—মাকে না পেয়ে আপনি এতগুলো বছর একা কাটিয়ে দিলেন। মা কি এতখানিই ছিল আপনার? 

—না। মিথ্যে বলব না। সে চলে যাওয়ায় আমার পাগলের দশা হয়েছিল। কিন্তু কবে যে সে মরে গিয়েছিল আমার মধ্যে, আমি জানতেও পারিনি। 

—তা-ই হয়। সময়। সময় সব গ্রাস করে। 

—না। বুড়িয়া। সময় ভোলায়। কিন্তু গ্রাস করে না। কোনও কোনও মানুষ তীব্রভাবে বেঁচে থাকে চিরকাল। কিন্তু শর্বরী বেঁচে ছিল না। আমি অন্য মানুষের সন্ধানে ছিলাম। 

— পাননি কেন? 

—পেয়েছিলাম। গুরুর আশীর্বাদ ছিল না। মিলন হল না তাই। 

—ময়না বৈষ্ণবী? 

দুলু বাউল কথা বলে না। চুপ করে থাকে। নীরস মাটি ফাটে নিঃশব্দে। রসহীন প্রস্তর-প্রস্তর সব। পাথর-পাথর। কঙ্কর-কঙ্করময়। 

বুড়িয়া বলে—মা বেঁচে নেই শুনে আপনি কষ্ট পেলেন না! 

—মৃত্যু অনিবার্য 

—নিষ্ঠুর আপনি! 

—আমার সে কে? আপনার মা। 

—এত অভিমান? 

—না। সে যদি চাইত, নিজেই আমার কাছে ফিরে আসতে পারত। তার স্বামীকে অনুরোধ করতে হত না। সে-ও সর্বাংশে আমাকে ত্যাগ করেছিল। শর্বরীর অশান্ত জীবনের জন্য আমি কষ্ট পেলাম। 

—তার জন্য আপনি দায়ী নন? 

—না। 

— হ্যাঁ। দায়ী। 

—কীভাবে? 

—আপনি জানতেন দীক্ষাপদ্ধতি। কেমন পুরুষ আপনি? নিজের নারীকে অন্য পুরুষের সঙ্গে সঙ্গম করতে পাঠান? 

—আমি পাঠাবার কে? সে তো স্বাধীন ছিল। 

—আপনার বাধা দেওয়া উচিত ছিল। পুরুষ হলে আপনি দিতেন। 

—না। সে তার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আপনার মতোই। আমি তো তাকে পাঠাইনি। যেমন আপনাকেও পাঠাইনি। আমি পাঠাবার কেউ না। বারণ করারও কেউ না। মানুষ স্বাধীন। তার ইচ্ছা স্বাধীন। আর এ তো দীক্ষাপদ্ধতি। এমনিতে অন্য পুরুষের কাছে গেলেও আমি বাধা দিতাম না। 

—কেন? কেন? আপনাকে আমি বুঝি না। বাবাকে বুঝিনি। নারায়ণমূর্তিকে বুঝি না। আপনারা জোর করতে পারেন না কেন? 

—মানুষ বলে। মানুষ বলে মানুষকে জোর করি না। জোর করে আর সব মেলে, প্রেম মেলে না বুড়িয়া 

—অনেকসময় যে মন জোরও চায়। মুক্তিও যে চায় বন্ধন। আপনারা বোঝেন না? 

—বুঝি। কিন্তু প্রশ্রয় দিই না। কারণ সেই বন্ধন শুধু রুচি পরিবর্তন। আর কিছু নয়। মানুষকে মহৎ হতে হয়, জোর করার মধ্যে মহত্ত্ব নেই। মন যা পায় তাকে অস্বীকার করে বসে। মুক্তি পেলে ভাবে অবহেলা। স্বাধীনতা পেলে ভাবে শৃঙ্খলেই ছিল ধারক। এগুলি ভ্রমমাত্র। যে এই ভ্রমকে বোঝে, সে বন্ধনের ভুল করে না। তোমার পিতা প্রণম্য। রিচার্ড প্রণম্য। 

—কাল আমি চলে যাব। আপনার দুঃখ হচ্ছে না? 

—জানি না। হয়তো হবে। 

—আমাকে ক্ষমা করেছেন? 

—আপনার অপরাধ নেই কোনও। ক্ষমা কীসের। কথা শুধু একটাই। 

—কী? 

—আমাকে পাপের ভাগী কেন করলেন! 

—কীসের পাপ? 

—শর্বরীর প্রেমিক ছিলাম আমি। তার মধ্যে আমার প্রথম নারীলাভ। আপনি আমার কন্যাসমা। আপনাতে আমি গমন করেছি। এ তো পাপ! 

—শর্বরী আপনার কাছে মৃত ছিল। 

—তাতে কী? 

—আমি কোনও বন্ধন মানি না। শীতলকাকু….. 

—আমার তো দেহলোভ ছিল না। কামুক পুরুষের মতো আপনার দেহ আকাঙ্ক্ষা করিনি আমি। ওই লোকের সঙ্গে আপনি আমার তুলনা করেছেন। 

—আমি আর মা দুটি আলাদা মানুষ। আমার কোনও পাপবোধ নেই। 

—আমার আছে। কিছু সম্পর্ক নিষিদ্ধ করে তাকে মাড়িয়ে এসেছে সভ্যতা। আমি তাকে সম্মান করি। যে দীক্ষা-পদ্ধতি দেখে আপনাদের বিবমিষা আসে, তা কি খুবই অসুন্দর? আপনারা যে-সমাজে, যে-জীবনযাপন করছেন, তার চেয়ে অসুন্দর কি? ভেবে দেখবেন। 

মোরগ ডেকে উঠল কোথাও। দুলু বাউল উঠে জল খেল। বলল—কাল আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসব আমি। 

—আমি একা যেতে পারব। 

—জানি। কিন্তু যতীনের বাড়ি অবধি আমি দিয়ে আসব আপনাকে। ওখান থেকে আপনি আমার সঙ্গে এসেছিলেন। আপনি অন্য কোথাও চলে গেলে আমি দায়ভাগী হব যে। 

.

জাহিরার গলা পাওয়া গেল তখন—ওগো, তোমরা এসো গো। এ যে নড়ে না। দেহ ঠান্ডা। ওগো… 

ছুটে গেল দুলু বাউল। জসিম বাউল আর পারুলবালা এল। কিন্তু বুড়িয়া এল না। কেন যাবে! এরা তার কে! 

গণিমিঞার গায়ে হাত রাখল দুলুক্ষ্যাপা। ঠান্ডা। বুকে কান পাতল সে। স্তব্ধ। নাকের কাছে হাত নিল। নেই শ্বসনক্রিয়া। সে বলল—ইহ সাঙ্গ করেছে বাউল। 

ডুকরে কেঁদে উঠল জাহিরা। পারুলবালা জাহিরাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *