2 of 3

রাজপাট – ৫১

৫১ 

জ্যৈষ্ঠে রসাল-রস 
সবে পান করে। 
বিরস আমার হিয়া 
পিয়া নাই ঘরে। 

.

সে এক ঘোরের মধ্যে শুয়ে আছে। কপাল তপ্ত। শরীর তপ্ত। মাঝে মাঝে অস্ফুট শব্দ করছে। কিছু বলতে চায় যেন। দুলুক্ষ্যাপা তার শিয়রে জেগে বসে আছে। সে বিষণ্ণ। বিমর্ষ। তার আশঙ্কাই সত্য হল শেষ পর্যন্ত। রাত্রি গড়িয়ে চলেছে। আখড়ার চালে খসে পড়ছে আম-কাঁঠালের পাতা। কয়েকটি বাঁশগাছ রয়েছে পিছনের দিকে। বাঁশের পাতায় পাতায় হাওয়া লেগে শব্দ হচ্ছে খস্ খস্। দুলুক্ষ্যাপার চোখে ঘুম নেই। তার মনে হচ্ছে, এ জীবনের মতো তার ঘুম ফুরল। আর কখনও দু’চোখের পাতা বুজবে না। সে আলতো হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বুড়িয়ার মাথায়। দু’চোখ উপচে জল আসছে চোখে। কী এক আবেগের বশে মেয়েটা এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল! কেন এত জোর করল সে নিজের ওপর? নিজেকে অপরাধী লাগছিল দুলুক্ষ্যাপার।— অতটুকু মেয়েকে সে প্রশ্রয় দিল কেন? 

মহাকালের গর্ভে এমন ঘটনা যেন তার সঙ্গেই ঘটবে বলে এতকাল অপেক্ষমাণ ছিল। এত কষ্ট কেন! জগৎজোড়া এমন ধাঁধায় পড়া কেন! কোনও প্রশ্নেরই জবাব কোথাও মেলে না। তার জীবনে কি নারী অসহ? নারী অভিশাপ? শর্বরী এসেছিল মধুবাতা হয়ে। ক্ষণিক বসন্তের মতোই সে সকল স্বাদ দিতে না-দিতেই মিলিয়ে গিয়েছিল। ময়না বৈষ্ণবীর ছিল স্নেহ-সিক্ত মাধুর্য। কিন্তু সে যে ধরাই দিল না। আর এই মেয়ে এসেছে প্রলাপের মতো। আজ সকল ছাপিয়ে চিরবান্ধবের মতো ময়না বৈষ্ণবীকেই মনে পড়ছে তার। ‘হায় বৈষ্ণবী! তুমি কোথা গেলে? কোন সে অধরা লোকে? তুমি গেলে বলেই আমি বিভ্রান্ত হলাম। একলা হৃদয়ে, পথে পথে খুঁজে ফিরতাম যাকে, যে চিরজীবনের সঙ্গিনী—সে তুমি ছিলে, তুমি। তোমাকে দেহে পাইনি, মনে পেয়েছিলাম। কিংবা মনেও পাইনি। চিত্তে ছিলে তুমি। হতে পারে, এ-ও আমার ভুল। তুমি ছিলে আমার বিশ্বাসে। বিশ্বাসে অধিষ্ঠাত্রী তুমি। আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।’ বুক ভরে শ্বাস নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে শ্বাস মোচন করল সে। যে কখনও ধরা দিল না, সেই সকল ধরা হয়ে রইল! 

মহম্মদ সাঁই গুরুজি ক্ষুব্ধ হয়েছেন তার ওপর। কেন না এই তিন মাসে সে বুড়িয়ার হৃদয় বুঝতে পারেনি। কাঙ্ক্ষার নাগাল পায়নি। এক চরম শূন্যবোধ তার হৃদয়ে বিরাজে। হায়! এবার সে কী করবে! 

এত কিছুর পরেও বুড়িয়ার ওপর রাগ হচ্ছে না তার। বুড়িয়া নামের মেয়েটিকে অভিযুক্ত করছে না সে। সে তো চেষ্টা করেছিল। মানুষের প্রয়াসকে মূল্য দিতে হয়। পূর্বজীবনের শিক্ষা, সংস্কার ঝেড়ে ফেলা সহজ নয়। সকলে পারে না। তার প্রশ্ন শুধু, সে নিজের ওপর এত জোর করেছিল কেন? কেউ তো তাকে বাধ্য করত না! এমনকী দুলু বাউলের প্রতিও নেই তার এমন তীব্র প্রেম যা দুলু বাউলের চিরসঙ্গ লাভের জন্য এই সমস্তই করতে তাকে প্ররোচিত করবে। 

মহম্মদ সাঁইয়ের চোখ মনে পড়ছে তার। সে-চোখ অগ্নিগোলক হয়ে উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন—তোরা বাউলদিগের কলঙ্ক। শিক্ষা! শিক্ষার গুমোর! এটা সংস্কার নয়? শিক্ষার সংস্কার নয়? 

সে কোনও কথা বলেনি। বুড়িয়াকে কাপড়ে জড়িয়ে ঘরে তুলে এনেছিল। কী হালকা শরীর! কী অসহায়! বাবা নেই, মা নেই। মেয়েটা কি তাই এমন পাগল পাগল হয়ে ঘুরে বেড়ায়? সে বুড়িয়ার বমি ইত্যাদি ময়লা পরিষ্কার করে দিয়ে এসেছিল। বুড়িয়াকে পরিয়ে দিয়েছিল তুলোর আড়াল লাগানো প্যান্টি। মহম্মদ সাঁই বলেছিলেন—নিয়ে যা, ওই অবস্তু আমার সামনা হতে নিয়ে যা। 

দীর্ঘশ্বাস ফেলল দুলুক্ষ্যাপা। কেন অবস্তু? দুলুক্ষ্যাপা জানে না। স্বাস্থ্যবিধি সম্মত এই প্রক্রিয়া। একে না মেনে নেবার কী আছে? মেয়েরা এসময় যে পুরনো কাপড় ব্যবহার করে, ধুয়ে মেলে দেয় গৃহের কানাচে, তাতে রক্তের ছোপ লেগে থাকে, কীট-পতঙ্গ হেঁটে চলে যায় সে কাপড়ে। তার চেয়ে অনেক পরিচ্ছন্ন এই ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া তুলোরাশি। কিন্তু দুলুক্ষ্যাপা তর্ক করেনি। কাল সকালেও জেগে না উঠলে বুড়িয়ার জন্য ডাক্তার আনতে হবে হরিহরপাড়া থেকে। এখানকার বেদে-বউদের ডাকা যায়। তারা গাছ-গাছালির চিকিৎসা করে। কোনও উপায় করতেও পারে হয়তো। 

সে এ ঘরে চলে আসার পরও বাউলদের আচার-অনুষ্ঠান থেমে থাকেনি। অনেকক্ষণ নানা কর্মকাণ্ড চলেছে। বাউল দম্পতিরা গুরুর সম্মুখে অভ্যাস করেছে বিবিধ সংযম মুদ্ৰা। শ্বসন পদ্ধতি। গাঁয়ের লোকের চোখ এড়িয়ে জব্বার মণ্ডল এসেছে। তার বিবিও এসেছে সঙ্গে। কাল আসবে সুলেমান মণ্ডল। ঘর ফেলে, সন্তানদের ফেলে দুই ভাই একই দিনে আসতে পারেনি। 

দুলুক্ষ্যাপা বুড়িয়ার পায়ে হাত দিল। পা ঠান্ডা নয়, এই যা ভরসা। দূরে কোথায় শেয়াল ডাকছে। পাঁচ বৎসর আগেও অনেক বেশি শোনা যেত এই ডাক। পাশের ঘরে গণিমিঞা কাশছে। জাহিরাও নিশ্চিতই আছে গণিমিঞার পাশে। আজ সে কী করে থাকবে গুরু সন্নিকটে? অন্যরা গুরু ও গুরুমাকে মাঝখানে রেখে চক্রাকারে ঘিরে শুয়েছে। এমনই নিয়ম। 

বুড়িয়া আবার অস্ফুটে কথা বলল। দুলুক্ষ্যাপা কান পাতল তার কথা বোঝার জন্য। কিছু বুঝল, কিছু হারিয়ে গেল। আমি… আমি পারিনি মা… মা… 

দুলুক্ষ্যাপা বড় স্নেহ বোধ করল মেয়েটির প্রতি। এক খেয়ালি, অগোছাল মেয়ে। কেমন বেসামাল। গুছিয়ে, গম্ভীর করে জ্ঞানের বাক্য বলে। আসলে সে এক আবেগপ্রবণ মেয়ে। হায়! এ মেয়েকে কে দেখবে, কে আড়াল দেবে এই শক্ত দুনিয়ায়? তার ইচ্ছে করল, বুড়িয়াকে বুকে তুলে নেয়। তাকে পিতৃস্নেহে আগলে রাখে সারাজীবন। তার ভাল-মন্দ বলে দেয়। কিন্তু এ মেয়ে ঝড়ের বাতাসের মতো। শাসন মানতে জানে না। ভুল-ত্রুটি, ভাল-মন্দের ধার ধারে না। অভিভাবকত্ব ঘৃণা করে সে। দুলুক্ষ্যাপার মনে আছে, সে বলেছিল, আই হেট গার্জিয়ানস। বুড়িয়ার সঙ্গে দেখা হওয়ার দিনগুলি ভাবতে থাকল সে। বুড়িয়া আবার অস্ফুটে কিছু বলল। শোনার জন্য তার মুখের কাছে মুখ আনল দুলুক্ষ্যাপা। 

তখনই শব্দ পেল সে। কথার শব্দ। পায়ের শব্দ। অনেকগুলি মানুষ যেন চলাফেরা করছে। যেন তারা নৈঃশব্দ্য বজায় রাখতে চায়। সে উঠল। দাঁড়াল জানালায়। তার অনুমান সত্য, আখড়ার বাইরে অনেকগুলি লোক এসে দাঁড়িয়েছে। কেন এসেছে? বাউলের প্রতি আক্রোশ ও আক্রমণের কথা শোনা যায় এখানে-ওখানে। কিন্তু এ গ্রামে তেমন কিছু ঘটেনি। তবে? সে দ্রুত ভাবতে থাকল। বাউলের আখড়া সম্বন্ধে গাঁয়ের কোনও ঔৎসুক্য কখনও বোঝা যায়নি। গুরু এর আগেও এসেছেন। বুড়িয়াও এমনকী বিশেষ কোনও আকর্ষণ রচনা করেনি। তাহলে কী? কী সেই নতুন জিজ্ঞাসা যা মানুষকে চুপিসাড়ে জড়ো করে আখড়ার বাইরে? 

হঠাৎ দুলু বাউলের মনে হল, গ্রামের লোক কি জানতে পেরে গেল জব্বার মণ্ডল এখানে চর্চা করতে আসে? সে দ্রুত গেল ও-ঘরের দরজায়। দরজা বন্ধ করা যায়নি লোক বাহুল্যে। সে চাপা গলায় ডাকল —জব্বারভাই। জব্বারভাই! 

ধড়মড় করে উঠে বসল জব্বার। জেগে উঠেছে আরও দু-একজন। বাইরে সাড়া উঠছে তখন—বাবাজিরা দরজা খোলো। জসিমভাই, দরজা খোলো। দরজা খোলো। 

বিবির হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়েছে জব্বার। কী হবে! লোক জানতে পারলে তাকে সমাজে মেনে নেবে না। দুলু বাউল বলছে—ভেবো না। পালাও 

—কোথায়? কোথায়? 

—পেছনদিক দিয়ে বেরিয়ে যাও ভাই। নদীর পাড় ধরে যাও। সোজা ঘরে যেয়ো। 

—ঘরে? 

—হ্যাঁ-হ্যাঁ। 

ভাববার সময় নেই এখন। ধরা পড়ার ভয়ে ফেটে পড়তে চাইছে হৃৎপিণ্ড। জসিম বাউল জব্বার ও তার বিবিকে সঙ্গে নিয়ে আম-কাঁঠাল গাছের ঝুপসি অন্ধকার পার করে দিল। দুলু বাউল গেল দরজায়। 

দরজা খুলতেই একটি টর্চের আলো এসে পড়ল তার মুখের ওপর। সে দু’ হাতে মুখ আড়াল করল। একজন বলল, জব্বার মণ্ডল কোথায়? তাকে ডাকো। 

আখড়া জেগে উঠেছে। জসিম বাউল এসে দাঁড়িয়েছে দুলুক্ষ্যাপার পাশে। দুলুক্ষ্যাপা জোড়হাত করছে। বিনীতভাবে বলছে—এখানে তো জব্বার মণ্ডল নাই বাবা। 

–নাই বাবা। বললেই হল! আমরা পুরো বাড়ি দেখব। 

–আগুন দিয়ে দে চালে। সব বেরবে। কেরাসিন কই? কেরাসিন? 

–মার লাগা শালা। সব বলবে। 

একজন বলে—এই, মারামারি না। মোহনদা বলে দিয়েছে, কোনও গোলমাল যেন না হয়। বাবাজি, আপনাদের সঙ্গে আমাদের কিছু নেই। আমরা শুধু জব্বার মণ্ডলকে চাই। তাকে বের করুন। 

দুলুক্ষ্যাপা সময় কাটাতে চাইছিল। বলল—সে তো এখানে আসেনি। আপনারা তার বাড়িতে খোঁজ করে দেখুন। 

একজন বলল-এঃ হে! বাড়িতে আগে দেখলেই হত। 

—আরে বাড়িতে নেই মানে যে এখানে আছে তা প্রমাণ হত কী করে। এখানেই ওকে হাতেনাতে ধরব আমরা। শালার ঘোমটার আড়ালে খেমটা নাচন বার করছি। 

—এখানেই আছে। আখড়া সার্চ কর। 

—চল শালা। ঢোক। এই চল। চল। 

দুলুক্ষ্যাপা হাতজোড় করল আবার। বলল—বাবারা, আমাদের গুরুদেব আর গুরুমা এসেছেন। তাঁরা বৃদ্ধ মানুষ। অন্যান্য গুরুভাইরাও দূর দেশ থেকে এসেছেন। তাঁরা পরিশ্রান্ত। তা ছাড়া ঘরে দু-দুটো রোগী মানুষ। আমরা মিছে বলব কেন? 

—আমরা ঘর দেখতে চাই। 

দুলুক্ষ্যাপা বলে—দু’জন আসেন দয়া করে। দেখে যান। 

—কে যাবে? কে যাবে? 

—নইম তুই যা। 

—সমির যা। 

—হ্যাঁ হ্যাঁ। নইম আর সমির যাক। 

তারা দরজা ছেড়ে দেয়। নইমুদ্দিন ও সমিরুদ্দিন আখড়ায় প্রবেশ করে। জসিম বাউল তাদের পথ দেখায়। তারা ঘুরে ঘুরে দেখে সব। আঙিনা দেখে। ঘর দেখে। আম-কাঁঠালের তলায় ঝুপসি অন্ধকার চিরে দেখে। কিন্তু জব্বার মণ্ডলকে খুঁজে পায় না। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তারা। ওদিকে জব্বার মণ্ডল বিবির হাত ধরে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়য়। নদীপাড়ের কাদায় পা ডুবে যায়। পাথরে হোঁচট লাগে। প্রতি মুহূর্তে ভয় হয়, এই বুঝি এক দল লোকের মুখোমুখি হবে তারা। তাদের হৃদপিণ্ড ধক ধক করে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। হাঁপাতে হাঁপাতে তারা ছোটে। কেবল ছোটে। মনে হয়, এই গ্রাম কত বড়। পথ কত দীর্ঘ। তারা যেন এভাবেই অনন্তকাল ছুটতে থাকবে তাড়া খাওয়া অন্ধকারে। ধরা পড়লেই তাদের নিয়ে যাওয়া হবে বধ্যভূমিতে। অতএব প্রাণ ওষ্ঠে তুলে তারা দৌড়তে থাকে। চোখে বিভ্রম জাগে তাদের। গাছকে মনে হয় লোক। অন্ধকারে মনে হয় কারা নড়াচড়া করছে! জব্বারের বিবি বলে – মিঞা, আর পারি না। খানিক তিষ্ঠাও। 

জব্বার হিসহিস করে ধমকায়—চুপ করো! একদম চুপ। ঘরে গিয়া দম নিবা। 

অবশেষে তারা আপন দরজায় পৌঁছয়। ডাকবে যে দরজা খোলার জন্য, সে শক্তি নেই। জব্বারের বিবি পেট চেপে আঙিনায় বসে পড়ে। জব্বার মণ্ডল দরজায় দ্রুত টোকা দেয়। পিছু ফিরে দেখে। মনে হয়, দলে দলে লোক তাদের তাড়া করে আসছে। সে চাপা স্বরে ডাকে— সুলেমান, সুলেমান। দরজা খোল সুলেমান। 

সুলেমান ঘুম চোখে দরজা খুলে দেয়। জব্বার মণ্ডল বিবিকে হিঁচড়ে টেনে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। কোনওক্রমে বলে—জল! 

সুলেমান জল দেয় তাদের। ঘরের আলো জ্বালতে চায়। জব্বার মণ্ডল নিষেধ করে তাকে— আলো জ্বালিস না। শুয়ে পড়। আমরা বোধ হয় ধরা পড়ে গেলাম সুলেমান। 

—কী করে? 

জব্বার মণ্ডল সংক্ষেপে বলে যায় সব। সুলেমান বলে—কেউ দেখেনি তো তোমাদের?

—বোধহয় না। 

—তা হলে কী করে ধরা পড়লাম। 

—লোক অত সহজে ছাড়বে না। আমাদের গুনাহগার দিতে হবে রে ভাই। 

সারারাত ঘুম হল না তাদের। জেগে জেগেই তারা শুনতে পেল মসজিদ থেকে ভেসে আসা আজান ধ্বনি। আজ শুক্রবার। তাদের মসজিদে যাবার কথা। ফজরের নামাজ বাড়িতেই তারা পড়ে নেবে। কিন্তু জোহর বা মগরেবের নামাজ পড়তে একবার মসজিদে যেতে হবে। আজান শুনতে শুনতে জব্বার মণ্ডলের মন শঙ্কায় ভরে যায়। সে কি ভুল করল? বাউল ধর্ম করে সে কি আখেরাতের জন্য পুণ্য জমাতে পারল না! বাউল আখেরাত মানে না। জান্নাত বা জাহান্নাম নিয়ে তার কোনও ভাবনা নেই। কিন্তু জব্বার এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। তার ভয় হয়, বুঝি বদদোয়া লেগে যাবে তার জীবনে। আল্লার রহম পাবে না সে। বরং আল্লার গজব নেমে আসবে তার ওপর। বেহুব মন নিয়ে সে শয্যা ত্যাগ করে। পরিষ্কার হয়ে ওজু করে নেয়। ফজরের নামাজ পড়তে পড়তেও অন্যমনস্ক হয়ে যায় তার মন। নাস্তাপানি করে দু’ভাই তারা মাঠে যায়। কিন্তু সারা গ্রাম জুড়ে স্তব্ধতা জেগে থাকে। সকাল হতে ঘরে ঘরে এই আলোচনা হতে থাকে। জব্বার মণ্ডল, সুলেমান মণ্ডল অন্যায় করেছে। গুনাহ করেছে তারা। বিচার হবে। বিচার হবেই তাদের। অর্জুন সেন অবধি এই আলোচনা পৌঁছয়। কিন্তু তিনি এই আলোচনাচক্র হতে দূরে সরে থাকেন। এ হল ধর্মের ব্যাপার। এখানে তিনি কী বলবেন? এমনকী মোহনলালকেও একবারের জন্যও বাড়ির বাইরে দেখা যায় না। সমিরুদ্দিন, নইমুদ্দিন, কালু শেখের দল গ্রামের পুরুষদিগকে নিয়ে এক সফল দরবার গড়ে তুলেছে বরকত আলির বাড়ি। 

—আপনি প্রধান। আপনি এর বিচার করেন। 

বরকত আলি ক্রুদ্ধ। ক্ষুব্ধ। বাউলের আচরণে সমর্থন নেই তাঁরও। তিনি ভাবছেন, জব্বার তা হলে সমাজ ত্যাগ করতে পারত। এই দ্বিচারিতাই তাঁকে ক্রোধী করছে। তিনি বলছেন— এই বিচারের ভার প্রধানের না। ইমাম সাহেবের। 

–ইমাম সাহেব মসজিদে আছেন। 

—তিনি কি এই বিষয়ে অবগত আছেন? 

—হ্যাঁ, তাঁকে জানানো হয়েছে। 

—কিন্তু আমরা জব্বারকে আখড়ায় পাইনি। সে ঘরেই ছিল। 

–তার পরীক্ষা হবে। 

—কী পরীক্ষা? 

—তাকে গোস্ত খাওয়ানো হবে। বাউল হলে সে গোস্ত খেতে চাইবে না। 

—তা হলে তোমরা ইমাম সাহেবের কাছে যাও ভাই। 

—প্রধানসাহেব আপনিও আমাদের সঙ্গে মসজিদে চলেন। 

—না। 

বরকত আলি নাকচ করে দেন প্রস্তাব। বলেন—আমি প্রধান। আমি এক্ষেত্রে যেতে পারি না। কারণ আমি গেলে রাজনীতির ফয়দা তুলবে অন্যরা। 

—কেউ তুলবে না। আমাদের সঙ্গে সব দলের লোক আছে। দেখেন। কংগ্রেসি আছে। লিগ আছে। সি পি এম আছে। আপনাকে যেতে হবে প্রধান সাহেব। এটা যে-সে ব্যাপার না। এ হল ধর্মাধর্মের ব্যাপার। আপনাকে থাকতে হবে। 

অগত্যা বরকত আলি সঙ্গে যান। ইমাম ফৈজুদ্দিন গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়েছিলেন মসজিদ প্রাঙ্গণে। বরকত আলি বললেন—কী বিধান হবে ইমামসাহেব? 

—আগে গুনাহ প্রমাণ হোক। 

—হ্যাঁ। আগে প্রমাণ হোক। 

নইমুদ্দিন চিৎকার করে—ওদের গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হোক। সমাজের বাইরে আখড়ার পাশে থাকুক ওরা। 

সমিরুদ্দিন বলে—ওদের ঘর জ্বালিয়ে দাও। 

কালু শেখ বলে-ওদের মারো। 

বরকত আলি বলেন—দাঁড়াও। তোমরা এসব বলার কে? বিধান দেবেন ইমামসাহেব। তার আগে দোষ প্রমাণ হোক। ওদের ডেকে আনো। 

দশজন ছুটল জব্বার মণ্ডল ও সুলেমান মণ্ডলকে ডেকে আনতে। আর প্রথমেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল জব্বারের ওপর। মারল চড় ঘুষি। অকথ্য গালাগালি দিল। ধৃত তস্করের মতোই প্রহৃত হল দুই ভাই। এবং তাদের প্রায় পুলিশি প্রহরায় ঘিরে আনা হল সারা পথ। তাদের ফাটা ঠোঁট হতে রক্ত পড়ছে তখন। চোখের তলায় কালশিটে। বড়-সড় চেহারার তেজি জব্বার নুয়ে পড়েছে কেমন। সকলে ঘিরে দাঁড়িয়েছে তাদের। ফৈজুদ্দিন ইমাম ও বরকত আলি প্রধান বসেছেন মসজিদের বাইরে একটি বাঁধানো বটতলায়। সান্ধ্য আড্ডার এ জায়গা। তাঁরা বসেছেন বাঁধান আসনে। মাটিতে বসেছে জব্বার ও সুলেমান। ইমাম ফৈজুদ্দিন বলছেন—জব্বার, সুলেমান। তোমাদের নামে অভিযোগ আছে, তোমরা গোপনে বাউলচর্চা কর। এ কথা কি সত্যি? 

জব্বার ও সুলেমান নীরব হয়ে থাকে। রুষ্ট শব্দ করে জনতা। 

ইমাম সাহেব আবার বলেন— কবুল করো তোমরা। 

তারা কাঠ হয়ে বসে থাকে। ইমামসাহেব বলেন—বেশ। কই রে—

দু’বাটি গোস্ত আসে তখন। অপূর্ব সুগন্ধ সেই রান্নার। গন্ধে উপস্থিত জনতার রসনা সিক্ত হয়ে ওঠে। বাটি দু’খানি দুই ভাইয়ের সামনে রাখা হয়। ইমামসাহেব আদেশ করেন—খাও। 

তারা হাত বাড়ায় না। 

—খাও। 

সুলেমান কেঁদে ফেলে। 

—খাও। 

ডুকরে ওঠে জব্বার মণ্ডল—পারব না খেতে। পারব না। মন্ত্র নিয়েছি আমরা ইমামসাহেব। বাউল মন্ত্র দীক্ষা নিয়েছি আমরা। 

গর্জে ওঠেন ইমামসাহেব। গর্জে ওঠে জনতা। 

—গাঁয়ে চলবে না এসব। শোনো তোমরা। শুনে রাখো। কী চাও তা বলো। যে-কোনও একটা সমাজ বেছে নাও। হয় বাউলের সঙ্গে থাকো, নয় আমাদের। দু’নৌকোয় পা দেওয়া চলবে না। 

জনতা বলে—গ্রাম ছাড়তে হবে, গ্রাম ছাড়তে হবে, মার, মার। 

বরকত আলি হাত তোলেন—চুপ কর সব। চুপ কর। জব্বার, তুমি এটা ঠিক করো নাই। বাউলের বিশ্বাস, আমাদের বিশ্বাস মিলে না। তুমি আমাদের ঠকিয়েছ। এখন বলো কী চাও। কোন সমাজ? 

জব্বার মণ্ডল ইমামসাহেবের পা জড়িয়ে ধরে। ডুকরে বলে—গ্রাম ছেড়ে কোথায় যাব আমরা? এ সমাজেই থাকতে দেন আমাদের। যা বিধান দেবেন, মেনে নেব। 

—খাও।

—জি? 

—খাও। 

দু’ভাই দুটি বাটি তুলে নেয়। দ্রুত খেতে থাকে সুস্বাদু রান্না। জনতা সোল্লাসে চিৎকার করে। তখন ইমামসাহেব বিধান দেন—মসজিদে তোবা করতে হবে তোমাদের। তোবা করিয়ে তোমাদের শরিয়তে গ্রহণ করা হবে। আর পাঁচহাজার টাকা জরিমানা। মসজিদের উন্নয়ন তহবিলে ওই টাকা দু’ মাসের মধ্যে জমা দেবে। 

জব্বার কাঁদে-অত পারব না। দয়া করেন প্রধান সাহেব। ইমামসাহেব দয়া করেন।

জনতা গর্জায়—দিতে হবে। দিতে হবে। 

নিসার ছিল এই জনতায়। ধীরে ধীরে পিছু হঠল সে। বেরিয়ে এল। বেহুব বিষণ্ণ হয়ে গেল তার মন। সারা গ্রাম কী করে জেনে গেল জব্বার মণ্ডলের কথা? সে তো গাঁয়ের মাত্র একজনকেই এ-সংবাদ দিয়েছিল। সিদ্ধার্থর কথা তার মনে পড়ল। সে বলেছিল, কারও ক্ষতি হতে পারে এমন কাজ কোরো না, এমন খবর দিয়ো না। সে কি জব্বারদের ক্ষতিই করে দিল না? 

সমিরুদ্দিন জব্বারের পাশে দাঁড়িয়ে বলে—দেবে। দেবে। নিশ্চয়ই দেবে। 

জব্বার তার দিকে তাকায়। সমিরুদ্দিন হাসে। জব্বার কবুল করে। দেবে। কোথা থেকে দেবে জানে না। হয়তো জমি বেচতে হবে। গোরু বেচতে হবে। কিন্তু ভিটে ফেলে, আবাদি ভূমি সন্তান-সন্ততিসহ ফেলে তারা যেত কোথায়? এ ছাড়া যে আর উপায় নেই। 

জনতা রব তোলে—ওই আখড়াই যত নষ্টের মূল।

ভাঙ ওকে। 

পুড়িয়ে দে। 

নষ্ট কর। 

মার বাউল ব্যাটাদের। 

মার। মার। মার। 

বিচার শেষ। দোষী দোষ কবুল করেছে। উপযুক্ত শাস্তি মিলেছে তার। যতক্ষণ ধরে এই রগড় চলবে বলে ভাবা হচ্ছিল, চলল তার চেয়ে অনেক কম সময়। এখানে আর মজা নেই। জনতা উন্মত্ত হয়ে আখড়ার দিকে যেতে থাকে। সমিরুদ্দিন চিৎকার করে—না। কেউ যাবে না আখড়ায়। কেউ না। 

জনতা তার কথা শোনে না। আপন মর্জিতে আপনার মতো এগোয়। সমিরুদ্দিন না বলার কে, হ্যাঁ বলারই বা কে! তারা জনতা, তারা শক্তি। তারা যা ন্যায্য মনে করবে, তা-ই ঘটাবে। এখন তারা আগুন চাইতে পারে, রক্ত চাইতে পারে, বলাৎকার চাইতে পারে, প্রাণ চাইতে পারে। ঘটনার গতি এখন তাদের হাতে। তারা হাঁটে, লাফায়, ঘঁষি পাকায় হাতে। সমিরুদ্দিন, মাতিন শেখ, কালু শেখ দৌড়ে যায় মোহনলালের বাড়ি। মোহনলাল নেই। বিব্রত বোধ করে তারা। মোহনলাল বলেছিল আখড়ার যেন কোনও ক্ষতি না হয়। তারা উন্মত্ত জনতার পিছনে ছোটে। এবং আখড়ার নিকটে গিয়ে সকলের সঙ্গেই থমকে দাঁড়ায়। আখড়ার সামনে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন পুলিশ। মোহনলাল কথা বলছে দুলু বাউল ও জসিম বাউলের সঙ্গে। পুলিশ দেখে, মোহনলালকে দেখে জনতার দম ফুরিয়ে যায়। পিছু হটে তারা। কে আগে ফিরে যাবে, তা নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। মোহনলাল কথা বলে আর খোঁজে চারপাশ। সে নেই? সে নেই? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *